alt

মুক্ত আলোচনা

বাংলাদেশের শিশু ও ওদের মায়ের ভাষা

সাদেকুর রহমান

: রোববার, ৩০ মে ২০২১

সরকারি হিসাবে দেশে প্রতি মিনিটে চারজন মানবশিশু জন্ম নিচ্ছে। এই হিসাবে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার ৪৭৯ জন এবং প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ শিশুর জন্ম হচ্ছে। প্রতিটি মানবশিশুই দুনিয়ায় আসার পর মায়ের ভাষায় কথা বলতে চেষ্টা করে।

জন্মের পর থেকে একটি শিশু কথা বলার জন্য আকুল হয়ে থাকে। তার মনে জমে থাকা কথাগুলো বলার জন্য সে চেষ্টা করে। এই ছোট্ট শিশুটিই ধীরে রপ্ত করে কীভাবে তার বাবা-মা আর কাছের মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। কিছু না বলেও সে বুঝিয়ে দিতে থাকে মনের কথা। একটু একটু করে সে ধ্বনি উচ্চারণ করতে শুরু করে। নাড়ির মাধ্যমে মায়ের সঙ্গে শিশুর যে বন্ধন নির্মিত হয়, তা থাকে অক্ষয়রূপে। শিশুটি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মায়ের বলন-চলন সবকিছুই সে অনুসরন করতে থাকে। শিশুর জন্মের প্রথম বছরের শেষ ভাগে এবং দ্বিতীয় বছরের প্রথম ভাগে বাবা-মায়ের ব্যবহৃত ভাষার বিভিন্ন শব্দ বলতে শুরু করে। জন্মের দ্বিতীয় বছরেই শিশু এক শব্দের বাক্য বলতে শুরু করে।

বাংলাদেশের শিশুরা বাংলা ভাষার পাশাপাশি অন্তত ৪১টি মাতৃভাষায় কথা বলে। প্রধান ভাষা বাংলা ছাড়াও দেশে আরও ৪০টি ভাষার সন্ধান পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। বাংলারও অন্তত ৫টি উপভাষা রয়েছে বলে জানা যায়। রয়েছে অনেকগুলো আঞ্চলিক ভাষাও। এক জনপদের বাংলা ভাষার সঙ্গে অন্য জনপদের বাংলা ভাষার পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। প্রতি দশ মাইল অন্তর ভাষা পরিবর্তন হয় বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়ে থাকেন।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের গবেষণায় সন্ধানপ্রাপ্ত সর্বশেষ মাতৃভাষাটি হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ‘রেংমিটচা’। অবিশ্বাস্য হলেও গবেষণায় দেখা গেছে, এ ভাষায় মাত্র ২৫ জন মানুষ কথা বলেন! মিয়ামানমার সীমান্তের কাছে বান্দরবান পার্বত্য জেলার গহীন পার্বত্য জঙ্গলে এ ভাষাভাষীর মানুষেরা বসবাস করেন।

