ছোটবেলা থেকেই বাবার মুখে শুনতাম বাবা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, ছাত্র রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। বাবা বলতেন, ঘিওর কলেজে নাকি মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীন দেশের প্রথম পতাকা উঠানোর সময় তিনিও ছিলেন। সত্যি কি মিথ্যা তা জানি না, তবে যা বলতেন তাই বিশ্বাস করতাম। কখনও যাচাই করার চেষ্টা করিনি আর ইচ্ছেও হয়নি। এইচএসসি পাস করার পর যখন জানলাম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য কোটা আছে (তখনও জানতাম না সরকারি চাকরিতেও একই সুযোগ আছে) তখন প্রথমবারের মতো বাবাকে বলেছিলাম, তোমার মুক্তিযোদ্ধার সনদটা দাও আমি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করব। সেদিন প্রথম জানতে পারলাম, আমার বাবা একজন সনদবিহীন মুক্তিযোদ্ধা। সেদিন অনেকটা রাগ ও অভিমান নিয়েই বলে ফেলেছিলাম মুক্তিযোদ্ধা সনদের জন্য আবেদন কেন করনি এতদিন? আজকে তোমার সনদ থাকলে আমাদের দুই ভাইয়ের কত উপকার হতো।
তারও প্রায় অনেক বছর পর যখন আমার ছোট ভাই এইচএসসি পাস করল আবারও বাবাকে মনে করিয়ে দিয়ে ধরে বসলাম, তুমি কি তোমার সনদের জন্য চেষ্টা করবেই না? এখন তোমার সনদ থাকলে ছোট ভাইটার তো ভবিষ্যতে কিছু উপকার হতো। বাবার উত্তর শুনে সেদিন থমকে গিয়েছিলাম। বাবা রেগে গিয়ে বলেছিলেন, ‘দেশ স্বাধীন কি সনদের জন্য করেছিলাম নাকি? দেশকে ভালোবেসে করেছিলাম।’ তারপর বললেন, ‘তুই বলাতে তোদের না জানিয়ে সনদের জন্য চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু কিছু জটিলতা (বিষয়টি খুলে বলেননি কি জটিলতা) আছে! আমি এইভাবে সনদ নেব না! তোদের যোগ্যতা থাকলে এমনিই জীবনে সফল হবি তার জন্য আমার মুক্তিযোদ্ধার সনদ লাগবে না।’
বাবার কথায় সেদিন আমার মনের কোণে সন্দেহ উঁকি দেয় যে, বাবা মনে হয় মিথ্যা কথা বলেছে। এতদিন তো অনেক কিছুই বলেছে এখন যদি সব মিথ্যা আমরা জেনে যাই তাহলে তিনি ছোট হয়ে যাবেন। তাই মনে হয় সত্যিটা লুকাচ্ছেন, উনি মনে হয় আসলে মুক্তিযোদ্ধাই না।
বাবা যেদিন মারা গেলেন সেদিন তার নিথর দেহ আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেল। অনেকেই জানতেন না উনি মারা গেছেন তাও প্রায় হাজার খানেক মানুষ হয়েছিল, আরও অনেকই পরে এসে জানাজাই পাননি। মানিকগঞ্জের তিন বীর মুক্তিযোদ্ধাই সেদিন তার জানাজায় এসেছিলেন। বাবার মৃতদেহকে সামনে রেখে তারা হাজারো মানুষের সামনে বলেছিলেন, মো. মনোয়ার আলী খান (আমার বাবা) ছিলেন ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাথি। সরকারিভাবে স্বীকৃতি না পেলেও দেশের সেই তিনজন সরকারি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিই সেদিন আমার মনের কোণে লুকিয়ে থাকা সব প্রশ্নের উত্তরগুলো দিয়ে গিয়েছিল।
বাবা মারা যাওয়ার পর যখন তার গোপন কাগজগুলো ঘেঁটেছিলাম তখন দেখালাম তার মুক্তিযোদ্ধার সনদের জন্য আবেদনের একটি কপি। মনে হয় সেই আবেদনটা এখনও সরকারি অফিসে অনুমোদনের অপেক্ষায় পরে আছে (আবার নাও হতে পারে)। সেই আবেদনের কপির সঙ্গে মানিকগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধকালীন একজন কমান্ডারের (সম্ভবত তার নাম বীর মুক্তিযোদ্ধা মফিজুল হক কামাল) স্বাক্ষরিত একটা সনদও তার নথিগুলোর সঙ্গে সেঁটে রয়েছে। আমার সেদিন আর প্রমাণ এর দরকার রইল না, আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। তবে হ্যাঁ, একজন সনদবিহীন মুক্তিযোদ্ধা। আর আমি গর্বিত এটা ভেবেই যে আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান।
মো. রাহাত খান
সহকারী অধ্যাপক
সিটি বিশ্ববিদ্যালয়
