alt

মুক্ত আলোচনা

চার সন্তান হত্যার দায়ে সাজাপ্রাপ্ত এক মা

জাহিদ অয়ন

: মঙ্গলবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১

নিজের চার সন্তানকে হত্যার দায়ে ২০০৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার নিউসাউথ ওয়েলস রাজ্যের বাসিন্দা ক্যাথলিন ফলবিগকে সেখানকার আদালত ৪০ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেন। এ মামলার আপিলে ২০০৫ সালে সাজা কমিয়ে নন-প্যারোলে ৩০ বছরের সাজা বহাল রাখা হয়। তারপর কেটে গিয়েছে অনেক বছর। ২০২১ সালে এসে ক্যাথলিন ফলবিগ ইতিমধ্যেই ভোগ করেছেন ১৮ বছরের কারাবাস; তাকে দেখা হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে ঘৃণিত নারী সিরিয়াল কিলার হিসেবে। ক্যাথলিনের মামলাটি পুনর্বিবেচনার জন্য বহুদিন ধরেই বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ দাবি জানিয়ে আসছিল। বৈজ্ঞানিক প্রমাণাদি এবং মৃত্যুর ঘটনাগুলোর ভিন্ন ব্যাখ্যা প্রদান করে ২০১৫ সালে একটি আনুষ্ঠানিক পিটিশন জমা দেওয়া হয়। তারপর বহু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা পার করে ২০১৮ সালে পিটিশনটির ভিত্তিতে নতুন করে ক্যাথলিনের মামলাটি পুনর্বিবেচনা করতে একটি বিচারিক তদন্ত পরিচালনা করা হয়। কিন্তু ২০১৯ সালে সেই জুডিশিয়াল ইনক্যুয়েরির বিচারকও সাজা বহাল রাখেন। এই সিদ্ধান্তকে মিসক্যারিয়েজ অব জাস্টিস বলে আখ্যা দিয়েছেন ক্যাথলিনের সমর্থকেরা। অবশেষে ২০২১ সালের মার্চে ক্ষমার আবেদন জানিয়ে একটি পিটিশন জমা দেওয়া হয়। পিটিশনটিতে স্বাক্ষর করেছেন অস্ট্রেলিয়ার প্রথম সারির ৯০ জন বিজ্ঞানী, যার মধ্যে দুজন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীও রয়েছেন। বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন যে ক্যাথলিন ফলবিগের চার সন্তানের মৃত্যুকেই প্রাকৃতিকভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। আর তাদের দাবি যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে ক্যাথলিন ফলবিগের মামলাটি অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে ঘৃণিত নারী সিরিয়াল কিলারের মামলা না হয়ে বরং সবচেয়ে দুর্ভাগা মায়ের মামলা হিসেবে ইতিহাসে লিখিত হবে, যিনি প্রথমত তার চার সন্তানকে ক্রমান্বয়ে হারিয়েছেন; তারপর ত্রুটিপূর্ণ বিচারিক প্রক্রিয়ার শিকার হয়ে নিজ সন্তানদের হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে কারাভোগ করছেন।

ঘটনাপ্রবাহ
ক্যাথলিন ফলবিগের মামলাটির পর্যালোচনা শুরু করতে হবে তার শৈশব থেকে। শৈশব থেকেই তার দুর্ভাগ্যজনক গল্পের সূচনা। ক্যাথলিনের বয়স যখন মাত্র তিন বছর তখন স¤পর্কের টানাপোড়েনে তার মা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান এবং কোনো বন্ধুর বাড়িতে অবস্থান নেন। এরপর কয়েক দফায় ক্যাথলিনের বাবা তাকে ফিরিয়ে আনতে জোরাজুরি করেন। এক্ষেত্রে বলে রাখতে হবে যে, ক্যাথলিনের বাবা অনেক ক্ষেত্রে শারীরিকভাবেও আঘাত করে বসেন। ক্যাথলিনের মা ফিরে আসতে অস্বীকৃতি জানাতে থাকেন। ধীরে ধীরে আরো ভয়ংকর হয়ে ওঠেন ক্যাথলিনের বাবা। তার মা যেখানে অবস্থান করছিলেন তার পাশের একটি রাস্তাতেই একদিন তাদের পুনরায় সাক্ষাৎ হয়। সেদিন ক্যাথলিনের বাবা ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে তার মাকে ২৪ বার ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেন। লোকটি অতটাই মানসিক বিকারগ্রস্ত ছিলেন যে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, লোকটি ছুরিকাঘাতের পর ঘটনাস্থলেই অবস্থান করেন। ক্যাথলিনের মুমূর্ষু মায়ের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কিছু কথাও বলেন; ক্ষমার্ত ভঙ্গিতে জানান যে এটি ছাড়া তার কোনো উপায় ছিল না। এমনকি প্রত্যক্ষদর্শীদের একজনকে উদ্দেশ্য করে পুলিশে (৯১১) খবর দিতে বলেন। ক্যাথলিনের মাকে হত্যার দায়ে তার বাবার যাবজ্জীবন বা ১৪ বছরের কারাদণ্ড হয়।

