alt

উপ-সম্পাদকীয়

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থিদের নেতৃত্বে কারা আসছেন

গৌতম রায়

: শুক্রবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১

পশ্চিমবঙ্গের সব থেকে বড় বামপন্থি দল সিপিআইয়ের (এম) সম্মেলন প্রক্রিয়া চলছে। ভূমিস্তর থেকে সর্বোচ্চ স্থর পর্যন্ত সম্মেলন হবে। সেই সম্মেলনের ভেতর দিয়েই প্রতিটি স্তরে দল পরিচালনার জন্য নির্বাচিত হবেন নেতৃত্ব। পশ্চিমবঙ্গের প্রাদেশিক নেতৃত্ব ও যেমন এই সম্মেলন প্রক্রিয়া ভেতর দিয়ে উঠে আসবে, তেমনিই উঠে আসবে দলের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব।

একটা অত্যন্ত সংকটময় সময়ের ভেতর দিয়ে যখন ভারতের রাজনীতি চলেছে, সেই সংকটের একটি অংশ হিসেবে আইনসভার ভেতরে এবং বাইরে বামপন্থিদের নেতৃত্বের বিষয়টি ও প্রচন্ড দুর্বিপাকের ভেতর দিয়ে চলেছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতে বামপন্থিদের বৃহৎত্তম অংশটির হাল কে বা কারা ধরবেন, তা ঘিরে শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতেই নয়, প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের মানুষদের ভেতরেও যথেষ্ট আগ্রহ তৈরি হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গে এমন একজন মানুষের এই নেতৃত্বের ক্ষেত্রে উঠে আসা দরকার যার নিজের দলের ভেতরে তো বটেই, শত্রু শিবিরের ভেতরেও চিড়বিড়ে গাত্রদাহ তৈরির ক্ষমতা আছে। তবেই সেই নেতা একটা যথার্থ টিম তৈরি করে টিম ওয়ার্ক করে সাফল্যের মুখ দেখবেন। কি ধরনের সাফল্য? ভোটে জেতা? পঞ্চায়েত থেকে সংসদে আরও বেশি বেশি করে সদস্য পাঠানোর ক্ষেত্রে সফল হওয়া? মন্ত্রী হওয়া? নানা সরকারি সুযোগ-সুবিধা নেয়া? পুলিশের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা?

না কি মতাদর্শের দৃঢ় ভিত্তিতে সহযোদ্ধাদের সংবদ্ধ করবার শিক্ষা দেয়া নেতা দরকার? যিনি, ‘ভেঙে পড়া গ্রামে প্রাণের দুর্গ ফিরে বানাও’- জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের এই স্লোগানকে যথার্থ অর্থে বাস্তবায়িত করতে পারেন ... এমন নেতা? ফ্যাকশন রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে ‘কমরেড’ হিসেবে যথার্থ একজন বন্ধুই শুধু নয়, কমরেডদের আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠতে পারেন এমন নেতা? কথায় কথায় মার্কস, লেনিন, স্টালিন আওড়ানো নেতাই পারবেন দল কে এই দুরবস্থা থেকে টেনে তুলতে, না কি বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে শহিদ মইদুলের সন্তানেরা নিয়মিত পড়াশোনার খরচ পাচ্ছে কি না-তা জানার জন্য নীরবে, নিভৃতে সজাগ আছেন এমন মানুষই পারবেন, দলকে রাজনীতির সঠিক পথে, সব ধরনের দোদুল্যমানতা কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পথ বাৎলে দিতে।

বামপন্থিরা সব সময়েই বলেন; নেতা নয়, নীতি। তাত্ত্বিক ভাবে এই শব্দচয়ণের সঙ্গে দ্বিমত হওয়ার কোন প্রশ্ন নেই। কিন্তু প্রয়োগ জনিত রাজনীতিতে ‘মুখে’র প্রয়োজন নেই, এই কথাটা বলার অর্থ কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতিকে এড়িয়ে যাওয়া। জ্যোতি বসু তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে সাংগঠনিক দিক সামলালেও সংসদীয় ক্ষেত্রেই বেশি সময় দিয়েছিলেন। তাই ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের জীবদ্দশাতেই তার বিকল্প হিসেবে মানুষের মনে স্থান করে নিতে শুরু করেছিলেন জ্যোতিবাবু। ‘মুখ’ হিসেবে জ্যোতিবাবুর ধীরে ধীরে যে জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছিল, তা পরবর্তী সময়ে বামদের সংসদীয় রাজনীতিতে অনেকটাই সুবিধা দিয়েছিল।

