alt

উপ-সম্পাদকীয়

করোনাকালে নতুন সংকটে মাসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা

সাকিলা পারভীন

: শুক্রবার, ০৭ মে ২০২১

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং মাসিকবান্ধব টয়লেট চালু রাখা বাংলাদেশ সরকারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত। ফলে বিশেজ্ঞদের মতে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)’র সফল বাস্তবায়ন তথা দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাসিকবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে দরকার- জাতীয় বাজেটে এই খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ, শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান ও নিয়মিত স্কুল মনিটরিং, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ ও কর্মপরিকল্পনা, সামাজিক উদ্যোগ এবং সর্বোপরি মাসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ের যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।

মাসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে স্থানীয় বা কমিউনিটির বিভিন্ন সমস্যা সমাধান কিংবা জনকল্যাণমুখী অনেক কার্যক্রম গ্রহণে সামাজিক উদ্যোগের অনেক উদাহরণ রয়েছে। তবে কৈশোরবান্ধব সমাজ প্রতিষ্ঠায় সামাজিক উদ্যোগের ঘাটতি দেখা যায়। এক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেয়েদের জন্য মাসিকবান্ধব টয়লেট স্থাপন ও তার রক্ষণাবেক্ষণ, সব শিক্ষার্থীকে মাসিক বিষয়ে বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা প্রদান ইত্যাদি বিষয়ে সামাজিক উদ্যোগ যেমন চোখে পড়েনা একইভাবে রাষ্ট্রীয়ভাবেও নেই তেমন কোন আর্থিক বরাদ্দ। আর করোনাকালে এক্ষেত্রে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে।

বয়ঃসন্ধি থেকে শুরু করে প্রজননক্ষম বয়স পর্যন্ত প্রত্যেক কিশোরী ও নারীকেই মাসে একবার মাসিকের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়, যা মানুষের জীবনপ্রবাহ সচল রাখার জন্য অত্যাবশ্যক। এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করতে পারা, না পারার ওপর কিশোরী ও নারীদের সুস্থ থাকা অনেকাংশে নির্ভর করে। সমাজে এই বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক লুকোছাপা আছে। ফলে কিশোরী ও নারীরা মাসিক ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানসম্মত উপায় সম্পর্কে যেমন জানতে পারে না, তেমনি লজ্জা-সংকোচের কারণে এ বিষয়ক চাহিদার কথাও পরিবার সদস্যদের কাছে খোলামেলাভাবে বলতে পারে না। যে কারণে সমাজে মাসিক নিয়ে প্রচুর কুসংস্কার ছড়িয়ে পড়ে ও চর্চিত হয়। এতে কিশোরী ও নারীরা শারীরিক-মানসিক নানা ক্ষতির সম্মুখীন হন।

আমাদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা বইয়ে মাসিক সম্পর্কে অল্প কিছু পাঠ অন্তর্ভুক্ত থাকলেও সেগুলো প্রায়ই স্কুলে পড়ানো হয় না। আবার অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেয়েদের জন্য মাসিকবান্ধব টয়লেটও নেই। ফলে স্কুলগামী মেয়েরা প্রায়ই বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়ে এবং অনেক মেয়ে মাসিকের কয়েকদিন স্কুলে টানা অনুপস্থিত থাকে। তাতে তাদের পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও তারা পরীক্ষায় খারাপ করে। এমন বাস্তবতায় নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের সহায়তায় নেত্রকোনা জেলার ৮টি উপজেলার ১৬০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও সংশ্লিষ্ট কমিউনিটিতে ঋতু নামে নভেম্বর ২০১৫ থেকে মার্চ ২০২০ পর্যন্ত মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাবিষয়ক একটি গবেষণাভিত্তিক কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়, যেটি ছিল সিমাভি, টিএনও, রেড অরেঞ্জ, বিএনপিএস ও ডরপের মধ্যকার একটি সহযোগিতামূলক কর্মসূচি। ঋতু কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল কর্মএলাকার ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সী মেয়েদের মাসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়, সংশ্লিষ্টদের মাসিক-সংক্রান্ত জ্ঞান, আচরণ ও চর্চার উন্নয়ন ঘটানো; স্কুলে ও কমিউনিটিতে মাসিকবান্ধব টয়লেট ও মাসিক উপকরণের সহজলভ্যতা তৈরি; এবং মাসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি কর্তৃপক্ষের প্রতিশ্রুতি জোরদার করা।

