alt

জীবনবোধের অনবদ্য চিত্ররূপ ‘স্বপ্নছোঁয়ার পদযাত্রা’

টি. এ. অনন্যা

: বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫

প্রাত্যহিক যাপিত জীবন ও বাস্তবতার আনন্দ যন্ত্রণা থেকে উৎসারিত যে কোনো গল্পই আমাদের জীবনবোধকে ছুঁয়ে যায়। রাহমান ওয়াহিদ রচিত সাতটি গল্পের মলাটবদ্ধ গল্পগ্রন্থ ‘স্বপ্নছোঁয়ার পদযাত্রা’ সেই বোধেরই অনেকটা প্রতিচ্ছবি। রাহমান ওয়াহিদ মূলত কবি। তাঁর গল্পগুলোর শরীরে তাই হয়তো কিছুটা কাব্যিক ব্যঞ্জনার ছোঁয়া মেলে। তাঁর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ স্বপ্নছোঁয়ার পদযাত্রাও তার ব্যতিক্রম নয়।

‘কুয়াশা অতল’ গল্পে মিনহাজের ভাবনায় স্ত্রী মেনেকার সাথে রোমান্টিক মুহূর্তগুলোর স্মৃতিচারণ দিয়ে গল্প শুরু হলেও কিছু পরেই দেখা যায় তাদের দাম্পত্য জীবনে ‘সন্দেহ’ নামের কীটের উপস্থিতি। সন্দেহের কেন্দ্রে ঈশিতা হলেও সে কি আদৌ দায়ী? নাকি সবটাই মেনেকার বোঝার ভুল? করোনায় আক্রান্ত মেনেকাকে এ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাবার অপেক্ষায় থাকা মিনহাজ উদ্বিগ্ন হয়ে ভাবে- মানুষটা তার ওপর অভিমান করে একেবারেই চলে যাবে নাতো? মিনহাজের এ ভাবনা পাঠককেও অনিশ্চয়তার ভাবনায় দোলায়িত করে তোলে। ‘নমিনি সমাচার’ গল্পে টি এ- টির অবসরপ্রাপ্ত অফিসার ইউসুফ আলী এক রাতের অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে উপলদ্ধি করতে পারেন নিজের মৃত্যু খুব সন্নিকটে। পারিবারিক কিছু সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করার কারণে পরিবারের সবার কাছ থেকে অনেক আগেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ইউসুফ আলী স্ত্রীর ওপর অভিমান করে মৃত্যুর আগে নিজের ব্যাংক এ্যাকাউন্টে স্ত্রীর পাশাপাশি নমিনি করতে চান পাশের বাড়ির পুত্রসম কামলা রবিউলকে। সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করে ব্যাংক থেকে ফেরার পথে ঘটে যায় এক অঘটন। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে ভর্তি হন হাসপাতালে। ছুটে আসে অনেক দূরে চলে যাওয়া স্ত্রী পুত্র কন্যারা। রবিউলকে স্ত্রীর সাথে নমিনি করার কথা জানতে পেরে প্রচ- ক্ষেপে যায় পরিবারের লোকজন। বাবার সিদ্ধান্তে ক্ষিপ্ত পুত্র অর্ধ চেতন বাবার সামনেই রবিউলকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। তখন পরিবারের সদস্যদের কাছে ইউসুফ আলীর সুস্থ হয়ে ওঠা, না তার জমানো টাকার হিস্যা পাওয়া- কোন্টি বড়- এ প্রশ্ন নিয়েই যথারীতি এগোতে থাকে গল্পটি। ‘জলকাদায় অপারেশন’-এর বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল যুদ্ধের পর মেম্বার হয়েছিলেন। একটা চুরির বিচার করতে বসে মনে পড়ে যায় একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে তার গা হিমকরা বিভিন্ন সাহসিকতাপূর্ণ ঘটনাবলির কথা। গল্পের শেষে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত জয়নালকে চমকপ্রদ যে কথাটি বলতে শোনা যায়, তা হলো, ‘স্বাধীন দেশে কিসের চুরির বিচার? অরে (চোরকে) আচ্ছামতো প্যাদানি দিয়া বুঝাইয়া দ্যান স্বধীন দ্যাশে চুরির মজা ক্যামুন।’ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এ গল্পটি পাঠককে কিছু সময়ের জন্য হলেও একাত্তরের সেই রক্তঝরা দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।

