alt

মুক্ত আলোচনা

মমতার হ্যাটট্রিক জয়, বাংলাদেশ ও অন্যান্য

ইনআমুল হাসান আরিফ

: বৃহস্পতিবার, ০৬ মে ২০২১

১.

পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে জয় লাভ করে মমতা ব্যানার্জি টানা তৃতীয়বারের মেয়াদে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পথে। গত ২৭ মার্চ থেকে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত ২৯৪টি মোট আসনের মধ্যে ২৯২টিতে ৬ ধাপে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২১৩টি আসনে জয়লাভ করে তৃণমূল কংগ্রেস একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। অন্যদিকে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি পায় ৭৭টি আসন।

এই হ্যাটট্রিক জয়ে তৃণমূল কংগ্রেস ‘নবান্ন বিল্ডিং’ (মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি কার্যালয়) এ শুধু নিজেদের আধিপত্যই বিস্তার করেনি মোদি-অমিত শাহর ছুঁড়ে দেয়া চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেছে শক্তভাবে। মূলত এবারের পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল তৃণমূল কংগ্রেস বনাম বিজেপির। আরও নির্দিষ্ট করে বললে মমতা বনাম মোদির। ছোট্ট একটা তথ্য দিলেই বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। এবারের বিধানসভা নির্বাচন উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গ সফর করেছেন যথাক্রমে ১৫ ও ৬২ বার করে। বিজেপির অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতা ও মন্ত্রীগণ নির্বাচন উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গে সফর করেছেন ১১৫ দিন। যা অতীতের সব রেকর্ড হার মানিয়েছে। অন্যদিকে নির্বাচন চলাকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর, তিস্তা ইস্যু, নাগরিকত্ব আইন, নির্বাচনে ধর্মের ব্যবহার ও বিভাজনের রাজনীতি, নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা ইত্যাদি কারণে এবারের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন ঘিরে বাংলাদেশের মানুষের আগ্রহ ছিল চোখে পড়ার মতো। শেষ পর্যন্ত ‘বাংলার নিজের মেয়ে’ মমতা ব্যানার্জির কাছে ধরাশায়ী হলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দিদির এই ম্যাজিকের পিছনে রয়েছে অনেকগুলো কারণ। যেমন-

ক. ঐতিহ্য অনুযায়ী বাংলার মানুষের সাম্প্রদায়িকতা, বিভাজন ও মেরুকরণের রাজনীতির বিপক্ষে অবস্থান।

খ. কন্যাশ্রী, সবুজ সাথী, স্বাস্থ্য সাথী, দুয়ারে সরকার ইত্যাদি জনকল্যাণমূলক কাজের কারণে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ লোকজন বিশেষ করে নারীদের ব্যাপক সমর্থন।

গ. মমতার পক্ষে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিমদের সমর্থন।

ঘ. অন্যদিকে বিজেপির মমতার মত কোন ফেইস না থাকা, রাজ্য বিজেপিকে উপেক্ষা করে ও পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে মূল্য না দিয়ে কেন্দ্র থেকে নির্বাচন পরিচালনা ইত্যাদি বিজেপির জন্য বুমেরাং হয়ে দেখা দিয়েছে আখেরে মমতার জন্য লাভ হয়েছে।

২.এবারের নির্বাচনের মাধ্যমে মমতা ব্যানার্জি কি দিল্লির মসনদের দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে গেলেন?

২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে মোদির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কি মমতা? এই প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে কয়েকটি কারণে।

প্রথমত ভারতের ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন দল কংগ্রেসের নেতৃত্ব এখন রাহুল গান্ধীর হাতে। কিন্তু তার নেতৃত্ব মোদির ক্যারিশমেটিক নেতৃত্বের কাছে হালে পানি পাচ্ছে না। একদিকে সোনিজয়া গান্ধী বয়সের কারণে দলীয় কাজকর্ম চালিয়ে যেতে পারছেন না অন্যদিকে রাহুল গান্ধীর নেতৃত্ব কংগ্রেসকে আলোর দিশা দিতে পারছে না। কংগ্রেস দিন দিন অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। এবারের বিধানসভা নির্বাচন তার আরেকটি বড় উদাহরণ। আসাম, কেরালা, তামিলনাড়–, পদুচেড়ি ও পশ্চিমবঙ্গে এবার বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে একটিতেও কংগ্রেস জিততে পারেনি।

