alt

উপ-সম্পাদকীয়

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ও বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

এমআর খায়রুল উমাম

: রোববার, ০২ মে ২০২১

বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারীর ব্যাপকতায় ২০২০ সালের মার্চ মাসের ১৮ তারিখ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিস্থিতি বিবেচনায় ছুটি ঘোষণা করা হয়। শিক্ষার্থীদের জীবন বাঁচাতে দফায় দফায় কর্তৃপক্ষ ছুটি বাড়িয়ে চলছে। শেষপর্যন্ত অনেক পর্যালোচনার পর ২০২১ সালের ৩০ মার্চ স্কুল-কলেজ এবং ১৭ মে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু হঠাৎ করে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা থেকে পিছিয়ে এলো এবং ঈদের পর ২৩ মে পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করা হলো। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবকদের অপেক্ষার পালা লম্বা হলো। করোনাভাইরাসের ব্যাপকতা কতদূর বিস্তার লাভ করবে তার ওপর নির্ভর করবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবে খুলবে। বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে এবং স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে টানাপোড়েনের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। অভিভাবকরাও দুশ্চিন্তার মধ্যে দিন পার করছেন। সরকার যে টেনশনের মধ্যে আছে তা পরিষ্কার।

কোভিড-১৯ মহামারীর শুরুতে সবাই থমকে গিয়েছিল। সর্বত্র একটা থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছিল। একান্ত বাধ্য না হলে সবাই বাড়িতে থাকছিল। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার চেষ্টা করছিল। সময়ের ব্যবধানে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশের বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকরা যেভাবে সাধারণ মানুষকে জীবনযাপনে উপদেশ দিচ্ছিলেন তেমনভাবে চলার চেষ্টা করে জীবন সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। দিনে দিনে সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্তে আস্তে করোনাভাইরাসের ভীতি কেটে যায়। যদিও ভীতি কাটিয়ে উঠা ছাড়া মানুষের সামনে বিকল্প পথও খোলা ছিল না। সরকারসহ সাধারণ মানুষ কোভিড-১৯ মোকাবেলায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে চললেও এ প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ফলে খেটে খাওয়া মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে ঘর থেকে বের হতে বাধ্য হয়।

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যত কমতে থাকে সরকারের পক্ষ থেকে তত ছাড় আসা শুরু করলে দলে দলে ঘরবন্দি মানুষের বের হওয়া শুরু হয়। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সরকারের সামনে বিকল্প কোনো পথ খোলা ছিল না। তাই প্রণোদোনার ডালি সাজিয়ে মানুষকে উৎসাহিত করার, সাহসী করার কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে করোনার ধ্বংসলীলাকে পাশে সরিয়ে রেখে এগিয়ে চলার সূচনা হয়। সেই এগিয়ে চলার পথে মানুষ একের পর এক যোগ দেয়া শুরু করে। তবে এ সব কার্যক্রমের কোনটাই কারোনাভাইরাসের প্রকোপ অবজ্ঞা করে নয় বরং সতর্কতার সাথে মোকাবেলা করে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সবাইকে সাহস দিয়ে পরিচালিত হয় এবং নিরাপত্তার সর্বোচ্চ ব্যবস্থাপনার মধ্যে থাকার জন্য কঠোর হয় সরকার। ধীরে ধীরে মানুষ ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। এখনকার পরিবেশ-পরিস্থিতি মাঠে-ঘাটে এতটাই স্বাভাবিক যা দেখে বিশ্বাস করতে হবে যে দেশে করোনার কোনো প্রকোপ নেই। সবকিছুই স্বাভাবিক নিয়মেই চলছে। অল্প কিছু মানুষ সতর্কতার মধ্য দিয়ে চললেও বেশির ভাগ মানুষ ন্যূনতম সচেতনতার মধ্যে নেই।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গিয়েছে। সংক্রমণ বাড়ছে, মৃত্যুও বাড়ছে, হাসপাতালের বিছানায় টান পড়েছে। দেশের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের রক্ষায় সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঈদের পর খোলার ঘোষণা দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে ১৮ দফা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশ জারি করা হয়েছে। সাধারণ ছুটির পর এবার ‘কঠোর লকডাউন’ চলছে। এসব নির্দেশ কতটা মেনে জীবনকে চলমান রাখা হবে তা আগামীই বলবে। তবে সবার মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার মানসিক অবস্থা বিবেচনায় এ কথা বলা যায় সময়টা খুব কঠিন যাবে। এর মাঝে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হলে বিপদ বাড়বে তা ঠিক। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে কী সরকার শিক্ষার্থীদের ঘরে রাখতে পেরেছে? প্রাথমিকভাবে শিক্ষার্থীরা ঘরেই ছিল তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া ও পরীক্ষার চিন্তা-ভাবনার শুরু করার পর থেকে শিক্ষার্থীরা আর ঘরে বসে নেই। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের নিয়ে বের হয়ে পড়েছেন। ছুটে চলেছেন কোচিং আর প্রাইভেট টিউশনির জন্য। শিক্ষকরাও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে চলেছেন। করোনা কিছু মানুষের ব্যবসায়িক ভাগ্য খুলে দিয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের চিন্তা-ভাবনার সুযোগে একশ্রেণীর শিক্ষকদেরও ভাগ্য খুলে গিয়েছে।

