alt

লাল লুঙ্গি

অনুবাদ: ফজল হাসান

: বৃহস্পতিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

‘আন্তর্জাতিক বুকার ২০২৫’ বিজয়ী
বানু মুশতাক-এর গল্প

লতিফ আহমদ একসময় অস্বস্তি অনুভব করতে শুরু করেন। তিনি কি এমন দারিদ্র্য ও দুঃখের সামনেও অমানবিক থাকতে পারেন? মহিলার মুখটা বারবার তাঁর সামনে ভেসে ওঠে। ‘ওহ, তাকে খালি হাতে পাঠানো আমার উচিত হয়নি।’ বলেই তিনি অপরাধীর চোখে মহিলার দিকে তাকান। কিন্তু মহিলা দ্রুত দৃষ্টির আড়ালে চলে যান, যেভাবে তিনি হঠাৎ করেই সেখানে হাজির হয়েছিলেন।

লাইনে দাঁড়ানো ছেলেরা একজনের পর একজন সামনের দিকে এগিয়ে যায় এবং ঘরে ঢোকে। কিছুক্ষণ পরে তারা লাল লুঙ্গি পড়ে বেরিয়ে আসে। লতিফ আহমদ অধৈর্য হয়ে ঘড়ির দিকে তাকান। ইতোমধ্যে পাঁচটা বেজে গেছে। স্থানীয় একজন স্বনামধন্য সার্জন ডাক্তার প্রকাশ তাঁকে ছয়টার মধ্যে পরিবারের ছেলেদের নিয়ে তাঁর কাছে যেতে বলেছেন। এখনো ওরা আসছে না কেন? রাজিয়া ওদের সবাইকে সকালে গোসল করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বড় ছেলে সামাদকে একটু বেশি যতœ নিয়ে গোসল করিয়েছেন। সামাদ যখন পাঁচ বছর বয়সে পা দিয়েছে, তখন থেকেই গত ছয় বছর ধরে রাজিয়া তাঁর স্বামীকে ক্রমাগত বলে আসছেন, ‘এবার ওকে সুন্নাতে খাতনা করার ব্যবস্থা করো- দেখছ না, ছেলেটা কেমন রোগা হয়ে যাচ্ছে!’ রাজিয়া আশা করছিলেন যে, খাতনার পর হয়তো ওর স্বাস্থ্য ভালো হবে। কিন্তু লতিফ আহমদ সাহস পাননি, তাই বারবার পিছিয়ে দিয়েছেন। অবশেষে সময় এসেছে, কিন্তু তারপরও তাঁর বিন্দুমাত্র উৎকণ্ঠা কমেনি।

অনুষ্ঠানের জন্য রাজিয়ার দেবররা উপস্থিত হয়েছেন। তাঁর বোনেরাও অনেক দূর থেকে এসেছেন। সমস্ত বাড়ি ভর্তি আত্মীয়-স্বজন। সব বাচ্চারা নতুন পোশাক পড়েছে। খাতনা করা ছেলেরা ঘোরাঘুরি করছে। অল্প বয়সী এবং বয়স্ক পুরুষেরা গণ-খাতনার জন্য মসজিদে গিয়েছেন। শহরের অনেক মেয়ে এবং বয়স্ক মহিলারা লতিফ আহমদের বাড়িতে জড়ো হয়েছে।

দুপুরের খাবার খাওয়ার পর বাড়ির ছেলেরা তাদের শেরওয়ানী, নেহেরু জ্যাকেট এবং জরীর টুপি পরেছে। তারা সারি বেঁধে বসে আছে। তাদের গলায় পা পর্যন্ত দীর্ঘ মালা এবং হাতে জুঁই ফুল। শুভাকাক্সক্ষীরা এসে জড়ো হয়েছেন। তাঁরা বাচ্চাদের কোলে নিয়ে আদর করেন। কেউ কেউ ছেলেদের হাতে আংটি পরিয়ে দেন এবং অন্যরা উপহার হিসেবে সোনার মালা দেন। পাঁচ শ’ এবং এক শ’ রুপির নোট এত বেশি যে, গুণে শেষ করা যায় না। যারা এসেছেন, তারা প্রত্যেকেই বদ নজর থেকে রক্ষা পাওয়ার নিয়ম-কানুন মেনে আলতো করে ছেলেদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন। পান-সুপারী, কলা, কারজি কায়ি৪ এবং অন্যসব হালকা খাবার পরিবেশন করা হয়েছে। খোশ-গল্প করার মতো কারোরই সময় হয়নি। সারা বাড়িতে ছিল বিভ্রান্তি, অস্থিরতা এবং তাড়াহুড়া।

মহিলা এসে লতিফ আহমদের সামনে উপস্থিত হন। তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন। ইতোমধ্যে কেউ একজন তাঁর জন্য চেয়ার আনে এবং তিনি সেই চেয়ারে বসে তাঁর অবসন্ন পা দু’টি ছড়িয়ে বিশ্রাম করছিলেন আর মুখ বড় করে হাই দিতে যাচ্ছিলেন- ‘আহ্...’ -আর তখনই সেখানে মহিলা এসে হাজির হন। মহিলা রোগা-পাতলা এবং পরনে পুরনো ভেজা সোয়েটার। তাঁর মাথায় রঙচটা স্কার্ফ বাঁধা এবং ফ্যাকাশে মুখ। তিনি বুকের সঙ্গে একটা পুঁটলি ধরে আছেন।

