alt

উপ-সম্পাদকীয়

গাছ কাটার অপসংস্কৃতি ছাড়ুন শহরটাকে বাসযোগ্য থাকতে দিন

মনজুরুল হক

: রোববার, ০৯ মে ২০২১
image

একাকী একটি গাছ মানুষকে কতভাবে লালন-পালন করে সেটা যদি মানুষ সত্যিকার অর্থে বুঝতে পারত তাহলে পৃথিবীর একটি গাছও সে কাটত না। দুঃখজনক হলো মানুষ সেভাবে কোনোদিনই বোঝেনি। যারা শিক্ষা-দীক্ষা অর্জন করেছেন তারা শুধু মনে করেন গাছ আমাদের ফল-ফুল দেয়, ছায়া দেয়, কাঠ দেয়। তারা কখনই তলিয়ে দেখেননি রাতারাতি এই পৃথিবী গাছশূন্য হয়ে গেলে চার দিনের মাথায় মানবপ্রজাতিই নিঃশেষ হয়ে যাবে! তারপরও আমাদের শিক্ষিত সমাজে গাছ না কাটার এবং গাছের চারা রোপণের সংস্কৃতি গড়ে উঠল না। স্কুলে-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে গাছ বিষয়ক বিভাগ থাকলেও গাছের ওপরকার নির্ভরযোগ্যতা এবং গাছের অপরিহার্যতা নিয়ে কোনো বিশেষায়িত শিক্ষা নেই। আমাদের শিক্ষিত সমাজে সে কারণে গাছের কোনো কদর নেই। এরা কেবল নগরীর শোভার জন্য ফুল গাছ লাগাতে নসিয়ত করে। আর মেহগনি কাঠের আসবাবের জন্য মেহগনি লাগাতে বলে।

দেশ স্বাধীনের পর রমনার রেসকোর্স ময়দানকে বনায়ন করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামকরণ হয়। সেই চারাগাছগুলো গত ৪৯ বছর ধরে মহীরূহ হয়েছে। ওই গোটা অঞ্চলটাকে শীতল রাখে। এই রুগ্ন শহরের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষের অক্সিজেন সাপ্লাই দেয়। এরই মধ্যে শিশুপার্ক, স্বাধীনতা স্তম্ভ, সরোবর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, গলফ কোর্সসহ এটা সেটা করে উদ্যানের তিন ভাগের দুই ভাগ খেয়ে ফেলা হয়েছে। উদ্যানজুড়েই ময়লা-আবর্জনা ফেলার ডাম্প স্টেশন যেন।

বছর বছর বইমেলার জন্য আরও বেশি বৃক্ষশূন্য হচ্ছে। এবার কয়েক দিন আগে হুট করে একটি মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প হিসেবে হোটেল-রেস্টুরেন্ট, কারপার্ক বানানোর জন্য নির্বিচারে বড় বড় গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। অথচ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটার ওপর কোর্টের নিষেধাজ্ঞা ছিল। আদালতের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রেস্টুরেন্ট স্থাপনের জন্য গাছকাটা বন্ধ করতে সংশ্লিষ্টদের আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ, গণপূর্ত বিভাগের চিফ ইঞ্জিনিয়ার মো. শামিম আখতার ও চিফ আর্কিটেক্ট অব বাংলাদেশ মীর মনজুর রহমানকে এ নোটিশ পাঠানো হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (৬ মে) সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ এ নোটিশ পাঠান। এতে বলা হয়েছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সংরক্ষণের নির্দেশনা চেয়ে ২০০৯ সালে দায়ের করা রিটের পর তৎকালিন বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ও বিচারপতি মো. মমতাজ উদ্দিন আহমেদের হাইকোর্ট বেঞ্চ উদ্যান সংরক্ষণে কয়েক দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন।

প্রকৃতির প্রতি নিষ্ঠুরতারও একটা সীমা আছে, অথচ আমাদের দেশে প্রকৃতি ধ্বংস করে নগরায়ন করাটাই যেন এখন সবচেয়ে বড় উন্নয়ন। একটা উদাহরণ : যশোর রোডের ঐতিহ্যবাহী রেইনট্রি গাছগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। ব্যাখা- রাস্তার উন্নয়ন। এখানে উন্নয়ন মানেই সবার আগে গাছ কাটা! এটা যশোর রোডের ঐতিহ্যের বিপর্যয়। যশোর রোড কলকাতা পর্যন্ত যার বিস্তৃতি বা আন্তর্জাতিক পরিচিতি, যেখানে পেট্রাপোল থেকে কলকাতা পর্যন্ত তারা তাদের ঐতিহ্যবাহী গাছগুলো রক্ষা করতে পারলেও বাংলাদেশে পারা যায়নি।

গাছ নিয়ে কথা তুললে যে বিষয়টি সবার আগে বলতে হবে তা জলবায়ু। জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের বায়ুমন্ডলে মিথেন গ্যাসের রহস্যময় ধোঁয়া শনাক্ত করেছে একাধিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা। মিথেন গ্যাসের অন্যতম প্রধান হটস্পট হয়ে উঠেছে রাজধানীর মাতুয়াইল স্যানিটারি ল্যান্ডফিল। সেখান থেকে প্রতি ঘণ্টায় চার হাজার কেজি মিথেন নির্গত হচ্ছে বলে বিশ্বখ্যাত ব্লুমবার্গ নিউজে গত ২৫ এপ্রিল একটা খবর প্রকাশিত হয় জিএইচজিস্যাট ইনকের বরাত দিয়ে। ব্লুমবার্গ নিউজে উল্লেখ করা হয়, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার কোনো এক অংশ থেকে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধিতে সবচেয়ে ক্ষতিকর ভূমিকা রাখা গ্রিনহাউস গ্যাসগুলোর একটা, মিথেন গ্যাসের একটা বিশাল নিঃসরণ চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাৎ ঢাকার কোনো এক অংশ থেকে প্রচুর পরিমাণে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হচ্ছে; যা পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে বাংলাদেশকে এই মুহূর্তে মিথেন গ্যাসের অন্যতম প্রধান কন্ট্রিবিউটর বানিয়ে দিয়েছে।

মিথেন গ্রিনহাউস গ্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান ডেডলিয়েস্ট গ্যাস, যা কিনা গত দুই দশকে কার্বন ডাই-অক্সাইড (যেটাকে উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয়) এর চেয়েও ৮৪ গুণ বেশি ক্ষতি করেছে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের। এই ঘ্রাণহীন বর্ণহীন গ্যাস সূর্যের যে তাপ পৃথিবীতে আসছে, সেটাকে পৃথিবীতেই ধরে রাখতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে, যা পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে বহুগুণে এবং খুব দ্রুত। ফলে বাড়তি তাপমাত্রা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়িয়ে দিচ্ছে, আমাদের মতো সমুদ্র তীরবর্তী দেশের জন্য যা অনিবার্য অভিশাপ। ক্লাইমেট চেঞ্জের ফলে গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের মাধ্যমে এভাবেই আমাদের সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়ার ভয়াবহ ঝুঁকিতে আছে। যদি এই ভয়াবহ বিষয়টি মাথায় রাখা হতো তাহলে গাছ কাটা দূরের কথা, নগর কর্তৃপক্ষের প্রধান কর্তব্য হতে হতো সারা শহরে সারা দেশে জরুরিভাবে লাখ লাখ গাছ লাগানো। এই নগরীর তাপমাত্রা প্রতি বছর একটু একটু বাড়ছে। এখন তো এই বৃদ্ধির হার ভয়াবহ মাত্রায়। প্রচন্ড গরম অথচ ঘাম নেই। মানে আদ্রতা শেষ হয়ে যাচ্ছে। বৃক্ষহীন একটি শহরে আরও যে সব বিপদ লালন-পালন করা হচ্ছে তার অন্যতম লাখ লাখ এয়ারকন্ডিশনার! ছোট্ট একটা হিসাব দেয়া যাক- পুরো ধানমন্ডি এলাকায় এক হাজার ১৬৮টি দালান রয়েছে। প্রতিটিতে গড়ে দশটি করে ফ্লোর ধরা হলে তার সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ হাজারের বেশি। একটি ফ্লোরে কমপক্ষে দশটি এসি থাকলে ধানমন্ডি এলাকাতেই এসি থাকে এক লাখের বেশি। প্রতিটি এসি যদি এক বর্গফুট এলাকাকেও উত্তপ্ত করে তবে এই এক লাখ এসি এক লাখ বর্গফুট এলাকাকে উত্তপ্ত করে দিচ্ছে। এসির ব্যবহার বাড়তে থাকায় বিদ্যুতের উপরও যে চাপ পড়ছে। বিদ্যুতের চাহিদাও বেড়ে যাচ্ছে। সেটা মেটাতে সরকার বিভিন্ন পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরি করছে, সেগুলোও আবার পরিবেশের একটা বিরাট অংশের ক্ষতি সাধন করছে। এসিতে ব্যবহার হওয়া গ্যাস রেফ্রিজারেন্ট নামে পরিচিত। নব্বইয়ের দশকেও এসিতে ক্লোরোফ্লুরোকার্বন (সিএফসি) রেফ্রিজারেন্ট ব্যবহার হত, যা ফ্রেয়ন বা আর-২২ নামেও পরিচিতি। বায়ুমন্ডলের ওজন স্তরের উপর এই গ্যাসের বিরূপ প্রভাব নিয়ে শঙ্কার প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র ২০১০ সাল থেকে দেশটির বিশুদ্ধ বাতাস নীতিমালার অধীনে আর-২২ গ্যাসের উৎপাদন ও আমদানি বন্ধ করে।

যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা ইপিএ বলছে, নব্বইয়ের দশকে দেশটিতে সিএফসির ব্যবহার বন্ধ হয়। এখন তারা হাইড্রো ক্লোরোফ্লুরোকার্বন (এইচসিএফসি) বন্ধের পর্যায়ে রয়েছে। ওজন স্তরের সুরক্ষায় ভিয়েনা কনভেনশনের অধীনে ১৯৮৭ সালে মন্ট্রিয়ল প্রটোকল নামে আন্তর্জাতিক চুক্তি হয়। এতে শিল্পায়নের কারণে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সিএফসি ও এইচসিএফসির মতো পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক রাসায়নিক গ্যাসের ব্যবহার বন্ধের সিদ্ধান্ত রয়েছে।

গাছ কমে গেলে কী হয়? মানবসৃষ্ট উৎপাদিত ক্ষতিকারক পদার্থ, যেমন- গ্রিন হাউস গ্যাস, ইগজোস্ট গ্যাস, তেজস্ক্রিয় পদার্থ, শিল্পকারখানার রাসায়নিক বর্জ্য, আর্সেনিকযুক্ত বর্জ্য, পারদ, ক্যাডমিয়াম, সিসা, বালাইনাশক, আগাছানাশক, ধোঁয়া, ধোঁয়াশা, ধূলিকণা, ময়লা-আর্বজনা ইত্যাদি মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষণ করে। গ্রিনহাউস ইফেক্টের কারণে বায়ুমন্ডলের তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই গ্যাসে কার্বন ডাইঅক্সাইড ৫০%, মিথেন ২০%, সিএফসি ১০%, নাইট্রাস অক্সাইড ১০% এবং অবশিষ্ট ১০% কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন পারঅক্সাইড ও কিছু অন্যান্য গ্যাস থাকে। বিজ্ঞানীদের ধারণা গ্রিন হাউস ইফেক্টের কারণে তাপ বৃদ্ধির ফলে শিগগিরই মেরু অঞ্চল ও পর্বতশ্রেণীর বরফ গলে সাগরের পানির উচ্চতা ১-২ মিটার বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে পৃর্থিবীর অধিকাংশ দ্বীপ সমুদ্রের লোনা পানির নিচে ডুবে যাবে এবং কোটি কোটি মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়বে ও প্রকট খাদ্য সঙ্কট দেখা দেবে।

রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার, পলিথিন, প্লাস্টিক ও রঙ তৈরির কারখানা থেকে ক্লোরোফ্লোরো কার্বন (সিএফসি) গ্যাস নির্গত হয়। এ গ্যাস বায়ুমন্ডলের ওজোন স্তরকে ধ্বংস করে। এক অণু সিএফসি প্রায় দুই হাজার ওজোন অণুকে ধ্বংস করতে পারে। এ গ্যাস বৃদ্ধির কারণে ওজোন স্তরের অনেক স্থান পাতলা ও কোথাও কোথাও ছিদ্রও হয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন। ওজোন স্তর ছিদ্র হলে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি এবং কসমিক রশ্মি সরাসরি পৃথিবীতে এসে প্রথমে ফাইটোপ্লাংটনসহ বিভিন্ন অণুজীব ও পরে উদ্ভিদ জগৎ ও প্রাণিকুলের মারাত্মক ক্ষতি করবে। এতে ক্যান্সার রোগের প্রকোপ বেড়ে যাবে।

বাতাসে অক্সিজেন ব্যতীত অন্যান্য গ্যাস ও ধূলিকণার পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে বায়ু দূষিত হয়। পৃথিবীর সব প্রাণী শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় অক্সিজেন গ্রহণ ও কার্বন ডাইঅক্সাইড ত্যাগ করে। অপরদিকে বৃক্ষরাজি কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ ও অক্সিজেন ত্যাগ করে। পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নির্বিচারে সবুজ বৃক্ষ নিধন করার কারণে বৃক্ষ হ্রাস পাচ্ছে। তাই পরিবেশের সবটুকু ঈঙ২ বৃক্ষরাজি শোষণ করতে পারছে না। ফলে বাতাসে ঈঙ২ এর মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও শিল্প-কারখানা, ইটভাটার চিমনি এবং মোটরযান হতে নির্গত- ধোঁয়া, ধোঁয়াশা, বর্জ্য, এগজোস্ট গ্যাস, গ্রিন হাউস গ্যাস ইত্যাদি দ্বারা বায়ু দূষিত হচ্ছে। মানুষের শ্বাস গ্রহণের সময় দূষিত বায়ু দেহের মধ্যে প্রবেশ করে রক্তের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে যকৃত, অগ্নাশয় ও বৃক্কে ক্রমান্বয়ে জমা হয়। এর ফলে বমি, মাথা ব্যথা, বুক ব্যথা, নাক-মুখ জ্বালা, অ্যাজমা, অ্যালার্জি, স্নায়ুবিক দুর্বলতা, মানসিক অস্থিরতা, ক্যান্সার ইত্যাদি জটিল রোগের অন্যতম কারণ।

এসব হলো তত্ত্বকথা। ব্যুরোক্র্যাসির কাছে এসব কথার কোন মূল্য নেই। তারা উন্নয়ন বলতে বুঝে গাছ কাটা, নদী দখল, সবুজ উচ্ছেদ, আর হাই স্কাইক্র্যাপার নির্মাণ। এতে কাড়ি কাড়ি টাকা আসে যে! একটা অবোধ গাছ তো টাকা দেয় না। দীর্ঘমেয়াদে উন্নয়নের নাম করে লুটপাটের এ এক নির্দয় মচ্ছব।

গাছ কাটার ব্যুরোক্র্যাটিক বজ্জাতি ফর্মূলা আছে। সবার অলক্ষ্যে গাছ কেটে ফেলা হবে। এরপর প্রতিবাদ হলে ‘বৃহত্তর স্বার্থের’ কথা বলে বিবৃতি দেয়া হবে। গাছ তো আর তাজা করা যাবে না। সুতরাং শোকসভা করুন আর মানববন্ধন। তাতে কিচ্ছু আসে-যায় না। এই ফর্মূলাতে যশোর রোডের শতবর্ষী গাছগুলোও কাটা হয়েছিল। হয়ত রিট-টিট করে দুই-একটা বাঁচানো যাবে। তাতে ওদের উদ্দেশ্য অসফল হবে না।

গত বছর রাজশাহী মেডিকেল কলেজের বড়কর্তা এক সামরিক অফিসারের মাথায় পাখির মল পড়েছিল। পরদিনই তিনি ওই পথের গাছ এবং ডাল-পালা কাটার আদেশ দেন। যথারীতি সবই কেটে ফেলা হয়। কারও কোনোরকম প্রতিবাদ করারও সময় হয়নি। কেউ সুযোগ পায়নি। তার আগেই পথের ধারের গাছের সব ডাল কেটে দেয়া হয়েছিল যেন পাখিরা বসতে না পারে এবং অধ্যক্ষর মাথায় মলত্যাগ করতে না পারে!

এ দেশের যা কিছু সর্বনাশ অনিষ্ট তার বেশিরভাগই করে শিক্ষিত মানুষ। কোনো একজন দরিদ্র মানুষ বিনাকারণে একটা ঘাসও নষ্ট করে না। এক বর্বরকে ঠেকালে, আরও শত শত বর্বর ধ্বংসযজ্ঞে নেমে পড়বে। তারপর ‘শহরাঞ্চলে বৃক্ষরোপণ কৌশল’ শিখতে বিদেশ সফর করবে সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে। এই-ই তো হয়ে আসছে। খিচুড়ি রান্না শিখতেও তো এরা বিদেশ সফরের আব্দার করেন!

শেষ কথা হলো আমাদের এই শহরেই করেকম্মে খেয়ে বাঁচতে হবে। তাই ন্যূনতম পক্ষে বাঁচার জন্য পরিবেশ যতটুকু সম্ভব রক্ষা করতে হবে; হবেই। এর কোনো বিকল্প নেই। প্রতি বছর এই শহরের তাপমাত্র ১ ডিগ্রি করে বাড়বে; বাড়বেই। এখনই সাব্যস্ত করতে হবে আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে একটা শ্যামল শহরে রাখব, না মরুভূমিতে ফেলে যাব?

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক]

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি

ঈদের অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ‘পোস্ট পার্টিশন সিনড্রম’

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

রম্যগদ্য : ‘প্রহরীর সাতশ কোটি টাকা...’

ছবি

অবন্তিকাদের আত্মহনন

শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা

অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান নয়

পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে

আত্মহত্যা রোধে নৈতিক শিক্ষা

আউশ ধান : পরিবেশ ও কৃষকবান্ধব ফসল

ছবি

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আতুড়ঘর

চেক ডিজঅনার মামলার অধিক্ষেত্র ও প্রাসঙ্গিকতা

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের কৃষি

ছবি

‘হৃৎ কলমের’ পাখি এবং আমাদের জেগে ওঠা

ছবি

ভূগর্ভস্থ পানি সুরক্ষায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

গাছ কাটার অপসংস্কৃতি ছাড়ুন শহরটাকে বাসযোগ্য থাকতে দিন

মনজুরুল হক

image

রোববার, ০৯ মে ২০২১

একাকী একটি গাছ মানুষকে কতভাবে লালন-পালন করে সেটা যদি মানুষ সত্যিকার অর্থে বুঝতে পারত তাহলে পৃথিবীর একটি গাছও সে কাটত না। দুঃখজনক হলো মানুষ সেভাবে কোনোদিনই বোঝেনি। যারা শিক্ষা-দীক্ষা অর্জন করেছেন তারা শুধু মনে করেন গাছ আমাদের ফল-ফুল দেয়, ছায়া দেয়, কাঠ দেয়। তারা কখনই তলিয়ে দেখেননি রাতারাতি এই পৃথিবী গাছশূন্য হয়ে গেলে চার দিনের মাথায় মানবপ্রজাতিই নিঃশেষ হয়ে যাবে! তারপরও আমাদের শিক্ষিত সমাজে গাছ না কাটার এবং গাছের চারা রোপণের সংস্কৃতি গড়ে উঠল না। স্কুলে-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে গাছ বিষয়ক বিভাগ থাকলেও গাছের ওপরকার নির্ভরযোগ্যতা এবং গাছের অপরিহার্যতা নিয়ে কোনো বিশেষায়িত শিক্ষা নেই। আমাদের শিক্ষিত সমাজে সে কারণে গাছের কোনো কদর নেই। এরা কেবল নগরীর শোভার জন্য ফুল গাছ লাগাতে নসিয়ত করে। আর মেহগনি কাঠের আসবাবের জন্য মেহগনি লাগাতে বলে।

দেশ স্বাধীনের পর রমনার রেসকোর্স ময়দানকে বনায়ন করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামকরণ হয়। সেই চারাগাছগুলো গত ৪৯ বছর ধরে মহীরূহ হয়েছে। ওই গোটা অঞ্চলটাকে শীতল রাখে। এই রুগ্ন শহরের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষের অক্সিজেন সাপ্লাই দেয়। এরই মধ্যে শিশুপার্ক, স্বাধীনতা স্তম্ভ, সরোবর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, গলফ কোর্সসহ এটা সেটা করে উদ্যানের তিন ভাগের দুই ভাগ খেয়ে ফেলা হয়েছে। উদ্যানজুড়েই ময়লা-আবর্জনা ফেলার ডাম্প স্টেশন যেন।

বছর বছর বইমেলার জন্য আরও বেশি বৃক্ষশূন্য হচ্ছে। এবার কয়েক দিন আগে হুট করে একটি মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প হিসেবে হোটেল-রেস্টুরেন্ট, কারপার্ক বানানোর জন্য নির্বিচারে বড় বড় গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। অথচ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটার ওপর কোর্টের নিষেধাজ্ঞা ছিল। আদালতের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রেস্টুরেন্ট স্থাপনের জন্য গাছকাটা বন্ধ করতে সংশ্লিষ্টদের আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ, গণপূর্ত বিভাগের চিফ ইঞ্জিনিয়ার মো. শামিম আখতার ও চিফ আর্কিটেক্ট অব বাংলাদেশ মীর মনজুর রহমানকে এ নোটিশ পাঠানো হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (৬ মে) সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ এ নোটিশ পাঠান। এতে বলা হয়েছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সংরক্ষণের নির্দেশনা চেয়ে ২০০৯ সালে দায়ের করা রিটের পর তৎকালিন বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ও বিচারপতি মো. মমতাজ উদ্দিন আহমেদের হাইকোর্ট বেঞ্চ উদ্যান সংরক্ষণে কয়েক দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন।

প্রকৃতির প্রতি নিষ্ঠুরতারও একটা সীমা আছে, অথচ আমাদের দেশে প্রকৃতি ধ্বংস করে নগরায়ন করাটাই যেন এখন সবচেয়ে বড় উন্নয়ন। একটা উদাহরণ : যশোর রোডের ঐতিহ্যবাহী রেইনট্রি গাছগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। ব্যাখা- রাস্তার উন্নয়ন। এখানে উন্নয়ন মানেই সবার আগে গাছ কাটা! এটা যশোর রোডের ঐতিহ্যের বিপর্যয়। যশোর রোড কলকাতা পর্যন্ত যার বিস্তৃতি বা আন্তর্জাতিক পরিচিতি, যেখানে পেট্রাপোল থেকে কলকাতা পর্যন্ত তারা তাদের ঐতিহ্যবাহী গাছগুলো রক্ষা করতে পারলেও বাংলাদেশে পারা যায়নি।

গাছ নিয়ে কথা তুললে যে বিষয়টি সবার আগে বলতে হবে তা জলবায়ু। জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের বায়ুমন্ডলে মিথেন গ্যাসের রহস্যময় ধোঁয়া শনাক্ত করেছে একাধিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা। মিথেন গ্যাসের অন্যতম প্রধান হটস্পট হয়ে উঠেছে রাজধানীর মাতুয়াইল স্যানিটারি ল্যান্ডফিল। সেখান থেকে প্রতি ঘণ্টায় চার হাজার কেজি মিথেন নির্গত হচ্ছে বলে বিশ্বখ্যাত ব্লুমবার্গ নিউজে গত ২৫ এপ্রিল একটা খবর প্রকাশিত হয় জিএইচজিস্যাট ইনকের বরাত দিয়ে। ব্লুমবার্গ নিউজে উল্লেখ করা হয়, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার কোনো এক অংশ থেকে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধিতে সবচেয়ে ক্ষতিকর ভূমিকা রাখা গ্রিনহাউস গ্যাসগুলোর একটা, মিথেন গ্যাসের একটা বিশাল নিঃসরণ চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাৎ ঢাকার কোনো এক অংশ থেকে প্রচুর পরিমাণে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হচ্ছে; যা পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে বাংলাদেশকে এই মুহূর্তে মিথেন গ্যাসের অন্যতম প্রধান কন্ট্রিবিউটর বানিয়ে দিয়েছে।

মিথেন গ্রিনহাউস গ্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান ডেডলিয়েস্ট গ্যাস, যা কিনা গত দুই দশকে কার্বন ডাই-অক্সাইড (যেটাকে উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয়) এর চেয়েও ৮৪ গুণ বেশি ক্ষতি করেছে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের। এই ঘ্রাণহীন বর্ণহীন গ্যাস সূর্যের যে তাপ পৃথিবীতে আসছে, সেটাকে পৃথিবীতেই ধরে রাখতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে, যা পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে বহুগুণে এবং খুব দ্রুত। ফলে বাড়তি তাপমাত্রা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়িয়ে দিচ্ছে, আমাদের মতো সমুদ্র তীরবর্তী দেশের জন্য যা অনিবার্য অভিশাপ। ক্লাইমেট চেঞ্জের ফলে গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের মাধ্যমে এভাবেই আমাদের সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়ার ভয়াবহ ঝুঁকিতে আছে। যদি এই ভয়াবহ বিষয়টি মাথায় রাখা হতো তাহলে গাছ কাটা দূরের কথা, নগর কর্তৃপক্ষের প্রধান কর্তব্য হতে হতো সারা শহরে সারা দেশে জরুরিভাবে লাখ লাখ গাছ লাগানো। এই নগরীর তাপমাত্রা প্রতি বছর একটু একটু বাড়ছে। এখন তো এই বৃদ্ধির হার ভয়াবহ মাত্রায়। প্রচন্ড গরম অথচ ঘাম নেই। মানে আদ্রতা শেষ হয়ে যাচ্ছে। বৃক্ষহীন একটি শহরে আরও যে সব বিপদ লালন-পালন করা হচ্ছে তার অন্যতম লাখ লাখ এয়ারকন্ডিশনার! ছোট্ট একটা হিসাব দেয়া যাক- পুরো ধানমন্ডি এলাকায় এক হাজার ১৬৮টি দালান রয়েছে। প্রতিটিতে গড়ে দশটি করে ফ্লোর ধরা হলে তার সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ হাজারের বেশি। একটি ফ্লোরে কমপক্ষে দশটি এসি থাকলে ধানমন্ডি এলাকাতেই এসি থাকে এক লাখের বেশি। প্রতিটি এসি যদি এক বর্গফুট এলাকাকেও উত্তপ্ত করে তবে এই এক লাখ এসি এক লাখ বর্গফুট এলাকাকে উত্তপ্ত করে দিচ্ছে। এসির ব্যবহার বাড়তে থাকায় বিদ্যুতের উপরও যে চাপ পড়ছে। বিদ্যুতের চাহিদাও বেড়ে যাচ্ছে। সেটা মেটাতে সরকার বিভিন্ন পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরি করছে, সেগুলোও আবার পরিবেশের একটা বিরাট অংশের ক্ষতি সাধন করছে। এসিতে ব্যবহার হওয়া গ্যাস রেফ্রিজারেন্ট নামে পরিচিত। নব্বইয়ের দশকেও এসিতে ক্লোরোফ্লুরোকার্বন (সিএফসি) রেফ্রিজারেন্ট ব্যবহার হত, যা ফ্রেয়ন বা আর-২২ নামেও পরিচিতি। বায়ুমন্ডলের ওজন স্তরের উপর এই গ্যাসের বিরূপ প্রভাব নিয়ে শঙ্কার প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র ২০১০ সাল থেকে দেশটির বিশুদ্ধ বাতাস নীতিমালার অধীনে আর-২২ গ্যাসের উৎপাদন ও আমদানি বন্ধ করে।

যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা ইপিএ বলছে, নব্বইয়ের দশকে দেশটিতে সিএফসির ব্যবহার বন্ধ হয়। এখন তারা হাইড্রো ক্লোরোফ্লুরোকার্বন (এইচসিএফসি) বন্ধের পর্যায়ে রয়েছে। ওজন স্তরের সুরক্ষায় ভিয়েনা কনভেনশনের অধীনে ১৯৮৭ সালে মন্ট্রিয়ল প্রটোকল নামে আন্তর্জাতিক চুক্তি হয়। এতে শিল্পায়নের কারণে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সিএফসি ও এইচসিএফসির মতো পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক রাসায়নিক গ্যাসের ব্যবহার বন্ধের সিদ্ধান্ত রয়েছে।

গাছ কমে গেলে কী হয়? মানবসৃষ্ট উৎপাদিত ক্ষতিকারক পদার্থ, যেমন- গ্রিন হাউস গ্যাস, ইগজোস্ট গ্যাস, তেজস্ক্রিয় পদার্থ, শিল্পকারখানার রাসায়নিক বর্জ্য, আর্সেনিকযুক্ত বর্জ্য, পারদ, ক্যাডমিয়াম, সিসা, বালাইনাশক, আগাছানাশক, ধোঁয়া, ধোঁয়াশা, ধূলিকণা, ময়লা-আর্বজনা ইত্যাদি মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষণ করে। গ্রিনহাউস ইফেক্টের কারণে বায়ুমন্ডলের তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই গ্যাসে কার্বন ডাইঅক্সাইড ৫০%, মিথেন ২০%, সিএফসি ১০%, নাইট্রাস অক্সাইড ১০% এবং অবশিষ্ট ১০% কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন পারঅক্সাইড ও কিছু অন্যান্য গ্যাস থাকে। বিজ্ঞানীদের ধারণা গ্রিন হাউস ইফেক্টের কারণে তাপ বৃদ্ধির ফলে শিগগিরই মেরু অঞ্চল ও পর্বতশ্রেণীর বরফ গলে সাগরের পানির উচ্চতা ১-২ মিটার বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে পৃর্থিবীর অধিকাংশ দ্বীপ সমুদ্রের লোনা পানির নিচে ডুবে যাবে এবং কোটি কোটি মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়বে ও প্রকট খাদ্য সঙ্কট দেখা দেবে।

রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার, পলিথিন, প্লাস্টিক ও রঙ তৈরির কারখানা থেকে ক্লোরোফ্লোরো কার্বন (সিএফসি) গ্যাস নির্গত হয়। এ গ্যাস বায়ুমন্ডলের ওজোন স্তরকে ধ্বংস করে। এক অণু সিএফসি প্রায় দুই হাজার ওজোন অণুকে ধ্বংস করতে পারে। এ গ্যাস বৃদ্ধির কারণে ওজোন স্তরের অনেক স্থান পাতলা ও কোথাও কোথাও ছিদ্রও হয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন। ওজোন স্তর ছিদ্র হলে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি এবং কসমিক রশ্মি সরাসরি পৃথিবীতে এসে প্রথমে ফাইটোপ্লাংটনসহ বিভিন্ন অণুজীব ও পরে উদ্ভিদ জগৎ ও প্রাণিকুলের মারাত্মক ক্ষতি করবে। এতে ক্যান্সার রোগের প্রকোপ বেড়ে যাবে।

বাতাসে অক্সিজেন ব্যতীত অন্যান্য গ্যাস ও ধূলিকণার পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে বায়ু দূষিত হয়। পৃথিবীর সব প্রাণী শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় অক্সিজেন গ্রহণ ও কার্বন ডাইঅক্সাইড ত্যাগ করে। অপরদিকে বৃক্ষরাজি কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ ও অক্সিজেন ত্যাগ করে। পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নির্বিচারে সবুজ বৃক্ষ নিধন করার কারণে বৃক্ষ হ্রাস পাচ্ছে। তাই পরিবেশের সবটুকু ঈঙ২ বৃক্ষরাজি শোষণ করতে পারছে না। ফলে বাতাসে ঈঙ২ এর মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও শিল্প-কারখানা, ইটভাটার চিমনি এবং মোটরযান হতে নির্গত- ধোঁয়া, ধোঁয়াশা, বর্জ্য, এগজোস্ট গ্যাস, গ্রিন হাউস গ্যাস ইত্যাদি দ্বারা বায়ু দূষিত হচ্ছে। মানুষের শ্বাস গ্রহণের সময় দূষিত বায়ু দেহের মধ্যে প্রবেশ করে রক্তের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে যকৃত, অগ্নাশয় ও বৃক্কে ক্রমান্বয়ে জমা হয়। এর ফলে বমি, মাথা ব্যথা, বুক ব্যথা, নাক-মুখ জ্বালা, অ্যাজমা, অ্যালার্জি, স্নায়ুবিক দুর্বলতা, মানসিক অস্থিরতা, ক্যান্সার ইত্যাদি জটিল রোগের অন্যতম কারণ।

এসব হলো তত্ত্বকথা। ব্যুরোক্র্যাসির কাছে এসব কথার কোন মূল্য নেই। তারা উন্নয়ন বলতে বুঝে গাছ কাটা, নদী দখল, সবুজ উচ্ছেদ, আর হাই স্কাইক্র্যাপার নির্মাণ। এতে কাড়ি কাড়ি টাকা আসে যে! একটা অবোধ গাছ তো টাকা দেয় না। দীর্ঘমেয়াদে উন্নয়নের নাম করে লুটপাটের এ এক নির্দয় মচ্ছব।

গাছ কাটার ব্যুরোক্র্যাটিক বজ্জাতি ফর্মূলা আছে। সবার অলক্ষ্যে গাছ কেটে ফেলা হবে। এরপর প্রতিবাদ হলে ‘বৃহত্তর স্বার্থের’ কথা বলে বিবৃতি দেয়া হবে। গাছ তো আর তাজা করা যাবে না। সুতরাং শোকসভা করুন আর মানববন্ধন। তাতে কিচ্ছু আসে-যায় না। এই ফর্মূলাতে যশোর রোডের শতবর্ষী গাছগুলোও কাটা হয়েছিল। হয়ত রিট-টিট করে দুই-একটা বাঁচানো যাবে। তাতে ওদের উদ্দেশ্য অসফল হবে না।

গত বছর রাজশাহী মেডিকেল কলেজের বড়কর্তা এক সামরিক অফিসারের মাথায় পাখির মল পড়েছিল। পরদিনই তিনি ওই পথের গাছ এবং ডাল-পালা কাটার আদেশ দেন। যথারীতি সবই কেটে ফেলা হয়। কারও কোনোরকম প্রতিবাদ করারও সময় হয়নি। কেউ সুযোগ পায়নি। তার আগেই পথের ধারের গাছের সব ডাল কেটে দেয়া হয়েছিল যেন পাখিরা বসতে না পারে এবং অধ্যক্ষর মাথায় মলত্যাগ করতে না পারে!

এ দেশের যা কিছু সর্বনাশ অনিষ্ট তার বেশিরভাগই করে শিক্ষিত মানুষ। কোনো একজন দরিদ্র মানুষ বিনাকারণে একটা ঘাসও নষ্ট করে না। এক বর্বরকে ঠেকালে, আরও শত শত বর্বর ধ্বংসযজ্ঞে নেমে পড়বে। তারপর ‘শহরাঞ্চলে বৃক্ষরোপণ কৌশল’ শিখতে বিদেশ সফর করবে সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে। এই-ই তো হয়ে আসছে। খিচুড়ি রান্না শিখতেও তো এরা বিদেশ সফরের আব্দার করেন!

শেষ কথা হলো আমাদের এই শহরেই করেকম্মে খেয়ে বাঁচতে হবে। তাই ন্যূনতম পক্ষে বাঁচার জন্য পরিবেশ যতটুকু সম্ভব রক্ষা করতে হবে; হবেই। এর কোনো বিকল্প নেই। প্রতি বছর এই শহরের তাপমাত্র ১ ডিগ্রি করে বাড়বে; বাড়বেই। এখনই সাব্যস্ত করতে হবে আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে একটা শ্যামল শহরে রাখব, না মরুভূমিতে ফেলে যাব?

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক]

back to top