alt

মুক্ত আলোচনা

করোনায় পারিবারিক সহিংসতা ও আমাদের করণীয়

জান্নাতুল ফেরদৌস সায়মা

: মঙ্গলবার, ১৮ মে ২০২১

‘পৃথিবীতে যা কিছু মহান চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার গড়িয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’। একটি সমাজ নারী পুরুষের সমান অংশগ্রহণের মাধ্যমেই গড়ে উঠে। অনুরূপ একটি পরিবার গঠনে নারী পুরুষ উভয়ের ভূমিকাই আবশ্যকীয়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলছে সভ্যতা, মানুষের পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনেও এসেছে নানান পরিবর্তন। বর্তমান সভ্যতাকে বলা হচ্ছে মানব ইতিহাসে সবচেয়ে সমৃদ্ধতম সভ্যতা। সভ্যতার এই গগনচুম্বি সাফল্য মানুষের হাতে ধরা দিলেও মানব সমাজ আজ বিভিন্ন নৈতিকতা কলুষিত সামাজিক ব্যাধিতে আক্রান্ত। পারিবারিক সহিংসতা হচ্ছে এমনই একটি ব্যাধি, যার শিকার হয়ে আসছে কেবল আমাদের সমাজের কোমলমতি শিশু এবং নারীরা। সম্প্রতি রায়েরবাজারে গৃহবধূ সাজুকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা এবং গাইবান্ধা জেলায় শশুর বাড়ির লোকজন কর্তৃক গৃহবধূ শারমিনের গায়ে আগুন দিয়ে হত্যা চেষ্টা পারিবারিক সহিংসতায় নারীর নৃশংস আক্রান্তের নিকৃষ্টতম উদাহরণ মাত্র।

পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন-২০১০-এ পারিবারিক সহিংসতা বলতে পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে এমন কোন ব্যক্তি কতৃর্ক পরিবারের অপর কোন নারী বা শিশু সদস্যের উপর শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন অথবা আর্থিক ক্ষতিকে বুঝানো হয়েছে। বিগত দুই দশকে বাংলাদেশে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধে কার্যকর আইনি কাঠামো শক্তিশালী হলেও এ অবস্থার কোন পরিবর্তন হচ্ছে না, বরং এর ভয়াবহতা ও নৃশংসতা মহামারীর মতো কেবল বেড়েই চলছে।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধির কারণে, গত বছর মার্চ মাস থেকে দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। এরপর থেকে মানুষ প্রয়োজন ব্যতীত ঘর থেকে বের হচ্ছে না। ব্রাকের তথ্যমতে, করোনার কারণে দেশে দারিদ্র্য সীমায় নেমে এসেছে দেশের প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ পরিবার। একইসঙ্গে গতবছর মার্চ মাস হতে পারিবারিক সহিংসতার হার দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ নামের একটি বেসরকারি সংস্থার মতে, করোনাকালীন বিগত ৮ মাসে সমগ্র দেশে পারিবারিক সহিংসতার স্বীকার হয়েছে প্রায় ৬৫ শতাংশ নারী ও ৩১ শতাংশ শিশু। তথ্যে ওঠে আসা সহিংসতার শিকার ৪০% পরিবারে পূর্বে কখনও পারিবারিক সহিংসতার মতো সমস্যা দেখা যায়নি।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের জরিপ মতে, পরিবারের সদস্য কিংবা নিকটাত্মীয়ের দ্বারা ধর্ষণের ঘটনা আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৮৮৯ জন নারীকে ধর্ষণ করা হয় ও ৪১ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, ২০১৯ সালে ১০০৮ জন শিশু এবং আগস্ট ২০২০ পর্যন্ত ৩২৪ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের অপর একটি পরিসংখ্যান মতে, ৮০% ধর্ষক ভুক্তভোগীর পূর্বপরিচিত ছিল।

করোনার কারণে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব দেখা দিয়েছে। দীর্ঘদিন লকডাউনের কারণে স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, আর্থিক দ্বীনতা, বেকারত্ব এবং চাকরির অনিশ্চয়তার কারণে মানুষ চরম মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে। যা মানুষের মনে প্রতিনিয়ত রাগ, হতাশা ও পারস্পরিক বিরোধ ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করছে। যা একসময় পারিবারিক সহিংসতার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