প্রচলিত ধারণা ছিল এ ভূখণ্ডে মোট মাতৃভাষা আছে ১৫ থেকে ২৫টি। গবেষকরা এতদিন ধরে এমন ধারণাই দিয়ে এসেছেন। কিন্তু বিভিন্ন গবেষকদের ব্যক্তিগত গবেষণা ও অনুসন্ধানের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ধারাবাহিক গবেষণা ও অনুসন্ধানে দেশে বর্তমানে মাতৃভাষার মোট সংখ্যা আগের ধারণার প্রায় দ্বিগুণ।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. জীনাত ইমতিয়াজ আলীর সঙ্গে আলাপকালে জানা গেল, ইনস্টিটিউট এ ভূখ-ের মাতৃভাষা নিয়ে আরও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এ প্রসঙ্গে তিনি এ-ও বলেন, বাড়তি আরো যে ১৫টি মাতৃভাষার সন্ধান পাওয়া গেছে সেগুলোরও হারিয়ে যাওয়ার বা বিলুপ্ত হবার আশঙ্কা রয়ে গেছে। এগুলোকে সংরক্ষণ করার বা টিকিয়ে রাখার উদ্যোগ না নেওয়া হলে একদিন এগুলোর অস্তিত্বই যাবে হারিয়ে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট তিন বছর ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর ভাষার ওপর বৈজ্ঞানিক ও গবেষণা চালিয়ে বাংলাসহ মোট ৪১টি মাতৃভাষার সন্ধান পায়। এর মধ্যে ৯৮ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা, যা সাংবিধানিকভাবে জাতীয় ও দাফতরিক ভাষা। অন্য ভাষাগুলোর মধ্যে রয়েছে-সাঁওতালি, মাহলে, কোল, কোরা বা কোদা, মুন্ডারি, খাড়িয়া, সাউরা, খাসি, কুরুখ, মাল্টো, তেলেগু, গারো/মান্দি, হাজং, কোচ, লালেং/পাত্র, মারমা, ককবরক, খুমি, খিয়াং, লুসাই, তঞ্চঙ্গ্যা, ¤্রাে, রাখাইন, পাংখুয়া, বাউম, রেংমিট্চা, চাক, মণিপুরী মৈতৈ, লিঙ্গাম, সাদরি, মাদ্রাজি, বেদে/ঠার, উর্দু, উড়িয়া, অহমিয়া, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, কানপুরী, চাকমা, নেপালি এবং কন্দো। গবেষণালব্ধ এ তালিকাটি মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ‘বাংলাদেশের নৃভাষাবৈজ্ঞানিক সমীক্ষা ভাষা (প্রথম খ-)’ শীর্ষক গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে। গ্রন্থটি ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয়েছে, যার প্রধান সম্পাদক ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী এবং গবেষণা সম্পাদক ড. সৌরভ সিকদার।

মাতৃভাষা সম্পর্কে এ পর্যন্ত যে ধারণা ছিল তার একটি ভিন্ন চিত্র পাওয়া গেছে বাংলাদেশে। আগে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গবেষকরা বেশ কয়েকটি মাতৃভাষার সন্ধান পেয়েছিলেন। কিন্তু এতদিন পর্যন্ত কাজটিতে কোনো সমন্বয় বা ধারাবাহিকতা ছিল না। সবই করা হয়েছে বিক্ষিপ্তভাবে ব্যক্তিগত চেষ্টায়। ফলে সংখ্যা নির্ণয়ের কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। বাংলাদেশে যে ২৫টির চেয়ে অনেক বেশিসংখ্যক মাতৃভাষার অস্তিত্ব রয়েছে সেটা কারো গোচরে আসেনি। বাংলাদেশে বাংলার বাইরে মাতৃভাষা আছে ৪০টি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এই সংখ্যা নির্ণয়ের কাজটি করেছে। এ সংখ্যার সঙ্গে দ্বিমত করার খুব একটা অবকাশ নেই। আমাদের দেশের শিশুরা এ সকল ভাষায় কথা বলে তাদের মনের ভাব প্রকাশ করে, যা দেশের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিকে নির্র্দেশ করে।

বাংলাদেশে বিদ্যমান সব মাতৃভাষাকে টিকিয়ে রাখতে এবং এগুলোর বিকশিত হওয়ার জন্য অধিকতর অনুকূল বাতাবরণ সৃষ্টির জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট সরকারের সহযোগিতায় কাজ করে যাচ্ছে। আসলে নতুনভাবে খুঁজে পাওয়া ভাষাগুলোর বেশিরভাগেরই কোনো লিপি নেই। লিপি রয়েছে হাতেগোনা দু’একটির। লিপিহীন ভাষাগুলোকে আমরা ‘অক্ষরহীন ভাষা’ বলে থাকি।

মাতৃভাষার সংরক্ষণ ও মাতৃভাষাশ্রয়ী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার মধ্য দিয়ে এই ভাষাগুলোকে জীবন্ত করা যেতে পারে। দেশে যে ভাষাগুলো কেবল মৌখিক রূপের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে, যেগুলোর কোনো লিপি নেই বা লেখ্যরূপ নেই, কাঠামো বা ব্যাকরণ নেই, যেগুলোতে কোনো বই লেখা হচ্ছে না, সেগুলোকে আমরা বলছি অক্ষরহীন ভাষা। এই ভাষাগুলোকে যে করেই হোক টিকিয়ে রাখতে হবে, যদিও কাজটা সহজ নয়। এ কাজটা করতে হলে প্রথমেই এ ভাষাগুলোকে জীবন্ত ও সচল করতে হবে, ব্যবহারিক কাজে এগুলোর প্রয়োগ করার মধ্য দিয়ে। এর জন্য কতগুলো বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়া আছে।