শিক্ষার্থীরা যদি ঘরেই না থাকতে পারে তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে লাভ কী? দেশের সবকিছু স্বাভাবিক নিয়মে চলছে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে যত চিন্তা। দেশের সব শিক্ষার মান নিয়ে এমনিতেই বহুবিধ প্রশ্ন আছে। এক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে শিক্ষার্থীদের আটো প্রমোশন দিয়ে দেশ ও জাতির কী উপকার হলো বুঝি না। শিক্ষার্থীরা এক বছর পিছিয়ে থাকলে তাতেই বা কি ক্ষতি হয়ে যেত তাও বুঝি না। মানহীন শিক্ষার চাইতে কি বেশি ক্ষতি হয়ে যেত? দেশে চলমান শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে সাধারণ শিক্ষা নিয়েই যত সমস্যা। কওমি মাদ্রাসা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে, ইংরেজি মিডিয়ামের শিক্ষা অনলাইনে চলছে। সাধারণ শিক্ষাকেও অনলাইনে করার চেষ্টা চলছে। তবে এ প্রক্রিয়া খুব বেশিদূর এগিয়েছে বলে মনে হয় না। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষার এ প্রক্রিয়ায় অংশীদার হওয়া খুব কঠিন। সরকারের পক্ষ থেকে এ শিক্ষার প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ ও সুলভ মূল্যে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেয়ার ঘোষণা থাকলেও বাস্তবে তা হয়নি। এ কারণে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা সবটাই মুখ থুবড়ে পড়েছে। ইংরেজি মাধ্যমের ও রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য খ্যাতনামা স্কুলের শিক্ষার্থীদের সাথে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এক পাল্লায় মাপা যথাযথ নয়। অর্থনৈতিক বৈষম্য বিবেচনায় রাখা জরুরি।

জীবন থেমে থাকে না তাই সবাই নিজেদের মতো করেই সবকিছু সচল করে নিয়েছে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক কেউ বসে নেই, সবাই নিজেদের মতো করে সচল হয়েছে। শিক্ষকরা পুরা শক্তি নিয়ে কোচিং চালাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের সকাল-সন্ধ্যা কখনও ছুটি নেই কোচিংয়ের জন্য দৌড়াচ্ছে। মেস বাড়িগুলোতে শিক্ষার্থীদের ভিড় আগের মতোই হয়ে গিয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে কিছু মানুষকে দাড়িতে মাস্ক বেঁধে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াতে দেখা যাওয়া ছাড়া সব কিছু এতটাই স্বাভাবিক যে, করোনা মহামারীতে বিশ্বব্যাপী মানুষ যে বিপর্যস্ত তা বোঝার কোনো উপায় নেই। তাই সরকার যত সদিচ্ছা নিয়ে, আন্তরিকতা নিয়ে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে বাড়িতে রাখতে চেষ্টা করুক না কেন তা হচ্ছে না। ভবিষ্যতের আশায় অভিভাবকরা সন্তানদের নিয়ে ছুটছেন। এখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তহীনতাও দায় এড়াতে পারবে না। শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার শেষ নেই। প্রতিদিন রাতে যা স্বপ্ন দেখে তাই সকালে মাইকের সামনে বলা শুরু করে দেয় দায়িত্বপ্রাপ্ত জনতার সেবকেরা। ফলে শিক্ষার্থীদের বাড়িতে বসিয়ে রাখার সুযোগ অভিভাবকরা পায় না।

