সউদ আহমেদ খান
কৃষি বাংলাদেশের অন্যতম অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি। যা দেশের খাদ্যনিরাপত্তা ও জনস্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষির অবদান প্রায় ১৪.১০ শতাংশ। ২০২০ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশের শতকরা ৪০ ভাগ জনগোষ্ঠী কৃষি পেশাজীবী। গ্রামের শতকরা ৮৩.৩৭ ভাগ কৃষির উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশে প্রায় ১,৫১,৮৩,৩৮৩ পরিবার সরাসরি কৃষি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সভ্যতার বিকাশ, জনসংখ্যার অতিরিক্ত চাপ, অবকাঠামোগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে কৃষি জমি কমছে। ফসল উৎপাদন চাহিদা অনুযায়ী বাড়ছে না। বাংলাদেশের বছরে ২.২ মিলিয়ন অতিরিক্ত লোকের জন্য ৩ লাখ টন অতিরিক্ত খাদ্য প্রয়োজন।
আবার, ন্যায্য পাওনা ও ফসল উৎপাদনের খরচ, কৃষি ব্যতিত অন্য কাজ করার সুযোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ততা কমছে। ২০০৩-০৪ সালে কৃষকের প্রাপ্ততা ৫১.৭০ থেকে কমে ২০১৮-১৯ সালে ৪০.২০ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০৩০ সালে এই প্রাপ্ততা ৩০ শতাংশে নেমে আসবে।
কৃষি হাবের ধারণটা বাংলাদেশে নতুন হলেও বহির্বিশ্বে অনেক পরিচিত শব্দ। কৃষি হাব সমন্বিত চাষাবাদ ও বিপণন ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পর্কিত, যা কৃষকের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে সহায়তা করে। কৃষি হাব স্থাপত্যরীতি ও কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষি উন্নয়নের শূন্যস্থান পূরণ করতে সহযোগিতা করে। এটি অনেক লাভজনক ব্যবসা পদ্ধতি এবং ব্যবহারকারীদের আয় বৃদ্ধি করে। একটি কৃষি হাব হচ্ছে ফসল উৎপাদন এলাকা এবং পরিবহনগত অবকাঠামো। একটি কৃষি হাব সাধারণত ৫০০-১০০০ কৃষককে পরিসেবা দেয় এবং তাদের ১০-২০ জন ছোট/বড় ব্যবসায়ীর সঙ্গে কিংবা প্রক্রিয়াজাতকারী এবং রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযুক্ত করে। কৃষি হাবগুলোর মালিকানা থাকবে প্রান্তিক উদ্যোক্তা, কৃষিপণ্য বিক্রেতা কিংবা সমবায় কৃষক সমিতির। কৃষকরা তাদের যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রণ, বাণিজ্যিকীকরণ, বাজারমূল্য সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ ও কৃষি অর্থনৈতিক পরামর্শের জন্য বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিবেন। এক্ষেত্রে তারা কৃষি কর্মকর্তার সাহায্য ও নিতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কৃষি বিভাগের (টঝউঅ) মতে, ‘কৃষি হাব হচ্ছে এমন একটি ব্যবসা পদ্ধতি কিংবা সংগঠন যা পাইকারি ও খুচরা সংস্থাগুলোর চাহিদা মেটাতে এবং তাদের সক্ষমতা শক্তিশালী করার জন্য স্থানীয় ও আঞ্চলিক উৎপাদকদের কাছ থেকে খাদ্য পণ্যগুলো সক্রিয়ভাবে একত্রে বিপণন ও বিতরণ পরিচালনা করে।’ কৃষি হাব হচ্ছে এমন একটি কৃষি পদ্ধতি একত্রে তহবিল গঠন, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে একটি দেশের সুশৃঙ্খল উৎপাদন ব্যবস্থায় সাহায্য করে।
এটি একটি ব্যবসা পদ্ধতি যা ছোট উৎপাদক ও পরিবেশকদের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে প্রান্তিক উন্নয়নে সাহায্য করে। কৃষি হাব সরাসরি ভোক্তা/ক্রেতাদের সঙ্গে সমন্বয় করার বিপণন ব্যবস্থা, যাতে মধ্যসত্ত্বভোগকারী ও প্রতারণা লোপ পায়। ভোক্তাদের আস্থা অর্জন ও তাদের বিশুদ্ধ/ টাটকা পণ্য পেতে সাহায্য করে।
