জিয়াউদ্দীন আহমেদ
পাকিস্তান আমল থেকেই ‘হায় হায় কোম্পানি’র নাম শুনে আসছি, কিন্তু এর অর্থ তখন বুঝিনি। ‘ডেস্টিনি ২০০০’-এর বিরুদ্ধে সরকারের ব্যবস্থা নেয়ার পর সবাই জানতে পারল এরা একটি বড় মাপের প্রতারক। তারপর বেরিয়ে এলো ‘যুবক’। সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে ‘ইভ্যালি’, ‘ই অরেঞ্জ’ ইত্যাদি ঠকবাজ প্রতিষ্ঠানের কথা। শুধু ইভ্যালি বা ই-অরেঞ্জ নয়, আরও বহু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের কেনা পণ্য সরবরাহ করছে না, টাকাও ফেরত দিচ্ছে না। মফস্বল শহরেও এমন ঠকবাজ কোম্পানির কথা ইদানীং অহর্নিশ শোনা যায়; গরিব লোকগুলোর সব সঞ্চয় নিয়ে হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে যাওয়ার পর মিডিয়া ও সরকার সরব হয়।
অভাব আর অতিরিক্ত লোভ কিছু মানুষকে অন্ধ করে ফেলে। লটারি কিনে রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার বাসনা সবারই কম-বেশি রয়েছে। সস্তায় কিছু পাওয়া গেলে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে, সস্তা ডিমের জন্য ধাক্কাধাক্কি করে খামার বাড়িতে হাজার হাজার ডিম ভেঙে ফেলে, কসকরের সস্তা পণ্য পাওয়ার লোভে অফিসে উপস্থিতির স্বাক্ষরটা করেই ট্রাকের পেছনে লাইন ধরে, খিঁচুড়ি খাওয়ার জন্য বুভুক্ষুরা সকালে লাইন দিয়ে বিকাল পর্যন্ত নেতার উদ্বোধনের জন্য অপেক্ষা করে, যাকাতের একটি নিম্নমানের লুঙ্গি বা শাড়ির জন্য হুড়হুড়ি করে পদদলিত হয়ে মৃত্যুবরণ করে, শেষ সম্বল মুরগি আর ছাগল বিক্রি করে কোম্পানির শেয়ার কিনে ফকির হয়। অতি সহজে লাভ করার, অর্জন করার লোভ কিছু মানুষকে এত বেশি প্রলুব্ধ করে তোলে যে, তাদের হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়ে যায়, মিডিয়ার চটকদার বিজ্ঞপ্তিতে মানুষ হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে।
বিগত ২৫ বছর ধরে এদের ব্যাপারে সরকারগুলোকে অনেকটা নির্লিপ্ত মনে হয়েছে। এই সব ঠকবাজি ব্যবসা সনাক্ত করার জন্য সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত লোকজন কূম্ভকর্ণের মতো ঘুমিয়ে থাকে, হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হওয়ার পর তাদের ঘুম ভাঙে। ১৯৯৪ সনে যে ‘যুবক’-এর সৃষ্টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক তার কার্যক্রম বন্ধ করে ২০০৬ সনে। ২০০০ সনে যে ডেসটিনির শুরু আদালতের নির্দেশে ২০১৩ সনে সেই ডেসটিনির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকির দায়িত্ব পায় পুলিশ। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, তত্ত্বাবধায়ক এবং আবার আওয়ামী লীগ সরকারের আমল মিলিয়ে এক যুগ পার হওয়ার পর ডেসটিনিকে ২০১২ সনে ধরাটা যুক্তিসঙ্গত কি না- সে ব্যাপারেও প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে।
