জাফরুল ইসলাম
আফগানিস্তান নামক দেশের কথা চিন্তা করলে যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে সংঘাত দাঙ্গা এবং হামলার বাস্তব চিত্র। সংঘাতময় এমন চিত্রের ফলে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর কান্না প্রতিনিয়ত পরিলক্ষিত হচ্ছে। আফগানিস্তানের এমন পরিস্থিতির কারণ জানতে হলে আমাদের একটু পেছনের দিকে তাকাতে হবে।
এশিয়া মহাদেশে একসময় ব্রিটিশদের শাসনাধীন ছিল প্রায় ২০০ বছর। সেই সময় ব্রিটিশরা প্রত্যক্ষভাবে সব দেশ শাসন করতে পারলেও আফগানিস্তান নামক এই দেশকে প্রত্যক্ষ শাসন করতে পারেনি। কারণ হলো আফগানিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থান এই সেই দেশকে সব বিদেশি শাসকদের কর্তৃত্ব থেকে রক্ষা করেছে। আমরা যদি আফগানিস্তানের দীর্ঘ চল্লিশ বছরের ইতিহাস লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাই সেখানে মার্কিনিদের প্রভাব। আমেরিকার এ প্রভাব শুরু হয় মূলত হাজার ১৯৭৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাদশা জহির শাহকে উৎখাত করে সোভিয়েতপন্থি সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সম্পর্ক ছিল অহি-নকুল। এরপর ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত সামরিক বাহিনী প্রবেশ করলে সেই সামরিক বাহিনীকে হটাতে যুক্তরাষ্ট্র মুজাহিদীনদের অর্থ, অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সোভিয়েত সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামিয়ে দেয়। এরপর ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন মুজাহিদীনদের সঙ্গে পেরে উঠতে না পেরে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয় এবং মার্কিন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
পরবর্তী সময়ে তালেবান নেতা মোল্লা ওমরের সঙ্গে আল-কায়েদার নেতা ওসামা বিন লাদেনের সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং আল-কায়েদার প্রধান ঘাঁটি হিসেবে আফগানিস্তান পরিচিতি লাভ করে। এরপর ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আল-কায়েদা কর্তৃক আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর আমেরিকা সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সেই সময় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বুশ ঘোষণা করেন যে, আমেরিকার যুদ্ধ সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে নয়। আমেরিকার এমন ঘোষণার ফলে মার্কিন সৈন্য মোতায়েন করে আফগানিস্তানে, আর এই সৈন্য মোতায়েনকে কেন্দ্র করে তালেবানদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ফাটল ধরে।
শুধু তালেবানদের সঙ্গে নয়, বর্তমানে পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকা সম্পর্ক ভালো নয়, অথচ এই পাকিস্তান ছিল আমেরিকার ঘনিষ্ঠ। বর্তমানে আফগানিস্তানের বর্তমানে তালেবানরা ছায়া সরকার পরিচালনা করছে। অর্থাৎ আফগানিস্তানের দুই-তৃতীয়াংশ পরিচালনা করে তালেবানরা, এবং তারা জনগণের সমর্থন লাভের সক্ষমতা লাভ করেছে। এখন পর্যন্ত ২৩ শত মার্কিন সেনা আফগানিস্তানে মারা গেছে, জখম হয়েছে ২০ হাজার জন। আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর ৬০ হাজারেরও বেশি মারা গেছে, একটা পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে এ পর্যন্ত আফগানিস্তানে ৫০ লাখ মানুষ মারা গেছে। বর্তমানে আফগানিস্তানে মার্কিন সৈন্য সংখ্যা ৩৫০০ জন, গত ২০ বছরে আমেরিকা আফগান যুদ্ধের জন্য অর্থ ব্যয় হয়েছে ১ ট্রিলিয়ন ডলার। এত সৈন্য এবং অর্থ ব্যয় করার কারণ হলো বিশ্ব সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে দমন করা।
গত ২০ বছরে আফগানিস্তানে বিশ্বের যে কোন দেশের চেয়ে বিস্ফোরণের আঘাতে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে। আল-কায়েদা ইসলামিক এস্টেটসহ আরও অনেক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো নির্মূল করা হয়নি বরং তাদের শক্তি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাদের শক্তি এমন বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে আত্মবিশ্বাস অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আপনারা স্মরণ করতে পারেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সময়ে প্রাথমিক পর্যায়ে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার শুরু হয়েছিল এবং তালেবানদের সঙ্গে একটা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল।
