alt

মুক্ত আলোচনা

বঙ্গবন্ধু : অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশের হিমালয়

শেখর ভট্টাচার্য

: রোববার, ০৬ জুন ২০২১

বঙ্গবন্ধুকে ভীষন ভয়, প্রতিক্রিয়াশীল, অন্ধকারের কুশীলবদের। জীবিত বঙ্গবন্ধুকে তারা যেমন ভয় করতো, মৃত বঙ্গবন্ধুকে তার চেয়ে বেশি ভয় তাদের। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার নৃশংস ভাবে হত্যার পরও প্রগতির পথে, ধর্মান্ধতার বিপক্ষে বাংলাদেশ যখন এগিয়ে চলে তখন মৃত বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ছায়া তাদেরকে তাড়িত করে। বঙ্গবন্ধুকে কেনো এতো ভয় ? ভয়ে উদভ্রান্ত হয়ে তাঁর সকল স্মৃতি চিহ্ন মুছে ফেলার প্রয়োজন বোধ করে তারা। পঁচাত্তরের পরে যে প্রচেষ্টার সুচনা হয়েছিলো, সেই প্রচেষ্টা এখনো বহমান। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ্ব থেকে অর্জিত আদর্শগুলো আসলে এক ও অভিন্ন।বঙ্গবন্ধুর দৃশ্য, অদৃশ্য সকল আদর্শবাহী স্মৃতি নিশ্চিহ্ন করার সাথে সাথে, বাংলাদেশ যে আদর্শে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো সে আদর্শ শুন্যে মিলিয়ে যাবে বলে তারা বিশ্বাস করে। পঁচাত্তরের পনের আগস্টের পরে “বঙ্গবন্ধু “ শব্দটি নিষিদ্ধ্ব ছিলো। শুধু বঙ্গবন্ধু কেনো? “জাতির পিতা”, “মুক্তিযুদ্ধ্ব, “জয়বাংলা” সহ অসংখ্য শব্দ পত্রিকার পাতা, পাঠ্যপুস্তক থেকে নিষ্ঠুর ভাবে ছেটে ফেলা হয়। শুধু কি শব্দ? আমাদের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস্ বিকৃত করে জাতিকে পিছন দিকে ঠেলে দেয়া হয়। জীবিত বঙ্গবন্ধুকে নির্মম ভাবে হত্যার পর তাঁর আদর্শের ছায়া যাতে বাংলাদেশকে প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারে তাই উন্মাদের মতো তাঁকে ইতিহাসের পাতা থেকে, মানুষের হৃদয়ের কোঠর থেকে চিরতরে বিস্মৃত করে দেয়ার সকল আয়োজন চলতে থাকে।

ম্যাকবেথ নাটকে সেনাপতি ম্যাকবেথ উচ্চাকাংখা, সীমাহীন লোভ এবং লেডি ম্যাকবেথের প্ররোচনায়, তার দুর্গে অতিথি হয়ে আসা রাজা ডানকানকে ঘুমের মধ্যে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। হত্যাকান্ডের পর, ক্ষমতা হারানোর ভয় নানাভাবে তাড়িত করে ম্যাকবেথ ও লেডি ম্যাকবেথকে। বিভ্রম চেপে বসে মনে।ক্ষমতাকে কুক্ষিগত ও নিরাপদ করার জন্য একের পর এক হত্যা যজ্ঞ চালাতে থাকে নব্য রাজা ম্যাকবেথ। কী আশচর্য মিল। রাজা ডানকানকে যেমন হত্যা করেছিলো উচ্চাকাংখি সেনাপতি, বাংলাদেশেও উচ্চাকাংখি সেনাপতির পরোক্ষ আদেশেই নিহত হন বঙ্গবন্ধু, একদল সেনা সদস্যদের হাতে। রাজা ডানকান অবশ্য খুন হন একাই আর বঙ্গবন্ধুকে সেনাসদস্যরা খুন করে পরিবার সহ। রাজা ডানকান নিহত হওয়ার পর ম্যাকবেথ এবং লেডি ম্যাকবেথের মধ্যে সামান্য হলেও অপরাধ বোধ কাজ করেছিলো আর বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর হত্যাকারিরা ও তাদের আদেশ দাতা সদর্পে বিচরন করতে থাকে। তার মানে শ্যাক্সপিয়ার তাঁর কল্পনা বোধ দ্বারা অপরাধের , নৃশংসতার যে মাত্রায় পৌঁছতে পারেননি, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা সে মাত্রা সহজেই অতিক্রম করতে সক্ষম হয়।