‘নীল ও বিবিধ সমীকরণ’ গল্পে আশিক দুই যুগ পরে এক চিঠির মাধ্যমে হারানো প্রেমিকা নীলকে খুঁজে পেলেও এক নির্মম সত্যির মুখোমুখি হতে হয় তাকে। মৃতপ্রায় নীলের শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী তার একমাত্র মেয়ে তুলির দেখভাল করার প্রতিশ্রুতি দিতে হলেও স্ত্রী ঋতু তা মেনে নেবে কিনা সেই অস্বস্তিও তাকে পেয়ে বসে। এখানে লেখক ত্রিভুজ প্রেমের এক জটিল সমীকরণে দাঁড় করিয়ে দেন পাঠককে। একটু ভিন্ন ধারার গল্প ‘গর্ত’ আমাদের সমাজের একটি প্রতিকী চিত্র। পার্কের একটি গর্ত থেকে উঠে আসা যুগল তরুণ-তরুণী অবসরপ্রাপ্ত দুই বন্ধুর জেরার মুখে পড়ে যায়। এক পর্যায়ে দুই বন্ধুর একজন রশিদ মানসিকভাবে বিধ্বস্ত মেয়েটিকে তার বাসার একটি অংশে মাসহ থাকার অফার দিলে মেয়েটি দোটানায় পড়ে গিয়ে ভাবে- এটি নতুন কোনো গর্ত নয় তো? কী করবে সে? চমৎকার লিখনশৈলীতে ঋদ্ধ এ গল্পের সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্রটি পাঠককে যথেষ্ট আকৃষ্ট করবে নিঃসন্দেহে। ‘একটি চশমা ও ধূসর অবয়ব’ গল্পে বিসিএস ক্যাডার মিলি হাওড় এলাকা ইটনার অফিসে জয়েন করতে এসে বাবার মতো দেখতে এক ভদ্রলোকের চশমার আড়ালে বাবার অস্তিত্ব খুঁজতে থাকে। চোখের তিলটি দেখতে পেলেই নিশ্চিত হতে পারে সে- তিনি তার বাবা কিনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনেক আগেই সংসারের মায়ার বাঁধন ছিঁড়ে পালিয়ে আসা ভদ্রলোকটি চশমাটি খোলেন বটে কিন্তু তাতে বাবা রহস্যটির কোনো সুরাহা হয় কি? তিনি কি সত্যিই মিলির বাবা, না অন্য কেউ? চমকপ্রদ এ গল্পের শেষটায় এ প্রশ্নটি মিলির মতো বেদনার্ত করে তোলে পাঠককেও। গ্রন্থটির নামগল্প ‘স্বপ্নছোঁয়ার পদযাত্রা’র প্লটটি পরিচিত হলেও লেখকের উপস্থাপনাটি অসাধারণ। মোবাইল প্রযুক্তিহীন সেই যুগে মাস্টার্স করা চালচুলোহীন নাহিদের সাথে চিঠির মাধ্যমে বেশ ভালোই প্রেম চলছিল নীরার। কিন্তু হঠাৎই অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়–য়া নীরাকে অন্যত্র বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লাগে তার পরিবার। তখন ভালোবাসার মানুষকে পেতে মরিয়া হয়ে ওঠা নাহিদ ও নীরা পালিয়ে যেতে চায় বহুদূরে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে সেখানেও। অনেক কৌশল করে তারা কোনমতে রাতের ট্রেনে উঠতে পারলেও ‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হওয়া’র মতো নীরার মামাকে দেখতে পায় নীরা ট্রেনের একই কামরায়। আঁৎকে ওঠে দুজনই। মামা তো ভীষণ অবাক এভাবে তার ভাগনিকে দেখে। নাহিদ নীরা তখনও কৌশল খুঁজতে থাকে মামার দৃষ্টিকে আড়াল করে পালিয়ে যাবার। তাদের স্বপ্নছোঁয়ার পদযাত্রা পরিকল্পনাটি কি শেষ পর্যন্ত সফল হবে? পাবে কি তারা একে অপরকে? উত্তরটি না হয় তোলা থাক পাঠকদের জন্য। শব্দ ও ভাষার শৈল্পিক বুননে নির্মিত আনন্দসঞ্চারী এ গল্পটি সত্যিই মন ছুঁয়ে যাবার মতো।

