alt

উপ-সম্পাদকীয়

কৃষিপণ্যে মূল্য সংযোজন ও আন্তর্জাতিক বাজার

জগৎ চাঁদ মালাকার

: রোববার, ১০ অক্টোবর ২০২১

ভোক্তার সন্তুষ্টি অর্জনের এবং লাভের আশায় কোন কৃষিপণ্য আহরণ বা ক্রয়ের পর এর ওপর বাড়তি কাজ করাকে বা পণ্যের খরচের ওপর বাড়তি মূল্য যোগ করাকে মূল্য সংযোজন বলে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা এবং প্রতিযোগীর ওপর বাড়তি সুবিধা অর্জন করে ভোক্তা সন্তুষ্টি অর্জন করাই হলো মূল্য সংযোজন। মোটামুটিভাবে বলা যায়- ভোক্তার সন্তুষ্টি অর্জন, প্রতিযোগী থেকে এগিয়ে থাকা, পণ্যের বেশি মূল্য পাওয়া। সুতরাং বাজারজাত করার পূর্বে বাজারে মানসম্মত কৃষিপণ্য, সুবিধাজনক মূল্য, স্থান-আন্তর্জাতিক বাজার প্রচারেই প্রসার বিষযগুলো গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।

মূল্য সংযোজন করতে কী কী বিষয়ে করতে হবে

বাংলাদেশে অধিকাংশ ফল ও সবজি গ্রেডিং না করে ছোট ও বড় একসঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি করা হয়।বিধায় পণ্যের বেশি মূল্যপাওয়ার জন্য গ্রেডিং, প্যাকিং, শুকানো, বাছাইকরণ ও শ্রেণীকরণ, আগাম উৎপাদন, পরিষ্কারকরণ, একত্রিকরণ, সংরক্ষণকাল বৃদ্ধি, ক্লোরিন দ্বারা ধৌতকরণ, গুদামজাতকরণ, দ্রুত পরিবহন করা প্রয়োজন।

যে যে বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন

বিশ্ব বাজারে আমাদের কৃষিপণ্য রপ্তানি করতে হলে উৎপাদনকালীন Good Agricultural Practices (GAP) নিশ্চিত করা জরুরি, সেইসাথে ঝুঁকিমুক্ত স্বার্থে রপ্তানির পূর্বে অ্যাক্রিডিয়েটেড ল্যাবরেটরিতে নমুনা পরীক্ষাপূর্বক প্রত্যায়ন/সনদ নেয়া প্রয়োজন। উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করা চুক্তিবদ্ধ কৃষক কর্তৃক উৎপাদিত কৃষি পণ্য- প্যাকিং হাউসে ফল ও সবজি আনার পর প্রথমেই বাছাই করে বাজারজাত করা যাবে না এমন পণ্য বাদ দিতে হয়। বাছাই করার সময় অপরিপক্ব, বেশি পরিপক্ব, বেশি ছোট, বাঁকা, থেঁতলানো ও নষ্ট পণ্য বাদ দিতে হয়। বেশি ছোট পণ্য বাছাই করার জন্য চালনি ব্যবহার করা যায়। উন্নত প্যাকিং হাউসে চওড়া কনভেয়ার বেল্টের ওপর দিয়ে পণ্য যেতে থাকে।