এর পর থেকে ক্যাথলিনের শৈশব কাটে পালক বাবা-মায়ের কাছে। শৈশবের ঘটনা তার ওপর কোনো মানসিক প্রভাব ফেলেছিল কি না, তা স্পষ্ট না হলেও, শুরুতে কিছুদিন তার আগ্রাসি মনোভাব লক্ষ করা যায়। যদিও এরপর সব স্বাভাবিক হতে থাকে। শৈশবের কোনো স্মৃতিই তার মনে থাকার কথা নয়। তাই ষোড়শ জন্মদিন পর্যন্ত তিনি জানতেনও না তার অতীতের কথা। ১৬ বছর বয়সি ক্যাথলিনকে তার পালক বাবা-মা নতুন করে অতীতের ঘটনাগুলো জানান। এই সত্য জানতে পেরে ক্যাথলিন নতুন করে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন।

স্বামী ক্রেইগ ফলবিগের সঙ্গে তার বিয়ে হয় ১৯৮৭ সালে। ক্যাথলিন সব সময়ই একটি সুখী-সুন্দর পরিবার চেয়েছিলেন, তার নিজের জীবনে সব সময়ই যেটি অনুপস্থিত ছিল। এটি তাকে মা হিসেবে তার মমত্ব, যত্নশীলতাকে আরো প্রগাঢ়ই করে তোলার কথা। কিন্তু তারপর ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত ১০ বছর সময়ে একে একে তার চার সন্তান ক্যালেব, প্যাট্রিক, সারা ও ল’রা রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করে।

চার সন্তানের মৃত্যুরহস্য
ফলবিগ দম্পতির প্রথম সন্তান ক্যালেবের জন্ম হয় ১৯৮৯ সালে। মাত্র ১৯ দিন বয়সে হঠাৎ একদিন ঘুমের ভেতর তার মৃত্যু হয়। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট এ ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। যদিও এক বছরের কম বয়সি নবজাতকের ক্ষেত্রে এমন রহস্যজনক মৃত্যুর নজির রয়েছে; আছে বৈজ্ঞানিক নামও। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এ ধরনের ঘটনাকে Sudden Infant Death Syndrome (SIDS) অথবা নবজাতকের হঠাৎ মৃত্যু উপসর্গ বলে থাকেন। এমন ঘটনায় এক বছরের কম বয়সি নবজাতকের হঠাৎ কোনো লক্ষণ ছাড়াই ঘুমের ভেতর মৃত্যু হতে দেখা যায় এবং মৃত্যুর কোনো প্রকার কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। ক্যালেবের মৃত্যুকেও ঝওউঝ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

প্যাট্রিকের জন্ম হয় ১৯৯০ সালে। মাত্র চার মাস বয়সে একবার দেখা যায় প্যাট্রিক নিশ্বাস নিচ্ছে না। তৎক্ষণাৎ অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সে যাত্রায় প্যাট্রিক বেঁচে যায়। তবে লম্বা সময় শ্বাস নিতে না পারার কারণে তার মস্তিষ্কে জটিলতা দেখা দেয়। এরপর প্যাট্রিকের যখন আট মাস বয়স, তখন আবার একদিন ঘুমন্ত অবস্থায় দেখা যায় যে, সে শ্বাস নিচ্ছে না। এবার আর তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। প্যাট্রিকের ময়নাতদন্ত অবশ্য উত্তরহীন ছিল না। রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে শ্বাসনালি অবরোধজনিত Asphixia বা শ্বাসকষ্ট।

ফলবিগ দম্পতির তৃতীয় সন্তান হিসেবে জন্ম হয় সারার। সারার ক্ষেত্রে ক্যাথলিন আরো বেশি সতর্ক ছিলেন। এবার তিনি ঈচজ প্রদানের ট্রেনিং নিয়েছিলেন। ১৯৯৩ সালে মাত্র ১০ মাস বয়সে একদিন সারাকেও ঘুমন্ত অবস্থায় শ্বাস-প্রশ্বাসহীন নির্জীব অবস্থায় পাওয়া যায়। ময়নাতদন্তে ক্যালেবের মতো সারার মৃত্যুকেও Sudden Infant Death Syndrome (SIDS) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

