alt

মুক্ত আলোচনা

সুন্দর আগামী : প্রসঙ্গ নারী উন্নয়ন

মুসলিমা খাতুন

: শনিবার, ২২ মে ২০২১

আজকের মেয়ে শিশু আগামীকালের নারী। সমতা, উন্নয়ন ও শান্তির লক্ষ্যসমূহ পরিপূর্ণভাবে অর্জনের জন্য মেয়ে শিশুর দক্ষতা, সৃজনশীলতা ও শক্তির বিকাশ গুরুত্বপূর্ণ। মেয়ে সন্তান যেন তার পূর্ণ সম্ভাবনা নিয়ে বিকশিত হতে পারে, এ জন্য তাকে সক্ষম করে গড়ে তোলার সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। তার টিকে থাকা, নিরাপত্তা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, উন্নতির জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীকে পুরুষের সমান অংশীদার করতে হলে এখন থেকেই মেয়ে শিশুকে সমান মর্যাদা ও গুরুত্ব দিতে হবে। তৈরি করতে হবে তার মানসিকতা সেভাবেই। মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতাগুলো পরিপূর্ণভাবে ভোগ করার সুযোগ দিতে হবে তাকে। শিশু অধিকার বিষয়ক কনভেনশনে যেসব অধিকারের কথা বলা হয়েছে, মেয়ে শিশুকে তার সবগুলো পূরণের নিশ্চয়তা আমাদের পূরণ করতে হবে।

বিশ্বব্যাপী মেয়েদের বিরুদ্ধে বৈষম্য ও সহিংসতা জীবনের প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু হয় এবং তা অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। প্রয়োজনীয় পুষ্টি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষার সুযোগ অনেক ক্ষেত্রেই তাদের কম থাকে। ছেলেদের তুলনায় কন্যা শিশুরা শৈশব ও কৈশোরের অধিকার, সমান সুযোগ তেমনভাবে ভোগ করতে পারে না। তারা প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হয়।

বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে তিন কোটি কিশোর-কিশোরী রয়েছে। তারা মোট জনসংখ্যার ২১ শতাংশ। অথচ এ তরুণ জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ফলে তাদের কম পারিশ্রমিকের কাজে আটকে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। এ সময় তাদের মূল্যবোধ ও দক্ষতা তৈরি হয়, যার বিরাট প্রভাব থাকে পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর। তাদের প্রয়োজন এবং সমস্যাগুলোর প্রতি নজর দেয়া অত্যন্ত জরুরি।

এছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ ভীষণভাবে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগপ্রবণ। এ রকম পরিস্থিতিতে শিশুশ্রম, পাচার ও বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়। সংকট ও দুর্যোগের সময় আশ্রয় কেন্দ্রেও নারী ও কন্যা শিশুরা অনিরাপদ থাকে। ফলে সরকারের আন্তরিক ও সর্বাত্মক প্রচেষ্টার পরও সঠিক অর্থে নারীর উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।

নারী ও শিশুর উন্নয়নে সরকার ও ইউনিসেফ দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। ২০১২ সাল থেকে ইউনিসেফ তিনশ’র বেশি তরুণ-তরুণী ক্লাবকে সহায়তা দিচ্ছে। এর সদস্য সংখ্যা বর্তমানে লাখের বেশি। জ্ঞান ও সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সমাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ বাড়াতে জীবনাভিজ্ঞতার প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এসব ক্লাবের মাধ্যমে। এছাড়া মেয়েদের বিশ্লেষণমূলক চিন্তা, সমঝোতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা তৈরিতে বিশেষ নজর দেয়া হয় জ্ঞানাবলির কর্মকাণ্ডে। এ ক্লাবগুলোর মাধ্যমে অল্পবয়সীরা নিজেদের মধ্যে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে জীবনমুখী দক্ষতা আয়ত্ত করতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা তৈরিতে ক্লাবের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এতে করে সামাজিক কর্মকা-ে নেতৃত্ব দেয়ার গুণাবলি গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে। বাল্যবিয়ে বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টি হয়। এ সবই নারী উন্নয়নের পেছনে শক্তি হিসেবে কাজ করে।

