alt

উপ-সম্পাদকীয়

প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন

সন্ধ্যা রানী সাহা

: বৃহস্পতিবার, ২১ অক্টোবর ২০২১
image

দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর দুর্বলতা দূর করতে চাই শিক্ষা ব্যবস্থার উৎকর্ষ সাধন ও গুণগতমান উন্নয়নের পরিকল্পনা প্রণয়ন। সাথে সাথে বাস্তবায়ন কৌশল নির্ধারণ করতে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নকৃত তথ্যাদি সংগ্রহকরণও আবশ্যক। সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের জন্য যথেষ্ট সংখ্যক পরিদর্শক নিযুক্ত করেছে। তাদের নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী বিদ্যালয়সমূহ পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করে উন্নয়ন সাধন করতে হয়। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। এর সাথে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। রয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতির প্রশ্ন। আরও আছে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দর্শনে উদ্বুদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি। শুধু লিখতে ও পড়তে পারা শেখানোই যথেষ্ট নয়। এ শিক্ষা কোনো কোনো শিক্ষার্থীর জীবনের শেষ শিক্ষাও হতে পারে। কাজেই এ শিক্ষা এমনভাবে প্রদান নিশ্চিত করা চাই যেন তা লাভ করে একজন শিক্ষার্থী সহজেই তার বাস্তব জীবনের সমস্যাদি সমাধান করতে পারে।

অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য নির্ধারিত ২৯টি প্রান্তিক যোগ্যতাই প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে পঙ্খানুপুঙ্খভাবে অর্জন করাতে হবে। আর এ দায়িত্ব শুধু শিক্ষকের একার নয়। তিনি যথাসময়ে বিদ্যালয়ে এলেন। যথাসময়ে চলেও গেলেন। মাঝে কী করলেন তা কেউ পরিবীক্ষণ করলেন না। অথবা মূল্যায়নও করলেন না। অথবা করলেও তা উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট কি না তাও খতিয়ে দেখা দরকার। অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন stake holder-দের মধ্যে একটা স্থায়ী joyfulness সৃষ্টি করা না যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। শিক্ষক বলেই শিক্ষার্থীদের শারীরিক/মানসিক শাস্তি প্রদান, ঊর্ধ্বতন বলেই নিম্নপদস্থদের হেয়প্রতিপন্ন করা, পক্ষপাতিত্ব করা এবং বিভাজন সৃষ্টি করা চলে না। নিম্নপদস্থরাও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ন্যয়সঙ্গত আদেশ-নিষেধ মানতে বাধ্য থাকবেন। একই বাজারে পণ্যসামগ্রী ক্রয় করে জীবন-যাপনকারী দিনমজুরের তুলনায় বহুগুণ বেশি বেতন-ভাতাদি গ্রহণের সচেষ্ট থাকা, সহকর্মীদের সহযোগিতা না করা এবং কর্মে দক্ষতা প্রদর্শনে অনীহা এসব কোনো পেশাদারের পক্ষে শোভনীয় নয়। এতে পরোক্ষভাবে রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানটির ক্ষতি করা হয়। অথচ রাষ্ট্র তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যেই বিভিন্ন পেশায় জনবল নিয়োগ করে থাকে।

তাই নিয়োগকৃত লোকদের কাছ থেকে সর্বোত্তম সেবা আদায় করতে রাষ্ট্রকে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নে পারদর্শী পরিদর্শক নিয়োগ করতে হয়। শুধু প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে নয়, সব ক্ষেত্রেই এ পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন অত্যাবশ্যক। এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও একজন মানুষকে লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহায়কের ভূমিকা পালন করে থাকে। যথাযথভাবে নিয়মিত পরিবীক্ষণ এবং মূল্যায়ন করা হলে সামাজিক বৈষম্য, দুর্নীতি, কর্মবিমুখতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, অপচয়, জনবিচ্ছিন্নতা ইত্যাদি থেকে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানসমূহকে মুক্ত রেখে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে জনসাধারণের জন্য সর্বোত্তম সেবা প্রদান নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। তাই শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয় বরঞ্চ সমাজের সব ক্ষেত্রে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের ব্যবস্থা জোরদারকরণ প্রয়োজন। রাষ্ট্রে বিরাজমান সামাজিক বৈষম্যের কারণে আয় অনুযায়ী পুষ্টির বিষয়েও আমাদের মধ্যে বিষমতা দেখা যায়। অপুষ্টিতে ভোগা আমাদের দেশের খেটে-খাওয়া দিনমজুরের সন্তানই বিশেষত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। তাই দৈনিক বিদ্যালয় থেকে পরিপূরক পুষ্টির ব্যবস্থা কীভাবে করা যায় কিংবা জনগণকে এ বিষয়ে কী পরামর্শ দেওয়া যায় সে সম্পর্কে সংশ্লিষ্টজনদের সাথে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টিও পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের সময় বিবেচনা করতে হবে। এসব অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুদের পাঠের মান নিম্ন হতে পারে।

