alt

উপ-সম্পাদকীয়

রাজা রামমোহন রায় ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা

জ্যোতির্ময় ধর

: বৃহস্পতিবার, ০২ সেপ্টেম্বর ২০২১
image

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার বলেছিলেন, রাজা রামমোহন রায় যে কালে বিরাজ করেন সে কাল তেমনি অতীতে অনাগতে পরিব্যপ্ত, আমরা তার সেই কালকে আজও উত্তীর্ণ হতে পারিনি। ভারতের আধুনিক যুগপ্রবর্তক রাজা রামমোহন রায় তার অসাধারণ মনীষা ও কর্মশক্তির প্রভাব ভারত-ইতিহাসে চির চিহ্নিত রেখে গেছেন। মধ্যযুগীয় ভারতকে তিনি হঠাৎ আধুনিক যুগের দ্বারদেশে এনে উপস্থাপিত করলেন, বহু বছরের সঞ্ছিত জড়ত্বের যবনিকা অপসারিত করে মুক্তিসূর্যের আলোকে চতুর্দিক প্রদীপ্ত করে তুললেন এবং অচলায়তনের অবরুদ্ধ বাতায়ন উন্মুক্ত করে বহির্বিশ্বের অবাধ হাওয়া তার মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিলেন। তার অমরচিন্তা ও মননের সাক্ষ্য হয়ে আছে তার সম্পাদিত সংবাদপত্রগুলো। তবে সাংবাদিকতায় রামমোহনের ভূমিকা সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সপক্ষে তার ঐতিহাসিক ভূমিকায়। ১৮২৩ সালে সাংবাদিকতায় ভারতীয়দের অভিজ্ঞতার মেয়াদ মাত্র ৫ বছর। সেই প্রেক্ষাপটে রামমোহন ও তার সহযোগীরা কীভাবে এই উন্নত চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে, প্রথম ভারতবর্ষে চৎবংং ভৎববফড়স এর কথা বলেছিলেন তা ভাবতেই অবাক হতে হয়। ভারতবর্ষে তথা ইংরেজ আমলে ভারতের রাজধানী কলকাতায় ব্রিটিশ ও ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের আমগন এবং সে সূত্রেই ভারতবর্ষ তথা কলকাতায় আসা পাশ্চাত্য সভ্যতা, আর স্থানীয় প্রাচ্য সভ্যতার আঁচলে জড়ানো ধর্মীয় কুসংস্কার ও সংস্কারের মিশ্রণে অমৃত যেমন উঠেছিল, গরল-ও তেমনি উঠেছিল। বেড়েছে টানাপোড়েন-অনাচার-অসহিষ্ণুতা এবং উচ্ছৃঙ্খলতা। সবমিলিয়ে নৈতিক অবক্ষয়-এর চিত্ররূপ দেখা গিয়েছিল। অন্যদিকে পৃথিবীকে জানার ও শেখার বিরাট অঙ্গন-ও উন্মুক্ত হয়েছিল তৎকালীন ‘নেটিভ’দের কাছে। দুয়ের দ্বন্দের মধ্যে থেকেই উঠে এল একটা পরিবর্তনের আবহাওয়া; যা পরবর্তীকালে বাংলার সর্বাঙ্গীন বিকাশের দ্যোতক। বাংলার সমাজজীবনে এই পরিবর্তনের আঁচ বা পটভূমি রাজা রামমোহন রায়ের জীবনে কতখানি প্রভাব ফেলেছিল সেটা গবেষণার বিষয়। কিন্তু ১৭৮০ সালে হিকির ‘বেঙ্গল গেজেট’ যখন প্রকাশিত হয় তখন রামমোহনের বয়স মাত্র আট বছর- সেই বয়সে কলকাতা থেকে অনেক দূরের একটি গ্রাম্য বালকের কাছে ভারতের প্রথম সংবাদপত্র সম্পর্কে জানা বা বোঝা সম্ভব ছিল না-এটা সহজ সত্য। তেমনি এটাও সত্য যে, তেজারতি ব্যবসার সূত্রে কলকাতার অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণের সমাজজীবনের প্রভাব পরবর্তীকালে রামমোহনের লেখায় পড়েছিল, পড়েছিল তার শিক্ষা-সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অবস্থানেও। রামমোহন ১৮১৪ সালে পাকাপাকিভাবে হুগলীর রাধানগর গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন। তখন তার বয়স ৩২ বছর। ইতোমধ্যে কলাকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছে (১৭৮০ থেকে ১৮১৭ সাল পর্যন্ত) মোট এগারোটি (১১) সংবাদপত্র। যদিও তার সবই ছিল ইংরেজি মালিকানায় এবং ইংরেজি ভাষায়। দৈনিক পত্রিকা একটি ও ছিল না। ছিল ৭টি মাসিক এবং ৪টি সাপ্তাহিক পত্রিকা।

এরপরই ১৮১৮ সালটি বাংলা সংবাদপত্রের ইতিহাসে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। প্রথম- এই সালেই ভারতের শাসন ক্ষমতায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের চরম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। আর দ্বিতীয়ত- এই ১৮১৮ সালেই ভারতীয়দের পরিচালনায়-সম্পাদনায় এবং খাঁটি ভারতীয় ভাষায় প্রথম ভারতীয় সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় শিক্ষক গঙ্গাকিশোর ভট্টাচ্যার্যের ‘ বেঙ্গল গেজেট’ (সপ্তাহিক) প্রকাশনার মধ্য দিয়ে (যদিও প্রকাশকাল নিয়ে কিছু মতভেদ আছে)। অন্যদিকে, এই পত্রিকা প্রকাশের আগে রামমোহনের বন্ধু জেমস সিল্ক বাকিংহামের সম্পাদনায় ‘ক্যালকাটা জার্নাল’ ভারতবর্ষ তথা বাংলার সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে একটি বলিষ্ঠ আদর্শের উদাহরণ হয়ে আছে। সংবাদপত্রের মান কীভাবে উন্নত স্তরে নিয়ে যাওয়া যায় তার নিজস্ব মান ধরে, তার পত্রিকাটি পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় অনন্য। সমালোচনার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র আক্রমণাত্মক নয়- এর বদলে দেখা গিয়েছে যুক্তিনির্ভর ও তথ্যভিত্তিক সমালোচনা এবং খুবই সামন্যভাবে হলেও এই প্রথম দেশবাসীর মনে স্বাধীন চেতনার উন্মেষের সঙ্গে স্বাধীনতা ও স্বরাজ্যের স্বপ্ন দেখার সূত্রপাত ঘটল। এমনি করেই ১৭৮৮ থেকে ১৮১৮-এই ৩৮ বছরের নানা ঘটনার, অভিজ্ঞতার আলোকে রামমোহন রায়ের ব্যক্তিত্বও গড়ে ওঠেছে। ইংরেজি, ফার্সি, সংস্কৃত ভাষায় তার সমান দক্ষতা ছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে যে তার নিবিড় পরিচয় ছিল তার উদাহরণ আমরা পেয়েছি পরবর্তীকালে তার লেখায়। যে লেখার সূত্রপাত তৎকালীন সমাজভিত্তিক হিন্দুধর্মের গোঁড়ামী ও সংস্কারকে কেন্দ্র করে। মাধ্যম ছিল সংবাদপত্র, যা তৎকালীন বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছোনোর একমাত্র বাহন। যে সংবাদপত্রের মাধ্যমেই বাংলা গদ্যসাহিত্য, সংবাদ-সাহিত্য, রস-রচনা, সমালোচনা পত্র, সাহিত্যের বিকাশ ও বিস্তার সম্ভবপর হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই রামমোহন সমকালীন সমাজকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র সাহিত্য চর্চায় নিমগ্ন হতে পারেনি। সমাজের ধর্ম ও সংস্কারকে কেন্দ্র করে যে বিরোধ গড়ে উঠেছে রামমোহন তাকে এগিয়ে নিতে না গিয়ে কলম ধরলেন, প্রতিবাদীর ভূমিকায় নেমে বাধা পড়লেন সংবাদপত্র জগতে উদারপন্থী হিসেবে। পরাধীন ভারতে রামমোহন-ই প্রথম চিন্তার মুক্ত প্রকাশের দাবি উচ্চারণ করেন। আমাদের আলোচনায় এই পটভূমিকে জানা দরকার রামমোহনকে জানতে গেলে। কেননা রামমোহনের ব্যক্তিত্ব্য গড়ে উঠেছে এই পটভূমিতেই।

ভারত ব্রিটিশ রাজত্বে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালে মুদ্রণ নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক আইন চালু ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে লর্ড হেস্টিংস ভারতে গভর্ণর জেনারেলের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাই ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দে এই আইনটি প্রত্যাহার করে নেন। হেস্টিংসের উদারনীতির পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করতে এ দেশের যে সব বুদ্ধিজীবিরা এগিয়ে এলেন তাদের মধ্যে রামমোহন রায় ছিলন অগ্রগণ্য। হিন্দুধর্মের প্রতি অযৌক্তিক আক্রমণের বিরুদ্ধে তিনি ১৮২১ এর সেপ্টেম্বরে প্রকাশ করলেন ইংরেজিতে-‘ ইৎধযসধহরপধষ গধমধুরহব’ এক পৃষ্ঠায়, আর অন্য পৃষ্ঠায় বাংলায় ‘ব্রাহ্মণ সেবধী’। ইংরেজিতে মূল রচনা-বাংলায় তারই অনুবাদ। শ্রীরামপুরের খ্রিস্টান মিশনারি দ্বারা প্রকাশিত ‘সমাচার দর্পণ’-এর এক বিতর্কিত ও আপত্তিকর মন্তব্যকে নিয়ে তিনি একটি প্রতিবাদপত্র পাঠিয়েছিলেন। ‘সমাচার দর্পণ’-এর সম্পাদক প্রথম অংশ ছাপাতে রাজি হলেও, দ্বিতীয় অংশ না ছাপানোয় তিনি তার প্রতিবাদ করার জন্যই এই পত্রিকাটি প্রকাশ করলেন। যদিও এখানে লক্ষ্যনীয় যে রামমোহন সংবাদপত্রের জন্য সংবাদপত্র প্রকাশ করেননি-প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবেই এই প্রয়াস করেন তিনি। পরবর্তী পর্যায়ে সংস্কারমূলক রচনা ‘সতী’ প্রকাশের জন্য ব্যাপটিস্ট মিশন থেকে প্রকাশিত ‘বেঙ্গল গেজেট’-এর দ্বারস্থ হয়েছিলেন। হয়ত বা তার একটি কারণ হতে পারে, তার বন্ধু ও তার প্রতিষ্ঠিত ‘আত্মীয় সভা’র সদস্য হরচন্দ্র রায় ছিলেন তখন ‘বেঙ্গল গেজেট’-র সম্পাদক এবং এই পত্রিকাটি তখন কলকাতার সমাজে খুবই জনপ্রিয় ছিল। এরপরেই সংবাদপত্রের জগৎ থমকে দাঁড়িয়েছে ১৮১৮ থেকে ১৮২১ সাল পর্যন্ত। যার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কারণ তৎকালীন সংবাদপত্রের ওপর প্রাক-সেন্সর বিধি, ফলে কোনও সংবাদপত্র প্রকাশিতও হয়নি। রামমোহনের ইংরেজিতে- ‘Brahmanical Magayine’ বা ‘ব্রাহ্মণ সেবধী’ বন্ধ হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। প্রাক-সেন্সর বিধি-ও উঠে গিয়েছে ১৮১৯ সালে। কিন্তু বাংলা সংবাদপত্রের আকাল তখনও ঘোঁচেনি।

রামমোহনের স্বাধীনচেতনা ও সংবাদপত্র : ১৮২১ সালের ৪ ডিসেম্বর প্রকাশিত হলো ‘সংবাদ কৌমুদী’, সাপ্তাহিক। সম্পাদক ছিলেন ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রকাশক তারাচাদ দত্ত। অনেকের মতে রামমোহন ছিলেন এই পত্রিকার মূল শক্তি-সম্পাদনা তথা লেখায়। রামমোহন প্রতিষ্ঠিত ছাপাখানায় এ পত্রিকা ছাপা হতো। রামমোহন যদিও পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন না, কিন্তু তারই নির্দেশিত নীতিতে পত্রিকাটি পরিচালিত হতো। স্বাভাবিকভাবেই হিন্দুধর্মের গোঁড়ামী ও কুসংস্কার-বিরুদ্ধ মতের তথা প্রগতিবাদী মনোভাবের পৃষ্ঠপোষক রামমোহনের লেখা কৌমুদীর অন্যতম বিষয় হয়ে উঠল। ‘সংবাদ কৌমুদী’ প্রথমে মঙ্গলবার ও পরে প্রতি শনিবার প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকায় ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র ইত্যাদি সম্পর্কিত নানা আলোচনা ও সংবাদ, দেশের দৈনন্দিন ঘটনাবলীর সংবাদ, জ্ঞাতব্য তথ্য ও সমাজিক সমস্যা সম্পর্কিত পত্রাবলী ছাপা হয়। গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য্যেের ‘বেঙ্গল গেজেটের’ পর, ‘সংবাদ-কৌমুদী’-ই বাংলা ভাষায় সাপ্তাহিক বাঙালি সম্পাদিত সাময়িকপত্র। জনসাধারণের অভাব, অভিযোগের প্রতি শাসকদের ও উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। সংবাদপত্রকে সঠিকভাবে গণমাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে ‘সংবাদ-কৌমুদী’-র ভূমিকা অনেকখানি সার্থক ছিল। স্বদেশবাসীকে উপযুক্ত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানালো, বিজ্ঞান ও কারিগরি চিকিৎসা ইত্যাদি বিভিন্ন পেশাদারি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে দেশবাসীকে বোঝানোর জন্য এই পত্রিকায় লেখা হতো। পত্রিকার এই প্রচেষ্টা তথা রামমোহনের শিক্ষা-প্রসারের এ উদ্দেশ্য যে অনেকাংশে সার্থক হয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য প্রমাণ ছিল ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে ডক্টর জেমসনের অধীনে কুড়িজন ছাত্রকে বৃত্তি দিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞান শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।

সামাজিক নানা বিষয়ে অসুবিধার কথা যেমন-হিন্দুদের মৃতদেহ সৎকারের জন্য শ্মশানঘাট, বিধবা বিবাহ, কৌলিন্য প্রথা, শিশুহত্যা, সতীদাহ ইত্যাদি নানা কুসংস্কার ও সামাজিক সমস্যা নিয়ে পত্রিকায় আলোচনা ও চিঠিপত্র-ও ‘সংবাদ-কৌমুদী’তে প্রকাশিত হতো এবং এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও বলা হতো। দেশবাসীর মানসিক ও নৈতিক উন্নতির জন্য পত্রিকায় হিন্দুর সম্পত্তি অধিকার আইনের সংশোধন চাওয়া হয়েছে, অপরিণত বয়স্কদের সম্পত্তির অধিকার দান নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। একই সাথে বিদেশি শাসনের একপেশে অন্যায় নীতি যেমন-স্বদেশীয়দের নিরাপত্তাহীনতা, তাদের প্রতি চরম বৈষম্যমূলক ব্যবহার, অন্যায়-বিচার ব্যবস্থা, দুর্ব্যবহার এবং এর বিরুদ্ধে জনগণের অসস্তোষ ও অভিযোগ পত্রিকায় সংবাদ-আলোচনা-পত্রাদির মাধ্যমে জনমক্ষে তুলে ধরা হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনায় রামমোহন প্রবর্তিত কাগজেই আমরা জাতীয়তাবাদের প্রথম স্ফুরণ দেখতে পাই। দুরদর্শী রামমোহন দেশের অর্থনৈতিক পরাধীনতা নিয়েও চিন্তা-ভাবনা করেছেন, যার প্রতিফলন তার পত্রিকায়ও দেখতে পাওয়া যায়। দেশের অর্থনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে পত্রিকার মধ্য দিয়ে দেশবাসীকে সজাগ করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে শুধু শাসনকর্তাদের নয়, রামমোহন দেশবাসীকেও দায়িত্বশীল হতে পত্রিকায় নির্দেশ দিয়েছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দিক থেকে পশ্চাৎপদ পরাধীন একটি জাতির মুখপত্ররূপে সংবাদ-কৌমুদী ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষায়, সামাজিক উন্নয়নে, স্বাদেশিকতা প্রচারে যেভাবে সোচ্চার হয়েছে ভারতীয় সংবাদপত্রের ইতিহাসে তার অবদান অবিস্মরণীয়। সমাজ-সংস্কারে সংবাদ-কৌমুদীর ভূমিকা সমাজের রক্ষণশীল ব্যক্তিদের অসন্তোষের কারণ হয়েছিল। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও রামমোহনের সামাজিক সংস্কার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাই ‘সংবাদ-কৌমুদী’-র ১৩টি সংখ্যার পর তিনি পত্রিকা ছেড়ে দিলে রামমোহন তার দায়িত্ব নেন (১৮২২ সাল)। এর শেষ পর্যায়ে সম্পাদক ছিলেন রামমোহন পুত্র রাধাপ্রসাদ রায়। ‘সংবাদ-কৌমুদী’-কে কেন্দ্র করেই রামমোহনের প্রত্যক্ষ এবং সচেতনভাবে সংবাদপত্র জগতে প্রবেশ। তার পত্রিকা পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশনার দায় ও দায়িত্ব বাংলার সংবাদপত্রের বিকাশে এক নতুন মাত্রা এনে দিল (উল্লেখ্য, ১৮৩৪ সাল পর্যন্ত ‘সংবাদ-কৌমুদী’ প্রকাশিত হতো)।

অবশ্য রামমোহন ১৮০৩ সালে, একটি পার্শিয়ান সংবাদপত্র প্রকাশ করেছিলেন, যার নাম ছিল ‘তাহাফত-উল হুয়াহহিদ্দিন’ (একেশ্বরবাদীদের জন্য প্রদত্ত উপহার), যেটা সাধারণ মানুষের অধিকার নিয়ে সরব ছিল।

রামমোহনের সময় এ দেশে শিক্ষিত মহলে ফার্সি ভাষাতেই বিদ্যাচর্চা করা হতো। রামমোহন এসব শিক্ষিতদের জন্য ফার্সি ভাষায় একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করার সংকল্প করেন। ১৮২২ সালের ১২ এপ্রিল ‘মিরাৎ-উল্-আখবার’ (সংবাদের দর্পণ) নামে রামমোহন রায় সম্পাদিত ফার্সী ভাষায় এই সাপ্তাহিক পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। প্রতি শুক্রবার পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো। এই পত্রিকা দেশবাসীকে তাদের সামাজিক অবস্থার উন্নতির জন্য অভিজ্ঞতা অর্জনে সাহায্য করবে; এই পত্রিকা শাসকশ্রেণীকে তাদের প্রজাদের প্রকৃত অবস্থা কী তা জানতে সাহায্য করবে এবং প্রজারাও সরকারি আইন ও নিয়মাবিধির সঙ্গে পরিচিত হতে থাকবে। এর ফলে শাসকশ্রেণী সহজেই জনগণের অভাব-অভিযোগ এবং তাদের অসন্তোষের প্রতিকার করতে পারবে। অন্যদিকে শাসকপক্ষ কীভাবে জনগণের নিরপত্তারক্ষা তথা তাদের কষ্টলাঘব করতে পারে সে বিষয়েও জনসাধারণ স্যমকভাবে ধারণা লাভ করবে। সুতরাং বলা যায় রামমোহনই প্রথম তৎকালীন একমাত্র গণমাধ্যম সংবাদপত্রের মধ্য দিয়ে দেশবাসীকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন।

‘মিরাৎ’ পত্রিকায় জাতীয় সংবাদের পাশাপাশি নানা ধরনের আন্তর্জাতিক সংবাদ-ও গুরুত্বসহকারে ছাপানো হতো। এই পত্রিকায় রাজনৈতিক আলোচনা যথেষ্ট প্রাধান্য পেয়েছে এবং রামমোহন তার রাজনৈতিক মতবাদ সুস্পষ্টভাবে যেকোনো আলোচনা প্রসঙ্গে ব্যক্ত করেছেন। ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির কোনো বিরোধ তিনি মানতেন না। এই কারণে ধর্ম ও রাজনীতি সম্পর্কিত রামমোহনের মতাদর্শ এই পত্রিকায় একইসঙ্গে প্রচারিত হয়েছে।

গণতন্ত্রকে সমর্থন করলেও, অনভিজ্ঞ জনগণের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রকে তিনি সমর্থন করেননি। মুসলিমদের সম্পর্কে বিদেশীদের যে ভ্রান্ত ধারণা ছিল তা দুর করার জন্য রামমোহন হাফিজের বয়ান অনুদিত করে মুসলিমদের উদার ধর্মবাদ সুফী ধর্মীয় নীতিগুলিকে পত্রিকা মারফত প্রচার করেন। এই পত্রিকা মারফত রামমোহন দেশের শিক্ষিত অংশকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করতে এবং শাসকশ্রেণীকে দেশের সামাজিক-ধর্মীয় অবস্থার সম্পর্কে অভিজ্ঞ করার চেষ্টা করেছে। দেশ-বিদেশের যে কোনো ঘটনার সংবাদ ও সে সম্পর্কে তার মতামত নির্ভিকভাবে প্রকাশ করে রামমোহন যথার্থ সাংবাদিকের কর্তব্য নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন। ‘সংবাদ-কৌমুদী’ ও ‘মীরাৎ-উল্-আখবার’-এ রামমোহনের মুক্ত চিন্তার এবং গণচেতান জাগানোর জন্য তার পত্রিকার ভূমিকা তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজের শাসন, কর্তৃপক্ষের অসন্তোষের কারণ হয়েছিল। কিন্তু কিছু উদারনৈতিক ইংরেজের সমর্থন-ও রামমোহন পেয়েছিলেন। ইংরেজ সম্পাদিত এদেশের সংবাদপত্রগুলোতে ‘সংবাদ-কৌমুদী’ ও মিরাৎ-এ প্রকাশিত সংবাদ ও আলোচনা অনুদিত ও পুনঃমুদ্রিত হয়েছে। এ দেশের সংবাদপত্রের জন্মলগ্নে রামমোহন রায়ের অবদান অপরিসীম এবং তার পরিচালিত দুটি পত্রিকাই ঐতিহাসিকদের কাছে তথ্য-সম্পদরূপেই চিহ্নিত।

‘মিরাৎ-উল্-আখবার’-এর অনেকে লেখাই সরকার আপত্তিকর মনে করেছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কলকাতার বিশপ ড. মিলটনের মৃত্যুতে কাগজে প্রকাশিত শোক সংবাদের সঙ্গে খ্রিস্টীয় ত্রিত্তবাদ নিয়ে কিছু মন্তব্য, পারস্যের রাজকুমারের সঙ্গে বড়লাটের সাক্ষাৎকার নিয়ে সরকারি মতে কিছু অতিরঞ্জিত সংবাদ ইত্যাদি। তাই ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দের অ্যাডামের ব্যক্তি-স্বাধীনতা হরণকারী মুদ্রণ-নিয়ন্ত্রণ আইনের কবলে, ‘মিরাৎ-উল্-আখবার’ও পড়ল। কিন্তু রামমোহন ব্যক্তি-স্বাধীনতার বরাবরই বিশ্বাসী ছিলেন। দেশের শিক্ষিত জনগণের প্রতি অবমাননাকর এই আইন রোধ করেন, ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও দেশবাসীর নায্য অধিকার অক্ষুণ্ন রাখতে তিনি এগিয়ে এলেন। সরকারি প্রস্তাবটি সুপ্রিম কোর্টে গৃহীত হয়ে আইনে তিনি একটি আবেদনপত্রে পেশ করেন। এত অল্প সময়ে আবেদনপত্রটি প্রস্তুত করা হয় যে বেশি লোকের লোকের স্বাক্ষর সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, হরচন্দ্র ঘোষ, গৌরীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রসন্নকুমার ঠাকুরের নাম, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব্য। রামমোহনের এই আবেদনপত্র ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা। যদিও তার ‘ব্রাহ্মণ সেবধী’কে সংবাদপত্র বলা যায় কিনা তা বিতর্কের বিষয়। আর ‘মিরাৎ-উল্-আখবার’-এর মধ্যে সংবাদ কতখানি প্রতিফলিত হয়েছিল তাও বলা কঠিন। কেননা তার কোন মূল কপি পাওয়া যায়নি। তবে অ্যাডামসের এই ‘কালা-কানুন’-এর প্রতিবাদে তার ভূমিকা নিঃসন্দেহে প্রনিধানযোগ্য। তিনি এর প্রতিবাদ করতে গিয়েই লেখেন-‘হৃদয়ের শত শত ফোঁটা শোণিতের বিনিময়ে অর্জন করেছো যে অমূল্য সম্মান, প্রিয় মোর তুচ্ছ দারোয়ানের অনুগ্রহ পাবার আশায় তাকে করোনা বিক্রয়’ এবং ‘মীরাৎ-উল্-আখবার’ বন্ধ করে দেন। পত্রিকা বন্ধ হলেও দিনের আলোয় প্রকাশিত হলো সেই উপলব্ধি যে, সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতা কোন কারণেই বিক্রি করা যায় না। ব্রিটিশ রাজত্বে মুদ্রণ ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে স্বাধীন মতামত প্রকাশে নায্য অধিকার রক্ষায় আমাদের দেশের সংবাদপত্রসেবীরা যে অনলস প্রয়াস চালিয়েছিলেন রামমোহনের আবেদনের মধ্য দিয়েই তার ভিত্তি-প্রস্তরটি স্থাপিত হয়। তাই রামমোহনের জীবনীকার মিস কলেট এই আবেদনপত্রটিকে ভারতীয় ইতিহাসের ‘অ্যারিওপ্যাগিটিকা’ রূপে অভিহিত করেছেন। সর্বোপরি যে উপলব্ধি আজ থেকে ১৭৭ বছর আগে ঘটেছি, তাত যে ভারতীয় স্বাধীনচেতা সাংবাদিকতার এক অনন্য সাধারণ উদাহরণ, তা মেনে নিতে কোন দ্বিধা থাকার কথা নয়। ‘মীরাৎ-উল্-আখবার’-এর পাশাপাশি রামমোহন রায় আরেকটি সংবাদপত্র প্রকাশ করতেন, যার নাম ছিল ‘জান-ই-জাহাপনামা’, সাল ১৮২২ এর মার্চ। এটি একটি সাপ্তাহিক পত্রিকাই ছিল। ১৮২২ সালের ১২ মে থেকে এটির অষ্টম সংখ্যায় ভারতীয় সংবাদপত্র হিসেবে তার উর্দু এবং পার্শিয়ান ভাষায়ও প্রকাশ হতে শুরু করে।

রামমোহন রায় ‘বেঙ্গল হেরান্ড’ নামে আরেকটি পত্রিকার মালিক-ও ছিলেন। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮২২ সালের ১০ মে, যার সম্পাদক ছিলেন মন্টেগো মেরি মারলিন। এই সংবাদপত্রটি চারটি ভাষায় প্রকাশিত হতো।

রাজা রামমোহন রায় একজন সমাজ-সংস্কারক হিসেবেই স্বাধীন প্রেসের জন্য লড়াই করে গেছিলেন। তিনি বিশ্বের সত্য সম্পর্কে চিন্তা করতেন, তা খুঁজতেন। তার লেখনীর ধারা না ছিল দেশী, না ছিল বিদেশি। তা ছিল সমাজের সর্ববন্ধন মুক্তির প্রয়াস। মূলত তাতে ছিল যেমন বিতর্কের ছোঁয়া, তেমনি থাকত যুক্তির মাধ্যমে বলিষ্ঠ বক্তব্য প্রকাশের স্বাধীন চেষ্টা। নতুন বিশ্বের আলোচনায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাথে হিন্দু সমাজের ও সমাজব্যবস্থার এক সার্থক সমন্বয়ের প্রয়াস তাকে সেই সমাজ ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এক অনবদ্য ভূমিকায় তুলে ধরেছে। যে সমাজ-ব্যবস্থায় ব্যাক্তি-স্বাধীনতার কোন মূল্য নেই সেখানে যে গোষ্ঠী স্বাধীনতার কোন মূল্য থাকবে না, তাতে তিনি একরকম নিঃসন্দিহান ছিলেন। আর এই পরাধীনতা যে দেশের স্বনির্ভরতার পথে বাধা তাও তিনি জানতেন। সেজন্য তিনি ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের প্রতি জোর দিতে গিয়ে সংবাদপত্রকেই বেঁচে নিয়েছিলেন, তার স্বাধীন বক্তব্য প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে। সেখানে জাতি-ধর্ম-ভাষার প্রতিবন্ধকতাকে দূর করতেও তিনি সচেষ্ট ছিলেন। যদিও এখানে উল্লেখ করা যায়, রামমোহন ১৮৩০ সালের ১৫ নভেম্বর বিলেত যান এবং সেখানে তার মৃত্যু হয় ১৯৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। অর্থাৎ তার ধর্ম ও কর্মজীবন এদেশে মাত্র ১৫ বছরের, ১৮১৮ সাল থেকে ১৮৩০ সাল পর্যন্ত। আর সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মাত্র ৯ বছর, ১৮২১ থেকে ১৮৩০ সাল পর্যন্ত। কিন্তু আমরা, আজকের যে সংবাদপত্রের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে পরিচিত, ১৮২১ সালে সেই চেহারা আশা করা যায় না, উচিতও নয়। তাই সম্পাদক হিসেবে রামমোহনের ভূমিকা ও অবদান যতখানি, সাংবাদিক হিসেবে সেই ভূমিকা ঠিক ততখানি নয়, কারণ তৎকালীন গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের সামাজিক, ধার্মিক কিংবা অর্থনৈতিক চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলন কিংবা প্রতিরূপ ‘সংবাদ-কৌমুদী’ বা অন্য কোন কাগজে প্রতিফলিত হয়নি। সেকালের সমস্ত সংবাদপত্র কিংবা সাময়িকপত্র কলকাতানির্ভর ইংরেজ কর্মচারী, সামান্য ইংরেজি জানা বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণী, আর ব্যবসায়ী বাঙালি ও ইংরেজনির্ভর। ফলে সংবাদপত্রের বিকাশ ও অগ্রগতি সেই শ্রেণীর প্রতিনিধিকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল তখন। সূত্র অবশ্যই ছিল- সেটা তৎকালীন ধর্মীয় সংস্কারপন্থিদের সঙ্গে প্রাচীনপন্থিদের মধ্যে বাদ-প্রতিবাদ, রামমোহনের সাংবাদিকতা, এই সূত্র ধরেই বিকাশ লাভ করেছে- সেখানে তার আগ্রহ, প্রচেষ্টা কিংবা উৎসাহের কোন ত্রুটি ছিল না। তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি তৎকালীন যুগাবয়বে প্রকাশনা ও সাংবাদিকতাকে সামাজিক ও ধার্মিক ভাবনাকে, জনমত সংগঠনায় প্রয়োগ করেছিলেন।

রামমোহন মাত্র ৯ বছর ‘ সংবাদ-কৌমুদীর’র সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন, এছাড়া ‘বেঙ্গল হেরাল্ড’ বা ‘বঙ্গদূত’ পত্রিকার সঙ্গে তিনি কতখানি ও কীভাবে জড়িত ছিলেন তাও পরিষ্কার নয়। ফলে রামমোহনের সম্পাদকের ভূমিকা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে মূল ভিত্তি হওয়া উচিত, সে যুগের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ও পটভূমিতে বিভিন্ন ঘটনার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ তার বিভিন্ন রচনা বা লেখাই। এখানেই প্রতিবাদী চরিত্রে রামমোহনের সাংবাদিকতার স্বরূপ পথিকৃতের দাবি করতে পারে। আগেই বলা হয়েছে, মতাদর্শগত সংঘাত এ দেশে, সাংবাদিকতাকে মানুষের স্বার্থের সঙ্গে জড়িয়ে দিয়েছে; সাংবাদপত্রকে গুরুত্ব দিয়েছে- এখানেই রামমোহনের অবদান অনস্বীকার্য। এবং তৎকালীন সীমাবদ্ধ সংবাদপত্র জগতে কলকাতাভিত্তিক মুদ্রণ শিল্পের হাত ধরে সাংবাদিকতার ক্রমবিকাশে রামমোহনের মূল্যায়ন করা উচিত সেই প্রেক্ষাপটেই।

উনিশ শতকের পূর্বে কলকাতার সাংবাদপত্রে জন্য লড়াই কিংবা আবেদন-নিবেদন কোন একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। রাজা রামমোহন রায় ছিলেন উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের ভারতীয় প্রেস ব্যবস্থার পুনঃজাগরণে সার্থক প্রচেষ্টাকারী ব্যক্তি। কারণ যেখানে এই একই শতকের প্রথমার্ধে এই মৃত্তিকার সন্তানদের বিনষ্ট করার প্রচেষ্টা ছিল, সেখানে দ্বিতীয়ার্ধে রামমোহন রায়ের প্রচেষ্টাতেই মেধাবীদের উদ্বুদ্ধ হওয়ার প্রবণতা দেখা গেছিল। যদিও তা ছিল পার্শ্ববর্তী পরিস্থিতির ঘটনার প্রভাবধারা অনুসারী। সমসাময়িক কালের ইউরোপে তা রেঁনেসাঁস, যা পরবর্তীকালের সাম্রাজ্যবাদী সাংস্কৃতিক রূপান্তরের সঙ্গেই বিকশিত হয়েছে- ফরাসি দেশে, ইংল্যান্ডে, এমনকি আমেরিকাতেও। সামাজিক ও রাজনৈতিক সাম্য-মৈত্রী স্বাধীনতার উচ্চারিত আকাক্সক্ষার সঙ্গেই মানুষের অধিকারের অংশ হিসেবে পুষ্ট করেছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ধারণাকে। এমনই একটি ধারণা ও চেতনায় রামমোহন ও তৎকালীন সহযোগীরা কীভাবে সমৃদ্ধ হয়েছিলেন তা ভাবলে অবাক হতে হয়। বিশেষত যেখানে সাংবাদিকতায় ভারতীয়দের অভিজ্ঞতার ভা-ার প্রায় শূন্য। যদিও হিকি থেকে বাকিংহাম-এর সংবাদপত্র জগত রামমোহন ও তার সতীর্থদের কাছে একটা প্রেক্ষাপট হিসেবে ছিলই, তারা দেখেছিলেন হিকির কাগজ বন্ধ করে দেওয়া ও হেনস্তার ঘটনা দেখেছিলেন প্রাক-সেন্সরশিপ আইনের বাধ্যবাধকতা। ধারণা ছিল বলেই হয়তো বাঁধন ছেঁড়ার প্রচেষ্টাও ছিল প্রবল। রামমোহন সেই প্রচেষ্টার প্রথম পদাতিক। ১৮২৩ সালের কুখ্যাত অ্যাডামস আইনের বিরোধিতা থেকেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সম্পর্কে তার যত প্রতিবাদ-যত ক্ষোভ। অনেকটাই যেন সাম্রাজ্যবাদী উদারপন্থি মানসিকতার প্রতিষ্ঠান। অবশ্য এটাই ছিল স্বাভাবিক। উনিশ শতকের প্রথম দিকে যে সময়ে এই যুক্তি প্রতিধ্বনিত হয়েছে, যখন ভারবর্ষের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষার জন্ম হয়নি- তখন একটি পরাধীন দেশের সংবাদপত্রে স্বাধীনতার প্রশ্নটির মধ্যে একটি মৌলিক অসঙ্গতি রয়েছে- এ সম্পর্কে কোম্পানির কর্তারা যেমন সচেতন ছিলেন, তেমনি রামমোহনও ছিলেন সচেতন। তাই তিনি ভাবতে পারেন ভারত ও ভারতবাসীর উন্নতির জন্য ব্রিটিশ শাসন যেমন প্রয়োজন, তেমনি লেখেন- যেখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই সেখানেই অসংখ্য বিদ্রোহ ও বিপ্লব ঘটে থাকে। কারণ স্বাধীন সংবাদপত্র না থাকায় প্রজাদের বিক্ষোভ প্রকাশের অন্য কোন পথ থাকে না।

মনে হওয়া স্বাভাবিক রামমোহনের কাছে সম্ভবত দেশের স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সমার্থক ছিল না। থাকলে তার বিপরীত বোধ থাকত না। আসলে তৎকালীন যুগ ও সমাজ চেতনার সীমাবদ্ধতায় ঘুরে বেড়িয়েছে তার চিন্তাধারা। এই সীমাবদ্ধতার একমাত্র মুক্তি সম্ভবত ঘটেছে মতপ্রকাশের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিবাদী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে, বাহন ছিল সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্র, বই সমালোচনামূলক লেখা আর স্মারকলিপি। এখানেই রামমোহনের ভূমিকা কিংবা অবদান এক পথিকৃতের।

রামমোহন তার সময়ে ব্যক্তি-স্বাধীনতা রক্ষার যে প্রচেষ্টা করেছেন, তা নিঃসন্দেহে একটি দুঃসাহসিক পদক্ষেপ। রামমোহন যখন তার সংগ্রাম শুরু করেন আমাদের জাতীয়তাবাদ তখন মাতৃগর্ভে, দেশের লোক, রাজনীতি সম্পর্কে অজ্ঞ ও নিস্পৃহ। মুষ্টিমেয় শিক্ষিত ও সচেতন ব্যক্তিরা উদীয়মান রাজশক্তিকে চ্যালেঞ্জ করার পক্ষে সাহসী নয়। ব্যক্তি-স্বাধীনতা বা গণতন্ত্রের দাবি তখন সাধারণের কাছে অলীক কল্পনা। আবেদনের ভঙ্গিতে ক্ষমতাশীল ব্রিটিশ সরকারের কাজের সমালোচনা করা ধৃষ্টতা। যদিও আমাদের দেশে সংবাদপত্রসেবীদের স্বাধীনতা আন্দোলন সূচনাতেই মহান পরাজয় বরণ করেছিল। কিন্তু এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ভারতে রাজনৈতিক অধিকার লাভের জন্য নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রথম সূত্রপাত ঘটে। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাই যথার্থ্যই রামমোহনকে ভারতের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের জনকরূপে অভিহিত করেছেন।

উল্লেখ্য, অষ্টাদশ ও উনিশ শতকের যথাক্রমে শেষ ও শুরুর পূর্বের সম্পর্কে, বাংলার ক্ষেত্রে অন্তত যে প্রসঙ্গেই আলোচনা করা হোক না কেন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজা রামমোহনের নাম আসতে বাধ্য। হয়তো অনেকেই এক্ষেত্রে অনেকভাবে রামমোহনকে তুলে ধরতে চেয়েছেন, নানা প্রসঙ্গে-নানাভাবে ও নানারূপে। সেখানে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের, বিতর্কের অবকাশ আছে এ কথা মেনে নিয়ে একজন স্বাধীনচেতা মানুষ হিসেবে সংবাদপত্র জগতে তার যে পদচারণামূলক ভূমিকা; তাতে বিতর্কের অবকাশ নেই বললেই চলে। যে সীমাবদ্ধতার জায়গা আছে তাতে কালের প্রেক্ষাপটে রাখলে তার অনন্যতার জায়গা আমাদের কাছে ধরা পড়ে এবং এখানেই তার উত্তরণও বটে।

[লেখক : প্রকৌশলী; বাংলাদেশ প্রতিনিধি, জার্মান ইনস্টিটিউট অব অল্টারনেটিভ এনার্জি]

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

tab

উপ-সম্পাদকীয়

রাজা রামমোহন রায় ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা

জ্যোতির্ময় ধর

image

বৃহস্পতিবার, ০২ সেপ্টেম্বর ২০২১

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার বলেছিলেন, রাজা রামমোহন রায় যে কালে বিরাজ করেন সে কাল তেমনি অতীতে অনাগতে পরিব্যপ্ত, আমরা তার সেই কালকে আজও উত্তীর্ণ হতে পারিনি। ভারতের আধুনিক যুগপ্রবর্তক রাজা রামমোহন রায় তার অসাধারণ মনীষা ও কর্মশক্তির প্রভাব ভারত-ইতিহাসে চির চিহ্নিত রেখে গেছেন। মধ্যযুগীয় ভারতকে তিনি হঠাৎ আধুনিক যুগের দ্বারদেশে এনে উপস্থাপিত করলেন, বহু বছরের সঞ্ছিত জড়ত্বের যবনিকা অপসারিত করে মুক্তিসূর্যের আলোকে চতুর্দিক প্রদীপ্ত করে তুললেন এবং অচলায়তনের অবরুদ্ধ বাতায়ন উন্মুক্ত করে বহির্বিশ্বের অবাধ হাওয়া তার মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিলেন। তার অমরচিন্তা ও মননের সাক্ষ্য হয়ে আছে তার সম্পাদিত সংবাদপত্রগুলো। তবে সাংবাদিকতায় রামমোহনের ভূমিকা সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সপক্ষে তার ঐতিহাসিক ভূমিকায়। ১৮২৩ সালে সাংবাদিকতায় ভারতীয়দের অভিজ্ঞতার মেয়াদ মাত্র ৫ বছর। সেই প্রেক্ষাপটে রামমোহন ও তার সহযোগীরা কীভাবে এই উন্নত চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে, প্রথম ভারতবর্ষে চৎবংং ভৎববফড়স এর কথা বলেছিলেন তা ভাবতেই অবাক হতে হয়। ভারতবর্ষে তথা ইংরেজ আমলে ভারতের রাজধানী কলকাতায় ব্রিটিশ ও ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের আমগন এবং সে সূত্রেই ভারতবর্ষ তথা কলকাতায় আসা পাশ্চাত্য সভ্যতা, আর স্থানীয় প্রাচ্য সভ্যতার আঁচলে জড়ানো ধর্মীয় কুসংস্কার ও সংস্কারের মিশ্রণে অমৃত যেমন উঠেছিল, গরল-ও তেমনি উঠেছিল। বেড়েছে টানাপোড়েন-অনাচার-অসহিষ্ণুতা এবং উচ্ছৃঙ্খলতা। সবমিলিয়ে নৈতিক অবক্ষয়-এর চিত্ররূপ দেখা গিয়েছিল। অন্যদিকে পৃথিবীকে জানার ও শেখার বিরাট অঙ্গন-ও উন্মুক্ত হয়েছিল তৎকালীন ‘নেটিভ’দের কাছে। দুয়ের দ্বন্দের মধ্যে থেকেই উঠে এল একটা পরিবর্তনের আবহাওয়া; যা পরবর্তীকালে বাংলার সর্বাঙ্গীন বিকাশের দ্যোতক। বাংলার সমাজজীবনে এই পরিবর্তনের আঁচ বা পটভূমি রাজা রামমোহন রায়ের জীবনে কতখানি প্রভাব ফেলেছিল সেটা গবেষণার বিষয়। কিন্তু ১৭৮০ সালে হিকির ‘বেঙ্গল গেজেট’ যখন প্রকাশিত হয় তখন রামমোহনের বয়স মাত্র আট বছর- সেই বয়সে কলকাতা থেকে অনেক দূরের একটি গ্রাম্য বালকের কাছে ভারতের প্রথম সংবাদপত্র সম্পর্কে জানা বা বোঝা সম্ভব ছিল না-এটা সহজ সত্য। তেমনি এটাও সত্য যে, তেজারতি ব্যবসার সূত্রে কলকাতার অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণের সমাজজীবনের প্রভাব পরবর্তীকালে রামমোহনের লেখায় পড়েছিল, পড়েছিল তার শিক্ষা-সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অবস্থানেও। রামমোহন ১৮১৪ সালে পাকাপাকিভাবে হুগলীর রাধানগর গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন। তখন তার বয়স ৩২ বছর। ইতোমধ্যে কলাকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছে (১৭৮০ থেকে ১৮১৭ সাল পর্যন্ত) মোট এগারোটি (১১) সংবাদপত্র। যদিও তার সবই ছিল ইংরেজি মালিকানায় এবং ইংরেজি ভাষায়। দৈনিক পত্রিকা একটি ও ছিল না। ছিল ৭টি মাসিক এবং ৪টি সাপ্তাহিক পত্রিকা।

এরপরই ১৮১৮ সালটি বাংলা সংবাদপত্রের ইতিহাসে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। প্রথম- এই সালেই ভারতের শাসন ক্ষমতায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের চরম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। আর দ্বিতীয়ত- এই ১৮১৮ সালেই ভারতীয়দের পরিচালনায়-সম্পাদনায় এবং খাঁটি ভারতীয় ভাষায় প্রথম ভারতীয় সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় শিক্ষক গঙ্গাকিশোর ভট্টাচ্যার্যের ‘ বেঙ্গল গেজেট’ (সপ্তাহিক) প্রকাশনার মধ্য দিয়ে (যদিও প্রকাশকাল নিয়ে কিছু মতভেদ আছে)। অন্যদিকে, এই পত্রিকা প্রকাশের আগে রামমোহনের বন্ধু জেমস সিল্ক বাকিংহামের সম্পাদনায় ‘ক্যালকাটা জার্নাল’ ভারতবর্ষ তথা বাংলার সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে একটি বলিষ্ঠ আদর্শের উদাহরণ হয়ে আছে। সংবাদপত্রের মান কীভাবে উন্নত স্তরে নিয়ে যাওয়া যায় তার নিজস্ব মান ধরে, তার পত্রিকাটি পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় অনন্য। সমালোচনার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র আক্রমণাত্মক নয়- এর বদলে দেখা গিয়েছে যুক্তিনির্ভর ও তথ্যভিত্তিক সমালোচনা এবং খুবই সামন্যভাবে হলেও এই প্রথম দেশবাসীর মনে স্বাধীন চেতনার উন্মেষের সঙ্গে স্বাধীনতা ও স্বরাজ্যের স্বপ্ন দেখার সূত্রপাত ঘটল। এমনি করেই ১৭৮৮ থেকে ১৮১৮-এই ৩৮ বছরের নানা ঘটনার, অভিজ্ঞতার আলোকে রামমোহন রায়ের ব্যক্তিত্বও গড়ে ওঠেছে। ইংরেজি, ফার্সি, সংস্কৃত ভাষায় তার সমান দক্ষতা ছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে যে তার নিবিড় পরিচয় ছিল তার উদাহরণ আমরা পেয়েছি পরবর্তীকালে তার লেখায়। যে লেখার সূত্রপাত তৎকালীন সমাজভিত্তিক হিন্দুধর্মের গোঁড়ামী ও সংস্কারকে কেন্দ্র করে। মাধ্যম ছিল সংবাদপত্র, যা তৎকালীন বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছোনোর একমাত্র বাহন। যে সংবাদপত্রের মাধ্যমেই বাংলা গদ্যসাহিত্য, সংবাদ-সাহিত্য, রস-রচনা, সমালোচনা পত্র, সাহিত্যের বিকাশ ও বিস্তার সম্ভবপর হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই রামমোহন সমকালীন সমাজকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র সাহিত্য চর্চায় নিমগ্ন হতে পারেনি। সমাজের ধর্ম ও সংস্কারকে কেন্দ্র করে যে বিরোধ গড়ে উঠেছে রামমোহন তাকে এগিয়ে নিতে না গিয়ে কলম ধরলেন, প্রতিবাদীর ভূমিকায় নেমে বাধা পড়লেন সংবাদপত্র জগতে উদারপন্থী হিসেবে। পরাধীন ভারতে রামমোহন-ই প্রথম চিন্তার মুক্ত প্রকাশের দাবি উচ্চারণ করেন। আমাদের আলোচনায় এই পটভূমিকে জানা দরকার রামমোহনকে জানতে গেলে। কেননা রামমোহনের ব্যক্তিত্ব্য গড়ে উঠেছে এই পটভূমিতেই।

ভারত ব্রিটিশ রাজত্বে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালে মুদ্রণ নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক আইন চালু ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে লর্ড হেস্টিংস ভারতে গভর্ণর জেনারেলের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাই ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দে এই আইনটি প্রত্যাহার করে নেন। হেস্টিংসের উদারনীতির পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করতে এ দেশের যে সব বুদ্ধিজীবিরা এগিয়ে এলেন তাদের মধ্যে রামমোহন রায় ছিলন অগ্রগণ্য। হিন্দুধর্মের প্রতি অযৌক্তিক আক্রমণের বিরুদ্ধে তিনি ১৮২১ এর সেপ্টেম্বরে প্রকাশ করলেন ইংরেজিতে-‘ ইৎধযসধহরপধষ গধমধুরহব’ এক পৃষ্ঠায়, আর অন্য পৃষ্ঠায় বাংলায় ‘ব্রাহ্মণ সেবধী’। ইংরেজিতে মূল রচনা-বাংলায় তারই অনুবাদ। শ্রীরামপুরের খ্রিস্টান মিশনারি দ্বারা প্রকাশিত ‘সমাচার দর্পণ’-এর এক বিতর্কিত ও আপত্তিকর মন্তব্যকে নিয়ে তিনি একটি প্রতিবাদপত্র পাঠিয়েছিলেন। ‘সমাচার দর্পণ’-এর সম্পাদক প্রথম অংশ ছাপাতে রাজি হলেও, দ্বিতীয় অংশ না ছাপানোয় তিনি তার প্রতিবাদ করার জন্যই এই পত্রিকাটি প্রকাশ করলেন। যদিও এখানে লক্ষ্যনীয় যে রামমোহন সংবাদপত্রের জন্য সংবাদপত্র প্রকাশ করেননি-প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবেই এই প্রয়াস করেন তিনি। পরবর্তী পর্যায়ে সংস্কারমূলক রচনা ‘সতী’ প্রকাশের জন্য ব্যাপটিস্ট মিশন থেকে প্রকাশিত ‘বেঙ্গল গেজেট’-এর দ্বারস্থ হয়েছিলেন। হয়ত বা তার একটি কারণ হতে পারে, তার বন্ধু ও তার প্রতিষ্ঠিত ‘আত্মীয় সভা’র সদস্য হরচন্দ্র রায় ছিলেন তখন ‘বেঙ্গল গেজেট’-র সম্পাদক এবং এই পত্রিকাটি তখন কলকাতার সমাজে খুবই জনপ্রিয় ছিল। এরপরেই সংবাদপত্রের জগৎ থমকে দাঁড়িয়েছে ১৮১৮ থেকে ১৮২১ সাল পর্যন্ত। যার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কারণ তৎকালীন সংবাদপত্রের ওপর প্রাক-সেন্সর বিধি, ফলে কোনও সংবাদপত্র প্রকাশিতও হয়নি। রামমোহনের ইংরেজিতে- ‘Brahmanical Magayine’ বা ‘ব্রাহ্মণ সেবধী’ বন্ধ হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। প্রাক-সেন্সর বিধি-ও উঠে গিয়েছে ১৮১৯ সালে। কিন্তু বাংলা সংবাদপত্রের আকাল তখনও ঘোঁচেনি।

রামমোহনের স্বাধীনচেতনা ও সংবাদপত্র : ১৮২১ সালের ৪ ডিসেম্বর প্রকাশিত হলো ‘সংবাদ কৌমুদী’, সাপ্তাহিক। সম্পাদক ছিলেন ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রকাশক তারাচাদ দত্ত। অনেকের মতে রামমোহন ছিলেন এই পত্রিকার মূল শক্তি-সম্পাদনা তথা লেখায়। রামমোহন প্রতিষ্ঠিত ছাপাখানায় এ পত্রিকা ছাপা হতো। রামমোহন যদিও পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন না, কিন্তু তারই নির্দেশিত নীতিতে পত্রিকাটি পরিচালিত হতো। স্বাভাবিকভাবেই হিন্দুধর্মের গোঁড়ামী ও কুসংস্কার-বিরুদ্ধ মতের তথা প্রগতিবাদী মনোভাবের পৃষ্ঠপোষক রামমোহনের লেখা কৌমুদীর অন্যতম বিষয় হয়ে উঠল। ‘সংবাদ কৌমুদী’ প্রথমে মঙ্গলবার ও পরে প্রতি শনিবার প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকায় ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র ইত্যাদি সম্পর্কিত নানা আলোচনা ও সংবাদ, দেশের দৈনন্দিন ঘটনাবলীর সংবাদ, জ্ঞাতব্য তথ্য ও সমাজিক সমস্যা সম্পর্কিত পত্রাবলী ছাপা হয়। গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য্যেের ‘বেঙ্গল গেজেটের’ পর, ‘সংবাদ-কৌমুদী’-ই বাংলা ভাষায় সাপ্তাহিক বাঙালি সম্পাদিত সাময়িকপত্র। জনসাধারণের অভাব, অভিযোগের প্রতি শাসকদের ও উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। সংবাদপত্রকে সঠিকভাবে গণমাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে ‘সংবাদ-কৌমুদী’-র ভূমিকা অনেকখানি সার্থক ছিল। স্বদেশবাসীকে উপযুক্ত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানালো, বিজ্ঞান ও কারিগরি চিকিৎসা ইত্যাদি বিভিন্ন পেশাদারি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে দেশবাসীকে বোঝানোর জন্য এই পত্রিকায় লেখা হতো। পত্রিকার এই প্রচেষ্টা তথা রামমোহনের শিক্ষা-প্রসারের এ উদ্দেশ্য যে অনেকাংশে সার্থক হয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য প্রমাণ ছিল ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে ডক্টর জেমসনের অধীনে কুড়িজন ছাত্রকে বৃত্তি দিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞান শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।

সামাজিক নানা বিষয়ে অসুবিধার কথা যেমন-হিন্দুদের মৃতদেহ সৎকারের জন্য শ্মশানঘাট, বিধবা বিবাহ, কৌলিন্য প্রথা, শিশুহত্যা, সতীদাহ ইত্যাদি নানা কুসংস্কার ও সামাজিক সমস্যা নিয়ে পত্রিকায় আলোচনা ও চিঠিপত্র-ও ‘সংবাদ-কৌমুদী’তে প্রকাশিত হতো এবং এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও বলা হতো। দেশবাসীর মানসিক ও নৈতিক উন্নতির জন্য পত্রিকায় হিন্দুর সম্পত্তি অধিকার আইনের সংশোধন চাওয়া হয়েছে, অপরিণত বয়স্কদের সম্পত্তির অধিকার দান নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। একই সাথে বিদেশি শাসনের একপেশে অন্যায় নীতি যেমন-স্বদেশীয়দের নিরাপত্তাহীনতা, তাদের প্রতি চরম বৈষম্যমূলক ব্যবহার, অন্যায়-বিচার ব্যবস্থা, দুর্ব্যবহার এবং এর বিরুদ্ধে জনগণের অসস্তোষ ও অভিযোগ পত্রিকায় সংবাদ-আলোচনা-পত্রাদির মাধ্যমে জনমক্ষে তুলে ধরা হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনায় রামমোহন প্রবর্তিত কাগজেই আমরা জাতীয়তাবাদের প্রথম স্ফুরণ দেখতে পাই। দুরদর্শী রামমোহন দেশের অর্থনৈতিক পরাধীনতা নিয়েও চিন্তা-ভাবনা করেছেন, যার প্রতিফলন তার পত্রিকায়ও দেখতে পাওয়া যায়। দেশের অর্থনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে পত্রিকার মধ্য দিয়ে দেশবাসীকে সজাগ করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে শুধু শাসনকর্তাদের নয়, রামমোহন দেশবাসীকেও দায়িত্বশীল হতে পত্রিকায় নির্দেশ দিয়েছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দিক থেকে পশ্চাৎপদ পরাধীন একটি জাতির মুখপত্ররূপে সংবাদ-কৌমুদী ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষায়, সামাজিক উন্নয়নে, স্বাদেশিকতা প্রচারে যেভাবে সোচ্চার হয়েছে ভারতীয় সংবাদপত্রের ইতিহাসে তার অবদান অবিস্মরণীয়। সমাজ-সংস্কারে সংবাদ-কৌমুদীর ভূমিকা সমাজের রক্ষণশীল ব্যক্তিদের অসন্তোষের কারণ হয়েছিল। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও রামমোহনের সামাজিক সংস্কার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাই ‘সংবাদ-কৌমুদী’-র ১৩টি সংখ্যার পর তিনি পত্রিকা ছেড়ে দিলে রামমোহন তার দায়িত্ব নেন (১৮২২ সাল)। এর শেষ পর্যায়ে সম্পাদক ছিলেন রামমোহন পুত্র রাধাপ্রসাদ রায়। ‘সংবাদ-কৌমুদী’-কে কেন্দ্র করেই রামমোহনের প্রত্যক্ষ এবং সচেতনভাবে সংবাদপত্র জগতে প্রবেশ। তার পত্রিকা পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশনার দায় ও দায়িত্ব বাংলার সংবাদপত্রের বিকাশে এক নতুন মাত্রা এনে দিল (উল্লেখ্য, ১৮৩৪ সাল পর্যন্ত ‘সংবাদ-কৌমুদী’ প্রকাশিত হতো)।

অবশ্য রামমোহন ১৮০৩ সালে, একটি পার্শিয়ান সংবাদপত্র প্রকাশ করেছিলেন, যার নাম ছিল ‘তাহাফত-উল হুয়াহহিদ্দিন’ (একেশ্বরবাদীদের জন্য প্রদত্ত উপহার), যেটা সাধারণ মানুষের অধিকার নিয়ে সরব ছিল।

রামমোহনের সময় এ দেশে শিক্ষিত মহলে ফার্সি ভাষাতেই বিদ্যাচর্চা করা হতো। রামমোহন এসব শিক্ষিতদের জন্য ফার্সি ভাষায় একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করার সংকল্প করেন। ১৮২২ সালের ১২ এপ্রিল ‘মিরাৎ-উল্-আখবার’ (সংবাদের দর্পণ) নামে রামমোহন রায় সম্পাদিত ফার্সী ভাষায় এই সাপ্তাহিক পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। প্রতি শুক্রবার পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো। এই পত্রিকা দেশবাসীকে তাদের সামাজিক অবস্থার উন্নতির জন্য অভিজ্ঞতা অর্জনে সাহায্য করবে; এই পত্রিকা শাসকশ্রেণীকে তাদের প্রজাদের প্রকৃত অবস্থা কী তা জানতে সাহায্য করবে এবং প্রজারাও সরকারি আইন ও নিয়মাবিধির সঙ্গে পরিচিত হতে থাকবে। এর ফলে শাসকশ্রেণী সহজেই জনগণের অভাব-অভিযোগ এবং তাদের অসন্তোষের প্রতিকার করতে পারবে। অন্যদিকে শাসকপক্ষ কীভাবে জনগণের নিরপত্তারক্ষা তথা তাদের কষ্টলাঘব করতে পারে সে বিষয়েও জনসাধারণ স্যমকভাবে ধারণা লাভ করবে। সুতরাং বলা যায় রামমোহনই প্রথম তৎকালীন একমাত্র গণমাধ্যম সংবাদপত্রের মধ্য দিয়ে দেশবাসীকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন।

‘মিরাৎ’ পত্রিকায় জাতীয় সংবাদের পাশাপাশি নানা ধরনের আন্তর্জাতিক সংবাদ-ও গুরুত্বসহকারে ছাপানো হতো। এই পত্রিকায় রাজনৈতিক আলোচনা যথেষ্ট প্রাধান্য পেয়েছে এবং রামমোহন তার রাজনৈতিক মতবাদ সুস্পষ্টভাবে যেকোনো আলোচনা প্রসঙ্গে ব্যক্ত করেছেন। ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির কোনো বিরোধ তিনি মানতেন না। এই কারণে ধর্ম ও রাজনীতি সম্পর্কিত রামমোহনের মতাদর্শ এই পত্রিকায় একইসঙ্গে প্রচারিত হয়েছে।

গণতন্ত্রকে সমর্থন করলেও, অনভিজ্ঞ জনগণের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রকে তিনি সমর্থন করেননি। মুসলিমদের সম্পর্কে বিদেশীদের যে ভ্রান্ত ধারণা ছিল তা দুর করার জন্য রামমোহন হাফিজের বয়ান অনুদিত করে মুসলিমদের উদার ধর্মবাদ সুফী ধর্মীয় নীতিগুলিকে পত্রিকা মারফত প্রচার করেন। এই পত্রিকা মারফত রামমোহন দেশের শিক্ষিত অংশকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করতে এবং শাসকশ্রেণীকে দেশের সামাজিক-ধর্মীয় অবস্থার সম্পর্কে অভিজ্ঞ করার চেষ্টা করেছে। দেশ-বিদেশের যে কোনো ঘটনার সংবাদ ও সে সম্পর্কে তার মতামত নির্ভিকভাবে প্রকাশ করে রামমোহন যথার্থ সাংবাদিকের কর্তব্য নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন। ‘সংবাদ-কৌমুদী’ ও ‘মীরাৎ-উল্-আখবার’-এ রামমোহনের মুক্ত চিন্তার এবং গণচেতান জাগানোর জন্য তার পত্রিকার ভূমিকা তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজের শাসন, কর্তৃপক্ষের অসন্তোষের কারণ হয়েছিল। কিন্তু কিছু উদারনৈতিক ইংরেজের সমর্থন-ও রামমোহন পেয়েছিলেন। ইংরেজ সম্পাদিত এদেশের সংবাদপত্রগুলোতে ‘সংবাদ-কৌমুদী’ ও মিরাৎ-এ প্রকাশিত সংবাদ ও আলোচনা অনুদিত ও পুনঃমুদ্রিত হয়েছে। এ দেশের সংবাদপত্রের জন্মলগ্নে রামমোহন রায়ের অবদান অপরিসীম এবং তার পরিচালিত দুটি পত্রিকাই ঐতিহাসিকদের কাছে তথ্য-সম্পদরূপেই চিহ্নিত।

‘মিরাৎ-উল্-আখবার’-এর অনেকে লেখাই সরকার আপত্তিকর মনে করেছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কলকাতার বিশপ ড. মিলটনের মৃত্যুতে কাগজে প্রকাশিত শোক সংবাদের সঙ্গে খ্রিস্টীয় ত্রিত্তবাদ নিয়ে কিছু মন্তব্য, পারস্যের রাজকুমারের সঙ্গে বড়লাটের সাক্ষাৎকার নিয়ে সরকারি মতে কিছু অতিরঞ্জিত সংবাদ ইত্যাদি। তাই ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দের অ্যাডামের ব্যক্তি-স্বাধীনতা হরণকারী মুদ্রণ-নিয়ন্ত্রণ আইনের কবলে, ‘মিরাৎ-উল্-আখবার’ও পড়ল। কিন্তু রামমোহন ব্যক্তি-স্বাধীনতার বরাবরই বিশ্বাসী ছিলেন। দেশের শিক্ষিত জনগণের প্রতি অবমাননাকর এই আইন রোধ করেন, ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও দেশবাসীর নায্য অধিকার অক্ষুণ্ন রাখতে তিনি এগিয়ে এলেন। সরকারি প্রস্তাবটি সুপ্রিম কোর্টে গৃহীত হয়ে আইনে তিনি একটি আবেদনপত্রে পেশ করেন। এত অল্প সময়ে আবেদনপত্রটি প্রস্তুত করা হয় যে বেশি লোকের লোকের স্বাক্ষর সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, হরচন্দ্র ঘোষ, গৌরীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রসন্নকুমার ঠাকুরের নাম, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব্য। রামমোহনের এই আবেদনপত্র ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা। যদিও তার ‘ব্রাহ্মণ সেবধী’কে সংবাদপত্র বলা যায় কিনা তা বিতর্কের বিষয়। আর ‘মিরাৎ-উল্-আখবার’-এর মধ্যে সংবাদ কতখানি প্রতিফলিত হয়েছিল তাও বলা কঠিন। কেননা তার কোন মূল কপি পাওয়া যায়নি। তবে অ্যাডামসের এই ‘কালা-কানুন’-এর প্রতিবাদে তার ভূমিকা নিঃসন্দেহে প্রনিধানযোগ্য। তিনি এর প্রতিবাদ করতে গিয়েই লেখেন-‘হৃদয়ের শত শত ফোঁটা শোণিতের বিনিময়ে অর্জন করেছো যে অমূল্য সম্মান, প্রিয় মোর তুচ্ছ দারোয়ানের অনুগ্রহ পাবার আশায় তাকে করোনা বিক্রয়’ এবং ‘মীরাৎ-উল্-আখবার’ বন্ধ করে দেন। পত্রিকা বন্ধ হলেও দিনের আলোয় প্রকাশিত হলো সেই উপলব্ধি যে, সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতা কোন কারণেই বিক্রি করা যায় না। ব্রিটিশ রাজত্বে মুদ্রণ ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে স্বাধীন মতামত প্রকাশে নায্য অধিকার রক্ষায় আমাদের দেশের সংবাদপত্রসেবীরা যে অনলস প্রয়াস চালিয়েছিলেন রামমোহনের আবেদনের মধ্য দিয়েই তার ভিত্তি-প্রস্তরটি স্থাপিত হয়। তাই রামমোহনের জীবনীকার মিস কলেট এই আবেদনপত্রটিকে ভারতীয় ইতিহাসের ‘অ্যারিওপ্যাগিটিকা’ রূপে অভিহিত করেছেন। সর্বোপরি যে উপলব্ধি আজ থেকে ১৭৭ বছর আগে ঘটেছি, তাত যে ভারতীয় স্বাধীনচেতা সাংবাদিকতার এক অনন্য সাধারণ উদাহরণ, তা মেনে নিতে কোন দ্বিধা থাকার কথা নয়। ‘মীরাৎ-উল্-আখবার’-এর পাশাপাশি রামমোহন রায় আরেকটি সংবাদপত্র প্রকাশ করতেন, যার নাম ছিল ‘জান-ই-জাহাপনামা’, সাল ১৮২২ এর মার্চ। এটি একটি সাপ্তাহিক পত্রিকাই ছিল। ১৮২২ সালের ১২ মে থেকে এটির অষ্টম সংখ্যায় ভারতীয় সংবাদপত্র হিসেবে তার উর্দু এবং পার্শিয়ান ভাষায়ও প্রকাশ হতে শুরু করে।

রামমোহন রায় ‘বেঙ্গল হেরান্ড’ নামে আরেকটি পত্রিকার মালিক-ও ছিলেন। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮২২ সালের ১০ মে, যার সম্পাদক ছিলেন মন্টেগো মেরি মারলিন। এই সংবাদপত্রটি চারটি ভাষায় প্রকাশিত হতো।

রাজা রামমোহন রায় একজন সমাজ-সংস্কারক হিসেবেই স্বাধীন প্রেসের জন্য লড়াই করে গেছিলেন। তিনি বিশ্বের সত্য সম্পর্কে চিন্তা করতেন, তা খুঁজতেন। তার লেখনীর ধারা না ছিল দেশী, না ছিল বিদেশি। তা ছিল সমাজের সর্ববন্ধন মুক্তির প্রয়াস। মূলত তাতে ছিল যেমন বিতর্কের ছোঁয়া, তেমনি থাকত যুক্তির মাধ্যমে বলিষ্ঠ বক্তব্য প্রকাশের স্বাধীন চেষ্টা। নতুন বিশ্বের আলোচনায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাথে হিন্দু সমাজের ও সমাজব্যবস্থার এক সার্থক সমন্বয়ের প্রয়াস তাকে সেই সমাজ ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এক অনবদ্য ভূমিকায় তুলে ধরেছে। যে সমাজ-ব্যবস্থায় ব্যাক্তি-স্বাধীনতার কোন মূল্য নেই সেখানে যে গোষ্ঠী স্বাধীনতার কোন মূল্য থাকবে না, তাতে তিনি একরকম নিঃসন্দিহান ছিলেন। আর এই পরাধীনতা যে দেশের স্বনির্ভরতার পথে বাধা তাও তিনি জানতেন। সেজন্য তিনি ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের প্রতি জোর দিতে গিয়ে সংবাদপত্রকেই বেঁচে নিয়েছিলেন, তার স্বাধীন বক্তব্য প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে। সেখানে জাতি-ধর্ম-ভাষার প্রতিবন্ধকতাকে দূর করতেও তিনি সচেষ্ট ছিলেন। যদিও এখানে উল্লেখ করা যায়, রামমোহন ১৮৩০ সালের ১৫ নভেম্বর বিলেত যান এবং সেখানে তার মৃত্যু হয় ১৯৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। অর্থাৎ তার ধর্ম ও কর্মজীবন এদেশে মাত্র ১৫ বছরের, ১৮১৮ সাল থেকে ১৮৩০ সাল পর্যন্ত। আর সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মাত্র ৯ বছর, ১৮২১ থেকে ১৮৩০ সাল পর্যন্ত। কিন্তু আমরা, আজকের যে সংবাদপত্রের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে পরিচিত, ১৮২১ সালে সেই চেহারা আশা করা যায় না, উচিতও নয়। তাই সম্পাদক হিসেবে রামমোহনের ভূমিকা ও অবদান যতখানি, সাংবাদিক হিসেবে সেই ভূমিকা ঠিক ততখানি নয়, কারণ তৎকালীন গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের সামাজিক, ধার্মিক কিংবা অর্থনৈতিক চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলন কিংবা প্রতিরূপ ‘সংবাদ-কৌমুদী’ বা অন্য কোন কাগজে প্রতিফলিত হয়নি। সেকালের সমস্ত সংবাদপত্র কিংবা সাময়িকপত্র কলকাতানির্ভর ইংরেজ কর্মচারী, সামান্য ইংরেজি জানা বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণী, আর ব্যবসায়ী বাঙালি ও ইংরেজনির্ভর। ফলে সংবাদপত্রের বিকাশ ও অগ্রগতি সেই শ্রেণীর প্রতিনিধিকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল তখন। সূত্র অবশ্যই ছিল- সেটা তৎকালীন ধর্মীয় সংস্কারপন্থিদের সঙ্গে প্রাচীনপন্থিদের মধ্যে বাদ-প্রতিবাদ, রামমোহনের সাংবাদিকতা, এই সূত্র ধরেই বিকাশ লাভ করেছে- সেখানে তার আগ্রহ, প্রচেষ্টা কিংবা উৎসাহের কোন ত্রুটি ছিল না। তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি তৎকালীন যুগাবয়বে প্রকাশনা ও সাংবাদিকতাকে সামাজিক ও ধার্মিক ভাবনাকে, জনমত সংগঠনায় প্রয়োগ করেছিলেন।

রামমোহন মাত্র ৯ বছর ‘ সংবাদ-কৌমুদীর’র সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন, এছাড়া ‘বেঙ্গল হেরাল্ড’ বা ‘বঙ্গদূত’ পত্রিকার সঙ্গে তিনি কতখানি ও কীভাবে জড়িত ছিলেন তাও পরিষ্কার নয়। ফলে রামমোহনের সম্পাদকের ভূমিকা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে মূল ভিত্তি হওয়া উচিত, সে যুগের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ও পটভূমিতে বিভিন্ন ঘটনার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ তার বিভিন্ন রচনা বা লেখাই। এখানেই প্রতিবাদী চরিত্রে রামমোহনের সাংবাদিকতার স্বরূপ পথিকৃতের দাবি করতে পারে। আগেই বলা হয়েছে, মতাদর্শগত সংঘাত এ দেশে, সাংবাদিকতাকে মানুষের স্বার্থের সঙ্গে জড়িয়ে দিয়েছে; সাংবাদপত্রকে গুরুত্ব দিয়েছে- এখানেই রামমোহনের অবদান অনস্বীকার্য। এবং তৎকালীন সীমাবদ্ধ সংবাদপত্র জগতে কলকাতাভিত্তিক মুদ্রণ শিল্পের হাত ধরে সাংবাদিকতার ক্রমবিকাশে রামমোহনের মূল্যায়ন করা উচিত সেই প্রেক্ষাপটেই।

উনিশ শতকের পূর্বে কলকাতার সাংবাদপত্রে জন্য লড়াই কিংবা আবেদন-নিবেদন কোন একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। রাজা রামমোহন রায় ছিলেন উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের ভারতীয় প্রেস ব্যবস্থার পুনঃজাগরণে সার্থক প্রচেষ্টাকারী ব্যক্তি। কারণ যেখানে এই একই শতকের প্রথমার্ধে এই মৃত্তিকার সন্তানদের বিনষ্ট করার প্রচেষ্টা ছিল, সেখানে দ্বিতীয়ার্ধে রামমোহন রায়ের প্রচেষ্টাতেই মেধাবীদের উদ্বুদ্ধ হওয়ার প্রবণতা দেখা গেছিল। যদিও তা ছিল পার্শ্ববর্তী পরিস্থিতির ঘটনার প্রভাবধারা অনুসারী। সমসাময়িক কালের ইউরোপে তা রেঁনেসাঁস, যা পরবর্তীকালের সাম্রাজ্যবাদী সাংস্কৃতিক রূপান্তরের সঙ্গেই বিকশিত হয়েছে- ফরাসি দেশে, ইংল্যান্ডে, এমনকি আমেরিকাতেও। সামাজিক ও রাজনৈতিক সাম্য-মৈত্রী স্বাধীনতার উচ্চারিত আকাক্সক্ষার সঙ্গেই মানুষের অধিকারের অংশ হিসেবে পুষ্ট করেছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ধারণাকে। এমনই একটি ধারণা ও চেতনায় রামমোহন ও তৎকালীন সহযোগীরা কীভাবে সমৃদ্ধ হয়েছিলেন তা ভাবলে অবাক হতে হয়। বিশেষত যেখানে সাংবাদিকতায় ভারতীয়দের অভিজ্ঞতার ভা-ার প্রায় শূন্য। যদিও হিকি থেকে বাকিংহাম-এর সংবাদপত্র জগত রামমোহন ও তার সতীর্থদের কাছে একটা প্রেক্ষাপট হিসেবে ছিলই, তারা দেখেছিলেন হিকির কাগজ বন্ধ করে দেওয়া ও হেনস্তার ঘটনা দেখেছিলেন প্রাক-সেন্সরশিপ আইনের বাধ্যবাধকতা। ধারণা ছিল বলেই হয়তো বাঁধন ছেঁড়ার প্রচেষ্টাও ছিল প্রবল। রামমোহন সেই প্রচেষ্টার প্রথম পদাতিক। ১৮২৩ সালের কুখ্যাত অ্যাডামস আইনের বিরোধিতা থেকেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সম্পর্কে তার যত প্রতিবাদ-যত ক্ষোভ। অনেকটাই যেন সাম্রাজ্যবাদী উদারপন্থি মানসিকতার প্রতিষ্ঠান। অবশ্য এটাই ছিল স্বাভাবিক। উনিশ শতকের প্রথম দিকে যে সময়ে এই যুক্তি প্রতিধ্বনিত হয়েছে, যখন ভারবর্ষের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষার জন্ম হয়নি- তখন একটি পরাধীন দেশের সংবাদপত্রে স্বাধীনতার প্রশ্নটির মধ্যে একটি মৌলিক অসঙ্গতি রয়েছে- এ সম্পর্কে কোম্পানির কর্তারা যেমন সচেতন ছিলেন, তেমনি রামমোহনও ছিলেন সচেতন। তাই তিনি ভাবতে পারেন ভারত ও ভারতবাসীর উন্নতির জন্য ব্রিটিশ শাসন যেমন প্রয়োজন, তেমনি লেখেন- যেখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই সেখানেই অসংখ্য বিদ্রোহ ও বিপ্লব ঘটে থাকে। কারণ স্বাধীন সংবাদপত্র না থাকায় প্রজাদের বিক্ষোভ প্রকাশের অন্য কোন পথ থাকে না।

মনে হওয়া স্বাভাবিক রামমোহনের কাছে সম্ভবত দেশের স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সমার্থক ছিল না। থাকলে তার বিপরীত বোধ থাকত না। আসলে তৎকালীন যুগ ও সমাজ চেতনার সীমাবদ্ধতায় ঘুরে বেড়িয়েছে তার চিন্তাধারা। এই সীমাবদ্ধতার একমাত্র মুক্তি সম্ভবত ঘটেছে মতপ্রকাশের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিবাদী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে, বাহন ছিল সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্র, বই সমালোচনামূলক লেখা আর স্মারকলিপি। এখানেই রামমোহনের ভূমিকা কিংবা অবদান এক পথিকৃতের।

রামমোহন তার সময়ে ব্যক্তি-স্বাধীনতা রক্ষার যে প্রচেষ্টা করেছেন, তা নিঃসন্দেহে একটি দুঃসাহসিক পদক্ষেপ। রামমোহন যখন তার সংগ্রাম শুরু করেন আমাদের জাতীয়তাবাদ তখন মাতৃগর্ভে, দেশের লোক, রাজনীতি সম্পর্কে অজ্ঞ ও নিস্পৃহ। মুষ্টিমেয় শিক্ষিত ও সচেতন ব্যক্তিরা উদীয়মান রাজশক্তিকে চ্যালেঞ্জ করার পক্ষে সাহসী নয়। ব্যক্তি-স্বাধীনতা বা গণতন্ত্রের দাবি তখন সাধারণের কাছে অলীক কল্পনা। আবেদনের ভঙ্গিতে ক্ষমতাশীল ব্রিটিশ সরকারের কাজের সমালোচনা করা ধৃষ্টতা। যদিও আমাদের দেশে সংবাদপত্রসেবীদের স্বাধীনতা আন্দোলন সূচনাতেই মহান পরাজয় বরণ করেছিল। কিন্তু এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ভারতে রাজনৈতিক অধিকার লাভের জন্য নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রথম সূত্রপাত ঘটে। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাই যথার্থ্যই রামমোহনকে ভারতের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের জনকরূপে অভিহিত করেছেন।

উল্লেখ্য, অষ্টাদশ ও উনিশ শতকের যথাক্রমে শেষ ও শুরুর পূর্বের সম্পর্কে, বাংলার ক্ষেত্রে অন্তত যে প্রসঙ্গেই আলোচনা করা হোক না কেন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজা রামমোহনের নাম আসতে বাধ্য। হয়তো অনেকেই এক্ষেত্রে অনেকভাবে রামমোহনকে তুলে ধরতে চেয়েছেন, নানা প্রসঙ্গে-নানাভাবে ও নানারূপে। সেখানে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের, বিতর্কের অবকাশ আছে এ কথা মেনে নিয়ে একজন স্বাধীনচেতা মানুষ হিসেবে সংবাদপত্র জগতে তার যে পদচারণামূলক ভূমিকা; তাতে বিতর্কের অবকাশ নেই বললেই চলে। যে সীমাবদ্ধতার জায়গা আছে তাতে কালের প্রেক্ষাপটে রাখলে তার অনন্যতার জায়গা আমাদের কাছে ধরা পড়ে এবং এখানেই তার উত্তরণও বটে।

[লেখক : প্রকৌশলী; বাংলাদেশ প্রতিনিধি, জার্মান ইনস্টিটিউট অব অল্টারনেটিভ এনার্জি]

back to top