অরিত্র দাস
১.
পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী ইতিহাসে এই প্রথম আট দফায় ভোটগ্রহণ। টানা ২ মাসের বেশি সময় ধরে চলে এ নির্বাচন। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হয়েছে এবং ইতোমধ্যে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা ব্যানার্জি টানা তৃতীয়বারের মতো তার সরকার পরিচলানার জন্য শপথ গ্রহণও করেছেন। সবই ভালো খবর তবে নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস জয় লাভ করার পর পরই একটা কথা হরহামেশাই শোনা যাচ্ছে- পশ্চিমবঙ্গে অসাম্প্রদায়িকতার জয়। ধর্মনিরপেক্ষতার জয়। কথাটির সঙ্গে আমি পুরোপুরি একমত নই। একমত নই এই কারণে যে, পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার যে মেরুকরণ : এই মেরুকরণে মমতা ব্যানার্জি কি তার দায় এড়াতে পারেন? স্রোতের প্রতিকূলে হাঁটতে পারা মানুষ, অনুকূল পথে হাঁটতে তার ভারি অসুবিধা। নানা অসঙ্গতি ধরা দেয় চোখে। সোজা পথের বাঁকে লুকিয়ে থাকে নানা বক্রতা। কোন বিষয় দেখতে যত সহজ হয়, তার গভীরতা ততটাই কঠিন হয়। তাই তৃণমূলের এই সহজ জয় ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে বড় কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এবারের বিধানসভা নির্বাচন অনেক ভাবেই সংজ্ঞায়িত করা যায়। উগ্র সাম্প্রদায়িকতা রুখতে নরম সাম্প্রদায়িকতাকে মানতে বাধ্য হলো পশ্চিমবঙ্গ। অর্থাৎ বড় দানবকে রুখতে ছোট দানবকে বেছে নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। আবার এভাবেও বলা যায়- সাম্প্রদায়িকতা রুখতে মমতা ছিল বিকল্প শক্তি, তবে আস্থার প্রতীক নয়। কিংবা বলা যায়- মমতার সরকার মন্দের ভালো। কেননা পশ্চিমবঙ্গের অপামর জনগণ বরাবরই রাজনীতি সচেতন। যার কেন্দ্রস্থল- হুগলী নদীর তীরে গড়ে উঠা কলকাতা শহর। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হওয়া এ শহরটি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের গোড়া পত্তন করে। এখান থেকেই সৃষ্টি হয় বাংলার নবজাগরণ, যা পরে সমগ্র বাংলা ভাষাভাষি অঞ্চল এবং মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এখানের বৈপ্লাবিক সাংস্কৃতিক উদ্ভব, সামাজিক সংস্কার ও স্বদেশী আন্দোলন বাঙালি সমাজের মননশীলতায় আমূল পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়। যার ঢেউ থেকে বাদ যায়নি তৎকালীন পূর্ববঙ্গও, বর্তমানে বাংলাদেশ।
সেই ব্রিটিশ পিরিয়ড থেকে পরিবারের সব সদস্য মিলে একসঙ্গে রাজনীতি নিয়ে গল্প-আড্ডার প্রচলন আছে পশ্চিমবঙ্গে। তারা প্রত্যাহিক জীবনে সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে গঠনমূলক আলাপ পারতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এমন পরিবার পাওয়া হয়তো দুষ্কর, যে পরিবারে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা হয় না। মূলত এ ধারা তৈরি করেছে বাম রাজনীতি। তা আজ কলেজ স্ট্রিট-বইপাড়া-বিশ্ববিদ্যালয়-ভিক্টোরিয়া পার্ক হয়ে সর্বত্র বিস্তৃত। তাছাড়া এখানের কফি হাউজগুলো প্রায় শত বছরের বেশি পুরনো। কফি হাউজগুলোর আড্ডার একমাত্র পাঠ্যবিষয় প্রগতিশীলতা ও প্রখর মুক্তচিন্তার রাজনীতি। ধর্ম ততটা নয়। তাই তো বাঙালি বুদ্ধিজীবীর আড্ডা মানেই কলকাতার কফি হাউস।
প্রগতিশীলতার সবগুলো উপাদান এ রাজ্যটিতে বিদ্যমান রয়েছে। শত শত বছর ধরে চর্চাও হয়েছে প্রবলভাবে। তারই প্রভাব পড়েছে এইবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ভোট বাক্সে। মোট আসন ২৯৪টি। কোন একটি দল বা জোটকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে সরকার গড়তে জয়লাভ করতে হয় অন্তত ১৪৮টি আসন। সেখানে মমতা পেয়েছেন ২১৩ ভোট। এটাকে অধিকাংশ মানুষ মমতার জনপ্রিয়তার বহির্প্রকাশ হিসাবে দেখলেও আমার কেন জানি সেভাবে দেখতে মন সায় দেয় না। এটাকে অন্যভাবে দেখার সুযোগ আছে, এর পেছনে দুটো কারণ নিশ্চয়ই আছে- এক, ঝুঁিক নেয়ার ভয়। দুই, মমতাকে সংশোধনের সুযোগ।
ভয়টা কি? ভয় হলো যেভাবেই হোক এবং যে করেই হোক বিজেপিকে আটকাতে হবে, সাম্প্রদায়িকতাকে কোনভাবেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেয়া যাবে না। এমন মানসিকতা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের মধ্যে প্রবলভাবে দানা বেঁধেছে। যারা সাধারণভাবে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ছিল দলগত বা আদর্শগতভাবে, তারাও কিন্তু মমতাকে ভোট দিয়েছে এবার। কারণ বিকল্প বলতে আর তো কেউ নেই যে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে পারবে। কংগ্রেস রাজনৈতিক অঙ্গনে দুর্বল এখন ভারতজুড়ে, লোকবলও সেরকম নেই, পশ্চিমবঙ্গে তাদের অবস্থান কখনোই ভালো ছিল না, সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং পশ্চিমবঙ্গের সন্তান প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সামনে তুলে ধরেও শেষ রক্ষা হয়নি, নানা প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে পারেনি দলটি। বাকি রইল বাম রাজনৈতিক দল, যারা অতীতে ৩৪ বছর শাসন করেছে পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু তাদের মাজা ভেঙে দিয়েছে বা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে মমতা বন্দোপ্যাধ্যায়। সে কথায় আসব লেখার বাকি অংশে। সুতরাং এমনাবস্থায় কংগ্রেস বাক্সে ভোট পড়লে তা নষ্ট হবে, অপরদিকে বামফ্রন্টের বাক্সে ভোট পড়লে তাও নষ্ট হবে। মাঝখান দিয়ে ভোট কাটাকাটি হয়ে বিজেপি রাজ্য ক্ষমতায় চলে আসতে পারে। এ ঝুঁকি পশ্চিমবঙ্গের মানুষ নিতে চায়নি। তাই অপশন একটা- তৃণমূল।