করোনা মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। প্রথমের চাইতে আরো কঠিনভাবে আক্রমণ শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে সবকিছু স্বাভাবিক ভাবার ফল মারাত্মক হয়ে উঠেছে। সবাইকে সাবধান করা না গেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। শুধু শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভাবলে হবে না। তাই দেশকে এগিয়ে নিতে, অর্থনীতিকে সচল রাখতে, সাধারণ মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে যতটুকু প্রয়োজন তা চলমান রেখে বাকি সবখানে নিয়ন্ত্রণ জরুরি। রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি মানুষের জন্য এ কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে মানুষ বাঁচলেই সব বাঁচবে। সুধী সমাজের সাথে সাথে শাসক শ্রেণীর মধ্যেও মহামারীর প্রকোপ উপলব্ধির বিষয়টি শুধু কথায় নয়, কাজে পরিণত করতে হবে। এসব মানুষ শক্ত হলে সাধারণ জনগণ শক্ত হয়ে মহামারী প্রতিরোধে শক্তি পাবে। এ কাজ করতে না পারলে শিক্ষার্থীদেরও ঘরে বসিয়ে রাখা যাবে না। তাদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হবে।

[লেখক : সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ]

khairulumam1950@gmail.com

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি

ঈদের অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ‘পোস্ট পার্টিশন সিনড্রম’

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

রম্যগদ্য : ‘প্রহরীর সাতশ কোটি টাকা...’

ছবি

অবন্তিকাদের আত্মহনন

শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা

অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান নয়

পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে

আত্মহত্যা রোধে নৈতিক শিক্ষা

আউশ ধান : পরিবেশ ও কৃষকবান্ধব ফসল

ছবি

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আতুড়ঘর

চেক ডিজঅনার মামলার অধিক্ষেত্র ও প্রাসঙ্গিকতা

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের কৃষি

ছবি

‘হৃৎ কলমের’ পাখি এবং আমাদের জেগে ওঠা

ছবি

ভূগর্ভস্থ পানি সুরক্ষায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ও বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

এমআর খায়রুল উমাম

রোববার, ০২ মে ২০২১

বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারীর ব্যাপকতায় ২০২০ সালের মার্চ মাসের ১৮ তারিখ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিস্থিতি বিবেচনায় ছুটি ঘোষণা করা হয়। শিক্ষার্থীদের জীবন বাঁচাতে দফায় দফায় কর্তৃপক্ষ ছুটি বাড়িয়ে চলছে। শেষপর্যন্ত অনেক পর্যালোচনার পর ২০২১ সালের ৩০ মার্চ স্কুল-কলেজ এবং ১৭ মে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু হঠাৎ করে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা থেকে পিছিয়ে এলো এবং ঈদের পর ২৩ মে পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করা হলো। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবকদের অপেক্ষার পালা লম্বা হলো। করোনাভাইরাসের ব্যাপকতা কতদূর বিস্তার লাভ করবে তার ওপর নির্ভর করবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবে খুলবে। বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে এবং স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে টানাপোড়েনের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। অভিভাবকরাও দুশ্চিন্তার মধ্যে দিন পার করছেন। সরকার যে টেনশনের মধ্যে আছে তা পরিষ্কার।

