মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ
নাইজেরিয়ায় বাউচি স্টেটসহ উত্তরাঞ্চলের রয়েছে ফুলানী গোত্রের অনেক মানুষ। পশ্চিম আফ্রিকার পশ্চিমাংশে ফুলানীদের অধিক বসবাস, যে অঞ্চলটি সেনেগাম্বিয়া নামে পরিচিত। তাদের রয়েছে হাজার বছরের সেনেগাম্বিয়া ঐতিহ্য। জানা যায়, উত্তর ও মধ্য নাইজেরিয়ায় তিনশ’ বছরের অধিক সময় আগে থেকে ফুলানীরা এ অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। নাইজেরিয়া ছাড়াও সেনেগাল, ইথিওপিয়া, গিনি ও সুদানে ফুলানী গোত্রের মানুষ রয়েছে। তারা ‘ফুলা’ নামেও পরিচিত। হাউসা ভাষায় ফুলানীদের ‘ফুলান’ও বলা হয়। নাইজেরিয়ার বাউচি ও সোকোটো স্টেটে ওদের অধিক বসবাস। ফুলানীদের প্রচলিত ভাষার নাম ‘ফুলফুলডে’। তবে তারা বসবাসসূত্রে হাউসা ভাষাও জানে। ফুলানীদের মোট সংখ্যা ৬ মিলিয়নের মতো। একাধিক বিয়ে এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণের ছোঁয়া না লাগার কারণে তাদের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। নিজস্ব এথনিক অনুসারী ছাড়া তারা অন্য কোনো গোত্রের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে না। ফুলানীদের প্রায় সবাই মুসলমান। তাদের দেহের গড়ন, চেহারাও অন্যান্য নাইজেরিয়ানদের চেয়ে খানিকটা আলাদা। আফ্রিকানদের গতানুগতিক আদলের মতো তাদের দেহ খুব বলিষ্ঠ নয়, অপেক্ষাকৃত হালকা-পাতলা। ঠোঁট তেমন পুরু নয়, নাকও কিছুটা উঁচু। দেহের রঙ তেমন গাঢ় কালো নয়, তামাটে। কিছু ফুলানী বেশ ফর্সা এবং রূপসী।
নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত বাউচি ১৯৭৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি স্টেট হিসাবে স্বীকৃতি পায়।
জানা যায়, ১৮০০ সাল বা কাছাকাছি সময়ে এ অঞ্চলে প্রথম ট্রডিশনাল শাসক ইয়াকুবুর আগমনের পূর্বে ‘বাউসে’ নামক এক শিকারীর নামানুসারে অধিকৃত এলাকার নাম ‘বাউচি’ রাখা হয়। বাউচি স্টেটের চারিদিক ঘিরে আছে সাতটি স্টেট। উত্তরে কানো এবং জিগাওয়া, দক্ষিণে প্লাটো এবং তারাবা, পূর্বে গোম্বে এবং ইওবে, পশ্চিমে রয়েছে কাদুনা। মোট ৪৯, ১১৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বাউচি স্টেট পুরো নাইজেরিয়ার আয়তনের ৫.৩ শতাংশ। এরমধ্যে স্টেট ক্যাপিটাল শহর বলে খ্যাত বাউচির আয়তন ৩, ৬৮৭ বর্গকিলোমিটার। গোম্বে বাউটি স্টেটের অন্তর্ভূক্ত থাকলেও ১৯৯৬ সালে বর্ধিষ্ণু শহর গোম্বেকে আলাদা স্টেটে রূপান্তরিত করা হয়। প্রথমত ১৬টি লোকাল গভর্নমেন্ট মিলিয়ে বাউটি স্টেট গঠিত হলেও পরবর্তীতে তা ২০ এবং আরও পরে ২৩টি লোকাল গভর্নমেন্ট বাউচি স্টেটের আওতায় আসে।
