alt

মুক্ত আলোচনা

সাঁওতাল বিদ্রোহ

এহছানুল মালিকী

: মঙ্গলবার, ২৯ জুন ২০২১

৩০ জুন ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ বা সাঁওতাল হুল দিবস। সাঁওতালি ভাষায় বিদ্রোহকে হুল বলা হয়। সাঁওতালরা ছিলেন বাংলা, বিহার ও ওড়িশার একটি বড়ো উপজাতি বা খণ্ডজাতি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের ইতিহাসে উনিশ শতকের পঞ্চম দশক অর্থাৎ ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে সাঁওতাল বিদ্রোহ এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। সাঁওতাল বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল তৎকালীন বাংলার বীরভূম, ভাগলপুর ও মুর্শিদাবাদ জেলার সাঁওতাল অঞ্চলগুলোতে। সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল মূলত কৃষক বিদ্রোহ। কোম্পানির বাংলা দখল করার পর সরল ও সাদাসিধে সাঁওতালদের ওপর তারা শোষণ ও নির্যাতনের মাত্রা বড়িয়ে দিয়েছিল। তাদের এলাকায় কোম্পানি সরকার শাসন ও শোষণ অপেক্ষাকৃত মজবুত করার উদ্দেশে জমিদার, দালাল, মহাজন, সরকারি আমলা ও দারোগা সৃষ্টি করে সাঁওতাল জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। মহাজনরা সাঁওতালদের কাছ থেকে চড়া সুদ আদায় করত। অভাবের তাড়নায় তারা মহাজনদের কাছ থেকে ধারে খাদ্য-শস্য বা অর্থ নিলে সাঁওতালদের ‘কামিয়াতি’ ও ‘হারওয়াহি’ নামে দু-ধরনের বন্ডে সই করতে হতো।

কামিয়াতি ব্যবস্থায় যতদিন না ঋণ শোধ দিতে পারত ততদিন সাঁওতালদের মহাজনের জমিতে বেগার খাটতে হতো। হারওয়াহি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ঋণ শোধ করতে ব্যর্থ সাঁওতালদের মহাজনদের জমিতে বেগার শ্রমদানের পাশাপাশি অন্যান্য কাজকর্মও করতে হতো। ধান-চাল ধার দেয়ার সময় ওজনে ফাঁকি দিত। সাঁওতালরা যখন ধান-চাল পরিশোধ করত, তখন তাদের কাছ থেকে আদায় করা হতো কয়েক গুণ বেশি। ক্রমেই পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছিল, বছরের পর বছর মহাজনের দেনা দশগুণ পরিশোধ করেও সাঁওতালরা ঋণ থেকে মুক্তি পেত না। এ অঞ্চলে শোষণ চালানোর জন্য বসতি স্থাপন করেছিল নীলকররা। তারা জোর করে নীলের চাষ করাত। রেলপথ নির্মাণের জন্য একদল ইউরোপীয় বাস করত এ অঞ্চলে। তারা সাঁওতালদের থেকে জোর করে হাঁস, মুরগি, পাঁঠা কেড়ে নিত। মূলত তাদের প্রধান কাজ ছিল সাঁওতাল মেয়েদের সতীত্ব নষ্ট করা ও তাদের হত্যা করা। যারা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাত, তাদের ওপর চালানো হতো কঠোর নির্যাতন। স্থানীয় সরকারি আমলা ও দারোগাদের অত্যাচারের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল অর্থাৎ সামগ্রিক পরিস্থিতি এমনই হয়ে ওঠেছিল যে, সাঁওতালদের বিদ্রোহ করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। সাঁওতাল বিদ্রোহীদের সেদিনের দেশপ্রেমিক সংগ্রাম, আদর্শ ও অভূতপূর্ব আত্মত্যাগ পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছিল। জুগিয়েছিল সাহস ও উদ্দীপনা। মুক্তিকামী মানুষের কাছে আজও তা অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে।

