alt

মুক্ত আলোচনা

দাও ফিরে সে অরণ্য

খন্দকার মুনতাসীর মামুন

: রোববার, ৩১ মার্চ ২০১৯

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেকও নেই বাংলাদেশের বনভূমি। যতটুকু আছে তার বেশিরভাগই আবার রয়েছে ধ্বংসের ঝুঁকিতে। যদিও বন অধিদফতরের দাবি, প্রতিনিয়ত বাড়ছে বনভূমির আয়তন। তবে আকৃতিগত দিক থেকে তা দৃশ্যমান নয়। দখলের মহোৎসব এবং বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে দেয়া বরাদ্দে দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে বনভূমি। আর এতে বিঘ্নিত হচ্ছে ঋতুচক্র যা হুমকির মুখে ফেলছে জীববৈচিত্র্যকে।

আগে বলা হত গাছপালা কাটলে পরিবেশের ক্ষতি হয়। জলবায়ু পরিবর্তনেও সেটা ভূমিকা রাখে। এখনও কথাটি শতভাগ ঠিক। শুধু এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মানবাধিকার সংকট। বনভূমি যে কোন উৎস থেকে আসা পানি প্রবাহের চাপ কমায় এবং ভূমিক্ষয় ও ভূমিধস থেকে দেশের মাটিকে রক্ষা করে। অধিকন্তু গাছপালা বায়ুমন্ডলের উত্তাপ কমিয়ে দিয়ে বাতাসে অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করে এবং বাতাস থেকে কার্বন-ডাই অক্সাইড শুষে নেয়। এমনকি বন যানবাহনের কালো ধোঁয়ার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বায়ুমন্ডলকে মুক্ত রাখতে সাহায্য করে। বনাঞ্চল, বিশেষ করে, ঝড়-ঝঞ্ঝা, সাইক্লোন, বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখে। অবৈধভাবে যারা গাছ কাটে, তারা সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারসহ অন্যান্য শক্তিশালী গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলে। ফলে অনেকটা বিনা বাধায় কাজটি করতে পারে তারা। যদি কেউ তাদের কাজে বাধা দেয় সেক্ষেত্রে মানুষ খুন করতেও হাত কাঁপে না বন দখলকারীদের।

গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশে বন ও বনভূমির পরিমাণ কমে তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। বন অধিদফতরের মহাপরিকল্পনায় বনভূমি ধ্বংসের তুলনামূলক তথ্য মতে, গত ২৫ বছরে সুন্দরবন কমেছে ১০ হাজার ৯৮০ হেক্টর। একই সময়ে শালবন ৬ হাজার ১৬০ হেক্টর এবং পার্বত্য বনাঞ্চল ৪৮ হাজার ৮১০ হেক্টর কমেছে। একইভাবে বাঁশবাগান কমেছে ৭৪ হাজার ৭৫০ হেক্টর। ক্রমাগত ও ধারাবাহিক বনাঞ্চল ধ্বংসে হুমকিতে রয়েছে দেশের জীববৈচিত্র্য। বিলুপ্তির পথে রয়েছে দেশের বনাঞ্চলের ৪০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৪১ প্রজাতির পাখি, ৫৮ প্রজাতির সরীসৃপ এবং আট প্রজাতির উভচর প্রাণী।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকার অপরিহার্যতার কথা বলা হলেও বেসরকারি হিসেবে এখন দেশে বনভূমির পরিমাণ মাত্র ৭ থেকে ৮ শতাংশ। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সংরক্ষিত বনভূমি, ব্যক্তিপর্যায়ে রোপণ করা গাছপালা, সামাজিক বনায়ন ও উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনীসহ নানা উদ্যোগ মিলিয়ে দেশে বনভূমির পরিমাণ এখন বেড়ে ১৬ থেকে ১৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তবে বনভূমি সংক্রান্ত সরকারি ভাষ্যের সঙ্গে বাস্তবতার যে বিন্দুমাত্র মিল নেই তা প্রতিদিনের খবরের কাগজ খুললেই আঁচ করা যায়।