এই ভয় থেকেই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে রুখতে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এক হয়েছে। আমার মনে হয়- এজন্যই তৃণমূল কংগ্রেস এত ভোট ভাগাতে পেরেছে। পশ্চিম বঙ্গের বাঙালিরা কখনোই ধর্মীয় বিভাজন, সাম্প্রদায়িকতা বা সংকীর্ণতাকে পছন্দ করে নি। এখনো করে না। জনসংঘকে আরএসএসের জারজ সন্তান বলে অভিহত করেছিলেন জওহরলাল নেহরু। ১৯৫১ তে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির নেতৃত্বে জনসংঘেরট প্রতিষ্ঠা হলেও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ পশ্চিমবঙ্গের সন্তান শ্যমাপ্রসাদকে মেনে নেননি। বরং শ্যামাপ্রসাদকে লোক চক্ষুর আড়ালে চিরতরে সরিয়ে দিয়েছিলো বাঙালিরাই। তারও অনেক আগের কথা ১৯০৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর, লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ করে, যে বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে পশ্চিমবাংলায় ধর্মীয় মেরুকরণ করতে চেষ্টা করেছিলো ইংরেজরা। ঊনবিংশ শতকের শেষ ভাগ থেকে ইংরেজরা এই হিন্দু মুসলমান পৃথকীকরণ ষড়যন্ত্রের খেলা খেলতে শুরু করে।
তাদের এ খেলা নস্যাৎ করার উদ্দেশ্যে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ঝড় হাওয়া বইতে থাকে, শুরু হয় ব্যাপক গণবিক্ষোভ। সাম্প্রদায়িকতা হটাতে শুরু হয় বিলেতি পণ্য বয়কট এবং বৃদ্ধি পেতে থাকে স্বদেশী আন্দোলনের তীব্রতা। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে বড় লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর সম্রাট পঞ্চম জর্জের মাধ্যমে বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করেন। যদিও এর ফলে কলকাতাকে অবিভক্ত ভারতবর্ষের রাজধানীর শিরোপা হারাতে হয়। গণবিক্ষোভের কারণে প্রশাসনিক কার্য সম্পাদনে ব্যাঘাত ঘটায় ১৯১১ সালে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত করা হয়। ১৯২৩ সালে ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল অ্যাক্টের অধীনে কলকাতা পৌরসংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই পৌরসংস্থার প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। এরপর অনেক মুসলিম এই পদ অলংকৃত করেছেন। ভারতের স্বাধীনতার পূর্বে আবুল কাশেম ফজলুল হক (শের-এ-বাংলা), আবদুর রহমান সিদ্দিকি, সাইদ বদরুদ্দোজা সহ অনেক মুসলমান মেয়ের হয়েছেন। সাতচল্লিশের পর মেয়র হন ফিরহাদ হাকিম।
২.
সেই মুক্তচিন্তা ও প্রগতিশীলতার বাতাবরণ থেকে পশ্চিমবঙ্গ অনেকটা সরে গেছে। এর পেছনের ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) উত্থান যেমন দায়ী, তেমনি এর দায় তৃণমূলের নেত্রী মমতা বন্দোপ্যাধ্যায় কোনভাবেই এড়াতে পারেন না। তার বর্তমান রাজনীতি পুরোপুরি পপুলিস্ট। সে সবসময় চেয়েছে একক শাসন বা এক দলীয় আধিপত্য। ভিন্ন মত শুনলেই টুঁিট চেপে ধরার প্রবণতা শুরু হয়ে যায় তার। দমন পীড়ন এক্ষেত্রে অন্যতম হাতিয়ার। বিরোধী দল দমনে চড়াও হলে বামপন্থি পরিবারের মধ্যে স্থায়ী ভাঙন শুরু হয়। মামলা-খুন-হয়রানির ভয়ে কেউ কেউ গ্রামছাড়া হয়, কেউ-বা হয় ঘরছাড়া। আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হয়ে উঠল না। পার্টি অফিস, সভা-সমাবেশ, সংগঠনের অফিস বেদখল। ফলে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে বামপন্থিরা আশ্রয় খুঁজতে লাগল তৃণমূল কংগ্রেস এবং ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) পতাকাতলে। তারুণ্যকে টানতে পারল না দলে। ম্লান হতে লাগল বাম রাজনীতির উঠে দাঁড়ানোর শক্তি। পাশাপাশি বাম সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দল, গোয়ার্তুমি এবং সেই সঙ্গে পার্টির কিছু মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত তো ছিলোই। জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী না করা, সোমেন চট্টোপাধ্যায়কে পার্টি থেকে বহিষ্কার, ২০০৪ সালে ইউপিএ সরকারে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকা অন্যতম ভুল। অন্যদিকে ভারতের স্বাধীনতাকামী দল কংগ্রেসের এমন অধঃপতন দেখে রাজ্যের কংগ্রেস নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন সময়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছে।
তৃণমূল সব দলের, সব মতের নেতাকর্মীদের সানন্দে গ্রহণ করে নিয়েছে। ফলাফল- এবার তৃণমূল প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ ভোট পেয়েছে। অন্যদিকে বিজেপি পেয়েছে ৩৬ শতাংশ। কংগ্রেস আড়াই ও সিপিএম সাড়ে চার শতাংশের মত ভোট। মমতা যা চেয়েছে তাই হয়েছে, বিরোধী শূন্য করতে পেরেছে। কিন্তু বিরোধীদের কূন্য গিয়ে মমতা আজ নিজের হাতেই সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রধান বিরোধী দলীয় শক্তিতে রূপান্তর করেছে। সাম্প্রদায়িক শক্তিকে বিরোধী শক্তি করে, সেই শক্তির আগুনে বাতাস দিয়ে নিজ দল তৃণমূল কংগ্রেসকে অবতাররূপে জনতার কাছে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে সব থেকে বড় ক্ষতিটা তাই মমতাই করেছেন। বাম এবং কংগ্রেসের জায়গায় অবতীর্ণ এখন মোদির বিজেপি। অথচ বাম সরকারের সময় বিধানসভায় ছিল না একজন বিজেপির বিধায়ক।
ভুলে গেলে চলবে না, এক সময় সাম্প্রদায়িক দলের শরিক ছিলেন মমতা বন্দোপ্যাধ্যায়। ১৯৯৯ সালে মমতা বিজেপি-নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটে শামিল হন। এ জোট সরকার থেকেই তিনি তার জীবনের প্রথম মন্ত্রীত্বের মাল্য বরণ করেন। রেলমন্ত্রী মনোনীত হন। মাঝে সম্পর্ক ছেদ ঘটে, আবার ২০০৪ সালে তিনি তার পুরানো ঘর এনডিএতে ফিরে আসে। ফিরে এসে হাতে তুলে নেয় কয়লা ও খনি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। এসময় পশ্চিমবঙ্গে ভারতীয় জনতা পার্টির আগমন ঘটে মূলত মমতার হাত ধরেই। মমতা বিজেপি’কে প্রবেশের জন্য নিজ দল থেকে কয়েকটা আসনও ছেড়ে দেন। তাই এ কথা বলার সুযোগ নেই মমতার রাজনীতিতে সংকীর্ণতার ছায়া নেই। সংকীর্ণতা আছে, আছে কৌশল, নিজের স্থায়ী আধিপত্য বিস্তারের কৌশল।
