alt

মুক্ত আলোচনা

ময়মনসিংহ-৪৯

জয়ন্তী রায়

: মঙ্গলবার, ১১ মে ২০২১

বাঙালির আড্ডা নিয়ে চমৎকার প্রবন্ধ লিখেছেন বুদ্ধদেব বসু। বুদ্ধদেব বসু গত শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকের নতুন কাব্যরীতির সূচনাকারী কবি হিসেবে বিশেষভাবে সমাদৃত। তিনি প্রবন্ধ, গল্প, নাটক এবং অনুবাদ ছাড়াও সম্পাদক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তার জন্ম বাংলাদেশে ১৯০৮ সালের ৩০ নভেম্বর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেছেন। পরে কলকাতায় স্থায়ী হয়ে ১৯৭৪ সালের ১৮ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন। তার স্ত্রী প্রতিভা বসুও লেখক হিসেবে সুখ্যাতি পেয়েছেন।

বুদ্ধদেব বসু তার আড্ডা প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘ছেলেবেলায় গুরুজনেরা আশঙ্কা করেছিলেন যে আড্ডায় আমার সর্বনাশ হবে, এখন দেখছি ওতে আমার সর্বলাভ হলো। তাই শুধু উপাসক হয়ে আমার তৃপ্তি নেই, পুরোহিত হয়ে তার মহিমা প্রচার করতে বসেছি’।

বুদ্ধদেব বসুকে আরও একটু উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না। তিনি লিখছেন, ‘আড্ডা জিনিসটা সর্বভারতীয়, কিন্তু বাংলাদেশের সজল বাতাসেই তার পূর্ণবিকাশ। আমাদের ঋতুগুলো যেমন কবিতা জাগায়, তেমনি আড্ডাও জমায়। আমাদের চৈত্রসন্ধ্যা, বর্ষার সন্ধ্যা, শরতের জ্যোৎস্না-ঢালা রাত্রি, শীতের মধুর উজ্জ্বল সকাল- সবই আড্ডার নীরব ঘণ্টা বাজিয়ে যায়, কেউ শুনতে পায়, কেউ পায় না। যেসব দেশে শীত-গ্রীষ্ম দুই অতি তীব্র, বা বছরের ছ-মাসজুড়েই শীতকাল রাজত্ব করে, সেগুলো আড্ডার পক্ষে ঠিক অনুকূল নয়। বাংলার কমনীয় আবহাওয়ায় যেমন গাছপালার ঘনতা, তেমনি আড্ডার উচ্ছ্বাসও স্বাভাবিক। ছেলেবেলা থেকে এই আড্ডার প্রেমে মজে আছি’।

হঠাৎ করে আড্ডার প্রসঙ্গ কেন মনে হলো, সে প্রশ্ন কেউ করতেই পারেন। আমার জীবনের এই শেষপ্রান্তে এসে নানা বিষয় হঠাৎ হঠাৎই মনের কোণে এসে উঁকি মারে। সংসারে আমাদের তেমন সচ্ছলতা হয়তো ছিল না, কিন্তু প্রাণ ভরা ছিল উচ্ছ্বাস, আনন্দ করার উপলক্ষ্য পেতে সমস্যা হতো না। পরিবার, পরিবেশ, পরিচিত মানুষজন সবকিছু যেন আমাদের প্রাণের আবেগের সঙ্গে মিলেমিশে গেয়েছিল। অজয় রায়ের মতো একজন রুচিবান, চিন্তাশীল, উদার এবং পরিবর্তনকামী মানুষের সঙ্গে সংসার পেতে আমি ব্যক্তিগতভাবে কত যে সমৃদ্ধ হয়েছি, তা বলে শেষ করা যাবে না। এটা আসলে বয়ান করার চেয়ে বেশি উপলব্ধি করার বিষয়। এখন অজয় রায় নেই। ছেলেমেয়েরা বিদেশ-বিভূঁইয়ে। আমার একাকী নিঃসঙ্গ জীবন। কথা বলার মতো তেমন লোকও নেই। আসলে পৃথিবীতে লোকসংখ্যা বাড়লেও কমছে মানুষের সংখ্যা। অন্যকে বোঝার মতো প্রকৃত মানুষ এখন কমে গেছে। এখন স্বার্থবুদ্ধি আমাদের এতোই তাড়িত করে যে হৃদয়বৃত্তি তার কাছে কেবলই হার মানে।