কৃষি হাবের মৌলিক উদ্দেশ্য হচ্ছে নতুন কৃষিপদ্ধতি সম্পর্কে ওয়াকিবহল, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং সুপরিকল্পিত তথ্যের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা যা সরবরাহ ব্যবস্থায় অংশগ্রহণকারী সব কৃষক, ভোক্তা, পরিবহন ব্যবস্থার সফল লেনদেন করতে সাহায্য করা। এ পদ্ধতিতে কেন্দ্রীয়ভাবে একটি গুদামঘর কিংবা বাজার তৈরি করতে হবে যাতে ক্রেতাগণ তাদের পণ্য সঠিকভাবে কিনতে পারেন। একটি সুশৃঙ্খলিত পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে যাতে পণ্য নষ্ট না হয়। গুদামগুলোতে মাননিয়ন্ত্রণ সার্ভিসিং থাকবে যেখানে ধোয়া, কাটা, শুকনো করা, বোতলজাত করা, মোড়কজাত করা, লেবেলিং এবং বর্জ্য নিষ্কাষণ ও ব্যবস্থাপনা থাকবে। কৃষি হাবগুলোতে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ফসল উৎপাদিত হবে, যাতে ফসলের দরপতন না হয় এবং কৃষক লোকসানের সম্মুখীন না হয়। কৃষি হাব কৃষকদের কৃষি প্রযুক্তি ও চাষাবাদ এবং কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, মোড়কজাতকরণের প্রশিক্ষণ দিবে। বর্তমানে বাংলাদেশে সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক কৃষি পণ্য ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সিনজেনটা পরীক্ষামূলকভাবে দেশের উত্তর-পশ্চিম দিকের চার জেলা যথাক্রমে রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী ও নাটোরে ১৭টি কৃষি হাব পরিচালনা করছে। ১০০টি গ্রামের প্রায় ৮৫০০ কৃষককে সহায়তা করছে। যার সঙ্গে প্রায় ২৫০ ব্যবসায়ী সংযুক্ত। এই কৃষি হাবগুলোতে ৫টি কৃষি বিপণন প্রতিষ্ঠান এবং প্রায় ৫০ পাইকার সংযুক্ত। এছাড়াও ব্যক্তি উদ্যোগে কিছু কৃষি হাব গড়ে উঠছে। কিন্তু সাংগাঠনিক দূর্বলতায় ও পুঁজির অভাবে সেগুলো মুখ থুবড়ে পড়ছে।
১৯৯৬ বাংলাদেশ সরকার নতুন কৃষি সম্প্রসারণ নীতি প্রয়োগ করেন। নিরাপদ, টেকসই, বহুমূখী ও লাভজনক কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাকে সামনে রেখে ১৯৯৬ সালের নীতিকে সংশোধন ও পরিমার্জন করে ‘কৃষি সম্প্রসারণ নীতি ২০২০’ ঘোষণা করেন। যার অন্যতম লক্ষ্য খাদ্য নিরাপত্তা ও জলবায়ুগত প্রাকৃতিক দুর্যোগ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মাধ্যমে এসডিজি-২০৩০ অর্জন করা। এই কৃষি সম্প্রসারণ নীতি উদ্দেশ্যগুলো হচ্ছে : খাদ্যশস্যসহ বিভিন্ন কৃষি পণ্যের উৎপাদন, উৎপাদনশীলতা এবং কৃসকের আয় বৃদ্ধি, শস্য বহুমূখীকরণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রতিকূল পরিবেশ ও জলবায়ু উপযোগী আধুনিক পরিবেশ বান্ধব কৃষি সম্প্রসারণ, খামার যান্ত্রিকীকরণ, চাহিদাভিত্তিক রপ্তানিমূখী এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ কৃষি শিল্পের প্রসার, কৃষি বাণিজ্যিকীকরণ এবং নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করা, অংশগ্রহণমূলক গবেষণা কাজে সহযোগিতা এবং প্রতিষ্ঠানিক উন্নয়ন ও তথ্য প্রযুক্তিগত প্রযুক্তির বৃদ্ধি, শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে কৃষিতে আগ্রহী ও নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে সহায়তা করা। এই লক্ষ্যে সরকার ২০২০-২০২৪ পর্যন্ত ৩০২০ কোটি টাকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণ করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এই বৃহৎ কর্মকাণ্ডে সরকার অঞ্চলভেদে ৫০-৭০ শতাংশ ভর্তুকিতে কৃষি সরঞ্জাম ক্রয় করতে পারবে। এই