alt

যোগফল শূন্য

সরকার মাসুদ

: বৃহস্পতিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

ফরিদ শেষ পর্যন্ত মেয়েটার পিছু নিয়েছিল। ‘দেখি তো কোন্ দিকে যায়’ এরকম ভেবে সে মেয়েটাকে ফলো করতে শুরু করে। নীলক্ষেত মোড়ের পেট্রোল পাম্প পেছনে ফেলে মেয়েটা নীলক্ষেত-পলাশী রোড ধরে কিছুদূর এগিয়েছে, তখন সে আর একা নয়। কোথা থেকে আরেকটা এসে জুটেছে। দু’জনেই ফরিদের ৩০/৪০ গজ দূরে। এ জায়গায় লোক চলাচল কম। আলোও কম। এখন ভরা সন্ধ্যা কিন্তু মনে হচ্ছে ৯টা বাজে। হঠাৎ একটা ট্যাক্সি এসে চলে গেল। গাড়িটার হেডলাইটের আলোয় কালো বা খয়েরি জামা পরা এক ছোকরাকে দেখা গেল। আস্তে আস্তে হাঁটছে। মুহূর্তেই স্পষ্ট হলো মেয়েটার হাঁটার বেদেনি ছন্দ। ফরিদ স্পষ্ট শুনল, ছেলেটা বলছে ‘কি রে সুন্দরী, আছস কেমুন?’ মেয়েটা টিপ্পনি কাটে। ছোকরাটা হেবলু মার্কা হাসি দিয়ে আঁচল টেনে ধরতেই ছন্ করে ওঠে ওই মেয়ে, ‘ছাড়, ছাড় কইলাম’।

চ্যাতস ক্যা? আমি তোর দুষমন নি?

চ্যাতুম না। অ্যাদ্দিন আছিলা কই, চান্দু? আগে আমার পাওনা ট্যাহাডা ফালা। তারপর কতা।

আজ সুবিধা হবে না বুঝে লাফাঙ্গা ছেলেটা সরে যায়। কেটে পড়তে পড়তে বলে, দিমু দিমু; আর কয়ডা দিন সবুর কর। হোসেন তর ট্যাহা মাইরা খাইবো না।

সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টার মধ্যে বাকুশাহ মার্কেট জমজমাট। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে-ওঠা দর্জিঘরগুলোতে মোমবাতি জ্বলছে। তার মানে লোডশেডিং। ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড়ানো কড়ইগাছের নিচে দুধ-রুটির দোকান। কয়েকজন কাস্টমার দুধে ভেজানো রুটি গিলছে। এক রিকশাওয়ালা কাউকে ডাকলো, ‘আহেন স্যার, কই যাইবেন?’ ফরিদও ভাবলো এখনও কেউ আসেনি বোধ হয়। সারাদিন নানান ধান্ধায় থাকে বন্ধুরা। ধান্ধা না করলে পেট চলবে? আড্ডার পয়সাইবা আসবে কোত্থেকে? আটটার আগে শাহবাগে মাথা ভাসাবে না কেউ।

ফরিদ ঠিক করেছিল আপাতত অসীম সাহার প্রেসে গিয়ে গ্যাজাবে। এ সময়টায় উনি থাকেন। তারপর আটটার দিকে শাহবাগের উদ্দেশে পা বাড়াবে। এক কাপ চা খেয়ে সিগারেট ধরিয়েছে কেবল। ঠিক তখনই ঘটে গেল ঘটনাটা। ফুটপাতের সামান্য আলোয় ঝিলকিয়ে উঠলো মেয়েটার চেহারা। কালো। প্রতিমার মতো আটোসাঁটো শরীর। নিতম্ব ছাড়িয়ে ঘন চুল। কিন্তু এত সব চোখে পড়ার আগে যা চুম্বকের মতো কাজ করছিল তা হচ্ছে মেয়েটার ওই মুহূর্তেও ছলকানো হাসি। রাস্তায় মৃদু আলো। শ্যামলা মুখম-লের মাঝখানে তার ধবধবে সাদা দাঁতগুলো মুহূর্তের জন্য জ্বলে উঠেছিল। তারপর লোকজনের ভিড়ে কোথায় যে মিলিয়ে গেল বিজলির মতো। পকেটে হাত চালায় ফরিদ। আজই সকালে এক হাজার টাকার নোট ভাঙ্গিয়েছে। শ’দুই টাকা খরচ হয়েছে। এখন আছে আটশ’ টাকার কিছু বেশি। মেয়েটার কথা মনে পড়ে তার। পাখিটা গেল কোন্ দিকে? মুহূর্তেই হাওয়া! ফরিদ একটু হতাশ। কারও সঙ্গে ভেগে গেলো না তো? কিন্তু না, দু’মিনিটের মাথায় ‘মিতালী হোটেলের’ সামনের লাইটপোস্টের গোড়ায় পানকৌড়ির মতো ভেসে উঠলো সে। ততক্ষণে কারেন্ট এসে গেছে। বিদ্যুতের আলোয় আবার কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছে চারপাশ।

ফরিদ আগেই লক্ষ্য করেছিল, মেয়েটা রাস্তার ওপাশের ঝুপড়িগুলোর একটাতে গিয়ে ঢুকেছে। বোঝা গেল এরা ওখানেই থাকে। ওখানেই ওদের ব্যবসা-পাতি। ইতোমধ্যে নীলক্ষেত মোড়ে পথচারির সংখ্যা বেড়েছে। রিকশা, টেম্পো, সিএনজি, বাইক মিলিয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা। ঢাকা শহরটা যা হয়ে উঠছে দিনকে দিন! মানুষের ভিড়ের জন্য ফুটপাতেও হাঁটা দায়। তাছাড়া ফুটপাতের অর্ধেকই তো চলে গেছে দোকানিদের দখলে। ফরিদ টের পেল তার মাথা ঝিমঝিম করছে। নর্দমার পচা পানি থেকে উঠে আসা গন্ধ নাক দিয়ে ঢুকে মগজে বুদ্বুদ তুলে মিলিয়ে গেল। হঠাৎ পল্লীগীতির সুর ভেসে ওঠে মাথায়। আসে বহুকাল আগের গ্রামের স্মৃতি। ভাদ্র মাসের ভরা বিলে বড়শিতে মাছের টোপ দিতে একটা লোক ডিঙিতে চেপেছে। তার গানের সুর সন্ধ্যার বাতাসে কেঁপে কেঁপে অবশেষে মিশে যাচ্ছে বিলের পানিতে। গান নয় যেন সুদূর কৈশোর থেকে উড়ে আসছে, অসংখ্য তেঁতুল পাতা : যৈবনকালে বন্ধু কই গেলো...। ‘বন্ধু’ শব্দটির সূত্রে ধূমপানরত ফরিদ এখন দেখেতে পাচ্ছে সিগারেটের ধোঁয়া থেকে জন্ম নিয়েছে এক বিরাট ধোঁয়ার কু-ুলি। অবাক হওয়ার মতো কা- বটে। ধূম্রকু-ুলিটা আস্তে আস্তে ওপরে উঠে যাচ্ছে। ওপরে দূরের আকাশের নীল ছাড়িয়ে কু-ুলিটা কি অবশেষে ছায়াপথে মিশে যাবে? পরমুহূর্তেই বাল্যসখী তাহমিনার মুখ ওই ধোঁয়ার কু-ুলির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে সেঁটে থাকলো ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি’র বিলবোর্ডে। ডান হাতে ক্রিমের টিউব তুলে ধরে বাঁ হাতের আঙুলের নির্দেশসহ তাহমিনা এখন মুচকি হাসছে নীলক্ষেতের এই চৌরাস্তায়।

