জিয়াউদ্দীন আহমেদ
কুমিল্লা শহরের নানুয়া দীঘির পাড়ে একটি দুর্গাপূজার মন্ডপে হনুমান মূর্তির কোলে পবিত্র কোরআন রাখার একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে; ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে পূজামন্ডপ ভাঙচুর শুরু হয়। স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জমান খান কামাল পূজা শুরু হওয়ার পূর্বে বলেছিলেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সজাগ রয়েছে, পুজামন্ডপগুলোতে কোন ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই। দেশের শান্তি রক্ষায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চেয়ে ক্ষমতাবান আর কেউ নেই; স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়ে হিন্দুদের মার খেতে হলো। পুলিশের তরফ থেকে বলা হয়েছে, এবারের দুর্গাপূজায় তারা কোন ঝুঁকি দেখছেন না, তবুও তারা নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছেন। নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা বা তিন-চার স্তরের নিরাপত্তাটা কী জিনিস তা আমাদের মাথায় এখনও ঢুকেনি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেছেন, বাংলাদেশের মুসলমানরা ধর্মভীরু, ধর্মান্ধ নয়; এই কথাটি অনেকেই বলেন যা চরম অসত্য এবং তাৎপর্যহীন। মন্ত্রী মহোদয়সহ যারা বলেন, বাংলাদেশের মুসলানেরা ধর্মান্ধ নয়, তাদের কাছে একটি বিনীত জিজ্ঞাসা, আমাদের বাংলাদেশের মানুষ ধর্মান্ধ না হলে পূজামন্ডপে পুলিশ বহাল রাখার প্রয়োজন কি? মসজিদ বা ইদগাহে তো পুলিশ থাকে না। মসজিদ বা ঈদগাহে পুলিশের প্রয়োজন না হলে পুজা মন্ডপে পুলিশ লাগে কেন?
কোন ইমানদার মুসলমানের এমন কাজ করার কথা নয়; কারণ কোরআন মুসলমানের কাছে সবচেয়ে পবিত্র গ্রন্থ; এই অপকর্মটি করেছে নাকি ৩৫ বছরের যুবক ইকবাল হোসেন। এই অপকর্মের পরিকল্পনায় কারা ছিল তা ইকবালের গ্রেপ্তারের পর হয়তো জানা যাবে। যে সব উগ্র মুসলিম পুজামন্ডপ ভেঙেছে, মানুষ পিটিয়ে মেরেছে তারাও বোধ হয় ইকবালের মতো নামধারী মুসলমান; নতুবা তারা কেন অনুধাবন করলো না, দেবদেবীর ঘোরবিরোধী কোরআন রেখে হিন্দুরা নিজেদের পুজা নষ্ট করতে পারে না। উপরন্তু কোন হিন্দুর কোরআনকে অবমাননা করার ইচ্ছা থাকলে সে কোরআনকে হনুমানের কোলের ওপর না রেখে তার পায়ের নিচে রাখতো। উগ্র মুসলমানদের উর্বর মস্তিষ্কে যদি মনেও হতো যে, এই অপকর্ম কোন হিন্দু করেছে, তাহলেও তো নবীজীর বিদায় হজের বাণী (‘হে মানবমন্ডলী, পিতার অপরাধে পুত্র দায়ী হবে না এবং পুত্রের অপরাধে কোন পিতাকে দায়ী করা হবে না’) অনুযায়ী বাংলাদেশের সব হিন্দু দায়ী হতে পারে না; কিন্তু দাঙ্গাবাজ ক্ষেপা ধর্মান্ধদের এটা বোঝাবে কে? কিছু শিক্ষিত লোক দেশ এবং বিদেশ থেকে কিছুদিন ধরে প্রচার করছেন, কোরআন রাখার ষড়যন্ত্র করেছে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা, কারণ ভারত আমাদের উন্নয়ন কর্মকান্ডে ঈর্ষান্বিত- উম্মাদের প্রলাপ।
ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় হিন্দুদের ওপর অনেকগুলো সংঘবদ্ধ আক্রমণ হয়ে গেছে। আমার নিজ জেলা ফেনীতেও হয়েছে। প্রতিমা আর পুজামন্ডপ ভাঙার জেহাদি জোশে উন্মত্ত কয়েকজন যুবককের স্লোগান ছিল, ‘নারায়ে তাকবির ... আল্লাহু আকবার’, ‘ইসলামের আলো, ঘরে ঘরে জ্বালো’। ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ, নবী, অবতার, উপসনালয় ইত্যাদির অবমাননার গুজবে পৃথিবীব্যাপী কোটি কোটি লোকের প্রাণ গিয়েছে, লক্ষ লক্ষ লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে, লাখ লাখ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছে- কিন্তু অসভ্য মানুষগুলোর বোধোদয় এখনও হয়নি, হবে বলেও মনে হয় না; পৃথিবীর ইতিহাসে শুরু থেকে আজ পর্যন্ত সংঘটিত বেশিরভাগ খুনাখুনির প্রধান কারণ ধর্ম এবং জাতিগত বিদ্বেষ। দাঙ্গার বিভিন্ন ঘটনাগুলো পর্যালাচনা করলে প্রতীয়মান হয়, যারা ধর্মের প্রতি একনিষ্ঠ নয়, আচার-অনুষ্ঠানে নিয়মিত নয় তাদের ধর্মানুভূতি একটু বেশি প্রখর। জাফর ইকবাল তার একটি গল্পের চরিত্রের নাম নির্বাচন করেছিলেন ‘সোলায়মান’; এতে একজন যুবকের ধর্মানুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়, সেই যুবক সোজা গিয়ে জাফর ইকবালের শরীরে ছুরি চালিয়ে দেয়। ব্লগার নাম দিয়ে ইতোমধ্যে যাদের খুন করা হয়েছে তাদের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলেও প্রতীয়মান হয়, ধর্মগ্রন্থ এবং ধর্মসংশ্লিষ্ট কোন প্রতিষ্ঠিত ভাবমূর্তির ভিন্নতর উপস্থাপনাকেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। বাংলাদেশে কিছু মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতি তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। প্রতিনিয়ত কিছু আলেম অন্যের ধর্মকে হেয় করে নিজের ধর্মের মহিমা প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে সমাজে বিদ্বেষ ও বিভেদ সৃষ্টি করে চলছেন।
আসলে কোরআন অবমাননা উছিলা মাত্র; আসল কথা হলো হিন্দু খেদাও, দেশকে হিন্দু শূন্য করো। ধর্মের প্রতি আনুগত্য ও ভালোবাসা থেকে উত্তেজনার সৃষ্টি হলে দেশের তৌহিদী জনতা ২০১৩ সনে হেফাজতে ইসলামের কোরআন শরিফ পোড়ানোর বিরুদ্ধেও আন্দোলন করত। আফগানিস্তান বা পাকিস্তানে যখন এক তরিকার ধার্মিক অন্য তরিকার ধার্মিককে মারার জন্য মসজিদে বোমা ফাটায় তখন তো ধর্ম অবমাননার কথা বলে কোন মুসলমানকে আমাদের দেশে মিছিল করতে দেখা যায় না। আল্লাহর ঘর যখন রক্তাক্ত হয় তখন ধর্মীয় অনুভূতি ঘুমিয়ে থাকে কেন?