যে কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে ১৯৪৭-৬৭ ও ১৯৭২-৭৭ দু’দফায় ২৫ বছর ক্ষমতায় ছিল তারাই এবারের বিধানসভা নির্বাচনে একটি আসনও পায়নি। তাই দৃশ্যত মোদিকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কোন নেতৃত্ব আপাতত নেই। চলমান এই নেতৃত্ব শূন্যতায় মমতা মোদিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবেন বলে কেউ কেউ মনে করেন।

আবার কিছু বিশ্লেষকের বিশ্লেষণ হচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস একটি আঞ্চলিক দল। এর উত্থান নন্দীগ্রামের একটি বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। দলের শক্তিমত্তা পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রিক। তাই মমতা ব্যানার্জির দিল্লির মসনদে যাত্রা এখনও অনেক দূরের ব্যাপার। অধিকন্তু মমতা ব্যানার্জির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গকে মডেল হিসেবে সবার সামনে তুলে ধরা যেটি ২০১৪ সালের নির্বাচনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গুজরাটকে মডেল হিসেবে সবার সামনে তুলে ধরতে পেরেছিলেন।

৩. বিজেপি হয়তো এবার পশ্চিমবঙ্গে সরকার গঠন করতে পারেনি কিন্তু যেখানে গত বিধানসভায় তাদের আসন সংখ্যা ছিল মাত্র ৩টি এবার তা বেড়ে ৭৭টিতে গিয়ে ঠেকেছে। যা তাদের পশ্চিমবঙ্গে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলে পরিণত করেছে। তাই এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির রাজনীতি ঠিকপথেই আছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে যারা সাম্প্রদায়িক ও বিভাজনের রাজনীতি করেন তাদের সামসাময়িক পরাজয় ঘটলেও উত্তরাধিকার ও ঐতিহ্য (লিগ্যাসি) থাকে বহুদিন। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের পরাজয় ট্রাপিজিয়াম (trumpism)-এর পরাজয় নয়, তেমনি পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির পরাজয়ও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পরিসমাপ্তি নয়।

অন্যদিকে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস একটিও আসন পাবে না এমনটি কেউ ধারণা করতে পারেনি। বামফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় ছিল টানা ৩৪ বছর (১৯৭৭-২০১১)। কংগ্রেস দুই মেয়াদে ছিল ২৫ বছর (১৯৪৭-৭৬, ১৯৭২-৭৭)। রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত ও গণমানুষের আশা-আকাক্সক্ষা বুঝার অক্ষমতা বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসকে আমজনতার কাছে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছে।

রাজনীতি যে শুধু ভাষণ সর্বস্ব নয়, বরং এর জন্য দরকার তৃণমূল পর্যন্ত সাংগঠনিক শক্তি, নিজ গণ্ডির বাইরে গণমানুষের সম্পৃক্ততা এ বিষয়গুলোও এবারের পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে আমাদের আরেকবার মনে করিয়ে দিয়েছে। নির্বাচন পূর্ববর্তী আব্বাস সিদ্দিকী যেভাবে বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তৃতা-বিবৃতি পসরা সাজিয়ে বসে ছিলেন এটা হয়ত সাময়িক পরিচিতি বাড়িয়েছে কিন্তু ব্যালট যুদ্ধে জেতার জন্য শুধু এতোটুকুই যথেষ্ট নয়। অবশ্য একজন পীরজাদা হতো তিনি যেভাবে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথে হেঁটেছেন, নিম্নবর্ণের হিন্দু-মুসলিমদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন যদি অদূর ভবিষ্যতেও এভাবে সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে থেকে রাজনীতি করতে পারেন তাহলে পশ্চিমবঙ্গে আরেকটি ধারা তৈরি করতে পারবেন বলে বিশ্লেষকদের মত।