এখন বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেন ঘোষণা করেছেন যে এ মাসে ২৫০০ থেকে ৩৫০০ মার্কিন সৈন্য আফগানিস্তানে রয়েছে, তারা ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দেশে ফিরে যাবে। এমন ঘোষণার ফলে ভবিষ্যৎ প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে সেটা এখন উদ্বেগের বিষয়। কারণ যে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে নির্মাণ করার জন্য আমেরিকা দীর্ঘ ২০ বছর ধরে লড়াই করে যাচ্ছিলেন, সে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো যখন শক্তিশালী হয়ে উঠছে তখন আমেরিকার পশ্চাদগমন।
১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের মাত্র ১২ বছর পর বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্র আমেরিকায় হামলা সংঘটিত হয়েছিল। যদি এখন আমেরিকার সৈন্য সম্পূর্ণভাবে আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয় তাহলে ভবিষ্যৎ বিশ্বকে আবারও সন্ত্রাসী হামলার মুখোমুখি হবে কিনা সেটাই দেখার বিষয়। আর যদি হামলার শিকার হয় তাহলে বিশ্ব মোড়লদের অবস্থান কেমন হতে পারে? নাকি আমেরিকার সৈন্য প্রত্যাহারের মাধ্যমে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সাধারণ জনগণ স্বাধীন হিসেবে বসবাস করতে পারবে এরকম হাজারো প্রশ্ন সামনে চলে আসছে।
এখন দেখার বিষয় হলো ১১ সেপ্টেম্বরের পরে আফগানিস্তানের রাজনীতিতে কি প্রভাব বিরাজ করে যেখানে ১১ তারিখে বিশ্ব এক ভয়াবহ অবস্থা পরিলক্ষিত করেছিল। মার্কিন বলয় থেকে মুক্ত হওয়ার ফলে আফগানিস্তানিরা তাদের দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করতে পারবে, যার ফলে দেশের সাধারণ মানুষদের জীবন মানের উন্নয়ন ঘটবে বলে আশা করা যায়। আর অন্যদিকে সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের ফলে বিশ্ব রাজনীতিতে সোভিয়েত হয়েছিল সেটাও কি আমেরিকার সঙ্গে হয় কিনা সেটাই দেখার বিষয়।
[ লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ]
জাফরুল ইসলাম
শনিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২১
আফগানিস্তান নামক দেশের কথা চিন্তা করলে যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে সংঘাত দাঙ্গা এবং হামলার বাস্তব চিত্র। সংঘাতময় এমন চিত্রের ফলে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর কান্না প্রতিনিয়ত পরিলক্ষিত হচ্ছে। আফগানিস্তানের এমন পরিস্থিতির কারণ জানতে হলে আমাদের একটু পেছনের দিকে তাকাতে হবে।
এশিয়া মহাদেশে একসময় ব্রিটিশদের শাসনাধীন ছিল প্রায় ২০০ বছর। সেই সময় ব্রিটিশরা প্রত্যক্ষভাবে সব দেশ শাসন করতে পারলেও আফগানিস্তান নামক এই দেশকে প্রত্যক্ষ শাসন করতে পারেনি। কারণ হলো আফগানিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থান এই সেই দেশকে সব বিদেশি শাসকদের কর্তৃত্ব থেকে রক্ষা করেছে। আমরা যদি আফগানিস্তানের দীর্ঘ চল্লিশ বছরের ইতিহাস লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাই সেখানে মার্কিনিদের প্রভাব। আমেরিকার এ প্রভাব শুরু হয় মূলত হাজার ১৯৭৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাদশা জহির শাহকে উৎখাত করে সোভিয়েতপন্থি সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সম্পর্ক ছিল অহি-নকুল। এরপর ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত সামরিক বাহিনী প্রবেশ করলে সেই সামরিক বাহিনীকে হটাতে যুক্তরাষ্ট্র মুজাহিদীনদের অর্থ, অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সোভিয়েত সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামিয়ে দেয়। এরপর ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন মুজাহিদীনদের সঙ্গে পেরে উঠতে না পেরে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয় এবং মার্কিন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