কিশোর-কিশোরীবান্ধব নীতিমালা ও কর্মসূচি প্রণয়নে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, বেসরকারি খাত, জাতীয় ও আঞ্চলিক প্রচারমাধ্যম এবং ইউনিসেফ জাতিসংঘের অপরাপর সংস্থার সঙ্গে কাজ করে। তাদের অধিকার ও বিভিন্ন সমস্যার বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণ এবং তাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, আচরণ ও সামাজিক প্রথার পরিবর্তনের উপযোগী পরিবেশ তৈরিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কাজে লাগানো হয় এদের কর্মকা-ের মাধ্যমে। বয়স উপযোগী, সাংস্কৃতিকভাবে সংবেদনশীল এবং শিশুদের বিনোদন ও শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান তৈরিতে সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সরকারি ও স্থানীয় মিডিয়ার নির্মাতাদের সঙ্গে কাজ করে ইউনিসেফ। সরকার তাদের এ কাজের সঙ্গে সরাসরি জড়িত এবং পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে।

উন্নয়নের পূর্ববার্তা হিসেবে তথ্য জানা ও হালনাগাদ থাকার আওতায় জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সচেতনতা বৃদ্ধিতে বেতারের শ্রোতা গ্রুপ, প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোগ ও কমিউনিটি মিডিয়া, ফোন-ইন, শো ও কুইজ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কিশোর-কিশোরীদের সম্পৃক্ত করা হয়। এর মাধ্যমে জরুরি পরিস্থিতিতে হয়রানি, সহিংসতা ও অবহেলার বিষয়ে অভিযোগ জানানোর জন্য তাদের সক্ষমতা তৈরিতে সহায়তা করা হয়।

এরই আওতায় কিশোর-কিশোরীদের ক্লাব গঠন করে তাদের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে জুলাই ২০১১ থেকে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর দেশের ৭টি বিভাগের ৭টি জেলার প্রত্যেক উপজেলায় সব ইউনিয়নে সর্বমোট ৩৭৯টি কিশোর-কিশোরী ক্লাব পরিচালনা করে আসছে। জেলাগুলো হলো গোপালগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, ঠাকুরগাঁও, ঝালকাঠি, রাঙ্গামাটি, মৌলভীবাজার ও সিরাজগঞ্জ জেলাতে এ কার্যক্রম চলছে। ক্লাবে কিশোর-কিশোরীরা মিলিত হয়ে বাল্যবিবাহ, যৌতুক, ইভটিজিংসহ বিভিন্ন সচেতনতামূলক বিষয়ে পারস্পরিক আলোচনা করে। এই ক্লাবগুলোর মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা প্রদর্শন শিখানো হয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ‘কিশোর-কিশোরী ক্লাব প্রকল্প’র আওতায় সারা দেশের সকল ইউনিয়নে ৪৮৮৩টি কিশোর-কিশোরী ক্লাব গঠন করা হয়েছে।

নারী ও শিশুর উন্নয়নে গত ১১ বছরে সরকার বেশকিছু আইন-নীতি ও বিধিমালা প্রণয়ণ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১; জাতীয় শিশু নীতি ২০১১; শিশুর প্রারম্ভিক যতœ ও বিকাশের সমন্বিত নীতি ২০১৩; মনোসামাজিক কাউন্সেলিং নীতিমালা ২০১৬ (খসড়া); জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়নকল্পে কর্মপরিকল্পনা ২০১৩-২০১৫; পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০; ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) আইন, ২০১৪; পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) বিধিমালা ২০১৩; বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭ ইত্যাদি।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম নারী ও শিশু নির্যাতন হ্রাস করা এবং সেবা কার্যক্রম জোরদারকরণে কাজ করে যাচ্ছে। এই প্রকল্পের আওতায় ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, বরিশাল, রংপুর ও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) স্থাপন করা হয়েছে। স্বাস্থ্য সেবা, পুলিশ ও আইনি সহায়তা, মানসিক ও সামাজিক কাউন্সেলিং, আশ্রয়সেবা এবং ডিএনএ পরীক্ষার সুবিধা ওসিসি থেকে প্রদান করা হয়। দেশব্যাপী নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের সেবাপ্রাপ্তির সুবিধার্থে দেশের ৪০টি জেলা সদর হাসপাতাল এবং ২০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২০১২ সালে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেল স্থাপন করা হয়েছে। এসবই নারী ও শিশুদের সুরক্ষা প্রদানে সরকারের উন্নয়ন প্রচেষ্টার বার্তা।