শুধু শিক্ষককে পাঠের মান উন্নয়নের জন্য পরামর্শ দিয়েই বিদ্যালয় ত্যাগ করাকে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করা হয়েছে বলা যায় না। এখানে পরি অর্থ বিশেষভাবে আর বীক্ষণ অর্থ দেখা। এই দেখা শুধু চেয়ে দেখা নয়। এই দেখাকে একটা মূল্যবান বিষয়ে উপনীত করার নামই তো মূল্যায়ন। এর সাথে বাস্তবে হাতে কলমে কাজ করে উন্নয়ন সাধনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। রয়েছে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সম্পর্ক। তা বলে শিক্ষার্থীর শিখন দুর্বলতা রেখেই শিক্ষক সিলেবাস/পাঠপরিকল্পনা শেষ করবেন এমনও হতে দেওয়া চলবে না। আর এ কারণেই পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নকারী অর্থাৎ পরিদর্শকদেরও জবাবদিহিতার মধ্যে রাখা প্রয়োজন। পরিদর্শকরা তাদের প্রতিটি পরিবীক্ষণকে মূল্যায়ন করে করণীয়/ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী সে বিষয়ে নিয়মিতভাবে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্যাদি প্রতিবেদন আকারে পেশ করবেন। এক্ষেত্রে শুধুই ছক পূরণ আর facebook এ নিজেদের ছবি post যথেষ্ট নয়। কোন প্রকার ego problem এখানে প্রদর্শন চলবে না। পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের জন্য-

(ক) কোন কিছু গোপন না করে টাটকা তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।

(খ) তথ্য লোপাট না করে তথ্য প্রক্রিয়াকরণ করতে হবে।

(গ) তথ্য ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে হবে।

(ঘ) প্রতিবেদন লিখন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তা যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবরে প্রেরণ নিশ্চিত করতে হবে।

এ চারটি কাজে কোনরূপ গাফিলতি প্রদর্শন কোনভাবেই পরিদর্শনকে পূর্ণতা দান করে না। যেসব শিক্ষার্থীর পিতা-মাতা-অভিভাবক বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটিতে আসতে পারে না তারা বিদ্যালয় ব্যবস্থায় ক্ষমতাহীন। তাদের কাছে কেউ জবাবদিহি করতে দায়বদ্ধ নয়। সংখ্যায় তারা অধিক হলেও বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার মধ্যে ক্ষমতা না থাকায় তারা অসহায়। শিশু বিদ্যালয়ে কী শিখছে, বিদ্যালয়ে কী ঘটছে, শিক্ষকরা সময়মতো বিদ্যালয়ে আসছেন কিনা, পরিদর্শকরা নিয়মিত বিদ্যালয় পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন সম্পন্ন করছেন কিনা, অংশীদারিত্বের উন্নয়ন ঘটাতে তাদের বিদ্যালয়ে ডাকা হয় না কেন, বিদ্যালয়ের নানা কাজে তাদের সম্পৃক্ততা ও ভূমিকা পালনের সুযোগ কতটুকু সেসব তারা জানেন না।

বিদ্যালয় পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করে পরিদর্শক এসব সাধারণ জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে বিদ্যালয় থেকে উন্নত সেবা আদায়ে সচেষ্ট থাকবেন। পরিবীক্ষণ ও ল্যায়নকারী/পরিদর্শকরা নিরপেক্ষ হবেন। পরিদর্শক জনগণের অভিযোগের প্রেক্ষিতে এবং স্বীয় উদ্যোগে এ দুইভাবেই পরিবীক্ষণ এবং মূল্যায়নের জন্য বিদ্যালয়ে যাবেন। তিনি তার কাজ বিষয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারী হবেন। তিনি stake holder-দের সাথে সৃজনশীল মিথস্ক্রিয়ায় (creative interaction) পারদর্শী হবেন। কারণ-