বাংলাদেশে বর্তমানে ধর্মীয় অনুভূতির চেয়ে রাজনৈতিক খেলার গুটি অনেক বেশি শক্তিশালী। দাঙ্গাকারীদের মধ্যে গণতন্ত্রপন্থি সব রাজনৈতিক দলের লোকই রয়েছে। এই সব দাঙ্গা সরকারকে নাজুক অবস্থায় ফেলে দিচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও যে দাঙ্গা হয় তার ঐতিহাসিক ভিত ইতোমধ্যে রচিত হয়ে গেছে। ধর্মীয় লেবাসে রাজনৈতিক গোষ্ঠী সরকারের বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বীদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। সরকারের ভাবখানা হলো, শ্যাম রাখি, না কুল রাখি। পুজামন্ডপ পোড়ানো শেষ হওয়ার পর আওয়ামী লীগ শান্তি মিছিল করেছে, কিন্তু ১৯৬৪ সনে আমাদের দেশে সবুর খানের প্ররোচনায় সংঘটিত দাঙ্গার সময় বঙ্গবন্ধুর মতো বজ্রকণ্ঠে বলতে পারেনি, ‘বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াও’।
ভঙ্গুর অর্থনীতির মধ্যেও অসাম্প্রদায়িক আদর্শ বিক্রি করে বঙ্গবন্ধু সৌদি আরবের স্বীকৃতিও চাননি, বাংলাদেশকে ‘ইসলামিক প্রজাতন্ত্র’ ঘোষণার সৌদি বাদশাহর দাবি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। অর্থনৈতিক বিবেচনায় দেশ যত শক্তিশালী হচ্ছে ক্রমান্বয়ে দেশ তত ধর্মান্ধদের কবলে চলে যাচ্ছে। ব্লগারদের নির্বিচারে হত্যার সময় আওয়ামী লীগ সরকার হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ত্বরিৎ ব্যবস্থা নিলে ওখানেই থামানো যেত। এছাড়াও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংঘটিত দাঙ্গার সঙ্গে জড়িত কারো বিচার হয়নি। হিন্দুদের ওপর সাম্প্রতিক নির্যাতনে আওয়ামী লীগের ওপর দেশের সংখ্যালঘুদের যে প্রত্যাশা ছিল তা নষ্ট হয়ে গেছে, তার পুনরুদ্ধার আর সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, ভোটের জন্য সব গণতন্ত্রী এখন ধর্মান্ধদের তোয়াজ করেন, নাস্তিক ও সংশয়বাদীরাও নির্বাচনকালীন টুপি পরেন, ধর্মান্ধরা এখন নির্বাচনে জেতার ‘ট্রাম্প কার্ড’।
কোরআন অবমাননা প্রসঙ্গে কিছু কিছু ওয়াজী আলেম তো জানতে চেয়েছেন, মুসলমানের দেশে হিন্দুরা এত সাহস পায় কোথায়, অর্থাৎ এই দেশ হিন্দুদের নয়। উসকানিমূলক এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এই সব ওয়াজের বিরুদ্ধে সরকারের নীরব থাকা ছাড়া উপায় নেই, কারণ তারা কোরআন হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়েই ওয়াজ করেন। নিজ ধর্মের বিপক্ষে কিছু শুনলেই প্রতিটি ধর্মের কট্টর অনুসারীদের অনুভূতিতে আঘাত লাগে; অন্য ধর্ম নিয়ে গালাগাল করলে তাদের আবার সুখানুভূতি হয়। কিন্তু সব ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তখনকার প্রচলিত ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করে, ইসলাম ধর্মও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার আগের ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে কথা বলে, তাদের মনে আঘাত দিয়ে। তাহলে ইসলাম ধর্মের পূর্ববর্তী ধর্মের অনুসারীদেরও কি অনুভূতিতে এভাবেই লেগেছিল? তাদের অনুভূতির আঘাতকে গুরুত্ব দেয়া হলে কি আমরা ইসলাম ধর্ম পেতাম? সূরা আন’আমের ১০৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছ, ‘আর তোমরা তাদের গালমন্দ করো না, আল্লাহ ছাড়া যাদের তারা ডাকে, ফলে তারা গালমন্দ করবে আল্লাহকে, শত্রুতা