অজয় রায় রাজনীতির মানুষ ছিলেন। সাম্য চিন্তার মানুষ ছিলেন। নিজের সুখের চিন্তার চেয়ে অনেকের সুখ-শান্তির বিষয়ে বেশি ভাবতেন। ভোগে নয়, ত্যাগের আদর্শে পথ চলেছেন। তাকে বাইরে থেকে দেখে মনে হতো তিনি বুঝি অতি কাঠখোট্টা একজন গুরুগম্ভীর মানুষ। কিন্তু যারা তার সঙ্গে মিশেছেন, তার সান্নিধ্য পেয়েছেন, তারা জানেন, তিনি আসলে ছিলেন একজন অহমিকাশূন্য সহজসরল মানুষ। তিনি ছিলেন মানুষের সঙ্গপ্রিয়। যাদের সঙ্গে মতপথের মিল হতো তাদের সঙ্গে সময় কাটাতে, কথা বলতে পছন্দ করতেন। সহজ কথায় তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন আড্ডাপ্রিয় মানুষ। তবে এটা ঠিক, জীবনের শেষদিকে এসে তিনি কথা বলার মতো লোকের অভাব বোধ করতেন। তাই কলকাতা যাওয়ার জন্য তার মন চঞ্চল হয়ে উঠতো। সেখানে সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি নিয়ে যারা ভাবতেন, চিন্তা করতেন কিছুটা খোলা মনে তাদের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালোবাসতেন। এদের মধ্যে প্রগতির ধারার রাজনীবিদ যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন লেখক-গবেষক-সাংবাদিক-সাংস্কৃতিককর্মী। তিনি নিজে পড়াশোনা, লেখালেখি করতেন, তাই এমন গুণের মানুষদের প্রতিও ছিল তার স্বাভাবিক দুর্বলতা।

অজয় রায়ের জীবনসঙ্গী হওয়ার কারণে কতো মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে, কতোজনের স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছি। তাদের কথা ভেবে, মনে করে এখন আমি নিঃসঙ্গতা কাটানোর চেষ্টা করি।

অজয় রায় কমিউনিস্ট পার্টি ত্যাগ করার পর নিষ্ক্রিয় জীবন কাটাননি। তিনি প্রগতির ধারায় একটি উদার অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বৃহত্তর রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। বাম ধারার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। দিনের পর দিন অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন। এক হয়ে চলার জন্য এক ছাতার নিচে আনার চেষ্টা করেছেন। মনজুরুল আহসান খান, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, পংকজ ভট্টাচার্য, রাশেদ খান মেনন, কাজী আরিফ আহমেদ, হাসানুল হক ইনু, শরীফ গোলাম আম্বিয়া, ফজলে হোসেন বাদশা, নাজমুল হক প্রধানসহ কতজনের সঙ্গে যে তাকে কথা বলতে, আলোচনা চালিয়ে যেতে দেখেছি। আমাদের বাসায়ও অনেক সময় তারা আসতেন, কথা বলতেন, মতবিনিময় করতেন। দেশে একটি জনসমর্থনপুষ্ট বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তুলতে সফল না হওয়ার দুঃখ তার মধ্যে ছিল।

আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও অজয় রায়ের পরিচয় ও যোগাযোগ ছিল। কয়েকটি বিশেষ রাজনৈতিক সংকটের সময় শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে অজয় রায় তার মতামত তুলে ধরেছেন, তাকে সতর্কতার সঙ্গে পথ চলার পরামর্শ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহস, তেজ, দৃঢ়তা ও কৌশলের প্রশংসা করতেন অজয় রায়।

আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে অজয় রায়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সৈয়দ আশরাফ আমাদের বাসায়ও একাধিকবার এসেছেন। দীর্ঘ সময় ধরে তারা কথা বলেছেন। অজয় রায়কে সৈয়দ আশরাফ রাজনৈতিক ‘গুরু’ বলে মানতেন। কিশোরগঞ্জের মানুষ হওয়ায় ছাত্র জীবন থেকেই তিনি অজয় রায়ের সম্পর্কে জানতেন। বাম-প্রগতিশীলদের ব্যাপারে সৈয়দ আশরাফের একটি বিশেষ দুর্বলতা ছিল। একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে সৈয়দ আশরাফ বলেছিলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার সময় তিনি লন্ডনে ছিলেন। ওই মর্মান্তিক ঘটনার খবর শুনে তিনি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে লন্ডনে একটি মিছিল করার উদ্যোগ নিয়ে তার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে সৈয়দ আশরাফ বলছিলেন, বঙ্গবন্ধুর অনুসারী বলে দাবিদারদের কাউকে তিনি কাছে পাননি। ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের ধারার জনাপঞ্চাশেক মানুষ তার ডাকে সাড়া দিয়ে মিছিলে সামিল হয়েছিলেন। সৈয়দ আশরাফ এটাও স্মরণ করেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদে কিশোরগঞ্জ শহরে ১৫ আগস্টেই প্রথম যে প্রতিবাদ মিছিল হয়েছিল সেটাও বাম-প্রগতিশীলদের উদ্যোগেই। বঙ্গবন্ধুর সময় কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহসহ অন্যদের সঙ্গে যে রাজনৈতিক বোঝাপড়া ছিল এখন আওয়ামী লীগ এবং কমিউনিস্ট পার্টির সেটা নেই। এতে দেশের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির কোন উপকার হয়েছে বলে মনে হয় না।