প্রকল্পের ভর্তুকি ব্যয় ধরা হয়েছে ৮০ শতাংশ। এই প্রকল্পের লক্ষ্যে সরকার কৃষক উদ্যোক্তা, কৃষি যন্ত্রপাতি কারিগর, প্রশিক্ষণদাতাদের সমন্বয় করতে এবং তাদের আধুনিক চারা উৎপাদন প্রশিক্ষণ, সমন্বিত খামারে বীজ সহায়তা, কৃষি যন্ত্রপাতি পরীক্ষা, প্রশিক্ষণ ভবন নির্মাণ ও সুবিধা বৃদ্ধি, খুচরা ও কাঁচামালের কর হ্রাসের উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু, কৃষি হাব গড়ে তোলা ও এর সমন্বয় সাধনে কার্যত কোন উদ্যোগে চোখে পড়েনি। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে কৃষি হাব গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রান্তিক কৃষকের কৃষিজমি তুলনামূলকভাবে কম। ভর্তুকির পরেও কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয় করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। তাই, তাদের জন্য কৃষি হাবগুলো হবে ‘দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ’ এর মতো। কারণ, কৃষি হাবের মাধ্যমে তাদের একইসঙ্গে উৎপাদন খরচ কমবে, ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত হবে এবং পণ্যে বিক্রিতে মধ্যসত্ত্বকারী লোপ পাবে।
অতএব, সরকারি সহযোগীতার মাধ্যমে কৃষি হাব গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন। তাহলে, বেসরকারি মুনাফা লোভী বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এদেশে কৃষি হাবের মাধ্যমে তাদের দেশে বাংলাদেশি অর্থ নিয়ে যেতে পারবে না। ফলে কৃষি পণ্য উৎপাদনে কৃষক উৎসাহ বৃদ্ধি পাবে এবং আমাদের দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে।
[লেখক : শিক্ষার্থী, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।]
সউদ আহমেদ খান
বৃহস্পতিবার, ২২ এপ্রিল ২০২১
কৃষি বাংলাদেশের অন্যতম অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি। যা দেশের খাদ্যনিরাপত্তা ও জনস্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষির অবদান প্রায় ১৪.১০ শতাংশ। ২০২০ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশের শতকরা ৪০ ভাগ জনগোষ্ঠী কৃষি পেশাজীবী। গ্রামের শতকরা ৮৩.৩৭ ভাগ কৃষির উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশে প্রায় ১,৫১,৮৩,৩৮৩ পরিবার সরাসরি কৃষি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সভ্যতার বিকাশ, জনসংখ্যার অতিরিক্ত চাপ, অবকাঠামোগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে কৃষি জমি কমছে। ফসল উৎপাদন চাহিদা অনুযায়ী বাড়ছে না। বাংলাদেশের বছরে ২.২ মিলিয়ন অতিরিক্ত লোকের জন্য ৩ লাখ টন অতিরিক্ত খাদ্য প্রয়োজন।
আবার, ন্যায্য পাওনা ও ফসল উৎপাদনের খরচ, কৃষি ব্যতিত অন্য কাজ করার সুযোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ততা কমছে। ২০০৩-০৪ সালে কৃষকের প্রাপ্ততা ৫১.৭০ থেকে কমে ২০১৮-১৯ সালে ৪০.২০ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০৩০ সালে এই প্রাপ্ততা ৩০ শতাংশে নেমে আসবে।
