alt

মুক্ত আলোচনা

ব্যাংক ইন্টারেস্ট কি সুদ, আরবিতে যা রিবা?

এম লতিফ ভূঁঞা

: বৃহস্পতিবার, ০৭ অক্টোবর ২০২১

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুদ (রিবা) হারাম করেছেন। এ নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই। কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যেয়ে এ লেখার প্রয়াস। প্রশ্ন হলো, ব্যাংক ইন্টারেস্ট সুদ (রিবা) কিনা, যা দেড় হাজার বছর আগে পবিত্র কুরআনের আয়াত দ্বারা নিষিদ্ধ হয়েছে।

পবিত্র কুরআন, হাদিস এবং শরীয়ায় আধুনিক ব্যাংক, ইন্টারেস্ট এবং টাকা সম্পর্কে কিছু উল্লেখ নেই। বর্তমানে ব্যাংক এবং ব্যাংক ইন্টারেস্ট সম্পর্কে যা বলা হয়ে থাকে, তা সবই কিয়াস, অর্থাৎ মিল করে বলা, যা ইংরেজিতে এনালোজি বলে। পবিত্র কুরআন পূর্ব নির্ধারিত কোন আয় এবং ঝুঁকিমুক্ত কোন আয়কে হারাম বলেনি। অর্থাৎ রিস্ক-ফ্রি ও ফিক্সড হলেই সুদ হবে সে রকম কিছু পবিত্র কুরাআনে নেই। এরকম থাকলে বেতন, বাড়িভাড়া, কমিশন, ভ্যাট, ট্যাক্স ইত্যাদি - যা কিছু পূর্ব নির্ধারিত হয়- অবৈধ বা হারাম হয়ে যাওয়ার কথা।

ইংরেজি টু বাংলা ডিকশেনারিতে ইন্টারেস্ট শব্দের অনেকগুলো বাংলা প্রতিশব্দ দেয়া আছে। যেমন, ইচ্ছা, লাভ, ফায়দা, মুনাফা, রেট অব ডিসকাউন্ট, সার্ভিস চার্জ, সুদ, কুশিদ ইত্যাদি। সুদের (রিবার) ইংরেজি প্রতিশব্দ কিন্তু ইউজুয়েরী। চড়া সুদকেও ইউজুয়েরী বলে। বিভিন্ন দেশে আইন করে ইউজুয়েরী নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পৃথিবীর সকল প্রধান ধর্মে সুদ এবং সুদের ব্যবসায় নিষিদ্ধ।

পবিত্র আল কুরআনে রিবা সম্পর্কে বেশ কয়েকটি আয়াত রয়েছে। রিবার সংজ্ঞা বুঝার জন্য ঐ সকল আয়াতের যে অংশটুকু প্রাসংগিক তা ধারাবাহিকভাবে নীচে উল্লেখ করা হলো-

প্রথম ওহি (সূরা রুম, আয়াত ৩৯) ‘... যা কিছু তোমরা সুদে দিয়ে থাক, আল্লাহর কাছে বর্ধিত হয় না..” এ আয়াতে সুদ থেকে মানুষের যে কোন কল্যাণ নেই তা বুঝানো হয়েছে। দ্বিতীয় ওহি (সূরা নিসা-আয়াত ১৬১) “ অর্থাৎ আর তাদের সুদ গ্রহণের কারণে, অথচ তা তাদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবং তাদের অন্যায়ভাবে মানুষের ধন সম্পদ গ্রাস করার কারণে..” আল্লাহ কেন সুদ নিষিদ্ধ করেছেন তার কারণ নিজেই উল্লেখ করেছেন। অন্যায়ভাবে মানুষের ধন সম্পদ গ্রাস করার কারণেই আল্লাহসুদকে হারাম করেছেন। তৃতীয় ওহি (সূরা আলে ইমরান-আয়াত ১৩০-১৩২) “..তোমরা সুদ খেয়ো না চক্রবৃদ্ধি হারে..” এই আয়াতে সুদ দ্বিগুণ-চারগুণ না করার জন্য সতর্ক করেছেন। সুদ নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ এখানেও উল্লেখ করেছেন।

চতুর্থ ওহি (সূরা আল বাকারা-আয়াত ২৭৫-২৮১) “ .. তারা বলে, বেচাকেনা তো সুদেরই মত। অথচ আল্লাহ বেচাকেনাকে বৈধ করেছেন এবং সুদকে অবৈধ করেছেন।..”

সে সময়ে পণ্যের বেচাকেনা ও রিবা কিছুটা একই পদ্ধতিতে সম্পাদিত হতো বলে হাদিস সূত্রে জানা যায়। পণ্য বিনিময় প্রথার ন্যায় লেনদেন হতো। তাই সে সময় কেউ কেউ রিবা এবং বেচাকেনাকে এক রকম মনে করতো। পার্থক্য করতে পারেনি।

আয়াত ২৭৬ “.. আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দান খয়রাতকে বর্ধিত করেন”

আয়াত ২৭৮ “..সুদের যা কিছু বকেয়া রয়েছে তা পরিত্যাগ করো..” আল্লাহ এই আয়াত দ্বারা বকেয়া সুদের (রিবা) দাবি পরিত্যাগের নির্দেশ দিচ্ছেন।

আয়াত ২৭৯ “..যদি তোমরা তওবা করো, তবে তোমাদের জন্য তোমাদের মূলধন রয়ে যাবে। তোমরা কাউকে অত্যাচার করবে না...” এই অংশে রিবা পরিত্যাগ এবং কেবল মূলধন ফেরত নেয়ার কথা বলা হয়েছে। অত্যাচার করতে নিষেধ করা হয়েছে। রিবা ব্যবসায় খাতকের ওপর অন্যায় অত্যাচার হতো বলেই আল্লাহ সুদনিষেধ করেছেন বুঝা যায়। রিবা নিষিদ্ধ হওয়ার প্রধান কারণ কি তাও বুঝা যায়। মূলধন রয়ে যাওয়ার কথায় বুঝা যায় দ্রব্য বিনিময় প্রথায় সময় অতিবাহিত হলেও দ্রব্যের মূল্যের পরিবর্তন হতো না। দ্রব্যের ওজন, পরিমাণ ও মান একই থাকতো। টাকার মতো অবমূল্যায়ন হতো না। তাই মূলধন ফেরত নেয়া হলে ক্ষতি ছিল না।

আয়াত ২৮০ “খাতক যদি অভাবগ্রস্ত হয় তবে তার সচ্ছলতা আসা পর্যন্ত তাকে অবকাশ দেয়া উচিত। আর যদি তোমরা ক্ষমা করে দাও, তা হবে তোমাদের জন্য উত্তম কাজ..” এই আয়াতের অংশে খেলাপি খাতককে স্বচ্ছলতা আসা পর্যন্ত সময় দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে। মানবিক হওয়ার তাগিদ আছে।

রিবা (সুদ) সম্পর্কে সহি হাদিসে যা পাওয়া যায় তা মোটামোটি একই ধরণের। বুঝার জন্য কয়েকটি সহি হাদিস নীচে বিবৃত হল-

হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা) বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন, “স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ, রূপার বিনিময়ে রূপা, গমের বিনিময়ে গম, যবের বিনিময়ে যব, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর, লবণের বিনিময়ে লবণ, আদান প্রদান করা হলে পরিমাণ সমান সমান এবং হাতে হাতে আদান প্রদান করতে হবে। যে ব্যক্তি বেশি দেবে বা গ্রহণ করবে সে সুদি লেনদেনকারি সাব্যস্ত হবে। এক্ষত্রে সুদ গ্রহীতা ও দাতা উভয়ে সমান অপরাধী সাব্যস্ত হবে। (বুখারি ও মুসলিম)।

“স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ, পরিমাণে সমতা ব্যতিরেকে বিক্রি করো না, একদিকে অপরদিক অপেক্ষা বেশি করো না।....আর উপস্থিতির বিনিময়ে অনুপস্থিতিকে বিক্রয় করো না।” (বুখারি মুসলিম)

