alt

উপ-সম্পাদকীয়

স্মরণ

নয়ন সমুখে তুমি নেই

জয়ন্তী রায়

: শনিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২১
image

‘নয়ন সমুখে তুমি নেই/নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই’-

দেখতে দেখতে ৫টি বছর কীভাবে চলে গেল। এবার তার পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৬ সালের ১৭ অক্টোবর ৮৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন অজয় রায়। অজয় রায় ছিলেন বাংলাদেশের বাম-প্রগতিশীল রাজনীতির এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। নিজে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও দেশের সংখ্যাধিক গরিব দুঃখী মানুষের দুর্দশা মোচনের সংগ্রামের সঙ্গে একাত্ম হয়েছিলেন সেই তরুণ বয়সেই। মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা তাকে কষ্ট সহ্য করার, প্রতিকূলতার মধ্যেও দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করার আত্মপ্রত্যয় জুগিয়েছিল। অন্যের জন্য নিজের জীবনের সুখ বিসর্জন দেয়া সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। অজয় রায় সেটা সম্ভব করেছিলেন বলেই তিনি এক অসাধারণ গুণের মানুষ হিসেবে সব মহলেই স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। দেশের জন্যই তিনি ১৫ বছর কারাগারে কাটিয়েছেন, বছরের পর বছর কাটিয়েছেন আত্মগোপনে।

অজয় রায় ১৯২৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানে তার মাতামহ মদন দত্ত আইন ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলেন। তার পৈত্রিক বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি উপজেলার বনগ্রামে। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে অজয় রায় ছিলেন সবার বড়। তার বাবা ড. প্রমথ নাথ রায় ছিলেন ভারতের বানারসি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশি ভাষার অধ্যাপক। তিনি একাধিক ভাষায় সুপন্ডিত ছিলেন। মা কল্যাণী রায় ছিলেন গৃহবধূ। অজয় রায়ের প্রাথমিক শিক্ষা জীবন বারানসীতেই শুরু। বারানসী বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ১৯৪৫ সালে আইএসসি পাস করেন। বারানসীতেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন এবং সক্রিয় কমিউনিস্ট হয়ে ওঠেন।

১৯৪৮ সালে তিনি বিকম পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরমধ্যে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কার্যক্রম থেকে সরে না গিয়ে বরং আরও বেশি সক্রিয় হন। ছাত্র জীবন থেকেই তার জেলজীবনও শুরু হয়। বিকম পাস করে কিছুদিন একটি হাই স্কুলে শিক্ষকতাও করেছেন। পাকিস্তানের প্রায় পুরোটা সময় তার কেটেছে কারাগারে। জেল থেকে পরীক্ষা দিয়েই তিনি অর্থনীতিতে কৃতিত্বের সঙ্গে এমএ পাস করেছিলেন।

সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পর মার্কসবাদী তত্ত্বের সঠিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় নতুন ভাবনা-চিন্তার বিষয়টি সামনে আসে। শৈশব-কৈশোর থেকে যে মার্কসীয় দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে অজয় রায় মানবমুক্তির সংগ্রাম এগিয়ে নিতে যোগ দিয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিবির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিও ভেঙে যায়। এই ভাঙনে অজয় রায় পক্ষ নিলেন সংস্কারবাদীদের। তিনি ছিলেন নেতা, কাজেই বলা যায় তিনি পার্টি ভাঙনে আরও অনেককে নিয়ে নেতৃতৃ দিলেন। এরপর আমৃত্যু অজয় রায়ের কেটেছে এক ধরনের অস্থিরতার মধ্য দিয়ে। কাজের ক্ষেত্র খুঁজেছেন, সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। কতটুকু সফল হয়েছেন সে বিচার এখনই নয়। তিনি ছিলেন চিন্তাশীল প্রগতিকামী সদাসক্রিয় মানুষ। মানবকল্যাণ, মানবমুক্তির যে স্বপ্ন নিয়ে কৈশোরকালেই নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন রাজনীতিতে সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা থেকে কখনই বিরত থাকেননি। নানা ধরনের উদ্যোগের সঙ্গে জড়িয়েছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত স্থিতু হয়েছিলেন সামাজিক আন্দোলন নামের একটি সংগঠনে। সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদবিরোধী একটি জাতীয় মঞ্চ গড়ে তুলতেও তিনি ভূমিকা পালন করেছিলেন।

রাজনীতি নয়- বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাই ছিল অজয় রায়ের উপযুক্ত ক্ষেত্র। তার লেখা বইয়ের সংখ্যা ২০টি। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : বাঙলা ও বাঙালি, বাংলাদেশের অর্থনীতির অতীত ও বর্তমান, বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থার সংকট ও সমাধান, বাংলার কৃষক বিদ্রোহ, রাজনীতির অ আ ক খ, আমাদের জাতীয় বিকাশের ধারা, বাংলাদেশের বামপন্থি আন্দোলন ইত্যাদি। তীরের অন্বেষায় নামে একটি আত্মজৈবনিক গ্রন্থও তিনি লিখেছেন। বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে তিনি নিয়মিত কলামও লিখতেন।

অজয় রায় মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। লাখো শহীদের আত্মদানে অর্জিত স্বদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ হবে- এটা ছিল অজয় রায়ের বিশ্বাস এবং লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনে নিজেও নানামুখী কাজ করেছেন। মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন আনার জন্য শিক্ষা-সংস্কৃতির বিস্তারে তিনি আগ্রহ নিয়ে কাজ করেছেন। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে থেকে মানুষকে সংগঠিত ও সচেতন করার কাজে শ্রম ও মেধা ব্যয় করেছেন।

গত শতকের নব্বইয়ের দশকের একপর্যায়ে মতাদর্শিক ভিন্নতায় তিনি কমিউনিস্ট পার্টি থেকে নিজেকে বিছিন্ন করলেও মুহূর্তের জন্যও মানুষের সঙ্গ ত্যাগ করেননি। তিনি সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলে সব ধরনের নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার কাজ করেছেন আমৃত্যু। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অপচেষ্টা যেখানেই দেখা গেছে সেখানেই তিনি পরিণত বয়সেও ছুটে গেছেন। জঙ্গিবাদ-মৌলবাদের উত্থানের বিপদ তিনি উপলব্ধি করতেন বলেই তার বিরুদ্ধে লেখালেখি করার পাশাপাশি রাজপথে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদও সংঘটিত করেছেন। তিনি ছিলেন সদাসক্রিয় মানুষ। প্রায় ৪৭ বছরের সংসার জীবনে অত্যন্ত কাছে থেকে তাকে দেখা ও বোঝার সুযোগ আমার হয়েছিল। মানুষের মঙ্গল চিন্তা ছাড়া তিনি আর কিছুই ভাবতেন না। এজন্য তার প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসার মানুষের সংখ্যাও কম নয়। তার শেষ শয্যা পাতা হয়েছে বনগ্রামের মাটিতে।

অজয় রায়কে স্মরণ করতে গিয়ে দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশের দিকে নজর দিলে মনে প্রশ্ন জাগে, অজয় রায়েরা কি এমন বাংলাদেশ চেয়েছিলেন? একটি সুন্দর দেশ-সাম্য, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে দেশই তো তার এবং তার মতো আরও আত্মত্যাগী রাজনীতিমনস্ক মানুষের মনে জাগ্রত ছিল। অথচ আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের কালে অনেকের মনেই জিজ্ঞাসা, একটি মানবিক দেশ আমরা গড়ে তুলতে পারলাম না কেন? কোথায় ত্রুটি, কোথায় ব্যর্থতা? অজয় রায়কে যারা ভালোবাসেন, তাকে যারা শ্রদ্ধা করেন, তাদের আজ আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন। নতুন প্রজন্মকে আলোকিত করা, তাদের সামনে সঠিক পথনির্দেশনা দেয়া আজ জাতীয় কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দেশের প্রতি মানুষের যে ভালোবাসা তা আদর্শবাদী রাজনীতির এক বড় দীক্ষা। একসময় অর্থনৈতিক ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির ভিত্তিতে রাজনীতিতে আদর্শিক অবস্থান নির্ধারিত হতো। এখন সব কিছুর ওপর প্রভাব ফেলছে ধর্মচিন্তা। নীতিগত অবস্থানের প্রতি নমনীয়তা দেখালেও ধর্মের প্রশ্নে কোন নমনীয়তা নেই। আদর্শচ্যুত হতে ভয় নেই। যত ভয় ভোট হারানোর। ভোটের রাজনীতির চোরাস্রোত মানুষকে কি আশা ও ভালোবাসা নিয়ে বাঁচার জন্য প্রাণিত করেছে? অজয় রায় দেশকে ভালোবেছিলেন যে আশা নিয়ে তা নতুন প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দেয়া না গেলে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোটা নিয়মের বৃত্তেই বাধা পড়বে।

[লেখক: অজয় রায়ের স্ত্রী]

