alt

মুক্ত আলোচনা

সুনীল অর্থনীতি ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ

মুতাসিম বিল্লাহ মাসুম

: বুধবার, ১৯ মে ২০২১

সমুদ্র পৃথিবীর অন্যতম মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। সামুদ্রিক বিভিন্ন উপাদানের কল্যাণে বিশ্ব দিন-দিন উন্নতি লাভ করেছে। এসব উপাদানের মধ্যে প্রথমেই আছে মৎস্য সম্পদ। দৈনন্দিন জীবনে প্রাণিজ আমিষের চাহিদার শতকরা ৬০ ভাগ জোগান দিচ্ছে মৎস্য খাত। আর এ খাতের অধিকাংশ মাছ আসে সমুদ্র থেকে। এছাড়া সমুদ্রের উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে মানুষ ও পণ্য পরিবহন খাত। এ খাতের মাধ্যমে সম্ভব হয় সুদূর বাণিজ্যিক সম্পর্কের। দূর-দূরান্তের দেশগুলোতে একইসঙ্গে অধিক পরিমাণ পণ্য বহন করতে সাহায্য করে সমুদ্রগুলো। এছাড়াও সমুদ্রে রয়েছে নানা ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদ। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম বালি, লবণ, সামুদ্রিক মাছ, শামুক, ঝিনুক, কবাল্ট, কপার, ইলমেনাইট, মোনাজাইট, কায়ানাইট, জিরকন ইত্যাদি। সমুদ্রসীমা ব্যবহার করে এসব অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে এককথায় ব্লু-ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতি বলা হয়।

স্বাভাবিকভাবে সুনীল অর্থনীতি বা ব্লু-ইকোনমি বলতে যা বোঝায় তা হলো, ‘সমুদ্রের রং নীল’। আর তাই সমুদ্র কেন্দ্রিক যে অর্থনীতি তাকে সুনীল অর্থনীতি বলে। তবে বিশ্ব ব্যাংকের এক রিপোর্ট অনুযায়ী ব্লু-ইকোনমির সংঙ্গায় বলা হয়েছেÑ ‘সমুদ্রে যে পানি আছে এবং এর তলদেশে যে পরিমাণ সম্পদ রয়েছে সেই সবধরনের সম্পদকে যদি আমরা টেকসই উন্নয়নের জন্য ব্যাবহার করে তবে তাকে ব্লু-ইকোনমি বলে।’ ১৯৯৪ সালে অধ্যাপক গুন্টার পাউলি জাতিসংঘ কর্তৃক আমন্ত্রিত হন। তিনি ভবিষ্যৎ অর্থনীতির রূপরেখা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ব্লু-ইকোনমি নামক মডেলের প্রবর্তন করেন। তিনি প্রথম ধারণা দেন পরিবেশবান্ধব উপায়ে সমুদ্রসীমা ব্যবহারের। পাওলি উদ্ভাবিত এ মডেল আজ বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে সমাদৃত।

বর্তমানে স্থল ও বনজ সম্পদের পাশাপাশি অনেক দেশ সমুদ্র সম্পদ ব্যবহারে তৎপর হয়েছে। কারণ সমুদ্র তলদেশে আছে অনেক লুকায়িত খনিজ সম্পদ। তাছাড়া অনেক দেশ নিজ সমুদ্রসীমা ব্যবহার করে মৎস রপ্তানিতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীনের মতো দেশগুলো। তবে বাংলাদেশে অনেকটা পিছিয়ে থাকলেও ধীরে ধীরে বেড়ে চলছে দেশের সমুদ্র কেন্দ্রিক অর্থনীতি। বর্তমানে দেশে প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসীমা রয়েছে। বিশাল আয়তনের সমুদ্রসীমা ব্যবহারের মাধ্যমে দেশে অর্থনীতির ভাগ্যবদল করা সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় সুষ্ঠু ব্যবহার হচ্ছে না এ সুনীল জলরাশির।