“ উপরন্তু তিনি বলেছেন, রূপার সাথে স্বর্ণের এবং স্বর্ণের সাথে রূপার যেভাবে ইচ্ছা (অর্থাৎ কমবেশি করে) ক্রয় বিক্রয় করতে পার।” (বুখারি ও মুসলিম)

হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা) বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন, “একদা হজরত বেলাল (সা) রাসূল (সা) এর নিকট বর্ণি প্রজাতির খেজুর নিয়ে এলে নবী (সা) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, এ প্রকার খেজুর কোথা হতে পেলে? তিনি বললেন, আমার নিকট খারাপ খেজুর ছিল, আমি উহার দুই ছা খেজুর এক ছা এর বিনিময়ে বিক্রি করেছি। তা শুনে নবী (সা) বললেন, ‘এতো সুদি লেনদেন হয়েছে। এরূপ করো না, বরং তুমি তা করতে হলে খারাপ খেজুর মুদ্রার বিনিময়ে বিক্রি করে এবং সেই মুদ্রায় উত্তম খেজুর ক্রয় করো। (বুখারিও মুসলিম)”

পবিত্র কুরআনের আয়াত এবং সহি হদিসের আলোকে সুদ বিষয়ে বিভিন্ন ফতোয়া রয়েছে। বলা হয়েছে, কোন জিনিস বিক্রি করতে হলে দোষ নির্দোষ দেখিয়ে বিক্রি করতে হবে। ফাঁকি বা ছাপিয়ে বিক্রি করা হারাম। স্বর্ণ দ্বারা স্বর্ণ বা স্বর্ণের জেওর কিনতে হলে ওজনে সমান সমান কিনতে হবে। খরিদ্দার ও বিক্রেতা এক মজলিসে বেচাকেনা সম্পন্ন করতে হবে, নচেৎ সুদে পরিণত হবে।(আলমগীরী)

স্বর্ণ দ্বারা রৌপ্য এবং রৌপ্য দ্বারা স্বর্ণ যত ইচ্ছা বেশকম কিনলে রিবা হবে না। অর্থাৎ যে জিনিস সে জিনিস দ্বারা বেশকম কিনলেই রিবা হবে, নচেৎ নয়। (আলমগীরী)

যদি এক জাতীয় দ্রব্য না হয়ে এক ওজনের হয়, তবে যত ইচ্ছা বেশকম নিতে পারবে। যথা- এক মণ আলুর পরিবর্তে ১০ মণ ধানও নেয়া যাবে। কিন্তু শর্ত হলো এক মজলিসে আদান প্রদান করতে হবে। নচেৎ সুদি হবে। (দোররুল মোখতার)

এবার জানা যাক ইসলামিক অর্থনীতির গবেষকগণ এবং ধর্মীয় জ্ঞান বুৎপত্তিসম্পন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা কি বলেন। ইসলামিক অর্থনীতির বোধ্যারাও রিবা’র সংজ্ঞা নির্ণয়ে এবং ব্যাংক ইন্টারেস্টের সাথে সামঞ্জস্য খুঁজতে গিয়ে পক্ষে বিপক্ষে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। কেউ ইন্টারেস্টকে রিবা (সুদ) আবার কেউ ইন্টারেস্টকে রিবা নয় বলে মত দিয়েছে। ১৯০০ থেকে ২০০২ পযর্šÍ ১০৩ বছরে মিসরের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রান্ড মুফতিরা বারবার মত পাল্টিয়েছে। ব্যাংক ইন্টারেস্টকে একবার বলেছে হালাল, আরেকবার বলেছে হারাম, আবার হালাল, আবার হারাম, আবার হালাল, এভাবে বারবার রায় বদল করেছেন।

আবদুল্লাহ ইউসুফ আলী পবিত্র কুরআন অনুবাদের সময় রিবাকে ইউজুযেরী (সুদ) বলেছেন, ইন্টারেস্ট বলেননি। জনাব আবদুল আলা মওদুদি তার ’দি মিনিং অব দি কুরআন’ -এ রিবাকে ইন্টারেস্ট বলেছেন। গ্রান্ড মুফতি আলী গোমা বলেন, ‘ইসলামের চার মাযহাবের ইমামগণ বলেছেন সোনা রূপার বিনিময়ে রিবা হয়। ব্যাংক কেবল টাকা লেনদেন করে।’ মিরিল গ্লাস গ্রান্ড মুফতি মোহম্মদ আবদুহ সূত্রে বলেছেন, ‘মডারেট ইন্টারেস্ট বৈধ।’

কোন কোন বোধ্যা প্রশ্ন করেন, দেড় হাজার বছর আগের অর্থনীতির ধারণা বর্তমান অর্থনীতিতে কি প্রয়োগযোগ্য? অন্যদিকে অনেকে এরূপ বলেন, যেখানে অস্পষ্টতা রয়েছে সেখানে না বোঝার জন্য কাউকে বিচারের সম্মুখীন করা কি যৌক্তিক? সময়ের সাথে সাথে ব্যবসায়ের ধরণ, বেচাকেনার পদ্ধতি, উপকরণ আমূল বদলে যায়। কিন্তু ব্যবসায়ের নৈতিকতা বদলে যায় না। ইসলাম নৈতিকতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। পবিত্র কুরআনে আছে ঐ সকল লোকদের জন্য দুর্ভোগ যারা মিসকিনকে খাদ্য দান করে না। বলা হয়েছে, মাপে কম দিও না। রিবাকে নিশ্চিহ্ন করার কথা রয়েছে। অন্যায়ভাবে সম্পদ গ্রাস করো না ইত্যাদি। অর্থাৎ যে কোন ব্যবসায়িক কিংবা অব্যবসায়িক কাজের বেলায় যতই বৈধ পদ্ধতি অবলম্বন করা হোক না কেন, অনৈতিক হলে তা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম হয়ে যাবে। যেমন ভেজাল করে বেচাকেনা, অতি মুনাফা, মজুতদারি, মাপে কম দেয়া এবং নেয়া ইত্যাদি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্দেশ্য, নৈতিকতা এবং কর্মকান্ডের দিক থেকে প্রচলিত এবং শরীয়াভিত্তিক ব্যাংকের মধ্যে তেমন উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নেই। উভয়ে জনকল্যাণে নিয়োজিত।

অধিকাংশ মুসলিম দেশ মডারেট ইন্টারেস্ট বৈধ বলেছে এবং চড়া সুদকে (ইউজুয়েরী) অবৈধ বলেছে। যদিও কিছু রিফর্মার্স সকল সুদকে অবৈধ বলেছেন। লেখক এম এ খান ভোগ্য-পণ্য ঋণ, চক্রবৃদ্ধি সুদ, গরীবকে প্রদত্ত ঋণসহ যে কোন ঋণের সুদকে রিবার সংজ্ঞায় ফেলেছেন। জনাব ওসমানি বলেন, ‘আধুনিক ইন্টারেস্ট কুরআন দ্বারা নিষিদ্ধ নয়। হারাম নয়, মাকরূহ বলা যায়। কুরআন অবতীর্ণের সময় রিবা ছিল, রিবা আল জাহিলিয়া নামে পরিচিত। ইন্টারন্যাশনাল পাবিলিকেশনস- এর মতে ক্লাসিক্যাল জুরিস্টরা সোনা ও রূপা কারেন্সির ওপর ভিত্তি করে ঋণের ইন্টারেস্ট অবৈধ বলেছেন। কাগজ বা নিম্ন ধাতুর ওপর বা টাকার ওপর ইন্টারেস্ট বৈধ বলেছেন।

থমাস আব্দুল কাদের বলেন, ‘পবিত্র কুরআনে পরিস্কারভাবে রিবা সংজ্ঞায়িত হয়নি। ফিকাহ এবং আইনবিজ্ঞদের সহায়তা এবং হাদিস থেকে কিছু জানা যায়।’

ফরহাদ নোমানি বলেন, ‘হাদিসে আছে মাংস, ফল ফলাদি এবং দাসের ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে ’বৃদ্ধির’ কথা বলা আছে।’