বাউচি স্টেট নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের পর্যায়ে এসে পেঁছেছে। বাউচি স্টেটের দক্ষিণাঞ্চল জস প্লাটোর অবস্থানের কারণে কিছু পাহাড় এলাকা রয়েছে। উত্তরের ভূ-প্রকৃতি অনেকটা বালুমিশ্রিত। জলবায়ু এবং বৃষ্টিপাতের ওপর এখানকার কৃষিপণ্যের ধরন নির্ভরশীল। বাউচির বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাত দক্ষিণে ১৩শ’ মিলিমিটার এবং উত্তরে মাত্র ৭০০ মিলিমিটার। বাউচি স্টেটে মোট ৫৫টি গোত্র বা ট্রাইবাল গ্রুপ রয়েছে যার মধ্যে হাউসাই প্রধান। এছাড়া ফুলানী, গেরাওয়া, কানুরি, জারাওয়া, কিরফাওয়া, টুরাওয়া বোলেওয়া, সায়াওয়া এবং কারেকারে গোত্রের মানুষের সংখ্যাও কম নয়। প্রতিটি গোত্রের ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহ্য, পেশা, ধর্মবিশ্বাস এবং সংস্কৃতি রয়েছে; যা তাদের জীবনাচারকে প্রভাবান্বিত করেই পুরো বাউচি স্টেটকে এক আলাদা রূপ দিয়েছে। এর মধ্যে কিছু কিছু ট্রাইবের ভাষা, পেশা, সংস্কৃতিতে গোত্রগত মিল রয়েছে; যা তাদের মধ্যকার উৎসব আয়োজন, পোশাক, পেশা, বিয়েসহ সহাবস্থানের পথ সুগম করেছে। এমনকি একই কারণে ফুলানী ও কানুরি এবং জারওয়া ও সায়ওয়ার মধ্যে হাস্য-কৌতুক বিনিময়েরও একটা সম্পর্ক রয়েছে।
ফুলানী মেয়েরা গায়ে জড়ায় ওড়না ও মাথায় একখণ্ড কাপড় বেঁধে রাখে। কানে বৃহদাকার ধাতব গহনা ব্যবহার করে। হাউসাদের মতোই ফুলানীরা পরে বর্ণালী লুঙ্গি ও ব্লাউজ। ফুলানী নারীরা চুলের খুব যত্ন নেয়। চুলকে সাপের মতো অনেকগুলো বেণী বানিয়ে সাজতে পছন্দ করে। পুরুষেরা জামা-পায়জামা ব্যবহার করে। পুরুষ ফুলানীদের মাথায় টুপি পরতে দেখা যায়। তারা লাজুক, ভদ্র ও নম্র স্বভাবের, বেশ পরিশ্রমী ও অতিথিপরায়ণ। ফুলানী ছেলেরা গরু, ছাগল, ভেড়া চড়ায়। হাটবাজারে পণ্য বেচাকেনার ব্যবসায় নিয়োজিত থাকে। নারীরা পোষা গরুর দুধ, মাখন, দই. পনির বানিয়ে বিক্রি করে। অন্য গোত্রের মানুষের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ, ভাববিনিময় কম। বিয়ের মতো নিজস্ব আচার-অনুষ্ঠানে গান গেয়ে, বাদ্য বাজিয়ে আনন্দ-উৎসব করে থাকে। হাউসাদের মতো ফুলানী নারীরা পিঠে শিশু সন্তানকে বেঁধে রেখে সকল কাজকর্ম করে। তারা সেলাই ও বুননের কাজে সিদ্ধহস্ত। বিভিন্ন রঙের সুতা দিয়ে কাপড়, টুপিতে কারুকাজ করে। সাদা, কালো রঙের ওপর নীল সুতার ব্যবহার তাদের বেশি পছন্দের। ফুলানীরা বাস্কেট জাতীয় জিনিষ তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে। নাইজেরিয়ার বাউচি, গোম্বে, কবি, ইওবে, কাটসিনা, সোকোটো এবং বেনুয়ে শহরে অধিক ফুলানীর বসবাস রয়েছে। ফুলানীদের মধ্যে শিক্ষার হার কম। আমি যে কলেজে প্রায় ৫ বছর শিক্ষকতা করেছি সেখানে কোনো ফুলানী ছাত্র-ছাত্রী ছিল না।