‘ভাইয়া! ওরও সুন্নাতে খাতনা করিয়ে দিন...’ লতিফ আহমদ তাকিয়ে দেখেন পুঁটলির ভেতর হয়তো এক মাসেরও কম বয়সী শিশু। তারপর তিনি মহিলার দিকে তাকালেন। তিনি উৎকণ্ঠিত, কেননা আশেপাশের যুবকরা যদি কোনো বাজে মন্তব্য করে। তিনি কোনো কথা না বলে পকেট থেকে এক শ’ রুপির একটা নোট মহিলার হাতে গুঁজে দেন। তাঁর মনে হলো রাজিয়া যেন সামাদকে কোলে নিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। মহিলা না তাকিয়ে চলে যান। লতিফ আহমদ ভাবলেন, আগের মহিলাকেও কিছু আর্থিক সাহায্য করা যেত। কিন্তু সেই মুহূর্তে তাঁর মনে হলো যে, একজনের পর আরেকজন আসবে... তারপর আরেকজন... এবং এভাবেই আসতে থাকবে... এর শেষ কোথায়? সব ছেলেদের খাতনা শেষ হলে সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে লতিফ আহমদ খানিকটা নির্ভার হলেন।

এবার তাঁকে নিজের পরিবারের ছেলেদের দেখভাল করতে হবে।

ছয়টায় লতিফ আহমদ বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই সার্জনের কাছে যাওয়ার জন্য ছেলেরা তৈরি হয়। ডাক্তার প্রকাশ বলেছিলেন, ‘আমরা ছেলেদের লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া দেব, ওরা কিছুই টের পাবে না। রাতে ভালো ঘুমের পর সকালে ওরা সতেজ হয়ে উঠবে।’ সুতরাং পুরো পরিবার ডাক্তার প্রকাশের ক্লিনিকে অস্ত্রোপচার কক্ষের বাইরে অপেক্ষা করছিল। অস্ত্রোপচার সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছিল, তবে কয়েকটি ছেলে হৈচৈ এবং কান্নাকাটি করেছে।

বাড়ি ফেরার পর ছেলেদের ফ্যানের নিচে নরম বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হয়। তাদের সেবা-যতœ করার জন্য অনেকেই তৈরি ছিল। হয়তো এক বা দু’টি ছেলে মাঝে মধ্যে ব্যথায় কঁকিয়ে উঠছিল। কিন্তু তাদের ঘরের বাইরে হাসি, ঠাট্টা-তামাশা এবং উৎসব উদযাপনের কোনো কমতি ছিল না। প্রতি আট ঘণ্টা অন্তর ছেলেদের বিছানা থেকে তুলে কাজু বাদাম বেটে তার সঙ্গে দুধ ও ব্যথানাশক ঔষধ দেওয়া হতো এবং খাওয়ার পর আবার শুইয়ে দিত। পরদিন তারা প্রায় সবাই সুস্থ হয়ে ওঠে। তাড়াতাড়ি সুস্থ হওয়ার প্রচুর ভালো খাবার ছিল- দুধ, ঘি, কাজুবাদাম, খেজুর... সবার জন্যই যথেষ্ট পরিমাণে ছিল এমনকী উচ্ছিষ্ট থেকেছে।

খাতনার পঞ্চম দিনে সামনের আঙিনায় হৈচৈ শুরু হয়। রাজিয়া নিচে যান এবং বাইরে উঁকি দিয়ে দেখলেন যে, আরিফ গাছে উঠে আধাপাকা সবুজ পেয়ারা ছিঁড়ছে। দু’জন কাজের লোক তাকে নিচে নামতে বলছে। তার মা আমিনা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কাজের লোকদের অনুরোধ করে এবং কাকুতি-মিনতি করে ছেলেকে নেমে আসতে বলে। আরিফ ইচ্ছে মতো পেয়ারা খেয়ে গাছ থেকে ধীরে ধীরে নেমে আসে এবং নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গেই কাজের লোকজন তাকে ধরে ফেলে। তাকে রাজিয়ার কাছে নিয়ে এলে সে নিজের পকেট থেকে হালকা চালে আরেকটি পেয়ারা বের করে কামড় দেয়। রাজিয়া কাজের লোকদের ছেড়ে দিতে বলেন। তিনি বিস্মিত গলায় আরিফকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর কী ঘা শুকিয়ে গেছে?’