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

tab

উপ-সম্পাদকীয়

স্মরণ

নয়ন সমুখে তুমি নেই

জয়ন্তী রায়

image

শনিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২১

‘নয়ন সমুখে তুমি নেই/নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই’-

দেখতে দেখতে ৫টি বছর কীভাবে চলে গেল। এবার তার পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৬ সালের ১৭ অক্টোবর ৮৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন অজয় রায়। অজয় রায় ছিলেন বাংলাদেশের বাম-প্রগতিশীল রাজনীতির এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। নিজে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও দেশের সংখ্যাধিক গরিব দুঃখী মানুষের দুর্দশা মোচনের সংগ্রামের সঙ্গে একাত্ম হয়েছিলেন সেই তরুণ বয়সেই। মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা তাকে কষ্ট সহ্য করার, প্রতিকূলতার মধ্যেও দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করার আত্মপ্রত্যয় জুগিয়েছিল। অন্যের জন্য নিজের জীবনের সুখ বিসর্জন দেয়া সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। অজয় রায় সেটা সম্ভব করেছিলেন বলেই তিনি এক অসাধারণ গুণের মানুষ হিসেবে সব মহলেই স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। দেশের জন্যই তিনি ১৫ বছর কারাগারে কাটিয়েছেন, বছরের পর বছর কাটিয়েছেন আত্মগোপনে।

অজয় রায় ১৯২৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানে তার মাতামহ মদন দত্ত আইন ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলেন। তার পৈত্রিক বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি উপজেলার বনগ্রামে। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে অজয় রায় ছিলেন সবার বড়। তার বাবা ড. প্রমথ নাথ রায় ছিলেন ভারতের বানারসি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশি ভাষার অধ্যাপক। তিনি একাধিক ভাষায় সুপন্ডিত ছিলেন। মা কল্যাণী রায় ছিলেন গৃহবধূ। অজয় রায়ের প্রাথমিক শিক্ষা জীবন বারানসীতেই শুরু। বারানসী বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ১৯৪৫ সালে আইএসসি পাস করেন। বারানসীতেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন এবং সক্রিয় কমিউনিস্ট হয়ে ওঠেন।

১৯৪৮ সালে তিনি বিকম পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরমধ্যে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কার্যক্রম থেকে সরে না গিয়ে বরং আরও বেশি সক্রিয় হন। ছাত্র জীবন থেকেই তার জেলজীবনও শুরু হয়। বিকম পাস করে কিছুদিন একটি হাই স্কুলে শিক্ষকতাও করেছেন। পাকিস্তানের প্রায় পুরোটা সময় তার কেটেছে কারাগারে। জেল থেকে পরীক্ষা দিয়েই তিনি অর্থনীতিতে কৃতিত্বের সঙ্গে এমএ পাস করেছিলেন।

সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পর মার্কসবাদী তত্ত্বের সঠিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় নতুন ভাবনা-চিন্তার বিষয়টি সামনে আসে। শৈশব-কৈশোর থেকে যে মার্কসীয় দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে অজয় রায় মানবমুক্তির সংগ্রাম এগিয়ে নিতে যোগ দিয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিবির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিও ভেঙে যায়। এই ভাঙনে অজয় রায় পক্ষ নিলেন সংস্কারবাদীদের। তিনি ছিলেন নেতা, কাজেই বলা যায় তিনি পার্টি ভাঙনে আরও অনেককে নিয়ে নেতৃতৃ দিলেন। এরপর আমৃত্যু অজয় রায়ের কেটেছে এক ধরনের অস্থিরতার মধ্য দিয়ে। কাজের ক্ষেত্র খুঁজেছেন, সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। কতটুকু সফল হয়েছেন সে বিচার এখনই নয়। তিনি ছিলেন চিন্তাশীল প্রগতিকামী সদাসক্রিয় মানুষ। মানবকল্যাণ, মানবমুক্তির যে স্বপ্ন নিয়ে কৈশোরকালেই নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন রাজনীতিতে সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা থেকে কখনই বিরত থাকেননি। নানা ধরনের উদ্যোগের সঙ্গে জড়িয়েছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত স্থিতু হয়েছিলেন সামাজিক আন্দোলন নামের একটি সংগঠনে। সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদবিরোধী একটি জাতীয় মঞ্চ গড়ে তুলতেও তিনি ভূমিকা পালন করেছিলেন।