২০১৪ সালে আমরা মিয়ানমারের কাছ থেকে সমুদ্রসীমা জয় করেছি। এতে আমাদের সমুদ্রসীমা বেড়েছে পুরো বাংলাদেশের সমান আরেকটি অংশ। দীর্ঘ ৭ বছর অতিক্রান্ত হলেও অর্থনীতিতে সমুদ্রসীমার অবদান খুব বেশি বর্ধিত হয়নি। এক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা প্রযুক্তিগত উন্নতির অভাব। বিশাল জলরাশি ব্যবহারের জন্য এখনও যথেষ্ট প্রযুক্তি নেই আমাদের। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্ভর করতে হয় অন্য কোন দেশের উপর। ফলে প্রযুক্তির অপ্রতুলতার কারণে নিজেদের খনিজ সম্পদ থেকে ভাগ দিতে হয় অন্য দেশের। অন্যদিকে দক্ষ মানবসম্পদের অভাব অন্যতম কারণ। আমাদের দেশ এখনো পর্যন্ত পর্যাপ্ত দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হয়নি, যাদের মাধ্যমে সামুদ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব। তাই বিরাট জলরাশি থাকা সত্ত্বেও দেশের উন্নয়নে সমুদ্রসীমার ভূমিকা এখনো সামান্য। আশার দিক হলো বর্তমান সরকার সুনীল অর্থনীতি সংক্রান্ত বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ( এফএও) তথ্যমতে, ২০২২ সালের মধ্যে মৎস্য সম্পদে যে চারটি দেশ বিপুল পরিমাণ সাফল্য অর্জন করবে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৪৭৫ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ দেখতে পাওয়া যায়। এসব প্রজাতির মাছ নিজ দেশে ব্যবহার হওয়া সহ রপ্তানি হচ্ছে বাইরের অনেক দেশে। কিন্তু দেশের সমুদ্রসীমা যত বৃহৎ এবং মাছের সংখ্যা যত বেশি সে তুলনায় রপ্তানি আয় অনেক কম। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা সরকারি পদক্ষেপের অভাব।

উল্লেখ্য, যথাযথ মৎস্য আহরণের পদ্ধতি গ্রহণ করলে সমুদ্র থেকে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। ৬০০ কিলোমিটার মাছ ধরার উপযুক্ত সমুদ্রসীমায় মাত্র ৩৭০ কিলোমিটারে মাছ ধরা হয়। ফলে বিপুল পরিমাণ সমুদ্রসীমা মাছের উপযোগী থাকলেও প্রযুক্তিগত উপাদন এবং দক্ষ জনবলের অভাবে সম্পূর্ণ সমুদ্রসীমা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে সরকারের কার্যকরী ভূমিকা দরকার।

এছাড়া দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক চিত্র পরিবর্তনের জন্য পণ্য পরিবহনে সমুদ্রপথ ব্যবহার করা দরকার। সমুদ্রপথে পরিবহন ব্যবস্থা কিছুটা সময়সাপেক্ষ হলেও একই সঙ্গে অধিক পরিমাণে পণ্য বহনের পাশাপাশি ব্যয় অনেকাংশে কমানো যায়। তাই পণ্য আমদানি ও রপ্তানির জন্য সমুদ্রপথ ব্যবহার করা দরকার। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সমুদ্র সৈকতগুলোকে আরো বেশি পরিবেশবান্ধব করার পাশাপাশি নতুন সমুদ্র সৈকত বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। কারণ পর্যটন খাতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সমুদ্র সৈকত অনন্য ভূমিকা পালন করে। আমাদের দেশে সমুদ্র সৈকত এর মধ্যে অন্যতম প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন এছাড়াও আছে ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত এবং কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। এসব সৈকতে সারা বছর থাকে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদচারণা। তবে দেশীয় সংস্কৃতির পাশাপাশি সৈকতগুলোতে রাখতে হবে বৈদেশিক কিছু বৈশিষ্ট্য। যার ফলে একদিকে যেমন দেশীয় পর্যটকদের কৌতূহল সৃষ্টি হবে তেমনি বিদেশি পর্যটকরা আকৃষ্ট হবে। সুনীল অর্থনীতির মাধ্যমে দেশের ভাগ্য বদল এর জন্য বিদেশি বণিকদের আকৃষ্ট করতে হবে। বিশেষ করে জাহাজভাঙা ও জাহাজ তৈরির মতো কাজ সমুদ্রকেন্দ্রিক বৃদ্ধি করা গেলে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আশা করা যায়।

