alt

মুক্ত আলোচনা

মুজিবনগর সরকারের দূরদর্শী নেতৃত্ব

মোহাম্মদ শাহজাহান

: মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০১৯

১৭ এপ্রিল বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। ১৯৭১-এর এ দিনে কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের আম্রকাননে একাত্তরে যুদ্ধ পরিচালনাকারী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। শত্রুর কারাগারে বন্দী থাকা সত্ত্বেও স্বাভাবিকভাবেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকেই ওই সরকারের রাষ্ট্রপতি করা হয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন তাজউদ্দীন আহমদ। দেশি-বিদেশি বিভিন্নমুখী ষড়যন্ত্রের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে ওই সময় সরকার পরিচালনা করতে হয়। অনেকের অভিমত, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন বলেই একাত্তরে ৯ মাসের যুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। মোশতাক গং শুরু থেকেই চায়নি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হন। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে প্রভাবশালী যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি যে কোন কারণেই হোক তাজউদ্দীন আহমদের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পক্ষে ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানের আন্তরিক সমর্থন ও সহযোগিতায় তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের মূল ভিত্তি হচ্ছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। ১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সভায় ওই ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। তাজউদ্দীন সরকারই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র, রসদ, টাকা, ট্রেনিং প্রদান, এক কোটি শরণার্থীর দেখাশোনা ভারতের সহায়তায় মুজিবনগর সরকারকেই করতে হয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পর তাজউদ্দীন-নজরুল সরকার ভারত থেকে বাংলাদেশে এসে স্বাধীন বাংলাদেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে কোন স্বাধীন ভূখন্ড ছিল না। ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশ। ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালে প্রথমবারের মতো স্বাধীনতা অর্জন করে। এ সময় বীরের জাতি হিসেবে বাঙালির সুখ্যাতি বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

২৫ মার্চে পাকিস্তানিদের আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা রক্ষার জন্য হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু পাকিস্তানি আঘাতের পর আওয়ামী লীগ নেতারা একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। কে জীবিত আছেন, কে নেই, তাও কারও জানা ছিল না। বঙ্গবন্ধু কোথায়? তিনি কি অবস্থায় রয়েছেন? তিনি গ্রেফতার হয়েছেন নাকি পাকিস্তানি দস্যুরা তাকে হত্যা করেছে, একথাও কেউ জানে না। তবে সবচেয়ে নিষ্ঠুর সত্য হলো, মুক্তি সংগ্রামের মূল নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন শত্রুর হেফাজতে বন্দী। তাজউদ্দীন উপলব্ধি করেন, ‘স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনার জন্য জরুরিভাবে একটি সরকার গঠন করা প্রয়োজন। প্রয়োজন একটি বেতার স্টেশনের।’ কিন্তু ২৫ মার্চের আঘাতের ১১-১২ দিন পরও কোন নেতার হদিস পাওয়া যাচ্ছিল না। একমাত্র লোক আমীর-উল-ইসলাম, যার সঙ্গে তাজউদ্দীন পরামর্শ করতে পারেন। তবে যে কোনো কারণেই হোক, বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতারের পরÑ পরবর্তী সরকারের গঠন প্রণালী নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধুও দিয়ে যাননি।