কৌশলের অংশ হিসাবেই ‘প্রগতিশীল’ পশ্চিমবঙ্গে এখন ধর্মীয় মেরুকরণই একমাত্র রাজনৈতিক মানদন্ড। প্রগতিশীল রাজ্যে স্বীকৃত প্রতিক্রিয়াশীল দলের আস্ফালন থাকলে ধর্মনিরপেক্ষতার ধোয়া তোলে আপনার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করা সহজ। তাই তৃণমূল কংগ্রেস অত্যন্ত সন্তর্পণে রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে মিশিয়েছে। মোদি যে কাজগুলো করতে চেয়েছে উগ্রভাবে, হুমকি ধামকি দিয়ে; মমতা অন্তত ঠা-া মাথায় এবং সুকৌশলে অনুরূপ কতেক কাজ একটু ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে করেছে। মমতা সরকার ‘ইমাম’ ভাতা চালু করেছে। এ দেখে হিন্দুরা যখন মনোক্ষুণœ হলো তখন ‘পুরোহিত ভাতা’ চালু করেছে। ধর্ম পালনকারী মানুষের নিজস্ব দানে চলবে এসব, সরকার কেন এ দায়িত্ব নিবে ? সরকার যখন এ দায়িত্ব নেয় তখন কিন্তু ধর্ম নিরপেক্ষ তত্ত্বটা অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। টিকে থাকে না। মন্দির এবং মসজিদ ভিত্তিক একটা রাজনীতি তৈরি হয়ে যায়। সরকারের দায়িত্ব তো নাগরিকের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া, স্বাধীনতা দেওয়া। সংবিধান যেখানে সব বিষয়ে সকলের সমানাধ্কিার দিয়েছে, সেখানে সংখ্যালঘুদের বাড়তি নজর দেওয়া মানে রাজনৈতিক গুটি হিসাবে ব্যববহার করা, সংখ্যালঘুদের নাগরিক হিসাবে দেখা নয়, করুণার দৃষ্টিতে দেখা এবং ধর্মের ভীত্তিতে উদ্বাস্তু হিসাবে গণ্য করা। সংখ্যালঘু তোষণ মমতা দির বিরুদ্ধে বরাবরই ছিল, তার প্রমাণও দেখা গেলো হুগলির তারকেশ্বরে এক নির্বাচনী জনসভায়। ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটারদের কাছে ধর্মের ভিত্তিতে ভোট চেয়েই বসলেন মমতা। প্রেক্ষিতে মমতাকে নির্বাচন কমিশনের নোটিশ। সংখ্যালঘু মুসলিমদের একজোট হয়ে ভোট দেওয়ার আবেদন জানিয়েছিলেন তিনি। এসব কি রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নয়? একবার ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদের বিরোধ হয়। এ বিরোধের কারণ- সোমনাথ মন্দির নির্মাণ। নেহরুর অভিমত এই, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ভারত। সুতরাং সরকারের খরচে কোনো মন্দির তৈরি এবং ধর্মীয় আনুষ্ঠিকতা পালন করা যাবে না। কিন্তু এ কথায় মানতে নারাজ রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ। অথচ পশ্চিমবঙ্গে মমতার তৃনমূল ফলত সেই কাজটিই করছে!
সদ্য বিধানসভা নির্বাচনের পর পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস মুখপাত্র অধীর চৌধুরী তো বলেই ফেলেছেন, মমতার সাম্প্রদায়িক প্রচারের কাছে হেরেছি। উনি বললেন, মোদিকে ঠেকাতে দিদিকে ভোট দাও। কংগ্রেস তো জন্মলগ্ন থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়েছে, এখন মোদির বিরুদ্ধে লড়ছে। অথচ মুসলমানদের বোঝাতে পারলাম না। শীতলকুচিতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে মুসলিমরা মারা গেলেন। তৃণমূল প্রচার করল, মোদি মুসলিমদের মারবে। এর মোকাবিলা আমরা করতে পারলাম না।
এ প্রসঙ্গে অন্য রাজ্যের চিত্র যদি তুলে ধরি তাহলে দেখতে পাই, মমতার মতো এমন ধর্মীয় ভাবাবেগ বা উসকানির পথে কিন্তু দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল হাঁটেননি। হেঁটেছেন পরিকাঠামোগত উন্নয়নের পথে, হেঁটেছেন নমনীয়তার পথে। নরম হিন্দুত্ব দেখিয়ে কোন হিন্দুকে তোষামোদ করেননি, তদ্রুপ উগ্র সংখ্যালঘুপ্রেম দেখিয়ে কোন মুসলমানের জন্য আলাদা মায়াকান্নাও করেননি। বিজেপি যখন দিল্লিতে ধর্মীয় মেরুকরণের প্রচেষ্টায় শাহিনবাগকে সামনে নিয়ে আসল, তখন মৌনতাকেই প্রধান অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কারণ কথায় কথা বাড়ে, তর্কে বাড়ে বিতর্ক এবং অবশেষে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি। উল্টো তিনি দিল্লির শিক্ষার উপর জোর দিয়েছেন, জোর দিয়েছেন দিল্লির রাস্তা-ঘাট, অর্থনীতি, সামাজিক মূলবোধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর। প্রতিটি মহল্লায় তৈরি করেছেন ‘মহল্লা ক্লিনিং’। মহিলাদের সুরক্ষার জন্য ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে- পাড়ায় পাড়ায় মার্শাল নিয়োগ। গণপরিবহনে মহিলাদের জন্য ভাড়া কমিয়েছে, উপরন্তু বাড়িতে ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ফ্রি। তাই বলে মমতা বন্দোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে উন্নয়নের কাজ করেন নি তা কিন্তু নয়। সবুজসাথী, শিশুসাথী, গীতাঞ্জলি, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, স্বাস্থ্যসাথীর মতো অনেক কাজ করেছেন। বিশেষ করে মহিলাদের গুরুত্ব দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তাই নারীদের সিংহভাগ ভোট মমতাই পেয়েছে, এতে তো কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়।
কিন্তু মমতা এই উন্নয়নের সঙ্গে ধর্মীয় ভাবাবেগও বাতাস দিয়েছে। বাতাস দিয়ে বুঝাতে চেয়েছে, সাম্প্রদায়িকতা এখানে অনিবার্য, তাই দাঙ্গা থেকে বাঁচতে আমাকে ভোট দাও। একটা ঘটনা বলি, বসিরহাটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। রাম নবমীকে কেন্দ্র করে এ ঘটনা। বিজেপির নেতৃত্বে রাম-নবমীর মিছিল রুখতে মুসলিম মহল্লায় মমতার ইশারায় একটি মিছিল বের করা হয়। কিন্তু কথা হলো বশিরহাটের মতো মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় কেন প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে মিছিল বের করতে হবে? তাছাড়া এক মিছিল দিয়ে অন্য মিছিলকে কখনোই প্রতিহত করা যায় না। ফলে লেগে যায় দাঙ্গা। এ ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মনে দাগ কাটে। প্রতীয়মান হয়- পূর্বে কখনোই হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজন এত প্রকট ছিল না। বিজেপি’র পালে হাওয়া দিয়ে তৃণমূলের কর্মকাণ্ডে কৌশলগত সাম্প্রদায়িকতা এভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠে। আরো একটি ঘটনা বলি, দুর্গাপুজোয় প্রতিমা বিসর্জন। মমতার সরকার প্রজ্ঞাপণ জারি করে বলল, ‘একাদশীর দিন মুসলিম সম্প্রদায়ের মহরম। তাই ওইদিন প্রতিমা বিসর্জন করা যাবে না। ’ কিন্তু মহরমের দিনে প্রতিমা বিসর্জন কোন অসুবিধা তৈরি হয় না। কারণ মহরম মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে ঈদ বা তাজিয়া মিছিলের মতো জাঁকজমকপূর্ণ নয়। এই দিন মুসলিমরা দলে দলে বাইরে বের হয়ে আসেন না, মোলাকাত করেন না। তাই কলকাতা হাইকোর্ট তাৎক্ষণিক এ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করে প্রতিমা বিসর্জনের নির্দেশ দেয়। নেটিজেনরা এ নিয়ে মমতার তুমুল সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
