শেখর ভট্টাচার্য
বাংলা সাহিত্যের রাখাল রাজা কাজী নজরুল ইসলাম আর বাংলাদেশের রাজনীতির মুকুটহীন রাজা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দুজনের জীবন, জীবন আচরণ, জীবন সংগ্রাম এবং আদর্শের অসাধারণ কিছু সাদৃশ্য রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শবিহীন বাংলাদেশ আর নজরুলের চেতনাবিহীন বাঙালির কথা আমরা ভাবতেই পারি না। এই যে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলি, বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলি, অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলি, সাম্যের গান গাই, স্বাধীনতার কথা বলি এগুলো প্রতিটি বিষয়ে আমরা প্রেরণা সংগ্রহ করি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য কর্ম থেকে। প্রাণ খোলা অকৃত্রিম মানুষ ছিলেন নজরুল। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে এবং মনুষ্যত্বের অপমানের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন প্রতিবাদী এবং আপসহীন। অন্যায়কে সহ্য করতেন না, জেলজুলুমের ভয় করতেন না। অথচ তার ছিল অসম্ভব রোমান্টিক একটি মন। নজরুল নিজের মনের ভেতর একটি শিশুকে লালন করে গেছেন, যে শিশুটি তাকে নিষ্পাপ, দ্রোহী হিসেবে গড়ে তোলেছে।
নজরুলের জন্ম ১৮৯৯ সালে আর বঙ্গবন্ধুর জন্ম ১৯২০ সালে। দুজনই ঔপনিবেশিক আমলের নিপীড়ন নির্যাতন প্রত্যক্ষ করেছেন। ১৯৪২ সালের আগস্ট মাসে দুরারোগ্য ব্যধিতে নজরুল তার সৃষ্টিশীল সচেতন সত্তা হারিয়ে ফেলেন; এর সঙ্গে সঙ্গে তার সৃষ্টি কর্মেও পড়ে চিরদিনের জন্য বিরতি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তার নেতৃত্ব ও অভিভাবক্ত হারা করা হয় বাঙালিকে ১৯৭৫ সালে, তাও সেই আগস্ট মাসে। বঙ্গবন্ধু বাঙলার মাটি, মানুষ, জলের সঙ্গে এমন ভাবে একাত্ম হয়েছিলেন, যা তাকে একজন রাজনীতির কবিতে রূপান্তরিত করে ফেলেছিল। নজরুল মূলত কবি, কিন্তু রাজনীতির প্রতি তার সক্রিয় আগ্রহ। বঙ্গবন্ধু মূলত রাজনীতিবীদ, কবি ও কবিতার প্রতি তার আগ্রহ সীমাহীন। বঙ্গবন্ধুর মনেও একজন শিশু বসবাস করতো যে শিশু তাকে বাঙালির সঙ্গে একাত্ম করে দিতো। শিশুর মতো উদার বলেই তিনি কখনো তার চারপাশে লুকিয়ে থাকা শত্রুদের দেখতে পেতেন না, নিজের সুরক্ষার ব্যাপারে ছিলেন উদাসীন।
বঙ্গবন্ধু মুসলিম-লীগ, আওয়ামী মুসলিম-লীগ হয়ে আওয়ামী-লীগের নেতৃত্ব প্রাপ্ত হন একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। কাজী নজরুল লেটোর দলের শিল্পী, সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী থেকে তার মূল তৃষ্ণার স্থল কবিতাতে এসে উপস্থিত হন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। দুজনের জীবনই বর্ণাঢ্য, সারা দেশের মানুষের কাছে সীমাহীন জনপ্রিয়তা দু’জনের। দু’জনই বাঙলা, বাঙালি অন্তঃপ্রাণ। দুজনই মানবতাবাদী এবং মানুষের নায্যতায় বিশ্বাসী। বহুমাত্রিক বঙ্গবন্ধুর বর্ণিল ব্যক্তিত্বের এক বড় অংশজুড়ে রয়েছেন সাধারণ মানুষ। তাদের মঙ্গলের জন্য তার প্রচেষ্টার শেষ নেই। তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আমরা অসংখ্য সাধারণ মানুষের খোঁজ পাই। বঙ্গবন্ধু আজীবন শোষিত ও প্রান্তজনের সখা। এই বঙ্গবন্ধুই জাতিসংঘে বলেছিলেন, ‘পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে শোষক, অন্যদিকে শোষিত মানুষ। আমি শোষিতের পক্ষে। ’এ’ এক অসাধারন উচ্চারন। কোন রাজনীতির মারপ্যাচ নেই, কোন ভয় নেই, শোষিতের পক্ষে থাকার তার যে স্বাভাবীক অবস্থান তা’হলো আপসহীন।
কাজী নজরুল বঙ্গবন্ধুর মতো মানবতাবাদী এবং সাম্যবাদী। নজরুল সাম্য, মানবতার জন্য প্রমিথিথিউসের মতো জীবন উৎসর্গ করতে সদা প্রস্তুত। তিনি তার সচেতন সত্তা হারানোর মাত্র ৯৬ দিন পূর্বে ১৯৪১ সালের ৬ এপ্রিল যে অভিভাষন দেন সেখানে তার স্বভাবজাত প্রকৃতি অনুযায়ী বলেন, মানুষের জীবনে এক দিকে কঠোর দারিদ্র্য-ঋণ-অভাব; অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তূপের মতো জমা হয়ে আছে। এ অসাম্য ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। নজরুল শোষিতের পক্ষ অবলম্বনে কোন রাখঢাক রাখেননি। তিনি তার সৃষ্টিশীলতার প্রায় সব প্রয়াস মনুষ্যত্ব, মানব ধর্মের বিকাশ এবং প্রগতির পথের বাধা দূর করার জন্য নিবেদন করেছিলেন। তিনি যখন বলেন, “গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কছু মহীয়ান” আমরা বাঙালি মনন ও ঐতিহ্যের কবি চণ্ডিদাসের উচ্চারণ সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই, এই শাশ্বত কথাটির প্রতিধ্বনি যেন শুনতে পাই।