পণ্য ধোয়ার কাজটি ট্যাপের পানি দিয়ে করা উচিত। বদ্ধ পানিতে ধুলে আগে ধোয়া পণ্যের ময়লা ও জীবাণু পানিতে থাকে যা পরবর্তীতে ধোয়া পণ্যে লেগে যায় বলে ধোয়ার আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো মাঠ পর্যায়ে আমাদের দেশে ফল ও সবজি ধোয়ার কাজটি প্রায় কখনোই ট্যাপের পানি দিয়ে করা হয় না। রাস্তার পাশের নর্দমা, ডোবা, নদী, প্রভৃতি অধিকাংশ সময়ই বিষাক্ত বর্জ্যে পূর্ণ থাকে। এরূপ পানিতে ধোয়া সবজিতে বাজার পূর্ণ থাকে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই উদ্বেগের বিষয়। প্লাস্টিক ক্রেট ছিদ্রযুক্ত থাকে বলে এতে পণ্য রেখে ট্যাপের পানিতে বা হোস পাইপের পানি দিয়ে ক্রেটের সবজি ও ফল ধোয়া সহজ। আম পাড়ার সময় বোঁটা রাখা হয় না বলে এর গোড়া থেকে কস বেরিয়ে আমের গায়ে লেগে থাকে। এটা পরবর্তী সময় শুকিয়ে গায়ে লেগে থাকে বলে আম খারাপ দেখায় এবং জীবন কাল কমে যায়। সেজন্য আম ভালো করে ব্রাশ বা অনুরূপ কিছু দিয়ে ধোয়া উচিত। তিন মিনিটের বেশি পানিতে রাখলে কোনো কোনো সবজির ভেতরে পানি ঢুকে গুণগতমান কমিয়ে দিতে পারে। সেজন্য দ্রুত এগুলো ধোয়া উচিত। ধোয়ার পর ফ্যানের বাতাস দিয়ে পণ্য শুকাতে হয়।

আমাদের দেশে গ্রেডিং করা ততটা গুরুত্বপূর্ণ না হলেও উন্নত দেশসমূহে একে শস্য সংগ্রহোত্তর পর্যায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে বিবেচিত হয় এবং কাজটি প্যাকিং হাউসের অন্যতম প্রধান কাজ। গ্রেডিং প্রধানত দুই প্রকার- সাইজ গ্রেডিং এবং কোয়ালিটি গ্রেডিং। সাইজ গ্রেডিংকে আবার আকার গ্রেডিং ও ওজন গ্রেডিং এই দুই ভাগে ভাগ করা যায়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে তুলনামূলকভাবে অনেক কম মূল্যের আলু গ্রেডার উদ্ভাবন করা হয়েছে। এর ক্ষমতা প্রতি ঘন্টায় এক টন এবং মূল্য ৩৫,০০০ টাকা (আনুমানিক)। কোয়ালিটি গ্রেডিং কাজটি যন্ত্র দিয়ে করা যায় না। প্যাকিং হাউসের কর্মীরা এ কাজটি প্রতিটি ফল চোখে দেখে গ্রেডিং করেন। বাংলাদেশে সাধারণত মাঠপর্যায়ে গ্রেডিং করা না হলেও শহরের সুপার মার্কেট ও অভিজাত এলাকার বিভিন্ন দোকানে খুচরা পর্যায়ে গ্রেডিং করে তুলনামূলকভাবে ভালো ফল ও সবজি একটু বেশি দামে বিক্রি করা হয়।

মোড়কীকরণ

ফসল বাজারজাতকরণের উদ্দেশ্যে নাড়াচাড়া করা, পরিবহন ও সংরক্ষণের সুবিধার্থে ফসল মোড়কীকরণ করা হয়। মোড়কীকরণের জন্য ব্যবহৃত মোড়কের নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্য থাকা বাঞ্ছনীয় :

(১) রাসায়নিকমুক্ত, (২) বাজার চাহিদা অনুযায়ী আকার, আকৃতি ও ওজন, (৩) বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা, (৪) সহজে খোলা ও বন্ধ করার ব্যবস্থা এবং (৫) সুবিধাজনক মূল্য।