কেরালা বা ত্রিপুরার ক্ষেত্রে ও সেই একই কথা বলতে হয়। কেরালাতে ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদ বা তার পরে ভিএস অচ্যুতানন্দন, পিনরাই বিজয়নেরা ‘মুখ’ হয়ে ওঠায় সংসদীয় রাজনীতিতে পরবর্তী সময়ে একটা মাইলেজ পেয়েছে বামেরা। ত্রিপুরাতে নৃপেন চক্রবর্তী, দশরথ দেব, মানিক সরকারের ক্ষেত্রেও এই একই কথা প্রযোজ্য। আজ ত্রিপুরাতে বিরোধী দলনেতা হিসেবে মানিক সরকার যে লড়াইটা দিচ্ছেন, তা অবশ্যই আগামী বছর সেই রাজ্যে যে বিধানসভার ভোট হচ্ছে, সেই ভোট যদি পরিচ্ছন্ন হয়, তার সুফল অবশ্যই বামেরা ঘরে তুলবে। মানিক সরকার ত্রিপুরাতে বছর পাঁচেক আগে পরাজয়ের পর একটি দিন ও ঘরে বসে থাকেননি। কোনরকম আত্মসমালোচনার দোহাই দিয়ে সদ্য জয়ী বিজেপির হাতে আক্রান্ত সহযোদ্ধাদের থেকে দূরে সরে থাকেননি। শাসক হিসেবে মানিকবাবুর সহজ সরল জীবনযাত্রা এবং সমস্ত রকমের আত্ম অহঙ্কার বর্জিত যাপনচিত্র তাকে এবং তার দলকে শুধু ত্রিপুরাতে নয়, গোটা দেশেই একটা ভিন্ন মাত্রার গ্রহণযোগ্যতা এনে দিয়ে দিয়েছে। জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য সস্তার রাজনীতি, তরল মানসিকতার প্রকাশ কিন্তু মানিকবাবুর ভেতরে আমরা একবার ও দেখিনি। আপাত গাম্ভীর্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বের ভেতর দিয়েই যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি মানিক সরকার তুলে ধরতে পেরেছেন, সেই বোধ এবং সংস্কারের ফসল আগামী বছরের গোড়ায় (২০২২) অনুষ্ঠিতব্য বিধানসভার ভোটে ত্রিপুরায় সিপিআই (এম) তুলবে- এটা সহজেই ধারণা করতে পারা যায়।

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থিরা ক্ষমতায় থাকাকালীন তাদের দলের কে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তা নিয়ে ভাবনাটা দলের ভেতরেই সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণ মানুষের তা নিয়ে খুব একটা ভাবনাচিন্তা ছিল না। আমজনতা ভাবতেন প্রশাসনে যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাকে ঘিরে। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বামেদের দলীয় স্তরে কে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সেই বিষয়টি ঘিরে আমজনতার ভেতর ভাবনা-চিন্তা আগের থেকে বেড়ে যায়।

সূর্যকান্ত মিশ্র যখন সিপিআই (এম) এর রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব নেন, তখন তিনি রাজ্যের বিরোধী দল নেতাও। সংসদীয় রাজনীতির ক্যারিশমা তখন ও তাকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। আর প্রচার মাধ্যমের সাম্প্রতিক যে প্রবণতা, আইনসভায় প্রতিনিধিত্বের নিরিখে সেই দলের নেতাকে প্রচারের আলোকে আলোকিত করা- সেই ধারাটির উলটপূরাণ আমরা দেখতে পাই ২০১৪ সালের লোকসভার ভোটে বামেদের আসন সংখ্যা কমে যাওয়ার সময়কাল থেকেই। প্রচার মাধ্যম এই সময় থেকেই যেভাবে পশ্চিমবঙ্গে শাসক তোষামুদে হয়ে উঠতে শুরু করে-তা পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের আসন্ন সংকটের একটা ভয়াবহ পূর্বাভাস বয়ে আনছিল। শাসক যেভাবে একাধারে বিজ্ঞাপন আর আইনিজুলুমের চোখ রাঙানি শুরু করে দেয়, তার প্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যমে বিরোধীদের খবরাখবরই কার্যত উধাও হয়ে যেতে শুরু করে।

সূর্যবাবু দলের দায়িত্ব নিয়ে একাধারে বিরোধী দলনেতা এবং দলের রাজ্য সম্পাদক হিসেবে একটা অত্যন্ত কঠিন সময়ে বজ্রকঠিন ব্যক্তিত্ব দিয়ে সবটা পরিচালনা করেছেন। এটা বাস্তব যে, কমিউনিস্ট পার্টিকে পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি সমষ্টিগত কর্মকান্ডের বিশেষ ভূমিকা থাকে। এই কাজে দলের রাজ্য সম্পাদকমন্ডলীর প্রবীণ ও নবীন নেতৃত্ব সূর্যবাবুকে সবদিকে সহযোগিতা করেছে বলেই তার পক্ষে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপির সাঁড়াশি আক্রমণের মোকাবিলা করেও দলকে পরিচালনা করা সম্ভবপর হয়েছে।

