alt

মুক্ত আলোচনা

নকল ওষুধ : সম্ভাবনাময় ওষুধ শিল্পের অন্তরায়

শেখ সায়মন পারভেজ হিমেল

: শনিবার, ২২ মে ২০২১

বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার মান নাজুক অবস্থা হলেও বিশ্ববাজারে ওষুধ শিল্পের রয়েছে বেশ সুনাম ও আস্তা। সেই সঙ্গে দেশের চাহিদা মিটিয়ে ঔষধ বহির্বিশ্বে রপ্তানি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে ওষুধের যে সহজলভ্যতা রয়েছে, তা পৃথিবীর কয়টা দেশেই বা আছে। সোনালী আঁশের দেশ বাংলাদেশ পাট রপ্তানিতে ইতিমধ্যে বিশ্ববাজারে চুকিয়ে গেলেও পোশাক ও ওষুধ শিল্পের সুনাম ক্রমশ বর্ধমান। বিশ্ববাজারে ওষুধ শিল্পের ক্রমশ বর্ধমান নিয়ে ‘দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন’ একটি প্রতিবেদন দেখলাম। যেখানে বলা হয়, দেশের ৯৮ শতাংশ চাহিদা মিটিয়ে ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে ১৬০টি দেশে। শুধু তাই নয়, বিশ্বের ৪৮ দেশের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশের ওষুধ। দেশের ২৫৭টি কোম্পানির কারখানায় বছরে ২৪ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদিত হচ্ছে। বছরে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ওষুধ ও কাঁচামাল উৎপাদিত হচ্ছে এসব কারখানায়। এ শিল্পে প্রায় ২ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশীয় ৪৬ কোম্পানির ৩০০ ধরনের ওষুধপণ্য বিশ্ববাজারে রপ্তানি হয়। শুধু ওষুধ রপ্তানিতে বিশ্ববাজার থেকে বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা বা এলডিসি হিসেবে ওষুধশিল্পে মেধাস্বত্ব ছাড় ১৭ বছর বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প খাতে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত মেধাস্বত্ব ছাড় পাচ্ছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ওষুধ রপ্তানির আকার বাড়াতে চায় বাংলাদেশ। বিশ্ববাজারে এখন ওষুধের বার্ষিক ব্যয় ৯৫ হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার। ইপিবির তথ্য বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ওষুধ রপ্তানি হয়েছে ১৩ কোটি ৫৭ লাখ ডলারের। আগের বছরের চেয়ে ওষুধ রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ ওষুধ রপ্তানি করেছে ১৩ কোটি ডলারের, যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছিল ১০ কোটি ৩৫ লাখ ডলার। করোনায় ওষুধের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ার দামের পালেও হাওয়া লেগেছে। মে ও জুনের শেয়ার লেনদেনে ওষুধ খাত ব্যাপকভাবে ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, জাতীয় অর্থনীতিতে ওষুধশিল্পের অবদান বাড়ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জিডিপিতে ওষুধ খাতের অবদান ছিল ১ দশমিক ৮৫ শতাংশ। বর্তমানে ২৫৭টি অনুমোদিত কোম্পানির মধ্যে উৎপাদনে রয়েছে ১৫০টি। সর্বশেষ ২০১৯ সালে ইবিএল সিকিউটিরিজের ওষুধ শিল্প খাত নিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ওষুধ শিল্পের বাজার ২০ হাজার ৫১১ কোটি টাকার। গত পাঁচ বছরে এ শিল্পের প্রবৃদ্ধি গড়ে ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ। পরবর্তী পাঁচ বছরে গড়ে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তথ্যমতে, চার দশক ধরে ওষুধ শিল্পে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। ওষুধের বৈশ্বিক বাজারের হিসাবে দেখা যায়, ২০১৮ সালের শুরুতে বিশ্বব্যাপী ওষুধের বাজার ছিল ১ হাজার ২০৫ বিলিয়ন ডলারের, যেখানে প্রবৃদ্ধি ছিল ৪ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩ সালে এটা ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। ওষুধ শিল্প সমিতির তথ্যানুযায়ী, গত দুই বছরে ১ হাজার ২০০ ধরনের ওষুধ রপ্তানির অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশে তৈরি ওষুধ বিশ্বের ১৪৭টি দেশে রপ্তানি হয়। রপ্তানিতে শীর্ষ সাত দেশ হচ্ছে মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান, কেনিয়া ও স্লোভেনিয়া। মোট ওষুধ রপ্তানির ৬০ দশমিক ৩২ শতাংশ যাচ্ছে এ দেশগুলোয়। আর বাকি ৩৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ অন্যান্য দেশে রপ্তানি হয়।