অন্য সব প্রধান নেতাদের অনুপস্থিতিতে কে সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান হবেন, উপরের সারির নেতারা কে কোথায় রয়েছেন, কেউ গ্রেফতার বা নিহত হয়েছেন কিনা, এসব কোন কিছুই তাজউদ্দীন আহমদের তখনও জানা ছিল না। প্রথম সাক্ষাতের এক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি দ্বিতীয়বারের মতো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ নিয়ে মতবিনিময় করেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের পরামর্শে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপ্রধান, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপ্রধান করে তাজউদ্দীন নিজেই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন। শত্রুর হাতে বন্দী বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি এবং তখনো দেখা মিলেনি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি করাটাও কম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ছিল না। ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠনের কথা বেতারের মাধ্যমে বিশ্ববাসী জেনে যায়। ১০ এপ্রিল প্রচারের জন্য প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণও রেকর্ড করা হয়। ইতোমধ্যে শেখ ফজলুল হক মণির নেতৃত্বে যুব ও ছাত্র নেতারাসহ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা কলকাতা পৌঁছে তাজউদ্দীন আহমদের প্রধানমন্ত্রী হওয়াসহ সরকার গঠনের ব্যাপারে ভিন্ন মত প্রকাশ করেন। ১০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পূর্বাপর পরিস্থিতি বর্ণনা করে এক গুরুত্বপূর্ণ দীর্ঘ ভাষণ দেন। প্রধানমন্ত্রীর এ ভাষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক অমূল্য দলিল হিসেবেই বিবেচিত হয়। ১০ এপ্রিলের পর প্রথমে এম মনসুর আলী ও কামারুজ্জামান, তারপর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবদুল মান্নান এবং আরও পরে খন্দকার মোশতাকসহ অন্য নেতারা কলকাতা পৌঁছেন। মোশতাক ও যুবনেতাদের বিরোধিতা সত্ত্বেও সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানের সমর্থন ও সহযোগিতায় তাজউদ্দীন আহমদ ঘোষিত সরকার বহাল থেকে যায়।

১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের মাটিতে মেহেরপুরের আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। অনুষ্ঠানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম রচিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আরেকটি অমূল্য দলিল হয়ে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন তাৎক্ষণিকভাবে প্রবাসী সরকারের রাজধানীর নামকরণ করেন মুজিবনগর। পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক, কয়েকজন যুব ও ছাত্রনেতাসহ বেশকিছু আওয়ামী লীগ নেতার অসহযোগিতা এবং বিরোধিতার মুখেও সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী ও কামারুজ্জামানের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতায় স্বাধীনতা যুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তি ঘটাতে সক্ষম হন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। মোশতাকগং আমেরিকার চক্রান্তে একবার ধুয়া তোলে, ‘স্বাধীনতা পেলে শেখ মুজিবকে জীবিত পাওয়া যাবে না, আর শেখ মুজিবকে পেলে স্বাধীনতা পাওয়া যাবে না।’ ওই কঠিন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের এমএনএ ও এমপিএদের এক যৌথ সভায় তাজউদ্দীন আহমদ তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণে যুক্তিতর্ক দিয়ে বুঝিয়ে বলেন, ‘আমরা স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু দুটিই চাই। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটিকে চাই না।’ প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ এতটাই প্রাণস্পর্শী ও যুক্তিযুক্ত ছিল যে, কয়েকজন চক্রান্তকারী ছাড়া সভায় উপস্থিত সবার উচ্চস্বরে তাজউদ্দীনের সমর্থনে সেøাগান দিতে থাকেন।

আরেকবার ওই বিপদ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও তাজউদ্দীনকে রক্ষা করেন ময়েজউদ্দিন আহমদ। ভারতে তাজউদ্দীন বিরোধী ষড়যন্ত্র জোরালো হয়ে উঠলে মিসেস গান্ধী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনকে এমপিএ ও এমএনদের আস্থা নিতে বলেন। ’৭১-এর ৫ জুলাই জলপাইগুড়িতে আওয়ামী লীগের জনপ্রতিনিধিদের ওই সভা হয়। মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসির (সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিক নন) ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী সরকার’ গ্রন্থে ওই সভার কথা লিপিবদ্ধ হয়েছে। এ সভায় শেখ আবদুল আজিজ, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনার পক্ষে জোরালো বক্তব্য শুরু করলে চক্রান্তকারীরা উল্লাসমুখর হয়ে ওঠে। ওই পরিস্থিতিতে ময়েজউদ্দিন আহমদ নাটকীয়ভাবে মঞ্চে উঠে শেখ আজিজকে শার্টের কলার ধরে ধাক্কা দিয়ে মঞ্চ থেকে ফেলে দিয়ে নিজে প্রধানমন্ত্রীর সমর্থনে এক আবেগময়ী জোরালো ভাষণ দেন। ২৩৯ এমপিএ ও ১৩৫ এমএনএ উপস্থিত থাকা ওই সভায় তাজউদ্দীন আহমদের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ময়েজউদ্দিন আহমদ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুনি মোশতাক আহূত এমপিদের সভায়ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে জোরালো বক্তব্য দিয়েছিলেন। চক্রান্তকারী মোশতাক গংয়ের উদ্দেশ্য ছিল তাজউদ্দীনকে সরিয়ে মোশতাককে প্রধানমন্ত্রী করা। আর যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ইরানের শাহের মধ্যস্থতায় পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করা।

মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি তার ওই গ্রন্থে আরও লিখেছেন, ’৭১-এর ১১ জুলাই কলকাতার থিয়েটার রোডে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের সভাপতিত্বে সেক্টর কমান্ডারদের এক সভার কথা। এতে বলা হয়, মেজর জিয়াউর রহমান একপর্যায়ে ওই সভায় অবিলম্বে একটি যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব করেন।

প্রস্তাবে কর্নেল ওসমানীকে প্রধান সেনাপতির পদ থেকে সরিয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রী করার কথা বলা হয়। এ প্রস্তাবের উদ্দেশ্য ছিল দুটি। ওই প্রস্তাব গৃহীত হলে যুদ্ধ পরিচালনার ব্যাপারে একদিকে সামরিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে, অন্যদিকে ওসমানী অপসারিত হলে সর্ব জ্যেষ্ঠ সামরিক অফিসার মেজর জিয়া প্রধান সেনাপতি হবেন। মেজর সফিউল্লাহ ও মেজর খালেদের বিরোধিতার কারণে যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনে মেজর জিয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়নি। ওই প্রস্তাবের পর কর্নেল ওসমানী পদত্যাগ করেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন অনেক বুঝিয়ে ওসমানীকে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারে রাজি করান। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মেজর জিয়ার সঙ্গে কর্নেল ওসমানীর সম্পর্কের অবনতি ঘটে। যার জন্য স্বাধীনতাযুদ্ধকালে (’৭১) মেজর জিয়াকে তিনবার গ্রেফতার করতে প্রধান সেনাপতি ওসমানী নির্দেশ দিয়েছিলেন। (জাতীয় সংসদে উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ এ তথ্য দেন। মেজর রফিকের লেখা নিবন্ধ। মাহবুব করিম সম্পাদিত ‘তাজউদ্দীন আহমদ-নেতা ও মানুষ’ গ্রন্থ, পৃষ্ঠা-৮৯)।

তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলামের সুযোগ্য, দূরদর্শী ও সফল নেতৃত্বে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পর ১২ জানুয়ারি ’৭২ বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭৪-এর ২৬ অক্টোবর অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ পদত্যাগ করেন। মোশতাক ও উচ্চাভিলাষী চক্রান্তকারীরা অবশেষে সফল হলো। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইতিহাসবিদরা নিশ্চয়ই একদিন একমত হবেন, ভারতের গান্ধী-নেহরু, চীনের মাও-চৌএনলাইয়ের মতো আরেক সফল জুটি ছিলেন বাংলাদেশের মুজিব-তাজউদ্দীন জুটি। ওই দুই জুটির মতো মুজিব-তাজউদ্দীন সম্পর্ক জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এক ও অভিন্ন থাকলে ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট যেমন এত তাড়াতাড়ি সংঘটিত হতো না, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশকেও জিয়া-এরশাদ চক্র ‘মিনি পাকিস্তান’ বানাতে পারত না। দুর্ভাগ্য বাঙালি জাতির, গত চার দশকে স্বাধীনতাবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীরাই বারবার বিজয়ী হয়েছেÑ আর চক্রান্তের শিকার হয়েছেন জাতির পিতা, জাতীয় নেতা, কয়েকজন সেক্টর কমান্ডারসহ মুক্তিযোদ্ধারা।