তারপর অ্যাক্সিডেন্টে থেঁতলে যাওয়া কুকুর, ফুটপাতের পুরি-পেঁয়াজি, ন্যাংটো, আধো ন্যাংটো ছেলেমেয়েদের কিলবিল, কাজের মাতারিদের কলস ভরে হেলেদুলে পানি আনা... এসব সাত-সতেরো দৃশ্যের ভেতর দিয়ে ফরিদ সোজা ওই ঝুপড়ির পাশের খোলা জায়গাটায় পৌঁছে যায়। দূর থেকে ওটাকে চায়ের দোকান মনে হচ্ছিল। কয়েকটা ডেকচি আর গোটা চারেক বড় বয়াম সামনে রাখা। বয়ামগুলো খালি। বড় একটা বোল ঢাকনি দিয়ে আবৃত। ‘চা হবে?’ এই প্রশ্নে নাসিরুদ্দিন হোজ্জার মতো চাগলদাড়িঅলা এক লোক মুখ তোলে, এইডা চা’র দোকান না। আমরা চা বেচি না।

ফরিদ খেয়াল করে লোকটার গায়ে ফতুয়া টাইপের জামা। গৌতম বুদ্ধের ভঙ্গিতে বসে বিড়ি ফুঁকছে। ছেলেটা ইতোমধ্যে টংয়ের কোনায় বসে পড়েছে। লোকটা আপত্তি করেনি। একটু পরে ফরিদের চেহারা, পোশাক ও ভাবভঙ্গি লক্ষ্য করে সে বলে, চা খাইতে চাইলে পার্সেল আনাইতে পারি; তয় পাঁচ ট্যাকা বেশি লাগবো।

ফরিদ ভাবে এখানে বসে আছি অন্য মতলবে। বসে থাকার মাশুল হিসাবে না হয় পাঁচ/দশ টাকা বেশিই দিলাম। সে বলে, ‘আনান। সাথে তিনটা গোল্ডলিফও আনাইয়েন।’

একটা ছোট ছেলে চা-সিগারেট আনতে গেল। আধবুড়া লোকটা হাঁক ছাড়ে, ‘বিলকিস, অই বিলকিস।’

বিলকিস নামে সেই কালো ছিপছিপে মেয়েটা রাস্তার দিকে পিঠ দিয়ে বসে ছিল। ওইভাবে বসেই জবাব দেয়, ‘কেয়ারে?’

বুড়ো বলে, ফুলমতি আহে নাই?

আইছে। ভিতরে বিশ্রাম নিতাছে।

সাইন্জাবেলা বিশ্রাম নিতাছে। ক্যা, ছেমড়ির কি অইলো আইজ।

একটু বিরতি। তারপর লোকটা আবার বলে, আমি তো আছিলাম না দুই দিন। ছাত্তার আইছলো নি?

কইতে পারি না। বিলকিসের কণ্ঠ নিরুত্তাপ।

হালায় আর কতো ঘুরাইবো? ট্যাহা লইছে দুই মাস হইয়া গেল। তুই করছ কি। কিছু কইতে পারছ না?

বুড়োর মেজাজের তোয়াক্কা না করে বিলকিস কুপির আগুনে বিড়ি ধরায়। কিচুক্ষণ পরেই ফুকফুক করে ধোঁয়া টানতে দেখা যায় তাকে।

নীলক্ষেতের দিকে ঢাকা ইউনিভর্সিটির বাউন্ডারি ওয়াল যেখানে শেষ সেখান থেকেই বুয়েটের এরিয়া শুরু। সন্নিকটে রাস্তার দক্ষিণ পাশে বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে রাস্তার সমান্তরালে মাথা তুলেছে এসব উদ্বাস্তু ঝুপড়ি। যুবকদের সান্ধ্য সমাবেশ, বাকুশাহ মার্কেটের পেছনের বাংলা মদের পট্টি থেকে মাল টেনে আসা লোকজনের খিস্তি-খেউড়, জুয়ার আসর, গাঁজার ডেরা ইত্যাদি নানা অসামাজিক কাজের জন্য জায়গাটা গভীর রাত পর্যন্ত জমজমাট থাকে। আর নিষিদ্ধ বস্তুর ও স্থানের প্রতি মানুষের আকর্ষণ তো সহজাত। ফরিদ সিগারেট টানে আর ভাবে, রিপনের সঙ্গে দেখা হয় না তিন/চার দিন। গেল কোথায় ছেলেটা। কিশোরগঞ্জে যায়নি তো? রিপন চৌধুরী কবি। নবীন লেখক হিসেবে বেশ নাম করেছে। ভালো মানুষ। ফরিদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ইতোমধ্যে চল্লিশ মিনিট অতিবাহিত হয়েছে। বসে বসে সিগারেট পুড়িয়ে আর কত সময়ই বা কাটানো যায়? ফরিদ ভেতরে-ভেতরে অস্থির। ফুলমতি ও বিলকিস তার খুব কাছে দাঁড়ানো। হাত বাড়ালেই যেন স্পর্শ করা যাবে। কিন্তু মেয়েরা শালা বাইন মাছের মতো, ছেলেটা ভাবে, হাতের মুঠোয় এসেও ছলকে বেরিয়ে যায়। ছাই দিয়ে শক্ত করে ঠেসে ধরতে না পারলে বেরিয়ে যাবেই।