প্রথম প্রক্রিয়াটি হলো ওই ভাষাগুলোকে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেওয়া। একেকটি ভাষার ডকুমেন্টশন প্রস্তুত করা। তারপর এ ভাষাগুলোর প্রত্যেকটির অভিধান তৈরি করা। সংশ্লিষ্ট ভাষায় প্রাথমিক বই লেখার জন্য লিপি প্রয়োজন, প্রয়োজন ব্যাকরণ। ওই ভাষার শিক্ষকদের শিক্ষাদানের জন্য উপযুক্ত করে তুলতে হবে। এভাবেই নানান সৃজনশীল পন্থা ও বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় মধ্য দিয়ে এসব ভাষায় আবারো নতুন প্রাণসঞ্চার হবে। এরপর দেখা যাবে ধীরে ধীরে ভাষাটি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার উপযোগী হয়ে উঠতে শুরু করেছে। কম্পিউটারে ব্যবহারের উপযোগী হয়ে উঠতে শুরু করেছে।

মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. জীনাত ইমতিয়াজ একটি গণমাধ্যমকে জানান, ওই ভাষাগুলো এখন হয়তো সমৃদ্ধ ও উন্নত নয় বা উন্নত মনে হচ্ছে না; তবে উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও স্বীকৃতি পেলে এবং বিকাশের অনুকূল পরিচর্যা পেলে দিনে দিনে এগুলো উন্নত ও সমৃদ্ধ হতে থাকবে। ভবিষ্যতে এমনও হতে পারে, ওই ভাষাগুলোর কোনো একটি বিকশিত ও সমৃদ্ধ হতে হতে এমন পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বড় কোনো পুরস্কার বা স্বীকৃতিও পেয়ে যেতে পারে।

মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের একটি টিম মাঠপর্যায়ে দুটি দলে ভাগ হয়ে একটি সমীক্ষার কাজ করছে। একটি ভাষা নিয়ে অন্যটি জাতিসত্তা নিয়ে। বাংলাদেশের প্রতিটি ইউনিয়নে আমাদের এথনেসিটির যে অবস্থান সেটা জিআইএস ম্যাপের মাধ্যমে চিহ্নিত করা আছে। এটা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ওয়েবপেইজে আপলোড করা হলে যে কেউ দেখতে পারবেন। এ থেকে খুঁজে নেওয়া যাবে কোথায় কারা কোন মাতৃভাষায় কথা বলেন। আসলে তারা যেখানে বাস করছে, তাদের গ্রাম পর্যন্ত এই ম্যাপে দেখা যাবে।

বাংলাদেশে শিশু যে যেমন পরিবেশে বড় হচ্ছে, সে সেই ভাষাকেই রপ্ত করছে। প্রমিত বাংলা ভাষায় কথা বলার শিশু যেমন অনেক আছে, তেমনি আঞ্চলিক বা বিভিন্ন কথ্য ও উপভাষায় কথা বলা শিশুর সংখ্যাও কম নয়। মানব জীবন মা-ঘনিষ্ঠ হওয়ায় মায়ের ভাষা ওরা সহজেই বলতে পারছে। প্রমিত বাংলা ছাড়া গবেষণালব্ধ অন্য কোনো মাতৃভাষারই এখন পর্যন্ত এদেশে সার্বজনীনতা কিংবা জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্ব না থাকলেও সংশ্লিষ্ট ভাষাভাষীর কাছে তা আবেগের, ওই ভাষাটাই তার হৃৎস্পন্দন। নিজ নিজ মাতৃভাষাই প্রতিটি শিশুর মুখের ভাষা, প্রাণের ভাষা। আর তাই সরকারও কয়েকটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুর শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে নিজ নিজ মাতৃভাষায় পাঠ্যবইয়ের ব্যবস্থা করেছে। শিশুদের মায়ের ভাষা রক্ষা এ সরকারের বিশাল এবং প্রশংসনীয় উদ্যোগ।

(পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম নিবন্ধ)

