লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের সাক্ষাৎকার
‘দ্য প্যারিস রিভিউ’। ২০১৮ সালের ২২৫তম গ্রীষ্মকালীন সংখ্যা। সদ্য নোবেলবিজয়ী লেখক লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করে। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন প্রখ্যাত শিল্পসমালোচক এডাম থ্রিলওয়েল। এটি ‘সংবাদ সাময়িকী’র পাঠকদের জন্য বাংলায় অনুবাদ করেছেন অশোক কর
এডাম থ্রিলওয়েল : আসুন, আপনার লেখক হয়ে ওঠার প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা শুরু করা যাক।
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই: সত্যি বলতে কী, আমার ধারণা ছিল- বাস্তবিক জীবন, একটা সত্যিকারের জীবনের অবস্থান রয়েছে অন?্য কোনোখানে, শিল্প-উপন্যাসে নয়। ফ্রাঞ্জ কাফকার ‘দ্য ক্যাসেল’ (The Castle)-এর পাশাপাশি- ম্যালকম লোরির ‘আন্ডার দ্য ভলক্যানো’ (Under the Volcano) ছিল আমার সেই সময়ের শিল্পতাত্মিক বাইবেল। এটা ষাটের দশকের শেষ আর সত্তরের দশকের প্রথম দিকের কথা। আমার ইচ্ছে ছিল সঙ্গীত নিয়ে কাজ করার, আমি আসলে লেখকের ভূমিকা নিতে চাইনি, মাত্র একটা উপন্যাস লিখব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তারপর ফিরে যাব আমার পেশা আর দৈনন্দিন জীবনযাপনে। আমি আমার পাশের দরিদ্র মানুষদের সাথেই থাকতে চেয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম সেটাই আমার আসল জীবন। আমি খুব দরিদ্র গ্রামে থাকতাম, জীবনধারণের জন্য শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করতাম। বাধ্যতামূলক (কমিউনিস্ট) সামরিক পরিষেবা এড়াতে প্রতি তিন/চার মাস অন্তর অবস্থান পরিবর্তন করতাম। তারপর, যেই থেকে আমি যৎসামান্য লেখা প্রকাশ করতে শুরু করলাম, অমনি পুলিশের কাছে জবাবদিহি দিতে বাধ্য হলাম। আমি তাদেরকে সবসময় বলতাম- “আমি রাজনীতি করি না, সমসাময়িক রাজনীতি নিয়েও লেখালেখি করি না।” গোয়েন্দা পুলিশেরা আমাকে বিশ্বাস করতো না, তাদের ধারণা ছিল লাসলো ক্রাসনাহোরকাই (László Krasznahorkai) একজন ঘোর কমিউনিস্ট-বিরোধী। তারা আমার পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করল, ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত আমার কোনো পাসপোর্ট ছিল না। আমি কিন্তু কখনোই কোনো রাজনৈতিক বিক্ষোভে যোগ দিইনি, রাজনীতিতে সক্রিয় অংশ নিইনি। আমি কেবলমাত্র অজ পাড়াগ্রামে কিম্বা পাতি-মফস্বল শহরে থাকতাম, আর আমার প্রথম উপন্যাস লেখার চেষ্টা করতাম।আমার লেখক জীবনের গল্পের শুরু এভাবেই- এবং খুব সহজেই তা শেষ গল্পও হতে পারত।
এ. থ্রি.: এ রকম পরিস্থিতিতে আপনার প্রথম উপন্যাসটি কখন, কীভাবে প্রকাশিত হলো?
লা. ক্রা.: উপন্যাসটি প্রকাশিত হলো ১৯৮৫ সাল। কেউই- আমি নিজেও- হৃদয়ঙ্গম করতে পারছিলাম না ‘স্যাটানটাঙ্গো’ (Satantango) উপন্যাসটি কীভাবে প্রকাশ করা সম্ভব হলো, কারণ কমিউনিস্ট ব্যবস্থার নিরিখে ‘স্যাটানটাঙ্গো’ একটি বিপদসঙ্কুল বিতর্কিত উপন্যাস ছিল। সেই সময়, সমসাময়িক সাহিত্য প্রকাশনা সংস্থাটির পরিচালক ছিলেন একজন প্রাক্তন গোপন-পুলিশ প্রধান, তিনি হয়তো প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে- তাঁর এখনও যথেষ্ট ক্ষমতা আছে- “স্যাটানটাঙ্গো” উপন্যাসটি প্রকাশ করার মতো সাহস দেখানোর ক্ষমতা। আমি অনুমান করি উপন্যসাটি প্রকাশিত হওয়ার সেটিই একমাত্র কারণ।
এ. থ্রি.: জীবন ধারণের জন্য আপনি তখন কোন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন?