পোষণ করে অজ্ঞতাবশত’। যেখানে আল্লাহতালা নিজেই কোরআনের সংরক্ষক সেখানে কোরআনের অপমান করা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়- ‘আমিই (আল্লাহ) কোরআন অবতীর্ণ করেছি। আর অবশ্যই আমি এর সংরক্ষক’ (সুরা : হিজর, আয়াত : ৯)। আল্লাহর এমন ঘোষণায় যাদের আস্থা কম তারাই কোরআন অবমাননার অসত্য প্রচারণায় হিন্দুদের ওপর নির্যাতন করে, প্রতিমা ভাঙে, পুজামন্ডপ পুড়িয়ে দেয়; এরাই আল্লাহর কথায় বিশ্বাস না রেখে কোরআন হেফাজতের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিতে চায়। মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে আমার একটি করুণ প্রার্থনা, ‘হে আল্লাহ, দয়া করে আমাদের উগ্র ধর্মীয় অনুভূতিকে একটু ভোঁতা করে দিন’।
[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের
সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]
ahmedzeauddin0@gmail.com
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
শনিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২১
কুমিল্লা শহরের নানুয়া দীঘির পাড়ে একটি দুর্গাপূজার মন্ডপে হনুমান মূর্তির কোলে পবিত্র কোরআন রাখার একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে; ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে পূজামন্ডপ ভাঙচুর শুরু হয়। স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জমান খান কামাল পূজা শুরু হওয়ার পূর্বে বলেছিলেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সজাগ রয়েছে, পুজামন্ডপগুলোতে কোন ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই। দেশের শান্তি রক্ষায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চেয়ে ক্ষমতাবান আর কেউ নেই; স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়ে হিন্দুদের মার খেতে হলো। পুলিশের তরফ থেকে বলা হয়েছে, এবারের দুর্গাপূজায় তারা কোন ঝুঁকি দেখছেন না, তবুও তারা নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছেন। নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা বা তিন-চার স্তরের নিরাপত্তাটা কী জিনিস তা আমাদের মাথায় এখনও ঢুকেনি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেছেন, বাংলাদেশের মুসলমানরা ধর্মভীরু, ধর্মান্ধ নয়; এই কথাটি অনেকেই বলেন যা চরম অসত্য এবং তাৎপর্যহীন। মন্ত্রী মহোদয়সহ যারা বলেন, বাংলাদেশের মুসলানেরা ধর্মান্ধ নয়, তাদের কাছে একটি বিনীত জিজ্ঞাসা, আমাদের বাংলাদেশের মানুষ ধর্মান্ধ না হলে পূজামন্ডপে পুলিশ বহাল রাখার প্রয়োজন কি? মসজিদ বা ইদগাহে তো পুলিশ থাকে না। মসজিদ বা ঈদগাহে পুলিশের প্রয়োজন না হলে পুজা মন্ডপে পুলিশ লাগে কেন?
কোন ইমানদার মুসলমানের এমন কাজ করার কথা নয়; কারণ কোরআন মুসলমানের কাছে সবচেয়ে পবিত্র গ্রন্থ; এই অপকর্মটি করেছে নাকি ৩৫ বছরের যুবক ইকবাল হোসেন। এই অপকর্মের পরিকল্পনায় কারা ছিল তা ইকবালের গ্রেপ্তারের পর হয়তো জানা যাবে। যে সব উগ্র মুসলিম পুজামন্ডপ ভেঙেছে, মানুষ পিটিয়ে মেরেছে তারাও বোধ হয় ইকবালের মতো নামধারী মুসলমান; নতুবা তারা কেন অনুধাবন করলো না, দেবদেবীর ঘোরবিরোধী কোরআন রেখে হিন্দুরা নিজেদের পুজা নষ্ট করতে পারে না। উপরন্তু কোন হিন্দুর