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

বাংলাদেশের শিশু ও ওদের মায়ের ভাষা

সাদেকুর রহমান

রোববার, ৩০ মে ২০২১

সরকারি হিসাবে দেশে প্রতি মিনিটে চারজন মানবশিশু জন্ম নিচ্ছে। এই হিসাবে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার ৪৭৯ জন এবং প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ শিশুর জন্ম হচ্ছে। প্রতিটি মানবশিশুই দুনিয়ায় আসার পর মায়ের ভাষায় কথা বলতে চেষ্টা করে।

জন্মের পর থেকে একটি শিশু কথা বলার জন্য আকুল হয়ে থাকে। তার মনে জমে থাকা কথাগুলো বলার জন্য সে চেষ্টা করে। এই ছোট্ট শিশুটিই ধীরে রপ্ত করে কীভাবে তার বাবা-মা আর কাছের মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। কিছু না বলেও সে বুঝিয়ে দিতে থাকে মনের কথা। একটু একটু করে সে ধ্বনি উচ্চারণ করতে শুরু করে। নাড়ির মাধ্যমে মায়ের সঙ্গে শিশুর যে বন্ধন নির্মিত হয়, তা থাকে অক্ষয়রূপে। শিশুটি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মায়ের বলন-চলন সবকিছুই সে অনুসরন করতে থাকে। শিশুর জন্মের প্রথম বছরের শেষ ভাগে এবং দ্বিতীয় বছরের প্রথম ভাগে বাবা-মায়ের ব্যবহৃত ভাষার বিভিন্ন শব্দ বলতে শুরু করে। জন্মের দ্বিতীয় বছরেই শিশু এক শব্দের বাক্য বলতে শুরু করে।

বাংলাদেশের শিশুরা বাংলা ভাষার পাশাপাশি অন্তত ৪১টি মাতৃভাষায় কথা বলে। প্রধান ভাষা বাংলা ছাড়াও দেশে আরও ৪০টি ভাষার সন্ধান পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। বাংলারও অন্তত ৫টি উপভাষা রয়েছে বলে জানা যায়। রয়েছে অনেকগুলো আঞ্চলিক ভাষাও। এক জনপদের বাংলা ভাষার সঙ্গে অন্য জনপদের বাংলা ভাষার পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। প্রতি দশ মাইল অন্তর ভাষা পরিবর্তন হয় বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়ে থাকেন।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের গবেষণায় সন্ধানপ্রাপ্ত সর্বশেষ মাতৃভাষাটি হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ‘রেংমিটচা’। অবিশ্বাস্য হলেও গবেষণায় দেখা গেছে, এ ভাষায় মাত্র ২৫ জন মানুষ কথা বলেন! মিয়ামানমার সীমান্তের কাছে বান্দরবান পার্বত্য জেলার গহীন পার্বত্য জঙ্গলে এ ভাষাভাষীর মানুষেরা বসবাস করেন।