১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন ভাগনাদিহির মাঠে গোক্কো ও বীরসিং নামক গোষ্ঠীপতিদের ওপর ইংরেজ সরকারের উৎপীড়নের প্রতিবাদে চারশত গ্রামের প্রতিনিধি, দশ হাজার সাঁওতাল কৃষকের বিরাট জমায়েত সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়ক দুই ভাই সিধু মুরমু ও কানু মুরমু’র নেতৃত্বে সমবেত হয়েছিল। সাঁওতালদের অনেকেই দিনটিকে সিধু-কানু দিবস বলে থাকেন। বিদ্রোহের বাণী চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে হাজার হাজার সাঁওতাল বিদ্রোহী দলের সঙ্গে সিধু ও কানু’র অপর দুই ভাই চাঁদ ও ভৈরব তাদের দুই বোন ফুলোমনি মুরমু ও ঝালোমনি মুরমু যোগদান করেন। প্রথম দিকে বিদ্রোহের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠেছিল ভাগলপুর থেকে মুঙ্গের পর্যন্ত। বিদ্রোহীদের তৎপরতার ফলে এ অঞ্চলে সরকারের ডাক চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ইংরেজ বাহিনী বিদ্রোহ দমন করতে এগিয়ে এলে বিদ্রোহীরা তাদের প্রতিরোধ করে। বিদ্রোহের আগুন শুধু ভাগলপুর থেকে মুঙ্গের পর্যন্ত জ্বলে ওঠেনি, জ্বলে ওঠেছিল গোদা, পাকুড়, মহেশপুর, মুর্শিদাবাদ ও বীরভূমের বিভিন্ন অঞ্চলে। বিদ্রোহের মূল দাবি ছিল ‘জমি চাই, মুক্তি চাই’। জমিদাররা ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। শুধু জমিদাররা নয়, দেওঘর থেকে ম্যাজিস্ট্রেটও পালিয়ে যায়। মহেশপুরে পঞ্চাশ হাজার সাঁওতাল কোম্পানি সৈন্যের গতিরোধ করে। কোম্পানি বিদ্রোহ দমন করার জন্য রেজিমেন্ট নিয়োগ করে। কিন্তু তবুও বিদ্রোহ দমন করা সম্ভব হয়নি। কোম্পানি সরকার বিদ্রোহী নেতাদের ধরিয়ে দেয়ার জন্য মাথাপিছু দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। ইংরেজরা ভেবেছিল, তাদের সৈন্যবাহিনীর আক্রমণে হয়তো সাঁওতাল বিদ্রোহীদের শক্তি ভেঙে পড়বে, কিন্তু পরিণামে দেখা গিয়েছিল উল্টো।

সেপ্টেম্বরের শেষদিকে সাঁওতাল অঞ্চলে আবার আগুন দ্বিগুণ জ্বলে উঠেছিল। ইংরেজরা বিদ্রোহী সাঁওতালের তুপে কাবু হয়ে পড়েছিল। বাধ্য হয়ে শাসক এ অঞ্চলে সামরিক আইন জারি করে। সাঁওতাল নেতারা এ বিদ্রোহের মধ্যদিয়ে একটা স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। তারা ঘোষণা করেছিলেন, তাদের রাজ্যে কাউকে খাজনা দিতে হবে না। প্রত্যেকে সাধ্যমতো জমি চাষ করার অধিকার পাবে। সব ঋণ মওকুফ করে দেয়া হবে। বলদ চালিত লাঙলের ওপর দুই পয়সা আর মহিষ চালিত লাঙলের ওপর দুই আনা খাজনা ধার্য হবে।

দিঘি থানার মহেশলাল দারোগাসহ ১৯ জনকে হত্যার মধ্যদিয়ে ৭ জুলাই বিদ্রোহের দামামা বেজে উঠেছিল। এই বিদ্রোহের সময় স্থানীয় কামার-কুমার, তেলি, চামার, ডোম ও মুসলমান তাঁতিরা সাঁওতালদের সক্রিয় সহযোগিতা করেছিল। বিদ্রোহীরা বাংলা, বিহার ও নাগপুরের কয়েকটি অঞ্চলে ইংরেজ শাসন উচ্ছেদ করেছিল এবং নিজেদের শাসন ছয় মাস পরিচালনা করেছিল। ইংরেজ শাসক প্রথম দিকটায় এই বিদ্রোহকে গুরুত্ব দেয়নি। ১৮৫৫ সালের ১৬ জুলাই ভাগলপুরে পিয়ারপুরের কাছে পীর বাইতির ময়দানে মেজর বরোজের নামক এক ইংরেজ সেনাপতি সাঁওতালদের হাতে পরাজিত হলে এই বিদ্রোহের গুরুত্ব উপলব্ধি করে। এরপর এই বিদ্রোহ দমন করার জন্য এক বিশাল সেনাবাহিনী ৫৫ নম্বর রেজিমেন্ট পাঠানো হয়। ইংরেজ গোলন্দাজ বাহিনীর বিরুদ্ধে সাঁওতালদের তীর-ধনুকের লড়াই ভারতের ইতিহাসে গৌরবময় স্থান অধিকার করে আছে।