সংরক্ষণ

বিভিন্ন ফল ও সবজির জীবন কাল খুব কম যা সংগ্রহের পরপরই উপযুক্ত তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় রাখলে কয়েক দিন, সপ্তাহ বা মাস ভালো থাকে। বাংলাদেশে প্রধানত কোল্ড স্টোরেজে আলু আট মাস পর্যন্ত রাখা হয়। সীমিত পরিসরে কয়েক মাসের জন্য গাজর রাখা হয়। বিভিন্ন ফসলের জন্য তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও বাতাস প্রবাহ ভিন্ন হয়ে থাকে। স্বল্প সময় সংরক্ষণের জন্য কোল্ড স্টোরেজ ব্যতীত বিভিন্নভাবে জীবন কাল বাড়ানোর জন্য গবেষণা করা হয়েছে। বালির মধ্যে, মাটির নিচে, রাতে বাতাস প্রবাহ করে, ইভাপোরেটিভ কুলিং, ইন সিটু সংরক্ষণ, আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ (evaporative cooling), প্রভৃতির সাহায্যে জীবন কাল কিছুটা বাড়ানো গেলেও তা সব আবহাওয়ায় সব পরিবেশে কার্যকর নয়, ব্যবহার করা সহজ নয় এবং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উপযুক্ত নয় বলে এগুলো জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি।

পরিবহন

বাংলাদেশে শস্য সংগ্রহোত্তর ক্ষতি বেশি হয় প্রধানত পরিবহনের সময়। এবড়োথেবড়ো ও ভাঙা রাস্তায় ট্রাক চলার সময় অনবরত ঝাঁকুনিতে নরম ফল ও সবজি নষ্ট হয় বেশি। মোড়ক ভালো না থাকলে এবং উপরে খালি থাকলে ঝাঁকুনি বেশি লাগে। সে জন্য কোনো অবস্থাতেই মোড়কের উপরিভাগ খালি রাখা যাবে না। অন্ত—ত কাগজ বা খড় বা অন্য কিছু দিয়ে উপরের অংশ পূর্ণ করতে হবে। বস্তা, বাঁশের ঝুড়ি প্রভৃতিতে পণ্য ভর্তি করে একটার উপর একটি চাপানো হয় বলে নিচের দিকে থাকা পণ্য বিক্রির অযোগ্য হয়ে পড়ে। উপরন্তু পণ্য ভর্তি ট্রাকের উপর লোকজন বসে বলে পণ্য আরো বেশি নষ্ট হয়। প্লাস্টিক ক্রেট ব্যবহার করলে এর নিচের ফল বা সবজির শুধু ওই ক্রেটের উপরের অংশের দ্রব্যের ভার বহন করতে হয় বলে নষ্ট হয় না।

অণুজীব সংক্রমণ হ্রাস পদ্ধতি

কৃষিপণ্য খামার থেকে ভোক্তার টেবিলে আসার পূর্ব পর্যন্ত যে কোন সময় রোগজীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর মলমূত্রের সাহায্যে বেশির ভাগ অণুজীব কৃষিপণ্যকে আক্রান্ত করে থাকে। যখনই কৃষিজাত পণ্য পানির সংস্পর্শে আসে তখনই অণুজীব দ্বারা আক্রান্ত হওয়া না হওয়া পণ্যের গুণগত মান এর ওপর নির্ভর করে। অর্থাৎ পণ্য তরতাজা হলে এ আক্রমণের প্রবণতা কম এবং পণ্য যদি তরতাজা কম থাকে তাহলে এই আক্রমণের প্রবণতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। এজন্য পরিষ্কার স্বচ্ছ পানিতে পণ্য ধোয়ার কাজটি করা উচিত। বদ্ধ পানিতে ধুলে আগে ধোয়া পণ্যের ময়লা ও জীবাণু পানিতে থাকে যা পরবর্তীতে ধোয়া পণ্যে লেগে যায় বলে ধোয়ার আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো মাঠ পর্যায়ে আমাদের দেশে ফল ও সবজি ধোয়ার কাজটি প্রায় কখনোই ট্যাপের পানি দিয়ে করা হয় না। রাস্তার পাশের নর্দমা, ডোবা, নদী, প্রভৃতি অধিকাংশ সময়ই বিষাক্ত বর্জ্যে পূর্ণ থাকে। এরূপ পানিতে ধোয়া সবজিতে বাজার পূর্ণ থাকে; যা জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই উদ্বেগের বিষয়।

