alt

মুক্ত আলোচনা

করোনায় হারিয়ে যাচ্ছে কৈশোর

সিরাজুল হক

: মঙ্গলবার, ০১ জুন ২০২১

সুনামগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী সামিয়া জাহান (ছদ্মনাম)। তিন ভাই বোনের মধ্যে সামিয়া সবার বড় । করোনা আসার পূর্বে নিয়মিত স্কুলে যাওয়া ও বাসায় পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে ঘরের কাজে মাকে সাহায্য করত সে। কিন্তু গত বছর করোনা ভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর হঠাৎ করে সবকিছু বদলে যায় তার। স্কুল বন্ধ থাকায় ঘরবন্দি হয়ে পড়ে সামিয়ার মতো লাখ লাখ শিক্ষার্থী। এখন রান্না থেকে শুরু করে ছোট ভাইদের দেখাশোনা, কাপড় ধোয়াসহ গৃহস্থালির কাজে মায়ের সহযোগী হিসেবে থাকতে হয় তাকে। অনলাইনে ক্লাসের ব্যবস্থা থাকলেও ক্লাস করতে পারেনি সে। সংসদ টিভির মাধ্যমে আমার ঘর আমার স্কুল থেকে যেটুকু ক্লাস করতে পেরেছে, তা খুবই সামান্য।

এদিকে করোনার কারণে খাবার কম খেতে হয়েছে কক্সবাজার জেলার চকোরিয়ার কিশোরী রহিমাকে। সে জানায়, করোনার সংক্রমণ শুরু হলে রিকশাচালক বাবার আয় কমে যাওয়ায় পরিবারের জীবিকা নির্বাহ করতে ব্যাপক সমস্যার মধ্যে পড়তে হয় তাদের। পাঁচ জনের পারিবারে লকডাউনের সময় প্রতি বেলা খাবার জোটেনি তাদের। সরকারিভাবে খাদ্য ও নগদ সহায়তা পাবার পর কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়েছে।

সামিয়া, রহিমাদের মতো দেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর করোনার কারণে শরীর-মন ও পড়াশোনায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে। হারিয়ে যাচ্ছে জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় সময় কৈশোর। যে সময়টা স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে হেসেখেলে কাটার কথা তা এখন কাটছে ঘরের মধ্যে দারিদ্র্যের সাথে সংগ্রাম করে। আবার উচ্চবিত্তের শিশুদের সময় কাটে টেলিভিশন কিংবা মোবাইলের স্ক্রিনে। অনেকেই ঝরে পড়েছে স্কুল থেকে। করোনাকালে সংসারের অভাব মেটাতে অনেক শিশু যুক্ত হয়েছে নানা কাজে।

সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, কভিড-১৯ দেশের আর্থসামাজিক ব্যবস্থা দুর্বল করার পাশাপাশি অপূরণীয় ক্ষতি করে চলেছে স্কুলের শিক্ষার্থীদের। বহু পরিবারে খাদ্যের অনিরাপত্তা ও উদ্বিগ্নতা মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে।

করোনা মহামারীতে স্কুল থেকে ঝরে পড়া ১০ থেকে ১৮ বছর বয়সী প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থীর ওপর জরিপ চালিয়ে ‘অ্যাডোলেসেন্স ইন দ্য টাইম অব কভিড-১৯: এভিডেন্স ফ্রম বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। এতে বলা হয়, স্কুল বন্ধ থাকার ফলে দীর্ঘ সময় ধরে ঘরে বসে থাকা শিক্ষার্থীদের শেখার সুযোগটি আর অবারিত নেই। এ কারণে নানা ধরনের মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে এসব কিশোর-কিশোরী। ৯০ শতাংশ কিশোর-কিশোরী তাদের পরিবারের কাছ থেকেই শিক্ষা কার্যক্রমে সহযোগিতা পাচ্ছে। মাত্র ১০ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী কোনো না কোনোভাবে স্কুলের সহযোগিতা পাচ্ছে। আর শিক্ষকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রেখে শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে পেরেছে ২২ শতাংশ শিক্ষার্থী।