কক্সবাজার জেলার উখিয়া বন রেঞ্জের আটটি বিটের অধীনে সংরক্ষিত ও রক্ষিত বনাঞ্চলের জমিজমা অবাধে জবর দখল হচ্ছে। চলছে অবাধ বিক্রয় বাণিজ্যও। প্রকৃতি ধ্বংসের অপরাধে পরিবেশ আইনে মামলা করার সুযোগ থাকলেও তা করছেন না বনসংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা। শুধু চাকরি বাঁচাতে বন আইনে মামলা করে তারা তাদের দায়িত্ব শেষ করেন। এ মামলায় তেমন কোন শাস্তি না হওয়ায় পার পেয়ে যাচ্ছে জবরদখলকারী চক্র।

প্রায় ছয় দশক আগে প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে আসে গাজীপুরের ভাওয়াল বন। আর বনটি রক্ষার পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৮২ সালে ভাওয়াল অরণ্যকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করে সরকার। কিন্তু বনটি রক্ষা তো হচ্ছেই না, উল্টো বিপন্নœতার পথে এ অঞ্চলের বনাঞ্চল। বেসরকারি ও ব্যক্তি খাতের মাধ্যমে বনাঞ্চল দখল ও দ্রুত নগরায়ন, বন বিভাগের তদারকির অভাব, দুর্নীতি ও অদক্ষতা, গাছ কাটা ও রক্ষণাবেক্ষণে অসচেতনতার কারণেই ভাওয়াল বন ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে বিলুপ্তির পথে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৮০ সালের দশক থেকেই সুন্দরবন নগ্ন আগ্রাসনের শিকার হতে থাকে। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী ভারত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় তার সুন্দরবন এলাকায় আধুনিক পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তুললে বাংলাদেশের সুন্দরবনেও পর্যটন শিল্প প্রসারের কথা ওঠে। কিন্তু সুন্দরবনের দায়িত্বে থাকা বন অধিদফতরের দুর্নীতি এবং বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ব্যর্থতার সুযোগে এ শিল্পটি ক্রমশ ব্যক্তি উদ্যোগের বিষয় হয়ে যায়। ২০০০ সাল নাগাদ সুন্দরবনের চারপাশে অনেক এনজিও সুন্দরবনের মানুষ ও প্রাণী রক্ষার নামে ঘাঁটি গাড়তে থাকে।

সুন্দরবন থেকে মাত্র ৯-১০ কিলোমিটার দূরে বাগেরহাটের রামপালে নির্মিত হচ্ছে দেশের সর্ববৃহৎ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। হিসাবের মারপ্যাঁচে এটিকে সুন্দরবন থেকে ‘নিরাপদ’ দূরত্বে দেখানো হচ্ছে। আর এ কেন্দ্র চালাতে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় ১৩ হাজার টন কয়লা পরিবহনের নৌরুট ঠিক করা হয়েছে পশুর নদে, যা সুন্দরবনের গভীরতম অংশের ভেতর দিয়েই বহমান। বিশাল সব জাহাজ চলাচলের শব্দ, সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়া কয়লার ভাঙা টুকরা, বর্জ্য, জাহাজের তেল আর সার্চলাইটের তীব্র আলোয় শুরু হবে সুন্দরবনের দূষণ। এ দূষণের প্রথম শিকার হবে সুন্দরবনের পানি প্রবাহের অন্যতম উৎস পশুর নদ। অথচ পশুর নদ ও এর চারদিকের জলাধারগুলোই সুন্দরবনের প্রাণভোমরা। বাস্তবিক অর্থে সুন্দরবনকে তার সামগ্রিক প্রতিবেশ ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ নেই ।