তবে সময়কে যেমন থামিয়ে রাখা যায় না, রাজনীতিরও বুঝি বাঁকবদল ঘটেই থাকে। এক অবস্থায় সব সময় থাকে না। চলমানতা রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হওয়ায় রাজনীতিতে শত্রু-মিত্রও তাই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো নয়।

এখন রাজনীতিতে এক মত হওয়ার চেয়ে ভিন্ন মতের প্রবাহ বেশি। আড্ডার যে মেজাজ আগে ছিল, এখন আর তা অবশিষ্ট আছে কিনা প্রশ্ন সেটাই। এখন পরনিন্দা-পরচর্চা ছাড়া আর যেন আড্ডা জমে না। ঐক্য গড়ে নয়, বিভেদেই এখন আনন্দ বেশি।

আবারও ফিরে যাই বুদ্ধদেব বসুর কাছে। এই যে আজ কথা বলার মতো মানুষের আমরা অভাব বোধ করছি তার কারণ কি? আড্ডা কি কোন বারোয়ারি বিষয়, ইচ্ছে হলেই জমানো যায়? না, বুদ্ধদেব বসু বলছেন, ‘তাই বলে এমন নয় যে এলোমেলোভাবেই আড্ডা গড়ে ওঠে। নিজে অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে তার পিছনে কোন একজনের প্রচ্ছন্ন কিন্তু প্রখর রচনাশক্তি চাই। অনেকগুলি শর্ত পূরণ হলে তবে কতিপয় ব্যক্তির সমাবেশ হয়ে ওঠে’।

আড্ডা গড়ার জন্য তেমন ‘প্রখর রচনাশক্তি’ সম্পন্ন মানুষেরই যে এখন আকাল চলছে।

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

ময়মনসিংহ-৪৯

জয়ন্তী রায়

মঙ্গলবার, ১১ মে ২০২১

বাঙালির আড্ডা নিয়ে চমৎকার প্রবন্ধ লিখেছেন বুদ্ধদেব বসু। বুদ্ধদেব বসু গত শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকের নতুন কাব্যরীতির সূচনাকারী কবি হিসেবে বিশেষভাবে সমাদৃত। তিনি প্রবন্ধ, গল্প, নাটক এবং অনুবাদ ছাড়াও সম্পাদক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তার জন্ম বাংলাদেশে ১৯০৮ সালের ৩০ নভেম্বর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেছেন। পরে কলকাতায় স্থায়ী হয়ে ১৯৭৪ সালের ১৮ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন। তার স্ত্রী প্রতিভা বসুও লেখক হিসেবে সুখ্যাতি পেয়েছেন।

বুদ্ধদেব বসু তার আড্ডা প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘ছেলেবেলায় গুরুজনেরা আশঙ্কা করেছিলেন যে আড্ডায় আমার সর্বনাশ হবে, এখন দেখছি ওতে আমার সর্বলাভ হলো। তাই শুধু উপাসক হয়ে আমার তৃপ্তি নেই, পুরোহিত হয়ে তার মহিমা প্রচার করতে বসেছি’।

বুদ্ধদেব বসুকে আরও একটু উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না। তিনি লিখছেন, ‘আড্ডা জিনিসটা সর্বভারতীয়, কিন্তু বাংলাদেশের সজল বাতাসেই তার পূর্ণবিকাশ। আমাদের ঋতুগুলো যেমন কবিতা জাগায়, তেমনি আড্ডাও জমায়। আমাদের চৈত্রসন্ধ্যা, বর্ষার সন্ধ্যা, শরতের জ্যোৎস্না-ঢালা রাত্রি, শীতের মধুর উজ্জ্বল সকাল- সবই আড্ডার নীরব ঘণ্টা বাজিয়ে যায়, কেউ শুনতে পায়, কেউ পায় না। যেসব দেশে শীত-গ্রীষ্ম দুই অতি তীব্র, বা বছরের ছ-মাসজুড়েই শীতকাল রাজত্ব করে, সেগুলো আড্ডার পক্ষে ঠিক অনুকূল নয়। বাংলার কমনীয় আবহাওয়ায় যেমন গাছপালার ঘনতা, তেমনি আড্ডার উচ্ছ্বাসও স্বাভাবিক। ছেলেবেলা থেকে এই আড্ডার প্রেমে মজে আছি’।