করোনা ভাইরাসের প্রভাবে স্কুল কলেজ বন্ধের এই সময়ে শিক্ষার্থীদের যাতে লেখাপড়ায় কোনো ক্ষতি না হয়, সে লক্ষ্যে বিকল্প পদ্ধতিতে সংসদ টিভিতে আমার ঘরে আমার স্কুল ষরাব প্রচার করা হচ্ছে। গত বছরের ২৯ মার্চ থেকে মাধ্যমিকের ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির ক্লাস সংসদ টিভিতে নেয়া হচ্ছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে “আমার ঘর আমার স্কুল” কার্যক্রমের ক্লাস রুটিন প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়াও প্রাথমিকের জন্য ‘ঘরে বসে শিখি’, মাদ্রাসা বোর্ডের জন্য ‘আমার ঘরে আমার মাদ্রাসা’ এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের জন্য ‘ঘরে বসে কারিগরি শিক্ষা’ কার্যক্রম চালু রয়েছে।

তবে নানা প্রতিবন্ধকতা এবং প্রযুক্তিগত সুবিধার অভাবে পড়ালেখা করতে পারেনি বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা। বাড়িতে টেলিভিশন থাকলেও সংসদ টিভিতে প্রচারিত পড়ালেখার ক্লাসগুলো নিয়মিত দেখার সুযোগ হয়ে ওঠে না অনেক শিক্ষার্থীর। কখনো বিদ্যুৎ সমস্যা, কখনো ক্লাস রুটিন না পাওয়া, আবার কখনো বাড়ির অন্য সদস্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে দেখতে হয় টেলিভিশন।

শহরের শিশু কিশোর ছাড়া গ্রামাঞ্চলের সব শিশু কিশোরদের প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা প্রায় একই। কারো অভিযোগ, টেলিভিশন ক্লাসে যা দেখানো হয় সেটা পরিপূর্ণ নয়। সেখানে সবকিছু বিস্তারিত দেখানো হয় না। শিক্ষকদের কাছে কোনো বিষয়ে জানতে চাওয়ারও উপায় নেই। ক্লাসে যখন শিক্ষক সরাসরি পড়াতেন সেটা বুঝে নিতে অনেক সহজ হতো। এ কারণে লেখাপড়ার প্রতি ধীরে ধীরে আগ্রহ কমে যাচ্ছে অনেক শিক্ষার্থীর।

কভিড-১৯-এর প্রভাবে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে কর্মসংস্থানে এবং শিক্ষা ব্যবস্থায়। বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, বিশেষ করে কিন্ডারগার্টেন স্কুল এবং বেসরকারি স্কুলগুলোর অবস্থা ভয়াবহ। বিশ্বব্যাংকের জরিপে দেখা গেছে, বহু মানুষ স্থায়ী ও সাময়িকভাবে চাকরি হারিয়েছে। ৮৩ শতাংশ খানা (হাউজহোল্ড) জানিয়েছে, করোনায় কোনো না কোনোভাবেই তাদের আয় কমে গেছে। ৬৫ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, করোনার মধ্যে তারা পরিবারের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। প্রয়োজনীয় খাদ্য কিনতে সক্ষম ৫৮ শতাংশ পরিবার। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, করোনাকালে পরিবারের আর্থিক সংকটে ৩৫ শতাংশ কিশোরী ও ৩১ শতাংশ কিশোর খাবার কম পেয়েছে। কম খাবার গ্রহণের কারণে ৬২ শতাংশ কিশোর ও ৫৮ শতাংশ কিশোরী কম প্রোটিন পেয়েছে।

করোনার প্রভাব মোকাবিলায় বর্তমান সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা এবং উপকারভোগীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করেছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি আরও ২৫টি মন্ত্রণালয় সামাজিক নিরাপত্তার বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এ কর্মসূচির আওতায় প্রায় আড়াই কোটি দরিদ্র জনগোষ্ঠী উপকৃত হচ্ছে। সরকারের লক্ষ্য করোনা মহামারিতে কোনো মানুষ যেন না খেয়ে থাকে। এ লক্ষ্যে পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাড়ে ৩৬ লক্ষ পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে নগদ সহায়তা করেছেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় অতি দরিদ্রদের কর্মসংস্থান, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি ভিজিজি, ভিজিএফ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ন্যায্যমূলে চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন জেলা এবং বিভাগে করোনাকালীন সরকারি মানবিক সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ও কর্মহীন হয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে সরকার ত্রাণসামগ্রী এবং মানবিক সহায়তা অব্যাহত রেখেছে।