লা. ক্রা.:আমি কিছুদিন খনি শ্রমিকের কাজ করেছিলাম। তারপর আমি বুদাপেস্ট থেকে অনেক দূরের কয়েকটি গ্রামের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক হয়েছিলাম। প্রতিটি গ্রামেই একটা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র থাকত, আর গ্রামবাসীদের দৈনন্দিন জীবনে এই লাইব্রেরিই ছিল তাদের সবকিছু। শুক্র বা শনিবারগুলোতে, সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক সঙ্গীতানুষ্ঠান বা এর মতো কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন, তরুণদের জন্য যা ছিল উৎসাহব্যঞ্জক। আমি মোট ছয়টি গ্রামের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক ছিলাম, সে কারণে তরুণ প্রজন্মের যুবকদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ থাকতো। আমি এই কাজ খুবই পছন্দ করতাম, কারণ আমি বুর্জোয়াদের থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করতাম। আর কী? এছাড়া আমি একটি জনমানবহীন (নো ম্যান’স ল্যান্ড) এলাকায় তিনশো গরুর রাতের রাখাল (নাইট ওয়ামচম্যান) হিসাবে কাজ করতাম। ওটা ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের একটা গোয়ালঘর। আশেপাশে আর কোনো গ্রাম বা শহর ছিল না। আমি কয়েক মাস এখানে রাতের রাখাল ছিলাম, এক পকেটে ‘আন্ডার দ্য ভলক্যানো’ আর অন্য পকেটে দস্তয়েভস্কি নিয়ে ছিল আমার সুখের দরিদ্র জীবন। আমার প্রথম উপন?্যাস “স্যাটানটাঙ্গো” রচনার অনুষঙ্গ এখান থেকেই সংগৃহীত।
এই ‘ভবঘুরে’ বছরগুলোতে আমি মদ?্যপান শুরু করি। হাঙ্গেরীয় সাহিত্যে একটি ঐতিহ্য ছিল যে, সত্যিকারের প্রতিভাধর ব্যক্তিরা ছিলেন চরম মাতাল। আমিও পুরোপুরি একজন উন্মাদ মাতাল হয়ে উঠলাম। সে সময়ে, সমসাময়িক গদ্য লেখকদের মধ্যে, একজন জীবন্ত কিংবদন্তি এবং ম্যালকম লোরির মতো চরম ও গভীর মদ্যপ- পিটার হাইনোচি (Péter Hajnóczy), মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যু হাঙ্গেরীয় সাহিত্যের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা। এমনি কোনো এক দিনে, একদল হাঙ্গেরীয় লেখকের সাথে সুরাপানকালে দুঃখের সাথে সবাই যখন একমত হচ্ছিল যে, প্রত্যক হাঙ্গেরীয় প্রতিভাই একজন উন্মাদ মাতাল- এটাই নিয়তির অনিবার্য পরিণতি-, আমি তা অস্বীকার করে ওদের সাথে বারো বোতল শ্যাম্পেনের বাজি ধরলাম যে- আমি আর কখনোই মদ্যপান করব না। এবং আমি আর মদ্যপান করিনি, মাতাল হইনি। এই ছিল আমার বেশ রোমাঞ্চকর জীবন। এ সময়ে কাজের কারণে প্রতিদিনই শহর থেকে শহরে ছুটতে হতো, সেই সুবাদে রাতে রেলস্টেশন আর বারে রাত্রিযাপন, জনতার সাথে সামাজিক যোগাযোগ, সংক্ষিপ্ত কথোপকথন, মানুষকে পর্যবেক্ষণ, এসব থেকেই ধীরে ধীরে, আমার মাথায় প্রথম উপন্যাস লেখারচিন্তা এলো। এভাবে কাজ করাটা তেমন কোন ভালো পদক্ষেপ ছিল না, কারণ আমার একটা দৃঢ় অনুভূতি ছিল যে- সাহিত্য একটি আধ্যাত্মিক ক্ষেত্র- সমসাময়িক বিশ্বসাহিত্যে তখন হাইনোচি, ইয়ানোস পিলিনস্কি (János Pilinszky), সান্দর ভেওরেস (Sándor Weöres), এবং আরও প্রতিভাবান কবি কবিতা লিখছেন, তাঁদের কবিতা খুবই ভাল লাগতো, এবং তাঁদেরকে ভালোবাসতাম, কারণ কবিতা সর্বদাই আকর্ষণীয়, আর গোপনীয়। কিন্তু গদ্যকে বাস্তবতার বেশ কাছাকাছি মনে হতো। ধারণা হতো- গদ্যপ্রতিভারা বাস্তব জীবনের খুব কাছাকাছি বাস করেন। এই কারণেই, ঐতিহ্যগতভাবে, হাঙ্গেরীয় গদ্য লেখকরা, যেমন জিগ্মোন্ড মোরিচ (Zsigmond Móricz), ছোট বাক্যে সাহিত্য রচনা করতেন। কিন্তু হাঙ্গেরীয় গদ্য সাহিত্যের ইতিহাসে আমার একমাত্র প্রিয় লেখক- গিউলা ক্রুডি (Gyula Krúdi)। তিনি প্রতিভাবান লেখক, অবশ্য তাঁর রচনা অনুবাদ করা ছিল প্রায় অসম্ভব।
এ. থ্রি.: আর গিউলা ক্রুডি’র বাক্যরচনার শৈলী কেমন ছিলো?
লা. ক্রা.:তিনি অন্য যে কোনো গদ্য লেখকের থেকে ভিন্ন বাক্যশৈলী ব্যবহার করতেন। তাঁর গদ্য সবসময় ম্রিয়মাণ মাতাল মানুষের মতো শোনাত, যেন খুব বিষণ্ণ, জীবনের প্রতি কোনো প্রকারের মোহ নেই, খুব শক্তিশালী কিন্তু যাঁর শক্তি একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু ক্রুডি আমার সাহিত্যিক আদর্শ ছিলেন না। ক্রুডি আমার কাছে একজন কিংবদন্তি, তিনি আমাকে উপন্যাস লেখার সিদ্ধান্ত নিতে শক্তি জুগিয়েছিলেন। ইয়ানোস পিলিনস্কি আমার আরেক কিংবদন্তি। সাহিত্যের বিবেচনায়, পিলিনস্কি তাঁর ভাষা, তাঁর কথা বলার শিল্পিত শৈলীর কারণে আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন।
এ. থ্রি.: সে সময়ে অনুবাদ সাহিত্য কি সহজলভ্য ছিল?
