নরেন্দ্রনাথ মিত্রের সাহিত্যভাবনা
নূর-ই আলম সিদ্দিকী
(নরেন্দ্রনাথ মিত্র / জন্ম : ৩০ জানুয়ারি ১৯১৬; মৃত্যু: ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫)
আধুনিক বাংলা ছোটগল্পের বিস্ময়কর প্রতিভা নরেন্দ্রনাথ মিত্র। রবীন্দ্রোত্তর এ কথাকার ছোটগল্প রচনায় আপন কৃতিত্বে ভাস্বর। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ পরবর্তী সময়ে মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক ও পারিবারিক জীবনের স্বপ্ন, হতাশা, ব্যর্থতা ও ভালোবাসা তাঁর গল্পের কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৪৭ সালে একত্রিশ বছরের নরেন্দ্রনাথ দেশভাগে শিকার হতাশাগ্রস্ত মানুষের টানাপোড়েন ও মানসিক যন্ত্রণা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন। দেশভাগ-উত্তর বিপর্যস্ত অর্থনীতি, মন্বন্তর ও দাঙ্গা কবলিত মানুষের বাঁচার আকুতি তাঁর গল্পের মূল প্রতিপাদ্য। এবং এই ছিন্নমূল বিবর্ণ, হতশ্রী মানুষই তাঁর গল্প-উপন্যাসের শিল্পিত ক্যানভাস। ফলে ঘরহারা মানুষের প্রেম-প্রীতি ও মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা তাঁর গল্পে পিনবদ্ধ হয়েছে সযতেœ। আধুনিক ছোটগল্পের অন্যতম প্রান্ত মানুষের রহস্যময় চিত্তবৃত্তির অন্বয়। যেখানে বাইরের ঘটনার সঙ্গে মনের গোপন-গহন দিক অন্যতম অনুষঙ্গ। সিগমন্ড ফ্রয়েডের দর্শনের প্রভাবে আধুনিক গল্প রচয়িতারা মানুষের অন্তর্জীবন দুর্জ্ঞেয়তার উপর আলো ফেলেছেন। বাংলা সাহিত্যে মনস্তাত্ত্বিক গল্পের সফল নির্মাতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রেমেন্দ্র মিত্র ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর আছেন মনস্তাত্ত্বিক গল্পের সার্থক শিল্পী নরেন্দ্রনাথ মিত্র। নরেন্দ্রনাথ মিত্র তাঁর গল্প ও উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মনের গূঢ়রহস্য উন্মোচনে শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। লক্ষণীয় মানুষের মনের অন্ধকার জগৎ গল্পে প্রতিপাদিত করলেও তাতে তিনি মনোবিকারকে প্রশ্রয় দেননি। সদর্থক জীবনের এ গল্পকার জানতেন মানুষের স্খলন পতন গর্বের বস্তু নয়, বরং ‘যেখানে আমরা মহৎ, শক্তিমান সেখানে যেন আমাদের যথার্থ পরিচয় রয়েছে।’ তাঁর মনোভাব সম্পর্কে সমালোচক বলেন- ‘লেখক প্রধানত মন নিয়ে কারবার করতে ভালোবাসেন। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ঘাত-প্রতিঘাতে বাইরের পরিবেশ হয়তো বদলায় কিন্তু তার চাইতে বেশি বদলায় মানুষের মন- মনের এই রংফেরতার কাহিনিই তিনি বিশেষ করে ফুটিয়েছেন তাঁর নানা গল্পগুলিতে।’ বাংলা ছোটগল্পের বিষয় নির্বাচন ও তার উপস্থাপন-রীতির বৈচিত্র্যে তিনি নতুন মাত্রা সংযোজন করেন। মানব স্বভাবের অন্তর্গূঢ় প্রবণতা ও পরিবর্তিত সময়ের প্রভাবে অস্থির মানুষের গল্প রচনা করেছেন নরেন্দ্রনাথ মিত্র। দক্ষ চিত্রগ্রাহকের নিবিড় অবলোকন এবং অসামান্য শিল্প-প্রকরণে নির্মিত হয়েছে তাঁর প্রতিটি ছোটগল্প। বাংলার ইতিহাসে চোখ ফেরালে দেখা যায় চল্লিশের দশক থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পর্যন্ত বাংলার আকাশের উপর দিয়ে বয়ে গেছে ইতিহাসের প্রচ- ঝড়। চল্লিশ সালের পর দেশের অভ্যন্তরে একের পর একে ঘটে দুর্ভিক্ষ, বস্ত্রসংকট, যুদ্ধের বোমাবর্ষণ, আজাদ হিন্দ ফৌজের লড়াই, দাঙ্গা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি দেশ ভাগের ট্রাজেডি। হৃদয় বিদারক মারাত্মক এ সকল ঘটনার প্রভাবে মানুষের ব্যক্তিজীবন, সমাজ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত বদল হতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতে বাঙালি মানসে লাগে প্রবল ভাঙনের ঢেউ। বিক্ষিপ্ত এ সকল অশুভ কর্মকা-ের প্রতিক্রিয়ায় মানুষের মন থেকে অপসৃত হতে থাকে দীর্ঘদিনের লালিত মূল্যবোধ। একই সঙ্গে সমাজ কাঠামোতে ধরে ব্যাপক কাঁপন ও ভাঙন। ভয়াবহ এ বিপর্যয়ে বাঙালির প্রাত্যহিক জীবনে বিশ্ব-রাজনীতির নৈরাশ্য আর নৈরাজ্যের সীমাহীন বিস্তৃতি ঘটে। অসংখ্য ঘটনার চাপে ভারতবর্ষের মানুষের জীবন হয়ে পড়ে বিপন্ন। স্পর্শকাতর এসব ঘটনার বিরূপ প্রতিক্রিয়াকবলিত ছিন্নমূল অসহায় মানুষের নিরাপত্তাহীন ও অসুস্থ জীবনকে নিয়েই নরেন্দ্রনাথ রচনা করেছেন তাঁর গল্প ও উপন্যাস। দেশভাগ পরবর্তী কলকাতা ছিন্নমূল মানুষে ভরে যায়। পরবাসী মানুষ নিপতিত হয় বহুমুখী সংকটে। এ সময়ের মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্ত সমাজের আবেগ-অনুভূতি ও বিকার খুব সহজ কথায় দক্ষতার সঙ্গে নরেন্দ্রনাথ মিত্র গল্পের ক্যানভাসে রেখায়িত করেছেন। গল্পে কাহিনির আল্পনায় তিনি গেঁথেছেন বিধ্বস্ত দেশের বিকীর্ণ অবয়ব ও ক্লেদাক্ত সময়। তাঁর অধিকাংশ গল্পের মূল চরিত্র হয়ে উঠেছে দেশতাড়িত, খাদ্য, বস্ত্র ও জীবিকাহীন মানসিক সংকটে উৎকণ্ঠিত মানুষ। গল্পের ভেতর এসব নিরন্ন মানব সবকিছু হারিয়েও পুরনো মূল্যবোধকে সঙ্গে নিয়ে প্রাণপণ সংগ্রাম করে যায়। নরেন্দ্রনাথের গল্পের মানুষেরা দেশছাড়া হলেও নিজেদের ঐতিহ্যকে ছাড়তে পারে না। ছিন্নসত্তা মানুষগুলো বাঁচার আশায় অবলম্বন খোঁজে ফেরে এপার-ওপার বাংলায়। পুরনো ঐতিহ্য আর ভেতরের মানবিকবোধকে সঙ্গে নিয়ে জীবনযুদ্ধে সংগ্রামী এ-সকল মানুষের বহির্বাস্তবতা আর অন্তর্বাস্তবতাকেই নরেন্দ্রনাথ মিত্র তাঁর গল্পের ফিতায় বেঁধেছেন নিপুণ শিল্পকৌশলে। মানব জীবনের