(১) ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন তথ্যের প্রয়োজন হয়।

(২) পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন নীতি-নির্ধারণের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

(৩) পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নে প্রাপ্ত তথ্যগুলো বিদ্যালয়, শিখন শেখানো পদ্ধতি এবং শিক্ষার্থীদের অগ্রগতি সমন্ধে জনগণকে ধারণা দিতে সাহায্য করে।

(৪) ভবিষ্যতে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন কার্যক্রমে প্রাপ্ত সম্পদের বিষয়টি বিবেচনা করা আবশ্যক হতে পারে।

(৫) পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য তথ্য সরবারহ করে।

(৬) পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন অভিযোগ নিষ্পত্তিতে দ্রুতগতি আনয়ন করে।

(৭) বিদ্যালয়ের অচলবস্থা নিরসনে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।

পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন কার্যক্রম পাশাপাশি চলতে থাকলেও একে অন্যের সাথে সর্ম্পযুক্ত নয়। পরিবীক্ষণ হলো তথ্য সংগ্রহ সর্ম্পকিত একটি কাজ। মূল্যায়ন একটি বিচার প্রক্রিয়া। পরিবীক্ষণের পরে মূল্যায়নের প্রসঙ্গ আসে। পরিবীক্ষণ মূল্যায়নের জন্য প্রামাণ্য তথ্য সরবরাহ করে। যে বিষয়টি পরিবীক্ষণ করা হচ্ছে তা উদ্দেশ্যর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা সেটা বিবেচনা করাই হলো মূল্যায়নের কাজ।

পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের ক্ষেত্র অনেক বড়। দরিদ্র অভিভাবকদের আয়বৃদ্ধিমূলক কার্যাদির বিষয়েও এক্ষেত্রে দৃষ্টিপাত করতে হবে। প্রয়োজনে উপজেলা কৃষি অফিস, প্রাণিসম্পদ অফিস, সমাজসেবা অফিস, জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশলীর কার্যালয় ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় ইত্যাদি থেকেও বিদ্যালয় ক্যাচমেন্ট এরিয়ার অধিবাসীদের সেবা পেতে সহযোগিতা করা যায় পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে। পরিদর্শকরা স্বপ্রণোদিত হয়ে বিদ্যালয় এবং ক্যাচমেন্ট এরিয়া পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করে উন্নয়নে মনোযোগী হলে পেশাগত উৎকর্ষতা লাভ করবেন।

বিদ্যালয় পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন কাজে কতটা সময় ব্যয় করতে হবে এটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তথ্যাদি সংগ্রহে যথেষ্ট সময় লাগলেও শ্রেণীকাজে যেন কোন বিঘ্ন না ঘটে। শিক্ষার্থীর সম্মুখে শিক্ষককে কোনো ভুলের জন্য তেমন কিছু বলা যাবে না। শ্রেণীকাজ শেষে শ্রেণিকক্ষের বাইরে/অফিসকক্ষে প্রয়োজনীয় পরামর্শ/সহায়তা প্রদান করতে হবে। কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসজনিত কারণে বিদ্যালয় দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় শিশুরা একঘেয়ে হয়ে উঠেছিল। সূতরাং বিদ্যালয়গুলো রি-ওপেনিংকালে শিশুদের খোশ মেজাজে রেখে শ্রেণীকাজ পরিচালনা করা হচ্ছে কিনা তা পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করেও নিশ্চিত করতে হবে। পাঠ-পরিকল্পনা তৈরিকালে শিক্ষককে চৌকষ হতে হবে। শ্রেণীর বিভিন্ন level-এর শিক্ষার্থীর জন্য একই পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হলে প্রাইভেট না পড়তে পারা কিংবা নিরক্ষর পিতা-মাতা-অভিভাবকের সন্তান তেমন কিছু শিখতে পারবে না। বরাবরের মতো তারা পিছিয়েই যাবে। এর ফলে ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