লা. ক্রা.:সত্তরের দশক এমন একটা সময় ছিল, যখন আমরা প্রচুর পশ্চিমা সাহিত্যের অনুবাদ পেতাম। উইলিয়াম ফকনার, ফ্রাঞ্জ কাফকা, রিলকে, আর্থার মিলার, জোসেফ হেলর, মার্সেল প্রুস্ত, স্যামুয়েল বেকেট- প্রায় প্রতি সপ্তাহে একটা নতুন মাস্টারওয়ার্ক প্রকাশিত হতো। কারণ, কমিউনিস্ট শাসনের অধীনে শিল্পী-সাহিত্যিকরা নিজেদের কাজ প্রকাশ করতে পারতেন না, তাই শ্রেষ্ঠ লেখক ও কবিরা অনুবাদক হয়ে উঠেছিলেন। সেই কারণেই আমাদের শেক্সপিয়ার, দান্তে, হোমার এবং ফকনার থেকে শুরু করে প্রতিটি মহান আমেরিকান লেখকদের চমৎকার অনুবাদ সহজলভ্য ছিল।
এ. থ্রি.: আর দস্তয়েভস্কি?
লা. ক্রা.: হ্যাঁ। দস্তয়েভস্কি আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন- তাঁর শৈলী বা কাহিনি বিন্যাসের জন্য নয়, বরং তাঁর চরিত্রগুলোর কারণে। দস্তয়েভস্কির ‘শ্বেত রজনী’র (White Nights) সেই কাহিনি বর্ণনাকারীর কথা ভাবুন, উপন্যাসটির প্রধান চরিত্রটি কিছুটা (আমার উপন্যাস) ‘দি ইডিয়ট’ (The Idiot)-এর মাইশকিনের মতো, একজন প্রাক-মাইশকিন চরিত্র। আমি এই বর্ণনাকারীর এবং মাইশকিনের জীবনের অসহায়ত্বের একজন অন্ধ ভক্ত ছিলাম, এক প্রতিরক্ষাহীন, দেবদূত-সুলভ চরিত্র। আমার উপন্যাসগুলোতে আপনি দস্তয়েভস্কির উপন্যাসের সমতুল্য চরিত্রদের খুঁজে পাবেন- যেমন ‘স্যাটানটাঙ্গো’-র এস্টিকি (Estike) বা ‘মেলানকোলি’র ভ্যালুস্কা (Valuska), যারা জাগতিক অসঙ্গতির পরম্পরায় ক্ষতবিক্ষত, এইসব ভাগ?্যবিড়ম্বনার আঘাতগুলো ওদের প্রাপ্য ছিল না। আমি আমার সৃষ্ট ঐসব চরিত্রদের অন্তর দিয়ে ভালোবাসি, কারণ ওরা এমন এক বিশ্বআত্মমানবিকতায় বিশ্বাসী- যেখানে মানুষের অস্তিত্ব স্বর্গীয় এবং মহৎ, আমি তাদের বিশ্বআত্মমানবিকতায় বিশ্বাসী হবার সত্যকে সম্মান করি। কিন্তু মহাবিশ্ব, জগৎ সম্পর্কে তাদের চিন্তাভাবনা, এই সরল বিশ্বাস, আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার মতে, আমরা বিশ্বমানবিকতা নয়, বরং বন?্যপ্রাণিজগতের অন্তর্ভুক্ত। আমরা একটি অত্যন্ত জটিল নৃতাত্ত্বিক (anthropomorphic) জগতে বাস করি- আমরা বিশ্বাস করি আমরা একটি মানব জগতে বাস করি যেখানে প্রাণি, উদ্ভিদ, পাথরের জন্য নির্ধারিত স্থান রয়েছে, কিন্তু আমার বাস্তবিক বিবেচনায় এটা সত্য নয়।
এ. থ্রি.: তাহলে আপনি বলতে চাইছেন, খাঁটি বস্তুবাদ (materialism) আপনার নিজস্ব দর্শন?
লা. ক্রা.: না, না, মাইশকিনও বাস্তব।
এ. থ্রি.: আরেকটু বিস্তারিত বুঝিয়ে বলুন প্লিজ!
লা. ক্রা.: ফ্রাঞ্জ কাফকাকেই ধরুন, তিনি ফ্রাঞ্জ কাফকা, তাঁর জীবনকাহিনী, তাঁর সাহিত?্যকর্মের কারণে। কিন্তু কে. (ক.) মহাবিশ্বের একটি স্বর্গীয় স্থানে আছেন, এবং সম্ভবত আমার উপন্যাসের কিছু চরিত্রও সেখানে বাস করে। উদাহরণস্বরূপ, ‘স্যাটানটাঙ্গো’-র ইরিমিয়াজ (Irimiás) এবং ডাক্তার অথবা ‘মেলানকোলি’র মিস্টার এস্টার (Mr. Eszter) এবং ভ্যালুস্কা বা আমার নতুন উপন্যাসের ব্যারন (Baron)। তারা চূড়ান্তভাবেই বেঁচে আছেন, তারা তাদের চিরন্তনী অবস্থানে বিদ্যমান! এখন আপনি বিতর্ক করতেই পারেন যে- মাইশকিন কি কেবলই কাল্পনিক? আমি বলব- অবশ্যই কাল্পনিক, কিন্তু এটা সত্য নয়। মাইশকিন হয়তো অন্য কারো মাধ্যমে, দস্তয়েভস্কির মাধ্যমে বাস্তবে প্রবেশ করেছেন, এবং এখন, আমাদের জন্য, তিনি একজন বাস্তব ব্যক্তিত্ব। তথাকথিত চিরন্তনী কল্পনার প্রতিটি চরিত্র কোনো সাধারণ মানুষের মাধ্যমেই এসেছেন। এটা একটা গোপন প্রক্রিয়া, কিন্তু আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে- এটা সত্যি।
এ. থ্রি.: আপনি কীভাবে আপনার বিশাল, বিস্তৃত বাক্যবিন্যাসের স্বতন্ত্র শৈলী সৃষ্টি করেছেন?