২০১৯ সালে কৃত দৈবচয়িত নিয়ন্ত্রিত গবেষণা (আরসিটি) ও কর্মসূচির চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী স্কুলে ও কমিউনিটিতে সরাসরি বাস্তবায়িত এই কর্মসূচি মেয়েদের মাসিক স্বাস্থ্যের বিদ্যমান পরিস্থিতির ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। কর্মসূচিভুক্ত মেয়েরা আগের তুলনায় মাসিক নিয়ে খুব কম লজ্জাবোধ করে এবং মাসিককালে আত্মবিশ্বাস অনুভব করে বলে জানায়। তাদের মতে, মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার জন্য তাদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা, জ্ঞান ও সহায়তা এবং প্রয়োজনীয় উপকরণ ও পরিষেবা নিশ্চিত হয়েছে। আরসিটির তথ্যে দেখা যায়, কর্মসূচিভুক্ত ৬৭ শতাংশ মেয়ে যেখানে স্কুলে তাদের মাসিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী, সেখানে কর্মসূচির বাইরের মেয়েদের মধ্যে এই হার মাত্র ৪৩ শতাংশ।

ঋতু কর্মসূচি কর্ম এলাকার শিক্ষক, স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত করার উদ্যোগ নেয় এবং কর্মসূচির শেষ দিকে প্রয়োজনীয় উপকরণসহ শিখন অধিবেশনগুলো অংশীদারদের কাছে হস্তান্তর করে, যাতে এই শিক্ষা স্কুলগুলোতে চালু থাকে। কর্মসূচি বাস্তবায়নকালে মাসিকের সময় মেয়েদের স্কুলে উপস্থিতি বেড়ে যাওয়ায় এবং মেয়েরা শারীরিক-মানসিকভাবে সুস্থ থাকায় সংশ্লিষ্টরা এই কাজের গুরুত্ব অনুভব করেন এবং কর্মসূচি শেষ হয়ে গেলেও কিছু স্কুলে নিজস্ব উদ্যোগে এর কার্যক্রম চলমান থাকে। কিন্তু কভিড-১৯ পরিস্থিতি এবং লকডাউন কর্মসূচির এই অর্জনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং দুঃখজনকভাবে লকডাউনের শুরু থেকে সব কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।

কর্মসূচির বর্ধিত মেয়াদে শেয়ার-নেট ইন্টারন্যাশনালের সহায়তায় সিমাভি ও বিএনপিএস’র যৌথ অংশীদারিত্বে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের তত্ত্বাধানে ৬টি স্কুলে একটি স্থায়িত্বশীলতা সমীক্ষা করা হয়। সমীক্ষার আওতায় এফজিডি ও সাক্ষাৎকারে অংশ নেন ছেলেমেয়ে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তাসহ ২৩০ জন। কর্মসূচি চলাকালে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ পেয়ে শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে আচরণগত পরিবর্তন লক্ষণীয় হয়ে ওঠে এবং অধিকাংশ স্কুল মাসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা চালু রাখা ও টয়লেট রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে। কিন্তু কভিড পরিস্থিতিজনিত বিরূপতার কারণে সমীক্ষাকালে তাদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনায় ঘাটতি দেখা যায়। কয়েকজন শিক্ষক জানান, মাসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে তাদের অর্জিত জ্ঞান হ্রাস পেয়েছে, এই বিষয়ে কথা বলতে এখন তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। মাসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে স্কুল পরীক্ষায় প্রশ্ন না থাকাও এ বিষয়ক চর্চা ও শিক্ষা স্থায়িত্বশীল করার একটি বড় বাধা বলে তারা জানান।

কর্মসূচি সংশ্লিষ্টরা আশা করেছিলেন, স্কুলগুলোতে স্থানীয় সরকারের শিক্ষা কর্মকর্তাদের মনিটরিং ভিজিট স্কুলে মাসিকবান্ধব টয়লেট নিশ্চিত করায় বাইরে থেকে উৎসাহ জোগানোর মতো একটা ব্যাপার হবে। দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়ার সময় শিক্ষা কর্মকর্তাদের মনিটরিং চেকলিস্ট এবং প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে লকডাউনের সময় কোন ভিজিটই অনুষ্ঠিত হয়নি। অবশ্য সেটা সম্ভবও ছিল না।