ঝুপড়ি ঘরে আলো খুব কম। ফরিদ বুড়োর চোখ এড়িয়ে ফুলমতির ফর্সা গাল টানলো দু’বার। মেয়েটা সরে গেল কিছুক্ষণের জন্য। তারপর বিলকিসের পিঠে হাত বুুলালো একটু। মেয়েটা অস্ফুট স্বরে কী যেন বলে পিছিয়ে দাঁড়াল। ফরিদ মনে মনে বলে, মেয়েটা বকা দিলো নাকি? পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সের দুটো লোক এসে বাম পাশের খালি বেঞ্চে বসেছে। একজনের মুখ নড়ে। পান চিবাচ্ছে। অন্যজনের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। ওরা অনেকক্ষণ ধরে ফরিদকে লক্ষ্য করছে। কিছু জিজ্ঞেস করেনি। হয়তো ভেবেছে ভার্সিটির ছাত্র। কিছু না বলাই ভালো। শেষে কী গ্যাঞ্জাম বাধাবে ঠিক আছে? বিড়ি হাতে বানরমুখো অন্য এক লোক দোকানের বুড়োকে বলে, তোমারে গরু-খোঁজা খুঁজলাম। কাইল আছিলা কই? ফতুল্লায় যা জমছিল না। ফুলমতি একলাই মাতাইয়া দিল। ছোট প্যান্ডেল। ড্যান্স দেইখ্যা মানুষ একেরে পাগল অইয়া গেল। কি কমু তোমারে, হ্যাশে তো...।

বাক্য অসম্পূর্ণ রেখে লোকটা বিড়িতে সুখটান দেয়। তারপর বাক্য কমপ্লিট করে। বুড়োর ঠোঁটে সামান্য হাসির রেখা। বানরমুখোর পাশে বসা লোকটা খ্যাসখাসে গলায় হেসে উঠলো। তখন ঢ্যাং ঢ্যাং করে বাচ্চা কোলে নিয়ে মধ্যবয়সী এক নারী এসে হাজির। তার চিৎকারে ঝুপড়ি পল্লী মুহূর্তেই গরম। ‘ওই লটির পো বিল্লাল, তরে না করছি না? আবার আইছস যে? বেশরম, বেহায়া।’

বানরমুখো লোকটা মাথা নিচু করে বসে থাকে। অবলীলায় বক হজম করে। উঠে যায় না। তা দেখে মহিলাটির জেদ চেপে বসে। সে এখন বলে, অহনো বইয়া আছস? ফুলমতিরে না দ্যাখলে প্যাডের বাত অজম অয় না তর, রা-ন্ডি-ও পুত। এইহানে কি, যা ভাগ! হারামজাদা...।

প্রতিরোধ না থাকায় মহিলা গালিগালাজ করতেই থাকে। তার রুদ্র মূর্তি দ্যাখার মতো। বানরমুখো লোকটা অনেকটা সময় ধরে চুপচাপ বকা খেয়ে চলেছে। এবার আর সহ্য হলো না। সে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ায় এবং বলে, জামালুদ্দিন, তর বউরে যাইত ক ইহান থাইকা। কেমন মুখ খরাপ করতাছে। বালা অইবো না কইলাম!

হাজার হলেও লোকটা ওই আধবুড়োর মানে জামালুদ্দিনে বন্ধু। তাছাড়া জামালুদ্দিনও নানা কারণে মনে-মনে ক্ষিপ্ত ছিল। এবার মওকা পেয়ে যায়। অতএব সেও মুখ খোলে, ওই কুত্তি! অনেক হইছে! ক্যাসেট বন্ধ করবি, না জুতার বাড়ি খাইতে চাছ?

এবার গরম তেলে ফোঁড়ন পড়ে, চোপ শয়তান। বেশি কতা কইলে এক্কেরে কাইটা ফালামু। সিয়ানা মাইয়াগুলার পিছে নাগর লাগাইয়া হেই ট্যাহা দিয়া মদ খাছ, জুয়া খেলছ। শকুন বইড়া তর শরম করে না? আল্লারে আল্লা! আমি পোলাপান লইয়া সারাদিন দিকদারি করি আর হ্যায় আছে হ্যার রঙ্গে...!

মেয়েলোকটা নাক ঝাড়ে। এবার বুঝি সে কেঁদেই ফেলবে। জামালুদ্দিন খিস্তি করে উঠলো। তার চোখে আগুন। তার হাতে টায়ারের ভারি স্যান্ডেল। কাজিয়া শুরু হওয়ার পর ফরিদ চলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু সে ঝগড়াটা উপভোগ করছে। অদূরে দাঁড়িয়ে সে কলহ দেখতে থাকে। সে খেয়াল করলো, ফুলমতির ঠোঁটে এ মুহূর্তে বেলাজ হাসির বদলে তপ্ত গজগজানি। বাপের সঙ্গে মেয়রাও যোগ দিয়েছে। কেননা তাদের ইজ্জত নিয়ে কথা বলেছে তাদের মা।... ‘চুপ কর শকুনি! তর কি অসুবিধা অইছে? কয়বেলা না খাইয়া আছিলি, না পিন্দনের কাপড় পাছ নাই হুনি? ... এক দোম চুপ। আর একটা কতা কবি না কইলাম!

দমকা হাওয়া যেমন এসেছিল তেমনি ফিরে গেছে। বেশি সময় নেয়নি। এখন ঝুপড়িপল্লী রীতিমতো ঠা-া। ফরিদ ভাবে, আধা ঘণ্টার ভেতর কতো কী হয়ে গেল। কিন্তু আমি যে ধান্ধায় এসেছি তার তো কিছু হলো না। হওয়ার সম্ভাবনাও দেখছি না। এভাবে ফলাফলহীন বসে থাকবো কতক্ষণ? আমি তো আকারে-ইঙ্গিতে যা বলার বলেছি। কিন্তু বুড়ো লাইনে আসছে না কেন? ফরিদ একবার ভাবে স্ট্রেটকাট বলে ফেলবে। কিন্তু সাহসে কুলোয় না। শেষে কী-না-কী বলে বসে। এদের মুখে তো ব্রেক নাই। আবার ভাবে, তা করার কথা নয়। একটু আগে যা দেখলাম তাতে মাইন্ড করবে বলে মনে হয় না। ছেলেটার মাথার ভেতরটা চুলবুল করতে থাকে। দশ মিনিট আগে লঙ্কাকা- বাধিয়েছিল যে স্ত্রী লোকটা সে এখন ঝুপড়ির ভেতর এক কোণে বসে আছে। মাথায় হাত। সামনে চেরাগ জ্বলছে। ফর্সা মেয়ে ফুলমতি এ মুহূর্তে ক্যামেরার রেঞ্জের বাইরে। কুপির ময়লা আলোয় বিলকিসকে এদিক-ওদিক হাঁটতে দেখা যায়। চ্যাকচ্যাক করে কী যেন খাচ্ছে।

ফরিদ ধৈর্য হারিয়ে ফেলছে। একবার ভাবলো, ফিরে যাই। আবার ভাবলো, শেষ না দেখেই চলে যাবো? দেখি না আরেকটু ট্রাই করে। ইতোমধ্যে পাশের ঝুপড়ির ছেলেটা গ্যারেজ থেকে ফিরেছে। বারো বাজার ভ্যান নিয়ে ফিরলো রাইস উদ্দিন। পৌনে ন’টা বাজে। বিলকিস এসে ফরিদের বাম কাঁধ বরাবর দাঁড়িয়ে পড়েছে। ফরিদের ইঙ্গিত পেয়ে মেয়েটা ঠোঁট বাঁকালো। তখন পেছন থেকে ওই দুর্মুখ স্ত্রী লোকটি নীরস কণ্ঠে বলে ওঠে, ছ্যারাডা কহন থাইকা বইয়া রইছে। কিছু জিগাও না ক্যা?

ফরিদ ভাবে এবার বুঝি পালে বাতাস লাগবে। কিন্তু স্ত্রী লোকটির ‘ছ্যারাডা’ উচ্চারণের মধ্যে কেমন শ্লেষ আছে মনে হলো। জামালুদ্দিন নড়েচড়ে বসে। বসার ভঙ্গি পাল্টায় না। তারপর বলে, কী লাগবো, কন?

ফরিদ বুঝে উঠতে পারে না কীভাবে কথাটা তুলবে। তখন জামালুদ্দিনই বলে, ছয় শ’ ট্যাহা লাগবো। লইয়া গেলে যান গিয়া। রাইত অইতাছে না!

চেরাগের লাল আলোয় বিলকিসের বিজলি হাসি দেখা গেল আবার। কোনের আলো-আঁধারের মধ্যে দাঁড়িয়ে ইশারা ছোঁড়ে সে। কিন্তু ফরিদ অন্যমনস্ক। কোথায় নিয়ে যাবে সে?

জামালুদ্দিন কিছু বলে না। এমন ভাব করে যেন শোনেইনি।

ফরিদ লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে অবশেষে বলেই ফেলে, এখানে-?

লোকটা বিরক্ত হয়, এহানে অইবো ক্যামনে? এইডা দোকান, দ্যাকতাছেন না?

নিজের ওপর রাগ হলো ফরিদের। ধুস্ শালা। খামাখা বসে থাকলাম এতটা সময়। সে টঙ থেকে নেমে রাস্তার এক পাশে দাঁড়ায়, আশাহত। জামালুদ্দিন সান্ত¡না দেয়ার মতো করে বলে, লইয়া যাইতে পারলে আবার আইয়েন। আমি আছি। অসুবিধা অইবো না।

ফিরে যাওয়ার আগে ফরিদের কানে এলো, ফুলমতি ও বিলকিস হাসাহাসি করছে। নিচু স্বরে তার উদ্দেশে কিছু একটা মন্তব্য করলো মনে হয়। ফরিদ অপমানিত বোধ করে।

জোর কদমে হাঁটতে থাকে ছেলেটা। দর্জিপট্টির কোনায় ‘বরিশাল হোটেল’-এর পেছনের ঢালে ফেলে দেয়া উচ্ছিষ্ট খাবার নিয়ে তখন ফাইট শুরু হয়ে গেছে কুকুরদের। চামড়া-ওঠা দুর্বল একটা কুকুর অন্যদের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে না পেরে কাঁই-কাঁই করতে করতে পেছনে হটে এলো। ফরিদ ভাবে, কী লাভ হলো? তার চেয়ে আজিমপুরে যেতাম যদি, মুজিব, রশিদদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে সময়টা ভালো কাটতো। ঠিক সেই সময় নিউমার্কেটের মোড়ে একটা ককটেল ফাটে। পনের/বিশ সেকেন্ডের ব্যবধানে আরও একটা। ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের উদ্দেশে কে যেন মন্তব্য করলো, লাগছে রে! পুলাপানগুলা আমার গ্যাঞ্জাম লাগাইছে! দুদ্দাড় শব্দে রিকশা, টেম্পো, বেবি ট্যাক্সি ও পথচারীদের পালানের হিড়িক পড়ে যায়। নীলক্ষেত-কাঁটাবন রোড মুহূর্তেই জনশূন্য।

শাহবাগে পৌঁছে ফরিদ দ্যাখে ‘মৌলি’,‘সিনোরিটা’ সব বন্ধ। পত্রিকাওয়ালাও দোকান গুটিয়ে চলে গেছে। জেগে আছে শুধু ‘কোহিনুর’। ভেতরে ৩/৪টি লোক খাচ্ছে। ফরিদ গলা বাড়িয়ে দেখলো শিশির, সামাদ, ফারুক আসাদ কেউ নেই। গেছে কোথায় সব? সাড়ে ন’টা বাজতে না বাজতেই আজ কেটে পড়লো সবাই! শেষ মুহূর্তে দু’একজনের দেখা যদি মেলে এ আশায় একটা টেবিলে বসে পড়ে সে। এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে একটা সিগারেট জ্বালায়। মনে-মনে বলে, হোউর! দিনটাই প- হলো!

চায়ের কাপ হাতে তুলে নিয়ে দু’টো চুমুক দেয় ফরিদ। কোনো স্বাদ পায় না। আসলে তার কিছুই ভালো লাগছে না এখন। ব্যর্থতার গ্লানি মাথার ভেতর একটা ঝিমঝিম ভাব সৃষ্টি করেছে। না আজ আর কেউ আসবে না। মিনিট পনের পর সে রাস্তায় নেমে আসে। বিরক্তির ও নিঃসঙ্গতার বোধ তাকে ভীষণ অস্বস্তির মধ্যে নিক্ষেপ করে। দুঃখের ও হতাশার চোরাবালিতে তালিয়ে যাচ্ছিল সে। এরকম অসহায় মুহূর্তে পল্লবীগামী একটি মিনিবাস তাকে তুলে নেয়। গাড়িটার পেছনের দিকে অনেকগুলো সিট ফাঁকা। জানালার পাশের একটা সিটে বসে ফরিদ সাত-পাঁচ ভাবতে থাকে।

