alt

সাময়িকী

অগ্রজ দাউদ হায়দারের মহাপ্রয়াণ

আরিফ হায়দার

: বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫

নোবেল বিজয়ী জার্মান লেখক গুন্টার গ্রাসের সাথে সদ্যপ্রয়াত বাংলাদেশী নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দার

ভাষাই আপন করে ভাষা করে পর। আমরা সুখে-দুখে বেঁচে ছিলাম ভাই বোনদের নিয়ে। একে একে মাথার উপর থেকে বট গাছের ছায়াগুলি আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। আমরা ১৬ ভাইবোনের পরিবার ছিলাম। অনেক আগেই এক ভাই এক বোন মারা গেছেন। তারপর চৌদ্দ ভাইবোন বেশ ছিলাম। সময়ের টানাপোড়েনে চার ভাই তিন বোন চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে,এখন আপাতত আমরা সাত। হয়তো আবারো আঙ্গুলের কর গুনতে হবে কেউ আমরা নেই। পাবনার দোহারপাড়ার বাড়িতে আমাদের ছোটবেলা। আমি ছোট বলে অতীত গল্প গুলি বড়দের কাছ থেকে যখন শুনি, তখন রূপকথার গল্পের মতো মনে হয়।

১৯৭৪ বাড়ির সামনে হাজারো মানুষ, বাড়ির ভেতরে যারা আছে তাদের মুখের দিকে তাকাতে পারছি না, আতঙ্ক চোখেমুখে। বাড়ি থেকে একে একে সবাই কোথায় যেন চলে গেল শুধু মা বাড়ির সিঁড়ির উপর বসে বুকে কোরআন শরীফ নিয়ে দোয়া করছেন- বুঝতে পারি দোহারপাড়ার বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হবে; কারণ একটাই কবিতা লেখার জন্য। কী কবিতা, কেমন কবিতা, কিছুই জানি না। একসময় দেখলাম তপন ভাই (আবিদ হায়দার) আর ছোট চাচা আবুল কাশেম মিছিলের সামনে গিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছেন বাড়িটা যেন না পোড়ানো হয়। বাড়িটা না পোড়ানোর নেপথ্যে সহযোগিতা করেছিলেন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী। সেই দিনগুলির কথা এখনো মনে পড়ে।

মাকে জিজ্ঞাসা করি- “মানুষ আমাদের বাড়ি পোড়াতে চায় কেন? মা উত্তরে শুধু বলেছিলেন, “আল্লাহ আল্লাহ কর, খোকন (দাউদ হায়দার) নাকি একটা কবিতা লিখেছে সেটার জন্য...। অনেক পরে জানতে পেরেছিলাম কী কবিতা। তারপর তো খোকন ভাইকে নির্বাসনে চলে যেতে হলো। একটি কবিতা লেখার জন্য আমাদের থেকে দূরে চলে গেলেন। আজো ফিরে আসতে পারলেন না বাংলাদেশের মাটিতে, আমাদের কাছে, আর কখনো আসবেন না চিরবিদায় নিলেন।

আমাদের প্রতি অভিমান। শেষ দেখাটাও হলো না। এপ্রিল ২৭ তারিখে সকালে ফোন বেজে উঠলে রিসিভ করতেই ফোনের ওপ্রান্ত থেকে রাকা (ভাগ্নি) বলল, “খোকন মামা আর নেই”। আমি চুপ হয়ে যাই। এই তো সেদিন জানুয়ারি ২০২৪ খোকন ভাই (দাউদ হায়দার), আমি, নোয়া ভাই (মাকিদ হায়দার), স্বপন ভাই (জাহিদ হায়দার) কলকাতার বইমেলায় চার ভাই বই কিনছি, এটা সেটা খাচ্ছি, আরো কত কী! খোকন ভাইয়ের জনপ্রিয়তা দেখেছি সেদিন বইমেলাতে, তাঁকে ঘিরে কত লেখক, পাঠক, বন্ধু, বান্ধবী। মাকিদ ভাই একসময় বলেই ফেলল, “ওর সাথে আসা আমাদের ঠিক হয়নি, আসলাম চার ভাই একসাথে বইমেলায় আড্ডা দিব তা না... জাহিদ ভাই বললেন, কবি মানুষ তো, তারপরে কলকাতার সাহিত্য তাঁর দখলে, অতএব এমনটা তো হবেই, আমাদের মেনে নিতে হবে...। আমি ছোট শুধু শুনে যাবার পালা।