কোরআনকে অবমাননা করার ইচ্ছা থাকলে সে কোরআনকে হনুমানের কোলের ওপর না রেখে তার পায়ের নিচে রাখতো। উগ্র মুসলমানদের উর্বর মস্তিষ্কে যদি মনেও হতো যে, এই অপকর্ম কোন হিন্দু করেছে, তাহলেও তো নবীজীর বিদায় হজের বাণী (‘হে মানবমন্ডলী, পিতার অপরাধে পুত্র দায়ী হবে না এবং পুত্রের অপরাধে কোন পিতাকে দায়ী করা হবে না’) অনুযায়ী বাংলাদেশের সব হিন্দু দায়ী হতে পারে না; কিন্তু দাঙ্গাবাজ ক্ষেপা ধর্মান্ধদের এটা বোঝাবে কে? কিছু শিক্ষিত লোক দেশ এবং বিদেশ থেকে কিছুদিন ধরে প্রচার করছেন, কোরআন রাখার ষড়যন্ত্র করেছে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা, কারণ ভারত আমাদের উন্নয়ন কর্মকান্ডে ঈর্ষান্বিত- উম্মাদের প্রলাপ।
ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় হিন্দুদের ওপর অনেকগুলো সংঘবদ্ধ আক্রমণ হয়ে গেছে। আমার নিজ জেলা ফেনীতেও হয়েছে। প্রতিমা আর পুজামন্ডপ ভাঙার জেহাদি জোশে উন্মত্ত কয়েকজন যুবককের স্লোগান ছিল, ‘নারায়ে তাকবির ... আল্লাহু আকবার’, ‘ইসলামের আলো, ঘরে ঘরে জ্বালো’। ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ, নবী, অবতার, উপসনালয় ইত্যাদির অবমাননার গুজবে পৃথিবীব্যাপী কোটি কোটি লোকের প্রাণ গিয়েছে, লক্ষ লক্ষ লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে, লাখ লাখ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছে- কিন্তু অসভ্য মানুষগুলোর বোধোদয় এখনও হয়নি, হবে বলেও মনে হয় না; পৃথিবীর ইতিহাসে শুরু থেকে আজ পর্যন্ত সংঘটিত বেশিরভাগ খুনাখুনির প্রধান কারণ ধর্ম এবং জাতিগত বিদ্বেষ। দাঙ্গার বিভিন্ন ঘটনাগুলো পর্যালাচনা করলে প্রতীয়মান হয়, যারা ধর্মের প্রতি একনিষ্ঠ নয়, আচার-অনুষ্ঠানে নিয়মিত নয় তাদের ধর্মানুভূতি একটু বেশি প্রখর। জাফর ইকবাল তার একটি গল্পের চরিত্রের নাম নির্বাচন করেছিলেন ‘সোলায়মান’; এতে একজন যুবকের ধর্মানুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়, সেই যুবক সোজা গিয়ে জাফর ইকবালের শরীরে ছুরি চালিয়ে দেয়। ব্লগার নাম দিয়ে ইতোমধ্যে যাদের খুন করা হয়েছে তাদের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলেও প্রতীয়মান হয়, ধর্মগ্রন্থ এবং ধর্মসংশ্লিষ্ট কোন প্রতিষ্ঠিত ভাবমূর্তির ভিন্নতর উপস্থাপনাকেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। বাংলাদেশে কিছু মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতি তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। প্রতিনিয়ত কিছু আলেম অন্যের ধর্মকে হেয় করে নিজের ধর্মের মহিমা প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে সমাজে বিদ্বেষ ও বিভেদ সৃষ্টি করে চলছেন।
আসলে কোরআন অবমাননা উছিলা মাত্র; আসল কথা হলো হিন্দু খেদাও, দেশকে হিন্দু শূন্য করো। ধর্মের প্রতি আনুগত্য ও ভালোবাসা থেকে উত্তেজনার সৃষ্টি হলে দেশের তৌহিদী জনতা ২০১৩ সনে হেফাজতে ইসলামের কোরআন শরিফ পোড়ানোর বিরুদ্ধেও আন্দোলন করত। আফগানিস্তান বা পাকিস্তানে যখন এক তরিকার ধার্মিক অন্য তরিকার ধার্মিককে মারার জন্য মসজিদে বোমা ফাটায় তখন তো ধর্ম অবমাননার কথা বলে কোন মুসলমানকে আমাদের দেশে মিছিল করতে দেখা যায় না। আল্লাহর ঘর যখন রক্তাক্ত হয় তখন ধর্মীয় অনুভূতি ঘুমিয়ে থাকে কেন?