লা. ক্রা.: শৈলী সৃষ্টি আমার জন্য কখনোই কঠিন কাজ ছিল না। আমার একাকী জীবনযাপনে আমার কেবল একজন বন্ধু ছিল এবং প্রতিটি বন্ধুর সাথে আমরা একক সংলাপে কথা বলতাম। যদি একদিন আমি কথা বলতাম, পরের দিন সে কথা বলত। কিন্তু কথোপকথন প্রতিবারই ভিন্ন প্রসঙ্গে হতো কারণ আমরা একে অন্যরে কাছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলতে চাইতাম, এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলার জন্য পূর্ণচ্ছেদ বা দাড়ি-কমার প্রয়োজন হতো না, প্রয়োজন হতো শ্বাস এবং ছন্দের- ছন্দ, গতি ও সুরের। বাক্যবিন?্যাসের স্বতন্ত্র শৈলী সৃষ্টির ক্ষেত্রে আমার তেমন কোনো সচেতন প্রচেষ্টার প্রয়োজন ছিল না। এই ধরনের ছন্দ, সুর এবং বাক্য গঠন বরং অন্য ব্যক্তিকে বোঝানোর ইচ্ছা থেকে সৃষ্টি হতো।
এ. থ্রি.: এই শৈল সৃষ্টির প্রয়াসে মিশেল প্রস্ত কিম্বা ব্রেকেটের শৈলীর সাথে কখনো সম্পর্কিত ছিল?
লা. ক্রা.:আমার কিশোর বয়সে- তাদের ভাষার অনুকরণ নয়, তাদের শৈলীর অনুকরণ নয়, বরং তাদের জীবন অনুকরণে সচেষ্ট ছিলাম। কাফকার সাথে আমার এক ধরনের নস্টালজিক সম্পর্ক ছিল, কারণ আমি তাঁকে কিশোর বয়সে পড়া শুরু করেছিলাম। কাফকা ছিলেন আমার প্রথম আবিষ্কৃত লেখক, শিল্প¯্রষ্টা, -তখন তাঁকে, তাঁর শিল্পকর্মকে তেমন একটা বুঝতে পারতাম না, কিন্তু একজন ব্যক্তি হিসাবে কাফকাকে নিয়ে অপার বিস্ময় অনুভব করতাম। যখন আমার বয়স বারো বা তেরো ছিল, তখন আমার প্রিয় বইগুলোর মধ্যে একটি ছিল গুস্তাভ ইয়ানৌচের ‘কনভারসেশনস উইথ কাফকা’ (Conversations with Kafka), বইটি আমি আমার বড়ভাইয়ের সংগ্রহ থেকে পেয়েছিলাম। এই বইটির মাধ্যমে কাফকার সাথে আমার পারস্পরিক আত্মিক সম্পর্কের জন্ম হয়েছিল। আর হয়তো সেই কারণেই আমি আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছিলাম- কাফকার মতো হবো বলে। আমার বাবা কিছুটা অবাক হয়েছিলেন, কারণ আমার ‘আইন’ ছাড়াসাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকর্ম, দর্শন, সব কিছুতেই আগ্রহ ছিল। অবশ্য তিন সপ্তাহ পর সেখানকার পরিবেশ আমার অসহ্য হতে শুরু করে, তাই শুধু আইন অনুষদ নয়, সে শহরটিও আমি স্বজ্ঞানে পরিত?্যাগ করি। এরপর কিছুদিন বুদাপেস্টে ধর্ম এবং ফিলোসফি অধ্যয়ন শুরু করি, সেইসাথে আমার পুরোনো গ্রিক এবং ল্যাটিন অধ্যয়ন চালিয়ে যাই, কিন্তু পরীক্ষাগুলো কঠিন ছিল- কারণ আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতাম না। অবশেষে, চার বছর পর, আমার সন্তানের জন্ম হলো, আর সন্তান হলে, আইনত সামরিক পরিষেবার ভয়ানক বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত থাকা যেত।
আমার জন্য সামরিক পরিষেবা ছিল প্রায় মৃত্যুসমতুল্য। সামরিক পরিষেবাকালে আমাকে একটি বন্দুক নিয়ে প্রহরী পোস্টে পাহারায় থাকতে হতো, আর উর্ধতন অফিসার পর্যবেক্ষণে এসে কাফকা পড়া অবস্থায় ধরা পড়লে শাস্তি হিসাবে ক্যাম্পের কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হলো। তাতে আমি খুব একটা হতাশ হইনি, কারণ কাফকা আমার কাছে একজন নির্বোধ সামরিক অফিসারের চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় ছিলেন। আমি নিশ্চিত যে, ফ্রাঞ্জ কাফকা এমন একটি সা¤্রাজ্যের অপরিমেয় বাস্তবতা- যা আমি কেবল দূর থেকে বিস্মিত অনুভব করতে পারি। সেই একই রকমের আনন্দ আমি অনুভব করি দান্তে এবং গ্যোয়েটে এবং বেকেট এবং হোমারের মতো ব্যক্তিত্বদের ক্ষেত্রে, যারা এমন এক সা¤্রাজ্যের অনন?্য অধিশ্বর এবং আমাদের জন্য তাঁদের স্বর্গীয় সহমর্মিতা বিদ্যমান। আমি নিশ্চিত যে, এইসকল পবিত্র ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের শৈল্পিক চিন্তাভাবনার কিছু সামঞ্জস্য রয়েছে। কাফকা সম্পর্কে আমার চিন্তাভাবনা- আপনার কাফকা চিন্তাভাবনার থেকে খুব বেশি আলাদা হবে না।
এ. থ্রি.: আমি আপনাকে নিয়ে একটি কালানুক্রমিক ধারা সাজানোর চেষ্টা করছি। আপনি গিউলাতে (Gyula) জন্মেছেন, তারপর আপনার সামরিক পরিষেবা, সেগেদে আপনার পড়াশোনা, অতঃপর ভবঘুরে বছরগুলো এবং ‘স্যাটানটাঙ্গো’-র প্রকাশনা। আপনি ১৯৮৭ সালে বার্লিনে এসেছিলেন এবং ১৯৮৯ সালে হাঙ্গেরিতে ফিরে গিয়েছিলেন।
লা. ক্রা.: হ?্যাঁ, এরপর জার্মানিতে নিয়মিত যাওয়া-আসার মধ্যেই ছিলাম। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে আমি ‘যুদ্ধ ও যুদ্ধ’ (War and War) লেখার প্রস্তুতি শুরু করি। মূলত, আমি জানতে চেয়েছিলাম রোমান সা¤্রাজ্যের সীমান্ত বলতে কি বোঝানো হতো? আমি ডেনমার্ক, গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, ক্রিট ঘুরে এসেছি- সেখানে সামরিক প্রতিরক্ষার ধ্বংসাবশেষ, চিহ্ন খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি। ‘যুদ্ধ ও যুদ্ধ’ লেখার রসদ যোগাতে আমি সেসময় ঘোরাঘুরির মধ্যেই থাকতাম। আমার মনে হয়, ১৯৯৬ সালে যখন আমি নিউ ইয়র্কে অ্যালেন গিন্সবার্গের ফ্ল্যাটে দিন কাটাচ্ছিলাম, তখন ‘যুদ্ধ ও যুদ্ধ’ লেখা শুরু করি।
এ. থ্রি.: গিন্সবার্গের সাথে আপনার দেখা হলো কীভাবে?