মৌলিক এবং মহত্তম বোধকে কথামালার গ্রন্থনে সেঁটে নিজের সৃষ্টিকে করেছেন চির-নতুন। নরেন্দ্রনাথের গল্পের গভীর আলোচনায় এ কথার যথার্থতা মেলে সর্বত্র। আমরা জানি তিরিশ পূর্বে বাংলা কথাসাহিত্যের কেন্দ্র ছিল সমাজের উঁচু-শ্রেণির মানুষ। তিরিশের পর থেকে খুব দ্রুত বিশ^পট পরিবর্তন ঘটতে থাকে। সাহিত্যিকদের রচনায় স্থান পেতে শুরু করে ‘মানুষী সত্তাসম্পন্ন অতি সাধারণ নি¤œবিত্তরা’। কথাকার হিসেবে নরেন্দ্রনাথ মিত্রের আবির্ভাব চল্লিশের দশকে। সাহিত্য জীবনের প্রারম্ভে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক উত্তাপ এবং তা থেকে সৃষ্ট নির্মম পরিণতি তাঁর লেখক মনকে নাড়িয়ে দেয়। তিনি হয়ে ওঠেন জীবনঘনিষ্ঠ কথাকোবিদ। তাঁর গল্পের মধ্যে ওঠে আসতে থাকে ঘরহারা অসহায় মানুষ। যারা জীবনের প্রয়োজনে নিষ্ঠুর পরিণতিকে মোকাবিলা করতে শুরু করে মানবেতর লড়াই। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা আর উন্মূল মানুষের মানবিক মর্যাদাকে সাহিত্যে প্রতিফলিত করতে কলম হাতে নেন তিনি। মানব কল্যাণের ইতিবাচক চেতনায় নরেন্দ্রনাথ মিত্র রবীন্দ্রনাথকে স্বীকার করে, তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে স্ব-বৈশিষ্ট্যে কথাসাহিত্য হয়ে ওঠেন একক ও অনন্য কথাকার। নরেন্দ্রনাথের গল্পের সব থেকে বড় দিক হলো তিনি নিজে যে জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, ঠিক সেই জীবনের নিখুঁত ছবি নির্মোহ বাস্তবতায় গল্প-উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। গল্পের মানস ভূগোলে কল্পনার ফানুস নয় বরং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁর অবলম্বন হয়ে ওঠে। নিজের রচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যাদের আমি দেখেছি, যাদের চরিত্রের কোনো না কোনো বৈশিষ্ট্য আমার মনে বিন্দুমাত্র রেখাপাত করেছে তাদের নিয়ে গল্প ও কাহিনি লিখতে আমার ভাল লাগে। নিছক কল্পনার উপর ভিত্তি করে আমি গল্প লিখতে পারিনে।’ সৃষ্টিশীল চল্লিশ বছর (১৯৩৬-১৯৭৫) সাহিত্য রচনায় বিচরণ করলেও গল্পকার হিসেবেই তিনি সার্থক। একেবারে গোড়ায় জীবন শুরু করেছিলেন নাটক ও উপন্যাস দিয়ে। তারপর কবিতা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত থিতু হয়েছিলেন উপন্যাস ও ছোটগল্পে। কিছু প্রবন্ধও লিখেছেন শেষ বেলায়। উপন্যাস রচনা করে খ্যাতি লাভ করলেও শ্রেষ্ঠত্ব পেয়েছেন ছোটগল্পকার হিসেবেই। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্পের কাহিনিতে স্থান পেয়েছে মানুষের বিচিত্র জীবন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমূহ পরিস্থিতি এবং তার প্রভাবে সমাজমূলে দৃশ্যমান হয় যে জীবন তা অসামান্য কৌশলে তিনি গল্পে চিত্রায়িত করেছেন। ফলে তাঁর গল্পে উঠে এসেছে সে সময়ের সামাজিক-আর্থনীতিক প্রতিবেশ, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, মন্বন্তর, দেশভাগ ও ছিন্নমূল মানুষের আহাজারি। আপন কররেখার অসামান্য মুন্সিয়ানায় তিনি সমকালীন পরিস্থিতি ও সমাজ অস্তিত্ব সংকটকে চিহ্নিত করে তাকে শিল্পিত সত্যে উদ্ভাসিত করেছেন। একই সঙ্গে গল্পে তিনি দৃশ্যায়িত করেছেন মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিকে। কাহিনিকে নিবিড়ঘন রূপ দিয়েছেন যুদ্ধ, মারী-মন্বন্তর ও দেশভাগ-উত্তর বাস্তব পরিবেশের বিরূপ প্রতিক্রিয়াকে মনোবিশ্লেষণের বিচার শৈলিতে। আর সেই কারণেই তাঁর গল্পের চরিত্রগুলোতে গুরুত্ব পেয়েছে মানুষের অতলান্ত মন। ফলে নরেন্দ্রনাথ মিত্র হয়েছেন মানুষের দুজ্ঞেয় মনের রহস্য উন্মেচনকারী সার্থক ছোটগল্পকার। সাহিত্য জীবনের শুরুতে গল্পকারের লেখায় মানবমনস্তত্ত্বেও সতর্ক বিশ্লেষণ পাঠক সমাজে ব্যাপক সাড়া ফেলে। নারীর প্রতি পুরুষের অনুরাগ চিরন্তন। কিন্তু এ বাসনার পথ বড় পিচ্ছিল ও বক্র। ফলে সেখানে অন্তর্লোকের চেতন, অবচেতন ও অচেতন সত্তার রহস্যময় খেলা তীব্র ঘোর সৃষ্টি করে। ‘যৌথ’, ‘রোগ’, ‘শম্বুক’, ‘চোর’, ‘উল্টোরথ, ‘সংক্রামক’, ‘দাম্পত্য’, ‘চোরাবালি’, ‘আলমারি’ ও ‘দুজ্ঞেয়’র মতো প্রভৃতি গল্পের চরিত্রগুলোর অস্বাভাবিক আচরণ আমাদের মানব-মানবীর বিকৃত মানসিক সংকটের অন্ধকার জগতকে চিনিয়ে দেয়। প্রতিটি গল্পের জটিল মনের গভীর-গোপন রহস্য উন্মোচনের তীক্ষ্ণ শক্তি তাঁকে অসামান্য গল্পকারের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। এবং তিনি পাঠকের মনে জে¦লেছেন নিজের অমরত্বের বর্ণিল শিখা। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্পের ভাষায় ছড়িয়ে আছে জাদুকরী মায়া। গল্পের কাহিনী বয়ান তাঁর বর্ণময়। গতিময়। এবং প্রাণময়। সে পথেই তাঁর মনস্তাত্ত্বিক গল্পগুলো প্রাণের লাবণ্যের স্নিগ্ধ দ্যুতি ঠিকরে পড়ে। অনুভবের তলদেশ থেকে ভাবনার প্রকাশে তিনি বিন্যস্ত করেন নর-নারীর সম্পর্কের বহুকৌণিক বৈচিত্র্য। যেখানে একইসঙ্গে প্রতিভাত হয় তাঁর সংবেদনশীলতা ও সততা। ১৯৭৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর মহান এ কথাসাহিত্যিকের জীবনাবসান হয়। বাংলা ছোটগল্পের আঙিনাকে তিনি দেশহারা ছিন্নমূল মানুষের বেঁচে ওঠার মৌল প্রতিমা নির্মাণের স্বতন্ত্র বিভায় আলোকিত করেছেন। যে আলোর ¯িœগ্ধ রশ্মিই তাঁকে উজ্জ্বল করে রাখবে আগামী দিন এবং আরো অনেক আগামীকাল। অনন্য এই সাহিত্যিককে হৃদয়ের নিতল ভালোবাসা ও বিনম্র শ্রদ্ধা।
নরেন্দ্রনাথ মিত্রের সাহিত্যভাবনা