অগ্রসরমান বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে হবে। বন্ধ করতে হবে বৃক্ষ নিধন। বন ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে আইনাননুগ কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। শিল্পোন্নয়নের পাশাপাশি সৃষ্টি করতে হবে নতুন বনাঞ্চল। এ ব্যাপারে ব্যাপক জনসচেতনতা জাগিয়ে তুলতে হবে। উন্নয়নের সঙ্গে পরিবেশের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। পরিবেশের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের বাঁচা-মরার প্রশ্ন। প্রতিকূল পরিবেশে মানুষ কেন, জীববৈচিত্র্যই অস্তিত্বহীন। দেশের বনাঞ্চলকে রক্ষা করেই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। প্রাকৃতির পরিবেশ ভারসাম্যহীন উন্নয়ন কখনও টেকসই হতে পারে না। আর উন্নয়ন, সে তো মানুষের জন্য। মানুষসহ যে কোন প্রাণীর জীবন হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে উন্নয়ন হবে অর্থহীন।

দেশে ঘন ঘন কালবৈশাখী, সাইক্লোন ও অকাল বন্যার তা-ব দেখা যাচ্ছে। এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধ করার একমাত্র উপায়, দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ বনাঞ্চল সৃষ্টি করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য অক্ষুণœ রাখা। বন এলাকায় শিল্প উদ্যোগ বাতিল করে পরিবেশ দূষণের জন্য তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে। এ অর্থ ব্যবহার করতে হবে পরিবেশ রক্ষায়। বনভূমি ইজারা প্রদানের কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। কোন বিবেচনাতেই বনভূমিতে কোন স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না।

সুন্দরবনকে রাহুমুক্ত রাখতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের বহু বিকল্প আছে, বিকল্প বহু জায়গাও আছে। কিন্তু আমাদের সুন্দরবন একটাই। তাই আমরা আশা করব, ভারত ও বাংলাদেশ সরকার এ সুন্দরবন সুরক্ষার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবে। রামপাল প্রকল্প অবিলম্বে বন্ধ করে বাঁচিয়ে রাখবে সুন্দরবন। সুন্দরবন বাঁচলে বাঁচবে বাংলাদেশ।

[লেখক : সাংবাদিক]

Suva.muntasir@gmail.com

দৈনিক সংবাদ : ৩১ মার্চ ২০১৯, রোববার, ৭ এর পাতায় প্রকাশিত

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

দাও ফিরে সে অরণ্য

খন্দকার মুনতাসীর মামুন

রোববার, ৩১ মার্চ ২০১৯

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেকও নেই বাংলাদেশের বনভূমি। যতটুকু আছে তার বেশিরভাগই আবার রয়েছে ধ্বংসের ঝুঁকিতে। যদিও বন অধিদফতরের দাবি, প্রতিনিয়ত বাড়ছে বনভূমির আয়তন। তবে আকৃতিগত দিক থেকে তা দৃশ্যমান নয়। দখলের মহোৎসব এবং বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে দেয়া বরাদ্দে দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে বনভূমি। আর এতে বিঘ্নিত হচ্ছে ঋতুচক্র যা হুমকির মুখে ফেলছে জীববৈচিত্র্যকে।

আগে বলা হত গাছপালা কাটলে পরিবেশের ক্ষতি হয়। জলবায়ু পরিবর্তনেও সেটা ভূমিকা রাখে। এখনও কথাটি শতভাগ ঠিক। শুধু এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মানবাধিকার সংকট। বনভূমি যে কোন উৎস থেকে আসা পানি প্রবাহের চাপ কমায় এবং ভূমিক্ষয় ও ভূমিধস থেকে দেশের মাটিকে রক্ষা করে। অধিকন্তু গাছপালা বায়ুমন্ডলের উত্তাপ কমিয়ে দিয়ে বাতাসে অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করে এবং বাতাস থেকে কার্বন-ডাই অক্সাইড শুষে নেয়। এমনকি বন যানবাহনের কালো ধোঁয়ার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বায়ুমন্ডলকে মুক্ত রাখতে সাহায্য করে। বনাঞ্চল, বিশেষ করে, ঝড়-ঝঞ্ঝা, সাইক্লোন, বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখে। অবৈধভাবে যারা গাছ কাটে, তারা সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারসহ অন্যান্য শক্তিশালী গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলে। ফলে অনেকটা বিনা বাধায় কাজটি করতে পারে তারা। যদি কেউ তাদের কাজে বাধা দেয় সেক্ষেত্রে মানুষ খুন করতেও হাত কাঁপে না বন দখলকারীদের।

গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশে বন ও বনভূমির পরিমাণ কমে তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। বন অধিদফতরের মহাপরিকল্পনায় বনভূমি ধ্বংসের তুলনামূলক তথ্য মতে, গত ২৫ বছরে সুন্দরবন কমেছে ১০ হাজার ৯৮০ হেক্টর। একই সময়ে শালবন ৬ হাজার ১৬০ হেক্টর এবং পার্বত্য বনাঞ্চল ৪৮ হাজার ৮১০ হেক্টর কমেছে। একইভাবে বাঁশবাগান কমেছে ৭৪ হাজার ৭৫০ হেক্টর। ক্রমাগত ও ধারাবাহিক বনাঞ্চল ধ্বংসে হুমকিতে রয়েছে দেশের জীববৈচিত্র্য। বিলুপ্তির পথে রয়েছে দেশের বনাঞ্চলের ৪০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৪১ প্রজাতির পাখি, ৫৮ প্রজাতির সরীসৃপ এবং আট প্রজাতির উভচর প্রাণী।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকার অপরিহার্যতার কথা বলা হলেও বেসরকারি হিসেবে এখন দেশে বনভূমির পরিমাণ মাত্র ৭ থেকে ৮ শতাংশ। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সংরক্ষিত বনভূমি, ব্যক্তিপর্যায়ে রোপণ করা গাছপালা, সামাজিক বনায়ন ও উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনীসহ নানা উদ্যোগ মিলিয়ে দেশে বনভূমির পরিমাণ এখন বেড়ে ১৬ থেকে ১৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তবে বনভূমি সংক্রান্ত সরকারি ভাষ্যের সঙ্গে বাস্তবতার যে বিন্দুমাত্র মিল নেই তা প্রতিদিনের খবরের কাগজ খুললেই আঁচ করা যায়।

কক্সবাজার জেলার উখিয়া বন রেঞ্জের আটটি বিটের অধীনে সংরক্ষিত ও রক্ষিত বনাঞ্চলের জমিজমা অবাধে জবর দখল হচ্ছে। চলছে অবাধ বিক্রয় বাণিজ্যও। প্রকৃতি ধ্বংসের অপরাধে পরিবেশ আইনে মামলা করার সুযোগ থাকলেও তা করছেন না বনসংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা। শুধু চাকরি বাঁচাতে বন আইনে মামলা করে তারা তাদের দায়িত্ব শেষ করেন। এ মামলায় তেমন কোন শাস্তি না হওয়ায় পার পেয়ে যাচ্ছে জবরদখলকারী চক্র।

প্রায় ছয় দশক আগে প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে আসে গাজীপুরের ভাওয়াল বন। আর বনটি রক্ষার পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৮২ সালে ভাওয়াল অরণ্যকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করে সরকার। কিন্তু বনটি রক্ষা তো হচ্ছেই না, উল্টো বিপন্নœতার পথে এ অঞ্চলের বনাঞ্চল। বেসরকারি ও ব্যক্তি খাতের মাধ্যমে বনাঞ্চল দখল ও দ্রুত নগরায়ন, বন বিভাগের তদারকির অভাব, দুর্নীতি ও অদক্ষতা, গাছ কাটা ও রক্ষণাবেক্ষণে অসচেতনতার কারণেই ভাওয়াল বন ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে বিলুপ্তির পথে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৮০ সালের দশক থেকেই সুন্দরবন নগ্ন আগ্রাসনের শিকার হতে থাকে। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী ভারত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় তার সুন্দরবন এলাকায় আধুনিক পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তুললে বাংলাদেশের সুন্দরবনেও পর্যটন শিল্প প্রসারের কথা ওঠে। কিন্তু সুন্দরবনের দায়িত্বে থাকা বন অধিদফতরের দুর্নীতি এবং বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ব্যর্থতার সুযোগে এ শিল্পটি ক্রমশ ব্যক্তি উদ্যোগের বিষয় হয়ে যায়। ২০০০ সাল নাগাদ সুন্দরবনের চারপাশে অনেক এনজিও সুন্দরবনের মানুষ ও প্রাণী রক্ষার নামে ঘাঁটি গাড়তে থাকে।

