আজিজুল পারভেজ
নোবেল বিজয়ী জার্মান লেখক গুন্টার গ্রাসের সাথে সদ্যপ্রয়াত বাংলাদেশী নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দার
রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা ধর্মীয় কারণে কবি-সাহিত্যিকদের দেশান্তরী হওয়ার ইতিহাস খুব ছোট নয়। বৈরী পরিবেশে নিরাপত্তা না পেয়ে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন অনেকে। কাউকে কাউকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নিষিদ্ধ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে এমন নজির অনেক। নির্বাসিত লেখকদের তালিকায় আছে ইংল্যান্ডের কবি লর্ড বায়রন, লেখক ডিএইচ লরেন্স, ভারতীয় বংশোদ্ভূত সালমান রুশদি, ফরাসি লেখক এমিল জোলা, ভিক্টর হুগো, আয়ারল্যান্ডের লেখক অস্কার ওয়াইল্ড, জার্মানির নাট্যকার বের্টল্ড ব্রেখট, চিলির কবি পাবলো নেরুদা, আয়ারল্যান্ডের জেমস জয়েস, চেকোস্লোভাকিয়ার মিলান কুন্ডেরা, তুরস্কের কবি নাজিম হিকমত, ফিলিস্তিনি কবি মাহমুদ দারবিশ, চীনের নোবেলজয়ী গাও জিং জিয়ানের মতো জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের নাম। নির্বাসিত লেখকদের আবার দেশে ফেরার সৌভাগ্য খুব একটা ঘটেনি।
ব্রিটিশ-ভারতে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়েছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্যসহ অনেকে। তবে নির্বাসনের ঘটনা ঘটেছে স্বাধীন বাংলাদেশে, স্বাধীনতার তিন বছরের মধ্যেই। কবিতা লেখার জন্য হুমকির মুখে প্রথম দেশান্তরী হন কবি দাউদ হায়দার। এরপর শারীরিকভাবে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
২
১৯৬৯ সালের দিকে দাউদ হায়দার নামক এক যুবক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে যান। ভাইভা বোর্ডে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়:
- বল তো, ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ - এটা কার কবিতা?
তিনি হাসিমুখে উত্তর দিয়েছিলেন:
- আমারই লেখা।
বোর্ডের শিক্ষকরা প্রথমে অবাক হয়েছিলেন, কারণ এমন একটি কবিতা এরকম কোনো যুবক লিখতে পারেন তা তাদের ধারণায় ছিল না। কিন্তু পরে তারা তার আগের কিছু লেখা দেখেন এবং তার প্রতিভা বুঝতে পারেন। নথিপত্র অনুসারে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেওয়া কবির বয়স তখন ছিল মাত্র ১৭ বছর!
আলোচিত কবিতাটির কয়েকটি লাইন:
‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ, মাতৃজরায়ু থেকে নেমেই জেনেছি আমি
সন্ত্রাসের ঝাঁঝালো দিনে বিবর্ণ পত্রের মতো হঠাৎ ফুৎকারে উড়ে যাই
পালাই পালাই সুদূরে।
...
আমার জন্যই তোমাদের এত দুঃখ
আহা দুঃখ
দুঃখরে!