নজরুলের বিদ্রোহের স্বরূপ বুঝতে সমকালে এমনকি একালেও অনেকেরই সামর্থের সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করা যায়। নজরুলের বিদ্রোহ যে বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থা, মানুষে মানুষে বৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা, গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও অসাঞ্জস্যতার বিরুদ্ধে এ কথাটির অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে অক্ষম আমরা। নজরুলকে এ কারণে তার অভিভাষণে নিজেকেই নিজের দর্শনের কথা বলতে হয়, আমাকে বিদ্রোহী বলে খামখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, যা মিথ্যা-কলুষিত-পুরাতন-পচা সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে। ধর্মের নামে ভণ্ডামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। এ তার সুস্পষ্ট অবস্থান। মানুষের কবির সমস্ত প্রয়াস শুধু মানব মুক্তির জন্য। তাকে তাই বিদ্রোহী, রোমান্টিক অথবা কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি নির্বাচিত করার চেষ্টা কূপম-ূকতা মাত্র।
বঙ্গবন্ধুকেও নানাভাবে তকমা দিয়ে নানারূপে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা করা হয়েছে। পাকিস্তান আমলে এবং স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে অনেকেই পুঁজিবাদী বুর্জোয়া রাজনীতির প্রতিনিধি, কেউ তাকে বামপন্থিদের থেকেও বড় বামপন্থি, তাকে অতি জাতীয়তাবাদী এরকম নানা ভাবে চিত্রিত করেছেন। বঙ্গোপসাগরের গভীরতা, কিংবা হিমালয়ের উচ্চতা মাপতে অক্ষম মানুষেরা তার মতো উদার, মানবতাবাদী মানুষকে এ’ভাবে সংকীর্ণ করে তোলেন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর পাতায় পাতায়, কারাগারের রোজনামচায় আমরা তাকে দেখতে পাই একজন আবেগি বাঙালি এবং মানবতাবাদী মানুষ রূপে। ১৯৫৪ সালের যুক্ত ফ্রন্টের নির্বাচনের পূর্বে তার একটি অভিজ্ঞতার কথা আমরা জানতে পারি তার লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে, আমার মনে আছে খুবই গরিব এক বৃদ্ধ মহিলা কয়েক ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন, শুনেছে এই পথে আমি যাব, আমাকে দেখে আমার হাত ধরে বলল, বাবা আমার এই কুঁড়েঘরে তোমায় একটু বসতে হবে। আমি তার হাত ধরেই তার বাড়িতে যাই! বঙ্গবন্ধু তার পাতানো পাটিতে বসলেন তার দেয়া একবাটি দুধ ও একটি পান খেলেন। বৃদ্ধ মহিলা চার আনা পয়সা এনে আমার সামনে ধরে বলল, খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছুই নাই। আমার চোখে পানি এল। ...বঙ্গবন্ধুর স্বগতোক্তি, নীরবে আমার চক্ষু দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছিল, যখন তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। সেইদিনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মানুষেরে ধোঁকা আমি দিতে পারব না।
নজরুল তার সারাটি জীবন সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন। নজরুলকে বাঙালি দুটি প্রধান সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলিম মৌলবাদীদের বিরদ্ধে লড়ে যেতে হয়েছে। সমাজে বিদ্যমান সাম্প্রদায়িকতা এবং তাকে যারা আক্রমন করছে তার অসাম্প্রদায়িক অবস্থানের জন্য এই দু’পক্ষের সঙ্গে তাকে যুগপৎ ভাবে লড়ে যেতে হয়েছে জীবনভর। নজরুলকে তার আদর্শের পক্ষে বলতে শোনা যায়, কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি, ও দুটোর কোনটাই নয়। আমি শুধু হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি; গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। সারা জীবন ভেদাভেদের বিপক্ষে তার সমস্ত প্রয়াস, কাণ্ডারি হুঁশিয়ার কবিতায় তাই মানুষের পক্ষে তার আন্তরিক উচ্চারণ, হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/ কাণ্ডারি! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!
