alt

উপ-সম্পাদকীয়

মধ্যবিত্তবিহীন ঝুঁকিপূর্ণ উন্নয়ন কৌশল

শঙ্কর প্রসাদ দে

: শনিবার, ০৫ জুন ২০২১

বলা হচ্ছে বাজেট কৌশলের কারণে এক দশক ধরে চাল, ডাল, মাছ, সবজিসহ বেশকিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম মুদ্রাস্ফীতির নিচে রয়েছে। এটাও বলা হচ্ছে কৃষিতে ভর্তুকি, বিদ্যুৎ সরবরাহ, সহনীয় কর ব্যবস্থা এতে ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের এমন কোন কৃষি পণ্য নেই যা বহির্বিশ্বে রপ্তানি হয় না। কথাগুলো সত্য। কিন্তু কৃষি থেকে সঞ্চয় বৃদ্ধির কোন উদ্যোগ বাজেটে নেই।

বাজার ব্যবস্থায় বর্তমানে দু’ধরনের অর্থনৈতিক অর্থব্যবস্থা জনপ্রিয়। প্রথমত; উন্নয়নশীল দেশগুলো গুরুত্ব দেয় কৃষি, ক্ষুদ্র শিল্প, বনজ শিল্প, মৎস্য, অপ্রচলিত পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি। এতো দুটো লাভ। কৃষিতে অর্থনীতির স্বনির্ভরতা অর্জন। কৃষির স্বনির্ভরতা সঞ্চয় প্রবণতা সৃষ্টি করে। সরকারগুলোর দায়িত্ব কৃষিতে ঘনীভূত সঞ্চয়গুলোর জন্য ব্যাংক নিরাপত্তা সৃষ্টি করা। ক্ষুদ্র সঞ্চয়গুলোকে ক্রমশ পুঁজিতে রূপান্তরই হলো উন্নয়ন। যে দেশে কৃষি থেকে দ্রুত পুঁজির সৃষ্টি হয় সে দেশে দ্রুত বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়। এই প্রক্রিয়ার ভালো উদাহরণ হলো ভারত, এই শতাব্দীর শুরু থেকে ভারত এবং ব্রাজিল এই মডেল অনুসরণ করছে।

উন্নয়নশীল দেশগুলো এই মডেল গ্রহণ করেছে চীন, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো থেকে। এদের বর্তমান যে ঈর্ষণীয় উন্নয়ন গতিধারা, তার মূল ভিত্তি হলো কৃষি। শুধু খানিকটা ব্যতিক্রম চীন, চীন একেবারে মাইক্রোলেভেলে পুতুল থেকে মোবাইল সেট পর্যন্ত হেন জিনিস নেই, যা ছোট ছোট কারখানাগুলোতে উৎপাদন করে না। এখানে যে সঞ্চয় হয় তা পুঁজিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। চীনের বর্তমান অর্থনৈতিক কৌশলই হচ্ছে এসব ছোট ছোট পুঁজিকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা। চীনের এ মডেল এতই ব্যতিক্রমী যে ইচ্ছে করলেই অন্য কোন দেশের পক্ষে এসব পণ্য উৎপাদন সম্ভব নয়।