মুজিবনগর সরকারের নেতাদের সত্যিকার মূল্যায়ন করার সময় এসেছে। তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী ও কামারুজ্জামানের কবর আর কতদিন অবহেলিত থাকবে? তবে স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস রচনা করতে গেলে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু মুজিবের পরে অবধারিতভাবেই তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং যুদ্ধকালীন সরকারের মন্ত্রী মনসুর-কামারুজ্জামানের নাম আসবে। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবসে ওই সরকারের মহানায়ক ও নায়কদের পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। সবশেষে তাজউদ্দীন আহমদ ও তার কবরকে নিয়ে আবদুল গাফফার চৌধুরীর একটি উদ্ধৃতি (‘তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও মানুষ’ গ্রন্থ, পৃষ্ঠা ৫৫-৫৬) দিয়েই আজকের লেখার সমাপ্তি টানছি। তিনি লিখেছেন, ‘যে মহামানব এদেশের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন, আত্মদান করেছেন, তার সমাধির ওপর একটা আচ্ছাদনও আজ নেই। তার নামও আজ ইতিহাস থেকে প্রায় লুপ্ত। আর ইতিহাস বিকৃতির যিনি হোতা, স্বাধীনতার নায়কদের হত্যার নীলনকশা অনুমোদনকারীদের মধ্যে যিনি নিজেও ছিলেন বলে আজ উচ্চারিত অভিযোগ, যার ক্ষমতালোলুপতা দেশে রক্তপাতের পর রক্তপাত ঘটিয়েছে, চক্রান্তেরই সেই পালের গোদা [জিয়াউর রহমান] এখন শহীদ বলে কীর্তিত। তার কবরকে বলা হয় মাজার।...’

১৩ এপ্রিল, ২০১৯

[লেখক : সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা সম্পাদক]

bandhu.ch77@yahoo.com

দৈনিক সংবাদ : ১৬ এপ্রিল ২০১৯, মঙ্গলবার, ৭ এর পাতায় প্রকাশিত

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

মুজিবনগর সরকারের দূরদর্শী নেতৃত্ব

মোহাম্মদ শাহজাহান

মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০১৯

১৭ এপ্রিল বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। ১৯৭১-এর এ দিনে কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের আম্রকাননে একাত্তরে যুদ্ধ পরিচালনাকারী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। শত্রুর কারাগারে বন্দী থাকা সত্ত্বেও স্বাভাবিকভাবেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকেই ওই সরকারের রাষ্ট্রপতি করা হয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন তাজউদ্দীন আহমদ। দেশি-বিদেশি বিভিন্নমুখী ষড়যন্ত্রের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে ওই সময় সরকার পরিচালনা করতে হয়। অনেকের অভিমত, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন বলেই একাত্তরে ৯ মাসের যুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। মোশতাক গং শুরু থেকেই চায়নি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হন। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে প্রভাবশালী যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি যে কোন কারণেই হোক তাজউদ্দীন আহমদের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পক্ষে ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানের আন্তরিক সমর্থন ও সহযোগিতায় তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের মূল ভিত্তি হচ্ছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। ১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সভায় ওই ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। তাজউদ্দীন সরকারই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র, রসদ, টাকা, ট্রেনিং প্রদান, এক কোটি শরণার্থীর দেখাশোনা ভারতের সহায়তায় মুজিবনগর সরকারকেই করতে হয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পর তাজউদ্দীন-নজরুল সরকার ভারত থেকে বাংলাদেশে এসে স্বাধীন বাংলাদেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে কোন স্বাধীন ভূখন্ড ছিল না। ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশ। ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালে প্রথমবারের মতো স্বাধীনতা অর্জন করে। এ সময় বীরের জাতি হিসেবে বাঙালির সুখ্যাতি বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