ছবি

আধুনিক বাংলা কবিতার একশ’ বছর

ছবি

বিশ্বসাহিত্যে এর প্রতিফলন

ছবি

মোজগান ফারামানেশ-এর কবিতা

ছবি

চোখ

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লাল লুঙ্গি

ছবি

শ্বেতা শতাব্দী এষের কবিতা

ছবি

বিপন্ন মানুষের মনোবাস্তবতার স্বরূপ

ছবি

দিনু বিল্লাহ: জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে

জেলার সিরিজ কবিতা

ছবি

লাল লুঙ্গি

সাময়িকী কবিতা

ছবি

নির্মলেন্দু গুণের রাজনৈতিক বলয় অতিক্রমের ক্ষমতা

ছবি

কেরাসিন বাত্তি ও লালচুলা মেয়েটি

ছবি

তাঁর সমকালীনদের চোখে

ছবি

নিজের মতো করেই সঠিক পথটি বেছে নিতে হবে

ছবি

সুকান্ত ভট্টাচার্য: বহুচর্চিত, বহুপঠিত এক অনন্য কবি

ছবি

চিত্রাঙ্গদা: দ্বৈত সত্তার শিল্পস্মারক

ছবি

খালেদ হামিদীর দৌত্যে ওরহান পামুক

সাময়িকী কবিতা

ছবি

মেঘলা আকাশ বৃষ্টি

ছবি

স্মৃতি ভদ্র

ছবি

হৃদয়রেখা

ছবি

সুরমা বুজি অথবা কাচপোকা

ছবি

শ্রাবণের জোছনায় হেসেছিল নার্গিস

ছবি

যোগাযোগ

ছবি

বাংলাদেশের স্বাপ্নিক কবি নজরুল

ছবি

ইলিয়াসের আশ্চর্য নিরীক্ষা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

মাটি ও মানুষের কথক

ছবি

অনাবিল প্রাচুর্যে ঋদ্ধ নজরুল প্রতিভা

ছবি

নজরুল: চির-বিস্ময়

ছবি

জীবনের সাথে সংযোগ ঘটল কই

পোয়েমস দ্যাট কেম টু মি

ছবি

লালন ও রবীন্দ্রনাথ অন্তর্জগতের আলাপন

ছবি

বংশধারা

tab

যোগফল শূন্য

সরকার মাসুদ

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

বৃহস্পতিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ফরিদ শেষ পর্যন্ত মেয়েটার পিছু নিয়েছিল। ‘দেখি তো কোন্ দিকে যায়’ এরকম ভেবে সে মেয়েটাকে ফলো করতে শুরু করে। নীলক্ষেত মোড়ের পেট্রোল পাম্প পেছনে ফেলে মেয়েটা নীলক্ষেত-পলাশী রোড ধরে কিছুদূর এগিয়েছে, তখন সে আর একা নয়। কোথা থেকে আরেকটা এসে জুটেছে। দু’জনেই ফরিদের ৩০/৪০ গজ দূরে। এ জায়গায় লোক চলাচল কম। আলোও কম। এখন ভরা সন্ধ্যা কিন্তু মনে হচ্ছে ৯টা বাজে। হঠাৎ একটা ট্যাক্সি এসে চলে গেল। গাড়িটার হেডলাইটের আলোয় কালো বা খয়েরি জামা পরা এক ছোকরাকে দেখা গেল। আস্তে আস্তে হাঁটছে। মুহূর্তেই স্পষ্ট হলো মেয়েটার হাঁটার বেদেনি ছন্দ। ফরিদ স্পষ্ট শুনল, ছেলেটা বলছে ‘কি রে সুন্দরী, আছস কেমুন?’ মেয়েটা টিপ্পনি কাটে। ছোকরাটা হেবলু মার্কা হাসি দিয়ে আঁচল টেনে ধরতেই ছন্ করে ওঠে ওই মেয়ে, ‘ছাড়, ছাড় কইলাম’।

চ্যাতস ক্যা? আমি তোর দুষমন নি?

চ্যাতুম না। অ্যাদ্দিন আছিলা কই, চান্দু? আগে আমার পাওনা ট্যাহাডা ফালা। তারপর কতা।

আজ সুবিধা হবে না বুঝে লাফাঙ্গা ছেলেটা সরে যায়। কেটে পড়তে পড়তে বলে, দিমু দিমু; আর কয়ডা দিন সবুর কর। হোসেন তর ট্যাহা মাইরা খাইবো না।

সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টার মধ্যে বাকুশাহ মার্কেট জমজমাট। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে-ওঠা দর্জিঘরগুলোতে মোমবাতি জ্বলছে। তার মানে লোডশেডিং। ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড়ানো কড়ইগাছের নিচে দুধ-রুটির দোকান। কয়েকজন কাস্টমার দুধে ভেজানো রুটি গিলছে। এক রিকশাওয়ালা কাউকে ডাকলো, ‘আহেন স্যার, কই যাইবেন?’ ফরিদও ভাবলো এখনও কেউ আসেনি বোধ হয়। সারাদিন নানান ধান্ধায় থাকে বন্ধুরা। ধান্ধা না করলে পেট চলবে? আড্ডার পয়সাইবা আসবে কোত্থেকে? আটটার আগে শাহবাগে মাথা ভাসাবে না কেউ।

ফরিদ ঠিক করেছিল আপাতত অসীম সাহার প্রেসে গিয়ে গ্যাজাবে। এ সময়টায় উনি থাকেন। তারপর আটটার দিকে শাহবাগের উদ্দেশে পা বাড়াবে। এক কাপ চা খেয়ে সিগারেট ধরিয়েছে কেবল। ঠিক তখনই ঘটে গেল ঘটনাটা। ফুটপাতের সামান্য আলোয় ঝিলকিয়ে উঠলো মেয়েটার চেহারা। কালো। প্রতিমার মতো আটোসাঁটো শরীর। নিতম্ব ছাড়িয়ে ঘন চুল। কিন্তু এত সব চোখে পড়ার আগে যা চুম্বকের মতো কাজ করছিল তা হচ্ছে মেয়েটার ওই মুহূর্তেও ছলকানো হাসি। রাস্তায় মৃদু আলো। শ্যামলা মুখম-লের মাঝখানে তার ধবধবে সাদা দাঁতগুলো মুহূর্তের জন্য জ্বলে উঠেছিল। তারপর লোকজনের ভিড়ে কোথায় যে মিলিয়ে গেল বিজলির মতো। পকেটে হাত চালায় ফরিদ। আজই সকালে এক হাজার টাকার নোট ভাঙ্গিয়েছে। শ’দুই টাকা খরচ হয়েছে। এখন আছে আটশ’ টাকার কিছু বেশি। মেয়েটার কথা মনে পড়ে তার। পাখিটা গেল কোন্ দিকে? মুহূর্তেই হাওয়া! ফরিদ একটু হতাশ। কারও সঙ্গে ভেগে গেলো না তো? কিন্তু না, দু’মিনিটের মাথায় ‘মিতালী হোটেলের’ সামনের লাইটপোস্টের গোড়ায় পানকৌড়ির মতো ভেসে উঠলো সে। ততক্ষণে কারেন্ট এসে গেছে। বিদ্যুতের আলোয় আবার কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছে চারপাশ।

ফরিদ আগেই লক্ষ্য করেছিল, মেয়েটা রাস্তার ওপাশের ঝুপড়িগুলোর একটাতে গিয়ে ঢুকেছে। বোঝা গেল এরা ওখানেই থাকে। ওখানেই ওদের ব্যবসা-পাতি। ইতোমধ্যে নীলক্ষেত মোড়ে পথচারির সংখ্যা বেড়েছে। রিকশা, টেম্পো, সিএনজি, বাইক মিলিয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা। ঢাকা শহরটা যা হয়ে উঠছে দিনকে দিন! মানুষের ভিড়ের জন্য ফুটপাতেও হাঁটা দায়। তাছাড়া ফুটপাতের অর্ধেকই তো চলে গেছে দোকানিদের দখলে। ফরিদ টের পেল তার মাথা ঝিমঝিম করছে। নর্দমার পচা পানি থেকে উঠে আসা গন্ধ নাক দিয়ে ঢুকে মগজে বুদ্বুদ তুলে মিলিয়ে গেল। হঠাৎ পল্লীগীতির সুর ভেসে ওঠে মাথায়। আসে বহুকাল আগের গ্রামের স্মৃতি। ভাদ্র মাসের ভরা বিলে বড়শিতে মাছের টোপ দিতে একটা লোক ডিঙিতে চেপেছে। তার গানের সুর সন্ধ্যার বাতাসে কেঁপে কেঁপে অবশেষে মিশে যাচ্ছে বিলের পানিতে। গান নয় যেন সুদূর কৈশোর থেকে উড়ে আসছে, অসংখ্য তেঁতুল পাতা : যৈবনকালে বন্ধু কই গেলো...। ‘বন্ধু’ শব্দটির সূত্রে ধূমপানরত ফরিদ এখন দেখেতে পাচ্ছে সিগারেটের ধোঁয়া থেকে জন্ম নিয়েছে এক বিরাট ধোঁয়ার কু-ুলি। অবাক হওয়ার মতো কা- বটে। ধূম্রকু-ুলিটা আস্তে আস্তে ওপরে উঠে যাচ্ছে। ওপরে দূরের আকাশের নীল ছাড়িয়ে কু-ুলিটা কি অবশেষে ছায়াপথে মিশে যাবে? পরমুহূর্তেই বাল্যসখী তাহমিনার মুখ ওই ধোঁয়ার কু-ুলির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে সেঁটে থাকলো ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি’র বিলবোর্ডে। ডান হাতে ক্রিমের টিউব তুলে ধরে বাঁ হাতের আঙুলের নির্দেশসহ তাহমিনা এখন মুচকি হাসছে নীলক্ষেতের এই চৌরাস্তায়।

তারপর অ্যাক্সিডেন্টে থেঁতলে যাওয়া কুকুর, ফুটপাতের পুরি-পেঁয়াজি, ন্যাংটো, আধো ন্যাংটো ছেলেমেয়েদের কিলবিল, কাজের মাতারিদের কলস ভরে হেলেদুলে পানি আনা... এসব সাত-সতেরো দৃশ্যের ভেতর দিয়ে ফরিদ সোজা ওই ঝুপড়ির পাশের খোলা জায়গাটায় পৌঁছে যায়। দূর থেকে ওটাকে চায়ের দোকান মনে হচ্ছিল। কয়েকটা ডেকচি আর গোটা চারেক বড় বয়াম সামনে রাখা। বয়ামগুলো খালি। বড় একটা বোল ঢাকনি দিয়ে আবৃত। ‘চা হবে?’ এই প্রশ্নে নাসিরুদ্দিন হোজ্জার মতো চাগলদাড়িঅলা এক লোক মুখ তোলে, এইডা চা’র দোকান না। আমরা চা বেচি না।

ফরিদ খেয়াল করে লোকটার গায়ে ফতুয়া টাইপের জামা। গৌতম বুদ্ধের ভঙ্গিতে বসে বিড়ি ফুঁকছে। ছেলেটা ইতোমধ্যে টংয়ের কোনায় বসে পড়েছে। লোকটা আপত্তি করেনি। একটু পরে ফরিদের চেহারা, পোশাক ও ভাবভঙ্গি লক্ষ্য করে সে বলে, চা খাইতে চাইলে পার্সেল আনাইতে পারি; তয় পাঁচ ট্যাকা বেশি লাগবো।

ফরিদ ভাবে এখানে বসে আছি অন্য মতলবে। বসে থাকার মাশুল হিসাবে না হয় পাঁচ/দশ টাকা বেশিই দিলাম। সে বলে, ‘আনান। সাথে তিনটা গোল্ডলিফও আনাইয়েন।’

একটা ছোট ছেলে চা-সিগারেট আনতে গেল। আধবুড়া লোকটা হাঁক ছাড়ে, ‘বিলকিস, অই বিলকিস।’

বিলকিস নামে সেই কালো ছিপছিপে মেয়েটা রাস্তার দিকে পিঠ দিয়ে বসে ছিল। ওইভাবে বসেই জবাব দেয়, ‘কেয়ারে?’

বুড়ো বলে, ফুলমতি আহে নাই?

আইছে। ভিতরে বিশ্রাম নিতাছে।

সাইন্জাবেলা বিশ্রাম নিতাছে। ক্যা, ছেমড়ির কি অইলো আইজ।

একটু বিরতি। তারপর লোকটা আবার বলে, আমি তো আছিলাম না দুই দিন। ছাত্তার আইছলো নি?

কইতে পারি না। বিলকিসের কণ্ঠ নিরুত্তাপ।

হালায় আর কতো ঘুরাইবো? ট্যাহা লইছে দুই মাস হইয়া গেল। তুই করছ কি। কিছু কইতে পারছ না?

বুড়োর মেজাজের তোয়াক্কা না করে বিলকিস কুপির আগুনে বিড়ি ধরায়। কিচুক্ষণ পরেই ফুকফুক করে ধোঁয়া টানতে দেখা যায় তাকে।

নীলক্ষেতের দিকে ঢাকা ইউনিভর্সিটির বাউন্ডারি ওয়াল যেখানে শেষ সেখান থেকেই বুয়েটের এরিয়া শুরু। সন্নিকটে রাস্তার দক্ষিণ পাশে বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে রাস্তার সমান্তরালে মাথা তুলেছে এসব উদ্বাস্তু ঝুপড়ি। যুবকদের সান্ধ্য সমাবেশ, বাকুশাহ মার্কেটের পেছনের বাংলা মদের পট্টি থেকে মাল টেনে আসা লোকজনের খিস্তি-খেউড়, জুয়ার আসর, গাঁজার ডেরা ইত্যাদি নানা অসামাজিক কাজের জন্য জায়গাটা গভীর রাত পর্যন্ত জমজমাট থাকে। আর নিষিদ্ধ বস্তুর ও স্থানের প্রতি মানুষের আকর্ষণ তো সহজাত। ফরিদ সিগারেট টানে আর ভাবে, রিপনের সঙ্গে দেখা হয় না তিন/চার দিন। গেল কোথায় ছেলেটা। কিশোরগঞ্জে যায়নি তো? রিপন চৌধুরী কবি। নবীন লেখক হিসেবে বেশ নাম করেছে। ভালো মানুষ। ফরিদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ইতোমধ্যে চল্লিশ মিনিট অতিবাহিত হয়েছে। বসে বসে সিগারেট পুড়িয়ে আর কত সময়ই বা কাটানো যায়? ফরিদ ভেতরে-ভেতরে অস্থির। ফুলমতি ও বিলকিস তার খুব কাছে দাঁড়ানো। হাত বাড়ালেই যেন স্পর্শ করা যাবে। কিন্তু মেয়েরা শালা বাইন মাছের মতো, ছেলেটা ভাবে, হাতের মুঠোয় এসেও ছলকে বেরিয়ে যায়। ছাই দিয়ে শক্ত করে ঠেসে ধরতে না পারলে বেরিয়ে যাবেই।