বস্তুত এভাবেই মমতা সুকৌশলে হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায় দুটোকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে প্রায় সময়ই। এক্ষেত্রে মোদি ছিল উগ্রপন্থি এবং মমতা কিছুটা নরমপন্থি। মমতা কথায় কথায় মুসলমান মুসলমান করেছে ঠিকই কিন্তু মুসলিম সম্প্রদায়ের সামাজিক, মানব-সম্পদ ও শিক্ষার জায়গা নিয়ে কখনোই কাজ করেননি। মুখে মুখে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের তোয়াজ করে তাদের হাতে রেখেছে মাত্র। অসাম্প্রদায়িকতার ধোয়া তুলতে গিয়ে অযথাই ‘ইনশাআল্লাহ’ দিয়ে ভাষণ শুরু করার প্রেক্ষিতে রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতারই একটা প্রলেপ অঙ্কিত করেছে। যা উগ্র জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী বিজেপির জনসমর্থন পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। ব্যালট পেপারের হিসাবে কিন্তু মোদিই জয়ী। সংখ্যালঘুর ৩০ শতাংশ ভোট তো মমতাই পেয়েছে, তা বাদ দিলে বাকি থাকে ৭০ শতাংশ ভোট। সেখানে মোদি পেয়েছে ৩৬ শতাংশ ভোট। ২০১৬ সালে বিধানসভায় এই প্রগতিশীল রাজ্যে দলটি আসন পেয়েছে ৩টি। ২০২১ সালে এসে ৭৭টি আসন। রাজ্যের শক্তিশালী বিরোধী দল এখন বিজেপি।
বিজেপির হিন্দুত্ববাদের পালে হাওয়া দেয়া ছাড়াও মমতা পশ্চিমবঙ্গের ‘হিন্দু সংহতি’র সঙ্গে আঁতাত করেছে। তিলে তিলে গড়ে ওঠা নব্য ‘ইসলামী মৌলবাদকেও’ প্রশ্রয় দিয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ বিরোধী অনেকে পাড়ি জমিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। এরা বঙ্গবন্ধুর ঘোর বিরোধী। দীর্ঘদিন অবস্থান করায় আস্তে আস্তে নিজেদের অবস্থান শক্ত করেছে। পশ্চিমবঙ্গের প্রসাশনেও তাদের বিস্তৃতি ঘটেছে। তসলিমা নাসরিনকে কলকাতা থেকে বিতাড়িত করার জন্য ইদ্রিস আলী নামের একজন মুসলিম ধর্মীয় নেতা উসকানি হামলা ও হাঙ্গামা করেছিল। মমতা ব্যানার্জি তাকে সমর্থন দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস থেকে সাংসদও বানিয়েছেন। এগুলো প্রগতিশীলতা এবং গণতন্ত্রের জন্য হুমকি বৈকি কিছু নয়। তৃণমূল ক্ষমতা ও স্বার্থের বৃত্তে এক প্রবঞ্চক মাকড়সা।
৩.
মমতার তৃণমূল কংগ্রেস এক দশক রাজ্য শাসন করছে, নতুন করে তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়- পশ্চিমবঙ্গ খুব একটা উন্নতি করছে তা কিন্ত নয়। বরং কৃষকেরা ভালো নেই। ফসলের দাম নেই, আত্মহত্যা করছে। বড় ধরণের কোন শিল্প কারখানা নেই। মাঝারি শিল্প ইন্ডাস্ট্রিগুলো সাফল্য পাচ্ছে না। ছোট শিল্পগুলো মরে যাচ্ছে, বেকারত্ব বাড়ছে। সরকারি দপ্তরে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নেই। ছেলেমেয়েগুলো পড়াশুনা করছে, প্রযুক্তি শিখছে কিন্তু চাকরি পাচ্ছে না। সেই সঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি, তোষামদ, সিন্ডিকেটসহ একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। রয়েছে দলটির মাথার উপর সারদা কেলেঙ্কারির মত ঘটনাও। এতে বার বার উঠে এসেছে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নাম। এ সবকিছুই পশ্চিমবঙ্গ রাজনীতি সচেতন মানুষের মনে আছে। সবকিছু মনে রেখেই তারা মমতার তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছে, কতগুলো আলোচ্য বিষয় সামনে রেখে- প্রথমত ধর্মনিরপেক্ষতা, দ্বিতীয়ত বাঙালি সংস্কৃতি এবং তৃতীয়ত সাম্প্রদায়িকতার অবসান এবং চতুর্থত তিস্তা।
এই পশ্চিমবঙ্গেই ১৯৪৬ সালে ঘটেছে রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক ইতিহাস- দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস। তাই তারা অতীতের পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ অসাম্প্রদীয়কতাকে আকড়ে ধরে থাকতে চায়। এক্ষেত্রে বলবো, সংকীর্ণতাকে উপেক্ষা করে বাম এবং কংগ্রেস যে মনস্তাত্ত্বিক ভিত তৈরি করে দিয়ে গেছে, তার সুফল ভোগ করছে এখন মমতা।
বিগত ৫ বছরে মমতার পপুলিস্ট রাজনীতি দেখে আমার তাই মনে হয়- এবারের নির্বাচনে আদর্শগত অবস্থানের দিক থেকে নয়, ‘বাঙালিত্ব’ ও ‘অসাম্প্রদায়িকতা’ শব্দ দুটিতে তৃণমূল মূলত জোর দিয়েছে এ কারণে যে, প্রগতিশীল পশ্চিমবঙ্গে সমগ্র বাঙালি এই দুই শব্দের পাদদেশে এক ও অভিন্ন। বাঙালি নাকি অবাঙালি- এ প্রশ্নে বাঙালি সর্বাগ্রে এগিয়ে থাকবে, জয় বাংলা। তাই এবারের নির্বাচনে যদি বাম ফ্রন্ট সরকার গঠন করত তবে ধরে নিতাম, এ নির্বাচন সংকীর্ণ হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে অসাম্প্রায়িক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক আদর্শের জয়। বাম ও কংগ্রেস দেউলিয়ার পথে, অন্যদিকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী প্রগতিশীল কোন সক্রিয় দল না থাকায় মমতাকে ভোট দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। আর এ কারণে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে মমতা তার পপুলিস্ট রাজনীতি থেকে সরে এসে নিজেকে সংশোধন করারও একটা সুযোগ পেয়েছে হাতে।
এ অঞ্চলে সংকীর্ণ প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির যে দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে, তার ধারাবাহিক অবস্থান অব্যাহত থাকবে কি থাকবে না তা নির্ভর করবে আগামী দিনে তৃণমূলের বাস্তবমুখী পদক্ষেপ, আঞ্চলিক মনোভাবের পাশাপাশি উদার আন্তর্জাতিক মনোভাব, গণতান্ত্রিক নীতি, অসাম্প্রদায়িক আচরণের ওপর। মমতা যদি নিজেকে সংশোধন করে তবে ভালো, আর না করে তবে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন এবং ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন মমতা বন্দোপ্যাধ্যায়কে চরম ভোগাবে। সেই সঙ্গে ভোগাবে পশ্চিমবঙ্গের জনগণকেও।
[ লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ]
অরিত্র দাস
মঙ্গলবার, ১৮ মে ২০২১
১.
পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী ইতিহাসে এই প্রথম আট দফায় ভোটগ্রহণ। টানা ২ মাসের বেশি সময় ধরে চলে এ নির্বাচন। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হয়েছে এবং ইতোমধ্যে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা ব্যানার্জি টানা তৃতীয়বারের মতো তার সরকার পরিচলানার জন্য শপথ গ্রহণও করেছেন। সবই ভালো খবর তবে নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস জয় লাভ করার পর পরই একটা কথা হরহামেশাই শোনা যাচ্ছে- পশ্চিমবঙ্গে অসাম্প্রদায়িকতার জয়। ধর্মনিরপেক্ষতার জয়। কথাটির সঙ্গে আমি পুরোপুরি একমত নই। একমত নই এই কারণে যে, পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার যে মেরুকরণ : এই মেরুকরণে মমতা ব্যানার্জি কি তার দায় এড়াতে পারেন? স্রোতের প্রতিকূলে হাঁটতে পারা মানুষ, অনুকূল পথে হাঁটতে তার ভারি অসুবিধা। নানা অসঙ্গতি ধরা দেয় চোখে। সোজা পথের বাঁকে লুকিয়ে থাকে নানা বক্রতা। কোন বিষয় দেখতে যত সহজ হয়, তার গভীরতা ততটাই কঠিন হয়। তাই তৃণমূলের এই সহজ জয় ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে বড় কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এবারের বিধানসভা নির্বাচন অনেক ভাবেই সংজ্ঞায়িত করা যায়। উগ্র সাম্প্রদায়িকতা রুখতে নরম সাম্প্রদায়িকতাকে মানতে বাধ্য হলো পশ্চিমবঙ্গ। অর্থাৎ বড় দানবকে রুখতে ছোট দানবকে বেছে নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। আবার এভাবেও বলা যায়- সাম্প্রদায়িকতা রুখতে মমতা ছিল বিকল্প শক্তি, তবে আস্থার প্রতীক নয়। কিংবা বলা যায়- মমতার সরকার মন্দের ভালো। কেননা পশ্চিমবঙ্গের অপামর জনগণ বরাবরই রাজনীতি সচেতন। যার কেন্দ্রস্থল- হুগলী নদীর তীরে গড়ে উঠা কলকাতা শহর। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হওয়া এ শহরটি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের গোড়া পত্তন করে। এখান থেকেই সৃষ্টি হয় বাংলার নবজাগরণ, যা পরে সমগ্র বাংলা ভাষাভাষি অঞ্চল এবং মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এখানের বৈপ্লাবিক সাংস্কৃতিক উদ্ভব, সামাজিক সংস্কার ও স্বদেশী আন্দোলন বাঙালি সমাজের মননশীলতায় আমূল পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়। যার ঢেউ থেকে বাদ যায়নি তৎকালীন পূর্ববঙ্গও, বর্তমানে বাংলাদেশ।
সেই ব্রিটিশ পিরিয়ড থেকে পরিবারের সব সদস্য মিলে একসঙ্গে রাজনীতি নিয়ে গল্প-আড্ডার প্রচলন আছে পশ্চিমবঙ্গে। তারা প্রত্যাহিক জীবনে সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে গঠনমূলক আলাপ পারতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এমন পরিবার পাওয়া হয়তো দুষ্কর, যে পরিবারে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা হয় না। মূলত এ ধারা তৈরি করেছে বাম রাজনীতি। তা আজ কলেজ স্ট্রিট-বইপাড়া-বিশ্ববিদ্যালয়-ভিক্টোরিয়া পার্ক হয়ে সর্বত্র বিস্তৃত। তাছাড়া এখানের কফি হাউজগুলো প্রায় শত বছরের বেশি পুরনো। কফি হাউজগুলোর আড্ডার একমাত্র পাঠ্যবিষয় প্রগতিশীলতা ও প্রখর মুক্তচিন্তার রাজনীতি। ধর্ম ততটা নয়। তাই তো বাঙালি বুদ্ধিজীবীর আড্ডা মানেই কলকাতার কফি হাউস।
প্রগতিশীলতার সবগুলো উপাদান এ রাজ্যটিতে বিদ্যমান রয়েছে। শত শত বছর ধরে চর্চাও হয়েছে প্রবলভাবে। তারই প্রভাব পড়েছে এইবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ভোট বাক্সে। মোট আসন ২৯৪টি। কোন একটি দল বা জোটকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে সরকার গড়তে জয়লাভ করতে হয় অন্তত ১৪৮টি আসন। সেখানে মমতা পেয়েছেন ২১৩ ভোট। এটাকে অধিকাংশ মানুষ মমতার জনপ্রিয়তার বহির্প্রকাশ হিসাবে দেখলেও আমার কেন জানি সেভাবে দেখতে মন সায় দেয় না। এটাকে অন্যভাবে দেখার সুযোগ আছে, এর পেছনে দুটো কারণ নিশ্চয়ই আছে- এক, ঝুঁিক নেয়ার ভয়। দুই, মমতাকে সংশোধনের সুযোগ।
ভয়টা কি? ভয় হলো যেভাবেই হোক এবং যে করেই হোক বিজেপিকে আটকাতে হবে, সাম্প্রদায়িকতাকে কোনভাবেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেয়া যাবে না। এমন মানসিকতা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের মধ্যে প্রবলভাবে দানা বেঁধেছে। যারা সাধারণভাবে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ছিল দলগত বা আদর্শগতভাবে, তারাও কিন্তু মমতাকে ভোট দিয়েছে এবার। কারণ বিকল্প বলতে আর তো কেউ নেই যে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে পারবে। কংগ্রেস রাজনৈতিক অঙ্গনে দুর্বল এখন ভারতজুড়ে, লোকবলও সেরকম নেই, পশ্চিমবঙ্গে তাদের অবস্থান কখনোই ভালো ছিল না, সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং পশ্চিমবঙ্গের সন্তান প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সামনে তুলে ধরেও শেষ রক্ষা হয়নি, নানা প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে পারেনি দলটি। বাকি রইল বাম রাজনৈতিক দল, যারা অতীতে ৩৪ বছর শাসন করেছে পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু তাদের মাজা ভেঙে দিয়েছে বা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে মমতা বন্দোপ্যাধ্যায়। সে কথায় আসব লেখার বাকি অংশে। সুতরাং এমনাবস্থায় কংগ্রেস বাক্সে ভোট পড়লে তা নষ্ট হবে, অপরদিকে বামফ্রন্টের বাক্সে ভোট পড়লে তাও নষ্ট হবে। মাঝখান দিয়ে ভোট কাটাকাটি হয়ে বিজেপি রাজ্য ক্ষমতায় চলে আসতে পারে। এ ঝুঁকি পশ্চিমবঙ্গের মানুষ নিতে চায়নি। তাই অপশন একটা- তৃণমূল।