শেষ পর্যন্ত সাঁওতালরা পরাজয় বরণ করে। ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে সিধু, কানুসহ নেতৃস্থানীয় সাঁওতালদের অধিকাংশই ধরা পরে এবং লোক দেখানো বিচার করে তাদের প্রকাশ্যে ফাঁসি দেয়া হয়। ৩৬টি সাঁওতাল গ্রাম ধ্বংস এবং প্রায় ১৫ থেকে ২৫ হাজার সাঁওতালকে হত্যা করা হয়। অবশেষে ১৮৫৬ সালের মার্চে বিদ্রোহ স্থিমিত হয়ে পরে। ভবিষ্যতে সাঁওতালদের পক্ষ থেকে অনুরূপ কোন বিদ্রোহ যাতে না হয়, সেজন্য জমির মালিকানা স্বত্ব দিয়ে রাজমহল পাহাড়ে বিপুল সংখ্যক মইরা ও দিকুদের বসতির ব্যবস্থা করা হয়। সরাসরি বিজয়ী না হলেও সাঁওতাল কৃষক বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়নি। বিদ্রোহের পর ইংরেজ সরকার সাঁওতালদের ক্ষুদ্র জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ইংরেজ কর্তৃপক্ষ উত্তরে গঙ্গার কাছাকাছি তেলিয়া গড়াই পরগনার সঙ্গে বীরভূম ও ভাগলপুর থেকে ৯,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে দেয়। এই এলাকা একজন ডেপুটি কমিশনারের অধীনে এনে ‘সাঁওতাল পরগনা’ নামে সাঁওতালদের জন্য একটি স্বতন্ত্র সংরক্ষিত এলাকা গঠন করা হয়। বলা হয় সাঁওতাল পরগনায় কোম্পানির কোন আইনবিধি কার্যকর করা হবে না। এর ফলে মহাজনদের দেয়া সব ঋণ বাতিল হয়। সাঁওতালরা জমির মালিকানা অর্জন করে।

সাঁওতাল বিদ্রোহ বাংলার ও ভারতের কৃষক-সংগ্রামের ঐতিহ্যকে শুধু উজ্জ্বল আর গৌরবান্বিতই করেনি, বরং বিদ্রোহীদের বীরত্বের কাহিনী পরবর্তী কৃষক সংগ্রামে ও তথাকথিত সিপাহি বিদ্রোহকেও প্রেরণা জুগিয়েছিল। তথাপি প্রত্যক্ষ বিদেশি শাসনের অবসান হলেও পরোক্ষ শোষণ আজও বিদ্যমান। যে দাবি নিয়ে সাঁওতাল ও তার সহযোগিরা লড়াই করেছিল, তা আজও পূরণ হয়নি। সাঁওতালদের দাবি আজ সাধারণ দাবিতে পরিণত হয়ে বনভূমি হতে রাজপথে পৌঁছে গিয়েছে। তাদের সেসব দাবি আজও কৃষক অব্যাহত রেখে বার বার লড়াই করছে। এই উপমহাদেশের কৃষককে সম্মানের আসনে বসিয়েছে। কৃষককে আজ কোন শাসক উপেক্ষা করতে পারে না। আজ পর্যন্ত চলে আসা সমস্ত কৃষক সংগ্রামের ইতিহাসে ১৮৫৫ থেকে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ সাঁওতাল বিদ্রোহের গুরুত্ব ও মূল্য ভারতবর্ষের কৃষককুল, দরিদ্র ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কাছে অনেক বেশি। আর তাই তো ইতিহাসের পাতায় সাঁওতাল বিদ্রোহ স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