১৯৯৭ সালে ক্যাথলিনের চতুর্থ সন্তান ল’রার জন্ম হয়। চার সন্তানের মধ্যে ল’রাই সম্ভবত সবচেয়ে আশাবাদী করেছিল ফলবিগ দম্পতিকে। কেননা ল’রাই একমাত্র সন্তান, যার একটি জন্মদিন তারা পালন করতে পেরেছিলেন; অর্থাৎ চার সন্তানের মধ্যে সে-ই এক বছরের বেশি সময় জীবিত ছিল। ল’রার যেদিন মৃত্যু হয় ক্যাথলিন তাকে সঙ্গে নিয়ে জিমে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে ল’রা গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়ে। ক্যাথলিন ল’রাকে ঘরে নিয়ে যান। ১৫-২০ মিনিট পর খোঁজ নিতে গিয়ে খেয়াল করেন ল’রা নিশ্বাস নিচ্ছে না। তৎক্ষণাৎ অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ফোন করেন, ঈচজ দেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু ল’রাকে বাঁচানো সম্ভব হয় না। ময়নাতদন্তে মৃত্যুর কারণ অজানা (undetermined) উল্লেখ করা হয়। রিপোর্টে আরো পাওয়া যায় যে ল’রার হৃৎপেশিতে প্রদাহ (inflammation in heart muscle) লক্ষ করা গিয়েছে। তবে সেটির জন্য তার মৃত্যু হবার কথা নয়, মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগে ল’রা ঠান্ডাজাতীয় এক ধরনের ভাইরাল ইনফেকশনে আক্রান্ত হয়েছিল। কিন্তু সবচেয়ে রহস্যময় ব্যাপার হলো ল’রার মৃত্যুকে আর Sudden Infant Death Syndrome (SIDS) হিসেবে চিহ্নিত করা যাচ্ছিল না, কারণ তার বয়স হয়েছিল ১৯ মাস অর্থাৎ এক বছরের চেয়ে যথেষ্ট বেশি। সাধারণত এক বছরের অধিক বয়সি বাচ্চারা SIDS-এ মৃত্যুবরণ করে না।

ক্রাউন’স থিওরি (যেভাবে ক্যাথলিন হত্যাকারী সাব্যস্ত হলেন)
ল’রার মৃত্যুর পর ক্যাথলিনের স্বামী ক্রেইগ ফলবিগ পুলিশের কাছে ক্যাথলিনের ব্যক্তিগত ডায়ারি হস্তান্তর করে জানান যে, ডায়ারিটিতে এমন কিছু বক্তব্য রয়েছে, যা ভীষণ সন্দেহজনক। ডায়ারিতে একটি জায়গায় ক্যাথলিন লেখেন, ‘Laura’s a fairly good-natured baby, thank goodness. It has saved her from the fate of her siblings. I think she was warned’ যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘ল’রা সৌভাগ্যবশত বেশ ভালো স্বভাবের একটি শিশু, যা তাকে রক্ষা করেছে তার অন্য ভাইবোনদের পরিণতি থেকে। আমার মনে হয় ওকে কেউ সতর্ক করেছে।’ তারপর তিনি আরেক জায়গায় লেখেন, ‘I’ve done it. I’ve lost it with her…Got so bad I nearly purposefully dropped her on the floor and left her’ যার অর্থ হলো, ‘আমি এটা করেছি। মেজাজ হারিয়ে ফেলেছিলাম...এতটাই যে ওকে (ল’রা) প্রায় মেঝেতে ফেলেই দিচ্ছিলাম ইচ্ছে করে।’ আরেকটি জায়গায় তিনি লেখেন, ‘I know I was short-tempered and cruel sometimes to her, and she left, with a bit of help.’ যার অর্থ, ‘আমি জানি, আমি অল্পেই মেজাজ হারাই এবং মাঝেমাঝে ওর (ল’রা) প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করে বসি, এবং সে চলে গেল, অল্প একটু সাহায্য প্রয়োজন হয়েছিল ওর।’

তদন্ত কর্মকর্তা দাবি করেন, ডায়ারির উক্তিগুলোতে ক্যাথলিন নিজের অপরাধ স্বীকার করেছেন। ক্যাথলিন যদিও ক্রমাগত অস্বীকার করে যান। তিনি বলেন যে, সন্তানদের মৃত্যুর ক্ষেত্রে তার যত্নের কোনো ত্রুটি বা কোনোরূপ অবহেলা ছিল কি না তাই ভেবে সব সময় নিজেকে দোষারোপ করতেন। নিজেকে দায়ী মনে করে অপরাধবোধে ভুগতেন এবং সেই অপরাধবোধের হতাশা থেকেই ডায়ারির বক্তব্যগুলো লেখা হয়েছে। তার মানে এই নয় যে, তিনি নিজের সন্তানদের হত্যা করেছেন। নিজের শোক, বেদনা ও হতাশা থেকেই কথাগুলো লেখা হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।

ফরেসসিক প্যাথোলজিস্ট ড. মাথ্যু অরডি বলেন যে এ ধরনের একটি মৃত্যু দুর্ঘটনা, দুটি হলে সন্দেহজনক এবং তিনটি মৃত্যু নিশ্চয়ই হত্যা- এ ধরনের একটা ধারণা তখন অস্ট্রেলিয়ায় প্রচলিত ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটনার নজির দেখা গিয়েছে।

