alt

মুক্ত আলোচনা

জাহানারা ইমাম নিরলস যুদ্ধ করেছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে

দিল মনোয়ারা মনু : রোববার, ০৫ মে ২০১৯

আমাদের দেশে যখন মুক্তিযোদ্ধারা সূর্যরশ্মির মতো ছড়িয়ে পড়েন সবখানে, মুক্তিযুদ্ধে যখন হয়ে ওঠেন এক অবিনশ্বর আকাশ, যেখানে অবারিত নীলের মধ্যে জেগে ওঠে কালো মেঘের ছায়া- তখন জাহানারা ইমাম হয়ে ওঠেন সেই প্রত্যয়ী, দুঃসাহসী নারী; যিনি তার গৌরবোজ্জ্বল অবদানে সমৃদ্ধ করেছেন দেশ ও জাতির ইতিহাসকে। বহুমাত্রিক উত্তরাধিকারের নির্মাণ উত্তরসূরিদের হাতে তুলে দেয়ার দায়বদ্ধতা থেকেই তিনি সারাজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এক দুঃসাধ্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম করেছেন তিনি এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে বিভ্রান্ত জাতিকে দেশপ্রেমের এক নতুন মন্ত্রে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। পেয়েছিলেন দেশবাসীর কাছ থেকে শহীদ জননীর মর্যাদায় অভিষিক্ত হওয়ার দুর্লভ সম্মান। ১৯২৯ সালের ৩ মে মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামের এক রক্ষণশীল পরিবারে তার জন্ম। সে সমাজে মেয়েদের জন্য বাংলা ভাষার চর্চা একেবারেই ছিল না। কিন্তু জাহানারা ইমামের উদার সংস্কৃতমনা বাবার কারণে অন্য মেয়েদের মতো তাকে আরবি ও উর্দু পড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হয়নি। বাবার সহযোগিতায় তিনি বাংলা শেখার অবাধ সুযোগ পান। জাহানারা ইমামের মা’কেও তিনি বাংলা শেখাতে শুরু করেছিলেন কিন্তু শেষপর্যন্ত পেরে ওঠেননি। মেয়েকে উপযুক্ত শিক্ষিত করার চেষ্টা তিনি অব্যাহত রেখেছিলেন, আপস করেননি। পারিপার্শ্বিক ও সামাজিক সকল প্রতিকূলতাকে দৃঢ়তার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে সন্তানদের শিক্ষিত করে তুলেছিলেন। বাবার বদলির চাকরি হওয়ার কারণে বাবার সঙ্গে তিনি সারাদেশ প্রায় চষে বেড়িয়েছেন। একটা সময় তাকে শাড়ি পড়তে এবং গৃহবন্দী হয়ে থাকতে হয়। কৈশোরে পড়াশোনার প্রতি দারুণ অনীহা ছিল কিন্তু একটি ঘটনা তার সমগ্র চিন্তা-চেতনাকে দারুণভাবে নাড়া দেয়। সেটা হলো বাবার এক বন্ধু যাকে জাহানারা ইমাম মটকা চাচা বলে ডাকতেন, তার কাছ থেকে কিশোরী জাহানারা ইন্দিরা গান্ধী, বিজয় লক্ষ্মী পন্ডিতের আধুনিক পোশাকে সজ্জিত ছবি স্টেটসম্যান পত্রিকায় দেখে মুগ্ধ হন। তার মনন ও চেতনাকে গভীরভাবে নাড়া দেয় সেই ছবি। লেখাপড়ার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং লেখাপড়া শেখায় ব্রতী হন। স্কুলের রেজিস্টার খাতায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত করে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়। বাবা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ায় তার বাড়িতে নানা ধরনের দেশি-বিদেশি পত্রিকা এবং বরণ্য লেখকদের বই আসার ব্যবস্থা ছিল। জাহানারার অবাধ সুযোগ হয় সেই বইগুলো পড়ার। এ তার জন্য এক দুর্লভ সুযোগ। নিজেকে সমৃদ্ধ করেন এর মধ্য দিয়ে। বাড়িতে ওস্তাদের কাছে গান শিখতেন। বিনোদনের জন্য বাড়িতে ছিল কলের গান। ফলে আঙ্গুর বালা, ইন্দু বালা, কমলা ঝড়িয়া, শাহানা দেবী, যুথীকা রায়, আব্বাস উদ্দিন প্রমুখ শিল্পীর গানের সঙ্গে তিনি পরিচিত হন। মটকা চাচার আনা দুর্লভ বই পড়ে টলস্টয়, ভিক্টর হুগো, শেকসপিয়ার, বানার্ড’শ, দস্তয় ভেসকির মতো বরেণ্য সাহিত্যিকদের লেখার সঙ্গে তিনি পরিচিত হন। রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন সম্পর্কে তার প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি হয়, তাই শান্তিনিকেতনে পড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু সংবাদ জানার পর সেই সিদ্ধান্ত বদল করেন। তিনি ভর্তি হন রংপুর কারমাইকেল কলেজে। অতঃপর ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে বিএড ডিগ্রি অর্জনের পর ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সার্টিফিকেট ইন ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি নেন ১৯৬৫ সালে।

শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, বিদ্যাময়ী গার্লস স্কুল, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন।

রংপুর কলেজে পড়ার সময় প্রেম হয় মোহাম্মদ আলী উকিলের ছেলে ইঞ্জিনিয়ার শহীদ ইমামের সঙ্গে। ১৯৪৮ সালে সব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে পরিবারিকভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। প্রগতিশীল আধুনিক দুটি মানুষ বিয়ে করেন সাধারণ আয়োজনে সাদা কাপড় ও অলংকার বিহীনভাবে। এ বিয়ে সেই সময়ে প্রগতিশীল নান্দনিক এক বিয়ে হিসেবে সমাদৃত হয়।

জাহানারা ইমামের রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ জন্মেছিল তার বন্ধুদের কাছ থেকে কমিউনিজম ধারণায় সমৃদ্ধ হয়ে। কিন্তু তার উদারপন্থি বাবা কমিউস্টিদের জনযুদ্ধ পত্রিকা পড়তে দেখে প্রচন্ড বিরক্ত হন। কারণ তিনি চাইতেন আধুনিক লেখাপড়া শিখুক মেয়ে কিন্তু রাজনীতি নয়। জাহানারা ইমাম এরপর আর রাজনীতিকে স্বাগত জানাননি। ১৯৭১ সালেও কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না তিনি। ’৭১-এর ২৫ মার্চের পর পাকিস্তানি বাহিনীকে জব্দ করার জন্য পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু হলে জাহানারা ইমামের ছেলে রুমী মায়ের কাছে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের তীব্র আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেন। অসাধারণ প্রতিভাবান মননশীল ছেলেটি যুদ্ধে যেতে চাইলে তিনি চিন্তিত হন।

অসহায় বোধ করেন তিনি। কারণ রুমীর উচ্চশিক্ষার্থে আমেরিকা যাওয়ার সব প্রস্তুতি তখন প্রায় শেষ। তার সত্যবাদী যুক্তিনিষ্ঠ মন দ্বিধান্বিত হয়। আত্মপ্রত্যয়ী রুমী বলেন, দেশের এ রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে যেতে না দাও, জোর করে আমেরিকা পাঠাও, আমি হয়তো যাব কিন্তু বিবেকের কাছে অপরাধী হয়ে থাকব চিরদিন। যত বড় ইঞ্জিনিয়ারই হই না কেন বিবেকের দংশন কুরে কুরে খাবে আমাকে। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে মনকে শক্ত করে ছেলেকে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দেন তিনি ১৯৭১ সালের ৭ মে। ’৭১-এর পুরো সময়টা তারা মুক্তিযুদ্ধের গতি-প্রকৃতি বিস্তার পর্যবেক্ষণ করেন। যেহেতু রুমী দুই নম্বর সেক্টরে যোগ দেন তাই এ সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলেন। ঢাকায় বসে রুমীর বাবা শরীফ ইমাম ঢাকার ব্রিজ কালভার্টের বিস্তারিত তথ্য এবং কোন ব্রিজ কালভার্ট কোন এক্সপ্লোসিভ দিয়ে উড়ানো সহজ হবে তা বিশদভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের জানান। শুধু তাই নয় প্রচন্ড জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ কাজের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ওষুধ এবং খাবারের রসদ মজুদ রাখার কাজটি নিষ্ঠার সঙ্গে করেন।