ভোট রাজনীতির ক্ষেত্রে সূর্যবাবুর নেতৃত্বাধীন দল তেমন একটা সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। এই ফল্যহীনতার পেছনে সূর্যবাবুর দল পরিচালনার নীতির ব্যর্থতা দেখাতে কেউ কেউ ব্যস্ত হলেও, ব্যর্থতার আসল কারণ তৃণমূল আর বিজেপির অর্থশক্তি এবং পেশী শক্তির সঙ্গে বামেদের বুঝতে না পারা। কিছু সাংগঠনিক ব্যর্থতা অবশ্যই বামদের আছে, কিন্তু সেই সাংগঠনিক ব্যর্থতাকে ছাপিয়ে উঠেছে বিজেপি আর তৃণমূল ... এই দুই দলের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের কুৎসিত রাজনীতি। ওই দুই দল সরকারে থাকার ফলে টাকার অবিশ্রান্ত স্রোতে গোটা ভোট প্রক্রিয়াটিকে পরিচালনা করবার প্রবণতা। এই অর্থশক্তির কাছে ভূমিস্তরের বামপন্থিদের একটা বড় অংশ যে নতজানু হয়নি ... তা বললে অসত্য কথা বলা হয়।

আর একটি বড় বিষয় হলো; বামরা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতিতে কীভাবে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে ... সেই শিক্ষার চর্চার তাদের ভেতরে সমানভাবে প্রসারিত হয়নি। একদা কংগ্রেস আমলে যারা নানাভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিলেন, প্রকৃতির নিয়মেই সেই প্রজন্ম এখন নেই। এই যে নতুন প্রজন্ম এখন বামপন্থিদের ভূমিস্তরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বা কর্মী-সমর্থক হিসেবে আছেন, তাদের সিংহভাগই রাজনৈতিক বাতাবরণের সংস্পর্শে এসেছেন ’৭৭ সালে বামরা ক্ষমতায় আসার পরের সময়কালে। ফলে এই প্রজন্ম শাসক তৃণমূল যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নামিয়ে আনছে, মামলা মোকদ্দমায় জীবন অতিষ্ঠ করে তুলছে- এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে আদৌ অভ্যস্থ নন। ফলে শাসকের গুন্ডারাজ, আর্থিক হাতছানি আর আইনি হেনস্তা ... এইগুলোর সঙ্গে শিরদাঁড়া সোজা রেখে লড়াইয়ের লোক একদম না থাকলেও, ভূমিস্তরে তা ক্রমশঃ কমে যাচ্ছে। ফলে ভোটের দিন বুথ আগলে লড়াইয়ের ক্ষেত্রটাও ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। এই সংকোচনের সুস্পষ্ট প্রতিক্রিয়া হলো, ভোট রাজনীতিতে বামদের বর্তমান দুরবস্থা।

এই অবস্থায় বয়সজনিত লক্ষণ রেখার কারনে সূর্যবাবু যখন আগামী সম্মেলনের পর আর সিপিআই (এম) এর নেতৃত্বে থাকবেন না- এটা প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে, তখন তার উত্তরসূরি কে হবেন- সেই প্রশ্নটাই যথার্থভাবে সামনে চলে আসছে। সূর্যবাবুর উত্তরাধিকারী হিসেবে তার দলকে এমন একজন নেতাকে বেছে নিতে হবে যার একই সঙ্গে দলের গন্ডি অতিক্রম করে সাধারণ সহানুভূতিশীল মানুষদের কাছে ও একটা বড় রকমের গ্রহণযোগ্যতা থাকবে। এখন বামপন্থি দলের নেতৃত্বে এমন একজন মানুষকেই বেছে নিতে হবে যার একই সঙ্গে সাংগঠনিক দক্ষতা এবং জননেতার ক্যারিশমা আছে।

এতকাল যে রাজনৈতিক গতিপ্রবাহ চলেছে, তাতে বামপন্থি দলের সাংগঠনিক নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে সাংগঠনিক দক্ষতার বিষয়টিই ছিল সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। সাংগঠিক নেতার জননেতার ক্যারিশমা আছে কি না-সেটা কখনও বিবেচ্য হয়ে ওঠেনি। কারণ, জননেতা হিসেবে জ্যোতি বসু, বিনয় চৌধুরী, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রমুখদের গ্রহণযোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত। তাই প্রমোদ দাশগুপ্তের জীবনাবসানের পর সরোজ মুখোপাধ্যায়, বা তার পরে শৈলেন দাশগুপ্ত, অনিল বিশ্বাস, বিমান বসু দের সাধারণের কাছে জনপ্রিয়তার বিষয়টি দল ক্ষমতায় থাকার কারণে সেভাবে উঠে আসেনি।