রাষ্ট্রপক্ষ অর্থাৎ এক্ষেত্রে দ্য ক্রাউন দাবি করেন যে, ক্যাথলিন নিজেই নিজের চার সন্তানকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছেন। তিনি তাদের হত্যা করেছেন আকস্মিক ক্রোধের বশবর্তী হয়ে। এবং পরমুহূর্তেই তৎক্ষণাৎ স্বাভাবিক হিতাহিত জ্ঞান ফিরে এলে তিনি অনুতপ্ত হয়ে পড়েছেন এবং এ কী করে ফেললাম ভেবে বিচলিত হয়ে পড়েছেন। এ মামলায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ক্যাথলিনের স্বামী ক্রেইগ ফলবিগের সাক্ষ্য। ক্রেইগ তার স্ত্রীর বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করে বলেন যে, ক্যাথলিন বাচ্চাদের নিয়ে বিষণœতায় ভুগছিল। এ ছাড়া চিকিৎসা বিশেষজ্ঞগণ আদালতকে জানান ল’রার মায়োকার্ডাইটিস বা হৃৎপেশির প্রদাহ এমন কোনো রোগ ছিল না, যার কারণে তার মৃত্যু ঘটবে। ক্যাথলিনের শৈশবও তার মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলতে পারে, এমন ধারণা থেকে তার বাবার ঘটনাও এ মামলায় প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে ডায়ারির উক্তিগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণিক দলিল হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৯৬ সালের একটি উক্তিতে ক্যাথলিন লেখেন, ‘obviously, I am my father’s daughter’ অর্থাৎ ‘নিশ্চয়ই, আমি আমার বাবার (মতো) মেয়ে।’ ডায়ারি থেকে বিশেষ করে ল’রার ক্ষেত্রে ‘with a bit of help’ কথাটি আলাদা করে নজরে আসে। যদিও এর বিপরীতে ক্যাথলিন বলেন- তিনি এখানে সৃষ্টিকর্তার সাহায্য বুঝিয়েছেন, নিজের কথা বোঝাননি। তবে তার কথা আমলে নেওয়া হয়নি।

সারকামস্টেনশিয়াল এভিডেন্স বা পরিস্থিতিগত প্রমাণের ভিত্তিতে ক্যাথলিন ফলবিগকে নিজের চার সন্তানকে হত্যার দায়ে ৪০ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়, যা পরে আপিলে ১০ বছর কমে ৩০ বছর বহাল থাকে। ২০২১ সালে এসে ক্যাথলিন ইতিমধ্যেই ভোগ করেছেন ১৮ বছরের সাজা।

নতুন বৈজ্ঞানিক প্রমাণাদি (New Scientific Evidences)
দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২০০৩ সালে অনেক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিই সুলভ্য ছিল না, যা এখন রয়েছে। বিশেষ করে, মানুষের জেনেটিক তথ্যাদি ব্যাখ্যা এবং মামলার বিচারকার্যে তার ব্যবহার সহজ ছিল না। সাম্প্রতিক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা ক্যাথলিন এবং তার দুই কন্যাসন্তানের জিনে এক ধরনের প্যাথোজেনিক জেনেটিকমিউটেশন আবিষ্কার করেছেন, যা তাদের মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল বলে তারা দাবি করেন। যদিও দুই পুত্রসন্তানের জিনে ভিন্ন ধরনের মিউটেশন দেখতে পেয়েছেন তারা। তাদের ক্ষেত্রে আরো গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলে তারা স্বীকার করেছেন।

একজন সাবেক বিচারক, রেজিনাল্ড ব্লাঞ্চ, যিনি ২০১৯-এর জুডিশিয়াল ইনক্যুয়েরির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, বলেন যে পরিস্থিতিগত প্রমাণাদি (circumstantial evediences) এখনো এটাই নির্দেশ করে যে, এত কিছুর পরেও মৃত্যুর জন্য কাউকে তাদের শ্বাসরোধ করতে হতো এবং সকল প্রমাণ মিস ফলবিগের দিকেই আঙুল উত্থাপন করছে।

শিশু ও জনস্বাস্থ্য গবেষক অধ্যাপক ফিওনা স্ট্যানলি বলেন যে, এটা খুবই দুঃখজনক যে বৈজ্ঞানিক তথ্যাদি উপেক্ষা করে বারবার পরিস্থিতিগত প্রমাণাদির ওপর নির্ভর করা হয়েছে। মানব জিনতত্ত্ব গবেষক অধ্যাপক জোসেফ গেচ বলেন, এই মামলায় বিজ্ঞান এতটাই স্পষ্ট এবং সন্দেহাতীত যে সেটি অগ্রাহ্য করার কোনো সুযোগ নেই।

দীর্ঘ প্রচেষ্টায় ক্রমাগত ব্যর্থতার পর ক্ষমার অনুরোধ জানিয়ে বিজ্ঞানীদের পিটিশন ক্যাথলিন ফলবিগকে মুক্ত করতে পারবে কি না, তা নিয়ে পৃথিবীব্যাপী মানুষের মধ্যে মামলাটি নতুন করে আগ্রহ তৈরি হয়েছে।

[লেখক: শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]
সৌজন্যে: আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