মঙ্গলবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২০
ছোটবেলা থেকেই বাবার মুখে শুনতাম বাবা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, ছাত্র রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। বাবা বলতেন, ঘিওর কলেজে নাকি মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীন দেশের প্রথম পতাকা উঠানোর সময় তিনিও ছিলেন। সত্যি কি মিথ্যা তা জানি না, তবে যা বলতেন তাই বিশ্বাস করতাম। কখনও যাচাই করার চেষ্টা করিনি আর ইচ্ছেও হয়নি। এইচএসসি পাস করার পর যখন জানলাম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য কোটা আছে (তখনও জানতাম না সরকারি চাকরিতেও একই সুযোগ আছে) তখন প্রথমবারের মতো বাবাকে বলেছিলাম, তোমার মুক্তিযোদ্ধার সনদটা দাও আমি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করব। সেদিন প্রথম জানতে পারলাম, আমার বাবা একজন সনদবিহীন মুক্তিযোদ্ধা। সেদিন অনেকটা রাগ ও অভিমান নিয়েই বলে ফেলেছিলাম মুক্তিযোদ্ধা সনদের জন্য আবেদন কেন করনি এতদিন? আজকে তোমার সনদ থাকলে আমাদের দুই ভাইয়ের কত উপকার হতো।
তারও প্রায় অনেক বছর পর যখন আমার ছোট ভাই এইচএসসি পাস করল আবারও বাবাকে মনে করিয়ে দিয়ে ধরে বসলাম, তুমি কি তোমার সনদের জন্য চেষ্টা করবেই না? এখন তোমার সনদ থাকলে ছোট ভাইটার তো ভবিষ্যতে কিছু উপকার হতো। বাবার উত্তর শুনে সেদিন থমকে গিয়েছিলাম। বাবা রেগে গিয়ে বলেছিলেন, ‘দেশ স্বাধীন কি সনদের জন্য করেছিলাম নাকি? দেশকে ভালোবেসে করেছিলাম।’ তারপর বললেন, ‘তুই বলাতে তোদের না জানিয়ে সনদের জন্য চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু কিছু জটিলতা (বিষয়টি খুলে বলেননি কি জটিলতা) আছে! আমি এইভাবে সনদ নেব না! তোদের যোগ্যতা থাকলে এমনিই জীবনে সফল হবি তার জন্য আমার মুক্তিযোদ্ধার সনদ লাগবে না।’
বাবার কথায় সেদিন আমার মনের কোণে সন্দেহ উঁকি দেয় যে, বাবা মনে হয় মিথ্যা কথা বলেছে। এতদিন তো অনেক কিছুই বলেছে এখন যদি সব মিথ্যা আমরা জেনে যাই তাহলে তিনি ছোট হয়ে যাবেন। তাই মনে হয় সত্যিটা লুকাচ্ছেন, উনি মনে হয় আসলে মুক্তিযোদ্ধাই না।
বাবা যেদিন মারা গেলেন সেদিন তার নিথর দেহ আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেল। অনেকেই জানতেন না উনি মারা গেছেন তাও প্রায় হাজার খানেক মানুষ হয়েছিল, আরও অনেকই পরে এসে জানাজাই পাননি। মানিকগঞ্জের তিন বীর মুক্তিযোদ্ধাই সেদিন তার জানাজায় এসেছিলেন। বাবার মৃতদেহকে সামনে রেখে তারা হাজারো মানুষের সামনে বলেছিলেন, মো. মনোয়ার আলী খান (আমার বাবা) ছিলেন ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাথি। সরকারিভাবে স্বীকৃতি না পেলেও দেশের সেই তিনজন সরকারি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিই সেদিন আমার মনের কোণে লুকিয়ে থাকা সব প্রশ্নের উত্তরগুলো দিয়ে গিয়েছিল।
বাবা মারা যাওয়ার পর যখন তার গোপন কাগজগুলো ঘেঁটেছিলাম তখন দেখালাম তার মুক্তিযোদ্ধার সনদের জন্য আবেদনের একটি কপি। মনে হয় সেই আবেদনটা এখনও সরকারি অফিসে অনুমোদনের অপেক্ষায় পরে আছে (আবার নাও হতে পারে)। সেই আবেদনের কপির সঙ্গে মানিকগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধকালীন একজন কমান্ডারের (সম্ভবত তার নাম বীর মুক্তিযোদ্ধা মফিজুল হক কামাল) স্বাক্ষরিত একটা সনদও তার নথিগুলোর সঙ্গে সেঁটে রয়েছে। আমার সেদিন আর প্রমাণ এর দরকার রইল না, আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। তবে হ্যাঁ, একজন সনদবিহীন মুক্তিযোদ্ধা। আর আমি গর্বিত এটা ভেবেই যে আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান।
মো. রাহাত খান
সহকারী অধ্যাপক
সিটি বিশ্ববিদ্যালয়