বাংলাদেশ পুরো বিশ্বকে কম মূল্যে প্যারাসিটামল তৈরি করে চমক লাগিয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয় হৃদরোগের জন্য অনেক দুর্লভ ওষুধ তৈরি করে তা বিদেশেও রফতানি করছে দেশ। একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ওষুধ শিল্প যুগান্তকারী অবদান রাখছে। পোশাক শিল্পের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলছে দেশের ওষুধ শিল্প। ওষুধ শিল্পের এত সুনামের সঙ্গে সঙ্গে নকল ওষুধের সহজলভ্যতা দেশ জাতীয় জীবনের জন্য অশনিসংকেত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফার্মেসি অনুষদের অধ্যাপক ডক্টর মুনির উদ্দিন চৌধুরীর একটি লেখায় নকল প্যারাসিটামল নিয়ে একটি উদাহরণ দিয়েছেন। একটা প্যারাসিটামল ট্যাবলেটে সক্রিয় উপাদান হিসেবে প্যারাসিটামল থাকে ৫০০ মিলিগ্রাম। সক্রিয় উপাদানের সঙ্গে আয়তন বাড়ানোর জন্য স্টার্চ, ল্যাকটোজ বা অন্যান্য নিষ্ক্রিয় উপাদান যোগ করাসহ ট্যাবলেটের আকার-আকৃতি প্রদানের জন্য অন্যান্য উপকরণ মিশিয়ে ওষুধের পরিপূর্ণ রূপ প্রদান করা হয়। অনেক সময় সক্রিয় উপাদানের পরিমাণ এত কম থাকে যে, (যেমন ১ মিলিগ্রাম) তা দিয়ে ওষুধের আকার-আকৃতি প্রদান করা যায় না। তাই নিষ্ক্রিয় উপকরণ মিশিয়ে আয়তন বাড়িয়ে ওষুধ তৈরি করা হয়। ওষুধে সক্রিয় উপাদান না থাকলে তাকে ওষুধ বলা যাবে না।

প্যারাসিটামল ব্যবহার না করেই শুধু স্টার্চ বা অন্যান্য উপকরণ দিয়ে এমন ট্যাবলেট তৈরি করা যায়, যা দেখলে মনে হবে হুবহু একটি প্যারাসিটামল ট্যাবলেট। সম্প্রতি সরকারের সক্রিয়তায় মাঠ পর্যায়ের অনেক দোকান হাসপাতাল সিলগালা করা হয়েছে, শুধুমাত্র নকল ওষুধ ও মেয়াদহীন ওষুধ বিপণন ও সংরক্ষণের জন্য। যাক ক্রেতাসাধারণের আস্তাকে অনেকাংশে কমিয়ে ফেলে। বিশেষ করে নকল ওষুধ একদিকে সেবার মানকে রিক্ত করে, অন্যদিকে ওষুধের প্রতি দেশের জনগণ ও মানুষের আস্থা কমায়; যা বলা যেতে পারে এক ধরনের জীবন মৃত্যু খেলা। পূর্ব অভিজ্ঞতা জানিয়ে রাখা ভালো, বিশ্ববাজারে পাটশিল্পে চাহিদা ও সুনাম নষ্ট হয়েছিল কিছুসংখ্যক অসাধু ব্যবসায়ীর কার্যকলাপে। যার ক্ষতি এখনো পুষানো সম্ভব হয়নি।

সেই একই পথে, অপার সম্ভাবনাময় ওষুধ শিল্পের সুনাম ও দেশের জনগণের আস্থা যেন জিম্মি না হয় কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর হাতে। যদিও আসল নকল ওষুধ সনাক্তকরণ সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। শনাক্ত করতে না পারায় স্বাভাবিক। তবে ব্যক্তিগত কিছু বিষয় জেনে রাখা ভালো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘ডব্লিওএইচও’র পরামর্শ অনুযায়ী, নকল ওষুধ চেনার ক্ষেত্রে কয়েকটি উপায় জেনে রাখতে পারি। সিরাপ, টনিক বা ওই জাতীয় বোতলজাত ওষুধের ক্ষেত্রে ওষুধের বোতলে সিল বা প্যাকেজিং-এ কোথাও কোনও গলদ (মোড়কের রং, আকার-আকৃতি, বানান ইত্যাদি সবই দেখে নিতে হবে) আছে কি-না, প্রথমেই তা ভাল করে দেখে নিতে হবে। কোনও রকম পার্থক্য বা সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়লেই ওই ওষুধ ফিরিয়ে দিন বিক্রেতাকে। বড়, ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল জাতীয় ওষুধের ক্ষেত্রে ওষুধের কোথাও কোন অংশ ভাঙা রয়েছে কি-না, স্বচ্ছ ক্যাপসুলের ভিতরে থাকা ওষুধের গুঁড়ার পরিমাণ আগের তুলনায় কম বা বেশি আছে কি-না, ওষুধের রঙে কোনও ফারাক রয়েছে কি-না তা ভাল করে দেখে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রেও ওষুধের মোড়কের রং, আকার-আকৃতি, বানান ইত্যাদি সবই ভাল করে দেখে নিতে হবে। যে কোন ওষুধের মোড়কের গায়ে তার ‘ইউনিক অথেনটিকেশন কোড’ লেখা থাকে।