বঙ্গবন্ধুকেও আমরা দেখি সারাটি জীবন সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণা করে যেতে। দেশ ভাগের অব্যবহিত পূর্বে কলকাতার দাঙ্গায় আমরা তাকে সক্রিয় দেখি সাম্প্রদায়িক সংঘাতের বিরুদ্ধ্বে। দাঙ্গা রোখার জন্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে কলকাতার বিভিন্ন স্থানে তাকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে দেখা যায়। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধুর জবানীতে তার দাঙ্গা রোখার একটি উদ্যোগের কথা শুনতে পাই, সেদিন রবিবার ছিল। আমি সকালবেলা শহীদ সাহেবের বাসায় যাই। তিনি আমাকে বললেন, চল, ব্যারাকপুর যাই। সেখানে খুব গোলমাল হয়েছে। মহাত্মা গান্ধীও যাবেন। আমি বললাম, যাব স্যার। তার গাড়িতে উঠলাম, নারকেলডাঙ্গা এলাম। সেখান থেকে মহাত্মাজী, মনু গান্ধী, আভা গান্ধী ও তার সেক্রেটারি এবং কিছু কংগ্রেস নেতাও সঙ্গে চললেন। এই পথ ধরেই তিনি পরবর্তীতে ধীরে ধীরে পাকিস্তানের ধর্মীয় খোলশ ভেঙ্গে অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তোলেন।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর পূর্ব বাঙলাতে এক নবজাগরণ সৃষ্টি হয়। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলসহ বাংলাভাষার প্রধান কবি ও দার্শনিকদের সৃষ্টিশীল রচনা এই জাগরণে ব্যপক ভূমিকা পালন করে। বায়ন্ন থেকে সৃষ্ট ভাষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নিয়ে তা স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে দিকে এগিয়ে যায়। নজরুলের অসাম্প্রদায়িক রচনা, সাম্যের বাণী, বৈষম্যের বিরুদ্ধ্বে লড়াই আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের ধাপে ধাপে অনুপ্রেরণা যোগাতে থাকে। বঙ্গবন্ধু বাঙালি মনীষীদের চিরায়ত অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিশেষ করে নজরুলের সাম্য, গণতন্ত্র, বৈষম্যহীনতা, অসাম্প্রদায়িকতাকে অন্তরের গভীরে ধারন করে এগিয়ে যেতে থাকেন। নজরুল সাহিত্যের দর্শন ও চেতনা এসে যখন বঙ্গবন্ধুর শোষনহীন, ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে মিলে যায় তখন তা স্বাধীন বাংলাদেশের চেতনায় রুপান্তরিত হয়ে পড়ে। আমরা যেমন আলো বাতাস থেকে নিজেদেরকে বিযুক্ত রাখতে পারিনা একই ভাবে আমরা নজরুল ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের চেতনা থেকেও দূরে থাকতে পারিনা। নজরুল, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের চেতনা এক সময়ে অবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আমাদের হৃদয়ের গহীনে এই চেতনা অনির্বান শিখার মতো প্রজ্জ্বল হয়ে থাকে। সময়ের দাবি হিসেবে তাই আজ আমাদেরকে তাদের সূচিত পথ ধরেই হাঁটতে হবে, এছাড়া আমাদের আর কোন গত্যন্তর নেই।
[লেখক : উন্নয়ন গবেষক ও কলামিস্ট]
শেখর ভট্টাচার্য
শনিবার, ২২ মে ২০২১
বাংলা সাহিত্যের রাখাল রাজা কাজী নজরুল ইসলাম আর বাংলাদেশের রাজনীতির মুকুটহীন রাজা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দুজনের জীবন, জীবন আচরণ, জীবন সংগ্রাম এবং আদর্শের অসাধারণ কিছু সাদৃশ্য রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শবিহীন বাংলাদেশ আর নজরুলের চেতনাবিহীন বাঙালির কথা আমরা ভাবতেই পারি না। এই যে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলি, বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলি, অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলি, সাম্যের গান গাই, স্বাধীনতার কথা বলি এগুলো প্রতিটি বিষয়ে আমরা প্রেরণা সংগ্রহ করি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য কর্ম থেকে। প্রাণ খোলা অকৃত্রিম মানুষ ছিলেন নজরুল। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে এবং মনুষ্যত্বের অপমানের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন প্রতিবাদী এবং আপসহীন। অন্যায়কে সহ্য করতেন না, জেলজুলুমের ভয় করতেন না। অথচ তার ছিল অসম্ভব রোমান্টিক একটি মন। নজরুল নিজের মনের ভেতর একটি শিশুকে লালন করে গেছেন, যে শিশুটি তাকে নিষ্পাপ, দ্রোহী হিসেবে গড়ে তোলেছে।