এছাড়া, নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রকল্পের আওতায় ১৯ জুন ২০১২ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ন্যাশনাল হেল্পলাইন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই সেন্টারে টোলফ্রি হেল্পলাইন ১০৯ নম্বরে ফোন করে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশু, তাদের পরিবার এবং সংশ্লিষ্ট সকলে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য, পরামর্শসহ দেশে বিরাজমান সেবা এবং সহায়তা সম্পর্কে জানতে পারে।

লিঙ্গ বৈষম্য দূর করে মেয়েদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের জন্যও অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানে ১০, ১৯, ২৭, ২৮, ২৯ অনুচ্ছেদে নারীর অধিকার সুরক্ষা এবং নারীর ক্ষমতায়নের সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা রয়েছে। বাংলাদেশ ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘ প্রণীত নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ সনদ (সিডো)-তে অনুস্বাক্ষরকারী একটি দেশ।

উন্নয়নের জন্য নারীর সুরক্ষা এবং ক্ষমতায়নের চেয়ে অধিকতর কার্যকর কোনো হাতিয়ার নেই। স্বাস্থ্যখাতে উন্নয়ন নিশ্চিত এবং মেয়ে শিশুর শিক্ষা, সম্ভাবনা এবং তাদের বিকশিত করার জন্যে প্রয়োজন নারীর ক্ষমতায়ন। দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে তরুণ জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা অপরিহার্য। এ লক্ষ্যে সরকার দেশের স্বার্থেই নারী সমাজকে উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম ও নীতিমালায় মেয়ে শিশুদের অধিক গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। সরকারের এ প্রচেষ্টাকে সফল করতে শুধু ইউনিসেফ এবং অন্যান্য কিছু প্রতিষ্ঠানই শুধু নয়, আমাদের প্রত্যেককেই এগিয়ে আসতে হবে যার যার অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ আন্তরিক প্রচেষ্টা ও সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে।

(পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম নিবন্ধ)

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

সুন্দর আগামী : প্রসঙ্গ নারী উন্নয়ন

মুসলিমা খাতুন

শনিবার, ২২ মে ২০২১

আজকের মেয়ে শিশু আগামীকালের নারী। সমতা, উন্নয়ন ও শান্তির লক্ষ্যসমূহ পরিপূর্ণভাবে অর্জনের জন্য মেয়ে শিশুর দক্ষতা, সৃজনশীলতা ও শক্তির বিকাশ গুরুত্বপূর্ণ। মেয়ে সন্তান যেন তার পূর্ণ সম্ভাবনা নিয়ে বিকশিত হতে পারে, এ জন্য তাকে সক্ষম করে গড়ে তোলার সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। তার টিকে থাকা, নিরাপত্তা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, উন্নতির জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীকে পুরুষের সমান অংশীদার করতে হলে এখন থেকেই মেয়ে শিশুকে সমান মর্যাদা ও গুরুত্ব দিতে হবে। তৈরি করতে হবে তার মানসিকতা সেভাবেই। মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতাগুলো পরিপূর্ণভাবে ভোগ করার সুযোগ দিতে হবে তাকে। শিশু অধিকার বিষয়ক কনভেনশনে যেসব অধিকারের কথা বলা হয়েছে, মেয়ে শিশুকে তার সবগুলো পূরণের নিশ্চয়তা আমাদের পূরণ করতে হবে।

বিশ্বব্যাপী মেয়েদের বিরুদ্ধে বৈষম্য ও সহিংসতা জীবনের প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু হয় এবং তা অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। প্রয়োজনীয় পুষ্টি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষার সুযোগ অনেক ক্ষেত্রেই তাদের কম থাকে। ছেলেদের তুলনায় কন্যা শিশুরা শৈশব ও কৈশোরের অধিকার, সমান সুযোগ তেমনভাবে ভোগ করতে পারে না। তারা প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হয়।

বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে তিন কোটি কিশোর-কিশোরী রয়েছে। তারা মোট জনসংখ্যার ২১ শতাংশ। অথচ এ তরুণ জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ফলে তাদের কম পারিশ্রমিকের কাজে আটকে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। এ সময় তাদের মূল্যবোধ ও দক্ষতা তৈরি হয়, যার বিরাট প্রভাব থাকে পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর। তাদের প্রয়োজন এবং সমস্যাগুলোর প্রতি নজর দেয়া অত্যন্ত জরুরি।

এছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ ভীষণভাবে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগপ্রবণ। এ রকম পরিস্থিতিতে শিশুশ্রম, পাচার ও বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়। সংকট ও দুর্যোগের সময় আশ্রয় কেন্দ্রেও নারী ও কন্যা শিশুরা অনিরাপদ থাকে। ফলে সরকারের আন্তরিক ও সর্বাত্মক প্রচেষ্টার পরও সঠিক অর্থে নারীর উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।

নারী ও শিশুর উন্নয়নে সরকার ও ইউনিসেফ দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। ২০১২ সাল থেকে ইউনিসেফ তিনশ’র বেশি তরুণ-তরুণী ক্লাবকে সহায়তা দিচ্ছে। এর সদস্য সংখ্যা বর্তমানে লাখের বেশি। জ্ঞান ও সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সমাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ বাড়াতে জীবনাভিজ্ঞতার প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এসব ক্লাবের মাধ্যমে। এছাড়া মেয়েদের বিশ্লেষণমূলক চিন্তা, সমঝোতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা তৈরিতে বিশেষ নজর দেয়া হয় জ্ঞানাবলির কর্মকাণ্ডে। এ ক্লাবগুলোর মাধ্যমে অল্পবয়সীরা নিজেদের মধ্যে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে জীবনমুখী দক্ষতা আয়ত্ত করতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা তৈরিতে ক্লাবের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এতে করে সামাজিক কর্মকা-ে নেতৃত্ব দেয়ার গুণাবলি গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে। বাল্যবিয়ে বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টি হয়। এ সবই নারী উন্নয়নের পেছনে শক্তি হিসেবে কাজ করে।

কিশোর-কিশোরীবান্ধব নীতিমালা ও কর্মসূচি প্রণয়নে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, বেসরকারি খাত, জাতীয় ও আঞ্চলিক প্রচারমাধ্যম এবং ইউনিসেফ জাতিসংঘের অপরাপর সংস্থার সঙ্গে কাজ করে। তাদের অধিকার ও বিভিন্ন সমস্যার বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণ এবং তাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, আচরণ ও সামাজিক প্রথার পরিবর্তনের উপযোগী পরিবেশ তৈরিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কাজে লাগানো হয় এদের কর্মকা-ের মাধ্যমে। বয়স উপযোগী, সাংস্কৃতিকভাবে সংবেদনশীল এবং শিশুদের বিনোদন ও শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান তৈরিতে সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সরকারি ও স্থানীয় মিডিয়ার নির্মাতাদের সঙ্গে কাজ করে ইউনিসেফ। সরকার তাদের এ কাজের সঙ্গে সরাসরি জড়িত এবং পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে।

উন্নয়নের পূর্ববার্তা হিসেবে তথ্য জানা ও হালনাগাদ থাকার আওতায় জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সচেতনতা বৃদ্ধিতে বেতারের শ্রোতা গ্রুপ, প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোগ ও কমিউনিটি মিডিয়া, ফোন-ইন, শো ও কুইজ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কিশোর-কিশোরীদের সম্পৃক্ত করা হয়। এর মাধ্যমে জরুরি পরিস্থিতিতে হয়রানি, সহিংসতা ও অবহেলার বিষয়ে অভিযোগ জানানোর জন্য তাদের সক্ষমতা তৈরিতে সহায়তা করা হয়।