আবু বলেন, ‘মিশ্রিত খেজুর ১ ছা এর পরিবর্তে ২ ছা গ্রহণ করা রিবা। ১ দিরহামের বিনিময়ে ২ দিরহাম বিনিময় রিবা। রিবা হলো নৈতিক পাপ।’

আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিক্রি হলো ব্যাংক ইন্টারেস্ট রিবা নয়। শত শত বছর অর্থাৎ দীর্ঘ সময় ধরে ভিন্ন ভিন্ন মত চলছে। ইন্টারেস্ট অন্তর্নীহিতভাবে রিবা নয়। ইসলামিক ডেভেলেপমেন্ট ব্যাংক তার ফান্ডের অতিরিক্ত টাকা দেশের বাইরে ইন্টারেস্ট বিয়ারিং হিসাবে সংরক্ষণ করে।

এম গামেল বলেন, ‘ইসলামিক অর্থনীতিতে টাইম ভ্যালু অফ মানি ধারণাটি স্বীকৃত নয়। মওদুদি, আল সদর এবং তকি ওসমানির বরাতেগ্যামে বলেন, ‘শরীয়ায় টাইম ভ্যালু অব মানি ধারণাটি নেই।’

আবদুল্লাহ সাঈদ বলেন, ‘মুরাবাহা অর্থয়নে পরেপাক্ষভাবে টাইম ভ্যালু অব মানি ধারণা কার্যকর রয়েছে, যা ইন্টারেস্ট ধারণাকে অনুমোদন করে।’

পবিত্র কুরআন, হাদিস, ফতোয়া এবং ইসলামিক গবেষণায় যা উল্লেখ রয়েছে তাতে বুঝা যায়, আরবে সে সময় পণ্য প্রথা চালু ছিল। টাকার মতো সাধারণ বিনিময় মাধ্যম ছিল না। আরবীয় স্বর্ণ ও রৌপ্যে ছবি এবং খাদ থাকতো না। বিশুদ্ধ ছিল। পারসিকদের ছিল দিনার (স্বর্ণের) এবং দিরহাম (রূপার)। এগুলোতে খাদ থাকতো। আরবের স্বর্ণের (পিন্ড, টুকরা) বিপরীতে ওজনে দিরহাম ও দিনার খাদের কারণে বেশি নেয়া হতো। একই মজলিসে ক্রেতা বিক্রেতা হাতে হাতে স্বর্ণ দিয়ে স্বর্ণ ওজনে কম বা বেশি করে বেচাকেনা করতো।

স্বর্ণ, রৌপ্য কিংবা দ্রব্য কম ধার দিয়ে নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে একই জিনিস বেশি গ্রহণ করতো। অতিরিক্ত যে পরিমাণ গ্রহণ করা হতো তাকে রিবা বলা হতো। অর্থাৎ ১টি দিনার দিয়ে নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে ২টি দিনার নেয়া হলে বাড়তি দিনারসুদ হতো। জাহেলিয়াতের যুগে স্বর্ণ দিয়ে স্বর্ণ, রৌপ্য দিয়ে রৌপ্য, দ্রব্য দিয়ে দ্রব্য, স্বর্ণ দিয়ে দ্রব্য, রৌপ্য দিয়ে দ্রব্য, প্রাণী দিয়ে প্রাণী, স্বর্ণ বা রূপা দিয়ে প্রাণী, এভাবে এওজবদল বা বেচাকেনা হতো। ওজন ও বিশুদ্ধতার ভিত্তিতে বেচাকেনা করতো। অর্থাৎ কম সম্পদ ধার দিয়ে বেশি সম্পদ ফেরত নিত। বর্তমানে এরূপ বেচাকেনা হয় না।

পণ্য প্রথার দৃষ্টিকোণে দেড় হাজার বছরে দিনার দিরহামের মূল্যস্ফীতি হবে শূন্য। দিনার, দিরহাম কিংবা কোন দ্রব্য হলো সম্পদ। মিন্টে দিনার ও দিরাহাম যতই প্রিন্টিং করা হোক মূল্যস্ফীত হবে না। পেপার কারেন্সির মতো সরকারি ডিক্রি জারি করেও অবমূল্যায়ন করা যায় না। এটা সম্পদ। কারো অর্থ পরিশোধের অঙ্গীকারের ওপর স্বর্ণ ও রূপার ভ্যালু নির্ভর করে না। অটোম্যান সম্রাজ্যের সময় যাকাত স্বর্ণ ও রৌপ্য দিয়ে দেয়া হতো। খেলাফত পর্যন্ত এরূপ ছিল। শরীয়ায় টাকা বলতে স্বর্ণের দিনার এবং রৌপ্যের দিরহাম। কাগজের টাকা স্বীকৃত নয়।

বর্তমানে কাগজের টাকার মালিক ও পৃষ্ঠ্যপোষক হলো সরকার। ১৯৩৩ সালের দিকে স্বর্ণমান পদ্ধতি বাদ হয়ে গেছে। এখন টাকা ফিয়াট কারেন্সি। টাকা সম্পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসের ওপরে চলে। বর্তমানে সমাজে পণ্য প্রথাও নেই। সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন টাকার ক্রয় ক্ষমতা হলো মানদন্ড। স্বর্ণ রৌপ্যের মতো টাকার নিজস্ব ওজন এবং মূল্য নেই। স্রেফ কাগজ। স্বর্ণ, রৌপ্য, দ্রব্য এখন মূল্যায়িত হয় টাকা দিয়ে। সময়ের সাথে টাকার ক্রয়মূল্য বা ক্রয়ক্ষমতা পরিবর্তিত হয়ে যায়। আজকের ১ টাকা আগামীকালের ১ টাকার সমান নয়। অর্থাৎ আজকে ১ টাকা দিয়ে যা কেনা যাবে তা দিয়ে আগামীকাল একই জিনিস কেনা যাবে না। বেশি টাকা লাগবে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যদি ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি থাকে তাহলে ১০০ টাকায় আজকে যদি একটা চশমা কেনা যায়, তবে ১ বছর পরে একই চশমা কিনতে ১০৫ টাকা লাগবে। এর অর্থ হচ্ছে, আজকের ১০০ টাকা ১ বছর পরে ১০৫ টাকার সমান ক্রয়ক্ষমতা রাখে। ৫ টাকা মূল্যস্ফীতির কারণে বাড়বে।

অন্যভাবে বলি, আজকে ব্যাংক থেকে ১০০ টাকা ধার নিয়ে ১ বছর পরে ১০০ টাকা ফেরত দিলে ব্যাংক ও আমানতকারী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ১০০ টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমে ৯৫ টাকার সমান হবে। একই জিনিস কেনা যাবে না। আর যদি ১০ বছর পরে ঐ ১০০ টাকা ফেরত দেয়, তবে টাকার ক্রয়ক্ষমতা শূণ্য হয়ে যাবে।

আরো পরিস্কার করে বলি, ব্যাংকের ৯ শতাংশ ইন্টারেস্ট মানে এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক পরিচালনার খরচ ২ শতাংশ এবং ব্যবসায়ে টিকে থাকার জন্য মুনাফা ১ শতাংশ, মোট ৯ শতাংশ। বিভিন্ন মূল্যমানের টাকা ও পয়সা রয়েছে, যা কারেন্সি নামে পরিচিত। সকল কিছু টাকার বিপরীতে বেচাকেনা হয় বিধায় সময়ের ব্যবধানে কাগজি টাকার ক্রয় ক্ষমতা সমন্বয় করতে হয়।