এ ছাড়াও, ওষুধ খাওয়ার পর যদি শরীরে অস্বস্তি শুরু হয়, অ্যালার্জি হলে একটুও দেরি না করে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে। প্রয়োজনে সেই ওষুধটি চিকিৎসককে দেখানো যেতে পারে। এটি এক ধরনের ব্যক্তিগত সচেতনতা। এখন সেই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে সরকারের সচেতনতা বা সরকারি বিভিন্ন পদক্ষেপের নিশ্চিতকরন। বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দেওয়া সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য হলেও তা সংখ্যায় বাড়াতে হবে। তাহলে ওষুধের গুণগতমান এবং সেবারমান উন্নতে সহায়ক হবে। মাঠ পর্যায়ে তদারকির জন্য ফার্মাসিস্টদের নিয়োগ দিতে হবে। বাজার তদারকির ফলে নকল ওষুধ বিষয়ে ওষুধ বিক্রেতা ও ক্রেতার সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে আইনের সুষ্ঠুতা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা কখনই চাই না, নকল ওষুধের বিস্তারে বিপন্ন হোক জীবন, বিশ্ববাজারে ধসে পড়–ক সম্ভাবনাময় ওষুধ শিল্প। জীবন নিয়ে খেলা আর নয়, স্বজনের বুকভরা হাহাকারের কারণ যেন না হয়ে দাঁড়ায় নকল ওষুধের বিস্তার।

[লেখক : মানবাধিকারকর্মী, সার্চ মানবাধিকার সোসাইটি]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