২৫ মার্চে পাকিস্তানিদের আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা রক্ষার জন্য হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু পাকিস্তানি আঘাতের পর আওয়ামী লীগ নেতারা একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। কে জীবিত আছেন, কে নেই, তাও কারও জানা ছিল না। বঙ্গবন্ধু কোথায়? তিনি কি অবস্থায় রয়েছেন? তিনি গ্রেফতার হয়েছেন নাকি পাকিস্তানি দস্যুরা তাকে হত্যা করেছে, একথাও কেউ জানে না। তবে সবচেয়ে নিষ্ঠুর সত্য হলো, মুক্তি সংগ্রামের মূল নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন শত্রুর হেফাজতে বন্দী। তাজউদ্দীন উপলব্ধি করেন, ‘স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনার জন্য জরুরিভাবে একটি সরকার গঠন করা প্রয়োজন। প্রয়োজন একটি বেতার স্টেশনের।’ কিন্তু ২৫ মার্চের আঘাতের ১১-১২ দিন পরও কোন নেতার হদিস পাওয়া যাচ্ছিল না। একমাত্র লোক আমীর-উল-ইসলাম, যার সঙ্গে তাজউদ্দীন পরামর্শ করতে পারেন। তবে যে কোনো কারণেই হোক, বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতারের পরÑ পরবর্তী সরকারের গঠন প্রণালী নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধুও দিয়ে যাননি।

অন্য সব প্রধান নেতাদের অনুপস্থিতিতে কে সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান হবেন, উপরের সারির নেতারা কে কোথায় রয়েছেন, কেউ গ্রেফতার বা নিহত হয়েছেন কিনা, এসব কোন কিছুই তাজউদ্দীন আহমদের তখনও জানা ছিল না। প্রথম সাক্ষাতের এক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি দ্বিতীয়বারের মতো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ নিয়ে মতবিনিময় করেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের পরামর্শে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপ্রধান, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপ্রধান করে তাজউদ্দীন নিজেই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন। শত্রুর হাতে বন্দী বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি এবং তখনো দেখা মিলেনি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি করাটাও কম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ছিল না। ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠনের কথা বেতারের মাধ্যমে বিশ্ববাসী জেনে যায়। ১০ এপ্রিল প্রচারের জন্য প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণও রেকর্ড করা হয়। ইতোমধ্যে শেখ ফজলুল হক মণির নেতৃত্বে যুব ও ছাত্র নেতারাসহ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা কলকাতা পৌঁছে তাজউদ্দীন আহমদের প্রধানমন্ত্রী হওয়াসহ সরকার গঠনের ব্যাপারে ভিন্ন মত প্রকাশ করেন। ১০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পূর্বাপর পরিস্থিতি বর্ণনা করে এক গুরুত্বপূর্ণ দীর্ঘ ভাষণ দেন। প্রধানমন্ত্রীর এ ভাষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক অমূল্য দলিল হিসেবেই বিবেচিত হয়। ১০ এপ্রিলের পর প্রথমে এম মনসুর আলী ও কামারুজ্জামান, তারপর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবদুল মান্নান এবং আরও পরে খন্দকার মোশতাকসহ অন্য নেতারা কলকাতা পৌঁছেন। মোশতাক ও যুবনেতাদের বিরোধিতা সত্ত্বেও সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানের সমর্থন ও সহযোগিতায় তাজউদ্দীন আহমদ ঘোষিত সরকার বহাল থেকে যায়।

