মো. আবদুর রহমান
ব্লাস্ট ধানের একটি ছত্রাকজনিত মারাত্মক ক্ষতিকারক রোগ। পাইরিকুলারিয়া ওরাইজি (Pyriculria Orayzai) নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে। অনুকূল আবহাওয়ায় রোগটি দ্রুত বিস্তার লাভ করে এবং ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে। রোগপ্রবণ জাতের ধানে রোগ সংক্রমণ হলে ফলন শতভাগ পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
বোরো ও আমন মৌসুমে ব্লাস্ট রোগ বেশি হয়। চারা অবস্থা থেকে শুরু করে ধান পাকার আগ পর্যন্ত যে কোন সময় এ রোগ দেখা যায়। এটি ধানের পাতা, গিঁট এবং নেক বা শিষে আক্রমণ করে থাকে। তাই এ রোগটি পাতা ব্লাস্ট, গিঁট ব্লাস্ট ও নেক বা শিষ ব্লাস্ট নামে পরিচিত। এ রোগ বীজের মাধ্যমে এক মৌসুম হতে অন্য মৌসুমে ছড়ায়। এছাড়া ব্লাস্ট রোগের জীবাণু বাতাস ও পোকা-মাকড়ের মাধ্যমে এক জমি থেকে অন্য জমিতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এর জীবানু দ্বারা ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সতেজ ধান গাছ আক্রান্ত হয়। আর যেখানেই অনুকূল পরিবেশ পায় সেখানেই জীবাণু ধান গাছের উপর পড়ে রোগ সৃষ্টি করে।
গত দু’বছর ধরে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ সারা দেশে বোরো ধানে ব্লাস্ট রোগের ব্যাপক আক্রমণ দেখা দেয়। বিশেষ করে ব্রিধান-২৮ জাতের বোরো ধানে এ রোগের আক্রমণ সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। ফলন ও গুণগতমান বিবেচনায় স্বল্প জীবনকালের ধানের এ জাতটি কৃষকদের কাছে খুবই জনপ্রিয় ও সমাদৃত। এক তথ্যে জানা যায়, বোরো মৌসুমে দেশের আবাদি ৪১ ভাগ জমিতে এবং আউশ মৌসুমে ২৯ ভাগ জমিতে ব্রিধান-২৮ এর চাষ হয়। বোরো মৌসুমে ব্রিধান-২৮ ও ব্রিধান-২৯ জাতের ধান সম্মিলিতভাবে ৬৫-৬৭ ভাগ জমিতে চাষ হয়। ব্রিধান-২৮ ছাড়াও এবছর বি.আর-২৬, ব্রিধান-২৯, ব্রিধান-৫০, ব্রিধান-৬১ ও ব্রিধান-৬৩সহ অন্যান্য জাতের ধানেও ব্লাস্টের সংক্রমণ ঘটেছে। অন্যদিকে হাইব্রিড জাতের ধানে ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া রোগ উল্লেখ যোগ্য ভাবে দেখা যায়। আগে সাধারণত ধানে পাতা ব্লাস্টের প্রকোপ বেশি দেখা গেলেও এবছর শিষ ব্লাস্টের আক্রমণ ছিল সর্বাধিক। কোথাও কোথাও আবার নোড বা গিঁট ব্লাস্টের ব্যাপক আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়। তবে উচ্চ ফলনশীল জাতের বোরো ধানের মধ্যে ব্রিধান-৫৮, ব্রিধান-৬৭ ও ব্রিধান-৬৯ জাতের ধানে ব্লাস্ট রোগ পরিলক্ষিত হয়নি। এছাড়া যেসব কৃষক ভাই রোগ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ধান গাছে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করেছেন তাদের জমির ধানে ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ কম হয়েছে।
পাতা ব্লাস্ট, গিঁট ব্লাস্ট ও শিষ ব্লাস্ট- এই তিন ধরনের ব্লাস্ট রোগের মধ্যে নেক বা শিষ ব্লাস্ট ধানের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ রোগের অনুকূল আবহাওয়া তৈরি হওয়ায় গত দু’বছর ধানে ব্লাস্ট রোগের ব্যাপক আক্রমণ হয়েছে। দিনের বেলায় গরম (২৫০-২৮০ সেন্টিগ্রেড) ও রাতে ঠান্ডা (২০০-২২০ সেন্টিগ্রেড), শিশিরে ভেজা দীর্ঘ সকাল, অধিক আদ্রতা (৮৫% বা তার অধিক), মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, আগাম বৃষ্টিপাত, ঝড়ো আবহাওয়া ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, ধানের জমি শুকনো থাকা, জমিতে মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া সার ব্যবহার এবং প্রয়োজনের তুলনায় কম পরিমাণে পটাশ সার দেয়ার কারণে এ রোগের প্রকোপ বেড়েছে।