সাঁওতাল বিদ্রোহ

এহছানুল মালিকী

মঙ্গলবার, ২৯ জুন ২০২১

৩০ জুন ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ বা সাঁওতাল হুল দিবস। সাঁওতালি ভাষায় বিদ্রোহকে হুল বলা হয়। সাঁওতালরা ছিলেন বাংলা, বিহার ও ওড়িশার একটি বড়ো উপজাতি বা খণ্ডজাতি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের ইতিহাসে উনিশ শতকের পঞ্চম দশক অর্থাৎ ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে সাঁওতাল বিদ্রোহ এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। সাঁওতাল বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল তৎকালীন বাংলার বীরভূম, ভাগলপুর ও মুর্শিদাবাদ জেলার সাঁওতাল অঞ্চলগুলোতে। সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল মূলত কৃষক বিদ্রোহ। কোম্পানির বাংলা দখল করার পর সরল ও সাদাসিধে সাঁওতালদের ওপর তারা শোষণ ও নির্যাতনের মাত্রা বড়িয়ে দিয়েছিল। তাদের এলাকায় কোম্পানি সরকার শাসন ও শোষণ অপেক্ষাকৃত মজবুত করার উদ্দেশে জমিদার, দালাল, মহাজন, সরকারি আমলা ও দারোগা সৃষ্টি করে সাঁওতাল জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। মহাজনরা সাঁওতালদের কাছ থেকে চড়া সুদ আদায় করত। অভাবের তাড়নায় তারা মহাজনদের কাছ থেকে ধারে খাদ্য-শস্য বা অর্থ নিলে সাঁওতালদের ‘কামিয়াতি’ ও ‘হারওয়াহি’ নামে দু-ধরনের বন্ডে সই করতে হতো।

কামিয়াতি ব্যবস্থায় যতদিন না ঋণ শোধ দিতে পারত ততদিন সাঁওতালদের মহাজনের জমিতে বেগার খাটতে হতো। হারওয়াহি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ঋণ শোধ করতে ব্যর্থ সাঁওতালদের মহাজনদের জমিতে বেগার শ্রমদানের পাশাপাশি অন্যান্য কাজকর্মও করতে হতো। ধান-চাল ধার দেয়ার সময় ওজনে ফাঁকি দিত। সাঁওতালরা যখন ধান-চাল পরিশোধ করত, তখন তাদের কাছ থেকে আদায় করা হতো কয়েক গুণ বেশি। ক্রমেই পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছিল, বছরের পর বছর মহাজনের দেনা দশগুণ পরিশোধ করেও সাঁওতালরা ঋণ থেকে মুক্তি পেত না। এ অঞ্চলে শোষণ চালানোর জন্য বসতি স্থাপন করেছিল নীলকররা। তারা জোর করে নীলের চাষ করাত। রেলপথ নির্মাণের জন্য একদল ইউরোপীয় বাস করত এ অঞ্চলে। তারা সাঁওতালদের থেকে জোর করে হাঁস, মুরগি, পাঁঠা কেড়ে নিত। মূলত তাদের প্রধান কাজ ছিল সাঁওতাল মেয়েদের সতীত্ব নষ্ট করা ও তাদের হত্যা করা। যারা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাত, তাদের ওপর চালানো হতো কঠোর নির্যাতন। স্থানীয় সরকারি আমলা ও দারোগাদের অত্যাচারের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল অর্থাৎ সামগ্রিক পরিস্থিতি এমনই হয়ে ওঠেছিল যে, সাঁওতালদের বিদ্রোহ করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। সাঁওতাল বিদ্রোহীদের সেদিনের দেশপ্রেমিক সংগ্রাম, আদর্শ ও অভূতপূর্ব আত্মত্যাগ পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছিল। জুগিয়েছিল সাহস ও উদ্দীপনা। মুক্তিকামী মানুষের কাছে আজও তা অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে।