সুন্দরবন থেকে মাত্র ৯-১০ কিলোমিটার দূরে বাগেরহাটের রামপালে নির্মিত হচ্ছে দেশের সর্ববৃহৎ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। হিসাবের মারপ্যাঁচে এটিকে সুন্দরবন থেকে ‘নিরাপদ’ দূরত্বে দেখানো হচ্ছে। আর এ কেন্দ্র চালাতে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় ১৩ হাজার টন কয়লা পরিবহনের নৌরুট ঠিক করা হয়েছে পশুর নদে, যা সুন্দরবনের গভীরতম অংশের ভেতর দিয়েই বহমান। বিশাল সব জাহাজ চলাচলের শব্দ, সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়া কয়লার ভাঙা টুকরা, বর্জ্য, জাহাজের তেল আর সার্চলাইটের তীব্র আলোয় শুরু হবে সুন্দরবনের দূষণ। এ দূষণের প্রথম শিকার হবে সুন্দরবনের পানি প্রবাহের অন্যতম উৎস পশুর নদ। অথচ পশুর নদ ও এর চারদিকের জলাধারগুলোই সুন্দরবনের প্রাণভোমরা। বাস্তবিক অর্থে সুন্দরবনকে তার সামগ্রিক প্রতিবেশ ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ নেই ।

অগ্রসরমান বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে হবে। বন্ধ করতে হবে বৃক্ষ নিধন। বন ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে আইনাননুগ কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। শিল্পোন্নয়নের পাশাপাশি সৃষ্টি করতে হবে নতুন বনাঞ্চল। এ ব্যাপারে ব্যাপক জনসচেতনতা জাগিয়ে তুলতে হবে। উন্নয়নের সঙ্গে পরিবেশের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। পরিবেশের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের বাঁচা-মরার প্রশ্ন। প্রতিকূল পরিবেশে মানুষ কেন, জীববৈচিত্র্যই অস্তিত্বহীন। দেশের বনাঞ্চলকে রক্ষা করেই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। প্রাকৃতির পরিবেশ ভারসাম্যহীন উন্নয়ন কখনও টেকসই হতে পারে না। আর উন্নয়ন, সে তো মানুষের জন্য। মানুষসহ যে কোন প্রাণীর জীবন হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে উন্নয়ন হবে অর্থহীন।

দেশে ঘন ঘন কালবৈশাখী, সাইক্লোন ও অকাল বন্যার তা-ব দেখা যাচ্ছে। এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধ করার একমাত্র উপায়, দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ বনাঞ্চল সৃষ্টি করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য অক্ষুণœ রাখা। বন এলাকায় শিল্প উদ্যোগ বাতিল করে পরিবেশ দূষণের জন্য তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে। এ অর্থ ব্যবহার করতে হবে পরিবেশ রক্ষায়। বনভূমি ইজারা প্রদানের কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। কোন বিবেচনাতেই বনভূমিতে কোন স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না।

সুন্দরবনকে রাহুমুক্ত রাখতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের বহু বিকল্প আছে, বিকল্প বহু জায়গাও আছে। কিন্তু আমাদের সুন্দরবন একটাই। তাই আমরা আশা করব, ভারত ও বাংলাদেশ সরকার এ সুন্দরবন সুরক্ষার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবে। রামপাল প্রকল্প অবিলম্বে বন্ধ করে বাঁচিয়ে রাখবে সুন্দরবন। সুন্দরবন বাঁচলে বাঁচবে বাংলাদেশ।

[লেখক : সাংবাদিক]

Suva.muntasir@gmail.com

দৈনিক সংবাদ : ৩১ মার্চ ২০১৯, রোববার, ৭ এর পাতায় প্রকাশিত

back to top