রোগের লক্ষণ :
পাতা ব্লাস্ট : পাতা ব্লাস্টের বেলায় চারা অবস্থায় ধানের পাতা আক্রান্ত হয়। প্রথমে পাতায় ছোট ছোট কালচে বাদামি দাগ দেখা যায়। আস্তে আস্তে এ দাগ বড় হয়ে দু’প্রান্ত লম্বা হয়ে চোখের আকৃতি ধারণ করে। দাগের চারদিকের অংশ গাঢ় বাদামি ও মাঝের অংশ সাদা ছাই রঙের হয়। একটি পাতায় একাধিক দাগ হতে পারে। কয়েকটি দাগ একত্রে মিশে গিয়ে পুরো পাতাই শুকিয়ে মরে যায়। এমনিভাবে সমস্ত পাতা আক্রান্ত হলে গাছটি আস্তে আস্তে ছাই রঙের হয়ে মরে যায়। পাতা ব্লাস্টের কারণে পাতায় খাদ্য তৈরি ব্যাহত হয়।
গিঁট ব্লাস্ট : এ রোগ ধান গাছে থোড় বের হবার আগে থেকেই দেখা যায়। এ অবস্থায় রোগ জীবাণু ছত্রাক ধান গাছের কা-ের গিঁটে এবং খোল ও পাতার সংযোগ স্থলে আক্রমণ করে কালো দাগ সৃস্টি করে পচিয়ে দেয়। পরে সেখানে সাদা সাদা ছত্রাক জীবাণু দেখা যায়। পরে আক্রান্ত গিঁটের উপরের অংশ ভেঙে ঝুলে পড়ে।
শিষ ব্লাস্ট : এ অবস্থায় শিষের গোড়ায় কালো দাগের সৃষ্টি করে গোড়াটি পচিয়ে দেয়। ফলে শিষটি গোড়ার দিকে শুকিয়ে যায়। একারণে ধান গাছের খাবার শিষে যেতে পারে না। এতে শিষ নুয়ে পড়ে ও শিষ শুকিয়ে ধান চিটা হয়ে যায়।
রোগ প্রতিরোধের উপায় :
* রোগ প্রতিরোধক্ষম জাতের বোরো ধান যেমন - ব্রিধান-৫৮, ব্রিধান-৬৭ ও ব্রিধান-৬৯ এর চাষ করতে হবে। এসব জাতের ধানে এখনও ব্লাস্ট রোগ পরিলক্ষিত হয়নি।
* মাটিতে পর্যাপ্ত জৈবসারসহ সুষম মাত্রায় সব ধরনের রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ইউরিয়া সার ব্যবহার করা উচিত নয়। ইউরিয়া সার তিন কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। পটাশ সার সমান দুইভাগে ভাগ করে প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম ভাগ জমি তৈরির সময় এবং দ্বিতীয় ভাগ শেষ কিস্তি ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগের সময় ব্যবহার করতে হবে।
* আক্রান্ত জমি থেকে বীজ সংগ্রহ না করে সুস্থ এবং রোগমুক্ত জমির ধান গাছ থেকে বীজ সংগ্রহপূর্বক শোধন করে ব্যবহার ব্যবহার করতে হবে।
* ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত জমির ধান কাটার পর, খড়-কুটো পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং ছাই জমিতে মিশিয়ে দিতে হবে।
* প্রয়োজন বোধে ধানের জমিতে পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।
* সেসব জমির ধান শিষ ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়নি অথচ এলাকায় রোগের অনুকূল আবহাওয়া (গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ও কুয়াশাচ্ছন্ন মেঘলা আকাশ) বিরাজমান সেখানকার জমির ধান গাছে রোগ হোক বা না হোক থোড় আসার পর একবার এবং ফুল আসার পর আর একবার ১ নং সারণিতে বর্ণিত যে কোন একটি ছত্রাকনাশক শেষ বিকেলে ৫-৭ দিন অন্তর দু’বার প্রয়োগ করতে হবে। এতে ব্লাস্ট রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
সারণি : ১। ধানের ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধের জন্য অনুমোদিত ছত্রাকনাশকের নাম ও প্রয়োগমাত্রা
ছত্রাকনাশকের নাম ১০ লিটার পানিতে প্রয়োগমাত্রা (৫ শতাংশ জমির জন্য)
ট্রুপার-৭৫ ডব্লিউপি ৮ গ্রাম
নাটিভো-৭৫ ডব্লিউজি ৬ গ্রাম
ব্লাস্টটিন-৭০ ডব্লিউজি ১০ গ্রাম
ফিলিয়া—৫২৫ এসই ২০ গ্রাম
সেলটিমা ২০ গ্রাম
নোভিটা-৭৫ ডব্লিউজি ৬ গ্রাম
জিল-৭৫ ডব্লিউপি ৭.৫ গ্রাম