করোনা হয়তো একদিন শেষ হবে, তবে এর প্রভাব থাকবে অনেক দিন, বিশেষ করে শিশু কিশোরদের জীবন থেকে যে দিনগুলো হারিয়ে গেল, সেগুলো ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। তারপরও সরকার জীবন জীবিকার গতি ফিরে আনতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব শিশুদের উপর সবচেয়ে বেশি। শিশুরা বদ্ধ ঘরে থাকতে চায় না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তারা হাঁপিয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় ঘরে বসে থাকতে থাকতে মেজাজ খিটখিটে হয়ে পড়ছে অনেক শিক্ষার্থীর। তারা এখন স্কুলে ফিরতে চায়। কিশোর-কিশোরীদের এ সংকট থেকে উত্তরণে নীতিনির্ধারকদের এমন কিছু পলিসি গ্রহণ করা প্রয়োজন, যা শিক্ষার্থীদের মানসিক প্রশান্তি ও উৎসাহ জোগাতে পারে। মেয়ে শিক্ষার্থী বিশেষ করে দরিদ্র শিক্ষার্থীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি।

করোনা এক অদৃশ্য মহামারি। এ থেকে উত্তেরণই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। সরকার এ পরিস্থিতি মানুষের পাশে থাকর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। লক ডাউনে শিশুসহ প্রতিটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের স্বাভাবিক জীবনে বড় ধরনের ছন্দপতন ঘটেছে। এ পরিস্থিতিতে শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য খেলাধুলা ও বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা দরকার। কিশোরদের মিথস্ক্রিয়া থাকে সমবয়সীদের সঙ্গে। এখানে তারা বাধার শিকার হলে তাদের মানসিক বৃদ্ধি হয় না। মানসিক বাধার কারণে তারা ভয়ে থাকে, মেজাজ খিটখিটে থাকে। তাদের সঙ্গ দিতে হবে। সব ধরনের সহায়তা করতে হবে।

করোনার এ সময় অভিভাবকদের কৈশোরবান্ধব হতে হবে। পারিবারিক পরিবেশ তাদের মতো করে সৃষ্টি করতে হবে। তাদের আনন্দ ও বিনোদনের বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে। অতিমাত্রায় নজরদারি না করে তাদের ভালো লাগার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। বাসার ছাদে কিংবা বাসার কাছে খোলা জায়গায় তাদের সাথে খেলতে হবে। সংগীত, ছবি আঁকা, গল্পের বই পড়ায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। কোনোভাবেই যেন তারা লেখাপড়া বিমূখ না হয়ে পড়ে সেদিকে সজাগ থাকতে হবে।

(পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম ফিচার)

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

করোনায় হারিয়ে যাচ্ছে কৈশোর

সিরাজুল হক

মঙ্গলবার, ০১ জুন ২০২১

সুনামগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী সামিয়া জাহান (ছদ্মনাম)। তিন ভাই বোনের মধ্যে সামিয়া সবার বড় । করোনা আসার পূর্বে নিয়মিত স্কুলে যাওয়া ও বাসায় পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে ঘরের কাজে মাকে সাহায্য করত সে। কিন্তু গত বছর করোনা ভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর হঠাৎ করে সবকিছু বদলে যায় তার। স্কুল বন্ধ থাকায় ঘরবন্দি হয়ে পড়ে সামিয়ার মতো লাখ লাখ শিক্ষার্থী। এখন রান্না থেকে শুরু করে ছোট ভাইদের দেখাশোনা, কাপড় ধোয়াসহ গৃহস্থালির কাজে মায়ের সহযোগী হিসেবে থাকতে হয় তাকে। অনলাইনে ক্লাসের ব্যবস্থা থাকলেও ক্লাস করতে পারেনি সে। সংসদ টিভির মাধ্যমে আমার ঘর আমার স্কুল থেকে যেটুকু ক্লাস করতে পেরেছে, তা খুবই সামান্য।

এদিকে করোনার কারণে খাবার কম খেতে হয়েছে কক্সবাজার জেলার চকোরিয়ার কিশোরী রহিমাকে। সে জানায়, করোনার সংক্রমণ শুরু হলে রিকশাচালক বাবার আয় কমে যাওয়ায় পরিবারের জীবিকা নির্বাহ করতে ব্যাপক সমস্যার মধ্যে পড়তে হয় তাদের। পাঁচ জনের পারিবারে লকডাউনের সময় প্রতি বেলা খাবার জোটেনি তাদের। সরকারিভাবে খাদ্য ও নগদ সহায়তা পাবার পর কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়েছে।