প্রচলিত ধারণা ছিল এ ভূখণ্ডে মোট মাতৃভাষা আছে ১৫ থেকে ২৫টি। গবেষকরা এতদিন ধরে এমন ধারণাই দিয়ে এসেছেন। কিন্তু বিভিন্ন গবেষকদের ব্যক্তিগত গবেষণা ও অনুসন্ধানের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ধারাবাহিক গবেষণা ও অনুসন্ধানে দেশে বর্তমানে মাতৃভাষার মোট সংখ্যা আগের ধারণার প্রায় দ্বিগুণ।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. জীনাত ইমতিয়াজ আলীর সঙ্গে আলাপকালে জানা গেল, ইনস্টিটিউট এ ভূখ-ের মাতৃভাষা নিয়ে আরও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এ প্রসঙ্গে তিনি এ-ও বলেন, বাড়তি আরো যে ১৫টি মাতৃভাষার সন্ধান পাওয়া গেছে সেগুলোরও হারিয়ে যাওয়ার বা বিলুপ্ত হবার আশঙ্কা রয়ে গেছে। এগুলোকে সংরক্ষণ করার বা টিকিয়ে রাখার উদ্যোগ না নেওয়া হলে একদিন এগুলোর অস্তিত্বই যাবে হারিয়ে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট তিন বছর ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর ভাষার ওপর বৈজ্ঞানিক ও গবেষণা চালিয়ে বাংলাসহ মোট ৪১টি মাতৃভাষার সন্ধান পায়। এর মধ্যে ৯৮ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা, যা সাংবিধানিকভাবে জাতীয় ও দাফতরিক ভাষা। অন্য ভাষাগুলোর মধ্যে রয়েছে-সাঁওতালি, মাহলে, কোল, কোরা বা কোদা, মুন্ডারি, খাড়িয়া, সাউরা, খাসি, কুরুখ, মাল্টো, তেলেগু, গারো/মান্দি, হাজং, কোচ, লালেং/পাত্র, মারমা, ককবরক, খুমি, খিয়াং, লুসাই, তঞ্চঙ্গ্যা, ¤্রাে, রাখাইন, পাংখুয়া, বাউম, রেংমিট্চা, চাক, মণিপুরী মৈতৈ, লিঙ্গাম, সাদরি, মাদ্রাজি, বেদে/ঠার, উর্দু, উড়িয়া, অহমিয়া, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, কানপুরী, চাকমা, নেপালি এবং কন্দো। গবেষণালব্ধ এ তালিকাটি মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ‘বাংলাদেশের নৃভাষাবৈজ্ঞানিক সমীক্ষা ভাষা (প্রথম খ-)’ শীর্ষক গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে। গ্রন্থটি ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয়েছে, যার প্রধান সম্পাদক ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী এবং গবেষণা সম্পাদক ড. সৌরভ সিকদার।

মাতৃভাষা সম্পর্কে এ পর্যন্ত যে ধারণা ছিল তার একটি ভিন্ন চিত্র পাওয়া গেছে বাংলাদেশে। আগে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গবেষকরা বেশ কয়েকটি মাতৃভাষার সন্ধান পেয়েছিলেন। কিন্তু এতদিন পর্যন্ত কাজটিতে কোনো সমন্বয় বা ধারাবাহিকতা ছিল না। সবই করা হয়েছে বিক্ষিপ্তভাবে ব্যক্তিগত চেষ্টায়। ফলে সংখ্যা নির্ণয়ের কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। বাংলাদেশে যে ২৫টির চেয়ে অনেক বেশিসংখ্যক মাতৃভাষার অস্তিত্ব রয়েছে সেটা কারো গোচরে আসেনি। বাংলাদেশে বাংলার বাইরে মাতৃভাষা আছে ৪০টি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এই সংখ্যা নির্ণয়ের কাজটি করেছে। এ সংখ্যার সঙ্গে দ্বিমত করার খুব একটা অবকাশ নেই। আমাদের দেশের শিশুরা এ সকল ভাষায় কথা বলে তাদের মনের ভাব প্রকাশ করে, যা দেশের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিকে নির্র্দেশ করে।

বাংলাদেশে বিদ্যমান সব মাতৃভাষাকে টিকিয়ে রাখতে এবং এগুলোর বিকশিত হওয়ার জন্য অধিকতর অনুকূল বাতাবরণ সৃষ্টির জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট সরকারের সহযোগিতায় কাজ করে যাচ্ছে। আসলে নতুনভাবে খুঁজে পাওয়া ভাষাগুলোর বেশিরভাগেরই কোনো লিপি নেই। লিপি রয়েছে হাতেগোনা দু’একটির। লিপিহীন ভাষাগুলোকে আমরা ‘অক্ষরহীন ভাষা’ বলে থাকি।

মাতৃভাষার সংরক্ষণ ও মাতৃভাষাশ্রয়ী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার মধ্য দিয়ে এই ভাষাগুলোকে জীবন্ত করা যেতে পারে। দেশে যে ভাষাগুলো কেবল মৌখিক রূপের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে, যেগুলোর কোনো লিপি নেই বা লেখ্যরূপ নেই, কাঠামো বা ব্যাকরণ নেই, যেগুলোতে কোনো বই লেখা হচ্ছে না, সেগুলোকে আমরা বলছি অক্ষরহীন ভাষা। এই ভাষাগুলোকে যে করেই হোক টিকিয়ে রাখতে হবে, যদিও কাজটা সহজ নয়। এ কাজটা করতে হলে প্রথমেই এ ভাষাগুলোকে জীবন্ত ও সচল করতে হবে, ব্যবহারিক কাজে এগুলোর প্রয়োগ করার মধ্য দিয়ে। এর জন্য কতগুলো বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়া আছে।