৪. বিশ্বায়নের এই যুগে কোন কিছুকেই আর আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই, সেটা হোক রাজনীতি, অর্থনীতি, পরিবেশ কিংবা জ্ঞান-বিজ্ঞান।

পশ্চিমবঙ্গ ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন আরেকটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ হতে পারে তা এবারের নির্বাচনে ফুটে ওঠেছে। একদিকে কেন্দ্রে বিজেপি সরকার অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় থাকায় বাংলাদেশের জন্য ভারসাম্য রক্ষা করে চলা কঠিন ছিল। নির্বাচন চলাকালে নরেন্দ্র মোদির গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দিতে মতুয়া সম্প্রদায়ের তীর্থস্থানের যাওয়া মমতা ব্যানার্জি ভালোভাবে নেননি। এটা সত্য যে তিস্তা নিয়ে মমতার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক সুখকর নয়। প্রতিবার কেন্দ্র সরকার তিস্তা চুক্তির পক্ষে থাকলেও রাজ্য সরকার তথা মমতা ব্যানার্জির অনিচ্ছার কারণেই তিস্তা চুক্তি এতদিনে আলোর মুখ দেখেনি। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না তিস্তা ছাড়াও কলকাতার সঙ্গে বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রকল্প চালু রাখতে হবে বাংলাদেশের স্বার্থেই।

তবে মমতা ব্যানার্জির এই জয়ে বাংলাদেশের জন্য স্বস্তির জায়গা হচ্ছে বাংলাদেশ ভারতের নাগরিকত্ব আইন (সিটিজেনশিপ আমেন্ডমেন্ট বিল-২০১৯, ক্যাব) নিয়ে সৃষ্টি হওয়া জটিলতায় আগামী পাঁচ বছর নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে। এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে নাগরিকত্ব আইন ছিল বিজেপির বিভাজনের রাজনীতিতে অন্যতম একটি প্রধান অস্ত্র। যদি বিজেপি ক্ষমতায় আসতো তাহলে কেন্দ্র সরকারের নাগরিকত্ব আইন অবশ্যই তারা পশ্চিমবঙ্গে চালু করতো। কিন্তু শুরু থেকে মমতা ব্যানার্জি এই আইনের বিরোধিতা করে আসছেন। তাই কেন্দ্র সরকার চাইলেও রাজ্য সরকারের বিরোধিতার কারণে পশ্চিমবঙ্গে নাগরিকত্ব আইন পাস হতে পারবে না।

ক্রিকেটে উইনিং কম্বিনেশন না ভাঙার একটি প্রথা আছে। মমতা ব্যানার্জিও কি তার উইনিং স্ট্যাটিজি ভাঙবেন না? তার উইনিং স্যাটিজির অন্যতম একটি দিক ছিল তিস্তা ইস্যু। তিনি মানুষকে বুঝাতে পেরেছিলেন বিজেপি সরকার পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থকে ক্ষুন্ন করে বাংলাদেশকে তিস্তার পানি দিতে চায়। আর তিনি পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ রক্ষা করতে চান। যদি তিনি তার অবস্থান থেকে সরে না আসেন, তাহলে তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশকে ক্ষতিগস্ত করবে। কিন্তু চীনের সঙ্গে তিস্তা প্রকল্প চুক্তি ও বর্ষা মৌসুমে পানির মজুদ রেখে তিস্তা সমস্যার কিছুটা প্রতিকার যদিওবা সম্ভব কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে নাগরিকত্ব আইন পাস হলে এটা বাংলাদেশের জন্য মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে দেখা দেবে। কারণ ইতিমধ্যে ১১ লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে বাংলাদেশ হিমশিম খাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে যদি আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে আরও প্রায় ১০ লাখ মানুষ আশ্রয়ের খোঁজে বাংলাদেশে পাড়ি জমায় তাহলে নিঃসন্দেহে তা বাংলাদেশের জন্য এক মহাসংকট হিসেবে দেখা দিবে।

[লেখক : শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

মমতার হ্যাটট্রিক জয়, বাংলাদেশ ও অন্যান্য

ইনআমুল হাসান আরিফ

বৃহস্পতিবার, ০৬ মে ২০২১

১.

পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে জয় লাভ করে মমতা ব্যানার্জি টানা তৃতীয়বারের মেয়াদে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পথে। গত ২৭ মার্চ থেকে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত ২৯৪টি মোট আসনের মধ্যে ২৯২টিতে ৬ ধাপে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২১৩টি আসনে জয়লাভ করে তৃণমূল কংগ্রেস একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। অন্যদিকে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি পায় ৭৭টি আসন।

এই হ্যাটট্রিক জয়ে তৃণমূল কংগ্রেস ‘নবান্ন বিল্ডিং’ (মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি কার্যালয়) এ শুধু নিজেদের আধিপত্যই বিস্তার করেনি মোদি-অমিত শাহর ছুঁড়ে দেয়া চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেছে শক্তভাবে। মূলত এবারের পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল তৃণমূল কংগ্রেস বনাম বিজেপির। আরও নির্দিষ্ট করে বললে মমতা বনাম মোদির। ছোট্ট একটা তথ্য দিলেই বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। এবারের বিধানসভা নির্বাচন উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গ সফর করেছেন যথাক্রমে ১৫ ও ৬২ বার করে। বিজেপির অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতা ও মন্ত্রীগণ নির্বাচন উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গে সফর করেছেন ১১৫ দিন। যা অতীতের সব রেকর্ড হার মানিয়েছে। অন্যদিকে নির্বাচন চলাকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর, তিস্তা ইস্যু, নাগরিকত্ব আইন, নির্বাচনে ধর্মের ব্যবহার ও বিভাজনের রাজনীতি, নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা ইত্যাদি কারণে এবারের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন ঘিরে বাংলাদেশের মানুষের আগ্রহ ছিল চোখে পড়ার মতো। শেষ পর্যন্ত ‘বাংলার নিজের মেয়ে’ মমতা ব্যানার্জির কাছে ধরাশায়ী হলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দিদির এই ম্যাজিকের পিছনে রয়েছে অনেকগুলো কারণ। যেমন-

ক. ঐতিহ্য অনুযায়ী বাংলার মানুষের সাম্প্রদায়িকতা, বিভাজন ও মেরুকরণের রাজনীতির বিপক্ষে অবস্থান।

খ. কন্যাশ্রী, সবুজ সাথী, স্বাস্থ্য সাথী, দুয়ারে সরকার ইত্যাদি জনকল্যাণমূলক কাজের কারণে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ লোকজন বিশেষ করে নারীদের ব্যাপক সমর্থন।

গ. মমতার পক্ষে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিমদের সমর্থন।

ঘ. অন্যদিকে বিজেপির মমতার মত কোন ফেইস না থাকা, রাজ্য বিজেপিকে উপেক্ষা করে ও পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে মূল্য না দিয়ে কেন্দ্র থেকে নির্বাচন পরিচালনা ইত্যাদি বিজেপির জন্য বুমেরাং হয়ে দেখা দিয়েছে আখেরে মমতার জন্য লাভ হয়েছে।

২.এবারের নির্বাচনের মাধ্যমে মমতা ব্যানার্জি কি দিল্লির মসনদের দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে গেলেন?

২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে মোদির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কি মমতা? এই প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে কয়েকটি কারণে।

প্রথমত ভারতের ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন দল কংগ্রেসের নেতৃত্ব এখন রাহুল গান্ধীর হাতে। কিন্তু তার নেতৃত্ব মোদির ক্যারিশমেটিক নেতৃত্বের কাছে হালে পানি পাচ্ছে না। একদিকে সোনিজয়া গান্ধী বয়সের কারণে দলীয় কাজকর্ম চালিয়ে যেতে পারছেন না অন্যদিকে রাহুল গান্ধীর নেতৃত্ব কংগ্রেসকে আলোর দিশা দিতে পারছে না। কংগ্রেস দিন দিন অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। এবারের বিধানসভা নির্বাচন তার আরেকটি বড় উদাহরণ। আসাম, কেরালা, তামিলনাড়–, পদুচেড়ি ও পশ্চিমবঙ্গে এবার বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে একটিতেও কংগ্রেস জিততে পারেনি।