লা. ক্রা.:আমাদের একজন অভিন্ন বন্ধুর মাধ?্যমে। আর অ্যালেন খুব বন্ধুত্বপরায়ণ মানুষ ছিলেন। তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে লোকজন আসত এবং যেত, দরজার তালাচাবি ছিলো একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। সেখানে থাকার অভিজ্ঞতা ছিল অসাধারণ, তবে গিন্সবার্গের বৃত্তের অংশ হওয়া ছিল খুব বিরক্তিকর। দিনের বেলায় আমি লেখালেখির কাজ করতে পারতাম, এবং রাতে, যখন অ্যালেন সত্যিই প্রাণবন্ত হয়ে উঠতেন, তখন আমি পার্টি, কথোপকথন এবং সঙ্গীত যোগানের কাজে অংশ নিতাম। অ্যালেনের পাশে রান্নাঘরে বসে বসে তাঁর বাড়িতে আসা সঙ্গীতজ্ঞ, কবি, চিত্রশিল্পী- অমর সব ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে ধন্য এবং বিস্মিত হতাম।
এ. থ্রি.: আমার মনে আছে, আপনি একবার সময়ের অসীমত্বের (timelessness) অনুভূতি নিয়ে আপনার আভিজ্ঞতার বর্ণনা করেছিলেন, বলেছিলেন আপনি সবসময় সেই অভিজ্ঞতা অনুভব করেন। আপনি সময়ের অসীমত্বকে সোভিয়েত সা¤্রাজ্যের তাত্ত্বিকতার সাথে সম্পর্কিত করেছিলেন, বলেছিলেন তারা ইতিহাসকে অদৃষ্ট দূরত্বে সরিয়ে দিয়েছিল।
লা. ক্রা.: তখন একটা কালহীন সমাজের অস্তিত্ব ছিল, সোভিয়েত তাত্ত্বিকেরা এটাই প্রমাণ করে দেখাতে চেয়েছিল যে, কমিউনিস্ট তত্ত্ব বা মার্কসবাদ অবনিশ্বর, এর কখনোই পরিবর্তন হবে না। সর্বদা একই ধূসর আকাশ এবং বর্ণহীন গাছপালা, পার্ক এবং রাস্তা, দালান এবং শহর এবং মফস্বল, বারের ভয়ানক পানীয় এবং দারিদ্র্য এবং যে জিনিসগুলো আপনাকে জোরে বলতে নিষেধ করা হয়েছিল, সেসব বুকে করে আপনি অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন। এটা খুবই হতাশাজনক। আমার প্রজন্মই প্রথম, যারা কেবল কমিউনিস্ট তত্ত্ব বা মার্কসবাদে অবিশ্বাস করতো, শুধু তাই নয়, বরং এটিকে মূর্খতা, বিব্রতকর বাস্তবতা বলে মনে করত। যখন আমরা এই রাজনৈতিক ব্যবস্থার শেষ দেখতে পেলাম, আমাদের জন্য তা ছিল এক অপার বিস্ময়। রাজনৈতিক স্বাধীনতার স্বাদ কখনোই ভুলব না আমি। এখন আমার জার্মান নাগরিকত্ব আছে, কারণ আমার কাছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন মানে, সবার উপরে, সেই আক্রমণাত্মক মূর্খতার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক স্বাধীনতা।
আমি একটি বুর্জোয়া জগৎ থেকে এসেছি, যেখানে কমিউনিস্ট তত্ত্ব কখনোই কোনো প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করেনি। আমরা ছিলাম সামাজিক গণতন্ত্রী, আমার বাবা ছিলেন আইনজীবী, এবং দরিদ্র মানুষকে সাহায্য করতেন। সেটাই আমার জীবনের বাস্তবতা- সপ্তাহে দুই বা তিন সন্ধ্যা দরিদ্র মানুষেরা আমাদের কাছে আসত, আমার বাবা বিনা পারিশ্রমিকে তাদের সাহায্য করতেন। এবং পরের দিন, খুব ভোরে, তারা এসে আমাদের দরজার বাইরে কিছু রেখে যেত- দুটো মুরগি, অথবা কিছু সবজি।
এ. থ্রি.: আসুন, আপনার সাহিত?্যচর্চা নিয়ে আরও বিশদ আলোচনা বলা যাক। একটি বিষয় আমাকে খুব কৌতূহলী করে তোলে- তা হলো, আপনি খুব স্পষ্টতই বলতে ভালোবাসেন যে- আপনার সাহিত?্যচর্চার বিশাল পরিসরে আপনি মাত্র চারটি উপন্যাস লিখেছেন!