সুনীল অর্থনীতির যথাযথ উন্নয়ন লাভ করতে হলে দেশের কয়েকটি সমস্যা কাটিয়ে উঠতে হবে। প্রথমত, প্রযুক্তিগত উন্নতি সাধন। গভীর সমুদ্র থেকে তেল, গ্যাস কিংবা অন্য কোন খনিজ পদার্থ আহরণের জন্য দেশে প্রযুক্তিগত উপাদান অপ্রতুল। বিভিন্ন রিপোর্টে দেখা যায় বঙ্গোপসাগরে ভারতের হাতে থাকা দশটি গ্যাস ব্লকের মধ্যে আটটি এবং মায়ানমারের ১৮টির মধ্যে ১৩টির মালিকানা পেয়েছে বাংলাদেশ। এসব ব্লক থেকে প্রায় ৪০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া সম্ভব। ছাড়াও বঙ্গোপসাগরের তলদেশে আছে বিভিন্ন মূল্যবান খনিজ পদার্থ। কিন্তু গভীর সমুদ্র থেকে এসব খনিজ পদার্থ উত্তোলনের জন্য দেশকে আরো বেশি প্রযুক্তিগত উন্নতি লাভ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সমুদ্রসীমা ব্যবহারের জন্য দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবল দরকার। খনিজ সম্পদ উত্তোলনের জন্য অভিজ্ঞ জনবল না হলে একদিকে যেমন সম্পদের সম্পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত হবে না তেমনি বিভিন্ন দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকবে। তাই দেশের উন্নতির জন্য সরকারি উদ্যোগে অভিজ্ঞ জনবল গড়ে তুলতে হবে, যাদের মাধ্যমে সমুদ্র সম্পদ আহরণ করা সম্ভব।

তৃতীয়ত, সমুদ্রসীমার সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করতে হবে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য দীর্ঘ প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কিন্তু এখনো স্বপ্নের গভীর সমুদ্রবন্দরের বাস্তবায়ন হয়নি। তবে সুনীল অর্থনীতির সুফল ভোগ করতে চাইলে দ্রুত গভীর সমুদ্রবন্দরের বাস্তবায়ন জরুরি। এরই মধ্যে ভারত, ভিয়েতনাম, চীনসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ সুনীল অর্থনীতির কার্যক্রম শুরু করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ ক্ষেত্রে অনেকটা পিছিয়ে। সমুদ্র সম্পদ ব্যবহার করে সবচেয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে সিঙ্গাপুর। ছোট এ দেশটি গভীর সমুদ্র বন্দরকে ব্যবহার করে বর্তমানে উন্নয়নের মডেলে পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে সিঙ্গাপুর কে অনুসরণ করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য দেশে দ্রুত গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করতে হবে। সুনীল অর্থনীতির সফলতা লাভ করতে বর্তমান সরকারের আরও কিছু পদক্ষেপ হাতে নেওয়া জরুরি। ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ বা ‘ডেল্টা প্ল্যান ২১০০’-তে সমুদ্র সম্পর্কিত অর্থনীতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তবে এ প্রকল্পের কাজ খুব ধীরগতিতে চলছে। এ প্রকল্পের বাস্তবায়নের জন্য দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে হবে। অন্যদিকে দেশের ভাগ্য বদলে গভীর সমুদ্রবন্দর অনেকটা সহায়ক হবে। এক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে চুক্তি হলেও কাজের মাত্রা খুবই ধীরগতির। কিন্তু সুনীল অর্থনীতির উন্নয়ন লাভ করতে গভীর সমুদ্রবন্দর আবশ্যক। তাই পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে সংযোগ বৃদ্ধি করতে হবে এবং গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে হবে। পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর সুনীল অর্থনীতি সংক্রান্ত অধ্যায়ন এবং প্রচার বৃদ্ধি করা দরকার। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে অর্থনৈতিক সুবিধা তুলে ধরে উদ্যোক্তাদের এ বিষয়ে আগ্রহী করতে হবে। পরিকল্পিতভাবে সুনীল অর্থনীতিকেন্দ্রিক পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির যথাযথ অগ্রগতি লাভ করা সম্ভব।

[লেখক : শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

সুনীল অর্থনীতি ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ

মুতাসিম বিল্লাহ মাসুম

বুধবার, ১৯ মে ২০২১

সমুদ্র পৃথিবীর অন্যতম মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। সামুদ্রিক বিভিন্ন উপাদানের কল্যাণে বিশ্ব দিন-দিন উন্নতি লাভ করেছে। এসব উপাদানের মধ্যে প্রথমেই আছে মৎস্য সম্পদ। দৈনন্দিন জীবনে প্রাণিজ আমিষের চাহিদার শতকরা ৬০ ভাগ জোগান দিচ্ছে মৎস্য খাত। আর এ খাতের অধিকাংশ মাছ আসে সমুদ্র থেকে। এছাড়া সমুদ্রের উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে মানুষ ও পণ্য পরিবহন খাত। এ খাতের মাধ্যমে সম্ভব হয় সুদূর বাণিজ্যিক সম্পর্কের। দূর-দূরান্তের দেশগুলোতে একইসঙ্গে অধিক পরিমাণ পণ্য বহন করতে সাহায্য করে সমুদ্রগুলো। এছাড়াও সমুদ্রে রয়েছে নানা ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদ। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম বালি, লবণ, সামুদ্রিক মাছ, শামুক, ঝিনুক, কবাল্ট, কপার, ইলমেনাইট, মোনাজাইট, কায়ানাইট, জিরকন ইত্যাদি। সমুদ্রসীমা ব্যবহার করে এসব অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে এককথায় ব্লু-ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতি বলা হয়।

স্বাভাবিকভাবে সুনীল অর্থনীতি বা ব্লু-ইকোনমি বলতে যা বোঝায় তা হলো, ‘সমুদ্রের রং নীল’। আর তাই সমুদ্র কেন্দ্রিক যে অর্থনীতি তাকে সুনীল অর্থনীতি বলে। তবে বিশ্ব ব্যাংকের এক রিপোর্ট অনুযায়ী ব্লু-ইকোনমির সংঙ্গায় বলা হয়েছেÑ ‘সমুদ্রে যে পানি আছে এবং এর তলদেশে যে পরিমাণ সম্পদ রয়েছে সেই সবধরনের সম্পদকে যদি আমরা টেকসই উন্নয়নের জন্য ব্যাবহার করে তবে তাকে ব্লু-ইকোনমি বলে।’ ১৯৯৪ সালে অধ্যাপক গুন্টার পাউলি জাতিসংঘ কর্তৃক আমন্ত্রিত হন। তিনি ভবিষ্যৎ অর্থনীতির রূপরেখা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ব্লু-ইকোনমি নামক মডেলের প্রবর্তন করেন। তিনি প্রথম ধারণা দেন পরিবেশবান্ধব উপায়ে সমুদ্রসীমা ব্যবহারের। পাওলি উদ্ভাবিত এ মডেল আজ বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে সমাদৃত।

বর্তমানে স্থল ও বনজ সম্পদের পাশাপাশি অনেক দেশ সমুদ্র সম্পদ ব্যবহারে তৎপর হয়েছে। কারণ সমুদ্র তলদেশে আছে অনেক লুকায়িত খনিজ সম্পদ। তাছাড়া অনেক দেশ নিজ সমুদ্রসীমা ব্যবহার করে মৎস রপ্তানিতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীনের মতো দেশগুলো। তবে বাংলাদেশে অনেকটা পিছিয়ে থাকলেও ধীরে ধীরে বেড়ে চলছে দেশের সমুদ্র কেন্দ্রিক অর্থনীতি। বর্তমানে দেশে প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসীমা রয়েছে। বিশাল আয়তনের সমুদ্রসীমা ব্যবহারের মাধ্যমে দেশে অর্থনীতির ভাগ্যবদল করা সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় সুষ্ঠু ব্যবহার হচ্ছে না এ সুনীল জলরাশির।

২০১৪ সালে আমরা মিয়ানমারের কাছ থেকে সমুদ্রসীমা জয় করেছি। এতে আমাদের সমুদ্রসীমা বেড়েছে পুরো বাংলাদেশের সমান আরেকটি অংশ। দীর্ঘ ৭ বছর অতিক্রান্ত হলেও অর্থনীতিতে সমুদ্রসীমার অবদান খুব বেশি বর্ধিত হয়নি। এক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা প্রযুক্তিগত উন্নতির অভাব। বিশাল জলরাশি ব্যবহারের জন্য এখনও যথেষ্ট প্রযুক্তি নেই আমাদের। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্ভর করতে হয় অন্য কোন দেশের উপর। ফলে প্রযুক্তির অপ্রতুলতার কারণে নিজেদের খনিজ সম্পদ থেকে ভাগ দিতে হয় অন্য দেশের। অন্যদিকে দক্ষ মানবসম্পদের অভাব অন্যতম কারণ। আমাদের দেশ এখনো পর্যন্ত পর্যাপ্ত দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হয়নি, যাদের মাধ্যমে সামুদ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব। তাই বিরাট জলরাশি থাকা সত্ত্বেও দেশের উন্নয়নে সমুদ্রসীমার ভূমিকা এখনো সামান্য। আশার দিক হলো বর্তমান সরকার সুনীল অর্থনীতি সংক্রান্ত বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ( এফএও) তথ্যমতে, ২০২২ সালের মধ্যে মৎস্য সম্পদে যে চারটি দেশ বিপুল পরিমাণ সাফল্য অর্জন করবে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৪৭৫ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ দেখতে পাওয়া যায়। এসব প্রজাতির মাছ নিজ দেশে ব্যবহার হওয়া সহ রপ্তানি হচ্ছে বাইরের অনেক দেশে। কিন্তু দেশের সমুদ্রসীমা যত বৃহৎ এবং মাছের সংখ্যা যত বেশি সে তুলনায় রপ্তানি আয় অনেক কম। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা সরকারি পদক্ষেপের অভাব।

উল্লেখ্য, যথাযথ মৎস্য আহরণের পদ্ধতি গ্রহণ করলে সমুদ্র থেকে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। ৬০০ কিলোমিটার মাছ ধরার উপযুক্ত সমুদ্রসীমায় মাত্র ৩৭০ কিলোমিটারে মাছ ধরা হয়। ফলে বিপুল পরিমাণ সমুদ্রসীমা মাছের উপযোগী থাকলেও প্রযুক্তিগত উপাদন এবং দক্ষ জনবলের অভাবে সম্পূর্ণ সমুদ্রসীমা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে সরকারের কার্যকরী ভূমিকা দরকার।

এছাড়া দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক চিত্র পরিবর্তনের জন্য পণ্য পরিবহনে সমুদ্রপথ ব্যবহার করা দরকার। সমুদ্রপথে পরিবহন ব্যবস্থা কিছুটা সময়সাপেক্ষ হলেও একই সঙ্গে অধিক পরিমাণে পণ্য বহনের পাশাপাশি ব্যয় অনেকাংশে কমানো যায়। তাই পণ্য আমদানি ও রপ্তানির জন্য সমুদ্রপথ ব্যবহার করা দরকার। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সমুদ্র সৈকতগুলোকে আরো বেশি পরিবেশবান্ধব করার পাশাপাশি নতুন সমুদ্র সৈকত বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। কারণ পর্যটন খাতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সমুদ্র সৈকত অনন্য ভূমিকা পালন করে। আমাদের দেশে সমুদ্র সৈকত এর মধ্যে অন্যতম প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন এছাড়াও আছে ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত এবং কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। এসব সৈকতে সারা বছর থাকে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদচারণা। তবে দেশীয় সংস্কৃতির পাশাপাশি সৈকতগুলোতে রাখতে হবে বৈদেশিক কিছু বৈশিষ্ট্য। যার ফলে একদিকে যেমন দেশীয় পর্যটকদের কৌতূহল সৃষ্টি হবে তেমনি বিদেশি পর্যটকরা আকৃষ্ট হবে। সুনীল অর্থনীতির মাধ্যমে দেশের ভাগ্য বদল এর জন্য বিদেশি বণিকদের আকৃষ্ট করতে হবে। বিশেষ করে জাহাজভাঙা ও জাহাজ তৈরির মতো কাজ সমুদ্রকেন্দ্রিক বৃদ্ধি করা গেলে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আশা করা যায়।