নকল ওষুধ : সম্ভাবনাময় ওষুধ শিল্পের অন্তরায়

শেখ সায়মন পারভেজ হিমেল

শনিবার, ২২ মে ২০২১

বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার মান নাজুক অবস্থা হলেও বিশ্ববাজারে ওষুধ শিল্পের রয়েছে বেশ সুনাম ও আস্তা। সেই সঙ্গে দেশের চাহিদা মিটিয়ে ঔষধ বহির্বিশ্বে রপ্তানি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে ওষুধের যে সহজলভ্যতা রয়েছে, তা পৃথিবীর কয়টা দেশেই বা আছে। সোনালী আঁশের দেশ বাংলাদেশ পাট রপ্তানিতে ইতিমধ্যে বিশ্ববাজারে চুকিয়ে গেলেও পোশাক ও ওষুধ শিল্পের সুনাম ক্রমশ বর্ধমান। বিশ্ববাজারে ওষুধ শিল্পের ক্রমশ বর্ধমান নিয়ে ‘দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন’ একটি প্রতিবেদন দেখলাম। যেখানে বলা হয়, দেশের ৯৮ শতাংশ চাহিদা মিটিয়ে ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে ১৬০টি দেশে। শুধু তাই নয়, বিশ্বের ৪৮ দেশের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশের ওষুধ। দেশের ২৫৭টি কোম্পানির কারখানায় বছরে ২৪ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদিত হচ্ছে। বছরে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ওষুধ ও কাঁচামাল উৎপাদিত হচ্ছে এসব কারখানায়। এ শিল্পে প্রায় ২ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশীয় ৪৬ কোম্পানির ৩০০ ধরনের ওষুধপণ্য বিশ্ববাজারে রপ্তানি হয়। শুধু ওষুধ রপ্তানিতে বিশ্ববাজার থেকে বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা বা এলডিসি হিসেবে ওষুধশিল্পে মেধাস্বত্ব ছাড় ১৭ বছর বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প খাতে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত মেধাস্বত্ব ছাড় পাচ্ছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ওষুধ রপ্তানির আকার বাড়াতে চায় বাংলাদেশ। বিশ্ববাজারে এখন ওষুধের বার্ষিক ব্যয় ৯৫ হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার। ইপিবির তথ্য বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ওষুধ রপ্তানি হয়েছে ১৩ কোটি ৫৭ লাখ ডলারের। আগের বছরের চেয়ে ওষুধ রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ ওষুধ রপ্তানি করেছে ১৩ কোটি ডলারের, যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছিল ১০ কোটি ৩৫ লাখ ডলার। করোনায় ওষুধের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ার দামের পালেও হাওয়া লেগেছে। মে ও জুনের শেয়ার লেনদেনে ওষুধ খাত ব্যাপকভাবে ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, জাতীয় অর্থনীতিতে ওষুধশিল্পের অবদান বাড়ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জিডিপিতে ওষুধ খাতের অবদান ছিল ১ দশমিক ৮৫ শতাংশ। বর্তমানে ২৫৭টি অনুমোদিত কোম্পানির মধ্যে উৎপাদনে রয়েছে ১৫০টি। সর্বশেষ ২০১৯ সালে ইবিএল সিকিউটিরিজের ওষুধ শিল্প খাত নিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ওষুধ শিল্পের বাজার ২০ হাজার ৫১১ কোটি টাকার। গত পাঁচ বছরে এ শিল্পের প্রবৃদ্ধি গড়ে ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ। পরবর্তী পাঁচ বছরে গড়ে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তথ্যমতে, চার দশক ধরে ওষুধ শিল্পে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। ওষুধের বৈশ্বিক বাজারের হিসাবে দেখা যায়, ২০১৮ সালের শুরুতে বিশ্বব্যাপী ওষুধের বাজার ছিল ১ হাজার ২০৫ বিলিয়ন ডলারের, যেখানে প্রবৃদ্ধি ছিল ৪ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩ সালে এটা ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। ওষুধ শিল্প সমিতির তথ্যানুযায়ী, গত দুই বছরে ১ হাজার ২০০ ধরনের ওষুধ রপ্তানির অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশে তৈরি ওষুধ বিশ্বের ১৪৭টি দেশে রপ্তানি হয়। রপ্তানিতে শীর্ষ সাত দেশ হচ্ছে মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান, কেনিয়া ও স্লোভেনিয়া। মোট ওষুধ রপ্তানির ৬০ দশমিক ৩২ শতাংশ যাচ্ছে এ দেশগুলোয়। আর বাকি ৩৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ অন্যান্য দেশে রপ্তানি হয়।

বাংলাদেশ পুরো বিশ্বকে কম মূল্যে প্যারাসিটামল তৈরি করে চমক লাগিয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয় হৃদরোগের জন্য অনেক দুর্লভ ওষুধ তৈরি করে তা বিদেশেও রফতানি করছে দেশ। একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ওষুধ শিল্প যুগান্তকারী অবদান রাখছে। পোশাক শিল্পের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলছে দেশের ওষুধ শিল্প। ওষুধ শিল্পের এত সুনামের সঙ্গে সঙ্গে নকল ওষুধের সহজলভ্যতা দেশ জাতীয় জীবনের জন্য অশনিসংকেত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফার্মেসি অনুষদের অধ্যাপক ডক্টর মুনির উদ্দিন চৌধুরীর একটি লেখায় নকল প্যারাসিটামল নিয়ে একটি উদাহরণ দিয়েছেন। একটা প্যারাসিটামল ট্যাবলেটে সক্রিয় উপাদান হিসেবে প্যারাসিটামল থাকে ৫০০ মিলিগ্রাম। সক্রিয় উপাদানের সঙ্গে আয়তন বাড়ানোর জন্য স্টার্চ, ল্যাকটোজ বা অন্যান্য নিষ্ক্রিয় উপাদান যোগ করাসহ ট্যাবলেটের আকার-আকৃতি প্রদানের জন্য অন্যান্য উপকরণ মিশিয়ে ওষুধের পরিপূর্ণ রূপ প্রদান করা হয়। অনেক সময় সক্রিয় উপাদানের পরিমাণ এত কম থাকে যে, (যেমন ১ মিলিগ্রাম) তা দিয়ে ওষুধের আকার-আকৃতি প্রদান করা যায় না। তাই নিষ্ক্রিয় উপকরণ মিশিয়ে আয়তন বাড়িয়ে ওষুধ তৈরি করা হয়। ওষুধে সক্রিয় উপাদান না থাকলে তাকে ওষুধ বলা যাবে না।