রোগ দমন ব্যবস্থা : ব্লাস্ট রোগের প্রাথমিক অবস্থায় জমিতে ১-২ ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে পারলে এ রোগের ব্যাপকতা অনেকাংশে হ্রাস পায়। ধানের কুশি অবস্থায় পাতা ব্লাস্ট রোগ দেখা দিলে একর প্রতি অতিরিক্ত ১৫ কেজি পটাশ সার উপরি প্রয়োগ করে সেচ দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এছাড়া ব্লাস্ট আক্রান্ত ধানের জমিতে ইউরিয়া সারের উপরি প্রয়োগ সাময়িক বন্ধ রাখতে হবে। সর্বোপরি, ধান গাছে ব্লাস্ট রোগ দেখামাত্র উপরোক্ত সারণিতে বর্ণিত যে কোন একটি ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় শেষ বিকেলে ৫-৭ দিন অন্তর দু’বার প্রয়োগ করতে হবে।
শেষ কথা : ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য। আমাদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় ক্যালোরির শতকরা প্রায় ৮০ ভাগই আসে ভাত থেকে। এদেশের জমি ও আবহাওয়া ধান চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। বাংলাদেশের বিভিন্ন মৌসুমে আবহমানকাল থেকে এফসলের চাষ হয়ে আসছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনুকূল আবহাওয়া তৈরি হওয়ায় ধান ফসলে ব্লাস্টসহ বিভিন্ন ধরনের রোগ ও পোকা-মাকড়ের আক্রমণ ক্রমশ বাড়ছে। এতে প্রতি বছর ধান ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। তাই ধানের এসব ক্ষতিকর রোগ ও পোকা-মাকড় দমনের জন্য কৃষক প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া একান্ত আবশ্যক।
[লেখক : উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি অফিস, খুলনা]
দৈনিক সংবাদ : শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০১৯, ৭ এর পাতায় প্রকাশিত
মো. আবদুর রহমান
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০১৯
ব্লাস্ট ধানের একটি ছত্রাকজনিত মারাত্মক ক্ষতিকারক রোগ। পাইরিকুলারিয়া ওরাইজি (Pyriculria Orayzai) নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে। অনুকূল আবহাওয়ায় রোগটি দ্রুত বিস্তার লাভ করে এবং ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে। রোগপ্রবণ জাতের ধানে রোগ সংক্রমণ হলে ফলন শতভাগ পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
বোরো ও আমন মৌসুমে ব্লাস্ট রোগ বেশি হয়। চারা অবস্থা থেকে শুরু করে ধান পাকার আগ পর্যন্ত যে কোন সময় এ রোগ দেখা যায়। এটি ধানের পাতা, গিঁট এবং নেক বা শিষে আক্রমণ করে থাকে। তাই এ রোগটি পাতা ব্লাস্ট, গিঁট ব্লাস্ট ও নেক বা শিষ ব্লাস্ট নামে পরিচিত। এ রোগ বীজের মাধ্যমে এক মৌসুম হতে অন্য মৌসুমে ছড়ায়। এছাড়া ব্লাস্ট রোগের জীবাণু বাতাস ও পোকা-মাকড়ের মাধ্যমে এক জমি থেকে অন্য জমিতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এর জীবানু দ্বারা ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সতেজ ধান গাছ আক্রান্ত হয়। আর যেখানেই অনুকূল পরিবেশ পায় সেখানেই জীবাণু ধান গাছের উপর পড়ে রোগ সৃষ্টি করে।