পরবর্তী সময়ে তালেবান নেতা মোল্লা ওমরের সঙ্গে আল-কায়েদার নেতা ওসামা বিন লাদেনের সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং আল-কায়েদার প্রধান ঘাঁটি হিসেবে আফগানিস্তান পরিচিতি লাভ করে। এরপর ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আল-কায়েদা কর্তৃক আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর আমেরিকা সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সেই সময় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বুশ ঘোষণা করেন যে, আমেরিকার যুদ্ধ সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে নয়। আমেরিকার এমন ঘোষণার ফলে মার্কিন সৈন্য মোতায়েন করে আফগানিস্তানে, আর এই সৈন্য মোতায়েনকে কেন্দ্র করে তালেবানদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ফাটল ধরে।
শুধু তালেবানদের সঙ্গে নয়, বর্তমানে পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকা সম্পর্ক ভালো নয়, অথচ এই পাকিস্তান ছিল আমেরিকার ঘনিষ্ঠ। বর্তমানে আফগানিস্তানের বর্তমানে তালেবানরা ছায়া সরকার পরিচালনা করছে। অর্থাৎ আফগানিস্তানের দুই-তৃতীয়াংশ পরিচালনা করে তালেবানরা, এবং তারা জনগণের সমর্থন লাভের সক্ষমতা লাভ করেছে। এখন পর্যন্ত ২৩ শত মার্কিন সেনা আফগানিস্তানে মারা গেছে, জখম হয়েছে ২০ হাজার জন। আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর ৬০ হাজারেরও বেশি মারা গেছে, একটা পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে এ পর্যন্ত আফগানিস্তানে ৫০ লাখ মানুষ মারা গেছে। বর্তমানে আফগানিস্তানে মার্কিন সৈন্য সংখ্যা ৩৫০০ জন, গত ২০ বছরে আমেরিকা আফগান যুদ্ধের জন্য অর্থ ব্যয় হয়েছে ১ ট্রিলিয়ন ডলার। এত সৈন্য এবং অর্থ ব্যয় করার কারণ হলো বিশ্ব সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে দমন করা।
গত ২০ বছরে আফগানিস্তানে বিশ্বের যে কোন দেশের চেয়ে বিস্ফোরণের আঘাতে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে। আল-কায়েদা ইসলামিক এস্টেটসহ আরও অনেক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো নির্মূল করা হয়নি বরং তাদের শক্তি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাদের শক্তি এমন বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে আত্মবিশ্বাস অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আপনারা স্মরণ করতে পারেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সময়ে প্রাথমিক পর্যায়ে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার শুরু হয়েছিল এবং তালেবানদের সঙ্গে একটা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল।
এখন বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেন ঘোষণা করেছেন যে এ মাসে ২৫০০ থেকে ৩৫০০ মার্কিন সৈন্য আফগানিস্তানে রয়েছে, তারা ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দেশে ফিরে যাবে। এমন ঘোষণার ফলে ভবিষ্যৎ প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে সেটা এখন উদ্বেগের বিষয়। কারণ যে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে নির্মাণ করার জন্য আমেরিকা দীর্ঘ ২০ বছর ধরে লড়াই করে যাচ্ছিলেন, সে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো যখন শক্তিশালী হয়ে উঠছে তখন আমেরিকার পশ্চাদগমন।
১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের মাত্র ১২ বছর পর বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্র আমেরিকায় হামলা সংঘটিত হয়েছিল। যদি এখন আমেরিকার সৈন্য সম্পূর্ণভাবে আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয় তাহলে ভবিষ্যৎ বিশ্বকে আবারও সন্ত্রাসী হামলার মুখোমুখি হবে কিনা সেটাই দেখার বিষয়। আর যদি হামলার শিকার হয় তাহলে বিশ্ব মোড়লদের অবস্থান কেমন হতে পারে? নাকি আমেরিকার সৈন্য প্রত্যাহারের মাধ্যমে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সাধারণ জনগণ স্বাধীন হিসেবে বসবাস করতে পারবে এরকম হাজারো প্রশ্ন সামনে চলে আসছে।
এখন দেখার বিষয় হলো ১১ সেপ্টেম্বরের পরে আফগানিস্তানের রাজনীতিতে কি প্রভাব বিরাজ করে যেখানে ১১ তারিখে বিশ্ব এক ভয়াবহ অবস্থা পরিলক্ষিত করেছিল। মার্কিন বলয় থেকে মুক্ত হওয়ার ফলে আফগানিস্তানিরা তাদের দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করতে পারবে, যার ফলে দেশের সাধারণ মানুষদের জীবন মানের উন্নয়ন ঘটবে বলে আশা করা যায়। আর অন্যদিকে সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের ফলে বিশ্ব রাজনীতিতে সোভিয়েত হয়েছিল সেটাও কি আমেরিকার সঙ্গে হয় কিনা সেটাই দেখার বিষয়।
[ লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ]