রণেশ মৈত্র
কলকাতা থেকে প্রকাশিত ভারতের সর্বাধিক প্রচলিত দৈনিক আনন্দবাজার ও সিপিআই’র (এম) মুখপাত্র দৈনিক গণশক্তির গত ২১ আগস্টে প্রকাশিত খবরটি আমাকে আকৃষ্ট করেছে। খবরটি হলো- কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী বিগত ২০ আগস্ট দিল্লিতে ভারতের সব অসাম্প্রদায়িক বিরোধীদলীয় নেতাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক ডেকেছিলেন। মূল লক্ষ্য আগামী ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিতব্য ভারতীয় লোকসভার নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক দল বিজেপিকে পরাজিত করে একটি অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ^াসী সরকার গঠনের লক্ষ্যে একটি সর্বভারতীয় জোট গঠন। এতে কংগ্রেস সিপিআই (এম), সিপিআই, ন্যাশনাল কনফারেন্সসহ ১৯ দলীয় নেতারা ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হন।
বৈঠকে উল্লেখযোগ্য দলের মধ্যে সমাজবাদী দল অনুপস্থিত থাকলেও কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিআই (এম), সিপিআইসহ ১৯টি অসাম্প্রদায়িক দল উপস্থিত হয়ে বিজেপিবিরোধী জোট গঠনে সম্মত হয়ে একটি যুক্ত বিবৃতিও প্রকাশ করে। অংশগ্রহণকারী দলগুলোর শীর্ষ নেতারাই বৈঠকে হাজির হন। তারা যৌথভাবে ভারতের জনজীবনের দৈনন্দিন সমস্যাবলী নিয়ে আগামী ২০-৩০ সেপ্টেম্বর ভারতজুড়ে আন্দোলনের নানা কর্মসূচিও ঘোষণা করেন।
এ ধরনের বিরোধীদলীয় জোট ভারতের রাজনীতির ও ভারতের জনগণের স্বার্থে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে; কারণ ভারতে প্রবল শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে বিগত ৭-৮ বছর যাবত নরেন্দ মোদির নেতৃত্বে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ। এই জোট ক্ষমতায় আসীন হয়ে ভারতের ঐতিহ্যবাহী ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি নানাভাবে ক্ষুণœ করে। ভারতের জনগণের অভিযোগ- এনডিএ জোট ক্ষমতায় এসে ভারতের মুসলিম নাগরিকদের নাগরিকত্ব হরণের লক্ষ্যে আইন জারি করা, গোমাংস ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ করা, গো-হত্যা নিষিদ্ধ করা, ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভারতের ধর্মীয় সংখ্যালঘু নাগরিকদের ধর্মান্তরিতকরণ প্রভৃতি ঘোর সাম্প্রদায়িক কাজে লিপ্ত হয়। এর দ্বারা ওই সরকার শুধু সাম্প্রদায়িকতার প্রসার ঘটিয়েছে শুধু তাই নয়, তারা ভারতের সংবিধানের মূলনীতি লঙ্ঘন করেছে, আইনের শাসন ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের গণতান্ত্রিক অধিকারও হরণ করেছে। তদুপরি তারা কৃষকের স্বার্থবিরোধী আইন প্রণয়ন করায় ভারতের হাজার হাজার কৃষক সমাজ মাসের পর মাসব্যাপী ভারতের নানা অঞ্চল থেকে লাঙ্গল-জোয়াল ও নানাবিধ আধুনিক কৃষি উপকরণ নিয়ে দিল্লিতে সমবেত হয়ে উন্মুক্ত ময়দানে মাসের পর মাস ধরে আহার-নিদ্রা ত্যাগ করে অবস্থান ধর্মঘটের মাধ্যমে ভারতের কৃষক আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেন। তাদের স্বার্থবিরোধী যে আইন রচিত হয়েছিল, এত আন্দোলনের পরও তাদের সেই দাবি পূরণ হয়নি- সেই আইন বাতিল হয়নি। সরকারের এমন কঠোর মনোভাব নিঃসন্দেহে কৃষক স্বার্থবিরোধী এবং ভারতের কৃষি খাতকে সংকটাপন্ন করে তুলবে- এমন আশঙ্কাও আছে। বিজেপি সরকার বছর দুয়েক আগে কাশ্মীরের জন্য সাংবিধানিকভাবে দীর্ঘকাল যাবত একটি রাজ্য হিসেবে বিশেষ মর্যাদা ভোগ করছিল দীর্ঘকাল যাবত। তা বাতিল করে ওই রাজ্যে ব্যাপক ধরপাকড়, ইন্টারনেট ও টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করাসহ কাশ্মীরবাসীর ওপর যে ভয়াবহ নির্যাতন চালিয়েছিল তার ফলে কাশ্মীরেও তারা জনপ্রিয়তা হারিয়েছে।
বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের নেতা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একের পর এক সেই দেশের সরকারি মালিকানাধীন শিল্প-কারখানা, ব্যাংক, বীমা প্রভৃতিকে ব্যক্তি খাতে দিয়ে কর্মরত লাখ লাখ শ্রমিক-কর্মচারীর জীবন সংকটাপন্ন করে তুলেছে। অপরপক্ষে এর ফলে উৎপাদনহানি এবং রপ্তানি পণ্যের ঘাটতি দেখা দেওয়ার আশঙ্কাও বিদ্যমান।
অপরদিকে ক্রমাগত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি মধ্যবিত্ত ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। এক কথায়, গুটিকতক কোটিপতি-লাখোপতি ছাড়া বাদবাকি কোটি কোটি ভারতবাসীর জীবন এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন। বিজেপির জনপ্রিয়তাও ধস নেমেছে বলে সেই দেশের পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে জানা যায়। যদিও তা অনেকেই বিশ^াস করতে চান না।
একদিকে বিশাল ভারতের এই চিত্র; অপরদিকে যদি ভারতের লোকসভা এবং বিধানসভাগুলোর নির্বাচনী ফলাফলের দিকে চোখ মেলানো যায়, তবে এর বিপরীত চিত্রই ফুটে ওঠে। মাস কয়েক আগে অনুষ্ঠিত পশ্চিম বাংলার রাজ্য বিধানসভায় তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপিবিরোধী ব্যাপক প্রচারাভিযান চালিয়ে মমতা ব্যানার্জী নিজ দলের অনুকূলে বিপুল বিজয় ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। সেখানে দুটি পুরাতন রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট মিলিতভাবে নির্বাচনে অংশ নিলেও একটি আসনেও জিততে পারেনি। কিন্তু বিজেপি জিতেছে ৭৭টি আসনে; যা কল্পনাতীত। পশ্চিম বাংলার মাটিতে বিজেপি অতীতে শিকড় গাড়তে পারেনি এবং কখনও পারবে না বলে যে বিশ্বাস বেশির ভাগ মানুষ পোষণ করতেন- তাও যেন মিথ্যা প্রমাণিত হলো।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, বিজেপি সরকার সবক্ষেত্রে গণবিরোধী কাজ করেও এবং কথিত মতে তাদের জনপ্রিয়াতায় ধস নামা সত্ত্বেও দলটি এত বেশি আসনে পশ্চিম বাংলায় কী করে জিততে পারলো। যে পশ্চিম বাংলায় বিগত নির্বাচনে মাত্র দুটি আসনে বিজয়ী হয়েছিল এবং তার আগের নির্বাচনগুলোতে বিজেপির ঝুলিতে পশ্চিমবাংলা থেকে একটি আসনও জোটেনি- সেই পশ্চিম বাংলায় এবারের নির্বাচনে তারা ৭৭টি আসনে বিজয়ী হয়ে আগামী ২০২৪ সালের লোকসভা নিবাচনের ক্ষেত্রেও বিজেপি একটা রীতিমতো হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার যে পশ্চিম বাংলার বিধানসভা নির্বাচনে অতীতে বারংবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনসমূহে বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট সর্বাধিক আসনে বিজয়ী হয়ে ৩৪ বছরের মতো একটানা ক্ষমতায় ছিল, সেই বামফ্রন্ট বিগত নির্বাচনে আদৌ কোন আসন না পাওয়াও কম আশ্চর্য্যরে বিষয় নয়। কংগ্রেস আজ প্রায় ৪০ বছর যাবত পশ্চিম বাংলায় মারাত্মকভাবে দুর্বল বটে! কিন্তু তারা বিধানসভায় একটি আসনও পাবে না- এটাও স্বাভাবিক বলে ভাবা যায় না।
উত্তর প্রদেশ ত্রিপুরাসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভায় বিজেপির এখন একচ্ছত্র আধিপত্য। এছাড়াও কয়েকটি রাজ্যে বিজেপি জোট সরকার পরিচালনা করছে গুজরাটসহ। তবে পশ্চিমবাংলা, ত্রিপুরা বাদে বাকি রাজ্যগুলোতে ক্রমান্বয়ে বিজেপির আসন সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে।
বিজেপিবিরোধী দলগুলোর চরম সংকটকালেও ভারতের সব ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল এ যাবত কার্যকর কোন ঐক্য গড়ে তুলতে পারেনি। একদিকে বিজেপির জনপ্রিয়াতায় ধস, অপরদিকে ১৯ দলীয় জোটের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা ও জোট গঠন অনেকটা আশাবাদ গড়ে তুলেছে; যদিও তা নেহায়েতই প্রাথমিক পর্যায়ে। এক ঐক্য সুসংহত কতটা হতে পারবে তা নিয়েও সংশয় থেকে যাচ্ছে। বিশেষ করে মমতা ব্যানার্জীর নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের মধ্যকার তিক্ত সম্পর্ক এবং পরস্পর মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ থাকা ঐক্য সংহত হওয়ার পথে এক মস্ত বাধা। এই দুই দলের নেতৃত্ব যদি কর্মসূচির ভিত্তিতে অন্তত একটি ওয়ার্কিং ইউনিটিও গড়ে তুলতে পারেন তবে উভয় দলই ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ভরাডুবি নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে এবং সর্বভারতীয় রাজনীতির অঙ্গনে নিজেদের গুরুত্ব যথেষ্ট বৃদ্ধি করতে সক্ষম হবে- এরকম সম্ভাবনা বাস্তবেই বেশ প্রবল।
তবে পশ্চিম বাংলা, ত্রিপুরা, কেরালা ভারতের অত্যন্ত ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। নিখিল ভারত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলোর ঐক্য কাশ্মীরেও প্রসারিত করে এবং দেশজোড়া ও ক্ষেত্রবিশেষে রাজ্যভিত্তিতে গণআন্দোলন আগামী দুই আড়াই বছর চালিয়ে যদি নিজেদের গণভিত্তি প্রসারিত করে তুলতে পারে- তবে আগামী ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের মাধ্যমে হয়তো ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি দিল্লিতে ক্ষমতায় ফিরে আসতে সক্ষম হবে। তেমন আশাবাদ অনেকেই পোষণ করেন।
[লেখক : সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ]
raneshmaitra@gmail.com
রণেশ মৈত্র
বৃহস্পতিবার, ০২ সেপ্টেম্বর ২০২১
কলকাতা থেকে প্রকাশিত ভারতের সর্বাধিক প্রচলিত দৈনিক আনন্দবাজার ও সিপিআই’র (এম) মুখপাত্র দৈনিক গণশক্তির গত ২১ আগস্টে প্রকাশিত খবরটি আমাকে আকৃষ্ট করেছে। খবরটি হলো- কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী বিগত ২০ আগস্ট দিল্লিতে ভারতের সব অসাম্প্রদায়িক বিরোধীদলীয় নেতাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক ডেকেছিলেন। মূল লক্ষ্য আগামী ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিতব্য ভারতীয় লোকসভার নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক দল বিজেপিকে পরাজিত করে একটি অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ^াসী সরকার গঠনের লক্ষ্যে একটি সর্বভারতীয় জোট গঠন। এতে কংগ্রেস সিপিআই (এম), সিপিআই, ন্যাশনাল কনফারেন্সসহ ১৯ দলীয় নেতারা ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হন।
বৈঠকে উল্লেখযোগ্য দলের মধ্যে সমাজবাদী দল অনুপস্থিত থাকলেও কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিআই (এম), সিপিআইসহ ১৯টি অসাম্প্রদায়িক দল উপস্থিত হয়ে বিজেপিবিরোধী জোট গঠনে সম্মত হয়ে একটি যুক্ত বিবৃতিও প্রকাশ করে। অংশগ্রহণকারী দলগুলোর শীর্ষ নেতারাই বৈঠকে হাজির হন। তারা যৌথভাবে ভারতের জনজীবনের দৈনন্দিন সমস্যাবলী নিয়ে আগামী ২০-৩০ সেপ্টেম্বর ভারতজুড়ে আন্দোলনের নানা কর্মসূচিও ঘোষণা করেন।
এ ধরনের বিরোধীদলীয় জোট ভারতের রাজনীতির ও ভারতের জনগণের স্বার্থে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে; কারণ ভারতে প্রবল শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে বিগত ৭-৮ বছর যাবত নরেন্দ মোদির নেতৃত্বে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ। এই জোট ক্ষমতায় আসীন হয়ে ভারতের ঐতিহ্যবাহী ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি নানাভাবে ক্ষুণœ করে। ভারতের জনগণের অভিযোগ- এনডিএ জোট ক্ষমতায় এসে ভারতের মুসলিম নাগরিকদের নাগরিকত্ব হরণের লক্ষ্যে আইন জারি করা, গোমাংস ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ করা, গো-হত্যা নিষিদ্ধ করা, ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভারতের ধর্মীয় সংখ্যালঘু নাগরিকদের ধর্মান্তরিতকরণ প্রভৃতি ঘোর সাম্প্রদায়িক কাজে লিপ্ত হয়। এর দ্বারা ওই সরকার শুধু সাম্প্রদায়িকতার প্রসার ঘটিয়েছে শুধু তাই নয়, তারা ভারতের সংবিধানের মূলনীতি লঙ্ঘন করেছে, আইনের শাসন ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের গণতান্ত্রিক অধিকারও হরণ করেছে। তদুপরি তারা কৃষকের স্বার্থবিরোধী আইন প্রণয়ন করায় ভারতের হাজার হাজার কৃষক সমাজ মাসের পর মাসব্যাপী ভারতের নানা অঞ্চল থেকে লাঙ্গল-জোয়াল ও নানাবিধ আধুনিক কৃষি উপকরণ নিয়ে দিল্লিতে সমবেত হয়ে উন্মুক্ত ময়দানে মাসের পর মাস ধরে আহার-নিদ্রা ত্যাগ করে অবস্থান ধর্মঘটের মাধ্যমে ভারতের কৃষক আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেন। তাদের স্বার্থবিরোধী যে আইন রচিত হয়েছিল, এত আন্দোলনের পরও তাদের সেই দাবি পূরণ হয়নি- সেই আইন বাতিল হয়নি। সরকারের এমন কঠোর মনোভাব নিঃসন্দেহে কৃষক স্বার্থবিরোধী এবং ভারতের কৃষি খাতকে সংকটাপন্ন করে তুলবে- এমন আশঙ্কাও আছে। বিজেপি সরকার বছর দুয়েক আগে কাশ্মীরের জন্য সাংবিধানিকভাবে দীর্ঘকাল যাবত একটি রাজ্য হিসেবে বিশেষ মর্যাদা ভোগ করছিল দীর্ঘকাল যাবত। তা বাতিল করে ওই রাজ্যে ব্যাপক ধরপাকড়, ইন্টারনেট ও টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করাসহ কাশ্মীরবাসীর ওপর যে ভয়াবহ নির্যাতন চালিয়েছিল তার ফলে কাশ্মীরেও তারা জনপ্রিয়তা হারিয়েছে।
বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের নেতা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একের পর এক সেই দেশের সরকারি মালিকানাধীন শিল্প-কারখানা, ব্যাংক, বীমা প্রভৃতিকে ব্যক্তি খাতে দিয়ে কর্মরত লাখ লাখ শ্রমিক-কর্মচারীর জীবন সংকটাপন্ন করে তুলেছে। অপরপক্ষে এর ফলে উৎপাদনহানি এবং রপ্তানি পণ্যের ঘাটতি দেখা দেওয়ার আশঙ্কাও বিদ্যমান।
অপরদিকে ক্রমাগত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি মধ্যবিত্ত ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। এক কথায়, গুটিকতক কোটিপতি-লাখোপতি ছাড়া বাদবাকি কোটি কোটি ভারতবাসীর জীবন এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন। বিজেপির জনপ্রিয়তাও ধস নেমেছে বলে সেই দেশের পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে জানা যায়। যদিও তা অনেকেই বিশ^াস করতে চান না।
একদিকে বিশাল ভারতের এই চিত্র; অপরদিকে যদি ভারতের লোকসভা এবং বিধানসভাগুলোর নির্বাচনী ফলাফলের দিকে চোখ মেলানো যায়, তবে এর বিপরীত চিত্রই ফুটে ওঠে। মাস কয়েক আগে অনুষ্ঠিত পশ্চিম বাংলার রাজ্য বিধানসভায় তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপিবিরোধী ব্যাপক প্রচারাভিযান চালিয়ে মমতা ব্যানার্জী নিজ দলের অনুকূলে বিপুল বিজয় ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। সেখানে দুটি পুরাতন রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট মিলিতভাবে নির্বাচনে অংশ নিলেও একটি আসনেও জিততে পারেনি। কিন্তু বিজেপি জিতেছে ৭৭টি আসনে; যা কল্পনাতীত। পশ্চিম বাংলার মাটিতে বিজেপি অতীতে শিকড় গাড়তে পারেনি এবং কখনও পারবে না বলে যে বিশ্বাস বেশির ভাগ মানুষ পোষণ করতেন- তাও যেন মিথ্যা প্রমাণিত হলো।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, বিজেপি সরকার সবক্ষেত্রে গণবিরোধী কাজ করেও এবং কথিত মতে তাদের জনপ্রিয়াতায় ধস নামা সত্ত্বেও দলটি এত বেশি আসনে পশ্চিম বাংলায় কী করে জিততে পারলো। যে পশ্চিম বাংলায় বিগত নির্বাচনে মাত্র দুটি আসনে বিজয়ী হয়েছিল এবং তার আগের নির্বাচনগুলোতে বিজেপির ঝুলিতে পশ্চিমবাংলা থেকে একটি আসনও জোটেনি- সেই পশ্চিম বাংলায় এবারের নির্বাচনে তারা ৭৭টি আসনে বিজয়ী হয়ে আগামী ২০২৪ সালের লোকসভা নিবাচনের ক্ষেত্রেও বিজেপি একটা রীতিমতো হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার যে পশ্চিম বাংলার বিধানসভা নির্বাচনে অতীতে বারংবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনসমূহে বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট সর্বাধিক আসনে বিজয়ী হয়ে ৩৪ বছরের মতো একটানা ক্ষমতায় ছিল, সেই বামফ্রন্ট বিগত নির্বাচনে আদৌ কোন আসন না পাওয়াও কম আশ্চর্য্যরে বিষয় নয়। কংগ্রেস আজ প্রায় ৪০ বছর যাবত পশ্চিম বাংলায় মারাত্মকভাবে দুর্বল বটে! কিন্তু তারা বিধানসভায় একটি আসনও পাবে না- এটাও স্বাভাবিক বলে ভাবা যায় না।
উত্তর প্রদেশ ত্রিপুরাসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভায় বিজেপির এখন একচ্ছত্র আধিপত্য। এছাড়াও কয়েকটি রাজ্যে বিজেপি জোট সরকার পরিচালনা করছে গুজরাটসহ। তবে পশ্চিমবাংলা, ত্রিপুরা বাদে বাকি রাজ্যগুলোতে ক্রমান্বয়ে বিজেপির আসন সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে।
বিজেপিবিরোধী দলগুলোর চরম সংকটকালেও ভারতের সব ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল এ যাবত কার্যকর কোন ঐক্য গড়ে তুলতে পারেনি। একদিকে বিজেপির জনপ্রিয়াতায় ধস, অপরদিকে ১৯ দলীয় জোটের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা ও জোট গঠন অনেকটা আশাবাদ গড়ে তুলেছে; যদিও তা নেহায়েতই প্রাথমিক পর্যায়ে। এক ঐক্য সুসংহত কতটা হতে পারবে তা নিয়েও সংশয় থেকে যাচ্ছে। বিশেষ করে মমতা ব্যানার্জীর নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের মধ্যকার তিক্ত সম্পর্ক এবং পরস্পর মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ থাকা ঐক্য সংহত হওয়ার পথে এক মস্ত বাধা। এই দুই দলের নেতৃত্ব যদি কর্মসূচির ভিত্তিতে অন্তত একটি ওয়ার্কিং ইউনিটিও গড়ে তুলতে পারেন তবে উভয় দলই ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ভরাডুবি নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে এবং সর্বভারতীয় রাজনীতির অঙ্গনে নিজেদের গুরুত্ব যথেষ্ট বৃদ্ধি করতে সক্ষম হবে- এরকম সম্ভাবনা বাস্তবেই বেশ প্রবল।
তবে পশ্চিম বাংলা, ত্রিপুরা, কেরালা ভারতের অত্যন্ত ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। নিখিল ভারত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলোর ঐক্য কাশ্মীরেও প্রসারিত করে এবং দেশজোড়া ও ক্ষেত্রবিশেষে রাজ্যভিত্তিতে গণআন্দোলন আগামী দুই আড়াই বছর চালিয়ে যদি নিজেদের গণভিত্তি প্রসারিত করে তুলতে পারে- তবে আগামী ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের মাধ্যমে হয়তো ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি দিল্লিতে ক্ষমতায় ফিরে আসতে সক্ষম হবে। তেমন আশাবাদ অনেকেই পোষণ করেন।
[লেখক : সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ]
raneshmaitra@gmail.com