গত দু’বছর ধরে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ সারা দেশে বোরো ধানে ব্লাস্ট রোগের ব্যাপক আক্রমণ দেখা দেয়। বিশেষ করে ব্রিধান-২৮ জাতের বোরো ধানে এ রোগের আক্রমণ সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। ফলন ও গুণগতমান বিবেচনায় স্বল্প জীবনকালের ধানের এ জাতটি কৃষকদের কাছে খুবই জনপ্রিয় ও সমাদৃত। এক তথ্যে জানা যায়, বোরো মৌসুমে দেশের আবাদি ৪১ ভাগ জমিতে এবং আউশ মৌসুমে ২৯ ভাগ জমিতে ব্রিধান-২৮ এর চাষ হয়। বোরো মৌসুমে ব্রিধান-২৮ ও ব্রিধান-২৯ জাতের ধান সম্মিলিতভাবে ৬৫-৬৭ ভাগ জমিতে চাষ হয়। ব্রিধান-২৮ ছাড়াও এবছর বি.আর-২৬, ব্রিধান-২৯, ব্রিধান-৫০, ব্রিধান-৬১ ও ব্রিধান-৬৩সহ অন্যান্য জাতের ধানেও ব্লাস্টের সংক্রমণ ঘটেছে। অন্যদিকে হাইব্রিড জাতের ধানে ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া রোগ উল্লেখ যোগ্য ভাবে দেখা যায়। আগে সাধারণত ধানে পাতা ব্লাস্টের প্রকোপ বেশি দেখা গেলেও এবছর শিষ ব্লাস্টের আক্রমণ ছিল সর্বাধিক। কোথাও কোথাও আবার নোড বা গিঁট ব্লাস্টের ব্যাপক আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়। তবে উচ্চ ফলনশীল জাতের বোরো ধানের মধ্যে ব্রিধান-৫৮, ব্রিধান-৬৭ ও ব্রিধান-৬৯ জাতের ধানে ব্লাস্ট রোগ পরিলক্ষিত হয়নি। এছাড়া যেসব কৃষক ভাই রোগ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ধান গাছে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করেছেন তাদের জমির ধানে ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ কম হয়েছে।
পাতা ব্লাস্ট, গিঁট ব্লাস্ট ও শিষ ব্লাস্ট- এই তিন ধরনের ব্লাস্ট রোগের মধ্যে নেক বা শিষ ব্লাস্ট ধানের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ রোগের অনুকূল আবহাওয়া তৈরি হওয়ায় গত দু’বছর ধানে ব্লাস্ট রোগের ব্যাপক আক্রমণ হয়েছে। দিনের বেলায় গরম (২৫০-২৮০ সেন্টিগ্রেড) ও রাতে ঠান্ডা (২০০-২২০ সেন্টিগ্রেড), শিশিরে ভেজা দীর্ঘ সকাল, অধিক আদ্রতা (৮৫% বা তার অধিক), মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, আগাম বৃষ্টিপাত, ঝড়ো আবহাওয়া ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, ধানের জমি শুকনো থাকা, জমিতে মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া সার ব্যবহার এবং প্রয়োজনের তুলনায় কম পরিমাণে পটাশ সার দেয়ার কারণে এ রোগের প্রকোপ বেড়েছে।
রোগের লক্ষণ :
পাতা ব্লাস্ট : পাতা ব্লাস্টের বেলায় চারা অবস্থায় ধানের পাতা আক্রান্ত হয়। প্রথমে পাতায় ছোট ছোট কালচে বাদামি দাগ দেখা যায়। আস্তে আস্তে এ দাগ বড় হয়ে দু’প্রান্ত লম্বা হয়ে চোখের আকৃতি ধারণ করে। দাগের চারদিকের অংশ গাঢ় বাদামি ও মাঝের অংশ সাদা ছাই রঙের হয়। একটি পাতায় একাধিক দাগ হতে পারে। কয়েকটি দাগ একত্রে মিশে গিয়ে পুরো পাতাই শুকিয়ে মরে যায়। এমনিভাবে সমস্ত পাতা আক্রান্ত হলে গাছটি আস্তে আস্তে ছাই রঙের হয়ে মরে যায়। পাতা ব্লাস্টের কারণে পাতায় খাদ্য তৈরি ব্যাহত হয়।
গিঁট ব্লাস্ট : এ রোগ ধান গাছে থোড় বের হবার আগে থেকেই দেখা যায়। এ অবস্থায় রোগ জীবাণু ছত্রাক ধান গাছের কা-ের গিঁটে এবং খোল ও পাতার সংযোগ স্থলে আক্রমণ করে কালো দাগ সৃস্টি করে পচিয়ে দেয়। পরে সেখানে সাদা সাদা ছত্রাক জীবাণু দেখা যায়। পরে আক্রান্ত গিঁটের উপরের অংশ ভেঙে ঝুলে পড়ে।
শিষ ব্লাস্ট : এ অবস্থায় শিষের গোড়ায় কালো দাগের সৃষ্টি করে গোড়াটি পচিয়ে দেয়। ফলে শিষটি গোড়ার দিকে শুকিয়ে যায়। একারণে ধান গাছের খাবার শিষে যেতে পারে না। এতে শিষ নুয়ে পড়ে ও শিষ শুকিয়ে ধান চিটা হয়ে যায়।
রোগ প্রতিরোধের উপায় :
* রোগ প্রতিরোধক্ষম জাতের বোরো ধান যেমন - ব্রিধান-৫৮, ব্রিধান-৬৭ ও ব্রিধান-৬৯ এর চাষ করতে হবে। এসব জাতের ধানে এখনও ব্লাস্ট রোগ পরিলক্ষিত হয়নি।