বাংলাদেশে বর্তমানে ধর্মীয় অনুভূতির চেয়ে রাজনৈতিক খেলার গুটি অনেক বেশি শক্তিশালী। দাঙ্গাকারীদের মধ্যে গণতন্ত্রপন্থি সব রাজনৈতিক দলের লোকই রয়েছে। এই সব দাঙ্গা সরকারকে নাজুক অবস্থায় ফেলে দিচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও যে দাঙ্গা হয় তার ঐতিহাসিক ভিত ইতোমধ্যে রচিত হয়ে গেছে। ধর্মীয় লেবাসে রাজনৈতিক গোষ্ঠী সরকারের বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বীদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। সরকারের ভাবখানা হলো, শ্যাম রাখি, না কুল রাখি। পুজামন্ডপ পোড়ানো শেষ হওয়ার পর আওয়ামী লীগ শান্তি মিছিল করেছে, কিন্তু ১৯৬৪ সনে আমাদের দেশে সবুর খানের প্ররোচনায় সংঘটিত দাঙ্গার সময় বঙ্গবন্ধুর মতো বজ্রকণ্ঠে বলতে পারেনি, ‘বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াও’।
ভঙ্গুর অর্থনীতির মধ্যেও অসাম্প্রদায়িক আদর্শ বিক্রি করে বঙ্গবন্ধু সৌদি আরবের স্বীকৃতিও চাননি, বাংলাদেশকে ‘ইসলামিক প্রজাতন্ত্র’ ঘোষণার সৌদি বাদশাহর দাবি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। অর্থনৈতিক বিবেচনায় দেশ যত শক্তিশালী হচ্ছে ক্রমান্বয়ে দেশ তত ধর্মান্ধদের কবলে চলে যাচ্ছে। ব্লগারদের নির্বিচারে হত্যার সময় আওয়ামী লীগ সরকার হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ত্বরিৎ ব্যবস্থা নিলে ওখানেই থামানো যেত। এছাড়াও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংঘটিত দাঙ্গার সঙ্গে জড়িত কারো বিচার হয়নি। হিন্দুদের ওপর সাম্প্রতিক নির্যাতনে আওয়ামী লীগের ওপর দেশের সংখ্যালঘুদের যে প্রত্যাশা ছিল তা নষ্ট হয়ে গেছে, তার পুনরুদ্ধার আর সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, ভোটের জন্য সব গণতন্ত্রী এখন ধর্মান্ধদের তোয়াজ করেন, নাস্তিক ও সংশয়বাদীরাও নির্বাচনকালীন টুপি পরেন, ধর্মান্ধরা এখন নির্বাচনে জেতার ‘ট্রাম্প কার্ড’।
কোরআন অবমাননা প্রসঙ্গে কিছু কিছু ওয়াজী আলেম তো জানতে চেয়েছেন, মুসলমানের দেশে হিন্দুরা এত সাহস পায় কোথায়, অর্থাৎ এই দেশ হিন্দুদের নয়। উসকানিমূলক এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এই সব ওয়াজের বিরুদ্ধে সরকারের নীরব থাকা ছাড়া উপায় নেই, কারণ তারা কোরআন হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়েই ওয়াজ করেন। নিজ ধর্মের বিপক্ষে কিছু শুনলেই প্রতিটি ধর্মের কট্টর অনুসারীদের অনুভূতিতে আঘাত লাগে; অন্য ধর্ম নিয়ে গালাগাল করলে তাদের আবার সুখানুভূতি হয়। কিন্তু সব ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তখনকার প্রচলিত ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করে, ইসলাম ধর্মও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার আগের ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে কথা বলে, তাদের মনে আঘাত দিয়ে। তাহলে ইসলাম ধর্মের পূর্ববর্তী ধর্মের অনুসারীদেরও কি অনুভূতিতে এভাবেই লেগেছিল? তাদের অনুভূতির আঘাতকে গুরুত্ব দেয়া হলে কি আমরা ইসলাম ধর্ম পেতাম? সূরা আন’আমের ১০৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছ, ‘আর তোমরা তাদের গালমন্দ করো না, আল্লাহ ছাড়া যাদের তারা ডাকে, ফলে তারা গালমন্দ করবে আল্লাহকে, শত্রুতা পোষণ করে অজ্ঞতাবশত’। যেখানে আল্লাহতালা নিজেই কোরআনের সংরক্ষক সেখানে কোরআনের অপমান করা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়- ‘আমিই (আল্লাহ) কোরআন অবতীর্ণ করেছি। আর অবশ্যই আমি এর সংরক্ষক’ (সুরা : হিজর, আয়াত : ৯)। আল্লাহর এমন ঘোষণায় যাদের আস্থা কম তারাই কোরআন অবমাননার অসত্য প্রচারণায় হিন্দুদের ওপর নির্যাতন করে, প্রতিমা ভাঙে, পুজামন্ডপ পুড়িয়ে দেয়; এরাই আল্লাহর কথায় বিশ্বাস না রেখে কোরআন হেফাজতের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিতে চায়। মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে আমার একটি করুণ প্রার্থনা, ‘হে আল্লাহ, দয়া করে আমাদের উগ্র ধর্মীয় অনুভূতিকে একটু ভোঁতা করে দিন’।
[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের
সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]
ahmedzeauddin0@gmail.com