নূর-ই আলম সিদ্দিকী
(নরেন্দ্রনাথ মিত্র / জন্ম : ৩০ জানুয়ারি ১৯১৬; মৃত্যু: ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫)
বৃহস্পতিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
আধুনিক বাংলা ছোটগল্পের বিস্ময়কর প্রতিভা নরেন্দ্রনাথ মিত্র। রবীন্দ্রোত্তর এ কথাকার ছোটগল্প রচনায় আপন কৃতিত্বে ভাস্বর। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ পরবর্তী সময়ে মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক ও পারিবারিক জীবনের স্বপ্ন, হতাশা, ব্যর্থতা ও ভালোবাসা তাঁর গল্পের কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৪৭ সালে একত্রিশ বছরের নরেন্দ্রনাথ দেশভাগে শিকার হতাশাগ্রস্ত মানুষের টানাপোড়েন ও মানসিক যন্ত্রণা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন। দেশভাগ-উত্তর বিপর্যস্ত অর্থনীতি, মন্বন্তর ও দাঙ্গা কবলিত মানুষের বাঁচার আকুতি তাঁর গল্পের মূল প্রতিপাদ্য। এবং এই ছিন্নমূল বিবর্ণ, হতশ্রী মানুষই তাঁর গল্প-উপন্যাসের শিল্পিত ক্যানভাস। ফলে ঘরহারা মানুষের প্রেম-প্রীতি ও মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা তাঁর গল্পে পিনবদ্ধ হয়েছে সযতেœ। আধুনিক ছোটগল্পের অন্যতম প্রান্ত মানুষের রহস্যময় চিত্তবৃত্তির অন্বয়। যেখানে বাইরের ঘটনার সঙ্গে মনের গোপন-গহন দিক অন্যতম অনুষঙ্গ। সিগমন্ড ফ্রয়েডের দর্শনের প্রভাবে আধুনিক গল্প রচয়িতারা মানুষের অন্তর্জীবন দুর্জ্ঞেয়তার উপর আলো ফেলেছেন। বাংলা সাহিত্যে মনস্তাত্ত্বিক গল্পের সফল নির্মাতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রেমেন্দ্র মিত্র ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর আছেন মনস্তাত্ত্বিক গল্পের সার্থক শিল্পী নরেন্দ্রনাথ মিত্র। নরেন্দ্রনাথ মিত্র তাঁর গল্প ও উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মনের গূঢ়রহস্য উন্মোচনে শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। লক্ষণীয় মানুষের মনের অন্ধকার জগৎ গল্পে প্রতিপাদিত করলেও তাতে তিনি মনোবিকারকে প্রশ্রয় দেননি। সদর্থক জীবনের এ গল্পকার জানতেন মানুষের স্খলন পতন গর্বের বস্তু নয়, বরং ‘যেখানে আমরা মহৎ, শক্তিমান সেখানে যেন আমাদের যথার্থ পরিচয় রয়েছে।’ তাঁর মনোভাব সম্পর্কে সমালোচক বলেন- ‘লেখক প্রধানত মন নিয়ে কারবার করতে ভালোবাসেন। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ঘাত-প্রতিঘাতে বাইরের পরিবেশ হয়তো বদলায় কিন্তু তার চাইতে বেশি বদলায় মানুষের মন- মনের এই রংফেরতার কাহিনিই তিনি বিশেষ করে ফুটিয়েছেন তাঁর নানা গল্পগুলিতে।’ বাংলা ছোটগল্পের বিষয় নির্বাচন ও তার উপস্থাপন-রীতির বৈচিত্র্যে তিনি নতুন মাত্রা সংযোজন করেন। মানব স্বভাবের অন্তর্গূঢ় প্রবণতা ও পরিবর্তিত সময়ের প্রভাবে অস্থির মানুষের গল্প রচনা করেছেন নরেন্দ্রনাথ মিত্র। দক্ষ চিত্রগ্রাহকের নিবিড় অবলোকন এবং অসামান্য শিল্প-প্রকরণে নির্মিত হয়েছে তাঁর প্রতিটি ছোটগল্প। বাংলার ইতিহাসে চোখ ফেরালে দেখা যায় চল্লিশের দশক থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পর্যন্ত বাংলার আকাশের উপর দিয়ে বয়ে গেছে ইতিহাসের প্রচ- ঝড়। চল্লিশ সালের পর দেশের অভ্যন্তরে একের পর একে ঘটে দুর্ভিক্ষ, বস্ত্রসংকট, যুদ্ধের বোমাবর্ষণ, আজাদ হিন্দ ফৌজের লড়াই, দাঙ্গা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি দেশ ভাগের ট্রাজেডি। হৃদয় বিদারক মারাত্মক এ সকল ঘটনার প্রভাবে মানুষের ব্যক্তিজীবন, সমাজ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত বদল হতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতে বাঙালি মানসে লাগে প্রবল ভাঙনের ঢেউ। বিক্ষিপ্ত এ সকল অশুভ কর্মকা-ের প্রতিক্রিয়ায় মানুষের মন থেকে অপসৃত হতে থাকে দীর্ঘদিনের লালিত মূল্যবোধ। একই সঙ্গে সমাজ কাঠামোতে ধরে ব্যাপক কাঁপন ও ভাঙন। ভয়াবহ এ বিপর্যয়ে বাঙালির প্রাত্যহিক জীবনে বিশ্ব-রাজনীতির নৈরাশ্য আর নৈরাজ্যের সীমাহীন বিস্তৃতি ঘটে। অসংখ্য ঘটনার চাপে ভারতবর্ষের মানুষের জীবন হয়ে পড়ে বিপন্ন। স্পর্শকাতর এসব ঘটনার বিরূপ প্রতিক্রিয়াকবলিত ছিন্নমূল অসহায় মানুষের নিরাপত্তাহীন ও অসুস্থ জীবনকে নিয়েই নরেন্দ্রনাথ রচনা করেছেন তাঁর গল্প ও উপন্যাস। দেশভাগ পরবর্তী কলকাতা ছিন্নমূল মানুষে ভরে যায়। পরবাসী মানুষ নিপতিত হয় বহুমুখী সংকটে। এ সময়ের মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্ত সমাজের আবেগ-অনুভূতি ও বিকার খুব সহজ কথায় দক্ষতার সঙ্গে নরেন্দ্রনাথ মিত্র গল্পের ক্যানভাসে রেখায়িত করেছেন। গল্পে কাহিনির আল্পনায় তিনি গেঁথেছেন বিধ্বস্ত দেশের বিকীর্ণ অবয়ব ও ক্লেদাক্ত সময়। তাঁর অধিকাংশ গল্পের মূল চরিত্র হয়ে উঠেছে দেশতাড়িত, খাদ্য, বস্ত্র ও জীবিকাহীন মানসিক সংকটে উৎকণ্ঠিত মানুষ। গল্পের ভেতর এসব নিরন্ন মানব সবকিছু হারিয়েও পুরনো মূল্যবোধকে সঙ্গে নিয়ে প্রাণপণ সংগ্রাম করে যায়। নরেন্দ্রনাথের গল্পের মানুষেরা দেশছাড়া হলেও নিজেদের ঐতিহ্যকে ছাড়তে পারে না। ছিন্নসত্তা মানুষগুলো বাঁচার আশায় অবলম্বন খোঁজে ফেরে এপার-ওপার বাংলায়। পুরনো ঐতিহ্য আর ভেতরের মানবিকবোধকে সঙ্গে নিয়ে জীবনযুদ্ধে সংগ্রামী এ-সকল মানুষের বহির্বাস্তবতা আর অন্তর্বাস্তবতাকেই নরেন্দ্রনাথ মিত্র তাঁর গল্পের ফিতায় বেঁধেছেন