আমিই পাপী, বুঝি তাই এ জন্মই আমার আজন্ম পাপ।’
এ রকম দুর্দান্ত সব কবিতা লিখে তারুণ্যেই ঝড় তোলেন, তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়ে যান কবি দাউদ হায়দার।
৩
দাউদ হায়দার দেশের প্রথম কবি- যাঁকে কবিতা লেখার জন্য দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১৯৭৪ সালে ২৪ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংবাদ-এর সাহিত্য সাময়িকীতে ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎ¯œায় কালো বন্যায়’ শিরোনামে একটি কবিতা ছাপা হয়। তাতে বিতর্কিত বক্তব্য থাকার অভিযোগে শুরু হয় প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ এনে ঢাকার এক কলেজ-শিক্ষক মামলা করেন আদালতে।
১১ মার্চ সংবাদ অফিস থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে দাউদ হায়দারকে। এরপর তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকারের উদ্যোগে কবিকে ২০ মে সন্ধ্যায় জেল থেকে মুক্তি দিয়ে ২১ মে সকালে বাংলাদেশ বিমানের একটা নিয়মিত ফ্লাইটে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতের কলকাতায়। ওই ফ্লাইটে কবি ছাড়া আর কোনো যাত্রী ছিলেন না। ছিল না ভিসা, টিকিট কিছুই। তাঁর স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, তাঁর মানিব্যাগে সে সময় ছিল ভারতীয় মাত্র ৬০ পয়সা। একটা স্যুটকেসে একজোড়া স্যান্ডেল, দুটি প্যান্ট, দুটি শার্ট, তোয়ালে, টুথপেস্ট, টুথব্রাশ, পাঁচ কপি জন্মই আমার আজন্ম পাপ, জেলে লেখা পদ্যের খাতা আর একটি ডায়রি। আত্মজীবনী প্রথম পর্ব ইল্লিন ঝিল্লিন এ সব তথ্য দিয়েছেন দাউদ।
মাত্র ২২ বছর বয়সে মাতৃভূমি হারান দাউদ হায়দার। কবির ভাষায়, ‘আমার কোনো উপায় ছিল না।’
৪
কলকাতা ছিল দাউদ হায়দারের কাছে একদম অচেনা বিদেশ, যেখানে কাউকেই চিনতেন না। এর আগে তিনি বিদেশ যাননি। দমদম এয়ারপোর্টে নেমে প্রথমে একা কাঁদছিলেন। সাংবাদিক-সাহিত্যিক গৌরকিশোর ঘোষের কাছে প্রথম আশ্রয় পান। একমাসের মতো ছিলেন। এরপর বিখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁকে নিজ বাড়িতে আশ্রয় দেন। লেখালেখি শুরু করেন দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ‘আন্তর্জাতিক তুলনামূলক সাহিত্যে’ ।
৫
বাংলাদেশের কোনো সরকারই দাউদ হায়দারের প্রতি সহানুভূতি দেখায়নি। নির্বাসিত অবস্থায় ১৯৭৯ সালে তিনি ভারতে বাংলাদেশ দূতাবাসে নবায়নের জন্য পাসপোর্ট জমা দিলে তা বাজেয়াপ্ত করা হয়। এরপর ভারত সরকারও তাঁকে ভারত ত্যাগের নোটিশ দেয়- “...য়্যু হ্যাভ নো কেইস ফর গ্রান্ট অব লংটার্ম স্টে ফ্যাসিলিটিজ ইন ইন্ডিয়া এন্ড য়্যু আর দেয়ারফর রিকোয়েস্টেড টুলিভ ইন্ডিয়া ইম্মিডিয়েটলি উইদাউট ফেইল।”