গল্পগ্রন্থ মানেই এক বইয়ে ভিন্ন ভিন্ন লেখার স্বাদ লুকিয়ে থাকে। ছোটগল্পের শেষ টুইস্ট, যা গল্প শেষ হলেও মস্তিষ্কে রেখে যায় তার রেশটা। সেটা উপভোগ করতে দারুণ লাগে। এই গল্পগ্রন্থের বেশিরভাগ গল্পেই সেই উপভোগটি পেতে নিরাশ হতে হয়নি। গল্পকার রাহমান ওয়াহিদের গল্প উপস্থাপন,ভাষার ব্যবহার, চরিত্র রূপায়ন, ঘটনার প্রবাহ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার বর্ণনা সত্যি খুব চমৎকার। সবচেয়ে বড় কথা- উপস্থাপনার মুন্সিয়ানায় সব গল্পই পাঠককে টেনে নিয়ে গেছে শেষ শব্দটি পর্যন্ত। একজন গল্পকারের সার্থকতা এখানেই। সেদিক থেকে বলাই যায়- গল্পপিপাসু পাঠকদের জন্য সুখপাঠ্য একটি গল্পগ্রন্থ ‘স্বপ্নছোঁয়ার পদযাত্রা’। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে অনুপ্রাণন প্রকাশন, ঢাকা। প্রকাশকাল ২০২৪ সাল। মুদ্রিত মূল্য ৩০০ টাকা। গ্রন্থটির বহুল প্রচার ও বিক্রয় কামনা করছি।

কার্তিকের স্নান

আমি- শেষ

ছবি

মহিবুল আলমের কবিতায় নদী ও নারী

ছবি

কবি মাহমুদ কামাল ও নিমগ্ন আত্মার সাধক

ছবি

স্পর্শ

ছবি

নুরুন্নাহার মুন্নির গল্প

ছবি

মাটির মমতায় হেমন্ত বিকেল

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

জীবনানন্দ দাশ দূর-সময়ের সার্বভৌম কবি

ছবি

পথ ভিন্ন : প্রসঙ্গ লালন

ছবি

মার্গারেট অ্যাটউড ‘রানিং দ্য ব্যাট’

ছবি

এলোমেলো স্মৃতির সমরেশ মজুমদার

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বিমল গুহের কবিতার অন্তর্জগৎ ও শিল্পৈশ্বর্য

ছবি

কবিতার সুনীল সুনীলের কবিতা

ছবি

রূপান্তরের অকথিত গল্পটা

ছবি

মানব সভ্যতার আত্মবিশ্লেষণের আয়না

ছবি

বাইরে একটা কিছু জ্বলছে

ছবি

‘কাফকার মতো হবো বলে আইন পড়েছিলাম’

ছবি

সত্যেন সেনের উপন্যাস: মিথ ও ইতিহাসলগ্ন মানুষ

ছবি

বিস্ময়ের সীমা নাই

ছবি

নগর বাউল ও ত্রিকালদর্শী সন্ত কবি শামসুর রাহমান

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ও বন্ধু আমার

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

শামসুর রাহমানের কবিতায় ‘মিথ’

ছবি

বহুমাত্রিক শামসুর রাহমান

ছবি

দূর-সময়ের সার্বভৌম কবি

ছবি

মাহফুজ আল-হোসেন-এর দশটি কবিতা

ছবি

মনোজগতের অন্বেষায়

সাময়িকী কবিতা

ছবি

এক ঘর রোদ

ছবি

দ্রোহের রম্য পঙ্ক্তিমালা

ছবি

সংবেদী রঙে ও রেখায় প্রাণের উন্মোচন

ছবি

অলস দিনের হাওয়া

tab

জীবনবোধের অনবদ্য চিত্ররূপ ‘স্বপ্নছোঁয়ার পদযাত্রা’

টি. এ. অনন্যা

বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫

প্রাত্যহিক যাপিত জীবন ও বাস্তবতার আনন্দ যন্ত্রণা থেকে উৎসারিত যে কোনো গল্পই আমাদের জীবনবোধকে ছুঁয়ে যায়। রাহমান ওয়াহিদ রচিত সাতটি গল্পের মলাটবদ্ধ গল্পগ্রন্থ ‘স্বপ্নছোঁয়ার পদযাত্রা’ সেই বোধেরই অনেকটা প্রতিচ্ছবি। রাহমান ওয়াহিদ মূলত কবি। তাঁর গল্পগুলোর শরীরে তাই হয়তো কিছুটা কাব্যিক ব্যঞ্জনার ছোঁয়া মেলে। তাঁর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ স্বপ্নছোঁয়ার পদযাত্রাও তার ব্যতিক্রম নয়।