প্লাস্টিক ক্রেট ছিদ্রযুক্ত থাকে বলে এতে পণ্য রেখে ট্যাপের পানিতে বা হোস পাইপের পানি দিয়ে ক্রেটের সবজি ও ফল ধোয়া সহজ। এভাবে পণ্য ধোয়া হলে অণুজীব দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বহুলাংশে হ্রাস পায়। সাধারণত পানিবাহিত রোগজীবাণু বিশেষ করে শস্য সংগ্রহোত্তরকালে ফসলের সঙ্গের রোগজীবাণু মানুষের শরীরের বিভিন্ন রোগজীবাণু প্রভৃতি দ্রুত শাকসবজিসহ অন্যান্য ফলমূল এবং গাছপালায় সংক্রমিত হয়। প্রাকৃতিকভাবে গাছপালার উপরিভাগে যেসব ফাটল, ছিদ্র, ফসল সংগ্রহকালের জখম প্রভৃতির মাধ্যমে রোগজীবানু দ্রুত সংক্রমিত হয়ে থাকে। এজন্য গরম পানির প্রবাহের মাধ্যমে গুপ্ত আশ্রয়ে থাকা রোগজীবাণু দূর করা যায়।

বাংলাদেশের কৃষি ক্রমেই স্বনির্ভর কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে পরিবর্তিত হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কারণে অধিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য তথা খাদ্যশস্যের ফলন বৃদ্ধির জন্য উচ্চ ফলনশীল এবং হাইব্রিড জাতের পাশাপাশি অধিক মাত্রায রাসাযনিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহৃত হচ্ছে। বাণিজ্যিকভাবে কৃষিপণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে এসবেরও ব্যবহার হয। মানব স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক বিবেচনায় নিরাপদ খাদ্য ক্রমাগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। জনগণকে খাদ্যজনিত অসুস্থতা থেকে রক্ষার পাশাপাশি বিশ্ব রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতার কারণে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন জরুরি।

উৎপাদনের প্রাথমিক পর্যায় থেকে খাদ্য শৃঙ্খলের বিভিন্ন পর্যায়ে বাছ-বিচারহীন বালাইনাশক ও রাসায়নিকের ব্যবহার, ভারি ধাতব পদার্থের উপস্থিতি, অণুজীবের সংক্রমণ ইত্যাদি খাদ্যকে অনিরাপদ করে। উত্তম কৃষি চর্চা নিরাপদ ও মানসম্মত খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি পরিবেশ এবং সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। বিশ্ব বাজারে আমাদের কৃষিপণ্য রপ্তানি করতে হলে উৎপাদনকালীন Good Agricultural Practices (GAP) নিশ্চিত করা জরুরি। সেইসাথে ঝুঁকিমুক্ত স্বার্থে রপ্তানির পূর্বে অ্যাক্রিডিয়েটেড ল্যাবরেটরিতে নমুনা পরীক্ষাপূর্বক প্রত্যায়ন/সনদ নেয়া প্রয়োজন। এসব কারণে নিরাপদ খাদ্যপণ্য প্রাপ্যতার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে উৎপাদনের শুরু থেকে সংগ্রহ, সংগ্রহোত্তর ও প্রক্রিয়াকরণ যেমন- মাঠ হতে সংগ্রহ, প্যাকেজিং, পরিবহন ইত্যাদি পর্যায়ে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করা একান্তই প্রয়োজন।

[লেখক : উপপরিচালক (এলআর), সংযুক্ত- উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর]

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি

ঈদের অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ‘পোস্ট পার্টিশন সিনড্রম’

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

রম্যগদ্য : ‘প্রহরীর সাতশ কোটি টাকা...’

ছবি

অবন্তিকাদের আত্মহনন

শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা

অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান নয়

পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে

আত্মহত্যা রোধে নৈতিক শিক্ষা

আউশ ধান : পরিবেশ ও কৃষকবান্ধব ফসল

ছবি

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আতুড়ঘর

চেক ডিজঅনার মামলার অধিক্ষেত্র ও প্রাসঙ্গিকতা

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের কৃষি

ছবি

‘হৃৎ কলমের’ পাখি এবং আমাদের জেগে ওঠা

ছবি

ভূগর্ভস্থ পানি সুরক্ষায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

প্রসঙ্গ : নিত্যপণ্যের দাম

ছবি

টঙ্ক আন্দোলনের কুমুদিনী হাজং

ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে চাই বিকেন্দ্রীকরণ

দূষণমুক্ত পানির বিকল্প নাই

রম্যগদ্য : ‘দুনিয়ার বাঙালি এক হও”

tab

উপ-সম্পাদকীয়

কৃষিপণ্যে মূল্য সংযোজন ও আন্তর্জাতিক বাজার

জগৎ চাঁদ মালাকার

রোববার, ১০ অক্টোবর ২০২১

ভোক্তার সন্তুষ্টি অর্জনের এবং লাভের আশায় কোন কৃষিপণ্য আহরণ বা ক্রয়ের পর এর ওপর বাড়তি কাজ করাকে বা পণ্যের খরচের ওপর বাড়তি মূল্য যোগ করাকে মূল্য সংযোজন বলে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা এবং প্রতিযোগীর ওপর বাড়তি সুবিধা অর্জন করে ভোক্তা সন্তুষ্টি অর্জন করাই হলো মূল্য সংযোজন। মোটামুটিভাবে বলা যায়- ভোক্তার সন্তুষ্টি অর্জন, প্রতিযোগী থেকে এগিয়ে থাকা, পণ্যের বেশি মূল্য পাওয়া। সুতরাং বাজারজাত করার পূর্বে বাজারে মানসম্মত কৃষিপণ্য, সুবিধাজনক মূল্য, স্থান-আন্তর্জাতিক বাজার প্রচারেই প্রসার বিষযগুলো গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।

মূল্য সংযোজন করতে কী কী বিষয়ে করতে হবে

বাংলাদেশে অধিকাংশ ফল ও সবজি গ্রেডিং না করে ছোট ও বড় একসঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি করা হয়।বিধায় পণ্যের বেশি মূল্যপাওয়ার জন্য গ্রেডিং, প্যাকিং, শুকানো, বাছাইকরণ ও শ্রেণীকরণ, আগাম উৎপাদন, পরিষ্কারকরণ, একত্রিকরণ, সংরক্ষণকাল বৃদ্ধি, ক্লোরিন দ্বারা ধৌতকরণ, গুদামজাতকরণ, দ্রুত পরিবহন করা প্রয়োজন।

যে যে বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন

বিশ্ব বাজারে আমাদের কৃষিপণ্য রপ্তানি করতে হলে উৎপাদনকালীন Good Agricultural Practices (GAP) নিশ্চিত করা জরুরি, সেইসাথে ঝুঁকিমুক্ত স্বার্থে রপ্তানির পূর্বে অ্যাক্রিডিয়েটেড ল্যাবরেটরিতে নমুনা পরীক্ষাপূর্বক প্রত্যায়ন/সনদ নেয়া প্রয়োজন। উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করা চুক্তিবদ্ধ কৃষক কর্তৃক উৎপাদিত কৃষি পণ্য- প্যাকিং হাউসে ফল ও সবজি আনার পর প্রথমেই বাছাই করে বাজারজাত করা যাবে না এমন পণ্য বাদ দিতে হয়। বাছাই করার সময় অপরিপক্ব, বেশি পরিপক্ব, বেশি ছোট, বাঁকা, থেঁতলানো ও নষ্ট পণ্য বাদ দিতে হয়। বেশি ছোট পণ্য বাছাই করার জন্য চালনি ব্যবহার করা যায়। উন্নত প্যাকিং হাউসে চওড়া কনভেয়ার বেল্টের ওপর দিয়ে পণ্য যেতে থাকে।