উক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর দায় এবং দুটোই আছে। দেশব্যাপী ডেসটিনির প্রচুর সম্পদ- বাড়ি, গাড়ি, প্লট-ফ্ল্যাট, সিনেমা হল, পাটকল, হিমাগার, টেলিভিশন চ্যানেল, গাছ, রাবার বাগান, বিজনেস সেন্টার নির্মাণের জমি, কক্সবাজারে হোটেল ও জমি, ধানি জমি ইত্যাদি। ২ হাজার ৫৮৮ কোটি ১১ লাখ টাকা দায়ের বিপরীতে যুবকের সম্পত্তির বাজারমূল্য হবে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। উদ্ভূত সমস্যার সমাধান দীর্ঘদিন ঝুলে থাকায় যুবক এবং ডেসটিনির সম্পদের বড় অংশই নষ্ট হচ্ছে, বেদখল হচ্ছে। এই সব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ব্যবসা করার পর মালিক বা মালিকদের আইনের আওতায় আনা হয়, কিন্তু এতে সমস্যার কোন সমাধান হয় না, বরং সমস্যার গভীরতা আরও বাড়ে। তাই গ্রাহকেরা রাস্তায় নেমে ইভ্যালির মালিকদের মুক্তি চায়। কারণ ভোক্তারা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে মনে করে, প্রতিষ্ঠানের মালিকদের জেলে রাখা হলে তাদের টাকা প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা বরং বেড়ে যায়।
আইনের মাধ্যমে একটি কোম্পানির অবসায়নপূর্বক অবসায়িত কোম্পানির সম্পদের বণ্টন প্রক্রিয়া সহজ নয়। প্রতারণার অভিযোগে যুব কর্মসংস্থান সোসাইটির (যুবক) কার্যক্রম ১৫ বছর পূর্বে বন্ধ করে দেয়া হলেও যুবকের তিন লক্ষাধিক গ্রাহক এখনও তাদের অর্থ ফেরত পায়নি। অন্যদিকে ডেসটিনির মামলা বিচারাধীন, বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছুই করার নেই। সম্ভবত এই বিবেচনায় সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত হলমার্কের গৃহীত নিয়ম বহির্ভূত ঋণ সমঝোতার মাধ্যমে আদায়ের পক্ষে ছিলেন; তার অভিমত ছিল, আইনি পদক্ষেপ নেয়া হলে বিষয়টি ঝুলে যাবে। সবাই তাকে তখন কঠোরভাবে সমালোচনা করেছিল। বাস্তবতা হচ্ছে, অপরাধীর শাস্তির চেয়ে গ্রাহকের কাছে তাদের টাকা পাওয়ার বিষয়টি বেশি জরুরি।
ইভ্যালি এক গ্রাহকের টাকা দিয়ে অন্য গ্রাহকের পণ্য কিনে সরবরাহ করত। জানা যায়, ইভ্যালি শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৭৫ লাখ পণ্য ডেলিভারি করেছে। কিন্তু পণ্যের মূল্যে ব্যাপক ছাড় দেয়ায় তাদের আয় এবং ব্যয়ের মধ্যে বিরাট গ্যাপের সৃষ্টি হয়। বিস্মিত হতে হয় তখন যখন দেখি বিপুল অর্থ ডিসকাউন্ট দিয়েও ইভ্যালি ৭৫ লাখ পণ্য গ্রাহকদের সরবরাহ করতে সক্ষম হয়েছে। পণ্য ডিসকাউন্টের পরিমাণ বিবেচনায় নিলে এই কোম্পানিটির বহু আগেই দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার কথা। এক টাকার পণ্য ৫০ পয়সায় বিক্রি করে কোন প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে পারে এমন উদ্ভট চিন্তা একমাত্র আহাম্মকেরাই করতে পারে।
বর্তমান বিশ্বে ই-কমার্স ছাড়া চলবে না। প্রতারণার লক্ষে প্রতিষ্ঠিত এমএলএম কোম্পানিগুলোর ব্যবসার প্রধান অস্ত্র হচ্ছে, আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন প্রচারপূর্বক ওজনদার ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়ে জনসাধারণের বিশ্বাস ও আস্থা তৈরি করা। অবসর নেয়ার পর বড় বড় সেনা কর্মকর্তা এবং আমলা এই সকল প্রতিষ্ঠানে ‘পরামর্শক’ হিসেবে চাকরি করেন, এদের নাম থাকলে প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ে। জুনিয়র কলিগদের কাছে গিয়ে কাজ ভাগানোর দালালি করাই এদের কাজ। অন্যদিকে বড় বড় তারকারা যখন বিজ্ঞাপনে অংশ নিয়ে এমএলএম কোম্পানিগুলোর পক্ষে কথা বলেন, তখন ওই কোম্পানিগুলোকে জনসাধারণের অবিশ্বাস করার কোন কারণ থাকে না।