অর্থাশাস্ত্র মতে, টাইম ভ্যালু অফ মানির বিচারে ইন্টারেস্ট হলো টাকার ভ্যালু মূল্যায়নের হাতিয়ার। ইন্টারেস্ট হার প্রয়োগ করে সমান সমান করতে হয়। আজকের এক টাকা আগামী এক বছর পরে কত টাকার সমান তা নির্ণয় করা হয় ইন্টারেস্ট রেট প্রয়োগ করে। অথবা নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পাওয়ার জন্য এখন কত টাকা রাখা দরকার তা টাইম ভ্যালু অফ মানির ধারণা অনুযায়ী ইন্টারেস্টে হার প্রয়োগ করে বের করা যায়। টাকার সময় সমন্বিত ভ্যালু বের করা না হলে টাকার ক্রয়ক্ষমতা ঠিক রাখা যাবে না। অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স গুরুরা ইন্টারেস্ট শব্দের নানারকম প্রতিশব্দ ব্যবহার করেন। যেমন- ইন্টারনাল রেট অফ রিটার্ন, ডিসকাউন্টিং ফেক্টর, নেট প্রেজেন্ট ভ্যালু রেট, অপরচিউনিটি কষ্ট ইত্যাদি। ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ইন্টারেস্টকে সার্ভিস চার্জ বলে। অন্যান্য শরীয়া ব্যাংক বলে মুনাফা। এ সবকিছুর হিসাবের মূূলে কিন্তু প্রতোক্ষ বা পরোক্ষভাবে টাইম ভ্যালু অফ মানির ধারণা কার্যকার রয়েছে। তা না হলে টাকার ক্রয়ক্ষমতা ঠিক থাকতো না।

আমানতের ইন্টারেস্ট হার মূল্যস্ফীতির হার থেকে কম হলে আমানতকারির আর্থিক ক্ষতি হবে।

সকল প্রধান ধর্মই সুদের বিরুদ্ধে। কেবল ইহুদিরা সুদের ব্যবসায় করতো তা নয়, আরবরাও করতো। সমাজ থেকে সুদের ব্যবসার মূলোৎপাটনের জন্যই আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থার উদ্ভব। রাষ্ট্র সুদের ব্যবসায় করে না। অন্যদিকে ব্যাংকের অমানতকারীরা সুদখোর নয়। জুলুম করে ইন্টারেস্ট আদায় করে না। এটা ব্যাংকের জন্য কষ্ট অব ক্যাপিটাল। বাজার থেকে ব্যাংক ব্যবসার জন্য সংগৃহীত ক্যাপিটালের খরচ। আমানতকারীর নিকট অপরচিউনিটি কষ্টও বটে। অন্য উৎসেও গ্রাহক তার সঞ্চিত অর্থ বিনিয়োগ করতে পারেন। তুলনামূলক সুবিধা বিবেচনা করে একজন গ্রাহক তার অর্থ বা ক্যাপিটাল বিনিয়োগ করেন। ব্যাংকের ইন্টারেস্ট যদি হারাম হয় তাহলে আপামর গণমানুষের কল্যাণে পরিচালিত ব্যাংক ব্যবসাও হারাম হয়ে যাবে। উদ্দেশ্য, নৈতিকতা এবং কর্মকান্ডের দিক থেকে প্রচলিত এবং শরীয়াভিত্তিক ব্যাংকের মধ্যে তেমন উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নেই। ব্যাংক গ্রাহকের সম্পর্ক এখন ঋণের ওপরে নয়, এখন অর্থায়ন এবং বিনিয়োগের ওপর নির্ভরশীল।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে। দেশের মুদ্রাস্ফীতিসহ টাকার যোগান ও চাহিদা নিরূপন করে। সে মোতাবেক ব্যাংক ইন্টারেস্ট (সর্বোচ্চ ও নূন্যতম হার) কত হওয়া উচিত সে ব্যাপারে গাইডলাইনস প্রদান করে। সকল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে তা মেনে চলতে হয়। ব্যাংকগুলো আইনের মাধ্যমে সৃষ্ট। ব্যাংক ইচ্ছে মতো ইন্টারেস্ট চার্জ করতে পারে না। চড়া ইন্টারেস্ট চার্জ করা হলে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়। ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগের দিক (সম্পদ সাইড) মার্কাআপ ভিত্তিক যা প্রচলিত ব্যাংকের ইন্টারেস্ট ভিত্তিক বিনিয়োগের মতো। অনেক ক্ষেত্রে বিনিয়োগের সময় প্রচলিত ব্যাংকের ইন্টারেস্ট হার, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি, মুদ্রা বাজার দেখে মুনাফার হার সমন্বয় করা হয়। ইন্টারেস্ট রেট হিসাবের সময় অনেক বৈধ উপাদান বিবেচনায় নেয়া হয়। যেমন মূল্যস্ফীতি, ব্যাংকের বেতনসহ অন্যান্য বৈধ খরচ, সরকারি কর-ভ্যাট, ঝুঁকি ব্যয়, সঞ্চিতি, ব্যাংকের নিজস্ব মুনাফা ইত্যাদি। এসব অন্তর্ভুক্ত করে যে হার নির্ণয় করা হয় তাকে সুদ নামকরণ করা অদৌ যৌক্তিক কিনা ভেবে দেখা দরকার।

পবিত্র কুরআনে পূর্ব নির্ধারিত আয়কে হারাম বলা হয়নি। সঞ্চয়পত্রের আয় পূর্ব নির্ধারিত। সরকার টাকা প্রচলন করে এবং টাকার মালিক। সরকার চাইলে যে কোন সময় টাকা বাতিল করতে পারেন, টাকশালে ছাপিয়ে নতুন টাকা প্রচলন করতে পারে। সরকার সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে টাকা ঋণ হিসেবে নিয়ে দেশে উন্নয়ণ এবং কল্যাণমূলক কাজ করে, যার সুবিধা আবার জনগণই ভোগ করে।

সরকার শক্তিশালী। অন্যদিকে যারা টাকা ধার দেন তারা দুর্বল। সরকার দুর্বলের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদের চলার জন্য নির্দিষ্ট হারে মুনাফা প্রদান করে সহায়তা করে। মুনাফার মাধমে সময়ের পরিক্রমায় বিনিয়োগকৃত টাকার অবমূল্যায়ন সমন্বয় হয়ে যায়। মুনাফার হার মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কখনই কম হয় না। মেয়াদ শেষে যথা সময়ে মূলধন ফেরত দিয়ে দেয়। সরকারের এ ধরণের জণকল্যাণমূলক কাজকে সুদের অনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে মিল করে হারাম বলে দেয়া সঠিক হচ্ছে কিনা, সেটা এক বড়ো প্রশ্ন।

সুদ বলে আমানতকারীকে ব্যাংক যা প্রদান করে থাকে তা অনেকের কাছে বিব্রতকর। ইন্টারেস্টকে সুদ না বলে আয়, মুনাফা, সার্ভিস চার্জ অথবা অন্য ভালো কিছু নামে বললে মনে হয় ভালো হয়। কেউ কেউ বলেন, ইন্টারেস্ট এর বাঙলা কেনো প্রয়োজন? ইন্টারেস্ট বললে ক্ষতি কি? সাধারণ মানুষ ইন্টারেস্ট বললে বুঝতে পারে। যা মানুষ বুঝতে পারে, সেটাই গ্রহণীয়। আবার কেউ কেউ বলেন, ইন্টারেস্ট বললে অনেক মানুষ সুদ মনে করে। অনেকটা মজ্জাগত হয়ে গেছে। তাই আয় বা মুনাফা বললে বিতর্ক হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে সুদ আখ্যা না দেয়াই শ্রেয়।

উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে ব্যাংক ইন্টারেস্ট শব্দের প্রতিশব্দ সুদ কিনা, সে বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করে সরকারি পর্যায়ে এখনি একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া আবশ্যক। যদি সুদ না হয়ে থাকে, তা হলে সরকারের উচিত হবে ধর্মীয় নৈতিকতাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে সকল গোমরাহী ও ভ্রান্তি অবসানের লক্ষ্যে যত দ্রুত সম্ভব ব্যাংকসহ সকল রাষ্ট্রীয় কাজের সকল স্তরে ইন্টারেস্ট শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে সুদ শব্দটির ব্যবহার রহিত করা। এর পরিবর্তে আয়, সার্ভিস চার্জ, মুনাফা অথবা অন্য ভালো কোন নাম দেয়া যেতে পারে। এদেশের অধীকাংশ মানুষ ধর্মভীরু এবং জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক মুসলমান। তাদের ধর্মীয় অনুভূতি ও আবেগের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই কাজটি করা আবশ্যক।

[লেখক: ডিজিএম, বিডিবিএল]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

ব্যাংক ইন্টারেস্ট কি সুদ, আরবিতে যা রিবা?