এটা স্বীকৃত যে, মাসিকবান্ধব টয়লেট রক্ষণাবেক্ষণের জন্য স্কুলগুলোর নিয়মিত অর্থ সংস্থানের ব্যবস্থা থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঋতু কর্মসূচি স্কুলগুলোকে বিদ্যমান সরকারি বাজেট পাবার ব্যাপারে সহায়তা দেয় ও সক্ষম করে তোলে। তবু আমরা দেখেছি, এই প্রক্রিয়াটি চালু রাখা স্কুলগুলোর পক্ষে খুবই কঠিন ও সময়সাপেক্ষ। কিছু স্কুল সঞ্চয় প্রক্রিয়া চালু করে বা ব্যক্তিগত দান সংগ্রহ করে প্যাডের ব্যবস্থা করলেও অধিকাংশ স্কুলই বাজেট না থাকাকে টয়লেটের রক্ষণাবেক্ষণ চালু রাখা এবং সাবান ও মাসিক উপকরণ সরবরাহের প্রধান বাধা হিসেবে জানিয়েছে।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরু থেকে স্কুলগুলো বন্ধ রয়েছে। ঋতু কর্মসূচির মাধ্যমে মেয়েদের মাসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে স্কুলগুলোতে যে জাগরণ তৈরি হয়েছিল বর্তমান পরিস্থিতিতে তা ধরে রাখা এবং মাসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক শিখন ও মাসিকবান্ধব টয়লেট রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চালু রাখা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এটা নিশ্চিত, ক্রমে করোনা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটবে এবং স্কুলগুলো আবার পুরোদমে কার্যক্রম শুরু করবে। তখন যাতে মেয়েরা স্কুলে মাসিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিকূলতার মুখে না পড়ে সেজন্য এখন থেকেই ভাবতে হবে। আর বৃহত্তর সমাজের সমর্থন ও নিয়মিত সহায়তা ব্যতীত এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ আবশ্যক।

সামাজিক উদ্যোগের ঘাটতি থাকায় স্কুলে মাসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং মাসিকবান্ধব টয়লেট স্থাপন ও তা রক্ষণাবেক্ষণে সরকারি বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকা জরুরি। তাছাড়া, এজন্য শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান ও নিয়মিত স্কুল মনিটরিং নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহের মধ্যে সমন্বয়ও দরকার। এক্ষেত্রে এনজিও এবং নাগরিক সমাজকে সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অ্যাডভোকেসির পাশাপাশি শিক্ষক, অভিভাবক ও স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির সঙ্গে মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। তবেই টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি)’র ৩, ৪, ৫ ও ৬ নম্বর লক্ষ্যের সফল বাস্তবায়ন তথা প্রতিটি স্কুলে মাসিকবান্ধব একটি পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হবে।

[লেখক : সাংবাদিক]

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

করোনাকালে নতুন সংকটে মাসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা

সাকিলা পারভীন

শুক্রবার, ০৭ মে ২০২১

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং মাসিকবান্ধব টয়লেট চালু রাখা বাংলাদেশ সরকারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত। ফলে বিশেজ্ঞদের মতে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)’র সফল বাস্তবায়ন তথা দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাসিকবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে দরকার- জাতীয় বাজেটে এই খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ, শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান ও নিয়মিত স্কুল মনিটরিং, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ ও কর্মপরিকল্পনা, সামাজিক উদ্যোগ এবং সর্বোপরি মাসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ের যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।

মাসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে স্থানীয় বা কমিউনিটির বিভিন্ন সমস্যা সমাধান কিংবা জনকল্যাণমুখী অনেক কার্যক্রম গ্রহণে সামাজিক উদ্যোগের অনেক উদাহরণ রয়েছে। তবে কৈশোরবান্ধব সমাজ প্রতিষ্ঠায় সামাজিক উদ্যোগের ঘাটতি দেখা যায়। এক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেয়েদের জন্য মাসিকবান্ধব টয়লেট স্থাপন ও তার রক্ষণাবেক্ষণ, সব শিক্ষার্থীকে মাসিক বিষয়ে বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা প্রদান ইত্যাদি বিষয়ে সামাজিক উদ্যোগ যেমন চোখে পড়েনা একইভাবে রাষ্ট্রীয়ভাবেও নেই তেমন কোন আর্থিক বরাদ্দ। আর করোনাকালে এক্ষেত্রে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে।

বয়ঃসন্ধি থেকে শুরু করে প্রজননক্ষম বয়স পর্যন্ত প্রত্যেক কিশোরী ও নারীকেই মাসে একবার মাসিকের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়, যা মানুষের জীবনপ্রবাহ সচল রাখার জন্য অত্যাবশ্যক। এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করতে পারা, না পারার ওপর কিশোরী ও নারীদের সুস্থ থাকা অনেকাংশে নির্ভর করে। সমাজে এই বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক লুকোছাপা আছে। ফলে কিশোরী ও নারীরা মাসিক ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানসম্মত উপায় সম্পর্কে যেমন জানতে পারে না, তেমনি লজ্জা-সংকোচের কারণে এ বিষয়ক চাহিদার কথাও পরিবার সদস্যদের কাছে খোলামেলাভাবে বলতে পারে না। যে কারণে সমাজে মাসিক নিয়ে প্রচুর কুসংস্কার ছড়িয়ে পড়ে ও চর্চিত হয়। এতে কিশোরী ও নারীরা শারীরিক-মানসিক নানা ক্ষতির সম্মুখীন হন।

আমাদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা বইয়ে মাসিক সম্পর্কে অল্প কিছু পাঠ অন্তর্ভুক্ত থাকলেও সেগুলো প্রায়ই স্কুলে পড়ানো হয় না। আবার অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেয়েদের জন্য মাসিকবান্ধব টয়লেটও নেই। ফলে স্কুলগামী মেয়েরা প্রায়ই বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়ে এবং অনেক মেয়ে মাসিকের কয়েকদিন স্কুলে টানা অনুপস্থিত থাকে। তাতে তাদের পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও তারা পরীক্ষায় খারাপ করে। এমন বাস্তবতায় নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের সহায়তায় নেত্রকোনা জেলার ৮টি উপজেলার ১৬০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও সংশ্লিষ্ট কমিউনিটিতে ঋতু নামে নভেম্বর ২০১৫ থেকে মার্চ ২০২০ পর্যন্ত মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাবিষয়ক একটি গবেষণাভিত্তিক কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়, যেটি ছিল সিমাভি, টিএনও, রেড অরেঞ্জ, বিএনপিএস ও ডরপের মধ্যকার একটি সহযোগিতামূলক কর্মসূচি। ঋতু কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল কর্মএলাকার ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সী মেয়েদের মাসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়, সংশ্লিষ্টদের মাসিক-সংক্রান্ত জ্ঞান, আচরণ ও চর্চার উন্নয়ন ঘটানো; স্কুলে ও কমিউনিটিতে মাসিকবান্ধব টয়লেট ও মাসিক উপকরণের সহজলভ্যতা তৈরি; এবং মাসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি কর্তৃপক্ষের প্রতিশ্রুতি জোরদার করা।

২০১৯ সালে কৃত দৈবচয়িত নিয়ন্ত্রিত গবেষণা (আরসিটি) ও কর্মসূচির চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী স্কুলে ও কমিউনিটিতে সরাসরি বাস্তবায়িত এই কর্মসূচি মেয়েদের মাসিক স্বাস্থ্যের বিদ্যমান পরিস্থিতির ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। কর্মসূচিভুক্ত মেয়েরা আগের তুলনায় মাসিক নিয়ে খুব কম লজ্জাবোধ করে এবং মাসিককালে আত্মবিশ্বাস অনুভব করে বলে জানায়। তাদের মতে, মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার জন্য তাদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা, জ্ঞান ও সহায়তা এবং প্রয়োজনীয় উপকরণ ও পরিষেবা নিশ্চিত হয়েছে। আরসিটির তথ্যে দেখা যায়, কর্মসূচিভুক্ত ৬৭ শতাংশ মেয়ে যেখানে স্কুলে তাদের মাসিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী, সেখানে কর্মসূচির বাইরের মেয়েদের মধ্যে এই হার মাত্র ৪৩ শতাংশ।

ঋতু কর্মসূচি কর্ম এলাকার শিক্ষক, স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত করার উদ্যোগ নেয় এবং কর্মসূচির শেষ দিকে প্রয়োজনীয় উপকরণসহ শিখন অধিবেশনগুলো অংশীদারদের কাছে হস্তান্তর করে, যাতে এই শিক্ষা স্কুলগুলোতে চালু থাকে। কর্মসূচি বাস্তবায়নকালে মাসিকের সময় মেয়েদের স্কুলে উপস্থিতি বেড়ে যাওয়ায় এবং মেয়েরা শারীরিক-মানসিকভাবে সুস্থ থাকায় সংশ্লিষ্টরা এই কাজের গুরুত্ব অনুভব করেন এবং কর্মসূচি শেষ হয়ে গেলেও কিছু স্কুলে নিজস্ব উদ্যোগে এর কার্যক্রম চলমান থাকে। কিন্তু কভিড-১৯ পরিস্থিতি এবং লকডাউন কর্মসূচির এই অর্জনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং দুঃখজনকভাবে লকডাউনের শুরু থেকে সব কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।

কর্মসূচির বর্ধিত মেয়াদে শেয়ার-নেট ইন্টারন্যাশনালের সহায়তায় সিমাভি ও বিএনপিএস’র যৌথ অংশীদারিত্বে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের তত্ত্বাধানে ৬টি স্কুলে একটি স্থায়িত্বশীলতা সমীক্ষা করা হয়। সমীক্ষার আওতায় এফজিডি ও সাক্ষাৎকারে অংশ নেন ছেলেমেয়ে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তাসহ ২৩০ জন। কর্মসূচি চলাকালে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ পেয়ে শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে আচরণগত পরিবর্তন লক্ষণীয় হয়ে ওঠে এবং অধিকাংশ স্কুল মাসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা চালু রাখা ও টয়লেট রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে। কিন্তু কভিড পরিস্থিতিজনিত বিরূপতার কারণে সমীক্ষাকালে তাদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনায় ঘাটতি দেখা যায়। কয়েকজন শিক্ষক জানান, মাসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে তাদের অর্জিত জ্ঞান হ্রাস পেয়েছে, এই বিষয়ে কথা বলতে এখন তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। মাসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে স্কুল পরীক্ষায় প্রশ্ন না থাকাও এ বিষয়ক চর্চা ও শিক্ষা স্থায়িত্বশীল করার একটি বড় বাধা বলে তারা জানান।

কর্মসূচি সংশ্লিষ্টরা আশা করেছিলেন, স্কুলগুলোতে স্থানীয় সরকারের শিক্ষা কর্মকর্তাদের মনিটরিং ভিজিট স্কুলে মাসিকবান্ধব টয়লেট নিশ্চিত করায় বাইরে থেকে উৎসাহ জোগানোর মতো একটা ব্যাপার হবে। দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়ার সময় শিক্ষা কর্মকর্তাদের মনিটরিং চেকলিস্ট এবং প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে লকডাউনের সময় কোন ভিজিটই অনুষ্ঠিত হয়নি। অবশ্য সেটা সম্ভবও ছিল না।

এটা স্বীকৃত যে, মাসিকবান্ধব টয়লেট রক্ষণাবেক্ষণের জন্য স্কুলগুলোর নিয়মিত অর্থ সংস্থানের ব্যবস্থা থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঋতু কর্মসূচি স্কুলগুলোকে বিদ্যমান সরকারি বাজেট পাবার ব্যাপারে সহায়তা দেয় ও সক্ষম করে তোলে। তবু আমরা দেখেছি, এই প্রক্রিয়াটি চালু রাখা স্কুলগুলোর পক্ষে খুবই কঠিন ও সময়সাপেক্ষ। কিছু স্কুল সঞ্চয় প্রক্রিয়া চালু করে বা ব্যক্তিগত দান সংগ্রহ করে প্যাডের ব্যবস্থা করলেও অধিকাংশ স্কুলই বাজেট না থাকাকে টয়লেটের রক্ষণাবেক্ষণ চালু রাখা এবং সাবান ও মাসিক উপকরণ সরবরাহের প্রধান বাধা হিসেবে জানিয়েছে।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরু থেকে স্কুলগুলো বন্ধ রয়েছে। ঋতু কর্মসূচির মাধ্যমে মেয়েদের মাসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে স্কুলগুলোতে যে জাগরণ তৈরি হয়েছিল বর্তমান পরিস্থিতিতে তা ধরে রাখা এবং মাসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক শিখন ও মাসিকবান্ধব টয়লেট রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চালু রাখা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এটা নিশ্চিত, ক্রমে করোনা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটবে এবং স্কুলগুলো আবার পুরোদমে কার্যক্রম শুরু করবে। তখন যাতে মেয়েরা স্কুলে মাসিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিকূলতার মুখে না পড়ে সেজন্য এখন থেকেই ভাবতে হবে। আর বৃহত্তর সমাজের সমর্থন ও নিয়মিত সহায়তা ব্যতীত এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ আবশ্যক।

সামাজিক উদ্যোগের ঘাটতি থাকায় স্কুলে মাসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং মাসিকবান্ধব টয়লেট স্থাপন ও তা রক্ষণাবেক্ষণে সরকারি বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকা জরুরি। তাছাড়া, এজন্য শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান ও নিয়মিত স্কুল মনিটরিং নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহের মধ্যে সমন্বয়ও দরকার। এক্ষেত্রে এনজিও এবং নাগরিক সমাজকে সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অ্যাডভোকেসির পাশাপাশি শিক্ষক, অভিভাবক ও স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির সঙ্গে মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। তবেই টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি)’র ৩, ৪, ৫ ও ৬ নম্বর লক্ষ্যের সফল বাস্তবায়ন তথা প্রতিটি স্কুলে মাসিকবান্ধব একটি পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হবে।

[লেখক : সাংবাদিক]

back to top