বামপন্থি দলের সাংগঠনিক নেতার দলের পরিমন্ডলের বাইরেও সাধারণের ভেতরে গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নটি বড় করে উঠে আসে বামপন্থিরা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরেই। মিডিয়া সামলানো থেকে গণ-আন্দোলন, বামফ্রন্টের ঐক্যের প্রশ্ন থেকে ফ্রন্টের বাইরের বাম দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক, নির্বাচনী সংগ্রামের নিরিখে বাম পরিমন্ডলের বাইরে অসাম্প্রদায়িক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ... এসব রকমের প্রশ্নে সংগঠনের আবর্তের বাইরে বাম নেতৃত্বে একজন জননেতার প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়। এই প্রয়োজনের তাগিদে সূর্যবাবুর নেতৃত্ব অত্যন্ত সফল। ভোটে আসন তার নেতৃত্বে না আসার পেছনে নেতৃত্বজনিত কোন দুর্বলতাই কিন্তু কার্যকরী ছিল না। ছিল বহিঃশত্রুর নানা ধরনের কর্মকান্ড এবং নিজেদের ভূমিস্থরে সাংগঠনিক দুর্বলতা, সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ফাঁদে দলের একাংশের পা দেয়া, মুসলমান সমাজ সম্পর্কে একটা বড় অংশের ভেতরে সহানুভূতিহীনতা আর সেই সহানুভূতিহীনতা অনেকাংশেই ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শিবির এবং প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক শিবির কেই শক্তিশালী করেছে।

একটা অত্যন্ত সংকটময় সময়ের ভেতর দিয়ে যখন ভারতের রাজনীতি চলেছে, সেই সংকটের একটি অংশ হিসেবে আইনসভার ভেতরে এবং বাইরে বামপন্থিদের নেতৃত্বের বিষয়টি ও প্রচন্ড দুর্বিপাকের ভেতর দিয়ে চলেছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতে বামপন্থিদের বৃহৎত্তম অংশটির হাল কে বা কারা ধরবেন

একটা বড় রকমের সীমাবদ্ধতার ভেতরে সূর্যবাবুকে সবদিক সামলে চলতে হয়েছে। মানিক সরকার যেভাবে পরাজয়ের পর নিজে ব্যাটন ধরে ময়দানে থেকে লড়াই করেছেন, জোরদার অসুস্থ হওয়ার আগে পর্যন্ত কিন্তু সদ্য ক্ষমতাচ্যুত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তা করেননি। তাই ত্রিপুরাতে সাংগঠনিক লড়াই এবং সংসদীয় রাজনীতিতে লড়াইটা যে পর্যায়ের হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে লড়াইটা সেই পর্যায়ে হতে পারেনি। সূর্যবাবু যতই দক্ষতার সঙ্গে ব্যাটন ধরুন না কেন, যতদিন বুদ্ধবাবু সুস্থ ছিলেন, অতি সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের ভেতরে তার প্রায় রাজনৈতিক সন্ন্যাস ঘিরে প্রশ্ন উঠেছে। সংশয় দেখা দিয়েছে। নিজেদের আত্ম-অভিমানে ঘা লেগেছে। লড়াইয়ের প্রশ্নে ও যে একটা সংশয়ের বাতাবরণ তৈরি হয়নি, তা জোর গলায় বলা যায় না।

এসব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে এগিয়েছেন সূর্যবাবু। নতুন যিনি তার স্থলাভিষিক্ত হবেন, তার কাছে এসব পর্যায়ের সঙ্গেই যুক্ত হবে এবারের ভোটে আইএসএফকে সঙ্গী করার বিষয়টি। কারণ, আইএসএফ বামেদের ভেতরে সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে যে ছাকনির কাজ করেছিল, সেই ছাকনি গলে কেউ কেউ প্রকাশ্যে, কেউ গোপনে যে মুসলমানবিরোধী এবং বিদ্বেষী মানসিকতা নিয়ে চলেন বামপন্থি দলগুলোর ভেতরে, তা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। এসব ভোটকেন্দ্রিক বামপন্থিদের কাছে আদর্শের থেকে অনেক বেশি জরুরি হলো ভোটে জেতা। তাই চিরদিন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়ে ও কংগ্রেস ঘিরে তারা সহনশীল হলেও, মুসলমানদের আধিপত্য বিস্তারের সহায়ক বলেই আইএসএফকে ঘিরে তাদের মূল্যায়ন। আর একাংশের বামেদের এই মানসিকতার দরুণ আইএসএফও এখন ভিন্ন সুরে কথা বলতে শুরু করেছে। এই অবস্থায় বাম নেতৃত্বে যিনি অভিষিক্ত হবেন, তাকে এসব সমস্যাকেই একসঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে।

[লেখক: ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি

ঈদের অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ‘পোস্ট পার্টিশন সিনড্রম’

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

রম্যগদ্য : ‘প্রহরীর সাতশ কোটি টাকা...’