এই ভয় থেকেই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে রুখতে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এক হয়েছে। আমার মনে হয়- এজন্যই তৃণমূল কংগ্রেস এত ভোট ভাগাতে পেরেছে। পশ্চিম বঙ্গের বাঙালিরা কখনোই ধর্মীয় বিভাজন, সাম্প্রদায়িকতা বা সংকীর্ণতাকে পছন্দ করে নি। এখনো করে না। জনসংঘকে আরএসএসের জারজ সন্তান বলে অভিহত করেছিলেন জওহরলাল নেহরু। ১৯৫১ তে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির নেতৃত্বে জনসংঘেরট প্রতিষ্ঠা হলেও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ পশ্চিমবঙ্গের সন্তান শ্যমাপ্রসাদকে মেনে নেননি। বরং শ্যামাপ্রসাদকে লোক চক্ষুর আড়ালে চিরতরে সরিয়ে দিয়েছিলো বাঙালিরাই। তারও অনেক আগের কথা ১৯০৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর, লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ করে, যে বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে পশ্চিমবাংলায় ধর্মীয় মেরুকরণ করতে চেষ্টা করেছিলো ইংরেজরা। ঊনবিংশ শতকের শেষ ভাগ থেকে ইংরেজরা এই হিন্দু মুসলমান পৃথকীকরণ ষড়যন্ত্রের খেলা খেলতে শুরু করে।
তাদের এ খেলা নস্যাৎ করার উদ্দেশ্যে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ঝড় হাওয়া বইতে থাকে, শুরু হয় ব্যাপক গণবিক্ষোভ। সাম্প্রদায়িকতা হটাতে শুরু হয় বিলেতি পণ্য বয়কট এবং বৃদ্ধি পেতে থাকে স্বদেশী আন্দোলনের তীব্রতা। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে বড় লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর সম্রাট পঞ্চম জর্জের মাধ্যমে বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করেন। যদিও এর ফলে কলকাতাকে অবিভক্ত ভারতবর্ষের রাজধানীর শিরোপা হারাতে হয়। গণবিক্ষোভের কারণে প্রশাসনিক কার্য সম্পাদনে ব্যাঘাত ঘটায় ১৯১১ সালে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত করা হয়। ১৯২৩ সালে ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল অ্যাক্টের অধীনে কলকাতা পৌরসংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই পৌরসংস্থার প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। এরপর অনেক মুসলিম এই পদ অলংকৃত করেছেন। ভারতের স্বাধীনতার পূর্বে আবুল কাশেম ফজলুল হক (শের-এ-বাংলা), আবদুর রহমান সিদ্দিকি, সাইদ বদরুদ্দোজা সহ অনেক মুসলমান মেয়ের হয়েছেন। সাতচল্লিশের পর মেয়র হন ফিরহাদ হাকিম।
২.
সেই মুক্তচিন্তা ও প্রগতিশীলতার বাতাবরণ থেকে পশ্চিমবঙ্গ অনেকটা সরে গেছে। এর পেছনের ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) উত্থান যেমন দায়ী, তেমনি এর দায় তৃণমূলের নেত্রী মমতা বন্দোপ্যাধ্যায় কোনভাবেই এড়াতে পারেন না। তার বর্তমান রাজনীতি পুরোপুরি পপুলিস্ট। সে সবসময় চেয়েছে একক শাসন বা এক দলীয় আধিপত্য। ভিন্ন মত শুনলেই টুঁিট চেপে ধরার প্রবণতা শুরু হয়ে যায় তার। দমন পীড়ন এক্ষেত্রে অন্যতম হাতিয়ার। বিরোধী দল দমনে চড়াও হলে বামপন্থি পরিবারের মধ্যে স্থায়ী ভাঙন শুরু হয়। মামলা-খুন-হয়রানির ভয়ে কেউ কেউ গ্রামছাড়া হয়, কেউ-বা হয় ঘরছাড়া। আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হয়ে উঠল না। পার্টি অফিস, সভা-সমাবেশ, সংগঠনের অফিস বেদখল। ফলে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে বামপন্থিরা আশ্রয় খুঁজতে লাগল তৃণমূল কংগ্রেস এবং ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) পতাকাতলে। তারুণ্যকে টানতে পারল না দলে। ম্লান হতে লাগল বাম রাজনীতির উঠে দাঁড়ানোর শক্তি। পাশাপাশি বাম সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দল, গোয়ার্তুমি এবং সেই সঙ্গে পার্টির কিছু মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত তো ছিলোই। জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী না করা, সোমেন চট্টোপাধ্যায়কে পার্টি থেকে বহিষ্কার, ২০০৪ সালে ইউপিএ সরকারে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকা অন্যতম ভুল। অন্যদিকে ভারতের স্বাধীনতাকামী দল কংগ্রেসের এমন অধঃপতন দেখে রাজ্যের কংগ্রেস নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন সময়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছে।
তৃণমূল সব দলের, সব মতের নেতাকর্মীদের সানন্দে গ্রহণ করে নিয়েছে। ফলাফল- এবার তৃণমূল প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ ভোট পেয়েছে। অন্যদিকে বিজেপি পেয়েছে ৩৬ শতাংশ। কংগ্রেস আড়াই ও সিপিএম সাড়ে চার শতাংশের মত ভোট। মমতা যা চেয়েছে তাই হয়েছে, বিরোধী শূন্য করতে পেরেছে। কিন্তু বিরোধীদের কূন্য গিয়ে মমতা আজ নিজের হাতেই সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রধান বিরোধী দলীয় শক্তিতে রূপান্তর করেছে। সাম্প্রদায়িক শক্তিকে বিরোধী শক্তি করে, সেই শক্তির আগুনে বাতাস দিয়ে নিজ দল তৃণমূল কংগ্রেসকে অবতাররূপে জনতার কাছে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে সব থেকে বড় ক্ষতিটা তাই মমতাই করেছেন। বাম এবং কংগ্রেসের জায়গায় অবতীর্ণ এখন মোদির বিজেপি। অথচ বাম সরকারের সময় বিধানসভায় ছিল না একজন বিজেপির বিধায়ক।
ভুলে গেলে চলবে না, এক সময় সাম্প্রদায়িক দলের শরিক ছিলেন মমতা বন্দোপ্যাধ্যায়। ১৯৯৯ সালে মমতা বিজেপি-নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটে শামিল হন। এ জোট সরকার থেকেই তিনি তার জীবনের প্রথম মন্ত্রীত্বের মাল্য বরণ করেন। রেলমন্ত্রী মনোনীত হন। মাঝে সম্পর্ক ছেদ ঘটে, আবার ২০০৪ সালে তিনি তার পুরানো ঘর এনডিএতে ফিরে আসে। ফিরে এসে হাতে তুলে নেয় কয়লা ও খনি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। এসময় পশ্চিমবঙ্গে ভারতীয় জনতা পার্টির আগমন ঘটে মূলত মমতার হাত ধরেই। মমতা বিজেপি’কে প্রবেশের জন্য নিজ দল থেকে কয়েকটা আসনও ছেড়ে দেন। তাই এ কথা বলার সুযোগ নেই মমতার রাজনীতিতে সংকীর্ণতার ছায়া নেই। সংকীর্ণতা আছে, আছে কৌশল, নিজের স্থায়ী আধিপত্য বিস্তারের কৌশল।