ম্যাকবেথ নাটকে রাজা ডানকানকে হত্যা করা হয় ক্ষমতা লাভের আকাংখায়। আর বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় শুধুমাত্র ক্ষমতা লাভের জন্য নয়। বঙ্গবন্ধুতো শুধু মাত্র জাতির পিতা, রাস্ট্র প্রধানই ছিলেন না। বঙ্গবন্ধু ছিলেন হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতিকে ধারন করা এক মহামানব। বঙ্গবন্ধু প্রগতি, মানবতা, বাঙালিসংস্কৃতি আর অসুন্দরের অপশক্তির মধ্যেখানে দাঁড়িয়ে থাকা সুরক্ষা প্রাচীর। বঙ্গপোসাগরের মতো বিশাল হৃদয় দিয়ে বঙ্গবন্ধু গণমানুষের শাসন প্রতিষ্ঠা, বৈষম্য হ্রাস , ধর্মান্ধতাকে দূর করে ধর্মনিরপেক্ষ এক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে অবিচল।তাঁর অবস্থান অনেকটা হিমালয় পর্বতের মতো। ওই যে কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ট্রো ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়াতে অনুষ্ঠিত জোট-নিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সাথে বৈঠকের পর তাঁর অনুভুতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছিলেন,— ‘আমি হিমালয় দেখিনি, তবে আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়ের সমতুল্য। আর এভাবেই আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা লাভ করেছি।’ ফিদেল কাস্ট্রোর সেই হিমালয় আসলে দাঁড়িয়ে ছিলেন সমস্থ অপশক্তি, ধর্মান্ধতা ও মানব মুক্তির প্রত্যয় নিয়ে। শুভ ও অশুভ, আলো ও অন্ধকার, প্রগতি ও পশ্চাদপদতার মধ্যে ছিলো তাঁর হিমালয়সম অবস্থান। তাঁর এই দৃঢ় অবস্থানের জন্যই তাঁকে দেশীয় অপ-শক্তির দ্বারা আন্তর্জাতিক শক্তির নির্দেশে হত্যা করে আপাত ভাবে সরিয়ে দেয়া হয়।

বঙ্গবন্ধুর লেখা “কারাগারের রোজ নামচা” কিংবা “অসমাপ্ত আত্ম জীবনী” পড়লে দেখা যায়, জেল থেকে বেরিয়েই তিনি সারা দেশে চষে বেড়াচ্ছেন। প্রতিটি জেলা, প্রতিটি মহকুমায় বড় বড় সভা করেছেন। সেই সভা গুলোতে বঙ্গবন্ধু তাঁর অসাধারন আন্তরিক ভঙ্গীতে জনগনের সাথে সংলাপের মতো করে বক্তব্য রাখছেন। এই জনসম্পৃক্ততাই তাঁকে বাংলাদেশের ইতিহাসে মুকুট বিহীন রাজার স্থান পেতে সহায়তা করেছে। জনগণের নেতাকে জনগণের সাথে থাকতে হয় আর বঙ্গবন্ধু এবং বাংলার জনগণ এতোই একাত্ম ছিলো যে বঙ্গবন্ধু কোন অবস্থাতেই জন বিচ্ছিন্ন হতে পারেননি । তাঁর নেতৃত্ত্বে সাড়ে সাত কোটি মানুষের কন্ঠস্বর একটি কন্ঠস্বরে রুপান্তরিত হয়, সাড়ে সাত কোটি মানুষের হাত একটি মুষ্ঠিবদ্ধ্ব হাতের আকার ধারন করে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের দাবিও ঠিক একটি দাবি নিয়ে এগিয়ে যায়। শোনা যায়, তাকে হত্যা করার পাঁয়তারা যখন চলছে বিভিন্ন দেশ থেকে বিশেষ করে প্রতিবেশি দেশ ভারত থেকে তাঁকে পুর্ন নিরাপত্তায় সরকারি বাস ভবনে থাকার পরামর্শ দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু মৃত্যুকে বরণ করেছেন কিন্তু জনগণ থেকে দূরে সরে যাননি ।জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বত্রিশ নম্বরের তার ব্যক্তিগত বাড়িতেই তিনি অবস্থান করেছেন। মৃত্যু না জনগণের কাছে থাকা এই দুটির মধ্যে তিনি জনগণের কাছে থাকাকেই বেছে নিয়েছিলেন।পাকিস্তানের কারাগারে ফাঁসির রজ্জুর সামনে দাঁড় করিয়ে নানা প্রলোভনের দেখিয়েও তাঁকে জনবিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশের আজকের এই অভুতপুর্ব অর্থনৈতিক উন্নয়নের বীজ রোপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর দেখা স্বপ্নের বিজয়কেও প্রতিক্রিয়াশীল, ধর্মান্ধ শক্তি সহ্য করতে পারেনা। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের আদি স্বপ গ্রন্থিত হয়েছিলো ছয় দফাতে। বাংলাদেশের অগ্রগতি, উন্নয়নের প্রতি ক্ষণে বারবার ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু, হাজার গুন শক্তি নিয়ে ফিনিক্স পাখির মতো, ছাই ভষ্ম থেকে উঠে আসে তাঁর জীবন্ত আদর্শ । বঙ্গবন্ধুর আদর্শের এই ফিরে আসাকেই যতো ভয়, তাই জীবিত বঙ্গবন্ধুর মতো মৃত বঙ্গবন্ধুর সাথেও অন্ধকারের কুশীলবদের লড়ে যেতে হয় নানা কৌশলে অবিরত।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ সারা বিশ্বের সামনে বিস্ময় তৈরি করতে পেরেছে। আর সকল বিস্ময়ের শেকড় নিহিত আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ্বে। মুক্তিযুদ্ধ তাই বাঙালির গৌরবময় ইতিহাসই শুধু নয়, মুক্তিযুদ্ধ্বের প্রাণশক্তি ও স্বপ্ন, বাংলাদেশের বর্তমান উন্নয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মুক্তি যুদ্ধ্বের রুপকার হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু । রূপকারের সমান্তরাল রূপকার, ইতিহাসের সমান্তরাল মিথ্যা ইতিহাস, জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে ভ্রান্ত জাতীয়তাবাদ দাঁড় করিয়েও বঙ্গবন্ধু অনুসরিরত বাঙালির শাশ্বত সংস্কৃতিকে কোনভাবেই পরিবর্তন করা যায়নি।