চার সন্তান হত্যার দায়ে সাজাপ্রাপ্ত এক মা

জাহিদ অয়ন

মঙ্গলবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১

নিজের চার সন্তানকে হত্যার দায়ে ২০০৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার নিউসাউথ ওয়েলস রাজ্যের বাসিন্দা ক্যাথলিন ফলবিগকে সেখানকার আদালত ৪০ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেন। এ মামলার আপিলে ২০০৫ সালে সাজা কমিয়ে নন-প্যারোলে ৩০ বছরের সাজা বহাল রাখা হয়। তারপর কেটে গিয়েছে অনেক বছর। ২০২১ সালে এসে ক্যাথলিন ফলবিগ ইতিমধ্যেই ভোগ করেছেন ১৮ বছরের কারাবাস; তাকে দেখা হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে ঘৃণিত নারী সিরিয়াল কিলার হিসেবে। ক্যাথলিনের মামলাটি পুনর্বিবেচনার জন্য বহুদিন ধরেই বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ দাবি জানিয়ে আসছিল। বৈজ্ঞানিক প্রমাণাদি এবং মৃত্যুর ঘটনাগুলোর ভিন্ন ব্যাখ্যা প্রদান করে ২০১৫ সালে একটি আনুষ্ঠানিক পিটিশন জমা দেওয়া হয়। তারপর বহু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা পার করে ২০১৮ সালে পিটিশনটির ভিত্তিতে নতুন করে ক্যাথলিনের মামলাটি পুনর্বিবেচনা করতে একটি বিচারিক তদন্ত পরিচালনা করা হয়। কিন্তু ২০১৯ সালে সেই জুডিশিয়াল ইনক্যুয়েরির বিচারকও সাজা বহাল রাখেন। এই সিদ্ধান্তকে মিসক্যারিয়েজ অব জাস্টিস বলে আখ্যা দিয়েছেন ক্যাথলিনের সমর্থকেরা। অবশেষে ২০২১ সালের মার্চে ক্ষমার আবেদন জানিয়ে একটি পিটিশন জমা দেওয়া হয়। পিটিশনটিতে স্বাক্ষর করেছেন অস্ট্রেলিয়ার প্রথম সারির ৯০ জন বিজ্ঞানী, যার মধ্যে দুজন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীও রয়েছেন। বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন যে ক্যাথলিন ফলবিগের চার সন্তানের মৃত্যুকেই প্রাকৃতিকভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। আর তাদের দাবি যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে ক্যাথলিন ফলবিগের মামলাটি অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে ঘৃণিত নারী সিরিয়াল কিলারের মামলা না হয়ে বরং সবচেয়ে দুর্ভাগা মায়ের মামলা হিসেবে ইতিহাসে লিখিত হবে, যিনি প্রথমত তার চার সন্তানকে ক্রমান্বয়ে হারিয়েছেন; তারপর ত্রুটিপূর্ণ বিচারিক প্রক্রিয়ার শিকার হয়ে নিজ সন্তানদের হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে কারাভোগ করছেন।

ঘটনাপ্রবাহ
ক্যাথলিন ফলবিগের মামলাটির পর্যালোচনা শুরু করতে হবে তার শৈশব থেকে। শৈশব থেকেই তার দুর্ভাগ্যজনক গল্পের সূচনা। ক্যাথলিনের বয়স যখন মাত্র তিন বছর তখন স¤পর্কের টানাপোড়েনে তার মা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান এবং কোনো বন্ধুর বাড়িতে অবস্থান নেন। এরপর কয়েক দফায় ক্যাথলিনের বাবা তাকে ফিরিয়ে আনতে জোরাজুরি করেন। এক্ষেত্রে বলে রাখতে হবে যে, ক্যাথলিনের বাবা অনেক ক্ষেত্রে শারীরিকভাবেও আঘাত করে বসেন। ক্যাথলিনের মা ফিরে আসতে অস্বীকৃতি জানাতে থাকেন। ধীরে ধীরে আরো ভয়ংকর হয়ে ওঠেন ক্যাথলিনের বাবা। তার মা যেখানে অবস্থান করছিলেন তার পাশের একটি রাস্তাতেই একদিন তাদের পুনরায় সাক্ষাৎ হয়। সেদিন ক্যাথলিনের বাবা ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে তার মাকে ২৪ বার ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেন। লোকটি অতটাই মানসিক বিকারগ্রস্ত ছিলেন যে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, লোকটি ছুরিকাঘাতের পর ঘটনাস্থলেই অবস্থান করেন। ক্যাথলিনের মুমূর্ষু মায়ের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কিছু কথাও বলেন; ক্ষমার্ত ভঙ্গিতে জানান যে এটি ছাড়া তার কোনো উপায় ছিল না। এমনকি প্রত্যক্ষদর্শীদের একজনকে উদ্দেশ্য করে পুলিশে (৯১১) খবর দিতে বলেন। ক্যাথলিনের মাকে হত্যার দায়ে তার বাবার যাবজ্জীবন বা ১৪ বছরের কারাদণ্ড হয়।