খোকন ভাইকে (দাউদ হায়দার) বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত করে ভারত পাঠিয়ে দেওয়া হয়, তারপর ভারত থেকে জার্মানি চলে যান।

আমাদের থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে। বিচ্ছিন্ন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকলাম আমরা। সে যে আরেক মহাদেশ। বহু, বহুদূর। ইতোমধ্যে আমি কলকাতার রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক নিয়ে লেখাপড়া করতে গেছি। আমার কলকাতা নিয়ে ভাইবোনেরা বলত, “খোকন কলকাতা থেকে জার্মানি, আর তৌহিদ (আরিফ হায়দার) কলকাতায়...”।কলকাতায় গিয়ে মনে হলো এখন আমি স্বাধীন, কেউ আমাকে বকাঝকা করতে পারবেনা, যা ইচ্ছে তাই করতে পারব। কিন্তু সে গুড়ে বালি। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটকের শিক্ষকরা জেনে গেছেন আমি জিয়া হায়দারের, দাউদ হায়দারের ছোটভাই। কোনো সাহিত্য আড্ডা আর্ট প্রদর্শনী যেখানেই যাই এবং মানুষের সাথে পরিচয় হলেই কথায় কথায় উঠে আসতো দাউদ হায়দারের নাম। শেষমেশ আর যা ইচ্ছে তাই করতে পারতাম না। রবীন্দ্র ভারতীতে পড়ালেখা করার সময় আমার জন্য খরচ পাঠাতেন জার্মানি থেকে; কিন্তু একদিন বুঝতে পারলেন টাকাটা অতিরিক্ত খরচ করছি। কোনো কথা না বলে শুধু একটি অনুমতি পত্র পাঠালেন, চিঠিতে লেখা আছে তুমি ‘প্রতিদিন’ (কলকাতার দৈনিক কাগজ) পত্রিকায় মাসের ৫ তারিখে গিয়ে ২৫০০ টাকা নিয়ে আসবে; ওই টাকাগুলি আমার লেখার সম্মানী। তবে মনে রেখো আমি না লিখলে টাকা পাবে না, আমার টাকা কখনো বন্ধ হয়নি; নিয়মিত লিখতেন প্রতিদিন কাগজে, শুধু আমার জন্য, তার শরীর অসুস্থ থাকলেও লেখাটা পাঠাতেন, এই হচ্ছে ভাই। শুধু আমার খবর নিতেন না আমাদের সকলের খবর নিতেন সবসময়। প্রায় প্রতিদিন ভিডিও কল করে কথা বলতেন, কে কেমন আছে জানতে চাইতেন, আমার দুই ছেলে ফসল-শস্যর খবর নিতেই বলতেন “আমার দুই বাবা কেমন আছে?” কথা বলতে বলতে ফিরে আসতেন পাবনার দোহারপাড়ার কথায়, দোহারপাড়ার  সকলে কেমন আছে পুকুরের সব ক’টি শান বাঁধানো ঘাট কি আছে না ভেঙে গেছে, বাড়িটা ভেঙে যাচ্ছে সারার ব্যবস্থা কর, তপনকে (আবিদ হায়দার) বল বাড়ি সারার ব্যবস্থা করতে, আমি যতটা পারি টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করছি, আমি যে শালগাছটা লাগিয়েছিলাম সেটা এখন কতটা বড় হয়েছে, এরকম অনেক জিজ্ঞাসা।

এখন আর জিজ্ঞাসা করবে না, কোনো ফোন কল আসবেনা, আমার স্ত্রী কবিতাকে (কবিতা হায়দার) জার্মানি থেকে ফুলের ছবি, আকাশের ছবি, বরফ পড়ার ছবি পাঠাবে না।