প্রথম প্রক্রিয়াটি হলো ওই ভাষাগুলোকে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেওয়া। একেকটি ভাষার ডকুমেন্টশন প্রস্তুত করা। তারপর এ ভাষাগুলোর প্রত্যেকটির অভিধান তৈরি করা। সংশ্লিষ্ট ভাষায় প্রাথমিক বই লেখার জন্য লিপি প্রয়োজন, প্রয়োজন ব্যাকরণ। ওই ভাষার শিক্ষকদের শিক্ষাদানের জন্য উপযুক্ত করে তুলতে হবে। এভাবেই নানান সৃজনশীল পন্থা ও বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় মধ্য দিয়ে এসব ভাষায় আবারো নতুন প্রাণসঞ্চার হবে। এরপর দেখা যাবে ধীরে ধীরে ভাষাটি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার উপযোগী হয়ে উঠতে শুরু করেছে। কম্পিউটারে ব্যবহারের উপযোগী হয়ে উঠতে শুরু করেছে।

মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. জীনাত ইমতিয়াজ একটি গণমাধ্যমকে জানান, ওই ভাষাগুলো এখন হয়তো সমৃদ্ধ ও উন্নত নয় বা উন্নত মনে হচ্ছে না; তবে উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও স্বীকৃতি পেলে এবং বিকাশের অনুকূল পরিচর্যা পেলে দিনে দিনে এগুলো উন্নত ও সমৃদ্ধ হতে থাকবে। ভবিষ্যতে এমনও হতে পারে, ওই ভাষাগুলোর কোনো একটি বিকশিত ও সমৃদ্ধ হতে হতে এমন পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বড় কোনো পুরস্কার বা স্বীকৃতিও পেয়ে যেতে পারে।

মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের একটি টিম মাঠপর্যায়ে দুটি দলে ভাগ হয়ে একটি সমীক্ষার কাজ করছে। একটি ভাষা নিয়ে অন্যটি জাতিসত্তা নিয়ে। বাংলাদেশের প্রতিটি ইউনিয়নে আমাদের এথনেসিটির যে অবস্থান সেটা জিআইএস ম্যাপের মাধ্যমে চিহ্নিত করা আছে। এটা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ওয়েবপেইজে আপলোড করা হলে যে কেউ দেখতে পারবেন। এ থেকে খুঁজে নেওয়া যাবে কোথায় কারা কোন মাতৃভাষায় কথা বলেন। আসলে তারা যেখানে বাস করছে, তাদের গ্রাম পর্যন্ত এই ম্যাপে দেখা যাবে।

বাংলাদেশে শিশু যে যেমন পরিবেশে বড় হচ্ছে, সে সেই ভাষাকেই রপ্ত করছে। প্রমিত বাংলা ভাষায় কথা বলার শিশু যেমন অনেক আছে, তেমনি আঞ্চলিক বা বিভিন্ন কথ্য ও উপভাষায় কথা বলা শিশুর সংখ্যাও কম নয়। মানব জীবন মা-ঘনিষ্ঠ হওয়ায় মায়ের ভাষা ওরা সহজেই বলতে পারছে। প্রমিত বাংলা ছাড়া গবেষণালব্ধ অন্য কোনো মাতৃভাষারই এখন পর্যন্ত এদেশে সার্বজনীনতা কিংবা জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্ব না থাকলেও সংশ্লিষ্ট ভাষাভাষীর কাছে তা আবেগের, ওই ভাষাটাই তার হৃৎস্পন্দন। নিজ নিজ মাতৃভাষাই প্রতিটি শিশুর মুখের ভাষা, প্রাণের ভাষা। আর তাই সরকারও কয়েকটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুর শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে নিজ নিজ মাতৃভাষায় পাঠ্যবইয়ের ব্যবস্থা করেছে। শিশুদের মায়ের ভাষা রক্ষা এ সরকারের বিশাল এবং প্রশংসনীয় উদ্যোগ।

(পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম নিবন্ধ)

back to top