১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন ভাগনাদিহির মাঠে গোক্কো ও বীরসিং নামক গোষ্ঠীপতিদের ওপর ইংরেজ সরকারের উৎপীড়নের প্রতিবাদে চারশত গ্রামের প্রতিনিধি, দশ হাজার সাঁওতাল কৃষকের বিরাট জমায়েত সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়ক দুই ভাই সিধু মুরমু ও কানু মুরমু’র নেতৃত্বে সমবেত হয়েছিল। সাঁওতালদের অনেকেই দিনটিকে সিধু-কানু দিবস বলে থাকেন। বিদ্রোহের বাণী চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে হাজার হাজার সাঁওতাল বিদ্রোহী দলের সঙ্গে সিধু ও কানু’র অপর দুই ভাই চাঁদ ও ভৈরব তাদের দুই বোন ফুলোমনি মুরমু ও ঝালোমনি মুরমু যোগদান করেন। প্রথম দিকে বিদ্রোহের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠেছিল ভাগলপুর থেকে মুঙ্গের পর্যন্ত। বিদ্রোহীদের তৎপরতার ফলে এ অঞ্চলে সরকারের ডাক চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ইংরেজ বাহিনী বিদ্রোহ দমন করতে এগিয়ে এলে বিদ্রোহীরা তাদের প্রতিরোধ করে। বিদ্রোহের আগুন শুধু ভাগলপুর থেকে মুঙ্গের পর্যন্ত জ্বলে ওঠেনি, জ্বলে ওঠেছিল গোদা, পাকুড়, মহেশপুর, মুর্শিদাবাদ ও বীরভূমের বিভিন্ন অঞ্চলে। বিদ্রোহের মূল দাবি ছিল ‘জমি চাই, মুক্তি চাই’। জমিদাররা ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। শুধু জমিদাররা নয়, দেওঘর থেকে ম্যাজিস্ট্রেটও পালিয়ে যায়। মহেশপুরে পঞ্চাশ হাজার সাঁওতাল কোম্পানি সৈন্যের গতিরোধ করে। কোম্পানি বিদ্রোহ দমন করার জন্য রেজিমেন্ট নিয়োগ করে। কিন্তু তবুও বিদ্রোহ দমন করা সম্ভব হয়নি। কোম্পানি সরকার বিদ্রোহী নেতাদের ধরিয়ে দেয়ার জন্য মাথাপিছু দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। ইংরেজরা ভেবেছিল, তাদের সৈন্যবাহিনীর আক্রমণে হয়তো সাঁওতাল বিদ্রোহীদের শক্তি ভেঙে পড়বে, কিন্তু পরিণামে দেখা গিয়েছিল উল্টো।

সেপ্টেম্বরের শেষদিকে সাঁওতাল অঞ্চলে আবার আগুন দ্বিগুণ জ্বলে উঠেছিল। ইংরেজরা বিদ্রোহী সাঁওতালের তুপে কাবু হয়ে পড়েছিল। বাধ্য হয়ে শাসক এ অঞ্চলে সামরিক আইন জারি করে। সাঁওতাল নেতারা এ বিদ্রোহের মধ্যদিয়ে একটা স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। তারা ঘোষণা করেছিলেন, তাদের রাজ্যে কাউকে খাজনা দিতে হবে না। প্রত্যেকে সাধ্যমতো জমি চাষ করার অধিকার পাবে। সব ঋণ মওকুফ করে দেয়া হবে। বলদ চালিত লাঙলের ওপর দুই পয়সা আর মহিষ চালিত লাঙলের ওপর দুই আনা খাজনা ধার্য হবে।

দিঘি থানার মহেশলাল দারোগাসহ ১৯ জনকে হত্যার মধ্যদিয়ে ৭ জুলাই বিদ্রোহের দামামা বেজে উঠেছিল। এই বিদ্রোহের সময় স্থানীয় কামার-কুমার, তেলি, চামার, ডোম ও মুসলমান তাঁতিরা সাঁওতালদের সক্রিয় সহযোগিতা করেছিল। বিদ্রোহীরা বাংলা, বিহার ও নাগপুরের কয়েকটি অঞ্চলে ইংরেজ শাসন উচ্ছেদ করেছিল এবং নিজেদের শাসন ছয় মাস পরিচালনা করেছিল। ইংরেজ শাসক প্রথম দিকটায় এই বিদ্রোহকে গুরুত্ব দেয়নি। ১৮৫৫ সালের ১৬ জুলাই ভাগলপুরে পিয়ারপুরের কাছে পীর বাইতির ময়দানে মেজর বরোজের নামক এক ইংরেজ সেনাপতি সাঁওতালদের হাতে পরাজিত হলে এই বিদ্রোহের গুরুত্ব উপলব্ধি করে। এরপর এই বিদ্রোহ দমন করার জন্য এক বিশাল সেনাবাহিনী ৫৫ নম্বর রেজিমেন্ট পাঠানো হয়। ইংরেজ গোলন্দাজ বাহিনীর বিরুদ্ধে সাঁওতালদের তীর-ধনুকের লড়াই ভারতের ইতিহাসে গৌরবময় স্থান অধিকার করে আছে।