ছোট সঞ্চয়-ছোট পুঁজি থেকে-ছোট বিনিয়োগের এই মডেল এখন বিশ্ব নন্দিত।

বাজার ব্যবস্থায় দ্বিতীয় কৌশলটি হলো মাঝারি, বড় বিনিয়োগে এবং বিদেশি বিনিয়োগকে রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎসাহী করা। নিরাপত্তা দেয়া। এটাকে টপ টু ডাউন মডেলও বলা হয়। ইউরোপের সব দেশ এবং আমেরিকা এই মডেলটা ব্যবহার করছে। উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও আর্জেন্টিনাও এই মডেল অনুসরণ করছে। এই কৌশলের বৈশিষ্ট্য হলো এখানে লাখ লাখ বিনিয়োগকারীকে আকৃষ্ট করা হয় না। হাতে গোনা বড় বড় উদ্যোক্তাদের দেদারছে ঋণ দেয়া হয়। এই ঋণ নিয়ে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করে, লভ্যাংশ থেকে ঋণের সুদ দেয়। সরকারকে ট্যাক্স দেয়। কারখানা একটা দিয়ে শুরু করে গ্রুপ অব কোম্পানিতে পরিণত হয়। উন্নত দেশগুলোর প্রবৃদ্ধির এই ধরন আর্জেন্টিনা ও বাংলাদেশে প্রয়োগ করা হচ্ছে।

ডাউন টু টপ ফর্মূলা বিএনপির অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান থেকে আওয়ামী লীগের শাহ্ এমএস কিবরিয়া পর্যন্ত বজায় ছিল। আরও সহজ করে বললে বঙ্গবন্ধুর সরকার, জিয়ার সরকার, এরশাদের সরকার, খালেদা জিয়ার প্রথম মেয়াদ ও শেখ হাসিনা প্রথম মেয়াদ পর্যন্ত এ কৌশল বজায় ছিল। ১৯৭২ থেকে ২০০১ পর্যন্ত সরকারগুলোর পররাষ্ট্রনীতি প্রশ্নে নানা ধরনের কৌশল বদলানোর ঘটনা ঘটলেও বাজার অর্থনীতির সনাতন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। একেবারে গ্রাম থেকে ছোট ছোট সঞ্চয়গুলোকে পুঁজি এবং বিনিয়োগে রূপান্তরের কৌশলটি বজায় ছিল। এই সময়কালে ব্যাংক সুদ, ডাকঘর সঞ্চয় সুদ, সঞ্চয়পত্র সুদ সব সময়ই দু’অঙ্কে ছিল। এরশাদ সাহেব তো প্রতিরক্ষা সঞ্চয়পত্র বলে একটি স্কিম চালু করে সুদ দিয়েছিলেন আঠার শতাংশ। আজ যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সদম্ভ উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে, হাজার হাজার প্রাইভেটকার দেখা যাচ্ছে এগুলো সব এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উপস্থিতির প্রমাণ। এর কৃতিত্ব হলো তাজউদ্দীন থেকে সাইফুর রহমান পর্যন্ত অর্থমন্ত্রীদের। এই শতাব্দীর শুরুতে বাংলাদেশের অর্থনীতির কৌশলগত পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। এখন উন্নয়ন বা প্রবৃদ্ধির জন্য গ্রামীণ ছোট সঞ্চয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়ার নীতি বদলানো হচ্ছে এবং বৃহৎ ঋণ-বৃহৎ শিল্প-বৃহৎ রপ্তানির গুরুত্ব বাড়ছে দিন দিন। তিনটি বড় ধরনের উপাদান অর্থনীতির এই কৌশল পরিবর্তনের জন্য দায়ী। এরা হলো- শেয়ারবাজার, রেমিট্যান্স পাঠানো প্রবাসী শ্রমিক এবং রপ্তানি থেকে ক্রমবর্ধমান রেমিট্যান্স বৃদ্ধি। ৩১ মে ২০২১ বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ পঁয়তাল্লিশ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।