বাংলাদেশ যেহেতু বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে অনুসরন করে এগিয়ে যাচ্ছে,তাই তাঁর আদর্শ থেকে বিচ্যুত করার অপচেষ্টা চলতে থাকবে। সেই চেষ্টা যতোই চলুক বাংলাদেশের সাধারন মানুষের অন্তর থেকে মুছে ফেলা যাবেনা বাংলাদেশের জাতির পিতা এবং তাঁর আদর্শকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে যেমন রোখে দিতে পারেনি বাংলাদেশ বিরোধী কোন শক্তি, বাংলাদেশের উন্নয়নকেও স্তিমিত করতে পারবেনা অন্ধকারের অপশক্তির দল। বাংলাদেশের এগিয়ে চলার পথ রোধ করতে যারা চায়,তারা বার বার ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপরেখা তৈরি হয়েছে আন্দোলনের মাঠ থেকে।মানুষের অন্তরের ভাষায় রচিত হয়েছে ছয় দফা। ছয় দফা আমাদের ইতিহাসের ম্যাগনাকার্টা। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সুবর্ন পলিমাটির গভীর থেকে নিয়ে এসেছিলেন ছয় দফা। আমাদের স্বাধীনতার গন্তব্য আমরা দেখতে পেয়েছিলাম মানুষের অন্তর হেকে উঠে আসা ছয় দফার মধ্যে।লক্ষ্য করলে দেখা যায় ছয় দফার অধিকাংশ দফা ছিলো অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশের আজকের উন্নয়নের পথ চলা ছয় দফা থেকে সুচিত রোডম্যাপ থেকে। বাংলাদেশের সব চেয়ে বড় শক্তি বাংলাদেশের লক্ষ কোটি মানুষ, যাদের অন্তরে বসবাস করেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনীতির কবি। সেই কবির দর্শনেই আজ বাংলাদেশ অপ্রতিরোধ্য। আমরা বিশ্বাস করি দুর্দমনীয় বাঙালি দীপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যাবে বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত পথে অনেক দুরে। যে পথের অনেক মাইলস্টোন ইতিমধ্যে আমরা পেরিয়ে গেছি, আরও অর্জন আমদের জন্য অপেক্ষা করছে।

[লেখকঃ উন্নয়ন গবেষক ও কলামিস্ট]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