এরপর ঘটতে থাকে একের পর এক মনভাঙ্গা ঘটনা, ধানমন্ডিতে ২৫ আগস্ট রুমীর নেতৃত্বে এক দুঃসাহসী অভিযান চলে। ২৯ আগস্ট পাকিস্তানি হানাদাররা রুমীকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। ইন্টাগোরেশনের নামে এ সময় জামী, শরীফ ইমাম, হাফিজ ও মাসুমকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। অকথ্য নির্যাতন ও সীমাহীন কষ্ট ভোগের পর দু’দিনের মাথায় ছেড়ে দেয়। এরপর অন্তহীন প্রচেষ্টা চালায় এ পরিবার বিশেষ করে মা জাহানারা ইমাম রুমীকে ছাড়িয়ে আনার জন্য। শেষপর্যন্ত দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে হিতৈষীদের পরামর্শে মার্সি পিটিশন করতেও রাজি হয়েছিলেন কিন্তু অকুতোভয় রুমীর আদর্শের প্রতি অবিচল নিষ্ঠার কারণে এ পিটিশন তারা শেষ পর্যন্ত করেননি। ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর বিজয় যখন দোরগোরায় তখনও অসাধারণ জাহানারা ইমাম বোমার ভয়ে আক্রান্ত আত্মীয়স্বজন প্রতিবেশীসহ পঁয়তাল্লিশজনকে বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে তাদের দেখাশোনার ভার নেন। অথচ বুকের ভেতরে নিদারুণ কষ্ট, প্রতি মুহূর্তে প্রচন্ড আকুলতা, ছেলে রুমী ভালো আছে তো? কবে ফিরে আসবে?

বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার পর অবশেষে সেই দিন আসে। জন্ম নেয় বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন দেশ। এ আনন্দের পাশাপাশি চলে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে রুমী ফেরার প্রতীক্ষা। হঠাৎ করেই উন্মোচিত হয় সেই কঠিন সত্য। রুমী আর নেই, ফিরে আসবে না কোন দিন তার স্বপ্নের বাংলাদেশে। এই পরিবারের সবার জীবনে তাই স্বাধীনতা আসে এক আনন্দ বেদনার কাব্য হয়ে।

কঠিন সত্য অদম্য ভালোবাসাকে বুকে বেঁধে তিনি মুক্তিযুদ্ধোত্তর দেশকে গড়ে তোলার সাধনায় ব্রতী হন। ১৯৭১ সালে জাহানারা ইমাম যুক্ত হন শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্ত দাবির আন্দোলনে। তার সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন শহীদ পরিবারের সদস্যদের। ১৯৮০ সালে গঠন করেন সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদবিরোধী নাগরিক কমিটি। কিন্তু এ সময়ে বাধা হয়ে দাঁড়াল তার দেহে এক মরণব্যাধি। তিনি আক্রান্ত হলেন ক্যান্সারে। তিনি হতাশ বা হতোদ্যম হলেন না। তার সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল নিজেকে এবং চারপাশকে আলোকিত করার, সেই লক্ষ্যে শত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও নিজেকে তৈরি করেছেন, পেশাগত জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন এবং জীবনের শেষপর্যায়ে এক নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশকে এবং নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এক অনন্য মর্যাদায়। সামনে নিয়ে এসেছেন এক কঠিন সত্যকে। শুধু তাই নয়, চিহ্নিত করে বিচারের সম্মুখীন করেছেন মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের। ১৯৯২ সালে জাহানারা ইমাম ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক হন। ১০১ জন সদস্যর এ কমিটির মাধ্যমে তিনি ১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গোলাম আযমের বিচারের জন্য গণআদালত গঠন এবং সেই আদালতে তার বিচার হবে বলে ঘোষণা দেন। ঘটতে থাকে একের এক চমকপ্রদ ও সাহসী ঘটনা। জাহানারা ইমামের প্রতি জনসমর্থন ছিল অপ্রত্যাশিত। যার জন্য প্রধান বিরোধী দলসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তি সেদিন একত্রিত হন। স্বল্প সময়ের মধ্যে সারাদেশে এর ব্যাপক বিস্তার ঘটে। তৈরি হয় এ চেতনার আলোকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নামে এক বৃহত্তম মোর্চা। মূলত জাহানারা ইমামকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে এই নতুন ধরনের এ বহুমুখী আন্দোলন প্রাণ পায়। গুরুতর মতভেদ থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন ব্যক্তিত্বদের তিনি গণআন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে পেরেছিলেন। এক ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতিক সহিষ্ণুতাই এই কর্মসূচির প্রধান সূচক হিসেবে বিবেচিত হয়। আর এর উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে জনসভায় তার বলিষ্ঠ কন্ঠের ভাষণ এবং শাণিত লেখনীর মাধ্যমে গভীর প্রত্যয় ব্যক্ত করার অনুপম শৈলী।

গণআদালতের রায় বাস্তবায়নের দাবিতে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে লাখো জনতার মিছিল হয় ১৯৯২ সালের ১২ এপ্রিল। তারা সংসদে এই দাবি সংবলিত স্মারকলিপি পেশ করেন এবং ১০০ জন সাংসদ এ রায়ের পক্ষে সমর্থন দেন। প্রবল গণআন্দোলনের মুখে ৩০ জুন সংসদে চার দফা চুক্তি করতে সরকার বাধ্য হয়।