পণ্য ধোয়ার কাজটি ট্যাপের পানি দিয়ে করা উচিত। বদ্ধ পানিতে ধুলে আগে ধোয়া পণ্যের ময়লা ও জীবাণু পানিতে থাকে যা পরবর্তীতে ধোয়া পণ্যে লেগে যায় বলে ধোয়ার আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো মাঠ পর্যায়ে আমাদের দেশে ফল ও সবজি ধোয়ার কাজটি প্রায় কখনোই ট্যাপের পানি দিয়ে করা হয় না। রাস্তার পাশের নর্দমা, ডোবা, নদী, প্রভৃতি অধিকাংশ সময়ই বিষাক্ত বর্জ্যে পূর্ণ থাকে। এরূপ পানিতে ধোয়া সবজিতে বাজার পূর্ণ থাকে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই উদ্বেগের বিষয়। প্লাস্টিক ক্রেট ছিদ্রযুক্ত থাকে বলে এতে পণ্য রেখে ট্যাপের পানিতে বা হোস পাইপের পানি দিয়ে ক্রেটের সবজি ও ফল ধোয়া সহজ। আম পাড়ার সময় বোঁটা রাখা হয় না বলে এর গোড়া থেকে কস বেরিয়ে আমের গায়ে লেগে থাকে। এটা পরবর্তী সময় শুকিয়ে গায়ে লেগে থাকে বলে আম খারাপ দেখায় এবং জীবন কাল কমে যায়। সেজন্য আম ভালো করে ব্রাশ বা অনুরূপ কিছু দিয়ে ধোয়া উচিত। তিন মিনিটের বেশি পানিতে রাখলে কোনো কোনো সবজির ভেতরে পানি ঢুকে গুণগতমান কমিয়ে দিতে পারে। সেজন্য দ্রুত এগুলো ধোয়া উচিত। ধোয়ার পর ফ্যানের বাতাস দিয়ে পণ্য শুকাতে হয়।

আমাদের দেশে গ্রেডিং করা ততটা গুরুত্বপূর্ণ না হলেও উন্নত দেশসমূহে একে শস্য সংগ্রহোত্তর পর্যায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে বিবেচিত হয় এবং কাজটি প্যাকিং হাউসের অন্যতম প্রধান কাজ। গ্রেডিং প্রধানত দুই প্রকার- সাইজ গ্রেডিং এবং কোয়ালিটি গ্রেডিং। সাইজ গ্রেডিংকে আবার আকার গ্রেডিং ও ওজন গ্রেডিং এই দুই ভাগে ভাগ করা যায়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে তুলনামূলকভাবে অনেক কম মূল্যের আলু গ্রেডার উদ্ভাবন করা হয়েছে। এর ক্ষমতা প্রতি ঘন্টায় এক টন এবং মূল্য ৩৫,০০০ টাকা (আনুমানিক)। কোয়ালিটি গ্রেডিং কাজটি যন্ত্র দিয়ে করা যায় না। প্যাকিং হাউসের কর্মীরা এ কাজটি প্রতিটি ফল চোখে দেখে গ্রেডিং করেন। বাংলাদেশে সাধারণত মাঠপর্যায়ে গ্রেডিং করা না হলেও শহরের সুপার মার্কেট ও অভিজাত এলাকার বিভিন্ন দোকানে খুচরা পর্যায়ে গ্রেডিং করে তুলনামূলকভাবে ভালো ফল ও সবজি একটু বেশি দামে বিক্রি করা হয়।

মোড়কীকরণ

ফসল বাজারজাতকরণের উদ্দেশ্যে নাড়াচাড়া করা, পরিবহন ও সংরক্ষণের সুবিধার্থে ফসল মোড়কীকরণ করা হয়। মোড়কীকরণের জন্য ব্যবহৃত মোড়কের নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্য থাকা বাঞ্ছনীয় :

(১) রাসায়নিকমুক্ত, (২) বাজার চাহিদা অনুযায়ী আকার, আকৃতি ও ওজন, (৩) বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা, (৪) সহজে খোলা ও বন্ধ করার ব্যবস্থা এবং (৫) সুবিধাজনক মূল্য।