বঙ্গবন্ধু : অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশের হিমালয়

শেখর ভট্টাচার্য

রোববার, ০৬ জুন ২০২১

বঙ্গবন্ধুকে ভীষন ভয়, প্রতিক্রিয়াশীল, অন্ধকারের কুশীলবদের। জীবিত বঙ্গবন্ধুকে তারা যেমন ভয় করতো, মৃত বঙ্গবন্ধুকে তার চেয়ে বেশি ভয় তাদের। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার নৃশংস ভাবে হত্যার পরও প্রগতির পথে, ধর্মান্ধতার বিপক্ষে বাংলাদেশ যখন এগিয়ে চলে তখন মৃত বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ছায়া তাদেরকে তাড়িত করে। বঙ্গবন্ধুকে কেনো এতো ভয় ? ভয়ে উদভ্রান্ত হয়ে তাঁর সকল স্মৃতি চিহ্ন মুছে ফেলার প্রয়োজন বোধ করে তারা। পঁচাত্তরের পরে যে প্রচেষ্টার সুচনা হয়েছিলো, সেই প্রচেষ্টা এখনো বহমান। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ্ব থেকে অর্জিত আদর্শগুলো আসলে এক ও অভিন্ন।বঙ্গবন্ধুর দৃশ্য, অদৃশ্য সকল আদর্শবাহী স্মৃতি নিশ্চিহ্ন করার সাথে সাথে, বাংলাদেশ যে আদর্শে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো সে আদর্শ শুন্যে মিলিয়ে যাবে বলে তারা বিশ্বাস করে। পঁচাত্তরের পনের আগস্টের পরে “বঙ্গবন্ধু “ শব্দটি নিষিদ্ধ্ব ছিলো। শুধু বঙ্গবন্ধু কেনো? “জাতির পিতা”, “মুক্তিযুদ্ধ্ব, “জয়বাংলা” সহ অসংখ্য শব্দ পত্রিকার পাতা, পাঠ্যপুস্তক থেকে নিষ্ঠুর ভাবে ছেটে ফেলা হয়। শুধু কি শব্দ? আমাদের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস্ বিকৃত করে জাতিকে পিছন দিকে ঠেলে দেয়া হয়। জীবিত বঙ্গবন্ধুকে নির্মম ভাবে হত্যার পর তাঁর আদর্শের ছায়া যাতে বাংলাদেশকে প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারে তাই উন্মাদের মতো তাঁকে ইতিহাসের পাতা থেকে, মানুষের হৃদয়ের কোঠর থেকে চিরতরে বিস্মৃত করে দেয়ার সকল আয়োজন চলতে থাকে।

ম্যাকবেথ নাটকে সেনাপতি ম্যাকবেথ উচ্চাকাংখা, সীমাহীন লোভ এবং লেডি ম্যাকবেথের প্ররোচনায়, তার দুর্গে অতিথি হয়ে আসা রাজা ডানকানকে ঘুমের মধ্যে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। হত্যাকান্ডের পর, ক্ষমতা হারানোর ভয় নানাভাবে তাড়িত করে ম্যাকবেথ ও লেডি ম্যাকবেথকে। বিভ্রম চেপে বসে মনে।ক্ষমতাকে কুক্ষিগত ও নিরাপদ করার জন্য একের পর এক হত্যা যজ্ঞ চালাতে থাকে নব্য রাজা ম্যাকবেথ। কী আশচর্য মিল। রাজা ডানকানকে যেমন হত্যা করেছিলো উচ্চাকাংখি সেনাপতি, বাংলাদেশেও উচ্চাকাংখি সেনাপতির পরোক্ষ আদেশেই নিহত হন বঙ্গবন্ধু, একদল সেনা সদস্যদের হাতে। রাজা ডানকান অবশ্য খুন হন একাই আর বঙ্গবন্ধুকে সেনাসদস্যরা খুন করে পরিবার সহ। রাজা ডানকান নিহত হওয়ার পর ম্যাকবেথ এবং লেডি ম্যাকবেথের মধ্যে সামান্য হলেও অপরাধ বোধ কাজ করেছিলো আর বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর হত্যাকারিরা ও তাদের আদেশ দাতা সদর্পে বিচরন করতে থাকে। তার মানে শ্যাক্সপিয়ার তাঁর কল্পনা বোধ দ্বারা অপরাধের , নৃশংসতার যে মাত্রায় পৌঁছতে পারেননি, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা সে মাত্রা সহজেই অতিক্রম করতে সক্ষম হয়।