ডেসটিনির ঠকবাজি ব্যবসা উন্মোচিত হওয়ার পর ধারণা করেছিলাম, লোকজনের শিক্ষা হয়েছে, আর ওমুখো হবে না; কিন্তু না, পরের ঠকবাজি কোম্পানিগুলোতে আরও বিপুল সংখ্যক মানুষ জড়িত হয়েছে, মনে হচ্ছে ভবিষ্যতেও হবে। লোভনীয় বিজ্ঞপ্তিতে মানুষ অভিভূত হচ্ছে এবং অল্প টাকা দিয়ে অধিক টাকা লাভের স্বপ্ন মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত হতেই থাকবে। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের লুটপাট-প্রতারণার দায় সরকার নেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু ২০১৯ সনের নভেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তৎকালীন মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক ‘এসক্রো সেবা’ চালু হলে হয়তো অর্থ তছরূপের ঘটনা ঘটতো না। ‘এসক্রো সেবা’ ব্যবস্থায় গ্রাহক পণ্য হাতে পাওয়ার পর ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের টাকা পরিশোধ হওয়ার কথা; তার আগে গ্রাহকের পরিশোধিত টাকা জমা থাকবে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত কোন প্রতিষ্ঠানের কাছে। দরকারি একটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে কত বছর লাগে? প্রশাসনের এমন শিথিল কর্মকান্ডের জন্য কোন ব্যবস্থা কারো বিরুদ্ধে কখনো নেয়া হয়েছে বলে শোনা যায়নি। মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে প্রতারক প্রতারণা করবে, আর সরকার বলবে ‘আমরা দায় নেব না’- এটা প্রজ্ঞাবান সরকারের কথা নয়, এমন ঠকবাজির দায় সরকারকেই নিতে হবে, নতুবা ঠকবাজি বন্ধ করতে হবে।
[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]
ahmedzeauddin0@gmail.com
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
শনিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২১
পাকিস্তান আমল থেকেই ‘হায় হায় কোম্পানি’র নাম শুনে আসছি, কিন্তু এর অর্থ তখন বুঝিনি। ‘ডেস্টিনি ২০০০’-এর বিরুদ্ধে সরকারের ব্যবস্থা নেয়ার পর সবাই জানতে পারল এরা একটি বড় মাপের প্রতারক। তারপর বেরিয়ে এলো ‘যুবক’। সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে ‘ইভ্যালি’, ‘ই অরেঞ্জ’ ইত্যাদি ঠকবাজ প্রতিষ্ঠানের কথা। শুধু ইভ্যালি বা ই-অরেঞ্জ নয়, আরও বহু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের কেনা পণ্য সরবরাহ করছে না, টাকাও ফেরত দিচ্ছে না। মফস্বল শহরেও এমন ঠকবাজ কোম্পানির কথা ইদানীং অহর্নিশ শোনা যায়; গরিব লোকগুলোর সব সঞ্চয় নিয়ে হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে যাওয়ার পর মিডিয়া ও সরকার সরব হয়।
অভাব আর অতিরিক্ত লোভ কিছু মানুষকে অন্ধ করে ফেলে। লটারি কিনে রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার বাসনা সবারই কম-বেশি রয়েছে। সস্তায় কিছু পাওয়া গেলে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে, সস্তা ডিমের জন্য ধাক্কাধাক্কি করে খামার বাড়িতে হাজার হাজার ডিম ভেঙে ফেলে, কসকরের সস্তা পণ্য পাওয়ার লোভে অফিসে উপস্থিতির স্বাক্ষরটা করেই ট্রাকের পেছনে লাইন ধরে, খিঁচুড়ি খাওয়ার জন্য বুভুক্ষুরা সকালে লাইন দিয়ে বিকাল পর্যন্ত নেতার উদ্বোধনের জন্য অপেক্ষা করে, যাকাতের একটি নিম্নমানের লুঙ্গি বা শাড়ির জন্য হুড়হুড়ি করে পদদলিত হয়ে মৃত্যুবরণ করে, শেষ সম্বল মুরগি আর ছাগল বিক্রি করে কোম্পানির শেয়ার কিনে ফকির হয়। অতি সহজে লাভ করার, অর্জন করার লোভ কিছু মানুষকে এত বেশি প্রলুব্ধ করে তোলে যে, তাদের হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়ে যায়, মিডিয়ার চটকদার বিজ্ঞপ্তিতে মানুষ হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে।
বিগত ২৫ বছর ধরে এদের ব্যাপারে সরকারগুলোকে অনেকটা নির্লিপ্ত মনে হয়েছে। এই সব ঠকবাজি ব্যবসা সনাক্ত করার জন্য সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত লোকজন কূম্ভকর্ণের মতো ঘুমিয়ে থাকে, হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হওয়ার পর তাদের ঘুম ভাঙে। ১৯৯৪ সনে যে ‘যুবক’-এর সৃষ্টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক তার কার্যক্রম বন্ধ করে ২০০৬ সনে। ২০০০ সনে যে ডেসটিনির শুরু আদালতের নির্দেশে ২০১৩ সনে সেই ডেসটিনির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকির দায়িত্ব পায় পুলিশ। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, তত্ত্বাবধায়ক এবং আবার আওয়ামী লীগ সরকারের আমল মিলিয়ে এক যুগ পার হওয়ার পর ডেসটিনিকে ২০১২ সনে ধরাটা যুক্তিসঙ্গত কি না- সে ব্যাপারেও প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে।
উক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর দায় এবং দুটোই আছে। দেশব্যাপী ডেসটিনির প্রচুর সম্পদ- বাড়ি, গাড়ি, প্লট-ফ্ল্যাট, সিনেমা হল, পাটকল, হিমাগার, টেলিভিশন চ্যানেল, গাছ, রাবার বাগান, বিজনেস সেন্টার নির্মাণের জমি, কক্সবাজারে হোটেল ও জমি, ধানি জমি ইত্যাদি। ২ হাজার ৫৮৮ কোটি ১১ লাখ টাকা দায়ের বিপরীতে যুবকের সম্পত্তির বাজারমূল্য হবে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। উদ্ভূত সমস্যার সমাধান দীর্ঘদিন ঝুলে থাকায় যুবক এবং ডেসটিনির সম্পদের বড় অংশই নষ্ট হচ্ছে, বেদখল হচ্ছে। এই সব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ব্যবসা করার পর মালিক বা মালিকদের আইনের আওতায় আনা হয়, কিন্তু এতে সমস্যার কোন সমাধান হয় না, বরং সমস্যার গভীরতা আরও বাড়ে। তাই গ্রাহকেরা রাস্তায় নেমে ইভ্যালির মালিকদের মুক্তি চায়। কারণ ভোক্তারা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে মনে করে, প্রতিষ্ঠানের মালিকদের জেলে রাখা হলে তাদের টাকা প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা বরং বেড়ে যায়।
আইনের মাধ্যমে একটি কোম্পানির অবসায়নপূর্বক অবসায়িত কোম্পানির সম্পদের বণ্টন প্রক্রিয়া সহজ নয়। প্রতারণার অভিযোগে যুব কর্মসংস্থান সোসাইটির (যুবক) কার্যক্রম ১৫ বছর পূর্বে বন্ধ করে দেয়া হলেও যুবকের তিন লক্ষাধিক গ্রাহক এখনও তাদের অর্থ ফেরত পায়নি। অন্যদিকে ডেসটিনির মামলা বিচারাধীন, বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছুই করার নেই। সম্ভবত এই বিবেচনায় সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত হলমার্কের গৃহীত নিয়ম বহির্ভূত ঋণ সমঝোতার মাধ্যমে আদায়ের পক্ষে ছিলেন; তার অভিমত ছিল, আইনি পদক্ষেপ নেয়া হলে বিষয়টি ঝুলে যাবে। সবাই তাকে তখন কঠোরভাবে সমালোচনা করেছিল। বাস্তবতা হচ্ছে, অপরাধীর শাস্তির চেয়ে গ্রাহকের কাছে তাদের টাকা পাওয়ার বিষয়টি বেশি জরুরি।