সংরক্ষণ

বিভিন্ন ফল ও সবজির জীবন কাল খুব কম যা সংগ্রহের পরপরই উপযুক্ত তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় রাখলে কয়েক দিন, সপ্তাহ বা মাস ভালো থাকে। বাংলাদেশে প্রধানত কোল্ড স্টোরেজে আলু আট মাস পর্যন্ত রাখা হয়। সীমিত পরিসরে কয়েক মাসের জন্য গাজর রাখা হয়। বিভিন্ন ফসলের জন্য তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও বাতাস প্রবাহ ভিন্ন হয়ে থাকে। স্বল্প সময় সংরক্ষণের জন্য কোল্ড স্টোরেজ ব্যতীত বিভিন্নভাবে জীবন কাল বাড়ানোর জন্য গবেষণা করা হয়েছে। বালির মধ্যে, মাটির নিচে, রাতে বাতাস প্রবাহ করে, ইভাপোরেটিভ কুলিং, ইন সিটু সংরক্ষণ, আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ (evaporative cooling), প্রভৃতির সাহায্যে জীবন কাল কিছুটা বাড়ানো গেলেও তা সব আবহাওয়ায় সব পরিবেশে কার্যকর নয়, ব্যবহার করা সহজ নয় এবং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উপযুক্ত নয় বলে এগুলো জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি।

পরিবহন

বাংলাদেশে শস্য সংগ্রহোত্তর ক্ষতি বেশি হয় প্রধানত পরিবহনের সময়। এবড়োথেবড়ো ও ভাঙা রাস্তায় ট্রাক চলার সময় অনবরত ঝাঁকুনিতে নরম ফল ও সবজি নষ্ট হয় বেশি। মোড়ক ভালো না থাকলে এবং উপরে খালি থাকলে ঝাঁকুনি বেশি লাগে। সে জন্য কোনো অবস্থাতেই মোড়কের উপরিভাগ খালি রাখা যাবে না। অন্ত—ত কাগজ বা খড় বা অন্য কিছু দিয়ে উপরের অংশ পূর্ণ করতে হবে। বস্তা, বাঁশের ঝুড়ি প্রভৃতিতে পণ্য ভর্তি করে একটার উপর একটি চাপানো হয় বলে নিচের দিকে থাকা পণ্য বিক্রির অযোগ্য হয়ে পড়ে। উপরন্তু পণ্য ভর্তি ট্রাকের উপর লোকজন বসে বলে পণ্য আরো বেশি নষ্ট হয়। প্লাস্টিক ক্রেট ব্যবহার করলে এর নিচের ফল বা সবজির শুধু ওই ক্রেটের উপরের অংশের দ্রব্যের ভার বহন করতে হয় বলে নষ্ট হয় না।

অণুজীব সংক্রমণ হ্রাস পদ্ধতি

কৃষিপণ্য খামার থেকে ভোক্তার টেবিলে আসার পূর্ব পর্যন্ত যে কোন সময় রোগজীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর মলমূত্রের সাহায্যে বেশির ভাগ অণুজীব কৃষিপণ্যকে আক্রান্ত করে থাকে। যখনই কৃষিজাত পণ্য পানির সংস্পর্শে আসে তখনই অণুজীব দ্বারা আক্রান্ত হওয়া না হওয়া পণ্যের গুণগত মান এর ওপর নির্ভর করে। অর্থাৎ পণ্য তরতাজা হলে এ আক্রমণের প্রবণতা কম এবং পণ্য যদি তরতাজা কম থাকে তাহলে এই আক্রমণের প্রবণতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। এজন্য পরিষ্কার স্বচ্ছ পানিতে পণ্য ধোয়ার কাজটি করা উচিত। বদ্ধ পানিতে ধুলে আগে ধোয়া পণ্যের ময়লা ও জীবাণু পানিতে থাকে যা পরবর্তীতে ধোয়া পণ্যে লেগে যায় বলে ধোয়ার আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো মাঠ পর্যায়ে আমাদের দেশে ফল ও সবজি ধোয়ার কাজটি প্রায় কখনোই ট্যাপের পানি দিয়ে করা হয় না। রাস্তার পাশের নর্দমা, ডোবা, নদী, প্রভৃতি অধিকাংশ সময়ই বিষাক্ত বর্জ্যে পূর্ণ থাকে। এরূপ পানিতে ধোয়া সবজিতে বাজার পূর্ণ থাকে; যা জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই উদ্বেগের বিষয়।