নজরুলের জন্ম ১৮৯৯ সালে আর বঙ্গবন্ধুর জন্ম ১৯২০ সালে। দুজনই ঔপনিবেশিক আমলের নিপীড়ন নির্যাতন প্রত্যক্ষ করেছেন। ১৯৪২ সালের আগস্ট মাসে দুরারোগ্য ব্যধিতে নজরুল তার সৃষ্টিশীল সচেতন সত্তা হারিয়ে ফেলেন; এর সঙ্গে সঙ্গে তার সৃষ্টি কর্মেও পড়ে চিরদিনের জন্য বিরতি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তার নেতৃত্ব ও অভিভাবক্ত হারা করা হয় বাঙালিকে ১৯৭৫ সালে, তাও সেই আগস্ট মাসে। বঙ্গবন্ধু বাঙলার মাটি, মানুষ, জলের সঙ্গে এমন ভাবে একাত্ম হয়েছিলেন, যা তাকে একজন রাজনীতির কবিতে রূপান্তরিত করে ফেলেছিল। নজরুল মূলত কবি, কিন্তু রাজনীতির প্রতি তার সক্রিয় আগ্রহ। বঙ্গবন্ধু মূলত রাজনীতিবীদ, কবি ও কবিতার প্রতি তার আগ্রহ সীমাহীন। বঙ্গবন্ধুর মনেও একজন শিশু বসবাস করতো যে শিশু তাকে বাঙালির সঙ্গে একাত্ম করে দিতো। শিশুর মতো উদার বলেই তিনি কখনো তার চারপাশে লুকিয়ে থাকা শত্রুদের দেখতে পেতেন না, নিজের সুরক্ষার ব্যাপারে ছিলেন উদাসীন।
বঙ্গবন্ধু মুসলিম-লীগ, আওয়ামী মুসলিম-লীগ হয়ে আওয়ামী-লীগের নেতৃত্ব প্রাপ্ত হন একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। কাজী নজরুল লেটোর দলের শিল্পী, সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী থেকে তার মূল তৃষ্ণার স্থল কবিতাতে এসে উপস্থিত হন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। দুজনের জীবনই বর্ণাঢ্য, সারা দেশের মানুষের কাছে সীমাহীন জনপ্রিয়তা দু’জনের। দু’জনই বাঙলা, বাঙালি অন্তঃপ্রাণ। দুজনই মানবতাবাদী এবং মানুষের নায্যতায় বিশ্বাসী। বহুমাত্রিক বঙ্গবন্ধুর বর্ণিল ব্যক্তিত্বের এক বড় অংশজুড়ে রয়েছেন সাধারণ মানুষ। তাদের মঙ্গলের জন্য তার প্রচেষ্টার শেষ নেই। তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আমরা অসংখ্য সাধারণ মানুষের খোঁজ পাই। বঙ্গবন্ধু আজীবন শোষিত ও প্রান্তজনের সখা। এই বঙ্গবন্ধুই জাতিসংঘে বলেছিলেন, ‘পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে শোষক, অন্যদিকে শোষিত মানুষ। আমি শোষিতের পক্ষে। ’এ’ এক অসাধারন উচ্চারন। কোন রাজনীতির মারপ্যাচ নেই, কোন ভয় নেই, শোষিতের পক্ষে থাকার তার যে স্বাভাবীক অবস্থান তা’হলো আপসহীন।
কাজী নজরুল বঙ্গবন্ধুর মতো মানবতাবাদী এবং সাম্যবাদী। নজরুল সাম্য, মানবতার জন্য প্রমিথিথিউসের মতো জীবন উৎসর্গ করতে সদা প্রস্তুত। তিনি তার সচেতন সত্তা হারানোর মাত্র ৯৬ দিন পূর্বে ১৯৪১ সালের ৬ এপ্রিল যে অভিভাষন দেন সেখানে তার স্বভাবজাত প্রকৃতি অনুযায়ী বলেন, মানুষের জীবনে এক দিকে কঠোর দারিদ্র্য-ঋণ-অভাব; অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তূপের মতো জমা হয়ে আছে। এ অসাম্য ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। নজরুল শোষিতের পক্ষ অবলম্বনে কোন রাখঢাক রাখেননি। তিনি তার সৃষ্টিশীলতার প্রায় সব প্রয়াস মনুষ্যত্ব, মানব ধর্মের বিকাশ এবং প্রগতির পথের বাধা দূর করার জন্য নিবেদন করেছিলেন। তিনি যখন বলেন, “গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কছু মহীয়ান” আমরা বাঙালি মনন ও ঐতিহ্যের কবি চণ্ডিদাসের উচ্চারণ সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই, এই শাশ্বত কথাটির প্রতিধ্বনি যেন শুনতে পাই।