হঠাৎ করে আড্ডার প্রসঙ্গ কেন মনে হলো, সে প্রশ্ন কেউ করতেই পারেন। আমার জীবনের এই শেষপ্রান্তে এসে নানা বিষয় হঠাৎ হঠাৎই মনের কোণে এসে উঁকি মারে। সংসারে আমাদের তেমন সচ্ছলতা হয়তো ছিল না, কিন্তু প্রাণ ভরা ছিল উচ্ছ্বাস, আনন্দ করার উপলক্ষ্য পেতে সমস্যা হতো না। পরিবার, পরিবেশ, পরিচিত মানুষজন সবকিছু যেন আমাদের প্রাণের আবেগের সঙ্গে মিলেমিশে গেয়েছিল। অজয় রায়ের মতো একজন রুচিবান, চিন্তাশীল, উদার এবং পরিবর্তনকামী মানুষের সঙ্গে সংসার পেতে আমি ব্যক্তিগতভাবে কত যে সমৃদ্ধ হয়েছি, তা বলে শেষ করা যাবে না। এটা আসলে বয়ান করার চেয়ে বেশি উপলব্ধি করার বিষয়। এখন অজয় রায় নেই। ছেলেমেয়েরা বিদেশ-বিভূঁইয়ে। আমার একাকী নিঃসঙ্গ জীবন। কথা বলার মতো তেমন লোকও নেই। আসলে পৃথিবীতে লোকসংখ্যা বাড়লেও কমছে মানুষের সংখ্যা। অন্যকে বোঝার মতো প্রকৃত মানুষ এখন কমে গেছে। এখন স্বার্থবুদ্ধি আমাদের এতোই তাড়িত করে যে হৃদয়বৃত্তি তার কাছে কেবলই হার মানে।

অজয় রায় রাজনীতির মানুষ ছিলেন। সাম্য চিন্তার মানুষ ছিলেন। নিজের সুখের চিন্তার চেয়ে অনেকের সুখ-শান্তির বিষয়ে বেশি ভাবতেন। ভোগে নয়, ত্যাগের আদর্শে পথ চলেছেন। তাকে বাইরে থেকে দেখে মনে হতো তিনি বুঝি অতি কাঠখোট্টা একজন গুরুগম্ভীর মানুষ। কিন্তু যারা তার সঙ্গে মিশেছেন, তার সান্নিধ্য পেয়েছেন, তারা জানেন, তিনি আসলে ছিলেন একজন অহমিকাশূন্য সহজসরল মানুষ। তিনি ছিলেন মানুষের সঙ্গপ্রিয়। যাদের সঙ্গে মতপথের মিল হতো তাদের সঙ্গে সময় কাটাতে, কথা বলতে পছন্দ করতেন। সহজ কথায় তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন আড্ডাপ্রিয় মানুষ। তবে এটা ঠিক, জীবনের শেষদিকে এসে তিনি কথা বলার মতো লোকের অভাব বোধ করতেন। তাই কলকাতা যাওয়ার জন্য তার মন চঞ্চল হয়ে উঠতো। সেখানে সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি নিয়ে যারা ভাবতেন, চিন্তা করতেন কিছুটা খোলা মনে তাদের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালোবাসতেন। এদের মধ্যে প্রগতির ধারার রাজনীবিদ যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন লেখক-গবেষক-সাংবাদিক-সাংস্কৃতিককর্মী। তিনি নিজে পড়াশোনা, লেখালেখি করতেন, তাই এমন গুণের মানুষদের প্রতিও ছিল তার স্বাভাবিক দুর্বলতা।

অজয় রায়ের জীবনসঙ্গী হওয়ার কারণে কতো মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে, কতোজনের স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছি। তাদের কথা ভেবে, মনে করে এখন আমি নিঃসঙ্গতা কাটানোর চেষ্টা করি।