নোবেল জয়ী জার্মান সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস ১৯৮৬ সালে প্রথমে ঢাকা ও কলকাতা সফরে এলে পুরো ঘটনা শোনেন। তিনি ফিরে গিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে কথা বলে নির্বাসিত কবিকে জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়ার ব্যবস্থা করেন। ২২ জুলাই ১৯৮৭ থেকে তিনি জার্মানির বার্লিন শহরে অবস্থান করেন। বাংলাদেশ সরকারের কাছে আটক পাসপোর্ট ফেরত চেয়ে আবেদন করেও বিফল হন। বার্লিন যাত্রায় তিনি পাসপোর্টের পরিবর্তে জাতিসংঘের বিশেষ ট্র্যাভেল পাস ব্যবহার করেন। পরে এই ট্র্যাভেল পাস ব্যবহার করে বহু দেশ ঘুরেছেন। ১৯৮৯ সালে তিনি জার্মানিতে সাংবাদিক হিসেবে চাকরি নেন।
৬
দাউদ হায়দার প্রায় ৩০টির মতো বই লিখেছেন- জার্মান, হিন্দি, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, জাপানি ও স্প্যানিশ ভাষায়। দাউদ হায়দারের কবিতায় ব্যক্তিগত বেদনা, নির্বাসনের কষ্ট, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, স্বাধীনতা-চেতনা, দ্রোহ এবং মানবতাবাদী চেতনা প্রবলভাবে ফুটে ওঠে। তিনি দীর্ঘ সময় বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় সাহসী উচ্চারণে কলাম লিখেও জনপ্রিয়তা পেয়েছেন।
৭
পাবনার দোহারপাড়ায় জন্ম নেওয়া দাউদ হায়দার ছিলেন এক রতœগর্ভা মায়ের সন্তান। মহাভারতের আলোচিত পঞ্চপা-বের মতো তাঁর সব ভাই-ই বিখ্যাত, লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। বড় ভাই জিয়া হায়দার নাট্যকার, অধ্যাপক। রশীদ হায়দার কথাসাহিত্যিক, গবেষক। বাংলা একাডেমিতে কর্মরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অসাধারণসব বই প্রকাশ করেছেন। মাকিদ হায়দার ও জাহিদ হায়দার কবি। এঁদের কনিষ্ঠ জাহিদ ছাড়া চারজনই এখন প্রয়াত। তবে তিন মায়ের ঘরে তাঁরা মোট ভাইবোন তেরোজন।
অন্য ভাইয়েরাও রয়েছেন শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে। সর্বকনিষ্ঠ আরিফ হায়দার আমাদের অগ্রজ বন্ধু। নাটকের মানুষ। বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলার অধ্যাপক। এখন নিয়মিত দেখা-সাক্ষাত না হলেও ফোন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কথা হয়। বিখ্যাত হায়দার পরিবারের একেকজন তারকা-নক্ষত্রের খসে পড়ার সংবাদ এলে তাকে ফোন দেই। বেদনাকে শেয়ার করি। সাংবাদিকতার সূত্রে বাড়তি তথ্য সংগ্রহের জন্য নির্দয়ভাবে নানা প্রশ্ন করি।
শনিবার (২৭ এপ্রিল ২০২৫) ঘুম ভাঙতেই শুনি কবি দাউদ হায়দার আর নেই। রাতে জার্মানির রাজধানী বার্লিনে আত্মীয়-পরিজনহীন অবস্থায় একটি বয়স্ক নিরাময় কেন্দ্রে মারা গেছেন। হাসপাতালে দীর্ঘদিন কোমায় ছিলেন। লাইভসাপোর্ট তুলে নিলে তিনি অনন্তের পথে যাত্রা করেন। চিরমুক্তি ঘটে ৫১ বছর ধরে দেশহীন এক নির্বাসিত কবিজীবনের। তিনি আমৃত্যু অকৃতদার ছিলেন।
এবার আর আরিফ ভাইকে ফোন দিতে ইচ্ছে করেনি। জানতাম তিনি কলকাতায়। তারপরও ফেসবুকের ইনবক্সে সমবেদনা জানাই। পরক্ষণেই দেখি আরিফ ভাই লিখেছেন, ‘খোকন ভাই (নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দার) আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে...।’ এরপর ভাইয়ের সঙ্গে কিছু ছবি শেয়ার দিয়েছেন, যেগুলো ২০২৩ সালের, কলকাতার। তার অনুভূতি প্রকাশ করেছে দৈনিক মানবজমিন। শিরোনাম ‘নির্বাসিত দাউদ হায়দার না আমরা?’
৮
দেশে ফেরার প্রবল আকুতি ছিল দাউদ হায়দারের। অপেক্ষার প্রহর গুনেছেন, স্বপ্ন দেখেছেন একদিন সময় আসবে পদ্মা-ইচ্ছামতি গাঙ-শালিকের দেশে ফেরার। সময় কি আর হবে? হলেও তো মাতৃভূমিতে শায়িত হওয়ার বাসনা তার আর পূরণ হবে না। পারিবারিক সূত্রে জেনেছিলাম, কলকাতায় অবস্থানকালে একবার মায়ের অসুস্থতার খরব শুনে গোপনে চলে এসেছিলেন পাবনায়। জার্মান যাওয়ার পর আর ফেরা হয়নি। তবে কলকাতায় বইমেলায় বারবার ছুটে আসতেন। এই সুযোগে দুই/এক বছর পরপর ভাইবোনরা দেখা করতে যেতেন। সেখানে তাঁদের পুনর্মিলনী হতো।কলকাতায় অবস্থানকালে ১৯৮৩ সালে কবি দেশান্তরী হওয়ার গভীর বেদনার কথা লিখেছেন ‘তোমার কথা’ কবিতায়।
‘মাঝে মাঝে মনে হয়
অসীম শূন্যের ভিতরে উড়ে যাই।
মেঘের মতন ভেসে ভেসে, একবার
বাংলাদেশ ঘুরে আসি।
মনে হয়, মনুমেন্টের চুড়োয় উঠে
চিৎকার করে
আকাশ ফাটিয়ে বলি:
দ্যাখো, সীমান্তের ওইপারে আমার ঘর
এইখানে আমি একা, ভিনদেশী।’
৯
আসলেই মানুষ সব সময়ই একা। অবশ্য ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন মনে করেন কবির কোনো দেশ থাকে না। তিনি লিখেছেন-
‘কবির কোনো দেশ থাকে না, দেশ থাকতে নেই!
(সব দেশ তাঁর দেশ হয়ে যায় নীরব অলক্ষ্যেই)...
নির্বাসনে পাঠায় যখন কবির নিজের দেশ-
তখন কবির জীবনব্যাপী অশ্রু অনিঃশেষ...
মাতৃভূমি সন্তানেরে বিতাড়নের পর-
দেশ হয়ে যায় সে সন্তানের স্মৃতির কুঁড়েঘর...
সামান্য ঝড়-ঝাপটা সে ঘর সইতে নাহি পারে,
দেশের বাতাস মৃত্তিকা ঘাস কি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে!!
দেশান্তরী সে সন্তানের আদর মাখা মুখ-
স্মরণ করে দেশ কি কাঁদে? তারও ভাঙে বুক?...’
azizulparvez@gmail.com
আজিজুল পারভেজ
নোবেল বিজয়ী জার্মান লেখক গুন্টার গ্রাসের সাথে সদ্যপ্রয়াত বাংলাদেশী নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দার
বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫
রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা ধর্মীয় কারণে কবি-সাহিত্যিকদের দেশান্তরী হওয়ার ইতিহাস খুব ছোট নয়। বৈরী পরিবেশে নিরাপত্তা না পেয়ে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন অনেকে। কাউকে কাউকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নিষিদ্ধ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে এমন নজির অনেক। নির্বাসিত লেখকদের তালিকায় আছে ইংল্যান্ডের কবি লর্ড বায়রন, লেখক ডিএইচ লরেন্স, ভারতীয় বংশোদ্ভূত সালমান রুশদি, ফরাসি লেখক এমিল জোলা, ভিক্টর হুগো, আয়ারল্যান্ডের লেখক অস্কার ওয়াইল্ড, জার্মানির নাট্যকার বের্টল্ড ব্রেখট, চিলির কবি পাবলো নেরুদা, আয়ারল্যান্ডের জেমস জয়েস, চেকোস্লোভাকিয়ার মিলান কুন্ডেরা, তুরস্কের কবি নাজিম হিকমত, ফিলিস্তিনি কবি মাহমুদ দারবিশ, চীনের নোবেলজয়ী গাও জিং জিয়ানের মতো জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের নাম। নির্বাসিত লেখকদের আবার দেশে ফেরার সৌভাগ্য খুব একটা ঘটেনি।
ব্রিটিশ-ভারতে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়েছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্যসহ অনেকে। তবে নির্বাসনের ঘটনা ঘটেছে স্বাধীন বাংলাদেশে, স্বাধীনতার তিন বছরের মধ্যেই। কবিতা লেখার জন্য হুমকির মুখে প্রথম দেশান্তরী হন কবি দাউদ হায়দার। এরপর শারীরিকভাবে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
২
১৯৬৯ সালের দিকে দাউদ হায়দার নামক এক যুবক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে যান। ভাইভা বোর্ডে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়:
- বল তো, ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ - এটা কার কবিতা?
তিনি হাসিমুখে উত্তর দিয়েছিলেন:
- আমারই লেখা।
বোর্ডের শিক্ষকরা প্রথমে অবাক হয়েছিলেন, কারণ এমন একটি কবিতা এরকম কোনো যুবক লিখতে পারেন তা তাদের ধারণায় ছিল না। কিন্তু পরে তারা তার আগের কিছু লেখা দেখেন এবং তার প্রতিভা বুঝতে পারেন। নথিপত্র অনুসারে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেওয়া কবির বয়স তখন ছিল মাত্র ১৭ বছর!
আলোচিত কবিতাটির কয়েকটি লাইন:
‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ, মাতৃজরায়ু থেকে নেমেই জেনেছি আমি
সন্ত্রাসের ঝাঁঝালো দিনে বিবর্ণ পত্রের মতো হঠাৎ ফুৎকারে উড়ে যাই
পালাই পালাই সুদূরে।
...
আমার জন্যই তোমাদের এত দুঃখ
আহা দুঃখ
দুঃখরে!
আমিই পাপী, বুঝি তাই এ জন্মই আমার আজন্ম পাপ।’
এ রকম দুর্দান্ত সব কবিতা লিখে তারুণ্যেই ঝড় তোলেন, তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়ে যান কবি দাউদ হায়দার।
৩
দাউদ হায়দার দেশের প্রথম কবি- যাঁকে কবিতা লেখার জন্য দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১৯৭৪ সালে ২৪ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংবাদ-এর সাহিত্য সাময়িকীতে ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎ¯œায় কালো বন্যায়’ শিরোনামে একটি কবিতা ছাপা হয়। তাতে বিতর্কিত বক্তব্য থাকার অভিযোগে শুরু হয় প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ এনে ঢাকার এক কলেজ-শিক্ষক মামলা করেন আদালতে।
১১ মার্চ সংবাদ অফিস থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে দাউদ হায়দারকে। এরপর তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকারের উদ্যোগে কবিকে ২০ মে সন্ধ্যায় জেল থেকে মুক্তি দিয়ে ২১ মে সকালে বাংলাদেশ বিমানের একটা নিয়মিত ফ্লাইটে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতের কলকাতায়। ওই ফ্লাইটে কবি ছাড়া আর কোনো যাত্রী ছিলেন না। ছিল না ভিসা, টিকিট কিছুই। তাঁর স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, তাঁর মানিব্যাগে সে সময় ছিল ভারতীয় মাত্র ৬০ পয়সা। একটা স্যুটকেসে একজোড়া স্যান্ডেল, দুটি প্যান্ট, দুটি শার্ট, তোয়ালে, টুথপেস্ট, টুথব্রাশ, পাঁচ কপি জন্মই আমার আজন্ম পাপ, জেলে লেখা পদ্যের খাতা আর একটি ডায়রি। আত্মজীবনী প্রথম পর্ব ইল্লিন ঝিল্লিন এ সব তথ্য দিয়েছেন দাউদ।
মাত্র ২২ বছর বয়সে মাতৃভূমি হারান দাউদ হায়দার। কবির ভাষায়, ‘আমার কোনো উপায় ছিল না।’
৪
কলকাতা ছিল দাউদ হায়দারের কাছে একদম অচেনা বিদেশ, যেখানে কাউকেই চিনতেন না। এর আগে তিনি বিদেশ যাননি। দমদম এয়ারপোর্টে নেমে প্রথমে একা কাঁদছিলেন। সাংবাদিক-সাহিত্যিক গৌরকিশোর ঘোষের কাছে প্রথম আশ্রয় পান। একমাসের মতো ছিলেন। এরপর বিখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁকে নিজ বাড়িতে আশ্রয় দেন। লেখালেখি শুরু করেন দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ‘আন্তর্জাতিক তুলনামূলক সাহিত্যে’ ।
৫
বাংলাদেশের কোনো সরকারই দাউদ হায়দারের প্রতি সহানুভূতি দেখায়নি। নির্বাসিত অবস্থায় ১৯৭৯ সালে তিনি ভারতে বাংলাদেশ দূতাবাসে নবায়নের জন্য পাসপোর্ট জমা দিলে তা বাজেয়াপ্ত করা হয়। এরপর ভারত সরকারও তাঁকে ভারত ত্যাগের নোটিশ দেয়- “...য়্যু হ্যাভ নো কেইস ফর গ্রান্ট অব লংটার্ম স্টে ফ্যাসিলিটিজ ইন ইন্ডিয়া এন্ড য়্যু আর দেয়ারফর রিকোয়েস্টেড টুলিভ ইন্ডিয়া ইম্মিডিয়েটলি উইদাউট ফেইল।”
নোবেল জয়ী জার্মান সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস ১৯৮৬ সালে প্রথমে ঢাকা ও কলকাতা সফরে এলে পুরো ঘটনা শোনেন। তিনি ফিরে গিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে কথা বলে নির্বাসিত কবিকে জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়ার ব্যবস্থা করেন। ২২ জুলাই ১৯৮৭ থেকে তিনি জার্মানির বার্লিন শহরে অবস্থান করেন। বাংলাদেশ সরকারের কাছে আটক পাসপোর্ট ফেরত চেয়ে আবেদন করেও বিফল হন। বার্লিন যাত্রায় তিনি পাসপোর্টের পরিবর্তে জাতিসংঘের বিশেষ ট্র্যাভেল পাস ব্যবহার করেন। পরে এই ট্র্যাভেল পাস ব্যবহার করে বহু দেশ ঘুরেছেন। ১৯৮৯ সালে তিনি জার্মানিতে সাংবাদিক হিসেবে চাকরি নেন।
৬
দাউদ হায়দার প্রায় ৩০টির মতো বই লিখেছেন- জার্মান, হিন্দি, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, জাপানি ও স্প্যানিশ ভাষায়। দাউদ হায়দারের কবিতায় ব্যক্তিগত বেদনা, নির্বাসনের কষ্ট, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, স্বাধীনতা-চেতনা, দ্রোহ এবং মানবতাবাদী চেতনা প্রবলভাবে ফুটে ওঠে। তিনি দীর্ঘ সময় বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় সাহসী উচ্চারণে কলাম লিখেও জনপ্রিয়তা পেয়েছেন।
৭
পাবনার দোহারপাড়ায় জন্ম নেওয়া দাউদ হায়দার ছিলেন এক রতœগর্ভা মায়ের সন্তান। মহাভারতের আলোচিত পঞ্চপা-বের মতো তাঁর সব ভাই-ই বিখ্যাত, লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। বড় ভাই জিয়া হায়দার নাট্যকার, অধ্যাপক। রশীদ হায়দার কথাসাহিত্যিক, গবেষক। বাংলা একাডেমিতে কর্মরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অসাধারণসব বই প্রকাশ করেছেন। মাকিদ হায়দার ও জাহিদ হায়দার কবি। এঁদের কনিষ্ঠ জাহিদ ছাড়া চারজনই এখন প্রয়াত। তবে তিন মায়ের ঘরে তাঁরা মোট ভাইবোন তেরোজন।
অন্য ভাইয়েরাও রয়েছেন শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে। সর্বকনিষ্ঠ আরিফ হায়দার আমাদের অগ্রজ বন্ধু। নাটকের মানুষ। বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলার অধ্যাপক। এখন নিয়মিত দেখা-সাক্ষাত না হলেও ফোন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কথা হয়। বিখ্যাত হায়দার পরিবারের একেকজন তারকা-নক্ষত্রের খসে পড়ার সংবাদ এলে তাকে ফোন দেই। বেদনাকে শেয়ার করি। সাংবাদিকতার সূত্রে বাড়তি তথ্য সংগ্রহের জন্য নির্দয়ভাবে নানা প্রশ্ন করি।