১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের মাটিতে মেহেরপুরের আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। অনুষ্ঠানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম রচিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আরেকটি অমূল্য দলিল হয়ে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন তাৎক্ষণিকভাবে প্রবাসী সরকারের রাজধানীর নামকরণ করেন মুজিবনগর। পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক, কয়েকজন যুব ও ছাত্রনেতাসহ বেশকিছু আওয়ামী লীগ নেতার অসহযোগিতা এবং বিরোধিতার মুখেও সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী ও কামারুজ্জামানের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতায় স্বাধীনতা যুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তি ঘটাতে সক্ষম হন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। মোশতাকগং আমেরিকার চক্রান্তে একবার ধুয়া তোলে, ‘স্বাধীনতা পেলে শেখ মুজিবকে জীবিত পাওয়া যাবে না, আর শেখ মুজিবকে পেলে স্বাধীনতা পাওয়া যাবে না।’ ওই কঠিন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের এমএনএ ও এমপিএদের এক যৌথ সভায় তাজউদ্দীন আহমদ তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণে যুক্তিতর্ক দিয়ে বুঝিয়ে বলেন, ‘আমরা স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু দুটিই চাই। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটিকে চাই না।’ প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ এতটাই প্রাণস্পর্শী ও যুক্তিযুক্ত ছিল যে, কয়েকজন চক্রান্তকারী ছাড়া সভায় উপস্থিত সবার উচ্চস্বরে তাজউদ্দীনের সমর্থনে সেøাগান দিতে থাকেন।

আরেকবার ওই বিপদ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও তাজউদ্দীনকে রক্ষা করেন ময়েজউদ্দিন আহমদ। ভারতে তাজউদ্দীন বিরোধী ষড়যন্ত্র জোরালো হয়ে উঠলে মিসেস গান্ধী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনকে এমপিএ ও এমএনদের আস্থা নিতে বলেন। ’৭১-এর ৫ জুলাই জলপাইগুড়িতে আওয়ামী লীগের জনপ্রতিনিধিদের ওই সভা হয়। মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসির (সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিক নন) ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী সরকার’ গ্রন্থে ওই সভার কথা লিপিবদ্ধ হয়েছে। এ সভায় শেখ আবদুল আজিজ, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনার পক্ষে জোরালো বক্তব্য শুরু করলে চক্রান্তকারীরা উল্লাসমুখর হয়ে ওঠে। ওই পরিস্থিতিতে ময়েজউদ্দিন আহমদ নাটকীয়ভাবে মঞ্চে উঠে শেখ আজিজকে শার্টের কলার ধরে ধাক্কা দিয়ে মঞ্চ থেকে ফেলে দিয়ে নিজে প্রধানমন্ত্রীর সমর্থনে এক আবেগময়ী জোরালো ভাষণ দেন। ২৩৯ এমপিএ ও ১৩৫ এমএনএ উপস্থিত থাকা ওই সভায় তাজউদ্দীন আহমদের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ময়েজউদ্দিন আহমদ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুনি মোশতাক আহূত এমপিদের সভায়ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে জোরালো বক্তব্য দিয়েছিলেন। চক্রান্তকারী মোশতাক গংয়ের উদ্দেশ্য ছিল তাজউদ্দীনকে সরিয়ে মোশতাককে প্রধানমন্ত্রী করা। আর যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ইরানের শাহের মধ্যস্থতায় পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করা।

মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি তার ওই গ্রন্থে আরও লিখেছেন, ’৭১-এর ১১ জুলাই কলকাতার থিয়েটার রোডে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের সভাপতিত্বে সেক্টর কমান্ডারদের এক সভার কথা। এতে বলা হয়, মেজর জিয়াউর রহমান একপর্যায়ে ওই সভায় অবিলম্বে একটি যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব করেন।

প্রস্তাবে কর্নেল ওসমানীকে প্রধান সেনাপতির পদ থেকে সরিয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রী করার কথা বলা হয়। এ প্রস্তাবের উদ্দেশ্য ছিল দুটি। ওই প্রস্তাব গৃহীত হলে যুদ্ধ পরিচালনার ব্যাপারে একদিকে সামরিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে, অন্যদিকে ওসমানী অপসারিত হলে সর্ব জ্যেষ্ঠ সামরিক অফিসার মেজর জিয়া প্রধান সেনাপতি হবেন। মেজর সফিউল্লাহ ও মেজর খালেদের বিরোধিতার কারণে যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনে মেজর জিয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়নি। ওই প্রস্তাবের পর কর্নেল ওসমানী পদত্যাগ করেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন অনেক বুঝিয়ে ওসমানীকে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারে রাজি করান। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মেজর জিয়ার সঙ্গে কর্নেল ওসমানীর সম্পর্কের অবনতি ঘটে। যার জন্য স্বাধীনতাযুদ্ধকালে (’৭১) মেজর জিয়াকে তিনবার গ্রেফতার করতে প্রধান সেনাপতি ওসমানী নির্দেশ দিয়েছিলেন। (জাতীয় সংসদে উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ এ তথ্য দেন। মেজর রফিকের লেখা নিবন্ধ। মাহবুব করিম সম্পাদিত ‘তাজউদ্দীন আহমদ-নেতা ও মানুষ’ গ্রন্থ, পৃষ্ঠা-৮৯)।

তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলামের সুযোগ্য, দূরদর্শী ও সফল নেতৃত্বে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পর ১২ জানুয়ারি ’৭২ বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭৪-এর ২৬ অক্টোবর অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ পদত্যাগ করেন। মোশতাক ও উচ্চাভিলাষী চক্রান্তকারীরা অবশেষে সফল হলো। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইতিহাসবিদরা নিশ্চয়ই একদিন একমত হবেন, ভারতের গান্ধী-নেহরু, চীনের মাও-চৌএনলাইয়ের মতো আরেক সফল জুটি ছিলেন বাংলাদেশের মুজিব-তাজউদ্দীন জুটি। ওই দুই জুটির মতো মুজিব-তাজউদ্দীন সম্পর্ক জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এক ও অভিন্ন থাকলে ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট যেমন এত তাড়াতাড়ি সংঘটিত হতো না, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশকেও জিয়া-এরশাদ চক্র ‘মিনি পাকিস্তান’ বানাতে পারত না। দুর্ভাগ্য বাঙালি জাতির, গত চার দশকে স্বাধীনতাবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীরাই বারবার বিজয়ী হয়েছেÑ আর চক্রান্তের শিকার হয়েছেন জাতির পিতা, জাতীয় নেতা, কয়েকজন সেক্টর কমান্ডারসহ মুক্তিযোদ্ধারা।

মুজিবনগর সরকারের নেতাদের সত্যিকার মূল্যায়ন করার সময় এসেছে। তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী ও কামারুজ্জামানের কবর আর কতদিন অবহেলিত থাকবে? তবে স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস রচনা করতে গেলে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু মুজিবের পরে অবধারিতভাবেই তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং যুদ্ধকালীন সরকারের মন্ত্রী মনসুর-কামারুজ্জামানের নাম আসবে। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবসে ওই সরকারের মহানায়ক ও নায়কদের পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। সবশেষে তাজউদ্দীন আহমদ ও তার কবরকে নিয়ে আবদুল গাফফার চৌধুরীর একটি উদ্ধৃতি (‘তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও মানুষ’ গ্রন্থ, পৃষ্ঠা ৫৫-৫৬) দিয়েই আজকের লেখার সমাপ্তি টানছি। তিনি লিখেছেন, ‘যে মহামানব এদেশের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন, আত্মদান করেছেন, তার সমাধির ওপর একটা আচ্ছাদনও আজ নেই। তার নামও আজ ইতিহাস থেকে প্রায় লুপ্ত। আর ইতিহাস বিকৃতির যিনি হোতা, স্বাধীনতার নায়কদের হত্যার নীলনকশা অনুমোদনকারীদের মধ্যে যিনি নিজেও ছিলেন বলে আজ উচ্চারিত অভিযোগ, যার ক্ষমতালোলুপতা দেশে রক্তপাতের পর রক্তপাত ঘটিয়েছে, চক্রান্তেরই সেই পালের গোদা [জিয়াউর রহমান] এখন শহীদ বলে কীর্তিত। তার কবরকে বলা হয় মাজার।...’

১৩ এপ্রিল, ২০১৯

[লেখক : সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা সম্পাদক]

bandhu.ch77@yahoo.com

দৈনিক সংবাদ : ১৬ এপ্রিল ২০১৯, মঙ্গলবার, ৭ এর পাতায় প্রকাশিত

back to top