এর পর থেকে ক্যাথলিনের শৈশব কাটে পালক বাবা-মায়ের কাছে। শৈশবের ঘটনা তার ওপর কোনো মানসিক প্রভাব ফেলেছিল কি না, তা স্পষ্ট না হলেও, শুরুতে কিছুদিন তার আগ্রাসি মনোভাব লক্ষ করা যায়। যদিও এরপর সব স্বাভাবিক হতে থাকে। শৈশবের কোনো স্মৃতিই তার মনে থাকার কথা নয়। তাই ষোড়শ জন্মদিন পর্যন্ত তিনি জানতেনও না তার অতীতের কথা। ১৬ বছর বয়সি ক্যাথলিনকে তার পালক বাবা-মা নতুন করে অতীতের ঘটনাগুলো জানান। এই সত্য জানতে পেরে ক্যাথলিন নতুন করে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন।

স্বামী ক্রেইগ ফলবিগের সঙ্গে তার বিয়ে হয় ১৯৮৭ সালে। ক্যাথলিন সব সময়ই একটি সুখী-সুন্দর পরিবার চেয়েছিলেন, তার নিজের জীবনে সব সময়ই যেটি অনুপস্থিত ছিল। এটি তাকে মা হিসেবে তার মমত্ব, যত্নশীলতাকে আরো প্রগাঢ়ই করে তোলার কথা। কিন্তু তারপর ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত ১০ বছর সময়ে একে একে তার চার সন্তান ক্যালেব, প্যাট্রিক, সারা ও ল’রা রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করে।

চার সন্তানের মৃত্যুরহস্য
ফলবিগ দম্পতির প্রথম সন্তান ক্যালেবের জন্ম হয় ১৯৮৯ সালে। মাত্র ১৯ দিন বয়সে হঠাৎ একদিন ঘুমের ভেতর তার মৃত্যু হয়। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট এ ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। যদিও এক বছরের কম বয়সি নবজাতকের ক্ষেত্রে এমন রহস্যজনক মৃত্যুর নজির রয়েছে; আছে বৈজ্ঞানিক নামও। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এ ধরনের ঘটনাকে Sudden Infant Death Syndrome (SIDS) অথবা নবজাতকের হঠাৎ মৃত্যু উপসর্গ বলে থাকেন। এমন ঘটনায় এক বছরের কম বয়সি নবজাতকের হঠাৎ কোনো লক্ষণ ছাড়াই ঘুমের ভেতর মৃত্যু হতে দেখা যায় এবং মৃত্যুর কোনো প্রকার কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। ক্যালেবের মৃত্যুকেও ঝওউঝ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

প্যাট্রিকের জন্ম হয় ১৯৯০ সালে। মাত্র চার মাস বয়সে একবার দেখা যায় প্যাট্রিক নিশ্বাস নিচ্ছে না। তৎক্ষণাৎ অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সে যাত্রায় প্যাট্রিক বেঁচে যায়। তবে লম্বা সময় শ্বাস নিতে না পারার কারণে তার মস্তিষ্কে জটিলতা দেখা দেয়। এরপর প্যাট্রিকের যখন আট মাস বয়স, তখন আবার একদিন ঘুমন্ত অবস্থায় দেখা যায় যে, সে শ্বাস নিচ্ছে না। এবার আর তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। প্যাট্রিকের ময়নাতদন্ত অবশ্য উত্তরহীন ছিল না। রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে শ্বাসনালি অবরোধজনিত Asphixia বা শ্বাসকষ্ট।

ফলবিগ দম্পতির তৃতীয় সন্তান হিসেবে জন্ম হয় সারার। সারার ক্ষেত্রে ক্যাথলিন আরো বেশি সতর্ক ছিলেন। এবার তিনি ঈচজ প্রদানের ট্রেনিং নিয়েছিলেন। ১৯৯৩ সালে মাত্র ১০ মাস বয়সে একদিন সারাকেও ঘুমন্ত অবস্থায় শ্বাস-প্রশ্বাসহীন নির্জীব অবস্থায় পাওয়া যায়। ময়নাতদন্তে ক্যালেবের মতো সারার মৃত্যুকেও Sudden Infant Death Syndrome (SIDS) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