গ্রামীণ জনপদে বেশির ভাগ ফুলানীর তেমন স্থায়ী বাসস্থান নেই। বনে-জঙ্গলে পরিবার-পরিজন নিয়ে তারা বাস করে। খড়-কুটা, মাটি বিশেষ করে পাতা দিয়ে ছোট্ট এক বিশেষ ধরনের গোলাকৃতি ঘর (বুকুরু বা সুদুহুদু) বানায়। অনেক সময় স্থান সংকুলান না হলে সেই ঘরের কেন্দ্রে একত্রে পা মিলিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে ঘুমিয়ে রাত কাটায়। কেউ আবার বনের গভীরে গাছ-গাছালির আড়ালেই কাটিয়ে দেয় দিনরাত। নাইজেরিয়ার গরুগুলো বেশি মোটা নয় তবে খুব বলিষ্ঠ। উঁচু পাহাড় বেয়ে ওরা তরতর করে উঠে যায়। আর ফুলানী পুরুষেরা হাতে ছোট্ট এক টুকরা লাঠি নিয়ে গরুর পালের পেছনে ওদের অনুসরণ করে। কোনো রকম না ফুটিয়েই ফুলানীরা গরুর দুধ পান করে। ভুট্টাসিদ্ধ আর বনের ফলমূল ওরা বেশি খায়। আর সুপারির মতো এক ধরনের ফল কোলানাট খেয়ে মুখ লাল করে রাখে। আরবির সঙ্গে হাউসা এবং ফুলানীদের নিজস্ব ভাষার কিছু শব্দের মিল রয়েছে। পশুপালনের জন্য উপযুক্ত ঘাস, লতাপাতাপূর্ণ স্থানে ফুলানীরা বসতি গড়ে। কোনো স্থানের ঘাস শেষ হয়ে গেলে ওরা বসতি গুটিয়ে অন্যত্র চলে যায়। যেসব জায়গায় ফুলানীদের সংখ্যা ও সামর্থ্য বেশি সেখানে হাউসাদের ওপর ফুলানীদের আধিপত্য বিস্তার করতেও শোনা যায়।
ফুলানী নারীরা দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য বিক্রির জন্য নিকটস্থ বাজারকে বেছে নেয়। বাউচির বাজারগুলোর এক কোণে সারি বেধে বসে ফুলানী মেয়েরা দুধ, দই, মাখন বিক্রি করে। এমনকি শহরের কাছের বাসা-বাড়িতেও দুধ, মাখন বিক্রি করে জীবন কাটায়। দুধ বহন করার জন্য ফুলানী নারীরা ব্যবহার করে বিচিত্র ধরনের এক পাত্র। ওই পাত্রগুলোও মাটি কিম্বা কোনও ধাতব পদার্থের তৈরি নয়। নাইজেরিয়ার উর্বর মাটিতে জন্মানো গোলাকৃতির ‘বালাবাস’ পেঁকে গেলে কেটে দুভাগ করে ভেতরের সব ফেলে শুধু শক্ত খোলসকে শুকিয়ে তৈরি করা হয় বিশাল পাত্র। আর তাতেই দুধ নিয়ে যাওয়া হয় বিপণনের জন্য। এমনকি দুধ-মাখন উঠানোর জন্য ব্যবহৃত চামচটিও তৈরি করা হয় ছোট্ট আকারের কালাবাস দিয়ে। সৎ, সহজ-সরল ফুলানীরা তাদের শতশত বছরের পুরনো ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সুনামের সঙ্গে বসবাস করছে। এক ফুলানী নারী প্রতিদিন অর্ধ-লিটারের একটি বোতল ভরে দুধ আনতেন আমার বাসায়। ঢেলে দিতেন একটি পাত্রে। সে দুধ এত ঘন ছিলো যে ঢেলে দেয়ার পরও মনে হতো কাঁচের বোতল দুধ লেগে সাদা হয়ে আছে। আমি ওদের ভাষায় ইনিয়ে বিনিয়ে বললাম, এ দুধ বেশি ঘন বলে দুধের সমপরিমান পানি মিলিয়ে ফুটিয়ে পান করতে হতো। নইলে পেট খারাপ অনিবার্য। ফুলানী মহিলা তো অবাক। তার কথা, পানি মিশিয়ে খেলে দুধের স্বাদ বা উপকারিতা থাকে কী করে! তারা তো গরুর দুধ সরাসরি বাচ্চাদের খেতে দেয়, নিজেরা খায়। দুধের ওপরই তো বেঁচে আছে তাদের জীবন। সেদিন ফুলানী মহিলার কথার কোনো উত্তর খুঁজে পাইনি। অনেক দিন আগে ফেলে আসা ওইসব মানুষগুলোকে কোনোদিন ভোলা যাবে না। শুধু আজকের দিনে এসে রাজনৈতিক সহিংসতা আর বিপর্যস্ত অর্থনীতির বলি নাইজেরিয়ার সেই সহজ-সরল মানুষগুলোর প্রতি গভীর ভালোবাসা আর সহানুভূতি জানাই।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ও শিক্ষক]
মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ
সোমবার, ১০ মে ২০২১
নাইজেরিয়ায় বাউচি স্টেটসহ উত্তরাঞ্চলের রয়েছে ফুলানী গোত্রের অনেক মানুষ। পশ্চিম আফ্রিকার পশ্চিমাংশে ফুলানীদের অধিক বসবাস, যে অঞ্চলটি সেনেগাম্বিয়া নামে পরিচিত। তাদের রয়েছে হাজার বছরের সেনেগাম্বিয়া ঐতিহ্য। জানা যায়, উত্তর ও মধ্য নাইজেরিয়ায় তিনশ’ বছরের অধিক সময় আগে থেকে ফুলানীরা এ অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। নাইজেরিয়া ছাড়াও সেনেগাল, ইথিওপিয়া, গিনি ও সুদানে ফুলানী গোত্রের মানুষ রয়েছে। তারা ‘ফুলা’ নামেও পরিচিত। হাউসা ভাষায় ফুলানীদের ‘ফুলান’ও বলা হয়। নাইজেরিয়ার বাউচি ও সোকোটো স্টেটে ওদের অধিক বসবাস। ফুলানীদের প্রচলিত ভাষার নাম ‘ফুলফুলডে’। তবে তারা বসবাসসূত্রে হাউসা ভাষাও জানে। ফুলানীদের মোট সংখ্যা ৬ মিলিয়নের মতো। একাধিক বিয়ে এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণের ছোঁয়া না লাগার কারণে তাদের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। নিজস্ব এথনিক অনুসারী ছাড়া তারা অন্য কোনো গোত্রের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে না। ফুলানীদের প্রায় সবাই মুসলমান। তাদের দেহের গড়ন, চেহারাও অন্যান্য নাইজেরিয়ানদের চেয়ে খানিকটা আলাদা। আফ্রিকানদের গতানুগতিক আদলের মতো তাদের দেহ খুব বলিষ্ঠ নয়, অপেক্ষাকৃত হালকা-পাতলা। ঠোঁট তেমন পুরু নয়, নাকও কিছুটা উঁচু। দেহের রঙ তেমন গাঢ় কালো নয়, তামাটে। কিছু ফুলানী বেশ ফর্সা এবং রূপসী।
নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত বাউচি ১৯৭৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি স্টেট হিসাবে স্বীকৃতি পায়।
জানা যায়, ১৮০০ সাল বা কাছাকাছি সময়ে এ অঞ্চলে প্রথম ট্রডিশনাল শাসক ইয়াকুবুর আগমনের পূর্বে ‘বাউসে’ নামক এক শিকারীর নামানুসারে অধিকৃত এলাকার নাম ‘বাউচি’ রাখা হয়। বাউচি স্টেটের চারিদিক ঘিরে আছে সাতটি স্টেট। উত্তরে কানো এবং জিগাওয়া, দক্ষিণে প্লাটো এবং তারাবা, পূর্বে গোম্বে এবং ইওবে, পশ্চিমে রয়েছে কাদুনা। মোট ৪৯, ১১৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বাউচি স্টেট পুরো নাইজেরিয়ার আয়তনের ৫.৩ শতাংশ। এরমধ্যে স্টেট ক্যাপিটাল শহর বলে খ্যাত বাউচির আয়তন ৩, ৬৮৭ বর্গকিলোমিটার। গোম্বে বাউটি স্টেটের অন্তর্ভূক্ত থাকলেও ১৯৯৬ সালে বর্ধিষ্ণু শহর গোম্বেকে আলাদা স্টেটে রূপান্তরিত করা হয়। প্রথমত ১৬টি লোকাল গভর্নমেন্ট মিলিয়ে বাউটি স্টেট গঠিত হলেও পরবর্তীতে তা ২০ এবং আরও পরে ২৩টি লোকাল গভর্নমেন্ট বাউচি স্টেটের আওতায় আসে।