প্রস্তাবিত বাজেটে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় চলতি বছরের ১০ হাজার কোটি টাকা থেকে বারানোর আহ্বান জানিয়ে অর্থমন্ত্রী সাধুবাদ বা ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। করজাল বৃদ্ধি অর্থাৎ আরও মানুষকে করের আওতায় নিয়ে আসার কৌশল ঠিকই আছে। প্রবাসীদের রেমিট্যান্স প্রণোদনা, রপ্তানি পণ্যের প্রণোদনা, কৃষি ভর্তুকি অব্যাহত রাখা ঠিকই আছে। তবে ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে ডাকঘরসহ সব ধরনের ব্যাংক সঞ্চয়ের হিসাবে এইভাবে সুদ কমানো- এটা কেমন বুদ্ধি হলো, এটাকে বাংলা ভাষায় কুবুদ্ধি বলা যায়। গ্রামে সঞ্চয়পত্র পাওয়া যায় না। সঞ্চয়পত্র কি জিনিস তা গ্রামের মানুষ বুঝেও না। ব্যাংকে গেলে বলে ৪ বা ৫ বা ৬ শতাংশ সুদ। মুদ্রাস্ফীতি এই সুদ খেয়ে ফেলবে। হতভাগা ডাকঘরে গেলে বলছে আপনার ১০ লাখ টাকার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করি, কারো কাছে পেনশানের বা প্রবাসী ছেলের পাঠানো আরও পাঁচ লাখ টাকা যদি থাকে এগুলো করবেটা কি? ফূর্তি করে এই টাকা নষ্ট করা ছাড়া তো কোন পথ অবশিষ্ট রইলো না।

দেশে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল থাকলে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আজ এই অবস্থা হতো না। এটি বড়লোকের দেশ। অর্থমন্ত্রী নিজে বড় লোক। একেবারে গরিব থেকে মধ্যবিত্ত অতঃপর দেশের বৃহৎ ধনীতে পরিণত হওয়া এই ভদ্রলোক গরিব আর মধ্যবিত্তদের ভুলেই গেলেন। বউ যদি শাশুড়ি হয়, ভুলে যায় তার অতীত, অর্থমন্ত্রী আজ একজন অবসরপ্রাপ্ত সৎ সরকারি কর্মচারীর কষ্টের কথা বুঝতে চাচ্ছেন না। একজন মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকও ৫০ লাখ টাকার ওপর গ্র্যাচুইটি পান। অথচ সঞ্চয়পত্রের লিমিট দেয়া হয়েছে ৩০ লাখ টাকা। বুড়ো বয়সে বাকি ২০ লাখ টাকা নিয়ে কি ভদ্রলোক শেয়ার বাজারের বাটপারদের হাতে তুলে দিয়ে আসবেন?

কষ্টের কথা আরও আছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কোন প্রতিনিধি সংসদে নেই। কোন নিরেট ভদ্রলোক উপজেলা চেয়ারম্যান দূরের কথা ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার হওয়ারও সুযোগ নেই। কঠোর ভাষায় বলা চলে ভদ্রলোক জনপ্রতিনিধি হওয়ার পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মাননীয় অর্থমন্ত্রী এমন কৌশল অবলম্বন করেছেন, যেন মানুষ টাকা নিয়ে শেয়ার বাজারে দৌড়ায়। যত ফন্দিফিকির করুন না কেন শেয়ার মার্কেটের ব্রোকার হাউসগুলো গ্রামের বাজারে বাজারে নিয়ে গেলেও মানুষ বিনিয়োগ করতে উৎসাহী হবে না। এজন্যই বলছিলাম বৃহৎ ঋণ-বৃহৎ শিল্প-বৃহৎ শেয়ার মার্কেট-বর্ধিত রপ্তানি-বর্ধিত রেমিট্যান্স প্রবাহ কৌশল ঝুঁকিপূর্ণ। রেমিট্যান্সের পরিমাণ পাহাড়ে পরিণত হলেও কাক্সিক্ষত উন্নয়ন প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে বলা যাবে না। অর্থমন্ত্রী আপনার গ্রামের প্রতিবেশীদের হাড্ডিসার শরীর দেখে বুঝে নেবেন গৃহীত মডেলে প্রবৃদ্ধি বাড়লেও সম্পদের সুষম বণ্টন হবে সুদূর পরাহত।

[লেখক : অর্থ শাস্ত্রের প্রাক্তন প্রভাষক; আইনজীবী, হাইকোর্ট] spdey2011@gmail.com

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

tab

উপ-সম্পাদকীয়

মধ্যবিত্তবিহীন ঝুঁকিপূর্ণ উন্নয়ন কৌশল

শঙ্কর প্রসাদ দে

শনিবার, ০৫ জুন ২০২১

বলা হচ্ছে বাজেট কৌশলের কারণে এক দশক ধরে চাল, ডাল, মাছ, সবজিসহ বেশকিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম মুদ্রাস্ফীতির নিচে রয়েছে। এটাও বলা হচ্ছে কৃষিতে ভর্তুকি, বিদ্যুৎ সরবরাহ, সহনীয় কর ব্যবস্থা এতে ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের এমন কোন কৃষি পণ্য নেই যা বহির্বিশ্বে রপ্তানি হয় না। কথাগুলো সত্য। কিন্তু কৃষি থেকে সঞ্চয় বৃদ্ধির কোন উদ্যোগ বাজেটে নেই।

বাজার ব্যবস্থায় বর্তমানে দু’ধরনের অর্থনৈতিক অর্থব্যবস্থা জনপ্রিয়। প্রথমত; উন্নয়নশীল দেশগুলো গুরুত্ব দেয় কৃষি, ক্ষুদ্র শিল্প, বনজ শিল্প, মৎস্য, অপ্রচলিত পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি। এতো দুটো লাভ। কৃষিতে অর্থনীতির স্বনির্ভরতা অর্জন। কৃষির স্বনির্ভরতা সঞ্চয় প্রবণতা সৃষ্টি করে। সরকারগুলোর দায়িত্ব কৃষিতে ঘনীভূত সঞ্চয়গুলোর জন্য ব্যাংক নিরাপত্তা সৃষ্টি করা। ক্ষুদ্র সঞ্চয়গুলোকে ক্রমশ পুঁজিতে রূপান্তরই হলো উন্নয়ন। যে দেশে কৃষি থেকে দ্রুত পুঁজির সৃষ্টি হয় সে দেশে দ্রুত বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়। এই প্রক্রিয়ার ভালো উদাহরণ হলো ভারত, এই শতাব্দীর শুরু থেকে ভারত এবং ব্রাজিল এই মডেল অনুসরণ করছে।

উন্নয়নশীল দেশগুলো এই মডেল গ্রহণ করেছে চীন, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো থেকে। এদের বর্তমান যে ঈর্ষণীয় উন্নয়ন গতিধারা, তার মূল ভিত্তি হলো কৃষি। শুধু খানিকটা ব্যতিক্রম চীন, চীন একেবারে মাইক্রোলেভেলে পুতুল থেকে মোবাইল সেট পর্যন্ত হেন জিনিস নেই, যা ছোট ছোট কারখানাগুলোতে উৎপাদন করে না। এখানে যে সঞ্চয় হয় তা পুঁজিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। চীনের বর্তমান অর্থনৈতিক কৌশলই হচ্ছে এসব ছোট ছোট পুঁজিকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা। চীনের এ মডেল এতই ব্যতিক্রমী যে ইচ্ছে করলেই অন্য কোন দেশের পক্ষে এসব পণ্য উৎপাদন সম্ভব নয়।

ছোট সঞ্চয়-ছোট পুঁজি থেকে-ছোট বিনিয়োগের এই মডেল এখন বিশ্ব নন্দিত।

বাজার ব্যবস্থায় দ্বিতীয় কৌশলটি হলো মাঝারি, বড় বিনিয়োগে এবং বিদেশি বিনিয়োগকে রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎসাহী করা। নিরাপত্তা দেয়া। এটাকে টপ টু ডাউন মডেলও বলা হয়। ইউরোপের সব দেশ এবং আমেরিকা এই মডেলটা ব্যবহার করছে। উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও আর্জেন্টিনাও এই মডেল অনুসরণ করছে। এই কৌশলের বৈশিষ্ট্য হলো এখানে লাখ লাখ বিনিয়োগকারীকে আকৃষ্ট করা হয় না। হাতে গোনা বড় বড় উদ্যোক্তাদের দেদারছে ঋণ দেয়া হয়। এই ঋণ নিয়ে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করে, লভ্যাংশ থেকে ঋণের সুদ দেয়। সরকারকে ট্যাক্স দেয়। কারখানা একটা দিয়ে শুরু করে গ্রুপ অব কোম্পানিতে পরিণত হয়। উন্নত দেশগুলোর প্রবৃদ্ধির এই ধরন আর্জেন্টিনা ও বাংলাদেশে প্রয়োগ করা হচ্ছে।

ডাউন টু টপ ফর্মূলা বিএনপির অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান থেকে আওয়ামী লীগের শাহ্ এমএস কিবরিয়া পর্যন্ত বজায় ছিল। আরও সহজ করে বললে বঙ্গবন্ধুর সরকার, জিয়ার সরকার, এরশাদের সরকার, খালেদা জিয়ার প্রথম মেয়াদ ও শেখ হাসিনা প্রথম মেয়াদ পর্যন্ত এ কৌশল বজায় ছিল। ১৯৭২ থেকে ২০০১ পর্যন্ত সরকারগুলোর পররাষ্ট্রনীতি প্রশ্নে নানা ধরনের কৌশল বদলানোর ঘটনা ঘটলেও বাজার অর্থনীতির সনাতন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। একেবারে গ্রাম থেকে ছোট ছোট সঞ্চয়গুলোকে পুঁজি এবং বিনিয়োগে রূপান্তরের কৌশলটি বজায় ছিল। এই সময়কালে ব্যাংক সুদ, ডাকঘর সঞ্চয় সুদ, সঞ্চয়পত্র সুদ সব সময়ই দু’অঙ্কে ছিল। এরশাদ সাহেব তো প্রতিরক্ষা সঞ্চয়পত্র বলে একটি স্কিম চালু করে সুদ দিয়েছিলেন আঠার শতাংশ। আজ যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সদম্ভ উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে, হাজার হাজার প্রাইভেটকার দেখা যাচ্ছে এগুলো সব এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উপস্থিতির প্রমাণ। এর কৃতিত্ব হলো তাজউদ্দীন থেকে সাইফুর রহমান পর্যন্ত অর্থমন্ত্রীদের। এই শতাব্দীর শুরুতে বাংলাদেশের অর্থনীতির কৌশলগত পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। এখন উন্নয়ন বা প্রবৃদ্ধির জন্য গ্রামীণ ছোট সঞ্চয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়ার নীতি বদলানো হচ্ছে এবং বৃহৎ ঋণ-বৃহৎ শিল্প-বৃহৎ রপ্তানির গুরুত্ব বাড়ছে দিন দিন। তিনটি বড় ধরনের উপাদান অর্থনীতির এই কৌশল পরিবর্তনের জন্য দায়ী। এরা হলো- শেয়ারবাজার, রেমিট্যান্স পাঠানো প্রবাসী শ্রমিক এবং রপ্তানি থেকে ক্রমবর্ধমান রেমিট্যান্স বৃদ্ধি। ৩১ মে ২০২১ বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ পঁয়তাল্লিশ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।

প্রস্তাবিত বাজেটে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় চলতি বছরের ১০ হাজার কোটি টাকা থেকে বারানোর আহ্বান জানিয়ে অর্থমন্ত্রী সাধুবাদ বা ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। করজাল বৃদ্ধি অর্থাৎ আরও মানুষকে করের আওতায় নিয়ে আসার কৌশল ঠিকই আছে। প্রবাসীদের রেমিট্যান্স প্রণোদনা, রপ্তানি পণ্যের প্রণোদনা, কৃষি ভর্তুকি অব্যাহত রাখা ঠিকই আছে। তবে ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে ডাকঘরসহ সব ধরনের ব্যাংক সঞ্চয়ের হিসাবে এইভাবে সুদ কমানো- এটা কেমন বুদ্ধি হলো, এটাকে বাংলা ভাষায় কুবুদ্ধি বলা যায়। গ্রামে সঞ্চয়পত্র পাওয়া যায় না। সঞ্চয়পত্র কি জিনিস তা গ্রামের মানুষ বুঝেও না। ব্যাংকে গেলে বলে ৪ বা ৫ বা ৬ শতাংশ সুদ। মুদ্রাস্ফীতি এই সুদ খেয়ে ফেলবে। হতভাগা ডাকঘরে গেলে বলছে আপনার ১০ লাখ টাকার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করি, কারো কাছে পেনশানের বা প্রবাসী ছেলের পাঠানো আরও পাঁচ লাখ টাকা যদি থাকে এগুলো করবেটা কি? ফূর্তি করে এই টাকা নষ্ট করা ছাড়া তো কোন পথ অবশিষ্ট রইলো না।

দেশে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল থাকলে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আজ এই অবস্থা হতো না। এটি বড়লোকের দেশ। অর্থমন্ত্রী নিজে বড় লোক। একেবারে গরিব থেকে মধ্যবিত্ত অতঃপর দেশের বৃহৎ ধনীতে পরিণত হওয়া এই ভদ্রলোক গরিব আর মধ্যবিত্তদের ভুলেই গেলেন। বউ যদি শাশুড়ি হয়, ভুলে যায় তার অতীত, অর্থমন্ত্রী আজ একজন অবসরপ্রাপ্ত সৎ সরকারি কর্মচারীর কষ্টের কথা বুঝতে চাচ্ছেন না। একজন মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকও ৫০ লাখ টাকার ওপর গ্র্যাচুইটি পান। অথচ সঞ্চয়পত্রের লিমিট দেয়া হয়েছে ৩০ লাখ টাকা। বুড়ো বয়সে বাকি ২০ লাখ টাকা নিয়ে কি ভদ্রলোক শেয়ার বাজারের বাটপারদের হাতে তুলে দিয়ে আসবেন?

কষ্টের কথা আরও আছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কোন প্রতিনিধি সংসদে নেই। কোন নিরেট ভদ্রলোক উপজেলা চেয়ারম্যান দূরের কথা ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার হওয়ারও সুযোগ নেই। কঠোর ভাষায় বলা চলে ভদ্রলোক জনপ্রতিনিধি হওয়ার পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মাননীয় অর্থমন্ত্রী এমন কৌশল অবলম্বন করেছেন, যেন মানুষ টাকা নিয়ে শেয়ার বাজারে দৌড়ায়। যত ফন্দিফিকির করুন না কেন শেয়ার মার্কেটের ব্রোকার হাউসগুলো গ্রামের বাজারে বাজারে নিয়ে গেলেও মানুষ বিনিয়োগ করতে উৎসাহী হবে না। এজন্যই বলছিলাম বৃহৎ ঋণ-বৃহৎ শিল্প-বৃহৎ শেয়ার মার্কেট-বর্ধিত রপ্তানি-বর্ধিত রেমিট্যান্স প্রবাহ কৌশল ঝুঁকিপূর্ণ। রেমিট্যান্সের পরিমাণ পাহাড়ে পরিণত হলেও কাক্সিক্ষত উন্নয়ন প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে বলা যাবে না। অর্থমন্ত্রী আপনার গ্রামের প্রতিবেশীদের হাড্ডিসার শরীর দেখে বুঝে নেবেন গৃহীত মডেলে প্রবৃদ্ধি বাড়লেও সম্পদের সুষম বণ্টন হবে সুদূর পরাহত।

[লেখক : অর্থ শাস্ত্রের প্রাক্তন প্রভাষক; আইনজীবী, হাইকোর্ট] spdey2011@gmail.com

back to top