ঝুপড়ি ঘরে আলো খুব কম। ফরিদ বুড়োর চোখ এড়িয়ে ফুলমতির ফর্সা গাল টানলো দু’বার। মেয়েটা সরে গেল কিছুক্ষণের জন্য। তারপর বিলকিসের পিঠে হাত বুুলালো একটু। মেয়েটা অস্ফুট স্বরে কী যেন বলে পিছিয়ে দাঁড়াল। ফরিদ মনে মনে বলে, মেয়েটা বকা দিলো নাকি? পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সের দুটো লোক এসে বাম পাশের খালি বেঞ্চে বসেছে। একজনের মুখ নড়ে। পান চিবাচ্ছে। অন্যজনের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। ওরা অনেকক্ষণ ধরে ফরিদকে লক্ষ্য করছে। কিছু জিজ্ঞেস করেনি। হয়তো ভেবেছে ভার্সিটির ছাত্র। কিছু না বলাই ভালো। শেষে কী গ্যাঞ্জাম বাধাবে ঠিক আছে? বিড়ি হাতে বানরমুখো অন্য এক লোক দোকানের বুড়োকে বলে, তোমারে গরু-খোঁজা খুঁজলাম। কাইল আছিলা কই? ফতুল্লায় যা জমছিল না। ফুলমতি একলাই মাতাইয়া দিল। ছোট প্যান্ডেল। ড্যান্স দেইখ্যা মানুষ একেরে পাগল অইয়া গেল। কি কমু তোমারে, হ্যাশে তো...।

বাক্য অসম্পূর্ণ রেখে লোকটা বিড়িতে সুখটান দেয়। তারপর বাক্য কমপ্লিট করে। বুড়োর ঠোঁটে সামান্য হাসির রেখা। বানরমুখোর পাশে বসা লোকটা খ্যাসখাসে গলায় হেসে উঠলো। তখন ঢ্যাং ঢ্যাং করে বাচ্চা কোলে নিয়ে মধ্যবয়সী এক নারী এসে হাজির। তার চিৎকারে ঝুপড়ি পল্লী মুহূর্তেই গরম। ‘ওই লটির পো বিল্লাল, তরে না করছি না? আবার আইছস যে? বেশরম, বেহায়া।’

বানরমুখো লোকটা মাথা নিচু করে বসে থাকে। অবলীলায় বক হজম করে। উঠে যায় না। তা দেখে মহিলাটির জেদ চেপে বসে। সে এখন বলে, অহনো বইয়া আছস? ফুলমতিরে না দ্যাখলে প্যাডের বাত অজম অয় না তর, রা-ন্ডি-ও পুত। এইহানে কি, যা ভাগ! হারামজাদা...।

প্রতিরোধ না থাকায় মহিলা গালিগালাজ করতেই থাকে। তার রুদ্র মূর্তি দ্যাখার মতো। বানরমুখো লোকটা অনেকটা সময় ধরে চুপচাপ বকা খেয়ে চলেছে। এবার আর সহ্য হলো না। সে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ায় এবং বলে, জামালুদ্দিন, তর বউরে যাইত ক ইহান থাইকা। কেমন মুখ খরাপ করতাছে। বালা অইবো না কইলাম!

হাজার হলেও লোকটা ওই আধবুড়োর মানে জামালুদ্দিনে বন্ধু। তাছাড়া জামালুদ্দিনও নানা কারণে মনে-মনে ক্ষিপ্ত ছিল। এবার মওকা পেয়ে যায়। অতএব সেও মুখ খোলে, ওই কুত্তি! অনেক হইছে! ক্যাসেট বন্ধ করবি, না জুতার বাড়ি খাইতে চাছ?

এবার গরম তেলে ফোঁড়ন পড়ে, চোপ শয়তান। বেশি কতা কইলে এক্কেরে কাইটা ফালামু। সিয়ানা মাইয়াগুলার পিছে নাগর লাগাইয়া হেই ট্যাহা দিয়া মদ খাছ, জুয়া খেলছ। শকুন বইড়া তর শরম করে না? আল্লারে আল্লা! আমি পোলাপান লইয়া সারাদিন দিকদারি করি আর হ্যায় আছে হ্যার রঙ্গে...!

মেয়েলোকটা নাক ঝাড়ে। এবার বুঝি সে কেঁদেই ফেলবে। জামালুদ্দিন খিস্তি করে উঠলো। তার চোখে আগুন। তার হাতে টায়ারের ভারি স্যান্ডেল। কাজিয়া শুরু হওয়ার পর ফরিদ চলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু সে ঝগড়াটা উপভোগ করছে। অদূরে দাঁড়িয়ে সে কলহ দেখতে থাকে। সে খেয়াল করলো, ফুলমতির ঠোঁটে এ মুহূর্তে বেলাজ হাসির বদলে তপ্ত গজগজানি। বাপের সঙ্গে মেয়রাও যোগ দিয়েছে। কেননা তাদের ইজ্জত নিয়ে কথা বলেছে তাদের মা।... ‘চুপ কর শকুনি! তর কি অসুবিধা অইছে? কয়বেলা না খাইয়া আছিলি, না পিন্দনের কাপড় পাছ নাই হুনি? ... এক দোম চুপ। আর একটা কতা কবি না কইলাম!

দমকা হাওয়া যেমন এসেছিল তেমনি ফিরে গেছে। বেশি সময় নেয়নি। এখন ঝুপড়িপল্লী রীতিমতো ঠা-া। ফরিদ ভাবে, আধা ঘণ্টার ভেতর কতো কী হয়ে গেল। কিন্তু আমি যে ধান্ধায় এসেছি তার তো কিছু হলো না। হওয়ার সম্ভাবনাও দেখছি না। এভাবে ফলাফলহীন বসে থাকবো কতক্ষণ? আমি তো আকারে-ইঙ্গিতে যা বলার বলেছি। কিন্তু বুড়ো লাইনে আসছে না কেন? ফরিদ একবার ভাবে স্ট্রেটকাট বলে ফেলবে। কিন্তু সাহসে কুলোয় না। শেষে কী-না-কী বলে বসে। এদের মুখে তো ব্রেক নাই। আবার ভাবে, তা করার কথা নয়। একটু আগে যা দেখলাম তাতে মাইন্ড করবে বলে মনে হয় না। ছেলেটার মাথার ভেতরটা চুলবুল করতে থাকে। দশ মিনিট আগে লঙ্কাকা- বাধিয়েছিল যে স্ত্রী লোকটা সে এখন ঝুপড়ির ভেতর এক কোণে বসে আছে। মাথায় হাত। সামনে চেরাগ জ্বলছে। ফর্সা মেয়ে ফুলমতি এ মুহূর্তে ক্যামেরার রেঞ্জের বাইরে। কুপির ময়লা আলোয় বিলকিসকে এদিক-ওদিক হাঁটতে দেখা যায়। চ্যাকচ্যাক করে কী যেন খাচ্ছে।