‘হুম, হ্যাঁ, চিকাম্মা৫,’ জবাবে আরিফ বলল এবং বলেই সে কোনো লজ্জা-শরম বা দ্বিধা না করে এক ঝটকায় লুঙ্গি খোলে। রাজিয়া নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। সেখানে কোনো ব্যান্ডেজ নেই। কাটা অংশটি সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেছে। সেখানে বিন্দুমাত্র পুঁজও নেই। আর অন্যদিকে তাঁর ছেলে সামাদের অবস্থা ভালো না। সে পা সোজা করতে পারছে না। অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার পরেও তার ঘা বেড়ে গেছে। সকালে সে গোসলখানায় যেতে পারেনি। কাজের লোকজন তাকে তুলে নিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছে। তার কাটা জায়গাটি স্যানিটাইজড ইস্পাতের কাপ দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে, যাতে ভিজে না যায়। গোসলের পর সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। কাজের লোকেরা আস্তে ধীরে তার শরীর মুছে দিয়েছে। একজন নার্স এসে ক্ষতটি পরিষ্কার করেছে এবং পুনরায় ব্যান্ডেজ করে ইনজেকশন দিয়েছে। আর আরিফ গাছে চড়ে বানরের মতো খেলছে। ‘তুই কী ওষুধ খেয়েছিস, আরিফ- কোন ট্যাবলেট?’ রাজিয়া জিজ্ঞেস না করে থাকতে পারলেন না।

‘আমি কোনো ওষুধ খাইনি, চিকাম্মা। তারা শুধু ক্ষত জায়গায় ছাই মেখেছিল, আর তাতেই শুকিয়ে গেছে...’

রাজিয়া আসলে বুঝতে পারেননি গরিব ছেলেদের খাতনা অত্যন্ত সহজভাবে সম্পন্ন করা হয়। ওদের ক্ষত জায়গায় ছাই দেওয়া হয়- রাজিয়া জানতে পেরে এই ভেবে ভীষণ চিন্তায় পড়ে যান যে, যদি ওদের কারোর কোনো অঘটন ঘটে, তবে কী হবে। দ্বিতীয় তলায় অন্য সব ছেলেদের দেখে রাজিয়া নিজের ছেলের ঘরে যান। সামাদ ঘুমাচ্ছিল। পাশের টেবিলের ওপর বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি, বিস্কুট এবং তাজা ও শুকনো ফল রাখা আছে। রাজিয়া জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখেন আরিফ সামনের উঠানে আছে কি না। তিনি ওকে এক প্যাকেট বিস্কুট দিতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু সে কোথাও নেই। তিনি সামাদের গায়ের ওপর হালকা কম্বল বিছিয়ে বুয়াদের কাজ দেখাশোনা করার জন্য রান্নাঘরে চলে যান।

খাতনা করা ছেলেদের জন্য মুরগির স্যুপ রান্না করা হয় এবং আত্মীয়-স্বজনদের জন্য পোলাও ও কোর্মা। কিন্তু পুনরায় অসুস্থ বোধ করার জন্য তিনি আমিনাকে নিয়ে দশ মিনিটও রান্নাঘরে থাকতে পারেননি। যদিও রাজিয়া নিশ্চিত যে, তাঁর তত্ত্বাবধান ছাড়া সব খাবার সময় মতো তৈরি করার কাজ শেষ হবে না, তবুও তিনি বাধ্য হয়ে রান্নাঘর ত্যাগ করেন। তিনি যে মুরগির মাংস দেখভাল করছিলেন, তা অসম্পূর্ণ রেখেই ওপর তলায় চলে যান।

রাজিয়া সামাদের শোবার ঘরের দরজা আগেই বন্ধ করেছিলেন, যেন সে শান্তিতে ঘুমাতে পারে। তিনি দরজা খোলেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই লোম খাড়া করা চিৎকার করেন। তাঁর চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এলো। বাড়ির অন্য সব লোকজন নিজের ঘর থেকে দৌড়ে আসে এবং তারা দেখে অচেতন রাজিয়া এবং রক্তে ভেজা সামাদ মেঝেতে পড়ে আছে। ঘুম থেকে উঠে সে বিছানা থেকে নেমে মাকে খুঁজছিল, কিন্তু দরজার কাছে যাওয়ার আগেই সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। দেওয়ালে ধাক্কা লেগে তার মাথা থেকে ফেটে গিয়ে রক্ত ঝরছিল। খাতনার সেলাই খুলে গিয়েছিল এবং সেই ক্ষতস্থান থেকেও রক্ত ঝরছিল। তাই সামাদকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

খাতনার এগারো দিনের দিন লতিফ আহমদের পরিবারের খাতনা করা ছেলেদের আনুষ্ঠানিকভাবে গোসল করানো হয়। আর সেদিনই সামাদ হাসপাতাল থেকে ফিরে আসে। সেদিন সন্ধ্যায় বাড়িতে খানাপিনার বিশাল আয়োজন করা হয়। পুরো শহরের লোকজনদের দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। অনেকগুলো ছাগল জবেহ করা হয় এবং ভূরিভোজের সমস্তপ্রস্তুতি নেওয়া হয়। বাড়ির সামনের আঙিনায় শামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। পেছনের উঠান থেকে ছড়িয়ে পড়া বিরিয়ানির খুশবো চারপাশের বাতাসে মঁ মঁ করছিল। তখনো সামাদ বেশ দুর্বল এবং রাজিয়া তাঁর দৃষ্টির আড়ালে তাকে যেতে দেননি। তিনি সামাদের মাথা কোলে নিয়ে সোফায় বসে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছিলেন।