ছবি

অবন্তিকাদের আত্মহনন

শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা

অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান নয়

পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে

আত্মহত্যা রোধে নৈতিক শিক্ষা

আউশ ধান : পরিবেশ ও কৃষকবান্ধব ফসল

ছবি

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আতুড়ঘর

চেক ডিজঅনার মামলার অধিক্ষেত্র ও প্রাসঙ্গিকতা

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের কৃষি

ছবি

‘হৃৎ কলমের’ পাখি এবং আমাদের জেগে ওঠা

ছবি

ভূগর্ভস্থ পানি সুরক্ষায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থিদের নেতৃত্বে কারা আসছেন

গৌতম রায়

শুক্রবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১

পশ্চিমবঙ্গের সব থেকে বড় বামপন্থি দল সিপিআইয়ের (এম) সম্মেলন প্রক্রিয়া চলছে। ভূমিস্তর থেকে সর্বোচ্চ স্থর পর্যন্ত সম্মেলন হবে। সেই সম্মেলনের ভেতর দিয়েই প্রতিটি স্তরে দল পরিচালনার জন্য নির্বাচিত হবেন নেতৃত্ব। পশ্চিমবঙ্গের প্রাদেশিক নেতৃত্ব ও যেমন এই সম্মেলন প্রক্রিয়া ভেতর দিয়ে উঠে আসবে, তেমনিই উঠে আসবে দলের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব।

একটা অত্যন্ত সংকটময় সময়ের ভেতর দিয়ে যখন ভারতের রাজনীতি চলেছে, সেই সংকটের একটি অংশ হিসেবে আইনসভার ভেতরে এবং বাইরে বামপন্থিদের নেতৃত্বের বিষয়টি ও প্রচন্ড দুর্বিপাকের ভেতর দিয়ে চলেছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতে বামপন্থিদের বৃহৎত্তম অংশটির হাল কে বা কারা ধরবেন, তা ঘিরে শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতেই নয়, প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের মানুষদের ভেতরেও যথেষ্ট আগ্রহ তৈরি হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গে এমন একজন মানুষের এই নেতৃত্বের ক্ষেত্রে উঠে আসা দরকার যার নিজের দলের ভেতরে তো বটেই, শত্রু শিবিরের ভেতরেও চিড়বিড়ে গাত্রদাহ তৈরির ক্ষমতা আছে। তবেই সেই নেতা একটা যথার্থ টিম তৈরি করে টিম ওয়ার্ক করে সাফল্যের মুখ দেখবেন। কি ধরনের সাফল্য? ভোটে জেতা? পঞ্চায়েত থেকে সংসদে আরও বেশি বেশি করে সদস্য পাঠানোর ক্ষেত্রে সফল হওয়া? মন্ত্রী হওয়া? নানা সরকারি সুযোগ-সুবিধা নেয়া? পুলিশের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা?

না কি মতাদর্শের দৃঢ় ভিত্তিতে সহযোদ্ধাদের সংবদ্ধ করবার শিক্ষা দেয়া নেতা দরকার? যিনি, ‘ভেঙে পড়া গ্রামে প্রাণের দুর্গ ফিরে বানাও’- জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের এই স্লোগানকে যথার্থ অর্থে বাস্তবায়িত করতে পারেন ... এমন নেতা? ফ্যাকশন রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে ‘কমরেড’ হিসেবে যথার্থ একজন বন্ধুই শুধু নয়, কমরেডদের আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠতে পারেন এমন নেতা? কথায় কথায় মার্কস, লেনিন, স্টালিন আওড়ানো নেতাই পারবেন দল কে এই দুরবস্থা থেকে টেনে তুলতে, না কি বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে শহিদ মইদুলের সন্তানেরা নিয়মিত পড়াশোনার খরচ পাচ্ছে কি না-তা জানার জন্য নীরবে, নিভৃতে সজাগ আছেন এমন মানুষই পারবেন, দলকে রাজনীতির সঠিক পথে, সব ধরনের দোদুল্যমানতা কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পথ বাৎলে দিতে।

বামপন্থিরা সব সময়েই বলেন; নেতা নয়, নীতি। তাত্ত্বিক ভাবে এই শব্দচয়ণের সঙ্গে দ্বিমত হওয়ার কোন প্রশ্ন নেই। কিন্তু প্রয়োগ জনিত রাজনীতিতে ‘মুখে’র প্রয়োজন নেই, এই কথাটা বলার অর্থ কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতিকে এড়িয়ে যাওয়া। জ্যোতি বসু তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে সাংগঠনিক দিক সামলালেও সংসদীয় ক্ষেত্রেই বেশি সময় দিয়েছিলেন। তাই ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের জীবদ্দশাতেই তার বিকল্প হিসেবে মানুষের মনে স্থান করে নিতে শুরু করেছিলেন জ্যোতিবাবু। ‘মুখ’ হিসেবে জ্যোতিবাবুর ধীরে ধীরে যে জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছিল, তা পরবর্তী সময়ে বামদের সংসদীয় রাজনীতিতে অনেকটাই সুবিধা দিয়েছিল।