এই কমিটির উদ্যোগে এক প্রতিবাদ সমাবেশে তাকে বক্তৃতারত অবস্থায় পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। ১৯৯৩ সালে ক্যান্সারের প্রকোপ বেশি হলে চিকিৎসার জন্য তিনি আবার বিদেশে যান। দেশে ফিরে এসে ১৯৯৪ সালের ২৫ মার্চ তার উদ্যোগে শহীদ মিনারে কালো রাতের বুক চিরে জ¦লে ওঠে হাজার মোমের শিখা। সেদিন এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এই আন্দোলনকে সমর্থন দেন ইউরোপিয় ইউনিয়ন। ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এ আন্দোলের ব্যাপক ব্যাপ্তি ঘটে। জাহানারা ইমাম একজন শক্তিমান লেখক, লেখালেখি শুরু করেন ষাটের দশকে। শিশুদের জন্য লেখা দিয়েই তার আত্মপ্রকাশ কিন্তু প্রচন্ড খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা পান ‘একাত্তরের দিনগুলো’ গ্রন্থের জন্য। ‘ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস’ গ্রন্থটিও সহমর্মিতা ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে অসংখ্য পাঠক আপন করে নেন জাহানারা ইমামকে। একথা বলতেই হয় মননশীল গ্রন্থ রচনা করে তিনি সেই সময়ে সময়ের দাবি পূরণ করেছেন তার ভালোবাসা নিষ্ঠা ও একাগ্রতা দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া প্রায় প্রতিটি ঘটনা লিপিবদ্ধ করে তিনি মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যেও সচিত্র সন্ধানী পত্রিকায় তা ধারাবাহিক প্রকাশ করেন। পরবর্তী সময়ে সেই স্মৃতিচারণমূলক অনন্যগাথা ‘একাত্তরের দিনগুলি’ দারুণ ভালোবাসার সঙ্গে বাংলার মানুষ গ্রহণ করেন। তিনি তখন শুধু শহীদ রুমীর মা নন, হয়ে ওঠেন সারাদেশের জনগণের পরম শ্রদ্ধার শহীদ জননী। এই ছোট বাংলাদেশে শুধু দেশকেই নয়, নারীর পৃথিবীকে তিনি অনেক বড় করেছিলেন।

১৯৯৪ সালের ২৬ জুন বাঙালির চেতনার এই প্রদীপ্ত অগ্নিশিখা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। অসম্ভব জীবনবাদী আধুনিক প্রগতিশীল পরমাসুন্দরী এই মহীয়সী নারী জীবনে কখনও হারতে শেখেননি। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী শহীদ জননী মনে করতেন, জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। তাই মৃত্যুর সময় তিনি ঘাতক দালাল নির্মূল সমন্বয় আন্দোলনের দায়িত্ব দিয়ে যান তার প্রিয় জনগণের হাতে। তিনি তার বিশ্বাসী চোখ জনগণের প্রতি রেখে আশা ব্যক্ত করেন- জয় আমাদের হবেই। আজ প্রার্থনা করছি যেখানে আপনি আছেন সেখানে নয়নের মণি রুমীকে আপনি বুকের মধ্যে পান, শরীফ ভাইকে পাশে পান; যাদের আপনি জীবনানন্দ দাসের কবিতার মতো ‘ঘাস ফড়িং’ শালিকের মাঝে খুঁজে বেড়িয়েছেন জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত। ইতিহাসের পথরেখা বেয়ে আমার দুর্লভ সুযোগ হয়েছে অনেক গুণী মানুষের সান্নিধ্যে সহচার্যে আসার। এমনি একজন অমিত তেজী, সাহসী, দেশপ্রেমী, বিচক্ষণ মানুষ পরম শ্রদ্ধার জাহানারা ইমাম। খুব কাছে থেকে দীর্ঘ সৃষ্টিশীল জীবন প্রত্যয়ী এই মানুষটি আমাকে শুভেচ্ছায় সহযোগিতায় বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে অনুপ্রাণিত করেছেন। তার কাছে দেশ ও জাতির মতো আমার ব্যক্তিগত ঋণ অপরিসীম। আজ সশ্রদ্ধ চিত্তে সেই ঋণ স্বীকার করছি। জয়তু শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।

[লেখক : বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক]

দৈনিক সংবাদ : ৫ মে ২০১৯, রোববার, ৭ এর পাতায় প্রকাশিত

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

জাহানারা ইমাম নিরলস যুদ্ধ করেছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে

দিল মনোয়ারা মনু

রোববার, ০৫ মে ২০১৯

আমাদের দেশে যখন মুক্তিযোদ্ধারা সূর্যরশ্মির মতো ছড়িয়ে পড়েন সবখানে, মুক্তিযুদ্ধে যখন হয়ে ওঠেন এক অবিনশ্বর আকাশ, যেখানে অবারিত নীলের মধ্যে জেগে ওঠে কালো মেঘের ছায়া- তখন জাহানারা ইমাম হয়ে ওঠেন সেই প্রত্যয়ী, দুঃসাহসী নারী; যিনি তার গৌরবোজ্জ্বল অবদানে সমৃদ্ধ করেছেন দেশ ও জাতির ইতিহাসকে। বহুমাত্রিক উত্তরাধিকারের নির্মাণ উত্তরসূরিদের হাতে তুলে দেয়ার দায়বদ্ধতা থেকেই তিনি সারাজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এক দুঃসাধ্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম করেছেন তিনি এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে বিভ্রান্ত জাতিকে দেশপ্রেমের এক নতুন মন্ত্রে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। পেয়েছিলেন দেশবাসীর কাছ থেকে শহীদ জননীর মর্যাদায় অভিষিক্ত হওয়ার দুর্লভ সম্মান। ১৯২৯ সালের ৩ মে মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামের এক রক্ষণশীল পরিবারে তার জন্ম। সে সমাজে মেয়েদের জন্য বাংলা ভাষার চর্চা একেবারেই ছিল না। কিন্তু জাহানারা ইমামের উদার সংস্কৃতমনা বাবার কারণে অন্য মেয়েদের মতো তাকে আরবি ও উর্দু পড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হয়নি। বাবার সহযোগিতায় তিনি বাংলা শেখার অবাধ সুযোগ পান। জাহানারা ইমামের মা’কেও তিনি বাংলা শেখাতে শুরু করেছিলেন কিন্তু শেষপর্যন্ত পেরে ওঠেননি। মেয়েকে উপযুক্ত শিক্ষিত করার চেষ্টা তিনি অব্যাহত রেখেছিলেন, আপস করেননি। পারিপার্শ্বিক ও সামাজিক সকল প্রতিকূলতাকে দৃঢ়তার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে সন্তানদের শিক্ষিত করে তুলেছিলেন। বাবার বদলির চাকরি হওয়ার কারণে বাবার সঙ্গে তিনি সারাদেশ প্রায় চষে বেড়িয়েছেন। একটা সময় তাকে শাড়ি পড়তে এবং গৃহবন্দী হয়ে থাকতে হয়। কৈশোরে পড়াশোনার প্রতি দারুণ অনীহা ছিল কিন্তু একটি ঘটনা তার সমগ্র চিন্তা-চেতনাকে দারুণভাবে নাড়া দেয়। সেটা হলো বাবার এক বন্ধু যাকে জাহানারা ইমাম মটকা চাচা বলে ডাকতেন, তার কাছ থেকে কিশোরী জাহানারা ইন্দিরা গান্ধী, বিজয় লক্ষ্মী পন্ডিতের আধুনিক পোশাকে সজ্জিত ছবি স্টেটসম্যান পত্রিকায় দেখে মুগ্ধ হন। তার মনন ও চেতনাকে গভীরভাবে নাড়া দেয় সেই ছবি। লেখাপড়ার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং লেখাপড়া শেখায় ব্রতী হন। স্কুলের রেজিস্টার খাতায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত করে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়। বাবা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ায় তার বাড়িতে নানা ধরনের দেশি-বিদেশি পত্রিকা এবং বরণ্য লেখকদের বই আসার ব্যবস্থা ছিল। জাহানারার অবাধ সুযোগ হয় সেই বইগুলো পড়ার। এ তার জন্য এক দুর্লভ সুযোগ। নিজেকে সমৃদ্ধ করেন এর মধ্য দিয়ে। বাড়িতে ওস্তাদের কাছে গান শিখতেন। বিনোদনের জন্য বাড়িতে ছিল কলের গান। ফলে আঙ্গুর বালা, ইন্দু বালা, কমলা ঝড়িয়া, শাহানা দেবী, যুথীকা রায়, আব্বাস উদ্দিন প্রমুখ শিল্পীর গানের সঙ্গে তিনি পরিচিত হন। মটকা চাচার আনা দুর্লভ বই পড়ে টলস্টয়, ভিক্টর হুগো, শেকসপিয়ার, বানার্ড’শ, দস্তয় ভেসকির মতো বরেণ্য সাহিত্যিকদের লেখার সঙ্গে তিনি পরিচিত হন। রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন সম্পর্কে তার প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি হয়, তাই শান্তিনিকেতনে পড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু সংবাদ জানার পর সেই সিদ্ধান্ত বদল করেন। তিনি ভর্তি হন রংপুর কারমাইকেল কলেজে। অতঃপর ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে বিএড ডিগ্রি অর্জনের পর ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সার্টিফিকেট ইন ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি নেন ১৯৬৫ সালে।

শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, বিদ্যাময়ী গার্লস স্কুল, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন।

রংপুর কলেজে পড়ার সময় প্রেম হয় মোহাম্মদ আলী উকিলের ছেলে ইঞ্জিনিয়ার শহীদ ইমামের সঙ্গে। ১৯৪৮ সালে সব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে পরিবারিকভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। প্রগতিশীল আধুনিক দুটি মানুষ বিয়ে করেন সাধারণ আয়োজনে সাদা কাপড় ও অলংকার বিহীনভাবে। এ বিয়ে সেই সময়ে প্রগতিশীল নান্দনিক এক বিয়ে হিসেবে সমাদৃত হয়।

জাহানারা ইমামের রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ জন্মেছিল তার বন্ধুদের কাছ থেকে কমিউনিজম ধারণায় সমৃদ্ধ হয়ে। কিন্তু তার উদারপন্থি বাবা কমিউস্টিদের জনযুদ্ধ পত্রিকা পড়তে দেখে প্রচন্ড বিরক্ত হন। কারণ তিনি চাইতেন আধুনিক লেখাপড়া শিখুক মেয়ে কিন্তু রাজনীতি নয়। জাহানারা ইমাম এরপর আর রাজনীতিকে স্বাগত জানাননি। ১৯৭১ সালেও কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না তিনি। ’৭১-এর ২৫ মার্চের পর পাকিস্তানি বাহিনীকে জব্দ করার জন্য পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু হলে জাহানারা ইমামের ছেলে রুমী মায়ের কাছে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের তীব্র আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেন। অসাধারণ প্রতিভাবান মননশীল ছেলেটি যুদ্ধে যেতে চাইলে তিনি চিন্তিত হন।

অসহায় বোধ করেন তিনি। কারণ রুমীর উচ্চশিক্ষার্থে আমেরিকা যাওয়ার সব প্রস্তুতি তখন প্রায় শেষ। তার সত্যবাদী যুক্তিনিষ্ঠ মন দ্বিধান্বিত হয়। আত্মপ্রত্যয়ী রুমী বলেন, দেশের এ রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে যেতে না দাও, জোর করে আমেরিকা পাঠাও, আমি হয়তো যাব কিন্তু বিবেকের কাছে অপরাধী হয়ে থাকব চিরদিন। যত বড় ইঞ্জিনিয়ারই হই না কেন বিবেকের দংশন কুরে কুরে খাবে আমাকে। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে মনকে শক্ত করে ছেলেকে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দেন তিনি ১৯৭১ সালের ৭ মে। ’৭১-এর পুরো সময়টা তারা মুক্তিযুদ্ধের গতি-প্রকৃতি বিস্তার পর্যবেক্ষণ করেন। যেহেতু রুমী দুই নম্বর সেক্টরে যোগ দেন তাই এ সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলেন। ঢাকায় বসে রুমীর বাবা শরীফ ইমাম ঢাকার ব্রিজ কালভার্টের বিস্তারিত তথ্য এবং কোন ব্রিজ কালভার্ট কোন এক্সপ্লোসিভ দিয়ে উড়ানো সহজ হবে তা বিশদভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের জানান। শুধু তাই নয় প্রচন্ড জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ কাজের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ওষুধ এবং খাবারের রসদ মজুদ রাখার কাজটি নিষ্ঠার সঙ্গে করেন।