লা. ক্রা.: সত্যি, এবং সেগুলো হলো- ‘স্যাটানটাঙ্গো’ (Satantango), ‘প্রতিরোধের বিষাদ’ (The Melancholy of Resistance), ‘যুদ্ধ ও যুদ্ধ’ (War and War), ‘ব্যারন ভেঙ্কেইম-এর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ (Baron WenckheimÕs Homecoming)।
এ. থ্রি.: আপনি ‘অ্যানিমালইনসাইড’ (Animalinside)-এর মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাসকে কোথায় স্থান দেবেন?
লা. ক্রা.:আমার বিবেচনায় ‘অ্যানিমালইনসাইড’ সার্বিক অর্থে একটি উপন্যাস নয়। কিন্তু কোনো উপন্যাস কিংবা ছোটগল্প- তা পৃষ্ঠার সংখ্যার ওপর নির্ভর করে না। আমি আমার কর্মজীবনের শুরুতে কিছু গল্প লিখেছিলাম যেগুলো পরে ‘রিলেশনস অফ গ্রেস’ (Relations of Grace, 1986) গল্পগ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। এই গল্পগুলো ছোট পরিসরে এবং খুব সীমিত সময়ে কাজ করে, যার কেন্দ্রে থাকে একেকটি একক চরিত্র। কিন্তু একটি উপন্যাসে হলো- শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি সেতুর মতো, একটি খিলানের মতো, তাতে বিশাল নির্মাণ থাকে। একটি গল্পের ক্ষেত্রে খিলানের প্রয়োজন হয় না। পরিবর্তে, গল্প হলো একটি ‘ব্ল্যাক বক্স’, একটি যাদুর বাক্স, যার মধ্যে কী ঘটেছে তা কেউ জানে না।
এ. থ্রি.: তাহলে নতুন উপন্যাস, ‘ব্যারন ভেঙ্কেইম-এর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ (Baron WenckheimÕs Homecoming), কী নিয়ে? এটি কি ওডিসি (odysse)-এর মতো কোনো কিছু?
লা. ক্রা.: হ্যাঁ। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ‘ব্যারন ভেঙ্কেইম’-এর জন্য, তার জীবনের শেষে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। তিনি বুয়েনোস আইরেসে বসবাসকাি অতি বৃদ্ধ একজন মানুষ। তিনি গিউলা ক্রুডির মতো একজন সংবেদনশীল, খুব লম্বা মানুষ, কিন্তু খুব দুর্ভাগ্যবান- তাঁর জীবনটা কেবলিই ভুলে ভরা।
এ. থ্রি.: তাহলে তিনি আপনার মাইশকিন, মানে আপনার সৃষ্ট প্রতিরক্ষাহীন কোন চরিত্র?
লা. ক্রা.: হ্যাঁ, এরা এস্টিকির মতো। এই উপন্যাসটি আসলে আমার সমস্ত উপন্যাসের সারসংক্ষেপ- আপনি অন্য চরিত্র, অন্যান্য গল্পের সাথে প্রচুর মিল এখানে খুঁজে পেতে পারেন। আমি মনে করি এটি আমার সেরা উপন্যাস।
এ. থ্রি.: আপনার সেরা?
লা. ক্রা.: এটা আমার সচরাচর অন?্যান?্য উপন্যাসের বিষয়বস্তু থেক একটু আলাদা, আমার পছন্দের একটি চিত্তাকার্ষক উপন্যাস। এটা কোনো মহাপ্রলয়ের বার্তায় ভরা নয়, বরং মহাপ্রলয় ইতিমধ্যেই ঘটে গেছে।
এ. থ্রি.: কিন্তু আমার মনে হয়, আপনার সমস্ত বইতেই, মহাপ্রলয় (Apocalypse) গোপনে এসে পড়ে। আমার মনে হয় ঔপন্যাসিকদের দুই রকম প্রকারভেদ আছে: যারা প্রতিটি উপন্যাসকে একটি পৃথক উপাখ্যান হিসাবে বিবেচনা করেন, এবং অন?্যদল মনে করেন যে, তারা একটি উপন্যাস লিখেছেন, যা তাদের লিখিত সমস্ত উপন্যাসের নির্যাস একসাথে ধারণ করে।
লা. ক্রা.:আমি অনেক-অনেকবার বলেছি যে, আমি সবসময় কেবল একটি উপন্যাস লিখতে চেয়েছিলাম। আমি প্রথমটিতে সন্তুষ্ট ছিলাম না, এবং সেই কারণেই আমি দ্বিতীয়টি লিখেছিলাম। আমি দ্বিতীয়টিতেও সন্তুষ্ট হতে পারলাম না, তাই আমি তৃতীয়টি লিখেছিলাম ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন, ‘ব্যারন ভেঙ্কেইম-এর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ (Baron WenckheimÕs Homecoming) দিয়ে আমার উপন্যাস লেখার গল্পটি শেষ করতে পারি। এই উপন্যাসটি দিয়ে আমি প্রমাণ করতে পারি যে, আমি সত্যিই আমার জীবনে মাত্র একটি বই লিখেছি। এটাই সেই বই- ‘স্যাটানটাঙ্গো’, ‘মেলানকোলি’, ‘যুদ্ধ ও যুদ্ধ’, এবং ‘ব্যারন’- এগুলো মিলিয়েই আমার প্রত?্যাশিত সেই সম্পূর্ণ একটি উপন্যাস।
এ. থ্রি.: আপনি কি আপনার লেখা সংশোধন করেন না?