১৯৯৭ সালে ক্যাথলিনের চতুর্থ সন্তান ল’রার জন্ম হয়। চার সন্তানের মধ্যে ল’রাই সম্ভবত সবচেয়ে আশাবাদী করেছিল ফলবিগ দম্পতিকে। কেননা ল’রাই একমাত্র সন্তান, যার একটি জন্মদিন তারা পালন করতে পেরেছিলেন; অর্থাৎ চার সন্তানের মধ্যে সে-ই এক বছরের বেশি সময় জীবিত ছিল। ল’রার যেদিন মৃত্যু হয় ক্যাথলিন তাকে সঙ্গে নিয়ে জিমে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে ল’রা গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়ে। ক্যাথলিন ল’রাকে ঘরে নিয়ে যান। ১৫-২০ মিনিট পর খোঁজ নিতে গিয়ে খেয়াল করেন ল’রা নিশ্বাস নিচ্ছে না। তৎক্ষণাৎ অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ফোন করেন, ঈচজ দেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু ল’রাকে বাঁচানো সম্ভব হয় না। ময়নাতদন্তে মৃত্যুর কারণ অজানা (undetermined) উল্লেখ করা হয়। রিপোর্টে আরো পাওয়া যায় যে ল’রার হৃৎপেশিতে প্রদাহ (inflammation in heart muscle) লক্ষ করা গিয়েছে। তবে সেটির জন্য তার মৃত্যু হবার কথা নয়, মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগে ল’রা ঠান্ডাজাতীয় এক ধরনের ভাইরাল ইনফেকশনে আক্রান্ত হয়েছিল। কিন্তু সবচেয়ে রহস্যময় ব্যাপার হলো ল’রার মৃত্যুকে আর Sudden Infant Death Syndrome (SIDS) হিসেবে চিহ্নিত করা যাচ্ছিল না, কারণ তার বয়স হয়েছিল ১৯ মাস অর্থাৎ এক বছরের চেয়ে যথেষ্ট বেশি। সাধারণত এক বছরের অধিক বয়সি বাচ্চারা SIDS-এ মৃত্যুবরণ করে না।

ক্রাউন’স থিওরি (যেভাবে ক্যাথলিন হত্যাকারী সাব্যস্ত হলেন)
ল’রার মৃত্যুর পর ক্যাথলিনের স্বামী ক্রেইগ ফলবিগ পুলিশের কাছে ক্যাথলিনের ব্যক্তিগত ডায়ারি হস্তান্তর করে জানান যে, ডায়ারিটিতে এমন কিছু বক্তব্য রয়েছে, যা ভীষণ সন্দেহজনক। ডায়ারিতে একটি জায়গায় ক্যাথলিন লেখেন, ‘Laura’s a fairly good-natured baby, thank goodness. It has saved her from the fate of her siblings. I think she was warned’ যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘ল’রা সৌভাগ্যবশত বেশ ভালো স্বভাবের একটি শিশু, যা তাকে রক্ষা করেছে তার অন্য ভাইবোনদের পরিণতি থেকে। আমার মনে হয় ওকে কেউ সতর্ক করেছে।’ তারপর তিনি আরেক জায়গায় লেখেন, ‘I’ve done it. I’ve lost it with her…Got so bad I nearly purposefully dropped her on the floor and left her’ যার অর্থ হলো, ‘আমি এটা করেছি। মেজাজ হারিয়ে ফেলেছিলাম...এতটাই যে ওকে (ল’রা) প্রায় মেঝেতে ফেলেই দিচ্ছিলাম ইচ্ছে করে।’ আরেকটি জায়গায় তিনি লেখেন, ‘I know I was short-tempered and cruel sometimes to her, and she left, with a bit of help.’ যার অর্থ, ‘আমি জানি, আমি অল্পেই মেজাজ হারাই এবং মাঝেমাঝে ওর (ল’রা) প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করে বসি, এবং সে চলে গেল, অল্প একটু সাহায্য প্রয়োজন হয়েছিল ওর।’

তদন্ত কর্মকর্তা দাবি করেন, ডায়ারির উক্তিগুলোতে ক্যাথলিন নিজের অপরাধ স্বীকার করেছেন। ক্যাথলিন যদিও ক্রমাগত অস্বীকার করে যান। তিনি বলেন যে, সন্তানদের মৃত্যুর ক্ষেত্রে তার যত্নের কোনো ত্রুটি বা কোনোরূপ অবহেলা ছিল কি না তাই ভেবে সব সময় নিজেকে দোষারোপ করতেন। নিজেকে দায়ী মনে করে অপরাধবোধে ভুগতেন এবং সেই অপরাধবোধের হতাশা থেকেই ডায়ারির বক্তব্যগুলো লেখা হয়েছে। তার মানে এই নয় যে, তিনি নিজের সন্তানদের হত্যা করেছেন। নিজের শোক, বেদনা ও হতাশা থেকেই কথাগুলো লেখা হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।

ফরেসসিক প্যাথোলজিস্ট ড. মাথ্যু অরডি বলেন যে এ ধরনের একটি মৃত্যু দুর্ঘটনা, দুটি হলে সন্দেহজনক এবং তিনটি মৃত্যু নিশ্চয়ই হত্যা- এ ধরনের একটা ধারণা তখন অস্ট্রেলিয়ায় প্রচলিত ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটনার নজির দেখা গিয়েছে।