সামিয়া, রহিমাদের মতো দেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর করোনার কারণে শরীর-মন ও পড়াশোনায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে। হারিয়ে যাচ্ছে জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় সময় কৈশোর। যে সময়টা স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে হেসেখেলে কাটার কথা তা এখন কাটছে ঘরের মধ্যে দারিদ্র্যের সাথে সংগ্রাম করে। আবার উচ্চবিত্তের শিশুদের সময় কাটে টেলিভিশন কিংবা মোবাইলের স্ক্রিনে। অনেকেই ঝরে পড়েছে স্কুল থেকে। করোনাকালে সংসারের অভাব মেটাতে অনেক শিশু যুক্ত হয়েছে নানা কাজে।

সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, কভিড-১৯ দেশের আর্থসামাজিক ব্যবস্থা দুর্বল করার পাশাপাশি অপূরণীয় ক্ষতি করে চলেছে স্কুলের শিক্ষার্থীদের। বহু পরিবারে খাদ্যের অনিরাপত্তা ও উদ্বিগ্নতা মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে।

করোনা মহামারীতে স্কুল থেকে ঝরে পড়া ১০ থেকে ১৮ বছর বয়সী প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থীর ওপর জরিপ চালিয়ে ‘অ্যাডোলেসেন্স ইন দ্য টাইম অব কভিড-১৯: এভিডেন্স ফ্রম বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। এতে বলা হয়, স্কুল বন্ধ থাকার ফলে দীর্ঘ সময় ধরে ঘরে বসে থাকা শিক্ষার্থীদের শেখার সুযোগটি আর অবারিত নেই। এ কারণে নানা ধরনের মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে এসব কিশোর-কিশোরী। ৯০ শতাংশ কিশোর-কিশোরী তাদের পরিবারের কাছ থেকেই শিক্ষা কার্যক্রমে সহযোগিতা পাচ্ছে। মাত্র ১০ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী কোনো না কোনোভাবে স্কুলের সহযোগিতা পাচ্ছে। আর শিক্ষকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রেখে শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে পেরেছে ২২ শতাংশ শিক্ষার্থী।

করোনা ভাইরাসের প্রভাবে স্কুল কলেজ বন্ধের এই সময়ে শিক্ষার্থীদের যাতে লেখাপড়ায় কোনো ক্ষতি না হয়, সে লক্ষ্যে বিকল্প পদ্ধতিতে সংসদ টিভিতে আমার ঘরে আমার স্কুল ষরাব প্রচার করা হচ্ছে। গত বছরের ২৯ মার্চ থেকে মাধ্যমিকের ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির ক্লাস সংসদ টিভিতে নেয়া হচ্ছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে “আমার ঘর আমার স্কুল” কার্যক্রমের ক্লাস রুটিন প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়াও প্রাথমিকের জন্য ‘ঘরে বসে শিখি’, মাদ্রাসা বোর্ডের জন্য ‘আমার ঘরে আমার মাদ্রাসা’ এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের জন্য ‘ঘরে বসে কারিগরি শিক্ষা’ কার্যক্রম চালু রয়েছে।

তবে নানা প্রতিবন্ধকতা এবং প্রযুক্তিগত সুবিধার অভাবে পড়ালেখা করতে পারেনি বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা। বাড়িতে টেলিভিশন থাকলেও সংসদ টিভিতে প্রচারিত পড়ালেখার ক্লাসগুলো নিয়মিত দেখার সুযোগ হয়ে ওঠে না অনেক শিক্ষার্থীর। কখনো বিদ্যুৎ সমস্যা, কখনো ক্লাস রুটিন না পাওয়া, আবার কখনো বাড়ির অন্য সদস্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে দেখতে হয় টেলিভিশন।

শহরের শিশু কিশোর ছাড়া গ্রামাঞ্চলের সব শিশু কিশোরদের প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা প্রায় একই। কারো অভিযোগ, টেলিভিশন ক্লাসে যা দেখানো হয় সেটা পরিপূর্ণ নয়। সেখানে সবকিছু বিস্তারিত দেখানো হয় না। শিক্ষকদের কাছে কোনো বিষয়ে জানতে চাওয়ারও উপায় নেই। ক্লাসে যখন শিক্ষক সরাসরি পড়াতেন সেটা বুঝে নিতে অনেক সহজ হতো। এ কারণে লেখাপড়ার প্রতি ধীরে ধীরে আগ্রহ কমে যাচ্ছে অনেক শিক্ষার্থীর।