কেরালা বা ত্রিপুরার ক্ষেত্রে ও সেই একই কথা বলতে হয়। কেরালাতে ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদ বা তার পরে ভিএস অচ্যুতানন্দন, পিনরাই বিজয়নেরা ‘মুখ’ হয়ে ওঠায় সংসদীয় রাজনীতিতে পরবর্তী সময়ে একটা মাইলেজ পেয়েছে বামেরা। ত্রিপুরাতে নৃপেন চক্রবর্তী, দশরথ দেব, মানিক সরকারের ক্ষেত্রেও এই একই কথা প্রযোজ্য। আজ ত্রিপুরাতে বিরোধী দলনেতা হিসেবে মানিক সরকার যে লড়াইটা দিচ্ছেন, তা অবশ্যই আগামী বছর সেই রাজ্যে যে বিধানসভার ভোট হচ্ছে, সেই ভোট যদি পরিচ্ছন্ন হয়, তার সুফল অবশ্যই বামেরা ঘরে তুলবে। মানিক সরকার ত্রিপুরাতে বছর পাঁচেক আগে পরাজয়ের পর একটি দিন ও ঘরে বসে থাকেননি। কোনরকম আত্মসমালোচনার দোহাই দিয়ে সদ্য জয়ী বিজেপির হাতে আক্রান্ত সহযোদ্ধাদের থেকে দূরে সরে থাকেননি। শাসক হিসেবে মানিকবাবুর সহজ সরল জীবনযাত্রা এবং সমস্ত রকমের আত্ম অহঙ্কার বর্জিত যাপনচিত্র তাকে এবং তার দলকে শুধু ত্রিপুরাতে নয়, গোটা দেশেই একটা ভিন্ন মাত্রার গ্রহণযোগ্যতা এনে দিয়ে দিয়েছে। জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য সস্তার রাজনীতি, তরল মানসিকতার প্রকাশ কিন্তু মানিকবাবুর ভেতরে আমরা একবার ও দেখিনি। আপাত গাম্ভীর্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বের ভেতর দিয়েই যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি মানিক সরকার তুলে ধরতে পেরেছেন, সেই বোধ এবং সংস্কারের ফসল আগামী বছরের গোড়ায় (২০২২) অনুষ্ঠিতব্য বিধানসভার ভোটে ত্রিপুরায় সিপিআই (এম) তুলবে- এটা সহজেই ধারণা করতে পারা যায়।

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থিরা ক্ষমতায় থাকাকালীন তাদের দলের কে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তা নিয়ে ভাবনাটা দলের ভেতরেই সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণ মানুষের তা নিয়ে খুব একটা ভাবনাচিন্তা ছিল না। আমজনতা ভাবতেন প্রশাসনে যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাকে ঘিরে। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বামেদের দলীয় স্তরে কে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সেই বিষয়টি ঘিরে আমজনতার ভেতর ভাবনা-চিন্তা আগের থেকে বেড়ে যায়।

সূর্যকান্ত মিশ্র যখন সিপিআই (এম) এর রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব নেন, তখন তিনি রাজ্যের বিরোধী দল নেতাও। সংসদীয় রাজনীতির ক্যারিশমা তখন ও তাকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। আর প্রচার মাধ্যমের সাম্প্রতিক যে প্রবণতা, আইনসভায় প্রতিনিধিত্বের নিরিখে সেই দলের নেতাকে প্রচারের আলোকে আলোকিত করা- সেই ধারাটির উলটপূরাণ আমরা দেখতে পাই ২০১৪ সালের লোকসভার ভোটে বামেদের আসন সংখ্যা কমে যাওয়ার সময়কাল থেকেই। প্রচার মাধ্যম এই সময় থেকেই যেভাবে পশ্চিমবঙ্গে শাসক তোষামুদে হয়ে উঠতে শুরু করে-তা পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের আসন্ন সংকটের একটা ভয়াবহ পূর্বাভাস বয়ে আনছিল। শাসক যেভাবে একাধারে বিজ্ঞাপন আর আইনিজুলুমের চোখ রাঙানি শুরু করে দেয়, তার প্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যমে বিরোধীদের খবরাখবরই কার্যত উধাও হয়ে যেতে শুরু করে।

সূর্যবাবু দলের দায়িত্ব নিয়ে একাধারে বিরোধী দলনেতা এবং দলের রাজ্য সম্পাদক হিসেবে একটা অত্যন্ত কঠিন সময়ে বজ্রকঠিন ব্যক্তিত্ব দিয়ে সবটা পরিচালনা করেছেন। এটা বাস্তব যে, কমিউনিস্ট পার্টিকে পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি সমষ্টিগত কর্মকান্ডের বিশেষ ভূমিকা থাকে। এই কাজে দলের রাজ্য সম্পাদকমন্ডলীর প্রবীণ ও নবীন নেতৃত্ব সূর্যবাবুকে সবদিকে সহযোগিতা করেছে বলেই তার পক্ষে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপির সাঁড়াশি আক্রমণের মোকাবিলা করেও দলকে পরিচালনা করা সম্ভবপর হয়েছে।

ভোট রাজনীতির ক্ষেত্রে সূর্যবাবুর নেতৃত্বাধীন দল তেমন একটা সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। এই ফল্যহীনতার পেছনে সূর্যবাবুর দল পরিচালনার নীতির ব্যর্থতা দেখাতে কেউ কেউ ব্যস্ত হলেও, ব্যর্থতার আসল কারণ তৃণমূল আর বিজেপির অর্থশক্তি এবং পেশী শক্তির সঙ্গে বামেদের বুঝতে না পারা। কিছু সাংগঠনিক ব্যর্থতা অবশ্যই বামদের আছে, কিন্তু সেই সাংগঠনিক ব্যর্থতাকে ছাপিয়ে উঠেছে বিজেপি আর তৃণমূল ... এই দুই দলের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের কুৎসিত রাজনীতি। ওই দুই দল সরকারে থাকার ফলে টাকার অবিশ্রান্ত স্রোতে গোটা ভোট প্রক্রিয়াটিকে পরিচালনা করবার প্রবণতা। এই অর্থশক্তির কাছে ভূমিস্তরের বামপন্থিদের একটা বড় অংশ যে নতজানু হয়নি ... তা বললে অসত্য কথা বলা হয়।

আর একটি বড় বিষয় হলো; বামরা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতিতে কীভাবে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে ... সেই শিক্ষার চর্চার তাদের ভেতরে সমানভাবে প্রসারিত হয়নি। একদা কংগ্রেস আমলে যারা নানাভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিলেন, প্রকৃতির নিয়মেই সেই প্রজন্ম এখন নেই। এই যে নতুন প্রজন্ম এখন বামপন্থিদের ভূমিস্তরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বা কর্মী-সমর্থক হিসেবে আছেন, তাদের সিংহভাগই রাজনৈতিক বাতাবরণের সংস্পর্শে এসেছেন ’৭৭ সালে বামরা ক্ষমতায় আসার পরের সময়কালে। ফলে এই প্রজন্ম শাসক তৃণমূল যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নামিয়ে আনছে, মামলা মোকদ্দমায় জীবন অতিষ্ঠ করে তুলছে- এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে আদৌ অভ্যস্থ নন। ফলে শাসকের গুন্ডারাজ, আর্থিক হাতছানি আর আইনি হেনস্তা ... এইগুলোর সঙ্গে শিরদাঁড়া সোজা রেখে লড়াইয়ের লোক একদম না থাকলেও, ভূমিস্তরে তা ক্রমশঃ কমে যাচ্ছে। ফলে ভোটের দিন বুথ আগলে লড়াইয়ের ক্ষেত্রটাও ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। এই সংকোচনের সুস্পষ্ট প্রতিক্রিয়া হলো, ভোট রাজনীতিতে বামদের বর্তমান দুরবস্থা।

এই অবস্থায় বয়সজনিত লক্ষণ রেখার কারনে সূর্যবাবু যখন আগামী সম্মেলনের পর আর সিপিআই (এম) এর নেতৃত্বে থাকবেন না- এটা প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে, তখন তার উত্তরসূরি কে হবেন- সেই প্রশ্নটাই যথার্থভাবে সামনে চলে আসছে। সূর্যবাবুর উত্তরাধিকারী হিসেবে তার দলকে এমন একজন নেতাকে বেছে নিতে হবে যার একই সঙ্গে দলের গন্ডি অতিক্রম করে সাধারণ সহানুভূতিশীল মানুষদের কাছে ও একটা বড় রকমের গ্রহণযোগ্যতা থাকবে। এখন বামপন্থি দলের নেতৃত্বে এমন একজন মানুষকেই বেছে নিতে হবে যার একই সঙ্গে সাংগঠনিক দক্ষতা এবং জননেতার ক্যারিশমা আছে।

এতকাল যে রাজনৈতিক গতিপ্রবাহ চলেছে, তাতে বামপন্থি দলের সাংগঠনিক নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে সাংগঠনিক দক্ষতার বিষয়টিই ছিল সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। সাংগঠিক নেতার জননেতার ক্যারিশমা আছে কি না-সেটা কখনও বিবেচ্য হয়ে ওঠেনি। কারণ, জননেতা হিসেবে জ্যোতি বসু, বিনয় চৌধুরী, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রমুখদের গ্রহণযোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত। তাই প্রমোদ দাশগুপ্তের জীবনাবসানের পর সরোজ মুখোপাধ্যায়, বা তার পরে শৈলেন দাশগুপ্ত, অনিল বিশ্বাস, বিমান বসু দের সাধারণের কাছে জনপ্রিয়তার বিষয়টি দল ক্ষমতায় থাকার কারণে সেভাবে উঠে আসেনি।