এম লতিফ ভূঁঞা

বৃহস্পতিবার, ০৭ অক্টোবর ২০২১

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুদ (রিবা) হারাম করেছেন। এ নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই। কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যেয়ে এ লেখার প্রয়াস। প্রশ্ন হলো, ব্যাংক ইন্টারেস্ট সুদ (রিবা) কিনা, যা দেড় হাজার বছর আগে পবিত্র কুরআনের আয়াত দ্বারা নিষিদ্ধ হয়েছে।

পবিত্র কুরআন, হাদিস এবং শরীয়ায় আধুনিক ব্যাংক, ইন্টারেস্ট এবং টাকা সম্পর্কে কিছু উল্লেখ নেই। বর্তমানে ব্যাংক এবং ব্যাংক ইন্টারেস্ট সম্পর্কে যা বলা হয়ে থাকে, তা সবই কিয়াস, অর্থাৎ মিল করে বলা, যা ইংরেজিতে এনালোজি বলে। পবিত্র কুরআন পূর্ব নির্ধারিত কোন আয় এবং ঝুঁকিমুক্ত কোন আয়কে হারাম বলেনি। অর্থাৎ রিস্ক-ফ্রি ও ফিক্সড হলেই সুদ হবে সে রকম কিছু পবিত্র কুরাআনে নেই। এরকম থাকলে বেতন, বাড়িভাড়া, কমিশন, ভ্যাট, ট্যাক্স ইত্যাদি - যা কিছু পূর্ব নির্ধারিত হয়- অবৈধ বা হারাম হয়ে যাওয়ার কথা।

ইংরেজি টু বাংলা ডিকশেনারিতে ইন্টারেস্ট শব্দের অনেকগুলো বাংলা প্রতিশব্দ দেয়া আছে। যেমন, ইচ্ছা, লাভ, ফায়দা, মুনাফা, রেট অব ডিসকাউন্ট, সার্ভিস চার্জ, সুদ, কুশিদ ইত্যাদি। সুদের (রিবার) ইংরেজি প্রতিশব্দ কিন্তু ইউজুয়েরী। চড়া সুদকেও ইউজুয়েরী বলে। বিভিন্ন দেশে আইন করে ইউজুয়েরী নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পৃথিবীর সকল প্রধান ধর্মে সুদ এবং সুদের ব্যবসায় নিষিদ্ধ।

পবিত্র আল কুরআনে রিবা সম্পর্কে বেশ কয়েকটি আয়াত রয়েছে। রিবার সংজ্ঞা বুঝার জন্য ঐ সকল আয়াতের যে অংশটুকু প্রাসংগিক তা ধারাবাহিকভাবে নীচে উল্লেখ করা হলো-

প্রথম ওহি (সূরা রুম, আয়াত ৩৯) ‘... যা কিছু তোমরা সুদে দিয়ে থাক, আল্লাহর কাছে বর্ধিত হয় না..” এ আয়াতে সুদ থেকে মানুষের যে কোন কল্যাণ নেই তা বুঝানো হয়েছে। দ্বিতীয় ওহি (সূরা নিসা-আয়াত ১৬১) “ অর্থাৎ আর তাদের সুদ গ্রহণের কারণে, অথচ তা তাদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবং তাদের অন্যায়ভাবে মানুষের ধন সম্পদ গ্রাস করার কারণে..” আল্লাহ কেন সুদ নিষিদ্ধ করেছেন তার কারণ নিজেই উল্লেখ করেছেন। অন্যায়ভাবে মানুষের ধন সম্পদ গ্রাস করার কারণেই আল্লাহসুদকে হারাম করেছেন। তৃতীয় ওহি (সূরা আলে ইমরান-আয়াত ১৩০-১৩২) “..তোমরা সুদ খেয়ো না চক্রবৃদ্ধি হারে..” এই আয়াতে সুদ দ্বিগুণ-চারগুণ না করার জন্য সতর্ক করেছেন। সুদ নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ এখানেও উল্লেখ করেছেন।

চতুর্থ ওহি (সূরা আল বাকারা-আয়াত ২৭৫-২৮১) “ .. তারা বলে, বেচাকেনা তো সুদেরই মত। অথচ আল্লাহ বেচাকেনাকে বৈধ করেছেন এবং সুদকে অবৈধ করেছেন।..”

সে সময়ে পণ্যের বেচাকেনা ও রিবা কিছুটা একই পদ্ধতিতে সম্পাদিত হতো বলে হাদিস সূত্রে জানা যায়। পণ্য বিনিময় প্রথার ন্যায় লেনদেন হতো। তাই সে সময় কেউ কেউ রিবা এবং বেচাকেনাকে এক রকম মনে করতো। পার্থক্য করতে পারেনি।

আয়াত ২৭৬ “.. আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দান খয়রাতকে বর্ধিত করেন”

আয়াত ২৭৮ “..সুদের যা কিছু বকেয়া রয়েছে তা পরিত্যাগ করো..” আল্লাহ এই আয়াত দ্বারা বকেয়া সুদের (রিবা) দাবি পরিত্যাগের নির্দেশ দিচ্ছেন।

আয়াত ২৭৯ “..যদি তোমরা তওবা করো, তবে তোমাদের জন্য তোমাদের মূলধন রয়ে যাবে। তোমরা কাউকে অত্যাচার করবে না...” এই অংশে রিবা পরিত্যাগ এবং কেবল মূলধন ফেরত নেয়ার কথা বলা হয়েছে। অত্যাচার করতে নিষেধ করা হয়েছে। রিবা ব্যবসায় খাতকের ওপর অন্যায় অত্যাচার হতো বলেই আল্লাহ সুদনিষেধ করেছেন বুঝা যায়। রিবা নিষিদ্ধ হওয়ার প্রধান কারণ কি তাও বুঝা যায়। মূলধন রয়ে যাওয়ার কথায় বুঝা যায় দ্রব্য বিনিময় প্রথায় সময় অতিবাহিত হলেও দ্রব্যের মূল্যের পরিবর্তন হতো না। দ্রব্যের ওজন, পরিমাণ ও মান একই থাকতো। টাকার মতো অবমূল্যায়ন হতো না। তাই মূলধন ফেরত নেয়া হলে ক্ষতি ছিল না।

আয়াত ২৮০ “খাতক যদি অভাবগ্রস্ত হয় তবে তার সচ্ছলতা আসা পর্যন্ত তাকে অবকাশ দেয়া উচিত। আর যদি তোমরা ক্ষমা করে দাও, তা হবে তোমাদের জন্য উত্তম কাজ..” এই আয়াতের অংশে খেলাপি খাতককে স্বচ্ছলতা আসা পর্যন্ত সময় দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে। মানবিক হওয়ার তাগিদ আছে।

রিবা (সুদ) সম্পর্কে সহি হাদিসে যা পাওয়া যায় তা মোটামোটি একই ধরণের। বুঝার জন্য কয়েকটি সহি হাদিস নীচে বিবৃত হল-

হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা) বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন, “স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ, রূপার বিনিময়ে রূপা, গমের বিনিময়ে গম, যবের বিনিময়ে যব, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর, লবণের বিনিময়ে লবণ, আদান প্রদান করা হলে পরিমাণ সমান সমান এবং হাতে হাতে আদান প্রদান করতে হবে। যে ব্যক্তি বেশি দেবে বা গ্রহণ করবে সে সুদি লেনদেনকারি সাব্যস্ত হবে। এক্ষত্রে সুদ গ্রহীতা ও দাতা উভয়ে সমান অপরাধী সাব্যস্ত হবে। (বুখারি ও মুসলিম)।

“স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ, পরিমাণে সমতা ব্যতিরেকে বিক্রি করো না, একদিকে অপরদিক অপেক্ষা বেশি করো না।....আর উপস্থিতির বিনিময়ে অনুপস্থিতিকে বিক্রয় করো না।” (বুখারি মুসলিম)