রাজনীতি নয়- বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাই ছিল অজয় রায়ের উপযুক্ত ক্ষেত্র। তার লেখা বইয়ের সংখ্যা ২০টি। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : বাঙলা ও বাঙালি, বাংলাদেশের অর্থনীতির অতীত ও বর্তমান, বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থার সংকট ও সমাধান, বাংলার কৃষক বিদ্রোহ, রাজনীতির অ আ ক খ, আমাদের জাতীয় বিকাশের ধারা, বাংলাদেশের বামপন্থি আন্দোলন ইত্যাদি। তীরের অন্বেষায় নামে একটি আত্মজৈবনিক গ্রন্থও তিনি লিখেছেন। বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে তিনি নিয়মিত কলামও লিখতেন।

অজয় রায় মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। লাখো শহীদের আত্মদানে অর্জিত স্বদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ হবে- এটা ছিল অজয় রায়ের বিশ্বাস এবং লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনে নিজেও নানামুখী কাজ করেছেন। মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন আনার জন্য শিক্ষা-সংস্কৃতির বিস্তারে তিনি আগ্রহ নিয়ে কাজ করেছেন। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে থেকে মানুষকে সংগঠিত ও সচেতন করার কাজে শ্রম ও মেধা ব্যয় করেছেন।

গত শতকের নব্বইয়ের দশকের একপর্যায়ে মতাদর্শিক ভিন্নতায় তিনি কমিউনিস্ট পার্টি থেকে নিজেকে বিছিন্ন করলেও মুহূর্তের জন্যও মানুষের সঙ্গ ত্যাগ করেননি। তিনি সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলে সব ধরনের নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার কাজ করেছেন আমৃত্যু। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অপচেষ্টা যেখানেই দেখা গেছে সেখানেই তিনি পরিণত বয়সেও ছুটে গেছেন। জঙ্গিবাদ-মৌলবাদের উত্থানের বিপদ তিনি উপলব্ধি করতেন বলেই তার বিরুদ্ধে লেখালেখি করার পাশাপাশি রাজপথে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদও সংঘটিত করেছেন। তিনি ছিলেন সদাসক্রিয় মানুষ। প্রায় ৪৭ বছরের সংসার জীবনে অত্যন্ত কাছে থেকে তাকে দেখা ও বোঝার সুযোগ আমার হয়েছিল। মানুষের মঙ্গল চিন্তা ছাড়া তিনি আর কিছুই ভাবতেন না। এজন্য তার প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসার মানুষের সংখ্যাও কম নয়। তার শেষ শয্যা পাতা হয়েছে বনগ্রামের মাটিতে।

অজয় রায়কে স্মরণ করতে গিয়ে দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশের দিকে নজর দিলে মনে প্রশ্ন জাগে, অজয় রায়েরা কি এমন বাংলাদেশ চেয়েছিলেন? একটি সুন্দর দেশ-সাম্য, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে দেশই তো তার এবং তার মতো আরও আত্মত্যাগী রাজনীতিমনস্ক মানুষের মনে জাগ্রত ছিল। অথচ আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের কালে অনেকের মনেই জিজ্ঞাসা, একটি মানবিক দেশ আমরা গড়ে তুলতে পারলাম না কেন? কোথায় ত্রুটি, কোথায় ব্যর্থতা? অজয় রায়কে যারা ভালোবাসেন, তাকে যারা শ্রদ্ধা করেন, তাদের আজ আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন। নতুন প্রজন্মকে আলোকিত করা, তাদের সামনে সঠিক পথনির্দেশনা দেয়া আজ জাতীয় কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দেশের প্রতি মানুষের যে ভালোবাসা তা আদর্শবাদী রাজনীতির এক বড় দীক্ষা। একসময় অর্থনৈতিক ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির ভিত্তিতে রাজনীতিতে আদর্শিক অবস্থান নির্ধারিত হতো। এখন সব কিছুর ওপর প্রভাব ফেলছে ধর্মচিন্তা। নীতিগত অবস্থানের প্রতি নমনীয়তা দেখালেও ধর্মের প্রশ্নে কোন নমনীয়তা নেই। আদর্শচ্যুত হতে ভয় নেই। যত ভয় ভোট হারানোর। ভোটের রাজনীতির চোরাস্রোত মানুষকে কি আশা ও ভালোবাসা নিয়ে বাঁচার জন্য প্রাণিত করেছে? অজয় রায় দেশকে ভালোবেছিলেন যে আশা নিয়ে তা নতুন প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দেয়া না গেলে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোটা নিয়মের বৃত্তেই বাধা পড়বে।

[লেখক: অজয় রায়ের স্ত্রী]

back to top