বামপন্থি দলের সাংগঠনিক নেতার দলের পরিমন্ডলের বাইরেও সাধারণের ভেতরে গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নটি বড় করে উঠে আসে বামপন্থিরা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরেই। মিডিয়া সামলানো থেকে গণ-আন্দোলন, বামফ্রন্টের ঐক্যের প্রশ্ন থেকে ফ্রন্টের বাইরের বাম দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক, নির্বাচনী সংগ্রামের নিরিখে বাম পরিমন্ডলের বাইরে অসাম্প্রদায়িক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ... এসব রকমের প্রশ্নে সংগঠনের আবর্তের বাইরে বাম নেতৃত্বে একজন জননেতার প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়। এই প্রয়োজনের তাগিদে সূর্যবাবুর নেতৃত্ব অত্যন্ত সফল। ভোটে আসন তার নেতৃত্বে না আসার পেছনে নেতৃত্বজনিত কোন দুর্বলতাই কিন্তু কার্যকরী ছিল না। ছিল বহিঃশত্রুর নানা ধরনের কর্মকান্ড এবং নিজেদের ভূমিস্থরে সাংগঠনিক দুর্বলতা, সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ফাঁদে দলের একাংশের পা দেয়া, মুসলমান সমাজ সম্পর্কে একটা বড় অংশের ভেতরে সহানুভূতিহীনতা আর সেই সহানুভূতিহীনতা অনেকাংশেই ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শিবির এবং প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক শিবির কেই শক্তিশালী করেছে।

একটা অত্যন্ত সংকটময় সময়ের ভেতর দিয়ে যখন ভারতের রাজনীতি চলেছে, সেই সংকটের একটি অংশ হিসেবে আইনসভার ভেতরে এবং বাইরে বামপন্থিদের নেতৃত্বের বিষয়টি ও প্রচন্ড দুর্বিপাকের ভেতর দিয়ে চলেছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতে বামপন্থিদের বৃহৎত্তম অংশটির হাল কে বা কারা ধরবেন

একটা বড় রকমের সীমাবদ্ধতার ভেতরে সূর্যবাবুকে সবদিক সামলে চলতে হয়েছে। মানিক সরকার যেভাবে পরাজয়ের পর নিজে ব্যাটন ধরে ময়দানে থেকে লড়াই করেছেন, জোরদার অসুস্থ হওয়ার আগে পর্যন্ত কিন্তু সদ্য ক্ষমতাচ্যুত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তা করেননি। তাই ত্রিপুরাতে সাংগঠনিক লড়াই এবং সংসদীয় রাজনীতিতে লড়াইটা যে পর্যায়ের হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে লড়াইটা সেই পর্যায়ে হতে পারেনি। সূর্যবাবু যতই দক্ষতার সঙ্গে ব্যাটন ধরুন না কেন, যতদিন বুদ্ধবাবু সুস্থ ছিলেন, অতি সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের ভেতরে তার প্রায় রাজনৈতিক সন্ন্যাস ঘিরে প্রশ্ন উঠেছে। সংশয় দেখা দিয়েছে। নিজেদের আত্ম-অভিমানে ঘা লেগেছে। লড়াইয়ের প্রশ্নে ও যে একটা সংশয়ের বাতাবরণ তৈরি হয়নি, তা জোর গলায় বলা যায় না।

এসব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে এগিয়েছেন সূর্যবাবু। নতুন যিনি তার স্থলাভিষিক্ত হবেন, তার কাছে এসব পর্যায়ের সঙ্গেই যুক্ত হবে এবারের ভোটে আইএসএফকে সঙ্গী করার বিষয়টি। কারণ, আইএসএফ বামেদের ভেতরে সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে যে ছাকনির কাজ করেছিল, সেই ছাকনি গলে কেউ কেউ প্রকাশ্যে, কেউ গোপনে যে মুসলমানবিরোধী এবং বিদ্বেষী মানসিকতা নিয়ে চলেন বামপন্থি দলগুলোর ভেতরে, তা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। এসব ভোটকেন্দ্রিক বামপন্থিদের কাছে আদর্শের থেকে অনেক বেশি জরুরি হলো ভোটে জেতা। তাই চিরদিন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়ে ও কংগ্রেস ঘিরে তারা সহনশীল হলেও, মুসলমানদের আধিপত্য বিস্তারের সহায়ক বলেই আইএসএফকে ঘিরে তাদের মূল্যায়ন। আর একাংশের বামেদের এই মানসিকতার দরুণ আইএসএফও এখন ভিন্ন সুরে কথা বলতে শুরু করেছে। এই অবস্থায় বাম নেতৃত্বে যিনি অভিষিক্ত হবেন, তাকে এসব সমস্যাকেই একসঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে।

[লেখক: ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

back to top