* মাটিতে পর্যাপ্ত জৈবসারসহ সুষম মাত্রায় সব ধরনের রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ইউরিয়া সার ব্যবহার করা উচিত নয়। ইউরিয়া সার তিন কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। পটাশ সার সমান দুইভাগে ভাগ করে প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম ভাগ জমি তৈরির সময় এবং দ্বিতীয় ভাগ শেষ কিস্তি ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগের সময় ব্যবহার করতে হবে।
* আক্রান্ত জমি থেকে বীজ সংগ্রহ না করে সুস্থ এবং রোগমুক্ত জমির ধান গাছ থেকে বীজ সংগ্রহপূর্বক শোধন করে ব্যবহার ব্যবহার করতে হবে।
* ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত জমির ধান কাটার পর, খড়-কুটো পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং ছাই জমিতে মিশিয়ে দিতে হবে।
* প্রয়োজন বোধে ধানের জমিতে পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।
* সেসব জমির ধান শিষ ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়নি অথচ এলাকায় রোগের অনুকূল আবহাওয়া (গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ও কুয়াশাচ্ছন্ন মেঘলা আকাশ) বিরাজমান সেখানকার জমির ধান গাছে রোগ হোক বা না হোক থোড় আসার পর একবার এবং ফুল আসার পর আর একবার ১ নং সারণিতে বর্ণিত যে কোন একটি ছত্রাকনাশক শেষ বিকেলে ৫-৭ দিন অন্তর দু’বার প্রয়োগ করতে হবে। এতে ব্লাস্ট রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
সারণি : ১। ধানের ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধের জন্য অনুমোদিত ছত্রাকনাশকের নাম ও প্রয়োগমাত্রা
ছত্রাকনাশকের নাম ১০ লিটার পানিতে প্রয়োগমাত্রা (৫ শতাংশ জমির জন্য)
ট্রুপার-৭৫ ডব্লিউপি ৮ গ্রাম
নাটিভো-৭৫ ডব্লিউজি ৬ গ্রাম
ব্লাস্টটিন-৭০ ডব্লিউজি ১০ গ্রাম
ফিলিয়া—৫২৫ এসই ২০ গ্রাম
সেলটিমা ২০ গ্রাম
নোভিটা-৭৫ ডব্লিউজি ৬ গ্রাম
জিল-৭৫ ডব্লিউপি ৭.৫ গ্রাম
রোগ দমন ব্যবস্থা : ব্লাস্ট রোগের প্রাথমিক অবস্থায় জমিতে ১-২ ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে পারলে এ রোগের ব্যাপকতা অনেকাংশে হ্রাস পায়। ধানের কুশি অবস্থায় পাতা ব্লাস্ট রোগ দেখা দিলে একর প্রতি অতিরিক্ত ১৫ কেজি পটাশ সার উপরি প্রয়োগ করে সেচ দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এছাড়া ব্লাস্ট আক্রান্ত ধানের জমিতে ইউরিয়া সারের উপরি প্রয়োগ সাময়িক বন্ধ রাখতে হবে। সর্বোপরি, ধান গাছে ব্লাস্ট রোগ দেখামাত্র উপরোক্ত সারণিতে বর্ণিত যে কোন একটি ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় শেষ বিকেলে ৫-৭ দিন অন্তর দু’বার প্রয়োগ করতে হবে।
শেষ কথা : ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য। আমাদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় ক্যালোরির শতকরা প্রায় ৮০ ভাগই আসে ভাত থেকে। এদেশের জমি ও আবহাওয়া ধান চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। বাংলাদেশের বিভিন্ন মৌসুমে আবহমানকাল থেকে এফসলের চাষ হয়ে আসছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনুকূল আবহাওয়া তৈরি হওয়ায় ধান ফসলে ব্লাস্টসহ বিভিন্ন ধরনের রোগ ও পোকা-মাকড়ের আক্রমণ ক্রমশ বাড়ছে। এতে প্রতি বছর ধান ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। তাই ধানের এসব ক্ষতিকর রোগ ও পোকা-মাকড় দমনের জন্য কৃষক প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া একান্ত আবশ্যক।
[লেখক : উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি অফিস, খুলনা]
দৈনিক সংবাদ : শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০১৯, ৭ এর পাতায় প্রকাশিত