খোকন ভাই আপনার লেখা চিঠিগুলি আমি যতœ করে রেখে দিয়েছি, নিজেকে বুঝবার জন্য। বারবার চিঠিগুলি পড়ি। আমি যে এখনো বাংলা ভালো করে লিখতে পারি না; তা আপনি চিঠিতে বলেছেন, কিন্তু একটা কবিতা দেখে বলেছিলেন “অল্প কথায় কবিতাটা ভালো লিখেছিস...”  তারপরেও কবিতার শব্দ উলট-পালট করে দিয়ে বলেছিলেন “এমনটা হলে আরো ভালো হতো...”। এখন থেকে আর কখনো বলবেন না এমন কথা।

আপনার একটি কবিতা যা আজ সত্য হলো-

এপিটাফ

যে-দেশে আমার মৃত্যুর অধিকার ছিল

সেই দেশ থেকে নির্বাসিত আমি

এই দেশে, বিদেশ বিভুঁইয়ে

অভুক্ত দেহমনে

বেঁচে আছি, ক্ষুধার্তপ্রাণ; কিমাশ্চর্য বাঁচা!

আমার মৃত্যুর পরে লিখে দিও

জননী জন্মভূমি ছেড়ে অচেনা নগরে তার

মৃত্যু হয়েছিল

মূলত সে কবি, তারও আকাক্সক্ষা ছিল

স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সাম্য, ছিল স্বপ্ন

বিজয়ী যোদ্ধার মতো

ছবি

আমজাদ হোসেনের ‘ভিন্ন ভাষার কবিতা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি: একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

দুই ঋতপার কিসসা এবং এক ন্যাকা চৈতন্য

ছবি

অন্যজীবন অন্যআগুন ছোঁয়া

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

কবিজীবন, দর্শন ও কাব্যসন্ধান

ছবি

অসামান্য গদ্যশৈলীর রূপকার

ছবি

পিয়াস মজিদের ‘রূপকথার রাস্তাঘাট’

ছবি

নজরুলের নিবেদিত কবিতা : অর্ঘ্যরে শিল্পরূপ

ছবি

বাঘাডাঙা গাঁও

ছবি

বুদ্ধদেব বসুর ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’ বিষয়ভাবনা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

পথকবিতা: লোকবাংলার সাধারণ কবিতা

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

ক্ষমতার ভাষার বিপরীতে মাতৃভাষার সাধনা

ছবি

ফিলিস্তিনের বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে অণুগল্প

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি: একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

শিল্পী সুনীল কুমারের ‘পথের গল্প’-এর স্বরূপ

ছবি

রাত গভীর

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

‘এ নয় আঁখিজল’

জ্যৈষ্ঠের পদাবলি

ছবি

ওসামা অ্যালোমারের একঝুড়ি খুদে গল্প

সাময়িকী কবিতা

ছবি

‘ব্রহ্মপুত্র দাঁড়াও’ কাব্যগ্রন্থে নীলদ্রোহের রেখাপাত

ছবি

নার্গিস-নজরুলের স্মৃতিধন্য দৌলতপুরে একদিন

ছবি

যেভাবে ভেঙেছিল এক মৌনতা

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি : একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

নজরুল সাহিত্যে নন্দনতত্ত্বের প্রেক্ষিত

ছবি

স্বাধীনতার কবি নজরুল

ছবি

নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত প্রতিভা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

দাউদ হায়দার: স্বকীয় ও নির্বাসিত

tab

সাময়িকী

অগ্রজ দাউদ হায়দারের মহাপ্রয়াণ

আরিফ হায়দার

নোবেল বিজয়ী জার্মান লেখক গুন্টার গ্রাসের সাথে সদ্যপ্রয়াত বাংলাদেশী নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দার

বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫

ভাষাই আপন করে ভাষা করে পর। আমরা সুখে-দুখে বেঁচে ছিলাম ভাই বোনদের নিয়ে। একে একে মাথার উপর থেকে বট গাছের ছায়াগুলি আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। আমরা ১৬ ভাইবোনের পরিবার ছিলাম। অনেক আগেই এক ভাই এক বোন মারা গেছেন। তারপর চৌদ্দ ভাইবোন বেশ ছিলাম। সময়ের টানাপোড়েনে চার ভাই তিন বোন চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে,এখন আপাতত আমরা সাত। হয়তো আবারো আঙ্গুলের কর গুনতে হবে কেউ আমরা নেই। পাবনার দোহারপাড়ার বাড়িতে আমাদের ছোটবেলা। আমি ছোট বলে অতীত গল্প গুলি বড়দের কাছ থেকে যখন শুনি, তখন রূপকথার গল্পের মতো মনে হয়।