একসময় রাজিয়া লক্ষ্য করেন কেউ একজন বসার ঘরে চোরের মতো নিঃশব্দে পায়চারী করছে। ‘এই... কে ওখানে? এদিকে আয়’, তিনি ডাকলেন। শরীর এগিয়ে আসে। ‘আমি, চিক্কাম্মা...’ রাজিয়ার চোখ বড় হয়ে যায়। আরিফ! যদিও তার পরনে ছেঁড়া কলারের রঙ-চটা পুরনো শার্ট, তবু সে স্বাস্থ্যবান। সে লাল লুঙ্গি ছেড়ে প্যান্ট পরা শুরু করেছে, অর্থাৎ তার ক্ষত সম্পূর্ণরূপে শুকিয়ে গেছে। রাজিয়া সামাদের দিকে ঘুরে তাকালেন এবং তাঁর চোখ অশ্রুতে ভয়ে যায়। তিনি ফিসফিস করে নিজেকে বললেন, ‘বড়লোকের জন্য লোকজন আছে, গরিবদের জন্য পরওয়ারদিগার।’

রাজিয়ার দৃষ্টি চলে যায় আরিফের প্যান্টের দিকে, হাঁটুর কাছে সুতা। চিকাম্মাকে নীরব আর গভীর চিন্তায় ডুবে যেতে দেখে সে ঘুরে দাঁড়ায়। তখন তার পরনের কাপড়ে আরও দু’টি বড়ফুটা দেখা যায়, একটি তার প্যান্টে এবং অন্যটি শার্টে।

‘দাঁড়াও আরিফ’, রাজিয়া উঠে দাঁড়ানোর সময় বললেন। আলমারি খুলে সুন্দর করে ভাঁজ করা কাপড়ের স্তূপের ওপর চোখ বুলিয়ে আনেন। সামাদকে উপহার হিসেবে দেওয়া প্রায় এক ডজন পোশাক তখনো প্যাকেটের মধ্যে রয়েছে। রাজিয়া একজোড়া প্যান্ট আর একটা টি-শার্ট, যেগুলো সামাদের জন্য বড় ছিল, বের করে আরিফের হাতে দিয়ে বললেন, ‘এগুলো নাও। তুমি যখন খেতে আসবে, তখন এগুলো পরে এসো, ঠিক আছে?’

যখন আরিফ কাপড়গুলো দেখল, তখন তার চোখ খুশিতে ঝলমল করে ওঠে। সে যে দৃষ্টিতে রাজিয়ার দিকে তাকায়, তাতে কৃতজ্ঞতার চেয়ে বেশি ছিল ভক্তির প্রতিফলন। সে ধীরে ধীরে টি-শার্টটি স্পর্শ করল এবং তা দেখে রাজিয়া নিঃশব্দে হাসলেন। সামাদ উঠে বসে এবং রাজিয়ার কাঁধে মাথা রাখে। আরিফ লঘু পায়ে দরজার দিকে হাঁটার সময় বারবার তাদের দিকে ফিরে তাকাচ্ছিল আর সে তার বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে রেখেছে রাজিয়ার দেওয়া প্যান্ট ও টি-শার্ট। (সমাপ্ত)

টীকা: (ইংরেজি অনুবাদে নেই, তবে বাংলাদেশী পাঠকের সুবিধার্থে দেওয়া হলো)

৪ কারজি কায়ি – কর্নাটক স্টাইলের ডুবো তেলে ভাজা অর্ধ-চন্দ্র্রাকৃতির মিষ্টি পিঠা, যা বাংলাদেশের পুলি পিঠার মতো আকৃতি।

৫ চিকাম্মা: কন্নড় ভাষায় খালাম্মা।

গল্পসূত্র: ‘লাল লুঙ্গি’ গল্পটি ইংরেজিতে ‘রেড লুঙ্গি’ গল্পের অনুবাদ। ইংরেজিতে গল্পটি বানু মুশতাকের ২০২৫ সালে আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত ছোটগল্প গ্রন্থ ‘হার্ট ল্যাম্প’-এ অন্তর্ভুক্ত। গ্রন্থটি কন্নড় ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন দীপা ভাসতি।