করোনা পূর্ববর্তী সময়ে একটি পরিবার যে পরিমাণ অর্থে পরিচালিত হতো, মহামারীর কারণে পরিবারগুলোর অর্থের যোগান কমে এসেছে এবং অনেক পরিবারের অর্থসংস্থানই বন্ধ হয়ে গেছে। করোনাকালীন পরিবারগুলোর আর্থিক উপার্জন কাঠামোয় পরিবর্তন আসায় পরিবারের সবার ওপর এটি গুরুতর চাপ সৃষ্টি করছে। একপর্যায়ে যা পরিবারের সদস্যদের একে অপরের প্রতি আস্থাহীন করে তুলছে। ফলশ্রুতিতে, মনোমালিন্য ও বিরূপ ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে বাড়ছে পরিবারের অন্তকলহ।

বেকারত্ব, চাকরিচ্যুত হওয়া, সামাজিক দূরত্ব এবং দরিদ্রতার কারণেই বর্তমানে পারিবারিক সহিংসতার পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে, করোনা তাতে যোগ করেছে বাড়তি মাত্রা। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত পুুরুষ সদস্যের মারাত্মক প্রতিক্রিয়া পরিবারের তুলনামূলক দুর্বল সদস্য যেমন স্ত্রী, শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠ পিতা-মাতা ভোগ করছে। নারীর যাবতীয় সাংসারিক কাজের পরিমাণ কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্রমবর্ধমান পারিবারিক সমস্যার ফলে নারী ও শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য প্রতিনিয়ত খারাপ হয়ে পড়ছে, অবশেষে তা কখনও আত্মহত্যায়ও রূপ নিচ্ছে।

সহিংসতার ঘটনা আমাদের সমাজে নতুন কিছু নয়, বরং এটা হাজার বছরের লালন করা মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি। যেখানে আমাদের সমাজে নারী-পুরুষ উভয়ই কোভিড-১৯ এর কারণে বিপর্যস্ত, সেখানে শুধু নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক পরিবারে পুরুষ সদস্য তার হতাশা, রাগ, আক্ষেপের কারণে নারীর ওপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করছে, অপরপক্ষে একজন নারীর পক্ষে তা কখনই সম্ভব হয় না। এমনকি যেসব পরিবারে নারী অর্থের যোগানদাতা ছিল, সেসব পরিবারেও বর্তমানে অর্থের যোগান দিতে না পারায় নারী বিরূপ সহিংসতার শিকার হচ্ছে।

পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারী ও শিশু পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০-এর মাধ্যমে নিজেকে সুরক্ষিত করতে পারে। এছাড়াও, দ্য পেনাল কোড ১৮৬০, যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০, পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ আইন ১৯৮৫, পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য কিছু আইন। তবে সমস্যা হলো, এ সব আইনে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হওয়া নারীদের ক্ষেত্রে কী ধরনের পুনর্বাসন, আইনি ও সামাজিক সহায়তা দেয়া যায় এ বিষয়ে ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।

আমাদের দেশের অনেক বিবাহিত নারী প্রতিনিয়ত মানসিক, শারীরিক ও যৌন সহিংসতার শিকার হয়। তাদের মধ্যে অধিকাংশ নারী মনে করে, স্বামীর তাদের প্রতি এ ধরনের আচরণ করার অধিকার আছে। এছাড়া নারী-পুরুষের প্রতি আচরণ, অধিকার ও ক্ষমতায়নের পার্থক্য সামাজিক ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করছে। এ কারণে এ ধরনের সমস্যা দিনদিন বাড়েই চলছে। পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারীর পক্ষে আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় এবং বিকল্প অবস্থা না থাকায় ভবিষ্যৎ জীবনের অনিশ্চয়তার কথা চিন্তা করে আইনের আশ্রয় নেয়াও তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

পরিবারের সবার সঙ্গে সমান সহানুভূতিশীল আচরণ পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে সর্বত্তম পন্থা। তৃতীয় বিশ্বে মানুষ তার সহিষ্ণুতার মনোভাব ক্রমশই হারিয়ে ফেলছে, যা আমাদের সামাজিকতা ধরে রাখতে খুবই দরকার। একুশ শতকের পৃথিবীতে মানুষের জন্য মঙ্গলজনক এবং বসবাসযোগ্য এক সুশৃঙ্খল পৃথিবীর জন্য দরকার বিশ্বব্যাপী নৈতিকতার পুনর্জাগরণ। আর এর জন্য আমাদের সুষ্ঠু সংস্কৃতির চর্চা এবং ধর্মীয় নীতিবোধ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।