ম্যাকবেথ নাটকে রাজা ডানকানকে হত্যা করা হয় ক্ষমতা লাভের আকাংখায়। আর বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় শুধুমাত্র ক্ষমতা লাভের জন্য নয়। বঙ্গবন্ধুতো শুধু মাত্র জাতির পিতা, রাস্ট্র প্রধানই ছিলেন না। বঙ্গবন্ধু ছিলেন হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতিকে ধারন করা এক মহামানব। বঙ্গবন্ধু প্রগতি, মানবতা, বাঙালিসংস্কৃতি আর অসুন্দরের অপশক্তির মধ্যেখানে দাঁড়িয়ে থাকা সুরক্ষা প্রাচীর। বঙ্গপোসাগরের মতো বিশাল হৃদয় দিয়ে বঙ্গবন্ধু গণমানুষের শাসন প্রতিষ্ঠা, বৈষম্য হ্রাস , ধর্মান্ধতাকে দূর করে ধর্মনিরপেক্ষ এক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে অবিচল।তাঁর অবস্থান অনেকটা হিমালয় পর্বতের মতো। ওই যে কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ট্রো ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়াতে অনুষ্ঠিত জোট-নিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সাথে বৈঠকের পর তাঁর অনুভুতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছিলেন,— ‘আমি হিমালয় দেখিনি, তবে আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়ের সমতুল্য। আর এভাবেই আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা লাভ করেছি।’ ফিদেল কাস্ট্রোর সেই হিমালয় আসলে দাঁড়িয়ে ছিলেন সমস্থ অপশক্তি, ধর্মান্ধতা ও মানব মুক্তির প্রত্যয় নিয়ে। শুভ ও অশুভ, আলো ও অন্ধকার, প্রগতি ও পশ্চাদপদতার মধ্যে ছিলো তাঁর হিমালয়সম অবস্থান। তাঁর এই দৃঢ় অবস্থানের জন্যই তাঁকে দেশীয় অপ-শক্তির দ্বারা আন্তর্জাতিক শক্তির নির্দেশে হত্যা করে আপাত ভাবে সরিয়ে দেয়া হয়।

বঙ্গবন্ধুর লেখা “কারাগারের রোজ নামচা” কিংবা “অসমাপ্ত আত্ম জীবনী” পড়লে দেখা যায়, জেল থেকে বেরিয়েই তিনি সারা দেশে চষে বেড়াচ্ছেন। প্রতিটি জেলা, প্রতিটি মহকুমায় বড় বড় সভা করেছেন। সেই সভা গুলোতে বঙ্গবন্ধু তাঁর অসাধারন আন্তরিক ভঙ্গীতে জনগনের সাথে সংলাপের মতো করে বক্তব্য রাখছেন। এই জনসম্পৃক্ততাই তাঁকে বাংলাদেশের ইতিহাসে মুকুট বিহীন রাজার স্থান পেতে সহায়তা করেছে। জনগণের নেতাকে জনগণের সাথে থাকতে হয় আর বঙ্গবন্ধু এবং বাংলার জনগণ এতোই একাত্ম ছিলো যে বঙ্গবন্ধু কোন অবস্থাতেই জন বিচ্ছিন্ন হতে পারেননি । তাঁর নেতৃত্ত্বে সাড়ে সাত কোটি মানুষের কন্ঠস্বর একটি কন্ঠস্বরে রুপান্তরিত হয়, সাড়ে সাত কোটি মানুষের হাত একটি মুষ্ঠিবদ্ধ্ব হাতের আকার ধারন করে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের দাবিও ঠিক একটি দাবি নিয়ে এগিয়ে যায়। শোনা যায়, তাকে হত্যা করার পাঁয়তারা যখন চলছে বিভিন্ন দেশ থেকে বিশেষ করে প্রতিবেশি দেশ ভারত থেকে তাঁকে পুর্ন নিরাপত্তায় সরকারি বাস ভবনে থাকার পরামর্শ দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু মৃত্যুকে বরণ করেছেন কিন্তু জনগণ থেকে দূরে সরে যাননি ।জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বত্রিশ নম্বরের তার ব্যক্তিগত বাড়িতেই তিনি অবস্থান করেছেন। মৃত্যু না জনগণের কাছে থাকা এই দুটির মধ্যে তিনি জনগণের কাছে থাকাকেই বেছে নিয়েছিলেন।পাকিস্তানের কারাগারে ফাঁসির রজ্জুর সামনে দাঁড় করিয়ে নানা প্রলোভনের দেখিয়েও তাঁকে জনবিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশের আজকের এই অভুতপুর্ব অর্থনৈতিক উন্নয়নের বীজ রোপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর দেখা স্বপ্নের বিজয়কেও প্রতিক্রিয়াশীল, ধর্মান্ধ শক্তি সহ্য করতে পারেনা। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের আদি স্বপ গ্রন্থিত হয়েছিলো ছয় দফাতে। বাংলাদেশের অগ্রগতি, উন্নয়নের প্রতি ক্ষণে বারবার ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু, হাজার গুন শক্তি নিয়ে ফিনিক্স পাখির মতো, ছাই ভষ্ম থেকে উঠে আসে তাঁর জীবন্ত আদর্শ । বঙ্গবন্ধুর আদর্শের এই ফিরে আসাকেই যতো ভয়, তাই জীবিত বঙ্গবন্ধুর মতো মৃত বঙ্গবন্ধুর সাথেও অন্ধকারের কুশীলবদের লড়ে যেতে হয় নানা কৌশলে অবিরত।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ সারা বিশ্বের সামনে বিস্ময় তৈরি করতে পেরেছে। আর সকল বিস্ময়ের শেকড় নিহিত আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ্বে। মুক্তিযুদ্ধ তাই বাঙালির গৌরবময় ইতিহাসই শুধু নয়, মুক্তিযুদ্ধ্বের প্রাণশক্তি ও স্বপ্ন, বাংলাদেশের বর্তমান উন্নয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মুক্তি যুদ্ধ্বের রুপকার হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু । রূপকারের সমান্তরাল রূপকার, ইতিহাসের সমান্তরাল মিথ্যা ইতিহাস, জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে ভ্রান্ত জাতীয়তাবাদ দাঁড় করিয়েও বঙ্গবন্ধু অনুসরিরত বাঙালির শাশ্বত সংস্কৃতিকে কোনভাবেই পরিবর্তন করা যায়নি।