প্লাস্টিক ক্রেট ছিদ্রযুক্ত থাকে বলে এতে পণ্য রেখে ট্যাপের পানিতে বা হোস পাইপের পানি দিয়ে ক্রেটের সবজি ও ফল ধোয়া সহজ। এভাবে পণ্য ধোয়া হলে অণুজীব দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বহুলাংশে হ্রাস পায়। সাধারণত পানিবাহিত রোগজীবাণু বিশেষ করে শস্য সংগ্রহোত্তরকালে ফসলের সঙ্গের রোগজীবাণু মানুষের শরীরের বিভিন্ন রোগজীবাণু প্রভৃতি দ্রুত শাকসবজিসহ অন্যান্য ফলমূল এবং গাছপালায় সংক্রমিত হয়। প্রাকৃতিকভাবে গাছপালার উপরিভাগে যেসব ফাটল, ছিদ্র, ফসল সংগ্রহকালের জখম প্রভৃতির মাধ্যমে রোগজীবানু দ্রুত সংক্রমিত হয়ে থাকে। এজন্য গরম পানির প্রবাহের মাধ্যমে গুপ্ত আশ্রয়ে থাকা রোগজীবাণু দূর করা যায়।

বাংলাদেশের কৃষি ক্রমেই স্বনির্ভর কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে পরিবর্তিত হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কারণে অধিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য তথা খাদ্যশস্যের ফলন বৃদ্ধির জন্য উচ্চ ফলনশীল এবং হাইব্রিড জাতের পাশাপাশি অধিক মাত্রায রাসাযনিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহৃত হচ্ছে। বাণিজ্যিকভাবে কৃষিপণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে এসবেরও ব্যবহার হয। মানব স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক বিবেচনায় নিরাপদ খাদ্য ক্রমাগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। জনগণকে খাদ্যজনিত অসুস্থতা থেকে রক্ষার পাশাপাশি বিশ্ব রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতার কারণে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন জরুরি।

উৎপাদনের প্রাথমিক পর্যায় থেকে খাদ্য শৃঙ্খলের বিভিন্ন পর্যায়ে বাছ-বিচারহীন বালাইনাশক ও রাসায়নিকের ব্যবহার, ভারি ধাতব পদার্থের উপস্থিতি, অণুজীবের সংক্রমণ ইত্যাদি খাদ্যকে অনিরাপদ করে। উত্তম কৃষি চর্চা নিরাপদ ও মানসম্মত খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি পরিবেশ এবং সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। বিশ্ব বাজারে আমাদের কৃষিপণ্য রপ্তানি করতে হলে উৎপাদনকালীন Good Agricultural Practices (GAP) নিশ্চিত করা জরুরি। সেইসাথে ঝুঁকিমুক্ত স্বার্থে রপ্তানির পূর্বে অ্যাক্রিডিয়েটেড ল্যাবরেটরিতে নমুনা পরীক্ষাপূর্বক প্রত্যায়ন/সনদ নেয়া প্রয়োজন। এসব কারণে নিরাপদ খাদ্যপণ্য প্রাপ্যতার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে উৎপাদনের শুরু থেকে সংগ্রহ, সংগ্রহোত্তর ও প্রক্রিয়াকরণ যেমন- মাঠ হতে সংগ্রহ, প্যাকেজিং, পরিবহন ইত্যাদি পর্যায়ে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করা একান্তই প্রয়োজন।

[লেখক : উপপরিচালক (এলআর), সংযুক্ত- উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর]

back to top