‘কুয়াশা অতল’ গল্পে মিনহাজের ভাবনায় স্ত্রী মেনেকার সাথে রোমান্টিক মুহূর্তগুলোর স্মৃতিচারণ দিয়ে গল্প শুরু হলেও কিছু পরেই দেখা যায় তাদের দাম্পত্য জীবনে ‘সন্দেহ’ নামের কীটের উপস্থিতি। সন্দেহের কেন্দ্রে ঈশিতা হলেও সে কি আদৌ দায়ী? নাকি সবটাই মেনেকার বোঝার ভুল? করোনায় আক্রান্ত মেনেকাকে এ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাবার অপেক্ষায় থাকা মিনহাজ উদ্বিগ্ন হয়ে ভাবে- মানুষটা তার ওপর অভিমান করে একেবারেই চলে যাবে নাতো? মিনহাজের এ ভাবনা পাঠককেও অনিশ্চয়তার ভাবনায় দোলায়িত করে তোলে। ‘নমিনি সমাচার’ গল্পে টি এ- টির অবসরপ্রাপ্ত অফিসার ইউসুফ আলী এক রাতের অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে উপলদ্ধি করতে পারেন নিজের মৃত্যু খুব সন্নিকটে। পারিবারিক কিছু সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করার কারণে পরিবারের সবার কাছ থেকে অনেক আগেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ইউসুফ আলী স্ত্রীর ওপর অভিমান করে মৃত্যুর আগে নিজের ব্যাংক এ্যাকাউন্টে স্ত্রীর পাশাপাশি নমিনি করতে চান পাশের বাড়ির পুত্রসম কামলা রবিউলকে। সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করে ব্যাংক থেকে ফেরার পথে ঘটে যায় এক অঘটন। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে ভর্তি হন হাসপাতালে। ছুটে আসে অনেক দূরে চলে যাওয়া স্ত্রী পুত্র কন্যারা। রবিউলকে স্ত্রীর সাথে নমিনি করার কথা জানতে পেরে প্রচ- ক্ষেপে যায় পরিবারের লোকজন। বাবার সিদ্ধান্তে ক্ষিপ্ত পুত্র অর্ধ চেতন বাবার সামনেই রবিউলকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। তখন পরিবারের সদস্যদের কাছে ইউসুফ আলীর সুস্থ হয়ে ওঠা, না তার জমানো টাকার হিস্যা পাওয়া- কোন্টি বড়- এ প্রশ্ন নিয়েই যথারীতি এগোতে থাকে গল্পটি। ‘জলকাদায় অপারেশন’-এর বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল যুদ্ধের পর মেম্বার হয়েছিলেন। একটা চুরির বিচার করতে বসে মনে পড়ে যায় একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে তার গা হিমকরা বিভিন্ন সাহসিকতাপূর্ণ ঘটনাবলির কথা। গল্পের শেষে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত জয়নালকে চমকপ্রদ যে কথাটি বলতে শোনা যায়, তা হলো, ‘স্বাধীন দেশে কিসের চুরির বিচার? অরে (চোরকে) আচ্ছামতো প্যাদানি দিয়া বুঝাইয়া দ্যান স্বধীন দ্যাশে চুরির মজা ক্যামুন।’ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এ গল্পটি পাঠককে কিছু সময়ের জন্য হলেও একাত্তরের সেই রক্তঝরা দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।