এরই আওতায় কিশোর-কিশোরীদের ক্লাব গঠন করে তাদের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে জুলাই ২০১১ থেকে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর দেশের ৭টি বিভাগের ৭টি জেলার প্রত্যেক উপজেলায় সব ইউনিয়নে সর্বমোট ৩৭৯টি কিশোর-কিশোরী ক্লাব পরিচালনা করে আসছে। জেলাগুলো হলো গোপালগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, ঠাকুরগাঁও, ঝালকাঠি, রাঙ্গামাটি, মৌলভীবাজার ও সিরাজগঞ্জ জেলাতে এ কার্যক্রম চলছে। ক্লাবে কিশোর-কিশোরীরা মিলিত হয়ে বাল্যবিবাহ, যৌতুক, ইভটিজিংসহ বিভিন্ন সচেতনতামূলক বিষয়ে পারস্পরিক আলোচনা করে। এই ক্লাবগুলোর মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা প্রদর্শন শিখানো হয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ‘কিশোর-কিশোরী ক্লাব প্রকল্প’র আওতায় সারা দেশের সকল ইউনিয়নে ৪৮৮৩টি কিশোর-কিশোরী ক্লাব গঠন করা হয়েছে।

নারী ও শিশুর উন্নয়নে গত ১১ বছরে সরকার বেশকিছু আইন-নীতি ও বিধিমালা প্রণয়ণ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১; জাতীয় শিশু নীতি ২০১১; শিশুর প্রারম্ভিক যতœ ও বিকাশের সমন্বিত নীতি ২০১৩; মনোসামাজিক কাউন্সেলিং নীতিমালা ২০১৬ (খসড়া); জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়নকল্পে কর্মপরিকল্পনা ২০১৩-২০১৫; পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০; ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) আইন, ২০১৪; পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) বিধিমালা ২০১৩; বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭ ইত্যাদি।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম নারী ও শিশু নির্যাতন হ্রাস করা এবং সেবা কার্যক্রম জোরদারকরণে কাজ করে যাচ্ছে। এই প্রকল্পের আওতায় ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, বরিশাল, রংপুর ও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) স্থাপন করা হয়েছে। স্বাস্থ্য সেবা, পুলিশ ও আইনি সহায়তা, মানসিক ও সামাজিক কাউন্সেলিং, আশ্রয়সেবা এবং ডিএনএ পরীক্ষার সুবিধা ওসিসি থেকে প্রদান করা হয়। দেশব্যাপী নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের সেবাপ্রাপ্তির সুবিধার্থে দেশের ৪০টি জেলা সদর হাসপাতাল এবং ২০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২০১২ সালে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেল স্থাপন করা হয়েছে। এসবই নারী ও শিশুদের সুরক্ষা প্রদানে সরকারের উন্নয়ন প্রচেষ্টার বার্তা।

এছাড়া, নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রকল্পের আওতায় ১৯ জুন ২০১২ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ন্যাশনাল হেল্পলাইন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই সেন্টারে টোলফ্রি হেল্পলাইন ১০৯ নম্বরে ফোন করে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশু, তাদের পরিবার এবং সংশ্লিষ্ট সকলে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য, পরামর্শসহ দেশে বিরাজমান সেবা এবং সহায়তা সম্পর্কে জানতে পারে।

লিঙ্গ বৈষম্য দূর করে মেয়েদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের জন্যও অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানে ১০, ১৯, ২৭, ২৮, ২৯ অনুচ্ছেদে নারীর অধিকার সুরক্ষা এবং নারীর ক্ষমতায়নের সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা রয়েছে। বাংলাদেশ ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘ প্রণীত নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ সনদ (সিডো)-তে অনুস্বাক্ষরকারী একটি দেশ।

উন্নয়নের জন্য নারীর সুরক্ষা এবং ক্ষমতায়নের চেয়ে অধিকতর কার্যকর কোনো হাতিয়ার নেই। স্বাস্থ্যখাতে উন্নয়ন নিশ্চিত এবং মেয়ে শিশুর শিক্ষা, সম্ভাবনা এবং তাদের বিকশিত করার জন্যে প্রয়োজন নারীর ক্ষমতায়ন। দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে তরুণ জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা অপরিহার্য। এ লক্ষ্যে সরকার দেশের স্বার্থেই নারী সমাজকে উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম ও নীতিমালায় মেয়ে শিশুদের অধিক গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। সরকারের এ প্রচেষ্টাকে সফল করতে শুধু ইউনিসেফ এবং অন্যান্য কিছু প্রতিষ্ঠানই শুধু নয়, আমাদের প্রত্যেককেই এগিয়ে আসতে হবে যার যার অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ আন্তরিক প্রচেষ্টা ও সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে।

(পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম নিবন্ধ)

back to top