সুনীল অর্থনীতির যথাযথ উন্নয়ন লাভ করতে হলে দেশের কয়েকটি সমস্যা কাটিয়ে উঠতে হবে। প্রথমত, প্রযুক্তিগত উন্নতি সাধন। গভীর সমুদ্র থেকে তেল, গ্যাস কিংবা অন্য কোন খনিজ পদার্থ আহরণের জন্য দেশে প্রযুক্তিগত উপাদান অপ্রতুল। বিভিন্ন রিপোর্টে দেখা যায় বঙ্গোপসাগরে ভারতের হাতে থাকা দশটি গ্যাস ব্লকের মধ্যে আটটি এবং মায়ানমারের ১৮টির মধ্যে ১৩টির মালিকানা পেয়েছে বাংলাদেশ। এসব ব্লক থেকে প্রায় ৪০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া সম্ভব। ছাড়াও বঙ্গোপসাগরের তলদেশে আছে বিভিন্ন মূল্যবান খনিজ পদার্থ। কিন্তু গভীর সমুদ্র থেকে এসব খনিজ পদার্থ উত্তোলনের জন্য দেশকে আরো বেশি প্রযুক্তিগত উন্নতি লাভ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সমুদ্রসীমা ব্যবহারের জন্য দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবল দরকার। খনিজ সম্পদ উত্তোলনের জন্য অভিজ্ঞ জনবল না হলে একদিকে যেমন সম্পদের সম্পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত হবে না তেমনি বিভিন্ন দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকবে। তাই দেশের উন্নতির জন্য সরকারি উদ্যোগে অভিজ্ঞ জনবল গড়ে তুলতে হবে, যাদের মাধ্যমে সমুদ্র সম্পদ আহরণ করা সম্ভব।

তৃতীয়ত, সমুদ্রসীমার সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করতে হবে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য দীর্ঘ প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কিন্তু এখনো স্বপ্নের গভীর সমুদ্রবন্দরের বাস্তবায়ন হয়নি। তবে সুনীল অর্থনীতির সুফল ভোগ করতে চাইলে দ্রুত গভীর সমুদ্রবন্দরের বাস্তবায়ন জরুরি। এরই মধ্যে ভারত, ভিয়েতনাম, চীনসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ সুনীল অর্থনীতির কার্যক্রম শুরু করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ ক্ষেত্রে অনেকটা পিছিয়ে। সমুদ্র সম্পদ ব্যবহার করে সবচেয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে সিঙ্গাপুর। ছোট এ দেশটি গভীর সমুদ্র বন্দরকে ব্যবহার করে বর্তমানে উন্নয়নের মডেলে পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে সিঙ্গাপুর কে অনুসরণ করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য দেশে দ্রুত গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করতে হবে। সুনীল অর্থনীতির সফলতা লাভ করতে বর্তমান সরকারের আরও কিছু পদক্ষেপ হাতে নেওয়া জরুরি। ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ বা ‘ডেল্টা প্ল্যান ২১০০’-তে সমুদ্র সম্পর্কিত অর্থনীতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তবে এ প্রকল্পের কাজ খুব ধীরগতিতে চলছে। এ প্রকল্পের বাস্তবায়নের জন্য দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে হবে। অন্যদিকে দেশের ভাগ্য বদলে গভীর সমুদ্রবন্দর অনেকটা সহায়ক হবে। এক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে চুক্তি হলেও কাজের মাত্রা খুবই ধীরগতির। কিন্তু সুনীল অর্থনীতির উন্নয়ন লাভ করতে গভীর সমুদ্রবন্দর আবশ্যক। তাই পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে সংযোগ বৃদ্ধি করতে হবে এবং গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে হবে। পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর সুনীল অর্থনীতি সংক্রান্ত অধ্যায়ন এবং প্রচার বৃদ্ধি করা দরকার। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে অর্থনৈতিক সুবিধা তুলে ধরে উদ্যোক্তাদের এ বিষয়ে আগ্রহী করতে হবে। পরিকল্পিতভাবে সুনীল অর্থনীতিকেন্দ্রিক পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির যথাযথ অগ্রগতি লাভ করা সম্ভব।

[লেখক : শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]

back to top