‘নীল ও বিবিধ সমীকরণ’ গল্পে আশিক দুই যুগ পরে এক চিঠির মাধ্যমে হারানো প্রেমিকা নীলকে খুঁজে পেলেও এক নির্মম সত্যির মুখোমুখি হতে হয় তাকে। মৃতপ্রায় নীলের শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী তার একমাত্র মেয়ে তুলির দেখভাল করার প্রতিশ্রুতি দিতে হলেও স্ত্রী ঋতু তা মেনে নেবে কিনা সেই অস্বস্তিও তাকে পেয়ে বসে। এখানে লেখক ত্রিভুজ প্রেমের এক জটিল সমীকরণে দাঁড় করিয়ে দেন পাঠককে। একটু ভিন্ন ধারার গল্প ‘গর্ত’ আমাদের সমাজের একটি প্রতিকী চিত্র। পার্কের একটি গর্ত থেকে উঠে আসা যুগল তরুণ-তরুণী অবসরপ্রাপ্ত দুই বন্ধুর জেরার মুখে পড়ে যায়। এক পর্যায়ে দুই বন্ধুর একজন রশিদ মানসিকভাবে বিধ্বস্ত মেয়েটিকে তার বাসার একটি অংশে মাসহ থাকার অফার দিলে মেয়েটি দোটানায় পড়ে গিয়ে ভাবে- এটি নতুন কোনো গর্ত নয় তো? কী করবে সে? চমৎকার লিখনশৈলীতে ঋদ্ধ এ গল্পের সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্রটি পাঠককে যথেষ্ট আকৃষ্ট করবে নিঃসন্দেহে। ‘একটি চশমা ও ধূসর অবয়ব’ গল্পে বিসিএস ক্যাডার মিলি হাওড় এলাকা ইটনার অফিসে জয়েন করতে এসে বাবার মতো দেখতে এক ভদ্রলোকের চশমার আড়ালে বাবার অস্তিত্ব খুঁজতে থাকে। চোখের তিলটি দেখতে পেলেই নিশ্চিত হতে পারে সে- তিনি তার বাবা কিনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনেক আগেই সংসারের মায়ার বাঁধন ছিঁড়ে পালিয়ে আসা ভদ্রলোকটি চশমাটি খোলেন বটে কিন্তু তাতে বাবা রহস্যটির কোনো সুরাহা হয় কি? তিনি কি সত্যিই মিলির বাবা, না অন্য কেউ? চমকপ্রদ এ গল্পের শেষটায় এ প্রশ্নটি মিলির মতো বেদনার্ত করে তোলে পাঠককেও। গ্রন্থটির নামগল্প ‘স্বপ্নছোঁয়ার পদযাত্রা’র প্লটটি পরিচিত হলেও লেখকের উপস্থাপনাটি অসাধারণ। মোবাইল প্রযুক্তিহীন সেই যুগে মাস্টার্স করা চালচুলোহীন নাহিদের সাথে চিঠির মাধ্যমে বেশ ভালোই প্রেম চলছিল নীরার। কিন্তু হঠাৎই অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়–য়া নীরাকে অন্যত্র বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লাগে তার পরিবার। তখন ভালোবাসার মানুষকে পেতে মরিয়া হয়ে ওঠা নাহিদ ও নীরা পালিয়ে যেতে চায় বহুদূরে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে সেখানেও। অনেক কৌশল করে তারা কোনমতে রাতের ট্রেনে উঠতে পারলেও ‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হওয়া’র মতো নীরার মামাকে দেখতে পায় নীরা ট্রেনের একই কামরায়। আঁৎকে ওঠে দুজনই। মামা তো ভীষণ অবাক এভাবে তার ভাগনিকে দেখে। নাহিদ নীরা তখনও কৌশল খুঁজতে থাকে মামার দৃষ্টিকে আড়াল করে পালিয়ে যাবার। তাদের স্বপ্নছোঁয়ার পদযাত্রা পরিকল্পনাটি কি শেষ পর্যন্ত সফল হবে? পাবে কি তারা একে অপরকে? উত্তরটি না হয় তোলা থাক পাঠকদের জন্য। শব্দ ও ভাষার শৈল্পিক বুননে নির্মিত আনন্দসঞ্চারী এ গল্পটি সত্যিই মন ছুঁয়ে যাবার মতো।

গল্পগ্রন্থ মানেই এক বইয়ে ভিন্ন ভিন্ন লেখার স্বাদ লুকিয়ে থাকে। ছোটগল্পের শেষ টুইস্ট, যা গল্প শেষ হলেও মস্তিষ্কে রেখে যায় তার রেশটা। সেটা উপভোগ করতে দারুণ লাগে। এই গল্পগ্রন্থের বেশিরভাগ গল্পেই সেই উপভোগটি পেতে নিরাশ হতে হয়নি। গল্পকার রাহমান ওয়াহিদের গল্প উপস্থাপন,ভাষার ব্যবহার, চরিত্র রূপায়ন, ঘটনার প্রবাহ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার বর্ণনা সত্যি খুব চমৎকার। সবচেয়ে বড় কথা- উপস্থাপনার মুন্সিয়ানায় সব গল্পই পাঠককে টেনে নিয়ে গেছে শেষ শব্দটি পর্যন্ত। একজন গল্পকারের সার্থকতা এখানেই। সেদিক থেকে বলাই যায়- গল্পপিপাসু পাঠকদের জন্য সুখপাঠ্য একটি গল্পগ্রন্থ ‘স্বপ্নছোঁয়ার পদযাত্রা’। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে অনুপ্রাণন প্রকাশন, ঢাকা। প্রকাশকাল ২০২৪ সাল। মুদ্রিত মূল্য ৩০০ টাকা। গ্রন্থটির বহুল প্রচার ও বিক্রয় কামনা করছি।

back to top