খন্দকার মুনতাসীর মামুন
কেমন যেন অধরা, ছিপছিপে শরীরে এক স্বতঃস্ফূর্ত স্বভাব তার। তার গতির সঙ্গে কেউ এঁটে উঠতে পারে না, সবাইকে দূরে ফেলে ছুটে যাওয়াতেই যেন তার তৃপ্তি। সব সময় একটু দূরে, সে যতই কারও কাছে থাকুক না কেন, তাকে ঠিকই দূর থেকে স্পষ্টভাবে আলাদা করা যাবে। যখন তখন হারিয়ে যাওয়া ইছামতীর চরে কাশের বনে!
কৃষ্ণা নামের সুহাসিনী মেয়েটি যখন তার পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশের পাবনা থেকে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় গিয়ে স্থায়ী হয়েছিলেন, তখন কি কারও পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব ছিল যে, এই মেয়েটি এক বিরল ইতিহাস রচনা করে দেখাবে? না, এখানে ইতিহাস রচনা বলতে অভিনয় করে বিখ্যাত হওয়া নয়, এখানে ইতিহাস রচনা বলতে একদম অন্যরকম কিছু; যা এর আগে বা পরে কেউ করে দেখাতে পারেনি। সেই পঞ্চাশের দশক, মানুষ আরও অনেক বেশি রক্ষণশীল ছিল; অথচ সেখানে, সেই সময়ে একজন নারী রমা দাসগুপ্ত থেকে সুচিত্রা সেন হতে পেরেছিলেন!
সুচিত্রা সেন মানেই যেন শেষ না হওয়া গল্প। কারও সঙ্গে তার তুলনা চলে না। জীবনে যেসব চরিত্রে অভিনয় করেছেন, সেখানে মিশিয়ে দিয়েছেন অদ্ভুত এক বিষণ্নতা। তার বাঁকা ঠোঁটের হাসিতে যে কত তরুণের হৃদস্পন্দন বেড়েছে, বুকের ভেতরটা হু-হু করে উঠেছে, তার কোন হিসাব নেই। তিনি ছিলেন জমকালো সেলুলয়েড সেনসেশন! সুচিত্রা ঘাড় কাত করে তাকালে সময়ও কি একটু থমকে যেত না! পর্দায় সুচিত্রার চোখ টলমল করে উঠলে জল গড়াতো পর্দার এপারে। তার চুল, চোখ, সাজগোজ বাঙালি নারীদের ফ্যাশনের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সাধারণ একটা ঢাকাই শাড়ি পরলেও তাকে অসম্ভব রূপসী দেখাত। তার স্টাইলের বিশেষত্বই ছিল সারল্য।
সুচিত্রা সেনের জন্ম ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল পাবনায়, নানার বাড়িতে। তার আসল নাম রমা দাশগুপ্ত। সুচিত্রা সেন পর্দার নাম। পাবনা শহরের দিলালপুরের বাড়িতে কেটেছে তার শৈশব-কৈশোর। ছিলেন পাবনা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের আগেই পরিবারের সঙ্গে কলকাতা চলে যান। এরপর থেকে কলকাতাতেই স্থায়ী হন। বিখ্যাত শিল্পপতি আদিনাথ সেনের পুত্র দিবানাথ সেনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তাদের একমাত্র কন্যা অভিনেত্রী মুনমুন সেন। সুচিত্রা সেনের চলচ্চিত্রে অভিষেক ১৯৫২ সালে। প্রথমে নেপথ্য গায়িকা হওয়ার জন্যই গেলেন স্টুডিওতে, কিন্তু এই রূপসীকে পর্দার পেছনে রাখার মতো ভুল করেননি রুপালি পর্দার লোকেরা! বারবার রমা মুখ ফিরিয়ে নিলেও পরিচালকেরা একবার তার খোঁজ পেয়ে যাওয়ার পর তাকে আর ছাড়েন কী করে? প্রথম ছবি ‘শেষ কোথায়’ দিয়ে শুরু। কিন্তু কিছুদিন অভিনয়ের পর অর্থাভাবে তা বন্ধ হয়ে গেল। কখনই মুক্তি পেল না।
এরপর সুকুমার দাশগুপ্তর ‘সাত নম্বর কয়েদি’ সিনেমা থেকে চলচ্চিত্রে নিয়মিত হলেন রমা। না, এখন আর রমা নয়, সুকুমার দাশগুপ্তর সহকারী নীতিশ রায় তার নাম দিলেন সুচিত্রা। রমার নবজন্ম ঘটল ‘সুচিত্রা’ হয়ে, সিনেমার রুপালি পর্দায়। এর পরের ছবি অর্থাৎ নীরেন লাহিড়ীর ‘কাজরী’ ছবির মাধ্যমে রমা সেন পাল্টিয়ে ‘সুচিত্রা সেন’ নামে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি।