শনিবার (২৭ এপ্রিল ২০২৫) ঘুম ভাঙতেই শুনি কবি দাউদ হায়দার আর নেই। রাতে জার্মানির রাজধানী বার্লিনে আত্মীয়-পরিজনহীন অবস্থায় একটি বয়স্ক নিরাময় কেন্দ্রে মারা গেছেন। হাসপাতালে দীর্ঘদিন কোমায় ছিলেন। লাইভসাপোর্ট তুলে নিলে তিনি অনন্তের পথে যাত্রা করেন। চিরমুক্তি ঘটে ৫১ বছর ধরে দেশহীন এক নির্বাসিত কবিজীবনের। তিনি আমৃত্যু অকৃতদার ছিলেন।
এবার আর আরিফ ভাইকে ফোন দিতে ইচ্ছে করেনি। জানতাম তিনি কলকাতায়। তারপরও ফেসবুকের ইনবক্সে সমবেদনা জানাই। পরক্ষণেই দেখি আরিফ ভাই লিখেছেন, ‘খোকন ভাই (নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দার) আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে...।’ এরপর ভাইয়ের সঙ্গে কিছু ছবি শেয়ার দিয়েছেন, যেগুলো ২০২৩ সালের, কলকাতার। তার অনুভূতি প্রকাশ করেছে দৈনিক মানবজমিন। শিরোনাম ‘নির্বাসিত দাউদ হায়দার না আমরা?’
৮
দেশে ফেরার প্রবল আকুতি ছিল দাউদ হায়দারের। অপেক্ষার প্রহর গুনেছেন, স্বপ্ন দেখেছেন একদিন সময় আসবে পদ্মা-ইচ্ছামতি গাঙ-শালিকের দেশে ফেরার। সময় কি আর হবে? হলেও তো মাতৃভূমিতে শায়িত হওয়ার বাসনা তার আর পূরণ হবে না। পারিবারিক সূত্রে জেনেছিলাম, কলকাতায় অবস্থানকালে একবার মায়ের অসুস্থতার খরব শুনে গোপনে চলে এসেছিলেন পাবনায়। জার্মান যাওয়ার পর আর ফেরা হয়নি। তবে কলকাতায় বইমেলায় বারবার ছুটে আসতেন। এই সুযোগে দুই/এক বছর পরপর ভাইবোনরা দেখা করতে যেতেন। সেখানে তাঁদের পুনর্মিলনী হতো।কলকাতায় অবস্থানকালে ১৯৮৩ সালে কবি দেশান্তরী হওয়ার গভীর বেদনার কথা লিখেছেন ‘তোমার কথা’ কবিতায়।
‘মাঝে মাঝে মনে হয়
অসীম শূন্যের ভিতরে উড়ে যাই।
মেঘের মতন ভেসে ভেসে, একবার
বাংলাদেশ ঘুরে আসি।
মনে হয়, মনুমেন্টের চুড়োয় উঠে
চিৎকার করে
আকাশ ফাটিয়ে বলি:
দ্যাখো, সীমান্তের ওইপারে আমার ঘর
এইখানে আমি একা, ভিনদেশী।’
৯
আসলেই মানুষ সব সময়ই একা। অবশ্য ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন মনে করেন কবির কোনো দেশ থাকে না। তিনি লিখেছেন-
‘কবির কোনো দেশ থাকে না, দেশ থাকতে নেই!
(সব দেশ তাঁর দেশ হয়ে যায় নীরব অলক্ষ্যেই)...
নির্বাসনে পাঠায় যখন কবির নিজের দেশ-
তখন কবির জীবনব্যাপী অশ্রু অনিঃশেষ...
মাতৃভূমি সন্তানেরে বিতাড়নের পর-
দেশ হয়ে যায় সে সন্তানের স্মৃতির কুঁড়েঘর...
সামান্য ঝড়-ঝাপটা সে ঘর সইতে নাহি পারে,
দেশের বাতাস মৃত্তিকা ঘাস কি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে!!
দেশান্তরী সে সন্তানের আদর মাখা মুখ-
স্মরণ করে দেশ কি কাঁদে? তারও ভাঙে বুক?...’
azizulparvez@gmail.com