কৃষি হাবের ধারণটা বাংলাদেশে নতুন হলেও বহির্বিশ্বে অনেক পরিচিত শব্দ। কৃষি হাব সমন্বিত চাষাবাদ ও বিপণন ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পর্কিত, যা কৃষকের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে সহায়তা করে। কৃষি হাব স্থাপত্যরীতি ও কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষি উন্নয়নের শূন্যস্থান পূরণ করতে সহযোগিতা করে। এটি অনেক লাভজনক ব্যবসা পদ্ধতি এবং ব্যবহারকারীদের আয় বৃদ্ধি করে। একটি কৃষি হাব হচ্ছে ফসল উৎপাদন এলাকা এবং পরিবহনগত অবকাঠামো। একটি কৃষি হাব সাধারণত ৫০০-১০০০ কৃষককে পরিসেবা দেয় এবং তাদের ১০-২০ জন ছোট/বড় ব্যবসায়ীর সঙ্গে কিংবা প্রক্রিয়াজাতকারী এবং রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযুক্ত করে। কৃষি হাবগুলোর মালিকানা থাকবে প্রান্তিক উদ্যোক্তা, কৃষিপণ্য বিক্রেতা কিংবা সমবায় কৃষক সমিতির। কৃষকরা তাদের যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রণ, বাণিজ্যিকীকরণ, বাজারমূল্য সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ ও কৃষি অর্থনৈতিক পরামর্শের জন্য বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিবেন। এক্ষেত্রে তারা কৃষি কর্মকর্তার সাহায্য ও নিতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কৃষি বিভাগের (টঝউঅ) মতে, ‘কৃষি হাব হচ্ছে এমন একটি ব্যবসা পদ্ধতি কিংবা সংগঠন যা পাইকারি ও খুচরা সংস্থাগুলোর চাহিদা মেটাতে এবং তাদের সক্ষমতা শক্তিশালী করার জন্য স্থানীয় ও আঞ্চলিক উৎপাদকদের কাছ থেকে খাদ্য পণ্যগুলো সক্রিয়ভাবে একত্রে বিপণন ও বিতরণ পরিচালনা করে।’ কৃষি হাব হচ্ছে এমন একটি কৃষি পদ্ধতি একত্রে তহবিল গঠন, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে একটি দেশের সুশৃঙ্খল উৎপাদন ব্যবস্থায় সাহায্য করে।
এটি একটি ব্যবসা পদ্ধতি যা ছোট উৎপাদক ও পরিবেশকদের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে প্রান্তিক উন্নয়নে সাহায্য করে। কৃষি হাব সরাসরি ভোক্তা/ক্রেতাদের সঙ্গে সমন্বয় করার বিপণন ব্যবস্থা, যাতে মধ্যসত্ত্বভোগকারী ও প্রতারণা লোপ পায়। ভোক্তাদের আস্থা অর্জন ও তাদের বিশুদ্ধ/ টাটকা পণ্য পেতে সাহায্য করে।
কৃষি হাবের মৌলিক উদ্দেশ্য হচ্ছে নতুন কৃষিপদ্ধতি সম্পর্কে ওয়াকিবহল, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং সুপরিকল্পিত তথ্যের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা যা সরবরাহ ব্যবস্থায় অংশগ্রহণকারী সব কৃষক, ভোক্তা, পরিবহন ব্যবস্থার সফল লেনদেন করতে সাহায্য করা। এ পদ্ধতিতে কেন্দ্রীয়ভাবে একটি গুদামঘর কিংবা বাজার তৈরি করতে হবে যাতে ক্রেতাগণ তাদের পণ্য সঠিকভাবে কিনতে পারেন। একটি সুশৃঙ্খলিত পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে যাতে পণ্য নষ্ট না হয়। গুদামগুলোতে মাননিয়ন্ত্রণ সার্ভিসিং থাকবে যেখানে ধোয়া, কাটা, শুকনো করা, বোতলজাত করা, মোড়কজাত করা, লেবেলিং এবং বর্জ্য নিষ্কাষণ ও ব্যবস্থাপনা থাকবে। কৃষি হাবগুলোতে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ফসল উৎপাদিত হবে, যাতে ফসলের দরপতন না হয় এবং কৃষক লোকসানের সম্মুখীন না হয়। কৃষি হাব কৃষকদের কৃষি প্রযুক্তি ও চাষাবাদ এবং কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, মোড়কজাতকরণের প্রশিক্ষণ দিবে। বর্তমানে বাংলাদেশে সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক কৃষি পণ্য ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সিনজেনটা পরীক্ষামূলকভাবে দেশের উত্তর-পশ্চিম দিকের চার জেলা যথাক্রমে রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী ও নাটোরে ১৭টি কৃষি হাব পরিচালনা করছে। ১০০টি গ্রামের প্রায় ৮৫০০ কৃষককে সহায়তা করছে। যার সঙ্গে প্রায় ২৫০ ব্যবসায়ী সংযুক্ত। এই কৃষি হাবগুলোতে ৫টি কৃষি বিপণন প্রতিষ্ঠান এবং প্রায় ৫০ পাইকার সংযুক্ত। এছাড়াও ব্যক্তি উদ্যোগে কিছু কৃষি হাব গড়ে উঠছে। কিন্তু সাংগাঠনিক দূর্বলতায় ও পুঁজির অভাবে সেগুলো মুখ থুবড়ে পড়ছে।