প্রধান শিক্ষকও নিজ বিদ্যালয়ের গুণগতমান উন্নয়নে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন কার্যক্রম কীভাবে শক্তিশালী করা যায় তা চিহ্নিত করে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করতে পারেন। তিনি নিজেও তার বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিখন কাজে অংশগ্রহণ, শিখন যোগ্যতা অর্জন, শিক্ষার্থীর বিভিন্ন কাজ ও সামাজিক দায়িত্ব পালনের দক্ষতা অর্জন, সুনাগরিকের গুণাবলী অর্জন এসব বিষয়ে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করবেন। তিনি সহকারী শিক্ষক এবং নিজের নিয়মিত বিদ্যালয়ের উপস্থিতি, শ্রেণীকক্ষ-ব্যবস্থাপনা, শিক্ষকদের পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন, যথাসময়ে বিদ্যালয়ের সকল কার্যক্রম পরিচালনা করা, শিক্ষক অনুপস্থিতির হার স্বল্প কিনা, শিখন শেখানো কাজে শিক্ষক আস্থাশীল ও অঙ্গীকারবদ্ধ কিনা, সমাজ বিদ্যালয়টিকে own করেছে কিনা, অবকাঠামো সুরক্ষিত কিনা, শিক্ষার্থী উপস্থিতি সন্তোষজনক কিনা, এসব বিষয়ে নিয়মিতভাবে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করে তথ্যাদি নিজের নখদর্পণে রেখে উন্নয়ন সাধনে সচেষ্ট হতে পারেন।

আবার সহকারী শিক্ষকগণ নিজের শিখন শেখানো কার্যক্রম নিজেই পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করে উন্নয়ন সাধন করতে পারেন। তিনি গুণী শিক্ষকের পাঠদান পরিবীক্ষণ ও মুল্যায়নের মাধ্যমে নিজের শিখন শেখানো কার্যক্রমে পরিবর্তন আনতে পারেন। শিক্ষার্থীদের শিখন অগ্রগতি, আচরণগত দিক, আনন্দ-বেদনা ইত্যাদি সবই শিক্ষকরা পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। এমনকি শিক্ষার্থীরাও নিজেদের পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করতে পারে। তারা শিক্ষকদের পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করে থাকে শিক্ষকদের অজান্তেই।

আজকে আমাদের শিক্ষকগণ নানাবিধ প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকেন। এসব প্রশিক্ষণ কতটা ফলপ্রসূভাবে বিদ্যালয়ের উন্নয়ন সাধন করছে তাও পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। প্রশিক্ষণ প্রদানকারীরা সাধারণত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন। বিদ্যালয়ে তা কার্যকরভাবে ব্যবহার করে উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে কিনা, তা নিয়মিতভাবে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন না করা হলে সেসব প্রশিক্ষণে শুধু অর্থের এবং সময়ের অপচয় হয়। অধিকন্তু বিদ্যালয়ের নিয়মিত শিখন শেখানো কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটে।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭নং অনুচ্ছেদের ভিত্তিতে আইন দ্বারা পরিচালিত সবার জন্য বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার ধারাকে অগ্রসর করে একটি বিশ^মানের প্রাথমিক শিক্ষায় রূপায়নের লক্ষ্যে নিয়ে যাবার চেতনা আমাদের বিদ্যালয় পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নকারীদের সবার মধ্যে সমানভাবে লালন করা চাই।

সুতরাং আমরা দেখেছি যে, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকে সফল করতে গেলে তার নানাদিকের উন্নয়ন ধারাবাহিকভাবে চলমান রাখতে হবে। শক্তিশালী নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপনা, উন্নত শিখন শেখানো কার্যপ্রণালী, একাডেমিক-তত্ত্বাবধান, এলাকাবাসীর সম্পৃক্ততা, অনুকূল পরিবেশ এবং প্রয়োজনীয় সম্পদ বিদ্যালয়ের রয়েছে কিনা তা বিদ্যালয় পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের মাধ্যমে নিরূপণ করে পরিকল্পনামাফিক অগ্রসর হলেই কেবল এ করোনাকালে দ্রুততম সময়ে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব।

[লেখক : উপজেলা শিক্ষা অফিসার,

কামারখন্দ, সিরাজগঞ্জ]