ছবি

আধুনিক বাংলা কবিতার একশ’ বছর

ছবি

বিশ্বসাহিত্যে এর প্রতিফলন

ছবি

মোজগান ফারামানেশ-এর কবিতা

ছবি

চোখ

ছবি

যোগফল শূন্য

সাময়িকী কবিতা

ছবি

শ্বেতা শতাব্দী এষের কবিতা

ছবি

বিপন্ন মানুষের মনোবাস্তবতার স্বরূপ

ছবি

দিনু বিল্লাহ: জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে

জেলার সিরিজ কবিতা

ছবি

লাল লুঙ্গি

সাময়িকী কবিতা

ছবি

নির্মলেন্দু গুণের রাজনৈতিক বলয় অতিক্রমের ক্ষমতা

ছবি

কেরাসিন বাত্তি ও লালচুলা মেয়েটি

ছবি

তাঁর সমকালীনদের চোখে

ছবি

নিজের মতো করেই সঠিক পথটি বেছে নিতে হবে

ছবি

সুকান্ত ভট্টাচার্য: বহুচর্চিত, বহুপঠিত এক অনন্য কবি

ছবি

চিত্রাঙ্গদা: দ্বৈত সত্তার শিল্পস্মারক

ছবি

খালেদ হামিদীর দৌত্যে ওরহান পামুক

সাময়িকী কবিতা

ছবি

মেঘলা আকাশ বৃষ্টি

ছবি

স্মৃতি ভদ্র

ছবি

হৃদয়রেখা

ছবি

সুরমা বুজি অথবা কাচপোকা

ছবি

শ্রাবণের জোছনায় হেসেছিল নার্গিস

ছবি

যোগাযোগ

ছবি

বাংলাদেশের স্বাপ্নিক কবি নজরুল

ছবি

ইলিয়াসের আশ্চর্য নিরীক্ষা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

মাটি ও মানুষের কথক

ছবি

অনাবিল প্রাচুর্যে ঋদ্ধ নজরুল প্রতিভা

ছবি

নজরুল: চির-বিস্ময়

ছবি

জীবনের সাথে সংযোগ ঘটল কই

পোয়েমস দ্যাট কেম টু মি

ছবি

লালন ও রবীন্দ্রনাথ অন্তর্জগতের আলাপন

ছবি

বংশধারা

tab

লাল লুঙ্গি

অনুবাদ: ফজল হাসান

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

বৃহস্পতিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

‘আন্তর্জাতিক বুকার ২০২৫’ বিজয়ী
বানু মুশতাক-এর গল্প

লতিফ আহমদ একসময় অস্বস্তি অনুভব করতে শুরু করেন। তিনি কি এমন দারিদ্র্য ও দুঃখের সামনেও অমানবিক থাকতে পারেন? মহিলার মুখটা বারবার তাঁর সামনে ভেসে ওঠে। ‘ওহ, তাকে খালি হাতে পাঠানো আমার উচিত হয়নি।’ বলেই তিনি অপরাধীর চোখে মহিলার দিকে তাকান। কিন্তু মহিলা দ্রুত দৃষ্টির আড়ালে চলে যান, যেভাবে তিনি হঠাৎ করেই সেখানে হাজির হয়েছিলেন।

লাইনে দাঁড়ানো ছেলেরা একজনের পর একজন সামনের দিকে এগিয়ে যায় এবং ঘরে ঢোকে। কিছুক্ষণ পরে তারা লাল লুঙ্গি পড়ে বেরিয়ে আসে। লতিফ আহমদ অধৈর্য হয়ে ঘড়ির দিকে তাকান। ইতোমধ্যে পাঁচটা বেজে গেছে। স্থানীয় একজন স্বনামধন্য সার্জন ডাক্তার প্রকাশ তাঁকে ছয়টার মধ্যে পরিবারের ছেলেদের নিয়ে তাঁর কাছে যেতে বলেছেন। এখনো ওরা আসছে না কেন? রাজিয়া ওদের সবাইকে সকালে গোসল করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বড় ছেলে সামাদকে একটু বেশি যতœ নিয়ে গোসল করিয়েছেন। সামাদ যখন পাঁচ বছর বয়সে পা দিয়েছে, তখন থেকেই গত ছয় বছর ধরে রাজিয়া তাঁর স্বামীকে ক্রমাগত বলে আসছেন, ‘এবার ওকে সুন্নাতে খাতনা করার ব্যবস্থা করো- দেখছ না, ছেলেটা কেমন রোগা হয়ে যাচ্ছে!’ রাজিয়া আশা করছিলেন যে, খাতনার পর হয়তো ওর স্বাস্থ্য ভালো হবে। কিন্তু লতিফ আহমদ সাহস পাননি, তাই বারবার পিছিয়ে দিয়েছেন। অবশেষে সময় এসেছে, কিন্তু তারপরও তাঁর বিন্দুমাত্র উৎকণ্ঠা কমেনি।

অনুষ্ঠানের জন্য রাজিয়ার দেবররা উপস্থিত হয়েছেন। তাঁর বোনেরাও অনেক দূর থেকে এসেছেন। সমস্ত বাড়ি ভর্তি আত্মীয়-স্বজন। সব বাচ্চারা নতুন পোশাক পড়েছে। খাতনা করা ছেলেরা ঘোরাঘুরি করছে। অল্প বয়সী এবং বয়স্ক পুরুষেরা গণ-খাতনার জন্য মসজিদে গিয়েছেন। শহরের অনেক মেয়ে এবং বয়স্ক মহিলারা লতিফ আহমদের বাড়িতে জড়ো হয়েছে।

দুপুরের খাবার খাওয়ার পর বাড়ির ছেলেরা তাদের শেরওয়ানী, নেহেরু জ্যাকেট এবং জরীর টুপি পরেছে। তারা সারি বেঁধে বসে আছে। তাদের গলায় পা পর্যন্ত দীর্ঘ মালা এবং হাতে জুঁই ফুল। শুভাকাক্সক্ষীরা এসে জড়ো হয়েছেন। তাঁরা বাচ্চাদের কোলে নিয়ে আদর করেন। কেউ কেউ ছেলেদের হাতে আংটি পরিয়ে দেন এবং অন্যরা উপহার হিসেবে সোনার মালা দেন। পাঁচ শ’ এবং এক শ’ রুপির নোট এত বেশি যে, গুণে শেষ করা যায় না। যারা এসেছেন, তারা প্রত্যেকেই বদ নজর থেকে রক্ষা পাওয়ার নিয়ম-কানুন মেনে আলতো করে ছেলেদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন। পান-সুপারী, কলা, কারজি কায়ি৪ এবং অন্যসব হালকা খাবার পরিবেশন করা হয়েছে। খোশ-গল্প করার মতো কারোরই সময় হয়নি। সারা বাড়িতে ছিল বিভ্রান্তি, অস্থিরতা এবং তাড়াহুড়া।