নিপুণ শিল্পকৌশলে। মানব জীবনের মৌলিক এবং মহত্তম বোধকে কথামালার গ্রন্থনে সেঁটে নিজের সৃষ্টিকে করেছেন চির-নতুন। নরেন্দ্রনাথের গল্পের গভীর আলোচনায় এ কথার যথার্থতা মেলে সর্বত্র। আমরা জানি তিরিশ পূর্বে বাংলা কথাসাহিত্যের কেন্দ্র ছিল সমাজের উঁচু-শ্রেণির মানুষ। তিরিশের পর থেকে খুব দ্রুত বিশ^পট পরিবর্তন ঘটতে থাকে। সাহিত্যিকদের রচনায় স্থান পেতে শুরু করে ‘মানুষী সত্তাসম্পন্ন অতি সাধারণ নি¤œবিত্তরা’। কথাকার হিসেবে নরেন্দ্রনাথ মিত্রের আবির্ভাব চল্লিশের দশকে। সাহিত্য জীবনের প্রারম্ভে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক উত্তাপ এবং তা থেকে সৃষ্ট নির্মম পরিণতি তাঁর লেখক মনকে নাড়িয়ে দেয়। তিনি হয়ে ওঠেন জীবনঘনিষ্ঠ কথাকোবিদ। তাঁর গল্পের মধ্যে ওঠে আসতে থাকে ঘরহারা অসহায় মানুষ। যারা জীবনের প্রয়োজনে নিষ্ঠুর পরিণতিকে মোকাবিলা করতে শুরু করে মানবেতর লড়াই। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা আর উন্মূল মানুষের মানবিক মর্যাদাকে সাহিত্যে প্রতিফলিত করতে কলম হাতে নেন তিনি। মানব কল্যাণের ইতিবাচক চেতনায় নরেন্দ্রনাথ মিত্র রবীন্দ্রনাথকে স্বীকার করে, তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে স্ব-বৈশিষ্ট্যে কথাসাহিত্য হয়ে ওঠেন একক ও অনন্য কথাকার। নরেন্দ্রনাথের গল্পের সব থেকে বড় দিক হলো তিনি নিজে যে জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, ঠিক সেই জীবনের নিখুঁত ছবি নির্মোহ বাস্তবতায় গল্প-উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। গল্পের মানস ভূগোলে কল্পনার ফানুস নয় বরং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁর অবলম্বন হয়ে ওঠে। নিজের রচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যাদের আমি দেখেছি, যাদের চরিত্রের কোনো না কোনো বৈশিষ্ট্য আমার মনে বিন্দুমাত্র রেখাপাত করেছে তাদের নিয়ে গল্প ও কাহিনি লিখতে আমার ভাল লাগে। নিছক কল্পনার উপর ভিত্তি করে আমি গল্প লিখতে পারিনে।’ সৃষ্টিশীল চল্লিশ বছর (১৯৩৬-১৯৭৫) সাহিত্য রচনায় বিচরণ করলেও গল্পকার হিসেবেই তিনি সার্থক। একেবারে গোড়ায় জীবন শুরু করেছিলেন নাটক ও উপন্যাস দিয়ে। তারপর কবিতা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত থিতু হয়েছিলেন উপন্যাস ও ছোটগল্পে। কিছু প্রবন্ধও লিখেছেন শেষ বেলায়। উপন্যাস রচনা করে খ্যাতি লাভ করলেও শ্রেষ্ঠত্ব পেয়েছেন ছোটগল্পকার হিসেবেই। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্পের কাহিনিতে স্থান পেয়েছে মানুষের বিচিত্র জীবন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমূহ পরিস্থিতি এবং তার প্রভাবে সমাজমূলে দৃশ্যমান হয় যে জীবন তা অসামান্য কৌশলে তিনি গল্পে চিত্রায়িত করেছেন। ফলে তাঁর গল্পে উঠে এসেছে সে সময়ের সামাজিক-আর্থনীতিক প্রতিবেশ, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, মন্বন্তর, দেশভাগ ও ছিন্নমূল মানুষের আহাজারি। আপন কররেখার অসামান্য মুন্সিয়ানায় তিনি সমকালীন পরিস্থিতি ও সমাজ অস্তিত্ব সংকটকে চিহ্নিত করে তাকে শিল্পিত সত্যে উদ্ভাসিত করেছেন। একই সঙ্গে গল্পে তিনি দৃশ্যায়িত করেছেন মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিকে। কাহিনিকে নিবিড়ঘন রূপ দিয়েছেন যুদ্ধ, মারী-মন্বন্তর ও দেশভাগ-উত্তর বাস্তব পরিবেশের বিরূপ প্রতিক্রিয়াকে মনোবিশ্লেষণের বিচার শৈলিতে। আর সেই কারণেই তাঁর গল্পের চরিত্রগুলোতে গুরুত্ব পেয়েছে মানুষের অতলান্ত মন। ফলে নরেন্দ্রনাথ মিত্র হয়েছেন মানুষের দুজ্ঞেয় মনের রহস্য উন্মেচনকারী সার্থক ছোটগল্পকার। সাহিত্য জীবনের শুরুতে গল্পকারের লেখায় মানবমনস্তত্ত্বেও সতর্ক বিশ্লেষণ পাঠক সমাজে ব্যাপক সাড়া ফেলে। নারীর প্রতি পুরুষের অনুরাগ চিরন্তন। কিন্তু এ বাসনার পথ বড় পিচ্ছিল ও বক্র। ফলে সেখানে অন্তর্লোকের চেতন, অবচেতন ও অচেতন সত্তার রহস্যময় খেলা তীব্র ঘোর সৃষ্টি করে। ‘যৌথ’, ‘রোগ’, ‘শম্বুক’, ‘চোর’, ‘উল্টোরথ, ‘সংক্রামক’, ‘দাম্পত্য’, ‘চোরাবালি’, ‘আলমারি’ ও ‘দুজ্ঞেয়’র মতো প্রভৃতি গল্পের চরিত্রগুলোর অস্বাভাবিক আচরণ আমাদের মানব-মানবীর বিকৃত মানসিক সংকটের অন্ধকার জগতকে চিনিয়ে দেয়। প্রতিটি গল্পের জটিল মনের গভীর-গোপন রহস্য উন্মোচনের তীক্ষ্ণ শক্তি তাঁকে অসামান্য গল্পকারের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। এবং তিনি পাঠকের মনে জে¦লেছেন নিজের অমরত্বের বর্ণিল শিখা। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্পের ভাষায় ছড়িয়ে আছে জাদুকরী মায়া। গল্পের কাহিনী বয়ান তাঁর বর্ণময়। গতিময়। এবং প্রাণময়। সে পথেই তাঁর মনস্তাত্ত্বিক গল্পগুলো প্রাণের লাবণ্যের স্নিগ্ধ দ্যুতি ঠিকরে পড়ে। অনুভবের তলদেশ থেকে ভাবনার প্রকাশে তিনি বিন্যস্ত করেন নর-নারীর সম্পর্কের বহুকৌণিক বৈচিত্র্য। যেখানে একইসঙ্গে প্রতিভাত হয় তাঁর সংবেদনশীলতা ও সততা। ১৯৭৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর মহান এ কথাসাহিত্যিকের জীবনাবসান হয়। বাংলা ছোটগল্পের আঙিনাকে তিনি দেশহারা ছিন্নমূল মানুষের বেঁচে ওঠার মৌল প্রতিমা নির্মাণের স্বতন্ত্র বিভায় আলোকিত করেছেন। যে আলোর ¯িœগ্ধ রশ্মিই তাঁকে উজ্জ্বল করে রাখবে আগামী দিন এবং আরো অনেক আগামীকাল। অনন্য এই সাহিত্যিককে হৃদয়ের নিতল ভালোবাসা ও বিনম্র শ্রদ্ধা।