অজয় রায় কমিউনিস্ট পার্টি ত্যাগ করার পর নিষ্ক্রিয় জীবন কাটাননি। তিনি প্রগতির ধারায় একটি উদার অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বৃহত্তর রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। বাম ধারার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। দিনের পর দিন অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন। এক হয়ে চলার জন্য এক ছাতার নিচে আনার চেষ্টা করেছেন। মনজুরুল আহসান খান, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, পংকজ ভট্টাচার্য, রাশেদ খান মেনন, কাজী আরিফ আহমেদ, হাসানুল হক ইনু, শরীফ গোলাম আম্বিয়া, ফজলে হোসেন বাদশা, নাজমুল হক প্রধানসহ কতজনের সঙ্গে যে তাকে কথা বলতে, আলোচনা চালিয়ে যেতে দেখেছি। আমাদের বাসায়ও অনেক সময় তারা আসতেন, কথা বলতেন, মতবিনিময় করতেন। দেশে একটি জনসমর্থনপুষ্ট বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তুলতে সফল না হওয়ার দুঃখ তার মধ্যে ছিল।

আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও অজয় রায়ের পরিচয় ও যোগাযোগ ছিল। কয়েকটি বিশেষ রাজনৈতিক সংকটের সময় শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে অজয় রায় তার মতামত তুলে ধরেছেন, তাকে সতর্কতার সঙ্গে পথ চলার পরামর্শ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহস, তেজ, দৃঢ়তা ও কৌশলের প্রশংসা করতেন অজয় রায়।

আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে অজয় রায়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সৈয়দ আশরাফ আমাদের বাসায়ও একাধিকবার এসেছেন। দীর্ঘ সময় ধরে তারা কথা বলেছেন। অজয় রায়কে সৈয়দ আশরাফ রাজনৈতিক ‘গুরু’ বলে মানতেন। কিশোরগঞ্জের মানুষ হওয়ায় ছাত্র জীবন থেকেই তিনি অজয় রায়ের সম্পর্কে জানতেন। বাম-প্রগতিশীলদের ব্যাপারে সৈয়দ আশরাফের একটি বিশেষ দুর্বলতা ছিল। একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে সৈয়দ আশরাফ বলেছিলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার সময় তিনি লন্ডনে ছিলেন। ওই মর্মান্তিক ঘটনার খবর শুনে তিনি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে লন্ডনে একটি মিছিল করার উদ্যোগ নিয়ে তার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে সৈয়দ আশরাফ বলছিলেন, বঙ্গবন্ধুর অনুসারী বলে দাবিদারদের কাউকে তিনি কাছে পাননি। ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের ধারার জনাপঞ্চাশেক মানুষ তার ডাকে সাড়া দিয়ে মিছিলে সামিল হয়েছিলেন। সৈয়দ আশরাফ এটাও স্মরণ করেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদে কিশোরগঞ্জ শহরে ১৫ আগস্টেই প্রথম যে প্রতিবাদ মিছিল হয়েছিল সেটাও বাম-প্রগতিশীলদের উদ্যোগেই। বঙ্গবন্ধুর সময় কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহসহ অন্যদের সঙ্গে যে রাজনৈতিক বোঝাপড়া ছিল এখন আওয়ামী লীগ এবং কমিউনিস্ট পার্টির সেটা নেই। এতে দেশের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির কোন উপকার হয়েছে বলে মনে হয় না।

তবে সময়কে যেমন থামিয়ে রাখা যায় না, রাজনীতিরও বুঝি বাঁকবদল ঘটেই থাকে। এক অবস্থায় সব সময় থাকে না। চলমানতা রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হওয়ায় রাজনীতিতে শত্রু-মিত্রও তাই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো নয়।

এখন রাজনীতিতে এক মত হওয়ার চেয়ে ভিন্ন মতের প্রবাহ বেশি। আড্ডার যে মেজাজ আগে ছিল, এখন আর তা অবশিষ্ট আছে কিনা প্রশ্ন সেটাই। এখন পরনিন্দা-পরচর্চা ছাড়া আর যেন আড্ডা জমে না। ঐক্য গড়ে নয়, বিভেদেই এখন আনন্দ বেশি।

আবারও ফিরে যাই বুদ্ধদেব বসুর কাছে। এই যে আজ কথা বলার মতো মানুষের আমরা অভাব বোধ করছি তার কারণ কি? আড্ডা কি কোন বারোয়ারি বিষয়, ইচ্ছে হলেই জমানো যায়? না, বুদ্ধদেব বসু বলছেন, ‘তাই বলে এমন নয় যে এলোমেলোভাবেই আড্ডা গড়ে ওঠে। নিজে অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে তার পিছনে কোন একজনের প্রচ্ছন্ন কিন্তু প্রখর রচনাশক্তি চাই। অনেকগুলি শর্ত পূরণ হলে তবে কতিপয় ব্যক্তির সমাবেশ হয়ে ওঠে’।

আড্ডা গড়ার জন্য তেমন ‘প্রখর রচনাশক্তি’ সম্পন্ন মানুষেরই যে এখন আকাল চলছে।

back to top