ইভ্যালি এক গ্রাহকের টাকা দিয়ে অন্য গ্রাহকের পণ্য কিনে সরবরাহ করত। জানা যায়, ইভ্যালি শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৭৫ লাখ পণ্য ডেলিভারি করেছে। কিন্তু পণ্যের মূল্যে ব্যাপক ছাড় দেয়ায় তাদের আয় এবং ব্যয়ের মধ্যে বিরাট গ্যাপের সৃষ্টি হয়। বিস্মিত হতে হয় তখন যখন দেখি বিপুল অর্থ ডিসকাউন্ট দিয়েও ইভ্যালি ৭৫ লাখ পণ্য গ্রাহকদের সরবরাহ করতে সক্ষম হয়েছে। পণ্য ডিসকাউন্টের পরিমাণ বিবেচনায় নিলে এই কোম্পানিটির বহু আগেই দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার কথা। এক টাকার পণ্য ৫০ পয়সায় বিক্রি করে কোন প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে পারে এমন উদ্ভট চিন্তা একমাত্র আহাম্মকেরাই করতে পারে।
বর্তমান বিশ্বে ই-কমার্স ছাড়া চলবে না। প্রতারণার লক্ষে প্রতিষ্ঠিত এমএলএম কোম্পানিগুলোর ব্যবসার প্রধান অস্ত্র হচ্ছে, আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন প্রচারপূর্বক ওজনদার ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়ে জনসাধারণের বিশ্বাস ও আস্থা তৈরি করা। অবসর নেয়ার পর বড় বড় সেনা কর্মকর্তা এবং আমলা এই সকল প্রতিষ্ঠানে ‘পরামর্শক’ হিসেবে চাকরি করেন, এদের নাম থাকলে প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ে। জুনিয়র কলিগদের কাছে গিয়ে কাজ ভাগানোর দালালি করাই এদের কাজ। অন্যদিকে বড় বড় তারকারা যখন বিজ্ঞাপনে অংশ নিয়ে এমএলএম কোম্পানিগুলোর পক্ষে কথা বলেন, তখন ওই কোম্পানিগুলোকে জনসাধারণের অবিশ্বাস করার কোন কারণ থাকে না।
ডেসটিনির ঠকবাজি ব্যবসা উন্মোচিত হওয়ার পর ধারণা করেছিলাম, লোকজনের শিক্ষা হয়েছে, আর ওমুখো হবে না; কিন্তু না, পরের ঠকবাজি কোম্পানিগুলোতে আরও বিপুল সংখ্যক মানুষ জড়িত হয়েছে, মনে হচ্ছে ভবিষ্যতেও হবে। লোভনীয় বিজ্ঞপ্তিতে মানুষ অভিভূত হচ্ছে এবং অল্প টাকা দিয়ে অধিক টাকা লাভের স্বপ্ন মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত হতেই থাকবে। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের লুটপাট-প্রতারণার দায় সরকার নেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু ২০১৯ সনের নভেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তৎকালীন মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক ‘এসক্রো সেবা’ চালু হলে হয়তো অর্থ তছরূপের ঘটনা ঘটতো না। ‘এসক্রো সেবা’ ব্যবস্থায় গ্রাহক পণ্য হাতে পাওয়ার পর ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের টাকা পরিশোধ হওয়ার কথা; তার আগে গ্রাহকের পরিশোধিত টাকা জমা থাকবে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত কোন প্রতিষ্ঠানের কাছে। দরকারি একটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে কত বছর লাগে? প্রশাসনের এমন শিথিল কর্মকান্ডের জন্য কোন ব্যবস্থা কারো বিরুদ্ধে কখনো নেয়া হয়েছে বলে শোনা যায়নি। মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে প্রতারক প্রতারণা করবে, আর সরকার বলবে ‘আমরা দায় নেব না’- এটা প্রজ্ঞাবান সরকারের কথা নয়, এমন ঠকবাজির দায় সরকারকেই নিতে হবে, নতুবা ঠকবাজি বন্ধ করতে হবে।
[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]
ahmedzeauddin0@gmail.com