যে কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে ১৯৪৭-৬৭ ও ১৯৭২-৭৭ দু’দফায় ২৫ বছর ক্ষমতায় ছিল তারাই এবারের বিধানসভা নির্বাচনে একটি আসনও পায়নি। তাই দৃশ্যত মোদিকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কোন নেতৃত্ব আপাতত নেই। চলমান এই নেতৃত্ব শূন্যতায় মমতা মোদিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবেন বলে কেউ কেউ মনে করেন।

আবার কিছু বিশ্লেষকের বিশ্লেষণ হচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস একটি আঞ্চলিক দল। এর উত্থান নন্দীগ্রামের একটি বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। দলের শক্তিমত্তা পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রিক। তাই মমতা ব্যানার্জির দিল্লির মসনদে যাত্রা এখনও অনেক দূরের ব্যাপার। অধিকন্তু মমতা ব্যানার্জির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গকে মডেল হিসেবে সবার সামনে তুলে ধরা যেটি ২০১৪ সালের নির্বাচনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গুজরাটকে মডেল হিসেবে সবার সামনে তুলে ধরতে পেরেছিলেন।

৩. বিজেপি হয়তো এবার পশ্চিমবঙ্গে সরকার গঠন করতে পারেনি কিন্তু যেখানে গত বিধানসভায় তাদের আসন সংখ্যা ছিল মাত্র ৩টি এবার তা বেড়ে ৭৭টিতে গিয়ে ঠেকেছে। যা তাদের পশ্চিমবঙ্গে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলে পরিণত করেছে। তাই এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির রাজনীতি ঠিকপথেই আছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে যারা সাম্প্রদায়িক ও বিভাজনের রাজনীতি করেন তাদের সামসাময়িক পরাজয় ঘটলেও উত্তরাধিকার ও ঐতিহ্য (লিগ্যাসি) থাকে বহুদিন। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের পরাজয় ট্রাপিজিয়াম (trumpism)-এর পরাজয় নয়, তেমনি পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির পরাজয়ও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পরিসমাপ্তি নয়।

অন্যদিকে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস একটিও আসন পাবে না এমনটি কেউ ধারণা করতে পারেনি। বামফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় ছিল টানা ৩৪ বছর (১৯৭৭-২০১১)। কংগ্রেস দুই মেয়াদে ছিল ২৫ বছর (১৯৪৭-৭৬, ১৯৭২-৭৭)। রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত ও গণমানুষের আশা-আকাক্সক্ষা বুঝার অক্ষমতা বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসকে আমজনতার কাছে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছে।

রাজনীতি যে শুধু ভাষণ সর্বস্ব নয়, বরং এর জন্য দরকার তৃণমূল পর্যন্ত সাংগঠনিক শক্তি, নিজ গণ্ডির বাইরে গণমানুষের সম্পৃক্ততা এ বিষয়গুলোও এবারের পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে আমাদের আরেকবার মনে করিয়ে দিয়েছে। নির্বাচন পূর্ববর্তী আব্বাস সিদ্দিকী যেভাবে বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তৃতা-বিবৃতি পসরা সাজিয়ে বসে ছিলেন এটা হয়ত সাময়িক পরিচিতি বাড়িয়েছে কিন্তু ব্যালট যুদ্ধে জেতার জন্য শুধু এতোটুকুই যথেষ্ট নয়। অবশ্য একজন পীরজাদা হতো তিনি যেভাবে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথে হেঁটেছেন, নিম্নবর্ণের হিন্দু-মুসলিমদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন যদি অদূর ভবিষ্যতেও এভাবে সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে থেকে রাজনীতি করতে পারেন তাহলে পশ্চিমবঙ্গে আরেকটি ধারা তৈরি করতে পারবেন বলে বিশ্লেষকদের মত।