“ উপরন্তু তিনি বলেছেন, রূপার সাথে স্বর্ণের এবং স্বর্ণের সাথে রূপার যেভাবে ইচ্ছা (অর্থাৎ কমবেশি করে) ক্রয় বিক্রয় করতে পার।” (বুখারি ও মুসলিম)

হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা) বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন, “একদা হজরত বেলাল (সা) রাসূল (সা) এর নিকট বর্ণি প্রজাতির খেজুর নিয়ে এলে নবী (সা) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, এ প্রকার খেজুর কোথা হতে পেলে? তিনি বললেন, আমার নিকট খারাপ খেজুর ছিল, আমি উহার দুই ছা খেজুর এক ছা এর বিনিময়ে বিক্রি করেছি। তা শুনে নবী (সা) বললেন, ‘এতো সুদি লেনদেন হয়েছে। এরূপ করো না, বরং তুমি তা করতে হলে খারাপ খেজুর মুদ্রার বিনিময়ে বিক্রি করে এবং সেই মুদ্রায় উত্তম খেজুর ক্রয় করো। (বুখারিও মুসলিম)”

পবিত্র কুরআনের আয়াত এবং সহি হদিসের আলোকে সুদ বিষয়ে বিভিন্ন ফতোয়া রয়েছে। বলা হয়েছে, কোন জিনিস বিক্রি করতে হলে দোষ নির্দোষ দেখিয়ে বিক্রি করতে হবে। ফাঁকি বা ছাপিয়ে বিক্রি করা হারাম। স্বর্ণ দ্বারা স্বর্ণ বা স্বর্ণের জেওর কিনতে হলে ওজনে সমান সমান কিনতে হবে। খরিদ্দার ও বিক্রেতা এক মজলিসে বেচাকেনা সম্পন্ন করতে হবে, নচেৎ সুদে পরিণত হবে।(আলমগীরী)

স্বর্ণ দ্বারা রৌপ্য এবং রৌপ্য দ্বারা স্বর্ণ যত ইচ্ছা বেশকম কিনলে রিবা হবে না। অর্থাৎ যে জিনিস সে জিনিস দ্বারা বেশকম কিনলেই রিবা হবে, নচেৎ নয়। (আলমগীরী)

যদি এক জাতীয় দ্রব্য না হয়ে এক ওজনের হয়, তবে যত ইচ্ছা বেশকম নিতে পারবে। যথা- এক মণ আলুর পরিবর্তে ১০ মণ ধানও নেয়া যাবে। কিন্তু শর্ত হলো এক মজলিসে আদান প্রদান করতে হবে। নচেৎ সুদি হবে। (দোররুল মোখতার)

এবার জানা যাক ইসলামিক অর্থনীতির গবেষকগণ এবং ধর্মীয় জ্ঞান বুৎপত্তিসম্পন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা কি বলেন। ইসলামিক অর্থনীতির বোধ্যারাও রিবা’র সংজ্ঞা নির্ণয়ে এবং ব্যাংক ইন্টারেস্টের সাথে সামঞ্জস্য খুঁজতে গিয়ে পক্ষে বিপক্ষে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। কেউ ইন্টারেস্টকে রিবা (সুদ) আবার কেউ ইন্টারেস্টকে রিবা নয় বলে মত দিয়েছে। ১৯০০ থেকে ২০০২ পযর্šÍ ১০৩ বছরে মিসরের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রান্ড মুফতিরা বারবার মত পাল্টিয়েছে। ব্যাংক ইন্টারেস্টকে একবার বলেছে হালাল, আরেকবার বলেছে হারাম, আবার হালাল, আবার হারাম, আবার হালাল, এভাবে বারবার রায় বদল করেছেন।

আবদুল্লাহ ইউসুফ আলী পবিত্র কুরআন অনুবাদের সময় রিবাকে ইউজুযেরী (সুদ) বলেছেন, ইন্টারেস্ট বলেননি। জনাব আবদুল আলা মওদুদি তার ’দি মিনিং অব দি কুরআন’ -এ রিবাকে ইন্টারেস্ট বলেছেন। গ্রান্ড মুফতি আলী গোমা বলেন, ‘ইসলামের চার মাযহাবের ইমামগণ বলেছেন সোনা রূপার বিনিময়ে রিবা হয়। ব্যাংক কেবল টাকা লেনদেন করে।’ মিরিল গ্লাস গ্রান্ড মুফতি মোহম্মদ আবদুহ সূত্রে বলেছেন, ‘মডারেট ইন্টারেস্ট বৈধ।’

কোন কোন বোধ্যা প্রশ্ন করেন, দেড় হাজার বছর আগের অর্থনীতির ধারণা বর্তমান অর্থনীতিতে কি প্রয়োগযোগ্য? অন্যদিকে অনেকে এরূপ বলেন, যেখানে অস্পষ্টতা রয়েছে সেখানে না বোঝার জন্য কাউকে বিচারের সম্মুখীন করা কি যৌক্তিক? সময়ের সাথে সাথে ব্যবসায়ের ধরণ, বেচাকেনার পদ্ধতি, উপকরণ আমূল বদলে যায়। কিন্তু ব্যবসায়ের নৈতিকতা বদলে যায় না। ইসলাম নৈতিকতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। পবিত্র কুরআনে আছে ঐ সকল লোকদের জন্য দুর্ভোগ যারা মিসকিনকে খাদ্য দান করে না। বলা হয়েছে, মাপে কম দিও না। রিবাকে নিশ্চিহ্ন করার কথা রয়েছে। অন্যায়ভাবে সম্পদ গ্রাস করো না ইত্যাদি। অর্থাৎ যে কোন ব্যবসায়িক কিংবা অব্যবসায়িক কাজের বেলায় যতই বৈধ পদ্ধতি অবলম্বন করা হোক না কেন, অনৈতিক হলে তা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম হয়ে যাবে। যেমন ভেজাল করে বেচাকেনা, অতি মুনাফা, মজুতদারি, মাপে কম দেয়া এবং নেয়া ইত্যাদি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্দেশ্য, নৈতিকতা এবং কর্মকান্ডের দিক থেকে প্রচলিত এবং শরীয়াভিত্তিক ব্যাংকের মধ্যে তেমন উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নেই। উভয়ে জনকল্যাণে নিয়োজিত।

অধিকাংশ মুসলিম দেশ মডারেট ইন্টারেস্ট বৈধ বলেছে এবং চড়া সুদকে (ইউজুয়েরী) অবৈধ বলেছে। যদিও কিছু রিফর্মার্স সকল সুদকে অবৈধ বলেছেন। লেখক এম এ খান ভোগ্য-পণ্য ঋণ, চক্রবৃদ্ধি সুদ, গরীবকে প্রদত্ত ঋণসহ যে কোন ঋণের সুদকে রিবার সংজ্ঞায় ফেলেছেন। জনাব ওসমানি বলেন, ‘আধুনিক ইন্টারেস্ট কুরআন দ্বারা নিষিদ্ধ নয়। হারাম নয়, মাকরূহ বলা যায়। কুরআন অবতীর্ণের সময় রিবা ছিল, রিবা আল জাহিলিয়া নামে পরিচিত। ইন্টারন্যাশনাল পাবিলিকেশনস- এর মতে ক্লাসিক্যাল জুরিস্টরা সোনা ও রূপা কারেন্সির ওপর ভিত্তি করে ঋণের ইন্টারেস্ট অবৈধ বলেছেন। কাগজ বা নিম্ন ধাতুর ওপর বা টাকার ওপর ইন্টারেস্ট বৈধ বলেছেন।

থমাস আব্দুল কাদের বলেন, ‘পবিত্র কুরআনে পরিস্কারভাবে রিবা সংজ্ঞায়িত হয়নি। ফিকাহ এবং আইনবিজ্ঞদের সহায়তা এবং হাদিস থেকে কিছু জানা যায়।’

ফরহাদ নোমানি বলেন, ‘হাদিসে আছে মাংস, ফল ফলাদি এবং দাসের ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে ’বৃদ্ধির’ কথা বলা আছে।’