১৯৯৬ বাংলাদেশ সরকার নতুন কৃষি সম্প্রসারণ নীতি প্রয়োগ করেন। নিরাপদ, টেকসই, বহুমূখী ও লাভজনক কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাকে সামনে রেখে ১৯৯৬ সালের নীতিকে সংশোধন ও পরিমার্জন করে ‘কৃষি সম্প্রসারণ নীতি ২০২০’ ঘোষণা করেন। যার অন্যতম লক্ষ্য খাদ্য নিরাপত্তা ও জলবায়ুগত প্রাকৃতিক দুর্যোগ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মাধ্যমে এসডিজি-২০৩০ অর্জন করা। এই কৃষি সম্প্রসারণ নীতি উদ্দেশ্যগুলো হচ্ছে : খাদ্যশস্যসহ বিভিন্ন কৃষি পণ্যের উৎপাদন, উৎপাদনশীলতা এবং কৃসকের আয় বৃদ্ধি, শস্য বহুমূখীকরণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রতিকূল পরিবেশ ও জলবায়ু উপযোগী আধুনিক পরিবেশ বান্ধব কৃষি সম্প্রসারণ, খামার যান্ত্রিকীকরণ, চাহিদাভিত্তিক রপ্তানিমূখী এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ কৃষি শিল্পের প্রসার, কৃষি বাণিজ্যিকীকরণ এবং নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করা, অংশগ্রহণমূলক গবেষণা কাজে সহযোগিতা এবং প্রতিষ্ঠানিক উন্নয়ন ও তথ্য প্রযুক্তিগত প্রযুক্তির বৃদ্ধি, শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে কৃষিতে আগ্রহী ও নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে সহায়তা করা। এই লক্ষ্যে সরকার ২০২০-২০২৪ পর্যন্ত ৩০২০ কোটি টাকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণ করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এই বৃহৎ কর্মকাণ্ডে সরকার অঞ্চলভেদে ৫০-৭০ শতাংশ ভর্তুকিতে কৃষি সরঞ্জাম ক্রয় করতে পারবে। এই প্রকল্পের ভর্তুকি ব্যয় ধরা হয়েছে ৮০ শতাংশ। এই প্রকল্পের লক্ষ্যে সরকার কৃষক উদ্যোক্তা, কৃষি যন্ত্রপাতি কারিগর, প্রশিক্ষণদাতাদের সমন্বয় করতে এবং তাদের আধুনিক চারা উৎপাদন প্রশিক্ষণ, সমন্বিত খামারে বীজ সহায়তা, কৃষি যন্ত্রপাতি পরীক্ষা, প্রশিক্ষণ ভবন নির্মাণ ও সুবিধা বৃদ্ধি, খুচরা ও কাঁচামালের কর হ্রাসের উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু, কৃষি হাব গড়ে তোলা ও এর সমন্বয় সাধনে কার্যত কোন উদ্যোগে চোখে পড়েনি। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে কৃষি হাব গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রান্তিক কৃষকের কৃষিজমি তুলনামূলকভাবে কম। ভর্তুকির পরেও কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয় করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। তাই, তাদের জন্য কৃষি হাবগুলো হবে ‘দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ’ এর মতো। কারণ, কৃষি হাবের মাধ্যমে তাদের একইসঙ্গে উৎপাদন খরচ কমবে, ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত হবে এবং পণ্যে বিক্রিতে মধ্যসত্ত্বকারী লোপ পাবে।
অতএব, সরকারি সহযোগীতার মাধ্যমে কৃষি হাব গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন। তাহলে, বেসরকারি মুনাফা লোভী বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এদেশে কৃষি হাবের মাধ্যমে তাদের দেশে বাংলাদেশি অর্থ নিয়ে যেতে পারবে না। ফলে কৃষি পণ্য উৎপাদনে কৃষক উৎসাহ বৃদ্ধি পাবে এবং আমাদের দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে।
[লেখক : শিক্ষার্থী, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।]