তবে ১৯৫৪ সালে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবির মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্র জগতে সুচিত্রা সেনের জয়যাত্রা শুরু। তার অভিনীত বাংলা ছবির সংখ্যা ৫০-এর অধিক। এছাড়া ৭টি হিন্দি ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন। উত্তম কুমার ছাড়াও সুচিত্রা বিকাশ রায়, বসন্ত চৌধুরী, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অশোক কুমার এবং হিন্দিতে দিলীপ কুমার, দেব আনন্দ, ধর্মেন্দ্র ও সঞ্জীব কুমারের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। সুচিত্রা-উত্তম জুটি ছিল সবচেয়ে রোমান্টিক ও জনপ্রিয়। এই জুটির একসঙ্গে করা ছবির সংখ্যা ৩০। রূপালি পর্দার এই জুটির আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তার সেই সময়ে সুচিত্রা সেন হয়ে উঠেছিলেন কোটি কোটি তরুণের স্বপ্নের মানুষ। আর নারীদের অনুসরণীয়। সুচিত্রা-উত্তম অভিনীত ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘সবার উপরে’, ‘শাপমোচন’, ‘শিল্পী’, ‘পথে হলো দেরী’, ‘হারানো সুর’, ‘গৃহদাহ’, ‘সাগরিকা’ ইত্যাদি।
হিন্দি চলচ্চিত্রে তার ক্যারিয়ার সম্পর্কে বলতে গেলে সামনে আসে দুটি নামÑ ‘দেবদাস’ ও ‘আন্ধি’। অনেক নায়িকার স্বপ্নের চরিত্র ‘পার্বতী’ হয়ে দিলীপ কুমারের বিপরীতে মুগ্ধতাভরা অভিনয়ের জাদু ছড়িয়েছিলেন সুচিত্রা। তার ক্যারিয়ারের শেষ দিকে আসে ‘আন্ধি’, পরিচালনায় গুলজার। অনেকে মনে করেন ইন্দিরা গান্ধীকে মাথায় রেখে রাজনীতিবিদের চরিত্রটি সাজানো হয়েছিল। এ চরিত্র বাস্তবায়নে বলিউডের কাউকে না নিয়ে বাংলার সুচিত্রা সেনকেই প্রথম পছন্দ বলে মনে হয় গুলজারের। এ ছবিতে তার বিপরীতে ছিলেন সঞ্জীব কুমার।
১৯৬৩ সালে ‘সাত পাকে বাঁধা’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সুচিত্রা সেন ‘সিলভার প্রাইজ ফর বেস্ট অ্যাকট্রেস’ জয় করেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী যিনি কোনো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী সম্মান প্রদান করে।
সুচিত্রা সেন অভিনীত সর্বশেষ ছবি ‘প্রণয়পাশা’ মুক্তি পায় ১৯৭৮ সালে। এতে নায়ক ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এরপর তিনি আর কোনো ছবিতে অভিনয় করেননি। এক সময় অভিনয় ছেড়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন। দীর্ঘ ৩৬ বছর তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিলেন। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের নিজস্ব ফ্ল্যাটে কন্যা মুনমুন, নাতনি রাইমা ও রিয়া এবং নিকটাত্মীয় ছাড়া আর কারও দেখা করার অনুমতি ছিল না।
ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি যুগে যুগে পুরুষেরা ডমিনেট করেছে। সব রকমের জি হুজুর নায়কদের করা হয়, সহঅভিনেত্রী পছন্দ/বাছাই করার অধিকার তাদের দেয়া হয়, তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী চিত্রনাট্য, দৃশ্য বা সংলাপ পরিবর্তন করা হয় এবং সর্বোপরি তাদের পারিশ্রমিক বা সম্মানীও নায়িকা/অভিনেত্রীদের থেকে বহুলাংশে বেশি। নারী শিল্পীরা সেটা মেনেই কাজ করে আসছেন। এক সুচিত্রা সেনই ছিলেনÑ যিনি কোনো কালেই এ নিয়ম মানেননি, প্রথা ভেঙে নিজের জন্য নতুন প্রথা গড়েছিলেন। এক অসম্ভব শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব ছিল তার, যেই ব্যক্তিত্বের জোরে সবাইকে কাবু করে ফেলতে পারতেন। কারও সাহস হতো না তার কথা অমান্য করার বা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে দিয়ে কিছু করিয়ে নেয়ার।
বোম্বেতে অভিনয় করতে যাওয়া সর্বকালেই অভিনেতা/ অভিনেত্রীদের জন্য চরম আকাঙ্ক্ষার বিষয়। সুচিত্রা সেন এক্ষেত্রেও একমাত্র ব্যতিক্রম হয়ে রয়ে গেছেন। যে সময়ের কথা বলছি, সে সময়ে হিন্দি ছবির জগতে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও ব্যবসায়িকভাবে সফল সিনেমা নির্মাতা, নির্দেশক ছিলেন রাজ কাপুর। সেই রাজ কাপুরকে সুচিত্রা সেন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ রাজ কাপুরের পার্সোনালিটি তার পছন্দ হয়নি। নির্ভীক সুচিত্রা সে সময় স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে ভঙ্গিতে রাজ কাপুর তার (সুচিত্রার) পায়ের কাছে বসে তাকে ছবিতে অভিনয় করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সেই ভঙ্গি তাকে (রাজ কাপুরকে) সুচিত্রার কাছে হালকা চরিত্রের মানুষ হিসাবে পরিচয় করে দিয়েছিল। আর সুচিত্রা এরকম হালকা ব্যক্তিত্বের অধিকারীদের অপছন্দ করেন।
সুচিত্রা সেন সারাজীবন নিজের আশপাশে এক অদ্ভুত দুর্ভেদ্য দেয়াল তুলে রাখতে পেরেছিলেন; তা ভেদ করার কথা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কেউ ভাবতে পারেনি। সুযোগের পেছনে ছোটেননি, বরং সুযোগ নিজেই বারবার তার কাছে এসে ধরনা দিয়েছে। মানুষের চোখে যা লোভনীয় সেরকম অনেক কিছু তিনি পেয়েও অগ্রাহ্য ভরে ফিরিয়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ তাকে অহংকারী, রাগী, খামখেয়ালি বিভিন্ন নামে অভিহিত করেছে, এতে তার কোনোদিনও কিছু এসে যায়নি। কারও জন্য নিজেকে বা নিজের কোনো সিদ্ধান্ত বা স্বভাব পরিবর্তন করেননি, যা তার ভালো লেগেছে ঠিক সেটাই করে গেছেন। তার অভিনীত সর্বশেষ ছবিটি মুক্তির পর সেই যে লোকচক্ষুর আড়ালে নিজেকে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তার মৃত্যুর আগপর্যন্ত তার সেই সিদ্ধান্ত বহাল ছিল। দীর্ঘ পয়ত্রিশটি বছর নিজেকে কারও সামনে আনেননি! স্বেচ্ছা নির্বাসিত সুচিত্রা সবার কাছে হয়ে উঠেছিলেন রহস্যের এক মিথ। মানুষের এত আগ্রহ, এত আকুলতা, এত অনুনয় কোনো কিছুই তাকে টলাতে পারেনি। এতটাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে দাদাসাহেব ফালকের (ভারতে চলচ্চিত্রের মধ্যে এটাই সর্বোচ্চ পুরস্কার) মতো পুরস্কার নিতে যেতে পর্যন্ত তিনি অস্বীকার করেছিলেন; কারণ পুরস্কারটি গ্রহণ করতে হলে তাকে দিল্লি যেতে হতো!
২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি অনন্তলোকে পাড়ি জমান বাংলা চলচ্চিত্রের অনন্য এ ধ্রুবতারা। সুচিত্রা সেন বাঙালির চিরদিনের প্রেমিকা, যার বয়স পর্দার ছবিতে স্থির হয়ে আছে। তাকে ঘিরে আজও কৌতূহলের শেষ নেই। তারকারা যত তাদের চারপাশে রহস্যের মেদুরতা সৃষ্টি করে রাখবে, ততই তাদের প্রতি ভক্তকুলের আকর্ষণ। সুচিত্রা সেন সেটা পেরেছেন। তিনি জানতেন কোথায় থামতে হয়। চাইলেও কেউ সুচিত্রা সেন হতে পারে না।
[লেখক : সাংবাদিক]
suva.muntasir@gmail.com
দৈনিক সংবাদ : ৭ এপ্রিল ২০১৯, রোববার, ৭ এর পাতায় প্রকাশিত
খন্দকার মুনতাসীর মামুন
রোববার, ০৭ এপ্রিল ২০১৯
কেমন যেন অধরা, ছিপছিপে শরীরে এক স্বতঃস্ফূর্ত স্বভাব তার। তার গতির সঙ্গে কেউ এঁটে উঠতে পারে না, সবাইকে দূরে ফেলে ছুটে যাওয়াতেই যেন তার তৃপ্তি। সব সময় একটু দূরে, সে যতই কারও কাছে থাকুক না কেন, তাকে ঠিকই দূর থেকে স্পষ্টভাবে আলাদা করা যাবে। যখন তখন হারিয়ে যাওয়া ইছামতীর চরে কাশের বনে!
কৃষ্ণা নামের সুহাসিনী মেয়েটি যখন তার পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশের পাবনা থেকে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় গিয়ে স্থায়ী হয়েছিলেন, তখন কি কারও পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব ছিল যে, এই মেয়েটি এক বিরল ইতিহাস রচনা করে দেখাবে? না, এখানে ইতিহাস রচনা বলতে অভিনয় করে বিখ্যাত হওয়া নয়, এখানে ইতিহাস রচনা বলতে একদম অন্যরকম কিছু; যা এর আগে বা পরে কেউ করে দেখাতে পারেনি। সেই পঞ্চাশের দশক, মানুষ আরও অনেক বেশি রক্ষণশীল ছিল; অথচ সেখানে, সেই সময়ে একজন নারী রমা দাসগুপ্ত থেকে সুচিত্রা সেন হতে পেরেছিলেন!
সুচিত্রা সেন মানেই যেন শেষ না হওয়া গল্প। কারও সঙ্গে তার তুলনা চলে না। জীবনে যেসব চরিত্রে অভিনয় করেছেন, সেখানে মিশিয়ে দিয়েছেন অদ্ভুত এক বিষণ্নতা। তার বাঁকা ঠোঁটের হাসিতে যে কত তরুণের হৃদস্পন্দন বেড়েছে, বুকের ভেতরটা হু-হু করে উঠেছে, তার কোন হিসাব নেই। তিনি ছিলেন জমকালো সেলুলয়েড সেনসেশন! সুচিত্রা ঘাড় কাত করে তাকালে সময়ও কি একটু থমকে যেত না! পর্দায় সুচিত্রার চোখ টলমল করে উঠলে জল গড়াতো পর্দার এপারে। তার চুল, চোখ, সাজগোজ বাঙালি নারীদের ফ্যাশনের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সাধারণ একটা ঢাকাই শাড়ি পরলেও তাকে অসম্ভব রূপসী দেখাত। তার স্টাইলের বিশেষত্বই ছিল সারল্য।
সুচিত্রা সেনের জন্ম ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল পাবনায়, নানার বাড়িতে। তার আসল নাম রমা দাশগুপ্ত। সুচিত্রা সেন পর্দার নাম। পাবনা শহরের দিলালপুরের বাড়িতে কেটেছে তার শৈশব-কৈশোর। ছিলেন পাবনা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের আগেই পরিবারের সঙ্গে কলকাতা চলে যান। এরপর থেকে কলকাতাতেই স্থায়ী হন। বিখ্যাত শিল্পপতি আদিনাথ সেনের পুত্র দিবানাথ সেনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তাদের একমাত্র কন্যা অভিনেত্রী মুনমুন সেন। সুচিত্রা সেনের চলচ্চিত্রে অভিষেক ১৯৫২ সালে। প্রথমে নেপথ্য গায়িকা হওয়ার জন্যই গেলেন স্টুডিওতে, কিন্তু এই রূপসীকে পর্দার পেছনে রাখার মতো ভুল করেননি রুপালি পর্দার লোকেরা! বারবার রমা মুখ ফিরিয়ে নিলেও পরিচালকেরা একবার তার খোঁজ পেয়ে যাওয়ার পর তাকে আর ছাড়েন কী করে? প্রথম ছবি ‘শেষ কোথায়’ দিয়ে শুরু। কিন্তু কিছুদিন অভিনয়ের পর অর্থাভাবে তা বন্ধ হয়ে গেল। কখনই মুক্তি পেল না।
এরপর সুকুমার দাশগুপ্তর ‘সাত নম্বর কয়েদি’ সিনেমা থেকে চলচ্চিত্রে নিয়মিত হলেন রমা। না, এখন আর রমা নয়, সুকুমার দাশগুপ্তর সহকারী নীতিশ রায় তার নাম দিলেন সুচিত্রা। রমার নবজন্ম ঘটল ‘সুচিত্রা’ হয়ে, সিনেমার রুপালি পর্দায়। এর পরের ছবি অর্থাৎ নীরেন লাহিড়ীর ‘কাজরী’ ছবির মাধ্যমে রমা সেন পাল্টিয়ে ‘সুচিত্রা সেন’ নামে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি।
তবে ১৯৫৪ সালে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবির মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্র জগতে সুচিত্রা সেনের জয়যাত্রা শুরু। তার অভিনীত বাংলা ছবির সংখ্যা ৫০-এর অধিক। এছাড়া ৭টি হিন্দি ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন। উত্তম কুমার ছাড়াও সুচিত্রা বিকাশ রায়, বসন্ত চৌধুরী, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অশোক কুমার এবং হিন্দিতে দিলীপ কুমার, দেব আনন্দ, ধর্মেন্দ্র ও সঞ্জীব কুমারের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। সুচিত্রা-উত্তম জুটি ছিল সবচেয়ে রোমান্টিক ও জনপ্রিয়। এই জুটির একসঙ্গে করা ছবির সংখ্যা ৩০। রূপালি পর্দার এই জুটির আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তার সেই সময়ে সুচিত্রা সেন হয়ে উঠেছিলেন কোটি কোটি তরুণের স্বপ্নের মানুষ। আর নারীদের অনুসরণীয়। সুচিত্রা-উত্তম অভিনীত ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘সবার উপরে’, ‘শাপমোচন’, ‘শিল্পী’, ‘পথে হলো দেরী’, ‘হারানো সুর’, ‘গৃহদাহ’, ‘সাগরিকা’ ইত্যাদি।
হিন্দি চলচ্চিত্রে তার ক্যারিয়ার সম্পর্কে বলতে গেলে সামনে আসে দুটি নামÑ ‘দেবদাস’ ও ‘আন্ধি’। অনেক নায়িকার স্বপ্নের চরিত্র ‘পার্বতী’ হয়ে দিলীপ কুমারের বিপরীতে মুগ্ধতাভরা অভিনয়ের জাদু ছড়িয়েছিলেন সুচিত্রা। তার ক্যারিয়ারের শেষ দিকে আসে ‘আন্ধি’, পরিচালনায় গুলজার। অনেকে মনে করেন ইন্দিরা গান্ধীকে মাথায় রেখে রাজনীতিবিদের চরিত্রটি সাজানো হয়েছিল। এ চরিত্র বাস্তবায়নে বলিউডের কাউকে না নিয়ে বাংলার সুচিত্রা সেনকেই প্রথম পছন্দ বলে মনে হয় গুলজারের। এ ছবিতে তার বিপরীতে ছিলেন সঞ্জীব কুমার।
১৯৬৩ সালে ‘সাত পাকে বাঁধা’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সুচিত্রা সেন ‘সিলভার প্রাইজ ফর বেস্ট অ্যাকট্রেস’ জয় করেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী যিনি কোনো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী সম্মান প্রদান করে।
সুচিত্রা সেন অভিনীত সর্বশেষ ছবি ‘প্রণয়পাশা’ মুক্তি পায় ১৯৭৮ সালে। এতে নায়ক ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এরপর তিনি আর কোনো ছবিতে অভিনয় করেননি। এক সময় অভিনয় ছেড়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন। দীর্ঘ ৩৬ বছর তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিলেন। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের নিজস্ব ফ্ল্যাটে কন্যা মুনমুন, নাতনি রাইমা ও রিয়া এবং নিকটাত্মীয় ছাড়া আর কারও দেখা করার অনুমতি ছিল না।
ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি যুগে যুগে পুরুষেরা ডমিনেট করেছে। সব রকমের জি হুজুর নায়কদের করা হয়, সহঅভিনেত্রী পছন্দ/বাছাই করার অধিকার তাদের দেয়া হয়, তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী চিত্রনাট্য, দৃশ্য বা সংলাপ পরিবর্তন করা হয় এবং সর্বোপরি তাদের পারিশ্রমিক বা সম্মানীও নায়িকা/অভিনেত্রীদের থেকে বহুলাংশে বেশি। নারী শিল্পীরা সেটা মেনেই কাজ করে আসছেন। এক সুচিত্রা সেনই ছিলেনÑ যিনি কোনো কালেই এ নিয়ম মানেননি, প্রথা ভেঙে নিজের জন্য নতুন প্রথা গড়েছিলেন। এক অসম্ভব শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব ছিল তার, যেই ব্যক্তিত্বের জোরে সবাইকে কাবু করে ফেলতে পারতেন। কারও সাহস হতো না তার কথা অমান্য করার বা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে দিয়ে কিছু করিয়ে নেয়ার।
বোম্বেতে অভিনয় করতে যাওয়া সর্বকালেই অভিনেতা/ অভিনেত্রীদের জন্য চরম আকাঙ্ক্ষার বিষয়। সুচিত্রা সেন এক্ষেত্রেও একমাত্র ব্যতিক্রম হয়ে রয়ে গেছেন। যে সময়ের কথা বলছি, সে সময়ে হিন্দি ছবির জগতে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও ব্যবসায়িকভাবে সফল সিনেমা নির্মাতা, নির্দেশক ছিলেন রাজ কাপুর। সেই রাজ কাপুরকে সুচিত্রা সেন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ রাজ কাপুরের পার্সোনালিটি তার পছন্দ হয়নি। নির্ভীক সুচিত্রা সে সময় স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে ভঙ্গিতে রাজ কাপুর তার (সুচিত্রার) পায়ের কাছে বসে তাকে ছবিতে অভিনয় করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সেই ভঙ্গি তাকে (রাজ কাপুরকে) সুচিত্রার কাছে হালকা চরিত্রের মানুষ হিসাবে পরিচয় করে দিয়েছিল। আর সুচিত্রা এরকম হালকা ব্যক্তিত্বের অধিকারীদের অপছন্দ করেন।
সুচিত্রা সেন সারাজীবন নিজের আশপাশে এক অদ্ভুত দুর্ভেদ্য দেয়াল তুলে রাখতে পেরেছিলেন; তা ভেদ করার কথা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কেউ ভাবতে পারেনি। সুযোগের পেছনে ছোটেননি, বরং সুযোগ নিজেই বারবার তার কাছে এসে ধরনা দিয়েছে। মানুষের চোখে যা লোভনীয় সেরকম অনেক কিছু তিনি পেয়েও অগ্রাহ্য ভরে ফিরিয়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ তাকে অহংকারী, রাগী, খামখেয়ালি বিভিন্ন নামে অভিহিত করেছে, এতে তার কোনোদিনও কিছু এসে যায়নি। কারও জন্য নিজেকে বা নিজের কোনো সিদ্ধান্ত বা স্বভাব পরিবর্তন করেননি, যা তার ভালো লেগেছে ঠিক সেটাই করে গেছেন। তার অভিনীত সর্বশেষ ছবিটি মুক্তির পর সেই যে লোকচক্ষুর আড়ালে নিজেকে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তার মৃত্যুর আগপর্যন্ত তার সেই সিদ্ধান্ত বহাল ছিল। দীর্ঘ পয়ত্রিশটি বছর নিজেকে কারও সামনে আনেননি! স্বেচ্ছা নির্বাসিত সুচিত্রা সবার কাছে হয়ে উঠেছিলেন রহস্যের এক মিথ। মানুষের এত আগ্রহ, এত আকুলতা, এত অনুনয় কোনো কিছুই তাকে টলাতে পারেনি। এতটাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে দাদাসাহেব ফালকের (ভারতে চলচ্চিত্রের মধ্যে এটাই সর্বোচ্চ পুরস্কার) মতো পুরস্কার নিতে যেতে পর্যন্ত তিনি অস্বীকার করেছিলেন; কারণ পুরস্কারটি গ্রহণ করতে হলে তাকে দিল্লি যেতে হতো!
২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি অনন্তলোকে পাড়ি জমান বাংলা চলচ্চিত্রের অনন্য এ ধ্রুবতারা। সুচিত্রা সেন বাঙালির চিরদিনের প্রেমিকা, যার বয়স পর্দার ছবিতে স্থির হয়ে আছে। তাকে ঘিরে আজও কৌতূহলের শেষ নেই। তারকারা যত তাদের চারপাশে রহস্যের মেদুরতা সৃষ্টি করে রাখবে, ততই তাদের প্রতি ভক্তকুলের আকর্ষণ। সুচিত্রা সেন সেটা পেরেছেন। তিনি জানতেন কোথায় থামতে হয়। চাইলেও কেউ সুচিত্রা সেন হতে পারে না।
[লেখক : সাংবাদিক]
suva.muntasir@gmail.com
দৈনিক সংবাদ : ৭ এপ্রিল ২০১৯, রোববার, ৭ এর পাতায় প্রকাশিত