পারবারিক সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি করতে, সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পারিবারিক সহিংসতা কমাতে, আমাদের নিজেদের নৈতিকতার চর্চা করতে হবে এবং অপরকে উৎসাহিত করতে হবে। দেশে পারিবারিক সহিংসতা থেকে নারী ও শিশুর প্রতিকার পেতে যুগোপযোগী আইন প্রণীত আছে, নারীর জন্য এসব আইনের ব্যবহার সহজ এবং গতিশীল করতে হবে। পাশাপাশি পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধের জন্য আমাদের দরকার সামাজিক প্রতিরোধ। পরিবারের সব সদস্যদের নারী-পুরুষের ক্ষেত্রে সমআচরণ করার মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের হেল্পলাইন ব্যবস্থাগুলোকে আরও সক্রিয় করতে হবে, যেন টেক্সট মেসেজ ও ফোন কলের মাধ্যমে সহজেই এ ধরনের সমস্যা প্রতিকার, প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। সহিংসতার শিকার নারী ও কন্যাশিশুদের আশ্রয় প্রদানের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা সম্পন্ন আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়াতে হবে। প্রতিটি থানা, মহিলা কর্মকর্তা, জেলা লিগাল এইডসহ এ বিষয়ক সব প্রতিষ্ঠানকে পারিবারিক সহিংসতারোধে, প্রচলিত আইনের কার্যকারিতা ও সুষ্ঠু প্রয়োগ বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হওয়া জরুরি।

পরিশেষে, পারিবারিক সহিংসতা আমাদের সমাজে বিশৃঙ্খলা এবং অশান্তি সৃষ্টির অন্যতম কারণ এবং এটি তরুণ প্রজন্মকেও বিপথে চালিত করতে পারে। তাই, সামাজিকভাবে এই সমস্যাটি মোকাবিলা করা যেমন জরুরি, তেমনি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রেরও তা কর্তব্য। পারিবারিক সহিংসতা এই গুরুতর সমস্যার বিলোপ করতে আমাদের সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে এবং রাষ্ট্রকে আইনের সঠিক প্রয়োগ এবং আক্রান্তের পুনর্বাসন নিয়ে গুরুত্বসহকারে ভাবতে হবে।

[লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

করোনায় পারিবারিক সহিংসতা ও আমাদের করণীয়

জান্নাতুল ফেরদৌস সায়মা

মঙ্গলবার, ১৮ মে ২০২১

‘পৃথিবীতে যা কিছু মহান চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার গড়িয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’। একটি সমাজ নারী পুরুষের সমান অংশগ্রহণের মাধ্যমেই গড়ে উঠে। অনুরূপ একটি পরিবার গঠনে নারী পুরুষ উভয়ের ভূমিকাই আবশ্যকীয়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলছে সভ্যতা, মানুষের পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনেও এসেছে নানান পরিবর্তন। বর্তমান সভ্যতাকে বলা হচ্ছে মানব ইতিহাসে সবচেয়ে সমৃদ্ধতম সভ্যতা। সভ্যতার এই গগনচুম্বি সাফল্য মানুষের হাতে ধরা দিলেও মানব সমাজ আজ বিভিন্ন নৈতিকতা কলুষিত সামাজিক ব্যাধিতে আক্রান্ত। পারিবারিক সহিংসতা হচ্ছে এমনই একটি ব্যাধি, যার শিকার হয়ে আসছে কেবল আমাদের সমাজের কোমলমতি শিশু এবং নারীরা। সম্প্রতি রায়েরবাজারে গৃহবধূ সাজুকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা এবং গাইবান্ধা জেলায় শশুর বাড়ির লোকজন কর্তৃক গৃহবধূ শারমিনের গায়ে আগুন দিয়ে হত্যা চেষ্টা পারিবারিক সহিংসতায় নারীর নৃশংস আক্রান্তের নিকৃষ্টতম উদাহরণ মাত্র।

পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন-২০১০-এ পারিবারিক সহিংসতা বলতে পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে এমন কোন ব্যক্তি কতৃর্ক পরিবারের অপর কোন নারী বা শিশু সদস্যের উপর শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন অথবা আর্থিক ক্ষতিকে বুঝানো হয়েছে। বিগত দুই দশকে বাংলাদেশে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধে কার্যকর আইনি কাঠামো শক্তিশালী হলেও এ অবস্থার কোন পরিবর্তন হচ্ছে না, বরং এর ভয়াবহতা ও নৃশংসতা মহামারীর মতো কেবল বেড়েই চলছে।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধির কারণে, গত বছর মার্চ মাস থেকে দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। এরপর থেকে মানুষ প্রয়োজন ব্যতীত ঘর থেকে বের হচ্ছে না। ব্রাকের তথ্যমতে, করোনার কারণে দেশে দারিদ্র্য সীমায় নেমে এসেছে দেশের প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ পরিবার। একইসঙ্গে গতবছর মার্চ মাস হতে পারিবারিক সহিংসতার হার দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ নামের একটি বেসরকারি সংস্থার মতে, করোনাকালীন বিগত ৮ মাসে সমগ্র দেশে পারিবারিক সহিংসতার স্বীকার হয়েছে প্রায় ৬৫ শতাংশ নারী ও ৩১ শতাংশ শিশু। তথ্যে ওঠে আসা সহিংসতার শিকার ৪০% পরিবারে পূর্বে কখনও পারিবারিক সহিংসতার মতো সমস্যা দেখা যায়নি।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের জরিপ মতে, পরিবারের সদস্য কিংবা নিকটাত্মীয়ের দ্বারা ধর্ষণের ঘটনা আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৮৮৯ জন নারীকে ধর্ষণ করা হয় ও ৪১ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, ২০১৯ সালে ১০০৮ জন শিশু এবং আগস্ট ২০২০ পর্যন্ত ৩২৪ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের অপর একটি পরিসংখ্যান মতে, ৮০% ধর্ষক ভুক্তভোগীর পূর্বপরিচিত ছিল।

করোনার কারণে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব দেখা দিয়েছে। দীর্ঘদিন লকডাউনের কারণে স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, আর্থিক দ্বীনতা, বেকারত্ব এবং চাকরির অনিশ্চয়তার কারণে মানুষ চরম মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে। যা মানুষের মনে প্রতিনিয়ত রাগ, হতাশা ও পারস্পরিক বিরোধ ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করছে। যা একসময় পারিবারিক সহিংসতার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

করোনা পূর্ববর্তী সময়ে একটি পরিবার যে পরিমাণ অর্থে পরিচালিত হতো, মহামারীর কারণে পরিবারগুলোর অর্থের যোগান কমে এসেছে এবং অনেক পরিবারের অর্থসংস্থানই বন্ধ হয়ে গেছে। করোনাকালীন পরিবারগুলোর আর্থিক উপার্জন কাঠামোয় পরিবর্তন আসায় পরিবারের সবার ওপর এটি গুরুতর চাপ সৃষ্টি করছে। একপর্যায়ে যা পরিবারের সদস্যদের একে অপরের প্রতি আস্থাহীন করে তুলছে। ফলশ্রুতিতে, মনোমালিন্য ও বিরূপ ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে বাড়ছে পরিবারের অন্তকলহ।

বেকারত্ব, চাকরিচ্যুত হওয়া, সামাজিক দূরত্ব এবং দরিদ্রতার কারণেই বর্তমানে পারিবারিক সহিংসতার পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে, করোনা তাতে যোগ করেছে বাড়তি মাত্রা। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত পুুরুষ সদস্যের মারাত্মক প্রতিক্রিয়া পরিবারের তুলনামূলক দুর্বল সদস্য যেমন স্ত্রী, শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠ পিতা-মাতা ভোগ করছে। নারীর যাবতীয় সাংসারিক কাজের পরিমাণ কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্রমবর্ধমান পারিবারিক সমস্যার ফলে নারী ও শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য প্রতিনিয়ত খারাপ হয়ে পড়ছে, অবশেষে তা কখনও আত্মহত্যায়ও রূপ নিচ্ছে।

সহিংসতার ঘটনা আমাদের সমাজে নতুন কিছু নয়, বরং এটা হাজার বছরের লালন করা মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি। যেখানে আমাদের সমাজে নারী-পুরুষ উভয়ই কোভিড-১৯ এর কারণে বিপর্যস্ত, সেখানে শুধু নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক পরিবারে পুরুষ সদস্য তার হতাশা, রাগ, আক্ষেপের কারণে নারীর ওপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করছে, অপরপক্ষে একজন নারীর পক্ষে তা কখনই সম্ভব হয় না। এমনকি যেসব পরিবারে নারী অর্থের যোগানদাতা ছিল, সেসব পরিবারেও বর্তমানে অর্থের যোগান দিতে না পারায় নারী বিরূপ সহিংসতার শিকার হচ্ছে।

পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারী ও শিশু পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০-এর মাধ্যমে নিজেকে সুরক্ষিত করতে পারে। এছাড়াও, দ্য পেনাল কোড ১৮৬০, যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০, পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ আইন ১৯৮৫, পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য কিছু আইন। তবে সমস্যা হলো, এ সব আইনে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হওয়া নারীদের ক্ষেত্রে কী ধরনের পুনর্বাসন, আইনি ও সামাজিক সহায়তা দেয়া যায় এ বিষয়ে ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।

আমাদের দেশের অনেক বিবাহিত নারী প্রতিনিয়ত মানসিক, শারীরিক ও যৌন সহিংসতার শিকার হয়। তাদের মধ্যে অধিকাংশ নারী মনে করে, স্বামীর তাদের প্রতি এ ধরনের আচরণ করার অধিকার আছে। এছাড়া নারী-পুরুষের প্রতি আচরণ, অধিকার ও ক্ষমতায়নের পার্থক্য সামাজিক ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করছে। এ কারণে এ ধরনের সমস্যা দিনদিন বাড়েই চলছে। পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারীর পক্ষে আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় এবং বিকল্প অবস্থা না থাকায় ভবিষ্যৎ জীবনের অনিশ্চয়তার কথা চিন্তা করে আইনের আশ্রয় নেয়াও তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

পরিবারের সবার সঙ্গে সমান সহানুভূতিশীল আচরণ পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে সর্বত্তম পন্থা। তৃতীয় বিশ্বে মানুষ তার সহিষ্ণুতার মনোভাব ক্রমশই হারিয়ে ফেলছে, যা আমাদের সামাজিকতা ধরে রাখতে খুবই দরকার। একুশ শতকের পৃথিবীতে মানুষের জন্য মঙ্গলজনক এবং বসবাসযোগ্য এক সুশৃঙ্খল পৃথিবীর জন্য দরকার বিশ্বব্যাপী নৈতিকতার পুনর্জাগরণ। আর এর জন্য আমাদের সুষ্ঠু সংস্কৃতির চর্চা এবং ধর্মীয় নীতিবোধ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।

পারবারিক সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি করতে, সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পারিবারিক সহিংসতা কমাতে, আমাদের নিজেদের নৈতিকতার চর্চা করতে হবে এবং অপরকে উৎসাহিত করতে হবে। দেশে পারিবারিক সহিংসতা থেকে নারী ও শিশুর প্রতিকার পেতে যুগোপযোগী আইন প্রণীত আছে, নারীর জন্য এসব আইনের ব্যবহার সহজ এবং গতিশীল করতে হবে। পাশাপাশি পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধের জন্য আমাদের দরকার সামাজিক প্রতিরোধ। পরিবারের সব সদস্যদের নারী-পুরুষের ক্ষেত্রে সমআচরণ করার মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের হেল্পলাইন ব্যবস্থাগুলোকে আরও সক্রিয় করতে হবে, যেন টেক্সট মেসেজ ও ফোন কলের মাধ্যমে সহজেই এ ধরনের সমস্যা প্রতিকার, প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। সহিংসতার শিকার নারী ও কন্যাশিশুদের আশ্রয় প্রদানের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা সম্পন্ন আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়াতে হবে। প্রতিটি থানা, মহিলা কর্মকর্তা, জেলা লিগাল এইডসহ এ বিষয়ক সব প্রতিষ্ঠানকে পারিবারিক সহিংসতারোধে, প্রচলিত আইনের কার্যকারিতা ও সুষ্ঠু প্রয়োগ বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হওয়া জরুরি।

পরিশেষে, পারিবারিক সহিংসতা আমাদের সমাজে বিশৃঙ্খলা এবং অশান্তি সৃষ্টির অন্যতম কারণ এবং এটি তরুণ প্রজন্মকেও বিপথে চালিত করতে পারে। তাই, সামাজিকভাবে এই সমস্যাটি মোকাবিলা করা যেমন জরুরি, তেমনি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রেরও তা কর্তব্য। পারিবারিক সহিংসতা এই গুরুতর সমস্যার বিলোপ করতে আমাদের সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে এবং রাষ্ট্রকে আইনের সঠিক প্রয়োগ এবং আক্রান্তের পুনর্বাসন নিয়ে গুরুত্বসহকারে ভাবতে হবে।

[লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়]

back to top