কৌশলের অংশ হিসাবেই ‘প্রগতিশীল’ পশ্চিমবঙ্গে এখন ধর্মীয় মেরুকরণই একমাত্র রাজনৈতিক মানদন্ড। প্রগতিশীল রাজ্যে স্বীকৃত প্রতিক্রিয়াশীল দলের আস্ফালন থাকলে ধর্মনিরপেক্ষতার ধোয়া তোলে আপনার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করা সহজ। তাই তৃণমূল কংগ্রেস অত্যন্ত সন্তর্পণে রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে মিশিয়েছে। মোদি যে কাজগুলো করতে চেয়েছে উগ্রভাবে, হুমকি ধামকি দিয়ে; মমতা অন্তত ঠা-া মাথায় এবং সুকৌশলে অনুরূপ কতেক কাজ একটু ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে করেছে। মমতা সরকার ‘ইমাম’ ভাতা চালু করেছে। এ দেখে হিন্দুরা যখন মনোক্ষুণœ হলো তখন ‘পুরোহিত ভাতা’ চালু করেছে। ধর্ম পালনকারী মানুষের নিজস্ব দানে চলবে এসব, সরকার কেন এ দায়িত্ব নিবে ? সরকার যখন এ দায়িত্ব নেয় তখন কিন্তু ধর্ম নিরপেক্ষ তত্ত্বটা অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। টিকে থাকে না। মন্দির এবং মসজিদ ভিত্তিক একটা রাজনীতি তৈরি হয়ে যায়। সরকারের দায়িত্ব তো নাগরিকের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া, স্বাধীনতা দেওয়া। সংবিধান যেখানে সব বিষয়ে সকলের সমানাধ্কিার দিয়েছে, সেখানে সংখ্যালঘুদের বাড়তি নজর দেওয়া মানে রাজনৈতিক গুটি হিসাবে ব্যববহার করা, সংখ্যালঘুদের নাগরিক হিসাবে দেখা নয়, করুণার দৃষ্টিতে দেখা এবং ধর্মের ভীত্তিতে উদ্বাস্তু হিসাবে গণ্য করা। সংখ্যালঘু তোষণ মমতা দির বিরুদ্ধে বরাবরই ছিল, তার প্রমাণও দেখা গেলো হুগলির তারকেশ্বরে এক নির্বাচনী জনসভায়। ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটারদের কাছে ধর্মের ভিত্তিতে ভোট চেয়েই বসলেন মমতা। প্রেক্ষিতে মমতাকে নির্বাচন কমিশনের নোটিশ। সংখ্যালঘু মুসলিমদের একজোট হয়ে ভোট দেওয়ার আবেদন জানিয়েছিলেন তিনি। এসব কি রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নয়? একবার ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদের বিরোধ হয়। এ বিরোধের কারণ- সোমনাথ মন্দির নির্মাণ। নেহরুর অভিমত এই, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ভারত। সুতরাং সরকারের খরচে কোনো মন্দির তৈরি এবং ধর্মীয় আনুষ্ঠিকতা পালন করা যাবে না। কিন্তু এ কথায় মানতে নারাজ রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ। অথচ পশ্চিমবঙ্গে মমতার তৃনমূল ফলত সেই কাজটিই করছে!
সদ্য বিধানসভা নির্বাচনের পর পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস মুখপাত্র অধীর চৌধুরী তো বলেই ফেলেছেন, মমতার সাম্প্রদায়িক প্রচারের কাছে হেরেছি। উনি বললেন, মোদিকে ঠেকাতে দিদিকে ভোট দাও। কংগ্রেস তো জন্মলগ্ন থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়েছে, এখন মোদির বিরুদ্ধে লড়ছে। অথচ মুসলমানদের বোঝাতে পারলাম না। শীতলকুচিতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে মুসলিমরা মারা গেলেন। তৃণমূল প্রচার করল, মোদি মুসলিমদের মারবে। এর মোকাবিলা আমরা করতে পারলাম না।
এ প্রসঙ্গে অন্য রাজ্যের চিত্র যদি তুলে ধরি তাহলে দেখতে পাই, মমতার মতো এমন ধর্মীয় ভাবাবেগ বা উসকানির পথে কিন্তু দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল হাঁটেননি। হেঁটেছেন পরিকাঠামোগত উন্নয়নের পথে, হেঁটেছেন নমনীয়তার পথে। নরম হিন্দুত্ব দেখিয়ে কোন হিন্দুকে তোষামোদ করেননি, তদ্রুপ উগ্র সংখ্যালঘুপ্রেম দেখিয়ে কোন মুসলমানের জন্য আলাদা মায়াকান্নাও করেননি। বিজেপি যখন দিল্লিতে ধর্মীয় মেরুকরণের প্রচেষ্টায় শাহিনবাগকে সামনে নিয়ে আসল, তখন মৌনতাকেই প্রধান অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কারণ কথায় কথা বাড়ে, তর্কে বাড়ে বিতর্ক এবং অবশেষে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি। উল্টো তিনি দিল্লির শিক্ষার উপর জোর দিয়েছেন, জোর দিয়েছেন দিল্লির রাস্তা-ঘাট, অর্থনীতি, সামাজিক মূলবোধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর। প্রতিটি মহল্লায় তৈরি করেছেন ‘মহল্লা ক্লিনিং’। মহিলাদের সুরক্ষার জন্য ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে- পাড়ায় পাড়ায় মার্শাল নিয়োগ। গণপরিবহনে মহিলাদের জন্য ভাড়া কমিয়েছে, উপরন্তু বাড়িতে ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ফ্রি। তাই বলে মমতা বন্দোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে উন্নয়নের কাজ করেন নি তা কিন্তু নয়। সবুজসাথী, শিশুসাথী, গীতাঞ্জলি, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, স্বাস্থ্যসাথীর মতো অনেক কাজ করেছেন। বিশেষ করে মহিলাদের গুরুত্ব দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তাই নারীদের সিংহভাগ ভোট মমতাই পেয়েছে, এতে তো কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়।
কিন্তু মমতা এই উন্নয়নের সঙ্গে ধর্মীয় ভাবাবেগও বাতাস দিয়েছে। বাতাস দিয়ে বুঝাতে চেয়েছে, সাম্প্রদায়িকতা এখানে অনিবার্য, তাই দাঙ্গা থেকে বাঁচতে আমাকে ভোট দাও। একটা ঘটনা বলি, বসিরহাটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। রাম নবমীকে কেন্দ্র করে এ ঘটনা। বিজেপির নেতৃত্বে রাম-নবমীর মিছিল রুখতে মুসলিম মহল্লায় মমতার ইশারায় একটি মিছিল বের করা হয়। কিন্তু কথা হলো বশিরহাটের মতো মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় কেন প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে মিছিল বের করতে হবে? তাছাড়া এক মিছিল দিয়ে অন্য মিছিলকে কখনোই প্রতিহত করা যায় না। ফলে লেগে যায় দাঙ্গা। এ ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মনে দাগ কাটে। প্রতীয়মান হয়- পূর্বে কখনোই হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজন এত প্রকট ছিল না। বিজেপি’র পালে হাওয়া দিয়ে তৃণমূলের কর্মকাণ্ডে কৌশলগত সাম্প্রদায়িকতা এভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠে। আরো একটি ঘটনা বলি, দুর্গাপুজোয় প্রতিমা বিসর্জন। মমতার সরকার প্রজ্ঞাপণ জারি করে বলল, ‘একাদশীর দিন মুসলিম সম্প্রদায়ের মহরম। তাই ওইদিন প্রতিমা বিসর্জন করা যাবে না। ’ কিন্তু মহরমের দিনে প্রতিমা বিসর্জন কোন অসুবিধা তৈরি হয় না। কারণ মহরম মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে ঈদ বা তাজিয়া মিছিলের মতো জাঁকজমকপূর্ণ নয়। এই দিন মুসলিমরা দলে দলে বাইরে বের হয়ে আসেন না, মোলাকাত করেন না। তাই কলকাতা হাইকোর্ট তাৎক্ষণিক এ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করে প্রতিমা বিসর্জনের নির্দেশ দেয়। নেটিজেনরা এ নিয়ে মমতার তুমুল সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