নজরুলের বিদ্রোহের স্বরূপ বুঝতে সমকালে এমনকি একালেও অনেকেরই সামর্থের সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করা যায়। নজরুলের বিদ্রোহ যে বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থা, মানুষে মানুষে বৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা, গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও অসাঞ্জস্যতার বিরুদ্ধে এ কথাটির অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে অক্ষম আমরা। নজরুলকে এ কারণে তার অভিভাষণে নিজেকেই নিজের দর্শনের কথা বলতে হয়, আমাকে বিদ্রোহী বলে খামখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, যা মিথ্যা-কলুষিত-পুরাতন-পচা সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে। ধর্মের নামে ভণ্ডামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। এ তার সুস্পষ্ট অবস্থান। মানুষের কবির সমস্ত প্রয়াস শুধু মানব মুক্তির জন্য। তাকে তাই বিদ্রোহী, রোমান্টিক অথবা কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি নির্বাচিত করার চেষ্টা কূপম-ূকতা মাত্র।
বঙ্গবন্ধুকেও নানাভাবে তকমা দিয়ে নানারূপে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা করা হয়েছে। পাকিস্তান আমলে এবং স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে অনেকেই পুঁজিবাদী বুর্জোয়া রাজনীতির প্রতিনিধি, কেউ তাকে বামপন্থিদের থেকেও বড় বামপন্থি, তাকে অতি জাতীয়তাবাদী এরকম নানা ভাবে চিত্রিত করেছেন। বঙ্গোপসাগরের গভীরতা, কিংবা হিমালয়ের উচ্চতা মাপতে অক্ষম মানুষেরা তার মতো উদার, মানবতাবাদী মানুষকে এ’ভাবে সংকীর্ণ করে তোলেন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর পাতায় পাতায়, কারাগারের রোজনামচায় আমরা তাকে দেখতে পাই একজন আবেগি বাঙালি এবং মানবতাবাদী মানুষ রূপে। ১৯৫৪ সালের যুক্ত ফ্রন্টের নির্বাচনের পূর্বে তার একটি অভিজ্ঞতার কথা আমরা জানতে পারি তার লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে, আমার মনে আছে খুবই গরিব এক বৃদ্ধ মহিলা কয়েক ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন, শুনেছে এই পথে আমি যাব, আমাকে দেখে আমার হাত ধরে বলল, বাবা আমার এই কুঁড়েঘরে তোমায় একটু বসতে হবে। আমি তার হাত ধরেই তার বাড়িতে যাই! বঙ্গবন্ধু তার পাতানো পাটিতে বসলেন তার দেয়া একবাটি দুধ ও একটি পান খেলেন। বৃদ্ধ মহিলা চার আনা পয়সা এনে আমার সামনে ধরে বলল, খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছুই নাই। আমার চোখে পানি এল। ...বঙ্গবন্ধুর স্বগতোক্তি, নীরবে আমার চক্ষু দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছিল, যখন তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। সেইদিনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মানুষেরে ধোঁকা আমি দিতে পারব না।
নজরুল তার সারাটি জীবন সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন। নজরুলকে বাঙালি দুটি প্রধান সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলিম মৌলবাদীদের বিরদ্ধে লড়ে যেতে হয়েছে। সমাজে বিদ্যমান সাম্প্রদায়িকতা এবং তাকে যারা আক্রমন করছে তার অসাম্প্রদায়িক অবস্থানের জন্য এই দু’পক্ষের সঙ্গে তাকে যুগপৎ ভাবে লড়ে যেতে হয়েছে জীবনভর। নজরুলকে তার আদর্শের পক্ষে বলতে শোনা যায়, কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি, ও দুটোর কোনটাই নয়। আমি শুধু হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি; গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। সারা জীবন ভেদাভেদের বিপক্ষে তার সমস্ত প্রয়াস, কাণ্ডারি হুঁশিয়ার কবিতায় তাই মানুষের পক্ষে তার আন্তরিক উচ্চারণ, হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/ কাণ্ডারি! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!