বাউচি স্টেট নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের পর্যায়ে এসে পেঁছেছে। বাউচি স্টেটের দক্ষিণাঞ্চল জস প্লাটোর অবস্থানের কারণে কিছু পাহাড় এলাকা রয়েছে। উত্তরের ভূ-প্রকৃতি অনেকটা বালুমিশ্রিত। জলবায়ু এবং বৃষ্টিপাতের ওপর এখানকার কৃষিপণ্যের ধরন নির্ভরশীল। বাউচির বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাত দক্ষিণে ১৩শ’ মিলিমিটার এবং উত্তরে মাত্র ৭০০ মিলিমিটার। বাউচি স্টেটে মোট ৫৫টি গোত্র বা ট্রাইবাল গ্রুপ রয়েছে যার মধ্যে হাউসাই প্রধান। এছাড়া ফুলানী, গেরাওয়া, কানুরি, জারাওয়া, কিরফাওয়া, টুরাওয়া বোলেওয়া, সায়াওয়া এবং কারেকারে গোত্রের মানুষের সংখ্যাও কম নয়। প্রতিটি গোত্রের ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহ্য, পেশা, ধর্মবিশ্বাস এবং সংস্কৃতি রয়েছে; যা তাদের জীবনাচারকে প্রভাবান্বিত করেই পুরো বাউচি স্টেটকে এক আলাদা রূপ দিয়েছে। এর মধ্যে কিছু কিছু ট্রাইবের ভাষা, পেশা, সংস্কৃতিতে গোত্রগত মিল রয়েছে; যা তাদের মধ্যকার উৎসব আয়োজন, পোশাক, পেশা, বিয়েসহ সহাবস্থানের পথ সুগম করেছে। এমনকি একই কারণে ফুলানী ও কানুরি এবং জারওয়া ও সায়ওয়ার মধ্যে হাস্য-কৌতুক বিনিময়েরও একটা সম্পর্ক রয়েছে।
ফুলানী মেয়েরা গায়ে জড়ায় ওড়না ও মাথায় একখণ্ড কাপড় বেঁধে রাখে। কানে বৃহদাকার ধাতব গহনা ব্যবহার করে। হাউসাদের মতোই ফুলানীরা পরে বর্ণালী লুঙ্গি ও ব্লাউজ। ফুলানী নারীরা চুলের খুব যত্ন নেয়। চুলকে সাপের মতো অনেকগুলো বেণী বানিয়ে সাজতে পছন্দ করে। পুরুষেরা জামা-পায়জামা ব্যবহার করে। পুরুষ ফুলানীদের মাথায় টুপি পরতে দেখা যায়। তারা লাজুক, ভদ্র ও নম্র স্বভাবের, বেশ পরিশ্রমী ও অতিথিপরায়ণ। ফুলানী ছেলেরা গরু, ছাগল, ভেড়া চড়ায়। হাটবাজারে পণ্য বেচাকেনার ব্যবসায় নিয়োজিত থাকে। নারীরা পোষা গরুর দুধ, মাখন, দই. পনির বানিয়ে বিক্রি করে। অন্য গোত্রের মানুষের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ, ভাববিনিময় কম। বিয়ের মতো নিজস্ব আচার-অনুষ্ঠানে গান গেয়ে, বাদ্য বাজিয়ে আনন্দ-উৎসব করে থাকে। হাউসাদের মতো ফুলানী নারীরা পিঠে শিশু সন্তানকে বেঁধে রেখে সকল কাজকর্ম করে। তারা সেলাই ও বুননের কাজে সিদ্ধহস্ত। বিভিন্ন রঙের সুতা দিয়ে কাপড়, টুপিতে কারুকাজ করে। সাদা, কালো রঙের ওপর নীল সুতার ব্যবহার তাদের বেশি পছন্দের। ফুলানীরা বাস্কেট জাতীয় জিনিষ তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে। নাইজেরিয়ার বাউচি, গোম্বে, কবি, ইওবে, কাটসিনা, সোকোটো এবং বেনুয়ে শহরে অধিক ফুলানীর বসবাস রয়েছে। ফুলানীদের মধ্যে শিক্ষার হার কম। আমি যে কলেজে প্রায় ৫ বছর শিক্ষকতা করেছি সেখানে কোনো ফুলানী ছাত্র-ছাত্রী ছিল না।