মহিলা এসে লতিফ আহমদের সামনে উপস্থিত হন। তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন। ইতোমধ্যে কেউ একজন তাঁর জন্য চেয়ার আনে এবং তিনি সেই চেয়ারে বসে তাঁর অবসন্ন পা দু’টি ছড়িয়ে বিশ্রাম করছিলেন আর মুখ বড় করে হাই দিতে যাচ্ছিলেন- ‘আহ্...’ -আর তখনই সেখানে মহিলা এসে হাজির হন। মহিলা রোগা-পাতলা এবং পরনে পুরনো ভেজা সোয়েটার। তাঁর মাথায় রঙচটা স্কার্ফ বাঁধা এবং ফ্যাকাশে মুখ। তিনি বুকের সঙ্গে একটা পুঁটলি ধরে আছেন।

‘ভাইয়া! ওরও সুন্নাতে খাতনা করিয়ে দিন...’ লতিফ আহমদ তাকিয়ে দেখেন পুঁটলির ভেতর হয়তো এক মাসেরও কম বয়সী শিশু। তারপর তিনি মহিলার দিকে তাকালেন। তিনি উৎকণ্ঠিত, কেননা আশেপাশের যুবকরা যদি কোনো বাজে মন্তব্য করে। তিনি কোনো কথা না বলে পকেট থেকে এক শ’ রুপির একটা নোট মহিলার হাতে গুঁজে দেন। তাঁর মনে হলো রাজিয়া যেন সামাদকে কোলে নিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। মহিলা না তাকিয়ে চলে যান। লতিফ আহমদ ভাবলেন, আগের মহিলাকেও কিছু আর্থিক সাহায্য করা যেত। কিন্তু সেই মুহূর্তে তাঁর মনে হলো যে, একজনের পর আরেকজন আসবে... তারপর আরেকজন... এবং এভাবেই আসতে থাকবে... এর শেষ কোথায়? সব ছেলেদের খাতনা শেষ হলে সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে লতিফ আহমদ খানিকটা নির্ভার হলেন।

এবার তাঁকে নিজের পরিবারের ছেলেদের দেখভাল করতে হবে।

ছয়টায় লতিফ আহমদ বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই সার্জনের কাছে যাওয়ার জন্য ছেলেরা তৈরি হয়। ডাক্তার প্রকাশ বলেছিলেন, ‘আমরা ছেলেদের লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া দেব, ওরা কিছুই টের পাবে না। রাতে ভালো ঘুমের পর সকালে ওরা সতেজ হয়ে উঠবে।’ সুতরাং পুরো পরিবার ডাক্তার প্রকাশের ক্লিনিকে অস্ত্রোপচার কক্ষের বাইরে অপেক্ষা করছিল। অস্ত্রোপচার সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছিল, তবে কয়েকটি ছেলে হৈচৈ এবং কান্নাকাটি করেছে।

বাড়ি ফেরার পর ছেলেদের ফ্যানের নিচে নরম বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হয়। তাদের সেবা-যতœ করার জন্য অনেকেই তৈরি ছিল। হয়তো এক বা দু’টি ছেলে মাঝে মধ্যে ব্যথায় কঁকিয়ে উঠছিল। কিন্তু তাদের ঘরের বাইরে হাসি, ঠাট্টা-তামাশা এবং উৎসব উদযাপনের কোনো কমতি ছিল না। প্রতি আট ঘণ্টা অন্তর ছেলেদের বিছানা থেকে তুলে কাজু বাদাম বেটে তার সঙ্গে দুধ ও ব্যথানাশক ঔষধ দেওয়া হতো এবং খাওয়ার পর আবার শুইয়ে দিত। পরদিন তারা প্রায় সবাই সুস্থ হয়ে ওঠে। তাড়াতাড়ি সুস্থ হওয়ার প্রচুর ভালো খাবার ছিল- দুধ, ঘি, কাজুবাদাম, খেজুর... সবার জন্যই যথেষ্ট পরিমাণে ছিল এমনকী উচ্ছিষ্ট থেকেছে।

খাতনার পঞ্চম দিনে সামনের আঙিনায় হৈচৈ শুরু হয়। রাজিয়া নিচে যান এবং বাইরে উঁকি দিয়ে দেখলেন যে, আরিফ গাছে উঠে আধাপাকা সবুজ পেয়ারা ছিঁড়ছে। দু’জন কাজের লোক তাকে নিচে নামতে বলছে। তার মা আমিনা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কাজের লোকদের অনুরোধ করে এবং কাকুতি-মিনতি করে ছেলেকে নেমে আসতে বলে। আরিফ ইচ্ছে মতো পেয়ারা খেয়ে গাছ থেকে ধীরে ধীরে নেমে আসে এবং নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গেই কাজের লোকজন তাকে ধরে ফেলে। তাকে রাজিয়ার কাছে নিয়ে এলে সে নিজের পকেট থেকে হালকা চালে আরেকটি পেয়ারা বের করে কামড় দেয়। রাজিয়া কাজের লোকদের ছেড়ে দিতে বলেন। তিনি বিস্মিত গলায় আরিফকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর কী ঘা শুকিয়ে গেছে?’