বঙ্গবন্ধুকেও আমরা দেখি সারাটি জীবন সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণা করে যেতে। দেশ ভাগের অব্যবহিত পূর্বে কলকাতার দাঙ্গায় আমরা তাকে সক্রিয় দেখি সাম্প্রদায়িক সংঘাতের বিরুদ্ধ্বে। দাঙ্গা রোখার জন্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে কলকাতার বিভিন্ন স্থানে তাকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে দেখা যায়। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধুর জবানীতে তার দাঙ্গা রোখার একটি উদ্যোগের কথা শুনতে পাই, সেদিন রবিবার ছিল। আমি সকালবেলা শহীদ সাহেবের বাসায় যাই। তিনি আমাকে বললেন, চল, ব্যারাকপুর যাই। সেখানে খুব গোলমাল হয়েছে। মহাত্মা গান্ধীও যাবেন। আমি বললাম, যাব স্যার। তার গাড়িতে উঠলাম, নারকেলডাঙ্গা এলাম। সেখান থেকে মহাত্মাজী, মনু গান্ধী, আভা গান্ধী ও তার সেক্রেটারি এবং কিছু কংগ্রেস নেতাও সঙ্গে চললেন। এই পথ ধরেই তিনি পরবর্তীতে ধীরে ধীরে পাকিস্তানের ধর্মীয় খোলশ ভেঙ্গে অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তোলেন।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর পূর্ব বাঙলাতে এক নবজাগরণ সৃষ্টি হয়। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলসহ বাংলাভাষার প্রধান কবি ও দার্শনিকদের সৃষ্টিশীল রচনা এই জাগরণে ব্যপক ভূমিকা পালন করে। বায়ন্ন থেকে সৃষ্ট ভাষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নিয়ে তা স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে দিকে এগিয়ে যায়। নজরুলের অসাম্প্রদায়িক রচনা, সাম্যের বাণী, বৈষম্যের বিরুদ্ধ্বে লড়াই আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের ধাপে ধাপে অনুপ্রেরণা যোগাতে থাকে। বঙ্গবন্ধু বাঙালি মনীষীদের চিরায়ত অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিশেষ করে নজরুলের সাম্য, গণতন্ত্র, বৈষম্যহীনতা, অসাম্প্রদায়িকতাকে অন্তরের গভীরে ধারন করে এগিয়ে যেতে থাকেন। নজরুল সাহিত্যের দর্শন ও চেতনা এসে যখন বঙ্গবন্ধুর শোষনহীন, ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে মিলে যায় তখন তা স্বাধীন বাংলাদেশের চেতনায় রুপান্তরিত হয়ে পড়ে। আমরা যেমন আলো বাতাস থেকে নিজেদেরকে বিযুক্ত রাখতে পারিনা একই ভাবে আমরা নজরুল ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের চেতনা থেকেও দূরে থাকতে পারিনা। নজরুল, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের চেতনা এক সময়ে অবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আমাদের হৃদয়ের গহীনে এই চেতনা অনির্বান শিখার মতো প্রজ্জ্বল হয়ে থাকে। সময়ের দাবি হিসেবে তাই আজ আমাদেরকে তাদের সূচিত পথ ধরেই হাঁটতে হবে, এছাড়া আমাদের আর কোন গত্যন্তর নেই।
[লেখক : উন্নয়ন গবেষক ও কলামিস্ট]