এরপর ঘটতে থাকে একের পর এক মনভাঙ্গা ঘটনা, ধানমন্ডিতে ২৫ আগস্ট রুমীর নেতৃত্বে এক দুঃসাহসী অভিযান চলে। ২৯ আগস্ট পাকিস্তানি হানাদাররা রুমীকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। ইন্টাগোরেশনের নামে এ সময় জামী, শরীফ ইমাম, হাফিজ ও মাসুমকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। অকথ্য নির্যাতন ও সীমাহীন কষ্ট ভোগের পর দু’দিনের মাথায় ছেড়ে দেয়। এরপর অন্তহীন প্রচেষ্টা চালায় এ পরিবার বিশেষ করে মা জাহানারা ইমাম রুমীকে ছাড়িয়ে আনার জন্য। শেষপর্যন্ত দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে হিতৈষীদের পরামর্শে মার্সি পিটিশন করতেও রাজি হয়েছিলেন কিন্তু অকুতোভয় রুমীর আদর্শের প্রতি অবিচল নিষ্ঠার কারণে এ পিটিশন তারা শেষ পর্যন্ত করেননি। ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর বিজয় যখন দোরগোরায় তখনও অসাধারণ জাহানারা ইমাম বোমার ভয়ে আক্রান্ত আত্মীয়স্বজন প্রতিবেশীসহ পঁয়তাল্লিশজনকে বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে তাদের দেখাশোনার ভার নেন। অথচ বুকের ভেতরে নিদারুণ কষ্ট, প্রতি মুহূর্তে প্রচন্ড আকুলতা, ছেলে রুমী ভালো আছে তো? কবে ফিরে আসবে?

বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার পর অবশেষে সেই দিন আসে। জন্ম নেয় বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন দেশ। এ আনন্দের পাশাপাশি চলে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে রুমী ফেরার প্রতীক্ষা। হঠাৎ করেই উন্মোচিত হয় সেই কঠিন সত্য। রুমী আর নেই, ফিরে আসবে না কোন দিন তার স্বপ্নের বাংলাদেশে। এই পরিবারের সবার জীবনে তাই স্বাধীনতা আসে এক আনন্দ বেদনার কাব্য হয়ে।

কঠিন সত্য অদম্য ভালোবাসাকে বুকে বেঁধে তিনি মুক্তিযুদ্ধোত্তর দেশকে গড়ে তোলার সাধনায় ব্রতী হন। ১৯৭১ সালে জাহানারা ইমাম যুক্ত হন শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্ত দাবির আন্দোলনে। তার সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন শহীদ পরিবারের সদস্যদের। ১৯৮০ সালে গঠন করেন সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদবিরোধী নাগরিক কমিটি। কিন্তু এ সময়ে বাধা হয়ে দাঁড়াল তার দেহে এক মরণব্যাধি। তিনি আক্রান্ত হলেন ক্যান্সারে। তিনি হতাশ বা হতোদ্যম হলেন না। তার সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল নিজেকে এবং চারপাশকে আলোকিত করার, সেই লক্ষ্যে শত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও নিজেকে তৈরি করেছেন, পেশাগত জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন এবং জীবনের শেষপর্যায়ে এক নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশকে এবং নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এক অনন্য মর্যাদায়। সামনে নিয়ে এসেছেন এক কঠিন সত্যকে। শুধু তাই নয়, চিহ্নিত করে বিচারের সম্মুখীন করেছেন মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের। ১৯৯২ সালে জাহানারা ইমাম ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক হন। ১০১ জন সদস্যর এ কমিটির মাধ্যমে তিনি ১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গোলাম আযমের বিচারের জন্য গণআদালত গঠন এবং সেই আদালতে তার বিচার হবে বলে ঘোষণা দেন। ঘটতে থাকে একের এক চমকপ্রদ ও সাহসী ঘটনা। জাহানারা ইমামের প্রতি জনসমর্থন ছিল অপ্রত্যাশিত। যার জন্য প্রধান বিরোধী দলসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তি সেদিন একত্রিত হন। স্বল্প সময়ের মধ্যে সারাদেশে এর ব্যাপক বিস্তার ঘটে। তৈরি হয় এ চেতনার আলোকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নামে এক বৃহত্তম মোর্চা। মূলত জাহানারা ইমামকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে এই নতুন ধরনের এ বহুমুখী আন্দোলন প্রাণ পায়। গুরুতর মতভেদ থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন ব্যক্তিত্বদের তিনি গণআন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে পেরেছিলেন। এক ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতিক সহিষ্ণুতাই এই কর্মসূচির প্রধান সূচক হিসেবে বিবেচিত হয়। আর এর উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে জনসভায় তার বলিষ্ঠ কন্ঠের ভাষণ এবং শাণিত লেখনীর মাধ্যমে গভীর প্রত্যয় ব্যক্ত করার অনুপম শৈলী।

গণআদালতের রায় বাস্তবায়নের দাবিতে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে লাখো জনতার মিছিল হয় ১৯৯২ সালের ১২ এপ্রিল। তারা সংসদে এই দাবি সংবলিত স্মারকলিপি পেশ করেন এবং ১০০ জন সাংসদ এ রায়ের পক্ষে সমর্থন দেন। প্রবল গণআন্দোলনের মুখে ৩০ জুন সংসদে চার দফা চুক্তি করতে সরকার বাধ্য হয়।