কোভিড-১৯ মহামারীর শুরুতে সবাই থমকে গিয়েছিল। সর্বত্র একটা থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছিল। একান্ত বাধ্য না হলে সবাই বাড়িতে থাকছিল। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার চেষ্টা করছিল। সময়ের ব্যবধানে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশের বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকরা যেভাবে সাধারণ মানুষকে জীবনযাপনে উপদেশ দিচ্ছিলেন তেমনভাবে চলার চেষ্টা করে জীবন সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। দিনে দিনে সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্তে আস্তে করোনাভাইরাসের ভীতি কেটে যায়। যদিও ভীতি কাটিয়ে উঠা ছাড়া মানুষের সামনে বিকল্প পথও খোলা ছিল না। সরকারসহ সাধারণ মানুষ কোভিড-১৯ মোকাবেলায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে চললেও এ প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ফলে খেটে খাওয়া মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে ঘর থেকে বের হতে বাধ্য হয়।

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যত কমতে থাকে সরকারের পক্ষ থেকে তত ছাড় আসা শুরু করলে দলে দলে ঘরবন্দি মানুষের বের হওয়া শুরু হয়। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সরকারের সামনে বিকল্প কোনো পথ খোলা ছিল না। তাই প্রণোদোনার ডালি সাজিয়ে মানুষকে উৎসাহিত করার, সাহসী করার কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে করোনার ধ্বংসলীলাকে পাশে সরিয়ে রেখে এগিয়ে চলার সূচনা হয়। সেই এগিয়ে চলার পথে মানুষ একের পর এক যোগ দেয়া শুরু করে। তবে এ সব কার্যক্রমের কোনটাই কারোনাভাইরাসের প্রকোপ অবজ্ঞা করে নয় বরং সতর্কতার সাথে মোকাবেলা করে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সবাইকে সাহস দিয়ে পরিচালিত হয় এবং নিরাপত্তার সর্বোচ্চ ব্যবস্থাপনার মধ্যে থাকার জন্য কঠোর হয় সরকার। ধীরে ধীরে মানুষ ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। এখনকার পরিবেশ-পরিস্থিতি মাঠে-ঘাটে এতটাই স্বাভাবিক যা দেখে বিশ্বাস করতে হবে যে দেশে করোনার কোনো প্রকোপ নেই। সবকিছুই স্বাভাবিক নিয়মেই চলছে। অল্প কিছু মানুষ সতর্কতার মধ্য দিয়ে চললেও বেশির ভাগ মানুষ ন্যূনতম সচেতনতার মধ্যে নেই।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গিয়েছে। সংক্রমণ বাড়ছে, মৃত্যুও বাড়ছে, হাসপাতালের বিছানায় টান পড়েছে। দেশের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের রক্ষায় সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঈদের পর খোলার ঘোষণা দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে ১৮ দফা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশ জারি করা হয়েছে। সাধারণ ছুটির পর এবার ‘কঠোর লকডাউন’ চলছে। এসব নির্দেশ কতটা মেনে জীবনকে চলমান রাখা হবে তা আগামীই বলবে। তবে সবার মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার মানসিক অবস্থা বিবেচনায় এ কথা বলা যায় সময়টা খুব কঠিন যাবে। এর মাঝে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হলে বিপদ বাড়বে তা ঠিক। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে কী সরকার শিক্ষার্থীদের ঘরে রাখতে পেরেছে? প্রাথমিকভাবে শিক্ষার্থীরা ঘরেই ছিল তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া ও পরীক্ষার চিন্তা-ভাবনার শুরু করার পর থেকে শিক্ষার্থীরা আর ঘরে বসে নেই। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের নিয়ে বের হয়ে পড়েছেন। ছুটে চলেছেন কোচিং আর প্রাইভেট টিউশনির জন্য। শিক্ষকরাও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে চলেছেন। করোনা কিছু মানুষের ব্যবসায়িক ভাগ্য খুলে দিয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের চিন্তা-ভাবনার সুযোগে একশ্রেণীর শিক্ষকদেরও ভাগ্য খুলে গিয়েছে।