‘হুম, হ্যাঁ, চিকাম্মা৫,’ জবাবে আরিফ বলল এবং বলেই সে কোনো লজ্জা-শরম বা দ্বিধা না করে এক ঝটকায় লুঙ্গি খোলে। রাজিয়া নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। সেখানে কোনো ব্যান্ডেজ নেই। কাটা অংশটি সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেছে। সেখানে বিন্দুমাত্র পুঁজও নেই। আর অন্যদিকে তাঁর ছেলে সামাদের অবস্থা ভালো না। সে পা সোজা করতে পারছে না। অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার পরেও তার ঘা বেড়ে গেছে। সকালে সে গোসলখানায় যেতে পারেনি। কাজের লোকজন তাকে তুলে নিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছে। তার কাটা জায়গাটি স্যানিটাইজড ইস্পাতের কাপ দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে, যাতে ভিজে না যায়। গোসলের পর সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। কাজের লোকেরা আস্তে ধীরে তার শরীর মুছে দিয়েছে। একজন নার্স এসে ক্ষতটি পরিষ্কার করেছে এবং পুনরায় ব্যান্ডেজ করে ইনজেকশন দিয়েছে। আর আরিফ গাছে চড়ে বানরের মতো খেলছে। ‘তুই কী ওষুধ খেয়েছিস, আরিফ- কোন ট্যাবলেট?’ রাজিয়া জিজ্ঞেস না করে থাকতে পারলেন না।

‘আমি কোনো ওষুধ খাইনি, চিকাম্মা। তারা শুধু ক্ষত জায়গায় ছাই মেখেছিল, আর তাতেই শুকিয়ে গেছে...’

রাজিয়া আসলে বুঝতে পারেননি গরিব ছেলেদের খাতনা অত্যন্ত সহজভাবে সম্পন্ন করা হয়। ওদের ক্ষত জায়গায় ছাই দেওয়া হয়- রাজিয়া জানতে পেরে এই ভেবে ভীষণ চিন্তায় পড়ে যান যে, যদি ওদের কারোর কোনো অঘটন ঘটে, তবে কী হবে। দ্বিতীয় তলায় অন্য সব ছেলেদের দেখে রাজিয়া নিজের ছেলের ঘরে যান। সামাদ ঘুমাচ্ছিল। পাশের টেবিলের ওপর বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি, বিস্কুট এবং তাজা ও শুকনো ফল রাখা আছে। রাজিয়া জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখেন আরিফ সামনের উঠানে আছে কি না। তিনি ওকে এক প্যাকেট বিস্কুট দিতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু সে কোথাও নেই। তিনি সামাদের গায়ের ওপর হালকা কম্বল বিছিয়ে বুয়াদের কাজ দেখাশোনা করার জন্য রান্নাঘরে চলে যান।

খাতনা করা ছেলেদের জন্য মুরগির স্যুপ রান্না করা হয় এবং আত্মীয়-স্বজনদের জন্য পোলাও ও কোর্মা। কিন্তু পুনরায় অসুস্থ বোধ করার জন্য তিনি আমিনাকে নিয়ে দশ মিনিটও রান্নাঘরে থাকতে পারেননি। যদিও রাজিয়া নিশ্চিত যে, তাঁর তত্ত্বাবধান ছাড়া সব খাবার সময় মতো তৈরি করার কাজ শেষ হবে না, তবুও তিনি বাধ্য হয়ে রান্নাঘর ত্যাগ করেন। তিনি যে মুরগির মাংস দেখভাল করছিলেন, তা অসম্পূর্ণ রেখেই ওপর তলায় চলে যান।

রাজিয়া সামাদের শোবার ঘরের দরজা আগেই বন্ধ করেছিলেন, যেন সে শান্তিতে ঘুমাতে পারে। তিনি দরজা খোলেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই লোম খাড়া করা চিৎকার করেন। তাঁর চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এলো। বাড়ির অন্য সব লোকজন নিজের ঘর থেকে দৌড়ে আসে এবং তারা দেখে অচেতন রাজিয়া এবং রক্তে ভেজা সামাদ মেঝেতে পড়ে আছে। ঘুম থেকে উঠে সে বিছানা থেকে নেমে মাকে খুঁজছিল, কিন্তু দরজার কাছে যাওয়ার আগেই সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। দেওয়ালে ধাক্কা লেগে তার মাথা থেকে ফেটে গিয়ে রক্ত ঝরছিল। খাতনার সেলাই খুলে গিয়েছিল এবং সেই ক্ষতস্থান থেকেও রক্ত ঝরছিল। তাই সামাদকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