কভিড-১৯-এর প্রভাবে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে কর্মসংস্থানে এবং শিক্ষা ব্যবস্থায়। বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, বিশেষ করে কিন্ডারগার্টেন স্কুল এবং বেসরকারি স্কুলগুলোর অবস্থা ভয়াবহ। বিশ্বব্যাংকের জরিপে দেখা গেছে, বহু মানুষ স্থায়ী ও সাময়িকভাবে চাকরি হারিয়েছে। ৮৩ শতাংশ খানা (হাউজহোল্ড) জানিয়েছে, করোনায় কোনো না কোনোভাবেই তাদের আয় কমে গেছে। ৬৫ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, করোনার মধ্যে তারা পরিবারের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। প্রয়োজনীয় খাদ্য কিনতে সক্ষম ৫৮ শতাংশ পরিবার। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, করোনাকালে পরিবারের আর্থিক সংকটে ৩৫ শতাংশ কিশোরী ও ৩১ শতাংশ কিশোর খাবার কম পেয়েছে। কম খাবার গ্রহণের কারণে ৬২ শতাংশ কিশোর ও ৫৮ শতাংশ কিশোরী কম প্রোটিন পেয়েছে।

করোনার প্রভাব মোকাবিলায় বর্তমান সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা এবং উপকারভোগীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করেছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি আরও ২৫টি মন্ত্রণালয় সামাজিক নিরাপত্তার বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এ কর্মসূচির আওতায় প্রায় আড়াই কোটি দরিদ্র জনগোষ্ঠী উপকৃত হচ্ছে। সরকারের লক্ষ্য করোনা মহামারিতে কোনো মানুষ যেন না খেয়ে থাকে। এ লক্ষ্যে পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাড়ে ৩৬ লক্ষ পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে নগদ সহায়তা করেছেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় অতি দরিদ্রদের কর্মসংস্থান, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি ভিজিজি, ভিজিএফ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ন্যায্যমূলে চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন জেলা এবং বিভাগে করোনাকালীন সরকারি মানবিক সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ও কর্মহীন হয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে সরকার ত্রাণসামগ্রী এবং মানবিক সহায়তা অব্যাহত রেখেছে।

করোনা হয়তো একদিন শেষ হবে, তবে এর প্রভাব থাকবে অনেক দিন, বিশেষ করে শিশু কিশোরদের জীবন থেকে যে দিনগুলো হারিয়ে গেল, সেগুলো ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। তারপরও সরকার জীবন জীবিকার গতি ফিরে আনতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব শিশুদের উপর সবচেয়ে বেশি। শিশুরা বদ্ধ ঘরে থাকতে চায় না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তারা হাঁপিয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় ঘরে বসে থাকতে থাকতে মেজাজ খিটখিটে হয়ে পড়ছে অনেক শিক্ষার্থীর। তারা এখন স্কুলে ফিরতে চায়। কিশোর-কিশোরীদের এ সংকট থেকে উত্তরণে নীতিনির্ধারকদের এমন কিছু পলিসি গ্রহণ করা প্রয়োজন, যা শিক্ষার্থীদের মানসিক প্রশান্তি ও উৎসাহ জোগাতে পারে। মেয়ে শিক্ষার্থী বিশেষ করে দরিদ্র শিক্ষার্থীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি।

করোনা এক অদৃশ্য মহামারি। এ থেকে উত্তেরণই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। সরকার এ পরিস্থিতি মানুষের পাশে থাকর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। লক ডাউনে শিশুসহ প্রতিটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের স্বাভাবিক জীবনে বড় ধরনের ছন্দপতন ঘটেছে। এ পরিস্থিতিতে শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য খেলাধুলা ও বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা দরকার। কিশোরদের মিথস্ক্রিয়া থাকে সমবয়সীদের সঙ্গে। এখানে তারা বাধার শিকার হলে তাদের মানসিক বৃদ্ধি হয় না। মানসিক বাধার কারণে তারা ভয়ে থাকে, মেজাজ খিটখিটে থাকে। তাদের সঙ্গ দিতে হবে। সব ধরনের সহায়তা করতে হবে।

করোনার এ সময় অভিভাবকদের কৈশোরবান্ধব হতে হবে। পারিবারিক পরিবেশ তাদের মতো করে সৃষ্টি করতে হবে। তাদের আনন্দ ও বিনোদনের বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে। অতিমাত্রায় নজরদারি না করে তাদের ভালো লাগার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। বাসার ছাদে কিংবা বাসার কাছে খোলা জায়গায় তাদের সাথে খেলতে হবে। সংগীত, ছবি আঁকা, গল্পের বই পড়ায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। কোনোভাবেই যেন তারা লেখাপড়া বিমূখ না হয়ে পড়ে সেদিকে সজাগ থাকতে হবে।

(পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম ফিচার)

back to top