ফরিদ ধৈর্য হারিয়ে ফেলছে। একবার ভাবলো, ফিরে যাই। আবার ভাবলো, শেষ না দেখেই চলে যাবো? দেখি না আরেকটু ট্রাই করে। ইতোমধ্যে পাশের ঝুপড়ির ছেলেটা গ্যারেজ থেকে ফিরেছে। বারো বাজার ভ্যান নিয়ে ফিরলো রাইস উদ্দিন। পৌনে ন’টা বাজে। বিলকিস এসে ফরিদের বাম কাঁধ বরাবর দাঁড়িয়ে পড়েছে। ফরিদের ইঙ্গিত পেয়ে মেয়েটা ঠোঁট বাঁকালো। তখন পেছন থেকে ওই দুর্মুখ স্ত্রী লোকটি নীরস কণ্ঠে বলে ওঠে, ছ্যারাডা কহন থাইকা বইয়া রইছে। কিছু জিগাও না ক্যা?

ফরিদ ভাবে এবার বুঝি পালে বাতাস লাগবে। কিন্তু স্ত্রী লোকটির ‘ছ্যারাডা’ উচ্চারণের মধ্যে কেমন শ্লেষ আছে মনে হলো। জামালুদ্দিন নড়েচড়ে বসে। বসার ভঙ্গি পাল্টায় না। তারপর বলে, কী লাগবো, কন?

ফরিদ বুঝে উঠতে পারে না কীভাবে কথাটা তুলবে। তখন জামালুদ্দিনই বলে, ছয় শ’ ট্যাহা লাগবো। লইয়া গেলে যান গিয়া। রাইত অইতাছে না!

চেরাগের লাল আলোয় বিলকিসের বিজলি হাসি দেখা গেল আবার। কোনের আলো-আঁধারের মধ্যে দাঁড়িয়ে ইশারা ছোঁড়ে সে। কিন্তু ফরিদ অন্যমনস্ক। কোথায় নিয়ে যাবে সে?

জামালুদ্দিন কিছু বলে না। এমন ভাব করে যেন শোনেইনি।

ফরিদ লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে অবশেষে বলেই ফেলে, এখানে-?

লোকটা বিরক্ত হয়, এহানে অইবো ক্যামনে? এইডা দোকান, দ্যাকতাছেন না?

নিজের ওপর রাগ হলো ফরিদের। ধুস্ শালা। খামাখা বসে থাকলাম এতটা সময়। সে টঙ থেকে নেমে রাস্তার এক পাশে দাঁড়ায়, আশাহত। জামালুদ্দিন সান্ত¡না দেয়ার মতো করে বলে, লইয়া যাইতে পারলে আবার আইয়েন। আমি আছি। অসুবিধা অইবো না।

ফিরে যাওয়ার আগে ফরিদের কানে এলো, ফুলমতি ও বিলকিস হাসাহাসি করছে। নিচু স্বরে তার উদ্দেশে কিছু একটা মন্তব্য করলো মনে হয়। ফরিদ অপমানিত বোধ করে।

জোর কদমে হাঁটতে থাকে ছেলেটা। দর্জিপট্টির কোনায় ‘বরিশাল হোটেল’-এর পেছনের ঢালে ফেলে দেয়া উচ্ছিষ্ট খাবার নিয়ে তখন ফাইট শুরু হয়ে গেছে কুকুরদের। চামড়া-ওঠা দুর্বল একটা কুকুর অন্যদের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে না পেরে কাঁই-কাঁই করতে করতে পেছনে হটে এলো। ফরিদ ভাবে, কী লাভ হলো? তার চেয়ে আজিমপুরে যেতাম যদি, মুজিব, রশিদদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে সময়টা ভালো কাটতো। ঠিক সেই সময় নিউমার্কেটের মোড়ে একটা ককটেল ফাটে। পনের/বিশ সেকেন্ডের ব্যবধানে আরও একটা। ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের উদ্দেশে কে যেন মন্তব্য করলো, লাগছে রে! পুলাপানগুলা আমার গ্যাঞ্জাম লাগাইছে! দুদ্দাড় শব্দে রিকশা, টেম্পো, বেবি ট্যাক্সি ও পথচারীদের পালানের হিড়িক পড়ে যায়। নীলক্ষেত-কাঁটাবন রোড মুহূর্তেই জনশূন্য।

শাহবাগে পৌঁছে ফরিদ দ্যাখে ‘মৌলি’,‘সিনোরিটা’ সব বন্ধ। পত্রিকাওয়ালাও দোকান গুটিয়ে চলে গেছে। জেগে আছে শুধু ‘কোহিনুর’। ভেতরে ৩/৪টি লোক খাচ্ছে। ফরিদ গলা বাড়িয়ে দেখলো শিশির, সামাদ, ফারুক আসাদ কেউ নেই। গেছে কোথায় সব? সাড়ে ন’টা বাজতে না বাজতেই আজ কেটে পড়লো সবাই! শেষ মুহূর্তে দু’একজনের দেখা যদি মেলে এ আশায় একটা টেবিলে বসে পড়ে সে। এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে একটা সিগারেট জ্বালায়। মনে-মনে বলে, হোউর! দিনটাই প- হলো!

চায়ের কাপ হাতে তুলে নিয়ে দু’টো চুমুক দেয় ফরিদ। কোনো স্বাদ পায় না। আসলে তার কিছুই ভালো লাগছে না এখন। ব্যর্থতার গ্লানি মাথার ভেতর একটা ঝিমঝিম ভাব সৃষ্টি করেছে। না আজ আর কেউ আসবে না। মিনিট পনের পর সে রাস্তায় নেমে আসে। বিরক্তির ও নিঃসঙ্গতার বোধ তাকে ভীষণ অস্বস্তির মধ্যে নিক্ষেপ করে। দুঃখের ও হতাশার চোরাবালিতে তালিয়ে যাচ্ছিল সে। এরকম অসহায় মুহূর্তে পল্লবীগামী একটি মিনিবাস তাকে তুলে নেয়। গাড়িটার পেছনের দিকে অনেকগুলো সিট ফাঁকা। জানালার পাশের একটা সিটে বসে ফরিদ সাত-পাঁচ ভাবতে থাকে।

back to top