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

tab

উপ-সম্পাদকীয়

প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন

সন্ধ্যা রানী সাহা

image

বৃহস্পতিবার, ২১ অক্টোবর ২০২১

দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর দুর্বলতা দূর করতে চাই শিক্ষা ব্যবস্থার উৎকর্ষ সাধন ও গুণগতমান উন্নয়নের পরিকল্পনা প্রণয়ন। সাথে সাথে বাস্তবায়ন কৌশল নির্ধারণ করতে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নকৃত তথ্যাদি সংগ্রহকরণও আবশ্যক। সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের জন্য যথেষ্ট সংখ্যক পরিদর্শক নিযুক্ত করেছে। তাদের নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী বিদ্যালয়সমূহ পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করে উন্নয়ন সাধন করতে হয়। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। এর সাথে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। রয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতির প্রশ্ন। আরও আছে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দর্শনে উদ্বুদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি। শুধু লিখতে ও পড়তে পারা শেখানোই যথেষ্ট নয়। এ শিক্ষা কোনো কোনো শিক্ষার্থীর জীবনের শেষ শিক্ষাও হতে পারে। কাজেই এ শিক্ষা এমনভাবে প্রদান নিশ্চিত করা চাই যেন তা লাভ করে একজন শিক্ষার্থী সহজেই তার বাস্তব জীবনের সমস্যাদি সমাধান করতে পারে।

অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য নির্ধারিত ২৯টি প্রান্তিক যোগ্যতাই প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে পঙ্খানুপুঙ্খভাবে অর্জন করাতে হবে। আর এ দায়িত্ব শুধু শিক্ষকের একার নয়। তিনি যথাসময়ে বিদ্যালয়ে এলেন। যথাসময়ে চলেও গেলেন। মাঝে কী করলেন তা কেউ পরিবীক্ষণ করলেন না। অথবা মূল্যায়নও করলেন না। অথবা করলেও তা উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট কি না তাও খতিয়ে দেখা দরকার। অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন stake holder-দের মধ্যে একটা স্থায়ী joyfulness সৃষ্টি করা না যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। শিক্ষক বলেই শিক্ষার্থীদের শারীরিক/মানসিক শাস্তি প্রদান, ঊর্ধ্বতন বলেই নিম্নপদস্থদের হেয়প্রতিপন্ন করা, পক্ষপাতিত্ব করা এবং বিভাজন সৃষ্টি করা চলে না। নিম্নপদস্থরাও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ন্যয়সঙ্গত আদেশ-নিষেধ মানতে বাধ্য থাকবেন। একই বাজারে পণ্যসামগ্রী ক্রয় করে জীবন-যাপনকারী দিনমজুরের তুলনায় বহুগুণ বেশি বেতন-ভাতাদি গ্রহণের সচেষ্ট থাকা, সহকর্মীদের সহযোগিতা না করা এবং কর্মে দক্ষতা প্রদর্শনে অনীহা এসব কোনো পেশাদারের পক্ষে শোভনীয় নয়। এতে পরোক্ষভাবে রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানটির ক্ষতি করা হয়। অথচ রাষ্ট্র তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যেই বিভিন্ন পেশায় জনবল নিয়োগ করে থাকে।

তাই নিয়োগকৃত লোকদের কাছ থেকে সর্বোত্তম সেবা আদায় করতে রাষ্ট্রকে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নে পারদর্শী পরিদর্শক নিয়োগ করতে হয়। শুধু প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে নয়, সব ক্ষেত্রেই এ পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন অত্যাবশ্যক। এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও একজন মানুষকে লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহায়কের ভূমিকা পালন করে থাকে। যথাযথভাবে নিয়মিত পরিবীক্ষণ এবং মূল্যায়ন করা হলে সামাজিক বৈষম্য, দুর্নীতি, কর্মবিমুখতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, অপচয়, জনবিচ্ছিন্নতা ইত্যাদি থেকে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানসমূহকে মুক্ত রেখে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে জনসাধারণের জন্য সর্বোত্তম সেবা প্রদান নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। তাই শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয় বরঞ্চ সমাজের সব ক্ষেত্রে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের ব্যবস্থা জোরদারকরণ প্রয়োজন। রাষ্ট্রে বিরাজমান সামাজিক বৈষম্যের কারণে আয় অনুযায়ী পুষ্টির বিষয়েও আমাদের মধ্যে বিষমতা দেখা যায়। অপুষ্টিতে ভোগা আমাদের দেশের খেটে-খাওয়া দিনমজুরের সন্তানই বিশেষত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। তাই দৈনিক বিদ্যালয় থেকে পরিপূরক পুষ্টির ব্যবস্থা কীভাবে করা যায় কিংবা জনগণকে এ বিষয়ে কী পরামর্শ দেওয়া যায় সে সম্পর্কে সংশ্লিষ্টজনদের সাথে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টিও পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের সময় বিবেচনা করতে হবে। এসব অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুদের পাঠের মান নিম্ন হতে পারে।

শুধু শিক্ষককে পাঠের মান উন্নয়নের জন্য পরামর্শ দিয়েই বিদ্যালয় ত্যাগ করাকে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করা হয়েছে বলা যায় না। এখানে পরি অর্থ বিশেষভাবে আর বীক্ষণ অর্থ দেখা। এই দেখা শুধু চেয়ে দেখা নয়। এই দেখাকে একটা মূল্যবান বিষয়ে উপনীত করার নামই তো মূল্যায়ন। এর সাথে বাস্তবে হাতে কলমে কাজ করে উন্নয়ন সাধনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। রয়েছে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সম্পর্ক। তা বলে শিক্ষার্থীর শিখন দুর্বলতা রেখেই শিক্ষক সিলেবাস/পাঠপরিকল্পনা শেষ করবেন এমনও হতে দেওয়া চলবে না। আর এ কারণেই পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নকারী অর্থাৎ পরিদর্শকদেরও জবাবদিহিতার মধ্যে রাখা প্রয়োজন। পরিদর্শকরা তাদের প্রতিটি পরিবীক্ষণকে মূল্যায়ন করে করণীয়/ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী সে বিষয়ে নিয়মিতভাবে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্যাদি প্রতিবেদন আকারে পেশ করবেন। এক্ষেত্রে শুধুই ছক পূরণ আর facebook এ নিজেদের ছবি post যথেষ্ট নয়। কোন প্রকার ego problem এখানে প্রদর্শন চলবে না। পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের জন্য-

(ক) কোন কিছু গোপন না করে টাটকা তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।

(খ) তথ্য লোপাট না করে তথ্য প্রক্রিয়াকরণ করতে হবে।

(গ) তথ্য ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে হবে।

(ঘ) প্রতিবেদন লিখন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তা যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবরে প্রেরণ নিশ্চিত করতে হবে।

এ চারটি কাজে কোনরূপ গাফিলতি প্রদর্শন কোনভাবেই পরিদর্শনকে পূর্ণতা দান করে না। যেসব শিক্ষার্থীর পিতা-মাতা-অভিভাবক বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটিতে আসতে পারে না তারা বিদ্যালয় ব্যবস্থায় ক্ষমতাহীন। তাদের কাছে কেউ জবাবদিহি করতে দায়বদ্ধ নয়। সংখ্যায় তারা অধিক হলেও বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার মধ্যে ক্ষমতা না থাকায় তারা অসহায়। শিশু বিদ্যালয়ে কী শিখছে, বিদ্যালয়ে কী ঘটছে, শিক্ষকরা সময়মতো বিদ্যালয়ে আসছেন কিনা, পরিদর্শকরা নিয়মিত বিদ্যালয় পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন সম্পন্ন করছেন কিনা, অংশীদারিত্বের উন্নয়ন ঘটাতে তাদের বিদ্যালয়ে ডাকা হয় না কেন, বিদ্যালয়ের নানা কাজে তাদের সম্পৃক্ততা ও ভূমিকা পালনের সুযোগ কতটুকু সেসব তারা জানেন না।

বিদ্যালয় পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করে পরিদর্শক এসব সাধারণ জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে বিদ্যালয় থেকে উন্নত সেবা আদায়ে সচেষ্ট থাকবেন। পরিবীক্ষণ ও ল্যায়নকারী/পরিদর্শকরা নিরপেক্ষ হবেন। পরিদর্শক জনগণের অভিযোগের প্রেক্ষিতে এবং স্বীয় উদ্যোগে এ দুইভাবেই পরিবীক্ষণ এবং মূল্যায়নের জন্য বিদ্যালয়ে যাবেন। তিনি তার কাজ বিষয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারী হবেন। তিনি stake holder-দের সাথে সৃজনশীল মিথস্ক্রিয়ায় (creative interaction) পারদর্শী হবেন। কারণ-