প্যারাসিটামল ব্যবহার না করেই শুধু স্টার্চ বা অন্যান্য উপকরণ দিয়ে এমন ট্যাবলেট তৈরি করা যায়, যা দেখলে মনে হবে হুবহু একটি প্যারাসিটামল ট্যাবলেট। সম্প্রতি সরকারের সক্রিয়তায় মাঠ পর্যায়ের অনেক দোকান হাসপাতাল সিলগালা করা হয়েছে, শুধুমাত্র নকল ওষুধ ও মেয়াদহীন ওষুধ বিপণন ও সংরক্ষণের জন্য। যাক ক্রেতাসাধারণের আস্তাকে অনেকাংশে কমিয়ে ফেলে। বিশেষ করে নকল ওষুধ একদিকে সেবার মানকে রিক্ত করে, অন্যদিকে ওষুধের প্রতি দেশের জনগণ ও মানুষের আস্থা কমায়; যা বলা যেতে পারে এক ধরনের জীবন মৃত্যু খেলা। পূর্ব অভিজ্ঞতা জানিয়ে রাখা ভালো, বিশ্ববাজারে পাটশিল্পে চাহিদা ও সুনাম নষ্ট হয়েছিল কিছুসংখ্যক অসাধু ব্যবসায়ীর কার্যকলাপে। যার ক্ষতি এখনো পুষানো সম্ভব হয়নি।

সেই একই পথে, অপার সম্ভাবনাময় ওষুধ শিল্পের সুনাম ও দেশের জনগণের আস্থা যেন জিম্মি না হয় কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর হাতে। যদিও আসল নকল ওষুধ সনাক্তকরণ সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। শনাক্ত করতে না পারায় স্বাভাবিক। তবে ব্যক্তিগত কিছু বিষয় জেনে রাখা ভালো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘ডব্লিওএইচও’র পরামর্শ অনুযায়ী, নকল ওষুধ চেনার ক্ষেত্রে কয়েকটি উপায় জেনে রাখতে পারি। সিরাপ, টনিক বা ওই জাতীয় বোতলজাত ওষুধের ক্ষেত্রে ওষুধের বোতলে সিল বা প্যাকেজিং-এ কোথাও কোনও গলদ (মোড়কের রং, আকার-আকৃতি, বানান ইত্যাদি সবই দেখে নিতে হবে) আছে কি-না, প্রথমেই তা ভাল করে দেখে নিতে হবে। কোনও রকম পার্থক্য বা সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়লেই ওই ওষুধ ফিরিয়ে দিন বিক্রেতাকে। বড়, ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল জাতীয় ওষুধের ক্ষেত্রে ওষুধের কোথাও কোন অংশ ভাঙা রয়েছে কি-না, স্বচ্ছ ক্যাপসুলের ভিতরে থাকা ওষুধের গুঁড়ার পরিমাণ আগের তুলনায় কম বা বেশি আছে কি-না, ওষুধের রঙে কোনও ফারাক রয়েছে কি-না তা ভাল করে দেখে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রেও ওষুধের মোড়কের রং, আকার-আকৃতি, বানান ইত্যাদি সবই ভাল করে দেখে নিতে হবে। যে কোন ওষুধের মোড়কের গায়ে তার ‘ইউনিক অথেনটিকেশন কোড’ লেখা থাকে।

এ ছাড়াও, ওষুধ খাওয়ার পর যদি শরীরে অস্বস্তি শুরু হয়, অ্যালার্জি হলে একটুও দেরি না করে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে। প্রয়োজনে সেই ওষুধটি চিকিৎসককে দেখানো যেতে পারে। এটি এক ধরনের ব্যক্তিগত সচেতনতা। এখন সেই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে সরকারের সচেতনতা বা সরকারি বিভিন্ন পদক্ষেপের নিশ্চিতকরন। বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দেওয়া সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য হলেও তা সংখ্যায় বাড়াতে হবে। তাহলে ওষুধের গুণগতমান এবং সেবারমান উন্নতে সহায়ক হবে। মাঠ পর্যায়ে তদারকির জন্য ফার্মাসিস্টদের নিয়োগ দিতে হবে। বাজার তদারকির ফলে নকল ওষুধ বিষয়ে ওষুধ বিক্রেতা ও ক্রেতার সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে আইনের সুষ্ঠুতা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা কখনই চাই না, নকল ওষুধের বিস্তারে বিপন্ন হোক জীবন, বিশ্ববাজারে ধসে পড়–ক সম্ভাবনাময় ওষুধ শিল্প। জীবন নিয়ে খেলা আর নয়, স্বজনের বুকভরা হাহাকারের কারণ যেন না হয়ে দাঁড়ায় নকল ওষুধের বিস্তার।

[লেখক : মানবাধিকারকর্মী, সার্চ মানবাধিকার সোসাইটি]

back to top