আবু বলেন, ‘মিশ্রিত খেজুর ১ ছা এর পরিবর্তে ২ ছা গ্রহণ করা রিবা। ১ দিরহামের বিনিময়ে ২ দিরহাম বিনিময় রিবা। রিবা হলো নৈতিক পাপ।’

আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিক্রি হলো ব্যাংক ইন্টারেস্ট রিবা নয়। শত শত বছর অর্থাৎ দীর্ঘ সময় ধরে ভিন্ন ভিন্ন মত চলছে। ইন্টারেস্ট অন্তর্নীহিতভাবে রিবা নয়। ইসলামিক ডেভেলেপমেন্ট ব্যাংক তার ফান্ডের অতিরিক্ত টাকা দেশের বাইরে ইন্টারেস্ট বিয়ারিং হিসাবে সংরক্ষণ করে।

এম গামেল বলেন, ‘ইসলামিক অর্থনীতিতে টাইম ভ্যালু অফ মানি ধারণাটি স্বীকৃত নয়। মওদুদি, আল সদর এবং তকি ওসমানির বরাতেগ্যামে বলেন, ‘শরীয়ায় টাইম ভ্যালু অব মানি ধারণাটি নেই।’

আবদুল্লাহ সাঈদ বলেন, ‘মুরাবাহা অর্থয়নে পরেপাক্ষভাবে টাইম ভ্যালু অব মানি ধারণা কার্যকর রয়েছে, যা ইন্টারেস্ট ধারণাকে অনুমোদন করে।’

পবিত্র কুরআন, হাদিস, ফতোয়া এবং ইসলামিক গবেষণায় যা উল্লেখ রয়েছে তাতে বুঝা যায়, আরবে সে সময় পণ্য প্রথা চালু ছিল। টাকার মতো সাধারণ বিনিময় মাধ্যম ছিল না। আরবীয় স্বর্ণ ও রৌপ্যে ছবি এবং খাদ থাকতো না। বিশুদ্ধ ছিল। পারসিকদের ছিল দিনার (স্বর্ণের) এবং দিরহাম (রূপার)। এগুলোতে খাদ থাকতো। আরবের স্বর্ণের (পিন্ড, টুকরা) বিপরীতে ওজনে দিরহাম ও দিনার খাদের কারণে বেশি নেয়া হতো। একই মজলিসে ক্রেতা বিক্রেতা হাতে হাতে স্বর্ণ দিয়ে স্বর্ণ ওজনে কম বা বেশি করে বেচাকেনা করতো।

স্বর্ণ, রৌপ্য কিংবা দ্রব্য কম ধার দিয়ে নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে একই জিনিস বেশি গ্রহণ করতো। অতিরিক্ত যে পরিমাণ গ্রহণ করা হতো তাকে রিবা বলা হতো। অর্থাৎ ১টি দিনার দিয়ে নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে ২টি দিনার নেয়া হলে বাড়তি দিনারসুদ হতো। জাহেলিয়াতের যুগে স্বর্ণ দিয়ে স্বর্ণ, রৌপ্য দিয়ে রৌপ্য, দ্রব্য দিয়ে দ্রব্য, স্বর্ণ দিয়ে দ্রব্য, রৌপ্য দিয়ে দ্রব্য, প্রাণী দিয়ে প্রাণী, স্বর্ণ বা রূপা দিয়ে প্রাণী, এভাবে এওজবদল বা বেচাকেনা হতো। ওজন ও বিশুদ্ধতার ভিত্তিতে বেচাকেনা করতো। অর্থাৎ কম সম্পদ ধার দিয়ে বেশি সম্পদ ফেরত নিত। বর্তমানে এরূপ বেচাকেনা হয় না।

পণ্য প্রথার দৃষ্টিকোণে দেড় হাজার বছরে দিনার দিরহামের মূল্যস্ফীতি হবে শূন্য। দিনার, দিরহাম কিংবা কোন দ্রব্য হলো সম্পদ। মিন্টে দিনার ও দিরাহাম যতই প্রিন্টিং করা হোক মূল্যস্ফীত হবে না। পেপার কারেন্সির মতো সরকারি ডিক্রি জারি করেও অবমূল্যায়ন করা যায় না। এটা সম্পদ। কারো অর্থ পরিশোধের অঙ্গীকারের ওপর স্বর্ণ ও রূপার ভ্যালু নির্ভর করে না। অটোম্যান সম্রাজ্যের সময় যাকাত স্বর্ণ ও রৌপ্য দিয়ে দেয়া হতো। খেলাফত পর্যন্ত এরূপ ছিল। শরীয়ায় টাকা বলতে স্বর্ণের দিনার এবং রৌপ্যের দিরহাম। কাগজের টাকা স্বীকৃত নয়।

বর্তমানে কাগজের টাকার মালিক ও পৃষ্ঠ্যপোষক হলো সরকার। ১৯৩৩ সালের দিকে স্বর্ণমান পদ্ধতি বাদ হয়ে গেছে। এখন টাকা ফিয়াট কারেন্সি। টাকা সম্পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসের ওপরে চলে। বর্তমানে সমাজে পণ্য প্রথাও নেই। সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন টাকার ক্রয় ক্ষমতা হলো মানদন্ড। স্বর্ণ রৌপ্যের মতো টাকার নিজস্ব ওজন এবং মূল্য নেই। স্রেফ কাগজ। স্বর্ণ, রৌপ্য, দ্রব্য এখন মূল্যায়িত হয় টাকা দিয়ে। সময়ের সাথে টাকার ক্রয়মূল্য বা ক্রয়ক্ষমতা পরিবর্তিত হয়ে যায়। আজকের ১ টাকা আগামীকালের ১ টাকার সমান নয়। অর্থাৎ আজকে ১ টাকা দিয়ে যা কেনা যাবে তা দিয়ে আগামীকাল একই জিনিস কেনা যাবে না। বেশি টাকা লাগবে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যদি ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি থাকে তাহলে ১০০ টাকায় আজকে যদি একটা চশমা কেনা যায়, তবে ১ বছর পরে একই চশমা কিনতে ১০৫ টাকা লাগবে। এর অর্থ হচ্ছে, আজকের ১০০ টাকা ১ বছর পরে ১০৫ টাকার সমান ক্রয়ক্ষমতা রাখে। ৫ টাকা মূল্যস্ফীতির কারণে বাড়বে।

অন্যভাবে বলি, আজকে ব্যাংক থেকে ১০০ টাকা ধার নিয়ে ১ বছর পরে ১০০ টাকা ফেরত দিলে ব্যাংক ও আমানতকারী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ১০০ টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমে ৯৫ টাকার সমান হবে। একই জিনিস কেনা যাবে না। আর যদি ১০ বছর পরে ঐ ১০০ টাকা ফেরত দেয়, তবে টাকার ক্রয়ক্ষমতা শূণ্য হয়ে যাবে।

আরো পরিস্কার করে বলি, ব্যাংকের ৯ শতাংশ ইন্টারেস্ট মানে এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক পরিচালনার খরচ ২ শতাংশ এবং ব্যবসায়ে টিকে থাকার জন্য মুনাফা ১ শতাংশ, মোট ৯ শতাংশ। বিভিন্ন মূল্যমানের টাকা ও পয়সা রয়েছে, যা কারেন্সি নামে পরিচিত। সকল কিছু টাকার বিপরীতে বেচাকেনা হয় বিধায় সময়ের ব্যবধানে কাগজি টাকার ক্রয় ক্ষমতা সমন্বয় করতে হয়।