খাতনার এগারো দিনের দিন লতিফ আহমদের পরিবারের খাতনা করা ছেলেদের আনুষ্ঠানিকভাবে গোসল করানো হয়। আর সেদিনই সামাদ হাসপাতাল থেকে ফিরে আসে। সেদিন সন্ধ্যায় বাড়িতে খানাপিনার বিশাল আয়োজন করা হয়। পুরো শহরের লোকজনদের দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। অনেকগুলো ছাগল জবেহ করা হয় এবং ভূরিভোজের সমস্তপ্রস্তুতি নেওয়া হয়। বাড়ির সামনের আঙিনায় শামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। পেছনের উঠান থেকে ছড়িয়ে পড়া বিরিয়ানির খুশবো চারপাশের বাতাসে মঁ মঁ করছিল। তখনো সামাদ বেশ দুর্বল এবং রাজিয়া তাঁর দৃষ্টির আড়ালে তাকে যেতে দেননি। তিনি সামাদের মাথা কোলে নিয়ে সোফায় বসে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছিলেন।

একসময় রাজিয়া লক্ষ্য করেন কেউ একজন বসার ঘরে চোরের মতো নিঃশব্দে পায়চারী করছে। ‘এই... কে ওখানে? এদিকে আয়’, তিনি ডাকলেন। শরীর এগিয়ে আসে। ‘আমি, চিক্কাম্মা...’ রাজিয়ার চোখ বড় হয়ে যায়। আরিফ! যদিও তার পরনে ছেঁড়া কলারের রঙ-চটা পুরনো শার্ট, তবু সে স্বাস্থ্যবান। সে লাল লুঙ্গি ছেড়ে প্যান্ট পরা শুরু করেছে, অর্থাৎ তার ক্ষত সম্পূর্ণরূপে শুকিয়ে গেছে। রাজিয়া সামাদের দিকে ঘুরে তাকালেন এবং তাঁর চোখ অশ্রুতে ভয়ে যায়। তিনি ফিসফিস করে নিজেকে বললেন, ‘বড়লোকের জন্য লোকজন আছে, গরিবদের জন্য পরওয়ারদিগার।’

রাজিয়ার দৃষ্টি চলে যায় আরিফের প্যান্টের দিকে, হাঁটুর কাছে সুতা। চিকাম্মাকে নীরব আর গভীর চিন্তায় ডুবে যেতে দেখে সে ঘুরে দাঁড়ায়। তখন তার পরনের কাপড়ে আরও দু’টি বড়ফুটা দেখা যায়, একটি তার প্যান্টে এবং অন্যটি শার্টে।

‘দাঁড়াও আরিফ’, রাজিয়া উঠে দাঁড়ানোর সময় বললেন। আলমারি খুলে সুন্দর করে ভাঁজ করা কাপড়ের স্তূপের ওপর চোখ বুলিয়ে আনেন। সামাদকে উপহার হিসেবে দেওয়া প্রায় এক ডজন পোশাক তখনো প্যাকেটের মধ্যে রয়েছে। রাজিয়া একজোড়া প্যান্ট আর একটা টি-শার্ট, যেগুলো সামাদের জন্য বড় ছিল, বের করে আরিফের হাতে দিয়ে বললেন, ‘এগুলো নাও। তুমি যখন খেতে আসবে, তখন এগুলো পরে এসো, ঠিক আছে?’

যখন আরিফ কাপড়গুলো দেখল, তখন তার চোখ খুশিতে ঝলমল করে ওঠে। সে যে দৃষ্টিতে রাজিয়ার দিকে তাকায়, তাতে কৃতজ্ঞতার চেয়ে বেশি ছিল ভক্তির প্রতিফলন। সে ধীরে ধীরে টি-শার্টটি স্পর্শ করল এবং তা দেখে রাজিয়া নিঃশব্দে হাসলেন। সামাদ উঠে বসে এবং রাজিয়ার কাঁধে মাথা রাখে। আরিফ লঘু পায়ে দরজার দিকে হাঁটার সময় বারবার তাদের দিকে ফিরে তাকাচ্ছিল আর সে তার বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে রেখেছে রাজিয়ার দেওয়া প্যান্ট ও টি-শার্ট। (সমাপ্ত)

টীকা: (ইংরেজি অনুবাদে নেই, তবে বাংলাদেশী পাঠকের সুবিধার্থে দেওয়া হলো)

৪ কারজি কায়ি – কর্নাটক স্টাইলের ডুবো তেলে ভাজা অর্ধ-চন্দ্র্রাকৃতির মিষ্টি পিঠা, যা বাংলাদেশের পুলি পিঠার মতো আকৃতি।

৫ চিকাম্মা: কন্নড় ভাষায় খালাম্মা।

গল্পসূত্র: ‘লাল লুঙ্গি’ গল্পটি ইংরেজিতে ‘রেড লুঙ্গি’ গল্পের অনুবাদ। ইংরেজিতে গল্পটি বানু মুশতাকের ২০২৫ সালে আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত ছোটগল্প গ্রন্থ ‘হার্ট ল্যাম্প’-এ অন্তর্ভুক্ত। গ্রন্থটি কন্নড় ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন দীপা ভাসতি।

back to top