শেষ পর্যন্ত সাঁওতালরা পরাজয় বরণ করে। ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে সিধু, কানুসহ নেতৃস্থানীয় সাঁওতালদের অধিকাংশই ধরা পরে এবং লোক দেখানো বিচার করে তাদের প্রকাশ্যে ফাঁসি দেয়া হয়। ৩৬টি সাঁওতাল গ্রাম ধ্বংস এবং প্রায় ১৫ থেকে ২৫ হাজার সাঁওতালকে হত্যা করা হয়। অবশেষে ১৮৫৬ সালের মার্চে বিদ্রোহ স্থিমিত হয়ে পরে। ভবিষ্যতে সাঁওতালদের পক্ষ থেকে অনুরূপ কোন বিদ্রোহ যাতে না হয়, সেজন্য জমির মালিকানা স্বত্ব দিয়ে রাজমহল পাহাড়ে বিপুল সংখ্যক মইরা ও দিকুদের বসতির ব্যবস্থা করা হয়। সরাসরি বিজয়ী না হলেও সাঁওতাল কৃষক বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়নি। বিদ্রোহের পর ইংরেজ সরকার সাঁওতালদের ক্ষুদ্র জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ইংরেজ কর্তৃপক্ষ উত্তরে গঙ্গার কাছাকাছি তেলিয়া গড়াই পরগনার সঙ্গে বীরভূম ও ভাগলপুর থেকে ৯,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে দেয়। এই এলাকা একজন ডেপুটি কমিশনারের অধীনে এনে ‘সাঁওতাল পরগনা’ নামে সাঁওতালদের জন্য একটি স্বতন্ত্র সংরক্ষিত এলাকা গঠন করা হয়। বলা হয় সাঁওতাল পরগনায় কোম্পানির কোন আইনবিধি কার্যকর করা হবে না। এর ফলে মহাজনদের দেয়া সব ঋণ বাতিল হয়। সাঁওতালরা জমির মালিকানা অর্জন করে।

সাঁওতাল বিদ্রোহ বাংলার ও ভারতের কৃষক-সংগ্রামের ঐতিহ্যকে শুধু উজ্জ্বল আর গৌরবান্বিতই করেনি, বরং বিদ্রোহীদের বীরত্বের কাহিনী পরবর্তী কৃষক সংগ্রামে ও তথাকথিত সিপাহি বিদ্রোহকেও প্রেরণা জুগিয়েছিল। তথাপি প্রত্যক্ষ বিদেশি শাসনের অবসান হলেও পরোক্ষ শোষণ আজও বিদ্যমান। যে দাবি নিয়ে সাঁওতাল ও তার সহযোগিরা লড়াই করেছিল, তা আজও পূরণ হয়নি। সাঁওতালদের দাবি আজ সাধারণ দাবিতে পরিণত হয়ে বনভূমি হতে রাজপথে পৌঁছে গিয়েছে। তাদের সেসব দাবি আজও কৃষক অব্যাহত রেখে বার বার লড়াই করছে। এই উপমহাদেশের কৃষককে সম্মানের আসনে বসিয়েছে। কৃষককে আজ কোন শাসক উপেক্ষা করতে পারে না। আজ পর্যন্ত চলে আসা সমস্ত কৃষক সংগ্রামের ইতিহাসে ১৮৫৫ থেকে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ সাঁওতাল বিদ্রোহের গুরুত্ব ও মূল্য ভারতবর্ষের কৃষককুল, দরিদ্র ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কাছে অনেক বেশি। আর তাই তো ইতিহাসের পাতায় সাঁওতাল বিদ্রোহ স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।

back to top