অর্থাশাস্ত্র মতে, টাইম ভ্যালু অফ মানির বিচারে ইন্টারেস্ট হলো টাকার ভ্যালু মূল্যায়নের হাতিয়ার। ইন্টারেস্ট হার প্রয়োগ করে সমান সমান করতে হয়। আজকের এক টাকা আগামী এক বছর পরে কত টাকার সমান তা নির্ণয় করা হয় ইন্টারেস্ট রেট প্রয়োগ করে। অথবা নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পাওয়ার জন্য এখন কত টাকা রাখা দরকার তা টাইম ভ্যালু অফ মানির ধারণা অনুযায়ী ইন্টারেস্টে হার প্রয়োগ করে বের করা যায়। টাকার সময় সমন্বিত ভ্যালু বের করা না হলে টাকার ক্রয়ক্ষমতা ঠিক রাখা যাবে না। অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স গুরুরা ইন্টারেস্ট শব্দের নানারকম প্রতিশব্দ ব্যবহার করেন। যেমন- ইন্টারনাল রেট অফ রিটার্ন, ডিসকাউন্টিং ফেক্টর, নেট প্রেজেন্ট ভ্যালু রেট, অপরচিউনিটি কষ্ট ইত্যাদি। ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ইন্টারেস্টকে সার্ভিস চার্জ বলে। অন্যান্য শরীয়া ব্যাংক বলে মুনাফা। এ সবকিছুর হিসাবের মূূলে কিন্তু প্রতোক্ষ বা পরোক্ষভাবে টাইম ভ্যালু অফ মানির ধারণা কার্যকার রয়েছে। তা না হলে টাকার ক্রয়ক্ষমতা ঠিক থাকতো না।

আমানতের ইন্টারেস্ট হার মূল্যস্ফীতির হার থেকে কম হলে আমানতকারির আর্থিক ক্ষতি হবে।

সকল প্রধান ধর্মই সুদের বিরুদ্ধে। কেবল ইহুদিরা সুদের ব্যবসায় করতো তা নয়, আরবরাও করতো। সমাজ থেকে সুদের ব্যবসার মূলোৎপাটনের জন্যই আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থার উদ্ভব। রাষ্ট্র সুদের ব্যবসায় করে না। অন্যদিকে ব্যাংকের অমানতকারীরা সুদখোর নয়। জুলুম করে ইন্টারেস্ট আদায় করে না। এটা ব্যাংকের জন্য কষ্ট অব ক্যাপিটাল। বাজার থেকে ব্যাংক ব্যবসার জন্য সংগৃহীত ক্যাপিটালের খরচ। আমানতকারীর নিকট অপরচিউনিটি কষ্টও বটে। অন্য উৎসেও গ্রাহক তার সঞ্চিত অর্থ বিনিয়োগ করতে পারেন। তুলনামূলক সুবিধা বিবেচনা করে একজন গ্রাহক তার অর্থ বা ক্যাপিটাল বিনিয়োগ করেন। ব্যাংকের ইন্টারেস্ট যদি হারাম হয় তাহলে আপামর গণমানুষের কল্যাণে পরিচালিত ব্যাংক ব্যবসাও হারাম হয়ে যাবে। উদ্দেশ্য, নৈতিকতা এবং কর্মকান্ডের দিক থেকে প্রচলিত এবং শরীয়াভিত্তিক ব্যাংকের মধ্যে তেমন উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নেই। ব্যাংক গ্রাহকের সম্পর্ক এখন ঋণের ওপরে নয়, এখন অর্থায়ন এবং বিনিয়োগের ওপর নির্ভরশীল।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে। দেশের মুদ্রাস্ফীতিসহ টাকার যোগান ও চাহিদা নিরূপন করে। সে মোতাবেক ব্যাংক ইন্টারেস্ট (সর্বোচ্চ ও নূন্যতম হার) কত হওয়া উচিত সে ব্যাপারে গাইডলাইনস প্রদান করে। সকল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে তা মেনে চলতে হয়। ব্যাংকগুলো আইনের মাধ্যমে সৃষ্ট। ব্যাংক ইচ্ছে মতো ইন্টারেস্ট চার্জ করতে পারে না। চড়া ইন্টারেস্ট চার্জ করা হলে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়। ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগের দিক (সম্পদ সাইড) মার্কাআপ ভিত্তিক যা প্রচলিত ব্যাংকের ইন্টারেস্ট ভিত্তিক বিনিয়োগের মতো। অনেক ক্ষেত্রে বিনিয়োগের সময় প্রচলিত ব্যাংকের ইন্টারেস্ট হার, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি, মুদ্রা বাজার দেখে মুনাফার হার সমন্বয় করা হয়। ইন্টারেস্ট রেট হিসাবের সময় অনেক বৈধ উপাদান বিবেচনায় নেয়া হয়। যেমন মূল্যস্ফীতি, ব্যাংকের বেতনসহ অন্যান্য বৈধ খরচ, সরকারি কর-ভ্যাট, ঝুঁকি ব্যয়, সঞ্চিতি, ব্যাংকের নিজস্ব মুনাফা ইত্যাদি। এসব অন্তর্ভুক্ত করে যে হার নির্ণয় করা হয় তাকে সুদ নামকরণ করা অদৌ যৌক্তিক কিনা ভেবে দেখা দরকার।

পবিত্র কুরআনে পূর্ব নির্ধারিত আয়কে হারাম বলা হয়নি। সঞ্চয়পত্রের আয় পূর্ব নির্ধারিত। সরকার টাকা প্রচলন করে এবং টাকার মালিক। সরকার চাইলে যে কোন সময় টাকা বাতিল করতে পারেন, টাকশালে ছাপিয়ে নতুন টাকা প্রচলন করতে পারে। সরকার সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে টাকা ঋণ হিসেবে নিয়ে দেশে উন্নয়ণ এবং কল্যাণমূলক কাজ করে, যার সুবিধা আবার জনগণই ভোগ করে।

সরকার শক্তিশালী। অন্যদিকে যারা টাকা ধার দেন তারা দুর্বল। সরকার দুর্বলের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদের চলার জন্য নির্দিষ্ট হারে মুনাফা প্রদান করে সহায়তা করে। মুনাফার মাধমে সময়ের পরিক্রমায় বিনিয়োগকৃত টাকার অবমূল্যায়ন সমন্বয় হয়ে যায়। মুনাফার হার মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কখনই কম হয় না। মেয়াদ শেষে যথা সময়ে মূলধন ফেরত দিয়ে দেয়। সরকারের এ ধরণের জণকল্যাণমূলক কাজকে সুদের অনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে মিল করে হারাম বলে দেয়া সঠিক হচ্ছে কিনা, সেটা এক বড়ো প্রশ্ন।

সুদ বলে আমানতকারীকে ব্যাংক যা প্রদান করে থাকে তা অনেকের কাছে বিব্রতকর। ইন্টারেস্টকে সুদ না বলে আয়, মুনাফা, সার্ভিস চার্জ অথবা অন্য ভালো কিছু নামে বললে মনে হয় ভালো হয়। কেউ কেউ বলেন, ইন্টারেস্ট এর বাঙলা কেনো প্রয়োজন? ইন্টারেস্ট বললে ক্ষতি কি? সাধারণ মানুষ ইন্টারেস্ট বললে বুঝতে পারে। যা মানুষ বুঝতে পারে, সেটাই গ্রহণীয়। আবার কেউ কেউ বলেন, ইন্টারেস্ট বললে অনেক মানুষ সুদ মনে করে। অনেকটা মজ্জাগত হয়ে গেছে। তাই আয় বা মুনাফা বললে বিতর্ক হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে সুদ আখ্যা না দেয়াই শ্রেয়।

উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে ব্যাংক ইন্টারেস্ট শব্দের প্রতিশব্দ সুদ কিনা, সে বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করে সরকারি পর্যায়ে এখনি একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া আবশ্যক। যদি সুদ না হয়ে থাকে, তা হলে সরকারের উচিত হবে ধর্মীয় নৈতিকতাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে সকল গোমরাহী ও ভ্রান্তি অবসানের লক্ষ্যে যত দ্রুত সম্ভব ব্যাংকসহ সকল রাষ্ট্রীয় কাজের সকল স্তরে ইন্টারেস্ট শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে সুদ শব্দটির ব্যবহার রহিত করা। এর পরিবর্তে আয়, সার্ভিস চার্জ, মুনাফা অথবা অন্য ভালো কোন নাম দেয়া যেতে পারে। এদেশের অধীকাংশ মানুষ ধর্মভীরু এবং জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক মুসলমান। তাদের ধর্মীয় অনুভূতি ও আবেগের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই কাজটি করা আবশ্যক।

[লেখক: ডিজিএম, বিডিবিএল]

back to top