১৯৭৪ বাড়ির সামনে হাজারো মানুষ, বাড়ির ভেতরে যারা আছে তাদের মুখের দিকে তাকাতে পারছি না, আতঙ্ক চোখেমুখে। বাড়ি থেকে একে একে সবাই কোথায় যেন চলে গেল শুধু মা বাড়ির সিঁড়ির উপর বসে বুকে কোরআন শরীফ নিয়ে দোয়া করছেন- বুঝতে পারি দোহারপাড়ার বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হবে; কারণ একটাই কবিতা লেখার জন্য। কী কবিতা, কেমন কবিতা, কিছুই জানি না। একসময় দেখলাম তপন ভাই (আবিদ হায়দার) আর ছোট চাচা আবুল কাশেম মিছিলের সামনে গিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছেন বাড়িটা যেন না পোড়ানো হয়। বাড়িটা না পোড়ানোর নেপথ্যে সহযোগিতা করেছিলেন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী। সেই দিনগুলির কথা এখনো মনে পড়ে।

মাকে জিজ্ঞাসা করি- “মানুষ আমাদের বাড়ি পোড়াতে চায় কেন? মা উত্তরে শুধু বলেছিলেন, “আল্লাহ আল্লাহ কর, খোকন (দাউদ হায়দার) নাকি একটা কবিতা লিখেছে সেটার জন্য...। অনেক পরে জানতে পেরেছিলাম কী কবিতা। তারপর তো খোকন ভাইকে নির্বাসনে চলে যেতে হলো। একটি কবিতা লেখার জন্য আমাদের থেকে দূরে চলে গেলেন। আজো ফিরে আসতে পারলেন না বাংলাদেশের মাটিতে, আমাদের কাছে, আর কখনো আসবেন না চিরবিদায় নিলেন।

আমাদের প্রতি অভিমান। শেষ দেখাটাও হলো না। এপ্রিল ২৭ তারিখে সকালে ফোন বেজে উঠলে রিসিভ করতেই ফোনের ওপ্রান্ত থেকে রাকা (ভাগ্নি) বলল, “খোকন মামা আর নেই”। আমি চুপ হয়ে যাই। এই তো সেদিন জানুয়ারি ২০২৪ খোকন ভাই (দাউদ হায়দার), আমি, নোয়া ভাই (মাকিদ হায়দার), স্বপন ভাই (জাহিদ হায়দার) কলকাতার বইমেলায় চার ভাই বই কিনছি, এটা সেটা খাচ্ছি, আরো কত কী! খোকন ভাইয়ের জনপ্রিয়তা দেখেছি সেদিন বইমেলাতে, তাঁকে ঘিরে কত লেখক, পাঠক, বন্ধু, বান্ধবী। মাকিদ ভাই একসময় বলেই ফেলল, “ওর সাথে আসা আমাদের ঠিক হয়নি, আসলাম চার ভাই একসাথে বইমেলায় আড্ডা দিব তা না... জাহিদ ভাই বললেন, কবি মানুষ তো, তারপরে কলকাতার সাহিত্য তাঁর দখলে, অতএব এমনটা তো হবেই, আমাদের মেনে নিতে হবে...। আমি ছোট শুধু শুনে যাবার পালা।

খোকন ভাইকে (দাউদ হায়দার) বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত করে ভারত পাঠিয়ে দেওয়া হয়, তারপর ভারত থেকে জার্মানি চলে যান।

আমাদের থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে। বিচ্ছিন্ন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকলাম আমরা। সে যে আরেক মহাদেশ। বহু, বহুদূর। ইতোমধ্যে আমি কলকাতার রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক নিয়ে লেখাপড়া করতে গেছি। আমার কলকাতা নিয়ে ভাইবোনেরা বলত, “খোকন কলকাতা থেকে জার্মানি, আর তৌহিদ (আরিফ হায়দার) কলকাতায়...”।কলকাতায় গিয়ে মনে হলো এখন আমি স্বাধীন, কেউ আমাকে বকাঝকা করতে পারবেনা, যা ইচ্ছে তাই করতে পারব। কিন্তু সে গুড়ে বালি। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটকের শিক্ষকরা জেনে গেছেন আমি জিয়া হায়দারের, দাউদ হায়দারের ছোটভাই। কোনো সাহিত্য আড্ডা আর্ট প্রদর্শনী যেখানেই যাই এবং মানুষের সাথে পরিচয় হলেই কথায় কথায় উঠে আসতো দাউদ হায়দারের নাম। শেষমেশ আর যা ইচ্ছে তাই করতে পারতাম না। রবীন্দ্র ভারতীতে পড়ালেখা করার সময় আমার জন্য খরচ পাঠাতেন জার্মানি থেকে; কিন্তু একদিন বুঝতে পারলেন টাকাটা অতিরিক্ত খরচ করছি। কোনো কথা না বলে শুধু একটি অনুমতি পত্র পাঠালেন, চিঠিতে লেখা আছে তুমি ‘প্রতিদিন’ (কলকাতার দৈনিক কাগজ) পত্রিকায় মাসের ৫ তারিখে গিয়ে ২৫০০ টাকা নিয়ে আসবে; ওই টাকাগুলি আমার লেখার সম্মানী। তবে মনে রেখো আমি না লিখলে টাকা পাবে না, আমার টাকা কখনো বন্ধ হয়নি; নিয়মিত লিখতেন প্রতিদিন কাগজে, শুধু আমার জন্য, তার শরীর অসুস্থ থাকলেও লেখাটা পাঠাতেন, এই হচ্ছে ভাই। শুধু আমার খবর নিতেন না আমাদের সকলের খবর নিতেন সবসময়। প্রায় প্রতিদিন ভিডিও কল করে কথা বলতেন, কে কেমন আছে জানতে চাইতেন, আমার দুই ছেলে ফসল-শস্যর খবর নিতেই বলতেন “আমার দুই বাবা কেমন আছে?” কথা বলতে বলতে ফিরে আসতেন পাবনার দোহারপাড়ার কথায়, দোহারপাড়ার  সকলে কেমন আছে পুকুরের সব ক’টি শান বাঁধানো ঘাট কি আছে না ভেঙে গেছে, বাড়িটা ভেঙে যাচ্ছে সারার ব্যবস্থা কর, তপনকে (আবিদ হায়দার) বল বাড়ি সারার ব্যবস্থা করতে, আমি যতটা পারি টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করছি, আমি যে শালগাছটা লাগিয়েছিলাম সেটা এখন কতটা বড় হয়েছে, এরকম অনেক জিজ্ঞাসা।

এখন আর জিজ্ঞাসা করবে না, কোনো ফোন কল আসবেনা, আমার স্ত্রী কবিতাকে (কবিতা হায়দার) জার্মানি থেকে ফুলের ছবি, আকাশের ছবি, বরফ পড়ার ছবি পাঠাবে না।

খোকন ভাই আপনার লেখা চিঠিগুলি আমি যতœ করে রেখে দিয়েছি, নিজেকে বুঝবার জন্য। বারবার চিঠিগুলি পড়ি। আমি যে এখনো বাংলা ভালো করে লিখতে পারি না; তা আপনি চিঠিতে বলেছেন, কিন্তু একটা কবিতা দেখে বলেছিলেন “অল্প কথায় কবিতাটা ভালো লিখেছিস...”  তারপরেও কবিতার শব্দ উলট-পালট করে দিয়ে বলেছিলেন “এমনটা হলে আরো ভালো হতো...”। এখন থেকে আর কখনো বলবেন না এমন কথা।

আপনার একটি কবিতা যা আজ সত্য হলো-

এপিটাফ

যে-দেশে আমার মৃত্যুর অধিকার ছিল

সেই দেশ থেকে নির্বাসিত আমি

এই দেশে, বিদেশ বিভুঁইয়ে

অভুক্ত দেহমনে

বেঁচে আছি, ক্ষুধার্তপ্রাণ; কিমাশ্চর্য বাঁচা!

আমার মৃত্যুর পরে লিখে দিও

জননী জন্মভূমি ছেড়ে অচেনা নগরে তার

মৃত্যু হয়েছিল

মূলত সে কবি, তারও আকাক্সক্ষা ছিল

স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সাম্য, ছিল স্বপ্ন

বিজয়ী যোদ্ধার মতো

back to top