বাংলাদেশ যেহেতু বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে অনুসরন করে এগিয়ে যাচ্ছে,তাই তাঁর আদর্শ থেকে বিচ্যুত করার অপচেষ্টা চলতে থাকবে। সেই চেষ্টা যতোই চলুক বাংলাদেশের সাধারন মানুষের অন্তর থেকে মুছে ফেলা যাবেনা বাংলাদেশের জাতির পিতা এবং তাঁর আদর্শকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে যেমন রোখে দিতে পারেনি বাংলাদেশ বিরোধী কোন শক্তি, বাংলাদেশের উন্নয়নকেও স্তিমিত করতে পারবেনা অন্ধকারের অপশক্তির দল। বাংলাদেশের এগিয়ে চলার পথ রোধ করতে যারা চায়,তারা বার বার ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপরেখা তৈরি হয়েছে আন্দোলনের মাঠ থেকে।মানুষের অন্তরের ভাষায় রচিত হয়েছে ছয় দফা। ছয় দফা আমাদের ইতিহাসের ম্যাগনাকার্টা। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সুবর্ন পলিমাটির গভীর থেকে নিয়ে এসেছিলেন ছয় দফা। আমাদের স্বাধীনতার গন্তব্য আমরা দেখতে পেয়েছিলাম মানুষের অন্তর হেকে উঠে আসা ছয় দফার মধ্যে।লক্ষ্য করলে দেখা যায় ছয় দফার অধিকাংশ দফা ছিলো অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশের আজকের উন্নয়নের পথ চলা ছয় দফা থেকে সুচিত রোডম্যাপ থেকে। বাংলাদেশের সব চেয়ে বড় শক্তি বাংলাদেশের লক্ষ কোটি মানুষ, যাদের অন্তরে বসবাস করেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনীতির কবি। সেই কবির দর্শনেই আজ বাংলাদেশ অপ্রতিরোধ্য। আমরা বিশ্বাস করি দুর্দমনীয় বাঙালি দীপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যাবে বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত পথে অনেক দুরে। যে পথের অনেক মাইলস্টোন ইতিমধ্যে আমরা পেরিয়ে গেছি, আরও অর্জন আমদের জন্য অপেক্ষা করছে।

[লেখকঃ উন্নয়ন গবেষক ও কলামিস্ট]

back to top