রাষ্ট্রপক্ষ অর্থাৎ এক্ষেত্রে দ্য ক্রাউন দাবি করেন যে, ক্যাথলিন নিজেই নিজের চার সন্তানকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছেন। তিনি তাদের হত্যা করেছেন আকস্মিক ক্রোধের বশবর্তী হয়ে। এবং পরমুহূর্তেই তৎক্ষণাৎ স্বাভাবিক হিতাহিত জ্ঞান ফিরে এলে তিনি অনুতপ্ত হয়ে পড়েছেন এবং এ কী করে ফেললাম ভেবে বিচলিত হয়ে পড়েছেন। এ মামলায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ক্যাথলিনের স্বামী ক্রেইগ ফলবিগের সাক্ষ্য। ক্রেইগ তার স্ত্রীর বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করে বলেন যে, ক্যাথলিন বাচ্চাদের নিয়ে বিষণœতায় ভুগছিল। এ ছাড়া চিকিৎসা বিশেষজ্ঞগণ আদালতকে জানান ল’রার মায়োকার্ডাইটিস বা হৃৎপেশির প্রদাহ এমন কোনো রোগ ছিল না, যার কারণে তার মৃত্যু ঘটবে। ক্যাথলিনের শৈশবও তার মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলতে পারে, এমন ধারণা থেকে তার বাবার ঘটনাও এ মামলায় প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে ডায়ারির উক্তিগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণিক দলিল হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৯৬ সালের একটি উক্তিতে ক্যাথলিন লেখেন, ‘obviously, I am my father’s daughter’ অর্থাৎ ‘নিশ্চয়ই, আমি আমার বাবার (মতো) মেয়ে।’ ডায়ারি থেকে বিশেষ করে ল’রার ক্ষেত্রে ‘with a bit of help’ কথাটি আলাদা করে নজরে আসে। যদিও এর বিপরীতে ক্যাথলিন বলেন- তিনি এখানে সৃষ্টিকর্তার সাহায্য বুঝিয়েছেন, নিজের কথা বোঝাননি। তবে তার কথা আমলে নেওয়া হয়নি।

সারকামস্টেনশিয়াল এভিডেন্স বা পরিস্থিতিগত প্রমাণের ভিত্তিতে ক্যাথলিন ফলবিগকে নিজের চার সন্তানকে হত্যার দায়ে ৪০ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়, যা পরে আপিলে ১০ বছর কমে ৩০ বছর বহাল থাকে। ২০২১ সালে এসে ক্যাথলিন ইতিমধ্যেই ভোগ করেছেন ১৮ বছরের সাজা।

নতুন বৈজ্ঞানিক প্রমাণাদি (New Scientific Evidences)
দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২০০৩ সালে অনেক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিই সুলভ্য ছিল না, যা এখন রয়েছে। বিশেষ করে, মানুষের জেনেটিক তথ্যাদি ব্যাখ্যা এবং মামলার বিচারকার্যে তার ব্যবহার সহজ ছিল না। সাম্প্রতিক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা ক্যাথলিন এবং তার দুই কন্যাসন্তানের জিনে এক ধরনের প্যাথোজেনিক জেনেটিকমিউটেশন আবিষ্কার করেছেন, যা তাদের মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল বলে তারা দাবি করেন। যদিও দুই পুত্রসন্তানের জিনে ভিন্ন ধরনের মিউটেশন দেখতে পেয়েছেন তারা। তাদের ক্ষেত্রে আরো গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলে তারা স্বীকার করেছেন।

একজন সাবেক বিচারক, রেজিনাল্ড ব্লাঞ্চ, যিনি ২০১৯-এর জুডিশিয়াল ইনক্যুয়েরির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, বলেন যে পরিস্থিতিগত প্রমাণাদি (circumstantial evediences) এখনো এটাই নির্দেশ করে যে, এত কিছুর পরেও মৃত্যুর জন্য কাউকে তাদের শ্বাসরোধ করতে হতো এবং সকল প্রমাণ মিস ফলবিগের দিকেই আঙুল উত্থাপন করছে।

শিশু ও জনস্বাস্থ্য গবেষক অধ্যাপক ফিওনা স্ট্যানলি বলেন যে, এটা খুবই দুঃখজনক যে বৈজ্ঞানিক তথ্যাদি উপেক্ষা করে বারবার পরিস্থিতিগত প্রমাণাদির ওপর নির্ভর করা হয়েছে। মানব জিনতত্ত্ব গবেষক অধ্যাপক জোসেফ গেচ বলেন, এই মামলায় বিজ্ঞান এতটাই স্পষ্ট এবং সন্দেহাতীত যে সেটি অগ্রাহ্য করার কোনো সুযোগ নেই।

দীর্ঘ প্রচেষ্টায় ক্রমাগত ব্যর্থতার পর ক্ষমার অনুরোধ জানিয়ে বিজ্ঞানীদের পিটিশন ক্যাথলিন ফলবিগকে মুক্ত করতে পারবে কি না, তা নিয়ে পৃথিবীব্যাপী মানুষের মধ্যে মামলাটি নতুন করে আগ্রহ তৈরি হয়েছে।

[লেখক: শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]
সৌজন্যে: আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)

back to top