বস্তুত এভাবেই মমতা সুকৌশলে হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায় দুটোকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে প্রায় সময়ই। এক্ষেত্রে মোদি ছিল উগ্রপন্থি এবং মমতা কিছুটা নরমপন্থি। মমতা কথায় কথায় মুসলমান মুসলমান করেছে ঠিকই কিন্তু মুসলিম সম্প্রদায়ের সামাজিক, মানব-সম্পদ ও শিক্ষার জায়গা নিয়ে কখনোই কাজ করেননি। মুখে মুখে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের তোয়াজ করে তাদের হাতে রেখেছে মাত্র। অসাম্প্রদায়িকতার ধোয়া তুলতে গিয়ে অযথাই ‘ইনশাআল্লাহ’ দিয়ে ভাষণ শুরু করার প্রেক্ষিতে রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতারই একটা প্রলেপ অঙ্কিত করেছে। যা উগ্র জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী বিজেপির জনসমর্থন পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। ব্যালট পেপারের হিসাবে কিন্তু মোদিই জয়ী। সংখ্যালঘুর ৩০ শতাংশ ভোট তো মমতাই পেয়েছে, তা বাদ দিলে বাকি থাকে ৭০ শতাংশ ভোট। সেখানে মোদি পেয়েছে ৩৬ শতাংশ ভোট। ২০১৬ সালে বিধানসভায় এই প্রগতিশীল রাজ্যে দলটি আসন পেয়েছে ৩টি। ২০২১ সালে এসে ৭৭টি আসন। রাজ্যের শক্তিশালী বিরোধী দল এখন বিজেপি।
বিজেপির হিন্দুত্ববাদের পালে হাওয়া দেয়া ছাড়াও মমতা পশ্চিমবঙ্গের ‘হিন্দু সংহতি’র সঙ্গে আঁতাত করেছে। তিলে তিলে গড়ে ওঠা নব্য ‘ইসলামী মৌলবাদকেও’ প্রশ্রয় দিয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ বিরোধী অনেকে পাড়ি জমিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। এরা বঙ্গবন্ধুর ঘোর বিরোধী। দীর্ঘদিন অবস্থান করায় আস্তে আস্তে নিজেদের অবস্থান শক্ত করেছে। পশ্চিমবঙ্গের প্রসাশনেও তাদের বিস্তৃতি ঘটেছে। তসলিমা নাসরিনকে কলকাতা থেকে বিতাড়িত করার জন্য ইদ্রিস আলী নামের একজন মুসলিম ধর্মীয় নেতা উসকানি হামলা ও হাঙ্গামা করেছিল। মমতা ব্যানার্জি তাকে সমর্থন দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস থেকে সাংসদও বানিয়েছেন। এগুলো প্রগতিশীলতা এবং গণতন্ত্রের জন্য হুমকি বৈকি কিছু নয়। তৃণমূল ক্ষমতা ও স্বার্থের বৃত্তে এক প্রবঞ্চক মাকড়সা।
৩.
মমতার তৃণমূল কংগ্রেস এক দশক রাজ্য শাসন করছে, নতুন করে তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়- পশ্চিমবঙ্গ খুব একটা উন্নতি করছে তা কিন্ত নয়। বরং কৃষকেরা ভালো নেই। ফসলের দাম নেই, আত্মহত্যা করছে। বড় ধরণের কোন শিল্প কারখানা নেই। মাঝারি শিল্প ইন্ডাস্ট্রিগুলো সাফল্য পাচ্ছে না। ছোট শিল্পগুলো মরে যাচ্ছে, বেকারত্ব বাড়ছে। সরকারি দপ্তরে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নেই। ছেলেমেয়েগুলো পড়াশুনা করছে, প্রযুক্তি শিখছে কিন্তু চাকরি পাচ্ছে না। সেই সঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি, তোষামদ, সিন্ডিকেটসহ একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। রয়েছে দলটির মাথার উপর সারদা কেলেঙ্কারির মত ঘটনাও। এতে বার বার উঠে এসেছে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নাম। এ সবকিছুই পশ্চিমবঙ্গ রাজনীতি সচেতন মানুষের মনে আছে। সবকিছু মনে রেখেই তারা মমতার তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছে, কতগুলো আলোচ্য বিষয় সামনে রেখে- প্রথমত ধর্মনিরপেক্ষতা, দ্বিতীয়ত বাঙালি সংস্কৃতি এবং তৃতীয়ত সাম্প্রদায়িকতার অবসান এবং চতুর্থত তিস্তা।
এই পশ্চিমবঙ্গেই ১৯৪৬ সালে ঘটেছে রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক ইতিহাস- দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস। তাই তারা অতীতের পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ অসাম্প্রদীয়কতাকে আকড়ে ধরে থাকতে চায়। এক্ষেত্রে বলবো, সংকীর্ণতাকে উপেক্ষা করে বাম এবং কংগ্রেস যে মনস্তাত্ত্বিক ভিত তৈরি করে দিয়ে গেছে, তার সুফল ভোগ করছে এখন মমতা।
বিগত ৫ বছরে মমতার পপুলিস্ট রাজনীতি দেখে আমার তাই মনে হয়- এবারের নির্বাচনে আদর্শগত অবস্থানের দিক থেকে নয়, ‘বাঙালিত্ব’ ও ‘অসাম্প্রদায়িকতা’ শব্দ দুটিতে তৃণমূল মূলত জোর দিয়েছে এ কারণে যে, প্রগতিশীল পশ্চিমবঙ্গে সমগ্র বাঙালি এই দুই শব্দের পাদদেশে এক ও অভিন্ন। বাঙালি নাকি অবাঙালি- এ প্রশ্নে বাঙালি সর্বাগ্রে এগিয়ে থাকবে, জয় বাংলা। তাই এবারের নির্বাচনে যদি বাম ফ্রন্ট সরকার গঠন করত তবে ধরে নিতাম, এ নির্বাচন সংকীর্ণ হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে অসাম্প্রায়িক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক আদর্শের জয়। বাম ও কংগ্রেস দেউলিয়ার পথে, অন্যদিকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী প্রগতিশীল কোন সক্রিয় দল না থাকায় মমতাকে ভোট দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। আর এ কারণে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে মমতা তার পপুলিস্ট রাজনীতি থেকে সরে এসে নিজেকে সংশোধন করারও একটা সুযোগ পেয়েছে হাতে।
এ অঞ্চলে সংকীর্ণ প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির যে দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে, তার ধারাবাহিক অবস্থান অব্যাহত থাকবে কি থাকবে না তা নির্ভর করবে আগামী দিনে তৃণমূলের বাস্তবমুখী পদক্ষেপ, আঞ্চলিক মনোভাবের পাশাপাশি উদার আন্তর্জাতিক মনোভাব, গণতান্ত্রিক নীতি, অসাম্প্রদায়িক আচরণের ওপর। মমতা যদি নিজেকে সংশোধন করে তবে ভালো, আর না করে তবে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন এবং ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন মমতা বন্দোপ্যাধ্যায়কে চরম ভোগাবে। সেই সঙ্গে ভোগাবে পশ্চিমবঙ্গের জনগণকেও।
[ লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ]