alt

উপ-সম্পাদকীয়

কারিকুলাম প্রণয়নের চেয়ে বাস্তবায়নই বেশি গুরুত্বপূর্ণ

মাছুম বিল্লাহ

: বৃহস্পতিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১
image

শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও বাস্তবায়ন সাধারণত ১০-১২ বছরের ব্যবধানে করা হয়। বাংলাদেশে কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন (১৯৭২-৭৪) রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রথমবার শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়নের (১৯৭৬-৮০) পর তা দুবার (১৯৯১-৯৫ ও ২০১২) পরিমার্জন করা হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় অবর্তনের শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও বাস্তবায়নের মধ্যে ১৫-১৬ বছরের ব্যবধান ছিল। কিন্তু তৃতীয় আবর্তনের (২০১১-১৩) মাত্র আট বছর পর চতুর্থবারের মতো শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের কাজ শুরু হয়েছে। এর দুটি প্রধান উদ্দেশ্য- ১. জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (২০১৬-২০৩০) বিধৃত শিক্ষার লক্ষ্যগুলো (এসডিজি-৪) অর্জনের চেষ্টা এবং ২. বিশ^ব্যাপী স্কুলশিক্ষাকে যোগ্যতাভিত্তিক করার ঢেউকে ধারণ করা। নতুন কারিকুলাম প্রণয়নে ২০১৭ সালে কাজ শুরু করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। তখন দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিয়ে দুটি কমিটি গঠন করা হয়। এরপর আবার দশজন শিক্ষাবিদ নিয়ে ‘কারিকুলাম ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিভিশন কোর কমিটি’ গঠন করা হয়। গত বছরের শেষদিকে তারা ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা : প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণী’ নামে ১১৪ পৃষ্ঠার রূপরেখা জমা দেয়। এই রূপরেখার ওপর বিশিষ্টজন, শিক্ষাবিদদের মতামত নেয় এনসিটিবি। এরপর তা ন্যাশনাল কারিকুলাম কো-অর্ডিনেশন কমিটির কাছে পাঠানো হয়। ধাপে ধাপে এসব যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতি অবলম্বন করায় এনসিটিবি ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।

আগামী ২০২৩ সাল থেকে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন শুরু হবে। এ বছর থেকে প্রাথমিক পর্যায়ের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা ও মাধ্যমিক পর্যায়ের ৬ষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নতুন কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত হবে। নতুন কারিকুলামে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের ১০০ ভাগ মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন মূল্যায়ন। সে হিসেবে ২০২৩ সাল থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে কোন পরীক্ষা হবে না। এটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। শিক্ষার্থীদের জন্য আনন্দঘন শিক্ষা নিশ্চিত করতে এ শিক্ষাক্রম তৈরি করা হয়েছে। এ শিক্ষাক্রম পাইলটিং হবে ২০২৩ সাল থেকে। প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হবে। ২০২৪ সালের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণী এবং অষ্টম ও নবম শ্রেণী এ শিক্ষাক্রমের আওতায় আসবে। এ শিক্ষাক্রমের আওতায় ২০২৫ সালের মধ্যে সব মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীদেরে নিয়ে আসা হবে এবং ২০২৬ সালে একাদশ ও ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণী যুক্ত হবে। এটিও যুক্তিসঙ্গত। এর আগে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের জন্য পৃথক সময়ে কারিকুলাম পরিবর্তন হওয়ার কারণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের কারিকুলামে কোন সমন্বয় থাকত না। এবারই একসঙ্গে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের কারিকুলাম পরিমার্জন করা হচেছ। এতে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমবে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা শিখন নিশ্চিত করা হচ্ছে। নতুন এ শিক্ষাক্রম পরীক্ষামূলকভাবে ১০০টি প্রাথমিক ও ১০০টি মাধ্যমিক স্কুলে আগামী বছর থেকে শুরু হবে। কোন কিছু শুরুর আগে পাইলটিং করা প্রয়োজন, কাজেই এটি ভালো সিদ্ধান্ত।

শুধু সনদের জন্য নয়, পারদর্শিতা অর্জনের জন্য শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণ করবে। পরীক্ষার বিষয় ও পাঠ্যপুস্তকের চাপ কমানোর চেষ্টা করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা যাতে নিজেদের মতো কিছুটা সময় কাটাতে পারে তা নিশ্চিত করতেই নতুন কারিকুলাম। এজন্য প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন করা হয়েছে। নতুন কারিকুলামে এসএসসি পরীক্ষা হবে শুধুমাত্র দশম শ্রেণীর পাঠ্যসূচি অনুসারে। আর উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের বিভাগ বিভাজন করা হবে। আগের মতো মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের বিভাজন থাকছে না। মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষার্থীকেই নির্ধারিত দশটি বিষয় পড়তে হবে। বিষয়গুলো হচ্ছে- বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, সামাজিক বিজ্ঞান, জীবন ও জীবিকা, ধর্ম ও স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। বর্তমানে এসব শ্রেণীতে ১২ থেকে ১৪টি বই পড়ানো হয়। ষষ্ঠ শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের কারিকুলামে একটি কারিগরি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। এ ছাড়াও শিক্ষার্থীদের নানা দক্ষতা অর্জনের সুযোগ থাকছে। নতুন কারিকুলামে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতার ইতিহাস অন্তুর্ভুক্ত থাকবে। এছাড়া নুতন সিলেবাসে করোনা অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। মুখস্তনির্ভর শিক্ষা পদ্ধতি থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে অভিজ্ঞতানির্ভর শিক্ষার দিকে জোর দেওয়া হচ্ছে।

প্রাথমিক ও অষ্টম শ্রেণী শেষে শিক্ষার্থীদের সনদ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে পারে শুধুমাত্র তাদের উদ্ধুদ্ধ করার জন্য, তবে পাবলিক পরীক্ষা থাকবে না।

শিক্ষামন্ত্রী এ বিষয়ে জানান, পাবলিক পরীক্ষা নিয়েই যে সনদ দিতে হবে এটা কোন কথা না বিদেশে প্রাথমিক পর্যায় শেষ করার পরেও বাচ্চাদের গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠান হয়। সনদ নিয়ে যদি শিক্ষার্থী উদ্বুদ্ধ বোধ করে সেজন্যই সনদটা। সনদের জন্য শিক্ষা নয়, শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতেই শিক্ষা। তারা যা পারদর্শিতা অর্জন করেছে তার স্বীকৃতিই সনদ। পাবলিক পরীক্ষা হবে দশম, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে। সমাপনী পরীক্ষা হবে প্রতি ক্লাসেই অর্থাৎ বছর শেষে একটি মূল্যায়ন হবে। দশম শ্রেণির আগে কোন পাবলিক পরীক্ষা হবে না এবং দশম শ্রেণীর পাবলিক পরীক্ষা হবে শুধুমাত্র দশম শ্রেণির সিলেবাসে। চমৎকার সিদ্ধান্ত।

শিক্ষাক্রমের খসড়া রূপরেখাকে খুবই ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হলে শিক্ষা হবে আনন্দময়, শিক্ষার্থীদের মধ্যে থাকবে না পরীক্ষাভীতি। যেখানে প্রাক-প্রাথমিক থেকে ধাপে ধাপে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পৌঁছানোর একটি রূপরেখা দেওয়া হয়েছে। এর ফলে কোচিং ও গাইড বাণিজ্য বন্ধ হবে, মুখস্তনির্ভর শিক্ষার পরিবর্তে প্রায়োগিক শিক্ষা গুরুত্ব পাবে। শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষার্থী হয়ে গড়ে উঠবে। এ উদ্যোগকে বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন জরুরি। এজন্য সবার শুরুতে মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। বাড়াতে হবে শিক্ষকদের বেতন। পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, ক্ষমতায়ন ও অর্থায়নে মনোযোগী হতে হবে। শিক্ষকের ক্ষমতায়নে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।

বর্তমানে প্রচলিত সৃজনশীল পদ্ধতি থাকছে না, এর পরিবর্তে অভিজ্ঞতা বা দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা যুক্ত করা হবে। সর্বোচ্চ জিপিএ পয়েন্ট ৫-এর পরিবর্তে চার হচ্ছে। গত দশ-এগারো বছরে সৃজনশীল পদ্ধতি বাস্তবায়নের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ করে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও আজ পর্যন্ত ওই পদ্ধতি আয়ত্তে আনতে পারেননি অনেক শিক্ষক। এর ফলে সৃজনশীল পদ্ধতি নোট-গাইডনির্ভর হয়ে পড়েছিল। তাই বলা হচ্ছে যে, শিক্ষকদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া না হলে এই নতুন পদ্ধতিও কতটা কাজে লাগবে সেটি প্রশ্নের মুখোমুখি। পাঠদান শ্রেণীকক্ষেই শেষ করতে হবে। হোমওয়ার্ক কম দিতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা নিজেরা সময় কাটাতে পারে, খেলাধুলা করতে পারে। তৃতীয় লিঙ্গের শিশু ও বিশেষ চাহিদসম্পন্ন শিশুদের স্কুলে ভর্তি করতে হবে। তারা যেখানে ভর্তি হতে চায় সেখানেই ভর্তি করতে হবে বলে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেন। ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রীকে। তবে সব বিষয় যাতে বাস্তবায়ন হয় সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। কারণ খাবারের রেসিপি কাগজে লেখা যায় অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে কিন্তু খাবার তৈরি করে সেটিকে উপাদেয় করা আসলেই কঠিন কাজ। সেই কঠিন কাজটির কোন উল্লেখ এখানে নেই। শিক্ষার হাজারও সীমাবদ্ধতা ও বৈষম্যের মাঝে বাস্তবায়নের কোন প্রেসক্রিপশন না থাকলে নতুন কারিকুলাম কতটা বাস্তবায়ন হবে- সেই সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।

[লেখক : ব্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত]

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

tab

উপ-সম্পাদকীয়

কারিকুলাম প্রণয়নের চেয়ে বাস্তবায়নই বেশি গুরুত্বপূর্ণ

মাছুম বিল্লাহ

image

বৃহস্পতিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১

শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও বাস্তবায়ন সাধারণত ১০-১২ বছরের ব্যবধানে করা হয়। বাংলাদেশে কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন (১৯৭২-৭৪) রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রথমবার শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়নের (১৯৭৬-৮০) পর তা দুবার (১৯৯১-৯৫ ও ২০১২) পরিমার্জন করা হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় অবর্তনের শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও বাস্তবায়নের মধ্যে ১৫-১৬ বছরের ব্যবধান ছিল। কিন্তু তৃতীয় আবর্তনের (২০১১-১৩) মাত্র আট বছর পর চতুর্থবারের মতো শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের কাজ শুরু হয়েছে। এর দুটি প্রধান উদ্দেশ্য- ১. জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (২০১৬-২০৩০) বিধৃত শিক্ষার লক্ষ্যগুলো (এসডিজি-৪) অর্জনের চেষ্টা এবং ২. বিশ^ব্যাপী স্কুলশিক্ষাকে যোগ্যতাভিত্তিক করার ঢেউকে ধারণ করা। নতুন কারিকুলাম প্রণয়নে ২০১৭ সালে কাজ শুরু করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। তখন দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিয়ে দুটি কমিটি গঠন করা হয়। এরপর আবার দশজন শিক্ষাবিদ নিয়ে ‘কারিকুলাম ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিভিশন কোর কমিটি’ গঠন করা হয়। গত বছরের শেষদিকে তারা ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা : প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণী’ নামে ১১৪ পৃষ্ঠার রূপরেখা জমা দেয়। এই রূপরেখার ওপর বিশিষ্টজন, শিক্ষাবিদদের মতামত নেয় এনসিটিবি। এরপর তা ন্যাশনাল কারিকুলাম কো-অর্ডিনেশন কমিটির কাছে পাঠানো হয়। ধাপে ধাপে এসব যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতি অবলম্বন করায় এনসিটিবি ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।

আগামী ২০২৩ সাল থেকে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন শুরু হবে। এ বছর থেকে প্রাথমিক পর্যায়ের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা ও মাধ্যমিক পর্যায়ের ৬ষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নতুন কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত হবে। নতুন কারিকুলামে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের ১০০ ভাগ মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন মূল্যায়ন। সে হিসেবে ২০২৩ সাল থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে কোন পরীক্ষা হবে না। এটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। শিক্ষার্থীদের জন্য আনন্দঘন শিক্ষা নিশ্চিত করতে এ শিক্ষাক্রম তৈরি করা হয়েছে। এ শিক্ষাক্রম পাইলটিং হবে ২০২৩ সাল থেকে। প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হবে। ২০২৪ সালের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণী এবং অষ্টম ও নবম শ্রেণী এ শিক্ষাক্রমের আওতায় আসবে। এ শিক্ষাক্রমের আওতায় ২০২৫ সালের মধ্যে সব মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীদেরে নিয়ে আসা হবে এবং ২০২৬ সালে একাদশ ও ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণী যুক্ত হবে। এটিও যুক্তিসঙ্গত। এর আগে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের জন্য পৃথক সময়ে কারিকুলাম পরিবর্তন হওয়ার কারণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের কারিকুলামে কোন সমন্বয় থাকত না। এবারই একসঙ্গে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের কারিকুলাম পরিমার্জন করা হচেছ। এতে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমবে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা শিখন নিশ্চিত করা হচ্ছে। নতুন এ শিক্ষাক্রম পরীক্ষামূলকভাবে ১০০টি প্রাথমিক ও ১০০টি মাধ্যমিক স্কুলে আগামী বছর থেকে শুরু হবে। কোন কিছু শুরুর আগে পাইলটিং করা প্রয়োজন, কাজেই এটি ভালো সিদ্ধান্ত।

শুধু সনদের জন্য নয়, পারদর্শিতা অর্জনের জন্য শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণ করবে। পরীক্ষার বিষয় ও পাঠ্যপুস্তকের চাপ কমানোর চেষ্টা করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা যাতে নিজেদের মতো কিছুটা সময় কাটাতে পারে তা নিশ্চিত করতেই নতুন কারিকুলাম। এজন্য প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন করা হয়েছে। নতুন কারিকুলামে এসএসসি পরীক্ষা হবে শুধুমাত্র দশম শ্রেণীর পাঠ্যসূচি অনুসারে। আর উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের বিভাগ বিভাজন করা হবে। আগের মতো মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের বিভাজন থাকছে না। মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষার্থীকেই নির্ধারিত দশটি বিষয় পড়তে হবে। বিষয়গুলো হচ্ছে- বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, সামাজিক বিজ্ঞান, জীবন ও জীবিকা, ধর্ম ও স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। বর্তমানে এসব শ্রেণীতে ১২ থেকে ১৪টি বই পড়ানো হয়। ষষ্ঠ শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের কারিকুলামে একটি কারিগরি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। এ ছাড়াও শিক্ষার্থীদের নানা দক্ষতা অর্জনের সুযোগ থাকছে। নতুন কারিকুলামে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতার ইতিহাস অন্তুর্ভুক্ত থাকবে। এছাড়া নুতন সিলেবাসে করোনা অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। মুখস্তনির্ভর শিক্ষা পদ্ধতি থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে অভিজ্ঞতানির্ভর শিক্ষার দিকে জোর দেওয়া হচ্ছে।

প্রাথমিক ও অষ্টম শ্রেণী শেষে শিক্ষার্থীদের সনদ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে পারে শুধুমাত্র তাদের উদ্ধুদ্ধ করার জন্য, তবে পাবলিক পরীক্ষা থাকবে না।

শিক্ষামন্ত্রী এ বিষয়ে জানান, পাবলিক পরীক্ষা নিয়েই যে সনদ দিতে হবে এটা কোন কথা না বিদেশে প্রাথমিক পর্যায় শেষ করার পরেও বাচ্চাদের গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠান হয়। সনদ নিয়ে যদি শিক্ষার্থী উদ্বুদ্ধ বোধ করে সেজন্যই সনদটা। সনদের জন্য শিক্ষা নয়, শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতেই শিক্ষা। তারা যা পারদর্শিতা অর্জন করেছে তার স্বীকৃতিই সনদ। পাবলিক পরীক্ষা হবে দশম, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে। সমাপনী পরীক্ষা হবে প্রতি ক্লাসেই অর্থাৎ বছর শেষে একটি মূল্যায়ন হবে। দশম শ্রেণির আগে কোন পাবলিক পরীক্ষা হবে না এবং দশম শ্রেণীর পাবলিক পরীক্ষা হবে শুধুমাত্র দশম শ্রেণির সিলেবাসে। চমৎকার সিদ্ধান্ত।

শিক্ষাক্রমের খসড়া রূপরেখাকে খুবই ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হলে শিক্ষা হবে আনন্দময়, শিক্ষার্থীদের মধ্যে থাকবে না পরীক্ষাভীতি। যেখানে প্রাক-প্রাথমিক থেকে ধাপে ধাপে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পৌঁছানোর একটি রূপরেখা দেওয়া হয়েছে। এর ফলে কোচিং ও গাইড বাণিজ্য বন্ধ হবে, মুখস্তনির্ভর শিক্ষার পরিবর্তে প্রায়োগিক শিক্ষা গুরুত্ব পাবে। শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষার্থী হয়ে গড়ে উঠবে। এ উদ্যোগকে বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন জরুরি। এজন্য সবার শুরুতে মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। বাড়াতে হবে শিক্ষকদের বেতন। পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, ক্ষমতায়ন ও অর্থায়নে মনোযোগী হতে হবে। শিক্ষকের ক্ষমতায়নে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।

বর্তমানে প্রচলিত সৃজনশীল পদ্ধতি থাকছে না, এর পরিবর্তে অভিজ্ঞতা বা দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা যুক্ত করা হবে। সর্বোচ্চ জিপিএ পয়েন্ট ৫-এর পরিবর্তে চার হচ্ছে। গত দশ-এগারো বছরে সৃজনশীল পদ্ধতি বাস্তবায়নের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ করে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও আজ পর্যন্ত ওই পদ্ধতি আয়ত্তে আনতে পারেননি অনেক শিক্ষক। এর ফলে সৃজনশীল পদ্ধতি নোট-গাইডনির্ভর হয়ে পড়েছিল। তাই বলা হচ্ছে যে, শিক্ষকদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া না হলে এই নতুন পদ্ধতিও কতটা কাজে লাগবে সেটি প্রশ্নের মুখোমুখি। পাঠদান শ্রেণীকক্ষেই শেষ করতে হবে। হোমওয়ার্ক কম দিতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা নিজেরা সময় কাটাতে পারে, খেলাধুলা করতে পারে। তৃতীয় লিঙ্গের শিশু ও বিশেষ চাহিদসম্পন্ন শিশুদের স্কুলে ভর্তি করতে হবে। তারা যেখানে ভর্তি হতে চায় সেখানেই ভর্তি করতে হবে বলে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেন। ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রীকে। তবে সব বিষয় যাতে বাস্তবায়ন হয় সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। কারণ খাবারের রেসিপি কাগজে লেখা যায় অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে কিন্তু খাবার তৈরি করে সেটিকে উপাদেয় করা আসলেই কঠিন কাজ। সেই কঠিন কাজটির কোন উল্লেখ এখানে নেই। শিক্ষার হাজারও সীমাবদ্ধতা ও বৈষম্যের মাঝে বাস্তবায়নের কোন প্রেসক্রিপশন না থাকলে নতুন কারিকুলাম কতটা বাস্তবায়ন হবে- সেই সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।

[লেখক : ব্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত]

back to top