শিক্ষার্থীরা যদি ঘরেই না থাকতে পারে তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে লাভ কী? দেশের সবকিছু স্বাভাবিক নিয়মে চলছে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে যত চিন্তা। দেশের সব শিক্ষার মান নিয়ে এমনিতেই বহুবিধ প্রশ্ন আছে। এক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে শিক্ষার্থীদের আটো প্রমোশন দিয়ে দেশ ও জাতির কী উপকার হলো বুঝি না। শিক্ষার্থীরা এক বছর পিছিয়ে থাকলে তাতেই বা কি ক্ষতি হয়ে যেত তাও বুঝি না। মানহীন শিক্ষার চাইতে কি বেশি ক্ষতি হয়ে যেত? দেশে চলমান শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে সাধারণ শিক্ষা নিয়েই যত সমস্যা। কওমি মাদ্রাসা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে, ইংরেজি মিডিয়ামের শিক্ষা অনলাইনে চলছে। সাধারণ শিক্ষাকেও অনলাইনে করার চেষ্টা চলছে। তবে এ প্রক্রিয়া খুব বেশিদূর এগিয়েছে বলে মনে হয় না। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষার এ প্রক্রিয়ায় অংশীদার হওয়া খুব কঠিন। সরকারের পক্ষ থেকে এ শিক্ষার প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ ও সুলভ মূল্যে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেয়ার ঘোষণা থাকলেও বাস্তবে তা হয়নি। এ কারণে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা সবটাই মুখ থুবড়ে পড়েছে। ইংরেজি মাধ্যমের ও রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য খ্যাতনামা স্কুলের শিক্ষার্থীদের সাথে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এক পাল্লায় মাপা যথাযথ নয়। অর্থনৈতিক বৈষম্য বিবেচনায় রাখা জরুরি।

জীবন থেমে থাকে না তাই সবাই নিজেদের মতো করেই সবকিছু সচল করে নিয়েছে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক কেউ বসে নেই, সবাই নিজেদের মতো করে সচল হয়েছে। শিক্ষকরা পুরা শক্তি নিয়ে কোচিং চালাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের সকাল-সন্ধ্যা কখনও ছুটি নেই কোচিংয়ের জন্য দৌড়াচ্ছে। মেস বাড়িগুলোতে শিক্ষার্থীদের ভিড় আগের মতোই হয়ে গিয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে কিছু মানুষকে দাড়িতে মাস্ক বেঁধে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াতে দেখা যাওয়া ছাড়া সব কিছু এতটাই স্বাভাবিক যে, করোনা মহামারীতে বিশ্বব্যাপী মানুষ যে বিপর্যস্ত তা বোঝার কোনো উপায় নেই। তাই সরকার যত সদিচ্ছা নিয়ে, আন্তরিকতা নিয়ে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে বাড়িতে রাখতে চেষ্টা করুক না কেন তা হচ্ছে না। ভবিষ্যতের আশায় অভিভাবকরা সন্তানদের নিয়ে ছুটছেন। এখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তহীনতাও দায় এড়াতে পারবে না। শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার শেষ নেই। প্রতিদিন রাতে যা স্বপ্ন দেখে তাই সকালে মাইকের সামনে বলা শুরু করে দেয় দায়িত্বপ্রাপ্ত জনতার সেবকেরা। ফলে শিক্ষার্থীদের বাড়িতে বসিয়ে রাখার সুযোগ অভিভাবকরা পায় না।

করোনা মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। প্রথমের চাইতে আরো কঠিনভাবে আক্রমণ শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে সবকিছু স্বাভাবিক ভাবার ফল মারাত্মক হয়ে উঠেছে। সবাইকে সাবধান করা না গেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। শুধু শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভাবলে হবে না। তাই দেশকে এগিয়ে নিতে, অর্থনীতিকে সচল রাখতে, সাধারণ মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে যতটুকু প্রয়োজন তা চলমান রেখে বাকি সবখানে নিয়ন্ত্রণ জরুরি। রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি মানুষের জন্য এ কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে মানুষ বাঁচলেই সব বাঁচবে। সুধী সমাজের সাথে সাথে শাসক শ্রেণীর মধ্যেও মহামারীর প্রকোপ উপলব্ধির বিষয়টি শুধু কথায় নয়, কাজে পরিণত করতে হবে। এসব মানুষ শক্ত হলে সাধারণ জনগণ শক্ত হয়ে মহামারী প্রতিরোধে শক্তি পাবে। এ কাজ করতে না পারলে শিক্ষার্থীদেরও ঘরে বসিয়ে রাখা যাবে না। তাদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হবে।

[লেখক : সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ]

khairulumam1950@gmail.com

back to top