(১) ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন তথ্যের প্রয়োজন হয়।

(২) পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন নীতি-নির্ধারণের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

(৩) পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নে প্রাপ্ত তথ্যগুলো বিদ্যালয়, শিখন শেখানো পদ্ধতি এবং শিক্ষার্থীদের অগ্রগতি সমন্ধে জনগণকে ধারণা দিতে সাহায্য করে।

(৪) ভবিষ্যতে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন কার্যক্রমে প্রাপ্ত সম্পদের বিষয়টি বিবেচনা করা আবশ্যক হতে পারে।

(৫) পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য তথ্য সরবারহ করে।

(৬) পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন অভিযোগ নিষ্পত্তিতে দ্রুতগতি আনয়ন করে।

(৭) বিদ্যালয়ের অচলবস্থা নিরসনে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।

পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন কার্যক্রম পাশাপাশি চলতে থাকলেও একে অন্যের সাথে সর্ম্পযুক্ত নয়। পরিবীক্ষণ হলো তথ্য সংগ্রহ সর্ম্পকিত একটি কাজ। মূল্যায়ন একটি বিচার প্রক্রিয়া। পরিবীক্ষণের পরে মূল্যায়নের প্রসঙ্গ আসে। পরিবীক্ষণ মূল্যায়নের জন্য প্রামাণ্য তথ্য সরবরাহ করে। যে বিষয়টি পরিবীক্ষণ করা হচ্ছে তা উদ্দেশ্যর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা সেটা বিবেচনা করাই হলো মূল্যায়নের কাজ।

পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের ক্ষেত্র অনেক বড়। দরিদ্র অভিভাবকদের আয়বৃদ্ধিমূলক কার্যাদির বিষয়েও এক্ষেত্রে দৃষ্টিপাত করতে হবে। প্রয়োজনে উপজেলা কৃষি অফিস, প্রাণিসম্পদ অফিস, সমাজসেবা অফিস, জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশলীর কার্যালয় ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় ইত্যাদি থেকেও বিদ্যালয় ক্যাচমেন্ট এরিয়ার অধিবাসীদের সেবা পেতে সহযোগিতা করা যায় পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে। পরিদর্শকরা স্বপ্রণোদিত হয়ে বিদ্যালয় এবং ক্যাচমেন্ট এরিয়া পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করে উন্নয়নে মনোযোগী হলে পেশাগত উৎকর্ষতা লাভ করবেন।

বিদ্যালয় পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন কাজে কতটা সময় ব্যয় করতে হবে এটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তথ্যাদি সংগ্রহে যথেষ্ট সময় লাগলেও শ্রেণীকাজে যেন কোন বিঘ্ন না ঘটে। শিক্ষার্থীর সম্মুখে শিক্ষককে কোনো ভুলের জন্য তেমন কিছু বলা যাবে না। শ্রেণীকাজ শেষে শ্রেণিকক্ষের বাইরে/অফিসকক্ষে প্রয়োজনীয় পরামর্শ/সহায়তা প্রদান করতে হবে। কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসজনিত কারণে বিদ্যালয় দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় শিশুরা একঘেয়ে হয়ে উঠেছিল। সূতরাং বিদ্যালয়গুলো রি-ওপেনিংকালে শিশুদের খোশ মেজাজে রেখে শ্রেণীকাজ পরিচালনা করা হচ্ছে কিনা তা পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করেও নিশ্চিত করতে হবে। পাঠ-পরিকল্পনা তৈরিকালে শিক্ষককে চৌকষ হতে হবে। শ্রেণীর বিভিন্ন level-এর শিক্ষার্থীর জন্য একই পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হলে প্রাইভেট না পড়তে পারা কিংবা নিরক্ষর পিতা-মাতা-অভিভাবকের সন্তান তেমন কিছু শিখতে পারবে না। বরাবরের মতো তারা পিছিয়েই যাবে। এর ফলে ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

প্রধান শিক্ষকও নিজ বিদ্যালয়ের গুণগতমান উন্নয়নে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন কার্যক্রম কীভাবে শক্তিশালী করা যায় তা চিহ্নিত করে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করতে পারেন। তিনি নিজেও তার বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিখন কাজে অংশগ্রহণ, শিখন যোগ্যতা অর্জন, শিক্ষার্থীর বিভিন্ন কাজ ও সামাজিক দায়িত্ব পালনের দক্ষতা অর্জন, সুনাগরিকের গুণাবলী অর্জন এসব বিষয়ে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করবেন। তিনি সহকারী শিক্ষক এবং নিজের নিয়মিত বিদ্যালয়ের উপস্থিতি, শ্রেণীকক্ষ-ব্যবস্থাপনা, শিক্ষকদের পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন, যথাসময়ে বিদ্যালয়ের সকল কার্যক্রম পরিচালনা করা, শিক্ষক অনুপস্থিতির হার স্বল্প কিনা, শিখন শেখানো কাজে শিক্ষক আস্থাশীল ও অঙ্গীকারবদ্ধ কিনা, সমাজ বিদ্যালয়টিকে own করেছে কিনা, অবকাঠামো সুরক্ষিত কিনা, শিক্ষার্থী উপস্থিতি সন্তোষজনক কিনা, এসব বিষয়ে নিয়মিতভাবে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করে তথ্যাদি নিজের নখদর্পণে রেখে উন্নয়ন সাধনে সচেষ্ট হতে পারেন।

আবার সহকারী শিক্ষকগণ নিজের শিখন শেখানো কার্যক্রম নিজেই পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করে উন্নয়ন সাধন করতে পারেন। তিনি গুণী শিক্ষকের পাঠদান পরিবীক্ষণ ও মুল্যায়নের মাধ্যমে নিজের শিখন শেখানো কার্যক্রমে পরিবর্তন আনতে পারেন। শিক্ষার্থীদের শিখন অগ্রগতি, আচরণগত দিক, আনন্দ-বেদনা ইত্যাদি সবই শিক্ষকরা পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। এমনকি শিক্ষার্থীরাও নিজেদের পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করতে পারে। তারা শিক্ষকদের পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করে থাকে শিক্ষকদের অজান্তেই।

আজকে আমাদের শিক্ষকগণ নানাবিধ প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকেন। এসব প্রশিক্ষণ কতটা ফলপ্রসূভাবে বিদ্যালয়ের উন্নয়ন সাধন করছে তাও পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। প্রশিক্ষণ প্রদানকারীরা সাধারণত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন। বিদ্যালয়ে তা কার্যকরভাবে ব্যবহার করে উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে কিনা, তা নিয়মিতভাবে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন না করা হলে সেসব প্রশিক্ষণে শুধু অর্থের এবং সময়ের অপচয় হয়। অধিকন্তু বিদ্যালয়ের নিয়মিত শিখন শেখানো কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটে।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭নং অনুচ্ছেদের ভিত্তিতে আইন দ্বারা পরিচালিত সবার জন্য বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার ধারাকে অগ্রসর করে একটি বিশ^মানের প্রাথমিক শিক্ষায় রূপায়নের লক্ষ্যে নিয়ে যাবার চেতনা আমাদের বিদ্যালয় পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নকারীদের সবার মধ্যে সমানভাবে লালন করা চাই।

সুতরাং আমরা দেখেছি যে, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকে সফল করতে গেলে তার নানাদিকের উন্নয়ন ধারাবাহিকভাবে চলমান রাখতে হবে। শক্তিশালী নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপনা, উন্নত শিখন শেখানো কার্যপ্রণালী, একাডেমিক-তত্ত্বাবধান, এলাকাবাসীর সম্পৃক্ততা, অনুকূল পরিবেশ এবং প্রয়োজনীয় সম্পদ বিদ্যালয়ের রয়েছে কিনা তা বিদ্যালয় পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের মাধ্যমে নিরূপণ করে পরিকল্পনামাফিক অগ্রসর হলেই কেবল এ করোনাকালে দ্রুততম সময়ে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব।

[লেখক : উপজেলা শিক্ষা অফিসার,

কামারখন্দ, সিরাজগঞ্জ]

back to top