গ্রামীণ জনপদে বেশির ভাগ ফুলানীর তেমন স্থায়ী বাসস্থান নেই। বনে-জঙ্গলে পরিবার-পরিজন নিয়ে তারা বাস করে। খড়-কুটা, মাটি বিশেষ করে পাতা দিয়ে ছোট্ট এক বিশেষ ধরনের গোলাকৃতি ঘর (বুকুরু বা সুদুহুদু) বানায়। অনেক সময় স্থান সংকুলান না হলে সেই ঘরের কেন্দ্রে একত্রে পা মিলিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে ঘুমিয়ে রাত কাটায়। কেউ আবার বনের গভীরে গাছ-গাছালির আড়ালেই কাটিয়ে দেয় দিনরাত। নাইজেরিয়ার গরুগুলো বেশি মোটা নয় তবে খুব বলিষ্ঠ। উঁচু পাহাড় বেয়ে ওরা তরতর করে উঠে যায়। আর ফুলানী পুরুষেরা হাতে ছোট্ট এক টুকরা লাঠি নিয়ে গরুর পালের পেছনে ওদের অনুসরণ করে। কোনো রকম না ফুটিয়েই ফুলানীরা গরুর দুধ পান করে। ভুট্টাসিদ্ধ আর বনের ফলমূল ওরা বেশি খায়। আর সুপারির মতো এক ধরনের ফল কোলানাট খেয়ে মুখ লাল করে রাখে। আরবির সঙ্গে হাউসা এবং ফুলানীদের নিজস্ব ভাষার কিছু শব্দের মিল রয়েছে। পশুপালনের জন্য উপযুক্ত ঘাস, লতাপাতাপূর্ণ স্থানে ফুলানীরা বসতি গড়ে। কোনো স্থানের ঘাস শেষ হয়ে গেলে ওরা বসতি গুটিয়ে অন্যত্র চলে যায়। যেসব জায়গায় ফুলানীদের সংখ্যা ও সামর্থ্য বেশি সেখানে হাউসাদের ওপর ফুলানীদের আধিপত্য বিস্তার করতেও শোনা যায়।
ফুলানী নারীরা দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য বিক্রির জন্য নিকটস্থ বাজারকে বেছে নেয়। বাউচির বাজারগুলোর এক কোণে সারি বেধে বসে ফুলানী মেয়েরা দুধ, দই, মাখন বিক্রি করে। এমনকি শহরের কাছের বাসা-বাড়িতেও দুধ, মাখন বিক্রি করে জীবন কাটায়। দুধ বহন করার জন্য ফুলানী নারীরা ব্যবহার করে বিচিত্র ধরনের এক পাত্র। ওই পাত্রগুলোও মাটি কিম্বা কোনও ধাতব পদার্থের তৈরি নয়। নাইজেরিয়ার উর্বর মাটিতে জন্মানো গোলাকৃতির ‘বালাবাস’ পেঁকে গেলে কেটে দুভাগ করে ভেতরের সব ফেলে শুধু শক্ত খোলসকে শুকিয়ে তৈরি করা হয় বিশাল পাত্র। আর তাতেই দুধ নিয়ে যাওয়া হয় বিপণনের জন্য। এমনকি দুধ-মাখন উঠানোর জন্য ব্যবহৃত চামচটিও তৈরি করা হয় ছোট্ট আকারের কালাবাস দিয়ে। সৎ, সহজ-সরল ফুলানীরা তাদের শতশত বছরের পুরনো ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সুনামের সঙ্গে বসবাস করছে। এক ফুলানী নারী প্রতিদিন অর্ধ-লিটারের একটি বোতল ভরে দুধ আনতেন আমার বাসায়। ঢেলে দিতেন একটি পাত্রে। সে দুধ এত ঘন ছিলো যে ঢেলে দেয়ার পরও মনে হতো কাঁচের বোতল দুধ লেগে সাদা হয়ে আছে। আমি ওদের ভাষায় ইনিয়ে বিনিয়ে বললাম, এ দুধ বেশি ঘন বলে দুধের সমপরিমান পানি মিলিয়ে ফুটিয়ে পান করতে হতো। নইলে পেট খারাপ অনিবার্য। ফুলানী মহিলা তো অবাক। তার কথা, পানি মিশিয়ে খেলে দুধের স্বাদ বা উপকারিতা থাকে কী করে! তারা তো গরুর দুধ সরাসরি বাচ্চাদের খেতে দেয়, নিজেরা খায়। দুধের ওপরই তো বেঁচে আছে তাদের জীবন। সেদিন ফুলানী মহিলার কথার কোনো উত্তর খুঁজে পাইনি। অনেক দিন আগে ফেলে আসা ওইসব মানুষগুলোকে কোনোদিন ভোলা যাবে না। শুধু আজকের দিনে এসে রাজনৈতিক সহিংসতা আর বিপর্যস্ত অর্থনীতির বলি নাইজেরিয়ার সেই সহজ-সরল মানুষগুলোর প্রতি গভীর ভালোবাসা আর সহানুভূতি জানাই।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ও শিক্ষক]