এই কমিটির উদ্যোগে এক প্রতিবাদ সমাবেশে তাকে বক্তৃতারত অবস্থায় পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। ১৯৯৩ সালে ক্যান্সারের প্রকোপ বেশি হলে চিকিৎসার জন্য তিনি আবার বিদেশে যান। দেশে ফিরে এসে ১৯৯৪ সালের ২৫ মার্চ তার উদ্যোগে শহীদ মিনারে কালো রাতের বুক চিরে জ¦লে ওঠে হাজার মোমের শিখা। সেদিন এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এই আন্দোলনকে সমর্থন দেন ইউরোপিয় ইউনিয়ন। ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এ আন্দোলের ব্যাপক ব্যাপ্তি ঘটে। জাহানারা ইমাম একজন শক্তিমান লেখক, লেখালেখি শুরু করেন ষাটের দশকে। শিশুদের জন্য লেখা দিয়েই তার আত্মপ্রকাশ কিন্তু প্রচন্ড খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা পান ‘একাত্তরের দিনগুলো’ গ্রন্থের জন্য। ‘ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস’ গ্রন্থটিও সহমর্মিতা ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে অসংখ্য পাঠক আপন করে নেন জাহানারা ইমামকে। একথা বলতেই হয় মননশীল গ্রন্থ রচনা করে তিনি সেই সময়ে সময়ের দাবি পূরণ করেছেন তার ভালোবাসা নিষ্ঠা ও একাগ্রতা দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া প্রায় প্রতিটি ঘটনা লিপিবদ্ধ করে তিনি মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যেও সচিত্র সন্ধানী পত্রিকায় তা ধারাবাহিক প্রকাশ করেন। পরবর্তী সময়ে সেই স্মৃতিচারণমূলক অনন্যগাথা ‘একাত্তরের দিনগুলি’ দারুণ ভালোবাসার সঙ্গে বাংলার মানুষ গ্রহণ করেন। তিনি তখন শুধু শহীদ রুমীর মা নন, হয়ে ওঠেন সারাদেশের জনগণের পরম শ্রদ্ধার শহীদ জননী। এই ছোট বাংলাদেশে শুধু দেশকেই নয়, নারীর পৃথিবীকে তিনি অনেক বড় করেছিলেন।

১৯৯৪ সালের ২৬ জুন বাঙালির চেতনার এই প্রদীপ্ত অগ্নিশিখা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। অসম্ভব জীবনবাদী আধুনিক প্রগতিশীল পরমাসুন্দরী এই মহীয়সী নারী জীবনে কখনও হারতে শেখেননি। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী শহীদ জননী মনে করতেন, জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। তাই মৃত্যুর সময় তিনি ঘাতক দালাল নির্মূল সমন্বয় আন্দোলনের দায়িত্ব দিয়ে যান তার প্রিয় জনগণের হাতে। তিনি তার বিশ্বাসী চোখ জনগণের প্রতি রেখে আশা ব্যক্ত করেন- জয় আমাদের হবেই। আজ প্রার্থনা করছি যেখানে আপনি আছেন সেখানে নয়নের মণি রুমীকে আপনি বুকের মধ্যে পান, শরীফ ভাইকে পাশে পান; যাদের আপনি জীবনানন্দ দাসের কবিতার মতো ‘ঘাস ফড়িং’ শালিকের মাঝে খুঁজে বেড়িয়েছেন জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত। ইতিহাসের পথরেখা বেয়ে আমার দুর্লভ সুযোগ হয়েছে অনেক গুণী মানুষের সান্নিধ্যে সহচার্যে আসার। এমনি একজন অমিত তেজী, সাহসী, দেশপ্রেমী, বিচক্ষণ মানুষ পরম শ্রদ্ধার জাহানারা ইমাম। খুব কাছে থেকে দীর্ঘ সৃষ্টিশীল জীবন প্রত্যয়ী এই মানুষটি আমাকে শুভেচ্ছায় সহযোগিতায় বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে অনুপ্রাণিত করেছেন। তার কাছে দেশ ও জাতির মতো আমার ব্যক্তিগত ঋণ অপরিসীম। আজ সশ্রদ্ধ চিত্তে সেই ঋণ স্বীকার করছি। জয়তু শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।

[লেখক : বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক]

দৈনিক সংবাদ : ৫ মে ২০১৯, রোববার, ৭ এর পাতায় প্রকাশিত

back to top