৪. বিশ্বায়নের এই যুগে কোন কিছুকেই আর আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই, সেটা হোক রাজনীতি, অর্থনীতি, পরিবেশ কিংবা জ্ঞান-বিজ্ঞান।

পশ্চিমবঙ্গ ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন আরেকটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ হতে পারে তা এবারের নির্বাচনে ফুটে ওঠেছে। একদিকে কেন্দ্রে বিজেপি সরকার অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় থাকায় বাংলাদেশের জন্য ভারসাম্য রক্ষা করে চলা কঠিন ছিল। নির্বাচন চলাকালে নরেন্দ্র মোদির গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দিতে মতুয়া সম্প্রদায়ের তীর্থস্থানের যাওয়া মমতা ব্যানার্জি ভালোভাবে নেননি। এটা সত্য যে তিস্তা নিয়ে মমতার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক সুখকর নয়। প্রতিবার কেন্দ্র সরকার তিস্তা চুক্তির পক্ষে থাকলেও রাজ্য সরকার তথা মমতা ব্যানার্জির অনিচ্ছার কারণেই তিস্তা চুক্তি এতদিনে আলোর মুখ দেখেনি। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না তিস্তা ছাড়াও কলকাতার সঙ্গে বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রকল্প চালু রাখতে হবে বাংলাদেশের স্বার্থেই।

তবে মমতা ব্যানার্জির এই জয়ে বাংলাদেশের জন্য স্বস্তির জায়গা হচ্ছে বাংলাদেশ ভারতের নাগরিকত্ব আইন (সিটিজেনশিপ আমেন্ডমেন্ট বিল-২০১৯, ক্যাব) নিয়ে সৃষ্টি হওয়া জটিলতায় আগামী পাঁচ বছর নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে। এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে নাগরিকত্ব আইন ছিল বিজেপির বিভাজনের রাজনীতিতে অন্যতম একটি প্রধান অস্ত্র। যদি বিজেপি ক্ষমতায় আসতো তাহলে কেন্দ্র সরকারের নাগরিকত্ব আইন অবশ্যই তারা পশ্চিমবঙ্গে চালু করতো। কিন্তু শুরু থেকে মমতা ব্যানার্জি এই আইনের বিরোধিতা করে আসছেন। তাই কেন্দ্র সরকার চাইলেও রাজ্য সরকারের বিরোধিতার কারণে পশ্চিমবঙ্গে নাগরিকত্ব আইন পাস হতে পারবে না।

ক্রিকেটে উইনিং কম্বিনেশন না ভাঙার একটি প্রথা আছে। মমতা ব্যানার্জিও কি তার উইনিং স্ট্যাটিজি ভাঙবেন না? তার উইনিং স্যাটিজির অন্যতম একটি দিক ছিল তিস্তা ইস্যু। তিনি মানুষকে বুঝাতে পেরেছিলেন বিজেপি সরকার পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থকে ক্ষুন্ন করে বাংলাদেশকে তিস্তার পানি দিতে চায়। আর তিনি পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ রক্ষা করতে চান। যদি তিনি তার অবস্থান থেকে সরে না আসেন, তাহলে তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশকে ক্ষতিগস্ত করবে। কিন্তু চীনের সঙ্গে তিস্তা প্রকল্প চুক্তি ও বর্ষা মৌসুমে পানির মজুদ রেখে তিস্তা সমস্যার কিছুটা প্রতিকার যদিওবা সম্ভব কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে নাগরিকত্ব আইন পাস হলে এটা বাংলাদেশের জন্য মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে দেখা দেবে। কারণ ইতিমধ্যে ১১ লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে বাংলাদেশ হিমশিম খাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে যদি আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে আরও প্রায় ১০ লাখ মানুষ আশ্রয়ের খোঁজে বাংলাদেশে পাড়ি জমায় তাহলে নিঃসন্দেহে তা বাংলাদেশের জন্য এক মহাসংকট হিসেবে দেখা দিবে।

[লেখক : শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।]

back to top