লা. ক্রা.: যখন আমি লিখি, তখন লেখার বিষয়বস্তু আমার মাথায় তৈরি থাকে। ছোটবেলা থেকেই আমি এভাবে কাজ করতে অভ?্যস্ত। আমার শৈশবে, আমার স্মৃতিশক্তি অস্বাভাবিক প্রখর ছিল, আমার ফটোগ্রাফিক মেমোরি ছিল। আমার মাথায় গল্প-উপন?্যাসের প্রয়োজনীয় রসদ সংরক্ষিত থাকতো, সঠিক রূপ, উপযুক্ত বাক্য তাৎক্ষণিক খুঁজে পেতাম, মাথার মধে?্য সবকিছু প্রস্তুত করে লিখে ফেলতাম। আমি ভাগ?্যবান, আমি প্রতিটি মুহূর্তেই কাজ করি। আমার মস্তিষ্ক একটি স্বংয়ক্রিয় যন্ত্রের মতো নিরবচ্ছিন্ন কাজ করে চলে। শুধুমাত্র অসুস্থ থাকলে অথবা যখন আমি মাতাল থাকতাম তখন আমার মস্তিষ্ক ঠিকমতো কাজ করতো না। এই ব্যতিক্রমগুলো ছাড়া, আমি সারাক্ষণই কাজ করি। একটি মাথার ভিতরের একটি বাক্য নিয়ে কাজ শুরু করি, সেই বাক?্যটি ঘিরে মাকড়সার খুব সূক্ষ্ম সুতোর জালের মতো প্রাসঙ্গিক শব্দ কিংবা সূত্র উঁকি দিতে শুরু করে, আমি শুধু সেগুলোর মধ্যে একটি উপযুক্ত, গুরুত্বপূর্ণ, প্রয়োজনিয় জিনিসগুলো সংগ্রহ করে নিই। সে কারণেই আমার বইগুলোর চমৎকার অনুবাদ রয়েছে, আমি চাই আপনি সেগুলো মূল ভাষায় পড়–ন, কারণ যখন আমি কাজ করি, তখন আমি প্রথম যে কাজটি করি তা হলো- ছন্দোময় উপাদানটি ৪
খুঁত করা তৈরি করা। যখন আমি কাজ করি, তখন আমি একই প্রক্রিয়া ব্যবহার করি যা সঙ্গীত এবং সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে বহুল প্রয়োগকৃত এবং প্রমাণিত। সঙ্গীত, সাহিত্য এবং ভিজ্যুয়াল শিল্পের একটি সাধারণ ভিত্তি রয়েছে- ছন্দ এবং গতির কাঠামো- এবং আমি সেই সঙ্গীত মাধ?্যম নিয়েই কাজ করি। সঙ্গীত এবং উপন্যাসের ক্ষেত্রে বিষয়বস্তু একেবারে আলাদা, কিন্তু আমার কাছে সারবস্তুটি সঙ্গীতেরই সমার্থক।
এ. থ্রি.: আপনার উপন্যাসগুলো সম্পর্কে খুব একান্তে কি কিছু বলবেন?
লা. ক্রা.: না, লেখালেখিতে আমি কখনোই আপস করি না। সেজন?্যই আমার উপন্যাসগুলোর মধ্যবর্তী স্তর বলে কিছু নেই। লেখালেখি- আমার কাছে একটি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত শিল্পিত পরিশ্রম। আমি আমার সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে সংকোচ বোধ করি- যেন আপনি আমার সবচেয়ে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিয়ে অযাচিত ঔৎসুক?্য বোধ করছেন। আমি কখনোই আমার সাহিত্যিক জীবনের অংশ ছিলাম না, কারণ আমি সামাজিক অর্থে একজন লেখক হওয়াকে কখনো মেনে নিতে পারিনি। আমার সাথে আপনি এবং আরও কয়েকজন ছাড়া- সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে উৎসাহ বোধ করি না। সবশেষে, আমার সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। সাহিত্য আমার কাছে একান্তই ব্যক্তিগত একটি বিষয়। (সংক্ষেপিত)
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের সাক্ষাৎকার
বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫
‘দ্য প্যারিস রিভিউ’। ২০১৮ সালের ২২৫তম গ্রীষ্মকালীন সংখ্যা। সদ্য নোবেলবিজয়ী লেখক লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করে। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন প্রখ্যাত শিল্পসমালোচক এডাম থ্রিলওয়েল। এটি ‘সংবাদ সাময়িকী’র পাঠকদের জন্য বাংলায় অনুবাদ করেছেন অশোক কর
এডাম থ্রিলওয়েল : আসুন, আপনার লেখক হয়ে ওঠার প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা শুরু করা যাক।
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই: সত্যি বলতে কী, আমার ধারণা ছিল- বাস্তবিক জীবন, একটা সত্যিকারের জীবনের অবস্থান রয়েছে অন?্য কোনোখানে, শিল্প-উপন্যাসে নয়। ফ্রাঞ্জ কাফকার ‘দ্য ক্যাসেল’ (The Castle)-এর পাশাপাশি- ম্যালকম লোরির ‘আন্ডার দ্য ভলক্যানো’ (Under the Volcano) ছিল আমার সেই সময়ের শিল্পতাত্মিক বাইবেল। এটা ষাটের দশকের শেষ আর সত্তরের দশকের প্রথম দিকের কথা। আমার ইচ্ছে ছিল সঙ্গীত নিয়ে কাজ করার, আমি আসলে লেখকের ভূমিকা নিতে চাইনি, মাত্র একটা উপন্যাস লিখব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তারপর ফিরে যাব আমার পেশা আর দৈনন্দিন জীবনযাপনে। আমি আমার পাশের দরিদ্র মানুষদের সাথেই থাকতে চেয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম সেটাই আমার আসল জীবন। আমি খুব দরিদ্র গ্রামে থাকতাম, জীবনধারণের জন্য শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করতাম। বাধ্যতামূলক (কমিউনিস্ট) সামরিক পরিষেবা এড়াতে প্রতি তিন/চার মাস অন্তর অবস্থান পরিবর্তন করতাম। তারপর, যেই থেকে আমি যৎসামান্য লেখা প্রকাশ করতে শুরু করলাম, অমনি পুলিশের কাছে জবাবদিহি দিতে বাধ্য হলাম। আমি তাদেরকে সবসময় বলতাম- “আমি রাজনীতি করি না, সমসাময়িক রাজনীতি নিয়েও লেখালেখি করি না।” গোয়েন্দা পুলিশেরা আমাকে বিশ্বাস করতো না, তাদের ধারণা ছিল লাসলো ক্রাসনাহোরকাই (László Krasznahorkai) একজন ঘোর কমিউনিস্ট-বিরোধী। তারা আমার পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করল, ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত আমার কোনো পাসপোর্ট ছিল না। আমি কিন্তু কখনোই কোনো রাজনৈতিক বিক্ষোভে যোগ দিইনি, রাজনীতিতে সক্রিয় অংশ নিইনি। আমি কেবলমাত্র অজ পাড়াগ্রামে কিম্বা পাতি-মফস্বল শহরে থাকতাম, আর আমার প্রথম উপন্যাস লেখার চেষ্টা করতাম।আমার লেখক জীবনের গল্পের শুরু এভাবেই- এবং খুব সহজেই তা শেষ গল্পও হতে পারত।
এ. থ্রি.: এ রকম পরিস্থিতিতে আপনার প্রথম উপন্যাসটি কখন, কীভাবে প্রকাশিত হলো?
লা. ক্রা.: উপন্যাসটি প্রকাশিত হলো ১৯৮৫ সাল। কেউই- আমি নিজেও- হৃদয়ঙ্গম করতে পারছিলাম না ‘স্যাটানটাঙ্গো’ (Satantango) উপন্যাসটি কীভাবে প্রকাশ করা সম্ভব হলো, কারণ কমিউনিস্ট ব্যবস্থার নিরিখে ‘স্যাটানটাঙ্গো’ একটি বিপদসঙ্কুল বিতর্কিত উপন্যাস ছিল। সেই সময়, সমসাময়িক সাহিত্য প্রকাশনা সংস্থাটির পরিচালক ছিলেন একজন প্রাক্তন গোপন-পুলিশ প্রধান, তিনি হয়তো প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে- তাঁর এখনও যথেষ্ট ক্ষমতা আছে- “স্যাটানটাঙ্গো” উপন্যাসটি প্রকাশ করার মতো সাহস দেখানোর ক্ষমতা। আমি অনুমান করি উপন্যসাটি প্রকাশিত হওয়ার সেটিই একমাত্র কারণ।
এ. থ্রি.: জীবন ধারণের জন্য আপনি তখন কোন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন?
লা. ক্রা.:আমি কিছুদিন খনি শ্রমিকের কাজ করেছিলাম। তারপর আমি বুদাপেস্ট থেকে অনেক দূরের কয়েকটি গ্রামের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক হয়েছিলাম। প্রতিটি গ্রামেই একটা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র থাকত, আর গ্রামবাসীদের দৈনন্দিন জীবনে এই লাইব্রেরিই ছিল তাদের সবকিছু। শুক্র বা শনিবারগুলোতে, সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক সঙ্গীতানুষ্ঠান বা এর মতো কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন, তরুণদের জন্য যা ছিল উৎসাহব্যঞ্জক। আমি মোট ছয়টি গ্রামের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক ছিলাম, সে কারণে তরুণ প্রজন্মের যুবকদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ থাকতো। আমি এই কাজ খুবই পছন্দ করতাম, কারণ আমি বুর্জোয়াদের থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করতাম। আর কী? এছাড়া আমি একটি জনমানবহীন (নো ম্যান’স ল্যান্ড) এলাকায় তিনশো গরুর রাতের রাখাল (নাইট ওয়ামচম্যান) হিসাবে কাজ করতাম। ওটা ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের একটা গোয়ালঘর। আশেপাশে আর কোনো গ্রাম বা শহর ছিল না। আমি কয়েক মাস এখানে রাতের রাখাল ছিলাম, এক পকেটে ‘আন্ডার দ্য ভলক্যানো’ আর অন্য পকেটে দস্তয়েভস্কি নিয়ে ছিল আমার সুখের দরিদ্র জীবন। আমার প্রথম উপন?্যাস “স্যাটানটাঙ্গো” রচনার অনুষঙ্গ এখান থেকেই সংগৃহীত।
এই ‘ভবঘুরে’ বছরগুলোতে আমি মদ?্যপান শুরু করি। হাঙ্গেরীয় সাহিত্যে একটি ঐতিহ্য ছিল যে, সত্যিকারের প্রতিভাধর ব্যক্তিরা ছিলেন চরম মাতাল। আমিও পুরোপুরি একজন উন্মাদ মাতাল হয়ে উঠলাম। সে সময়ে, সমসাময়িক গদ্য লেখকদের মধ্যে, একজন জীবন্ত কিংবদন্তি এবং ম্যালকম লোরির মতো চরম ও গভীর মদ্যপ- পিটার হাইনোচি (Péter Hajnóczy), মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যু হাঙ্গেরীয় সাহিত্যের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা। এমনি কোনো এক দিনে, একদল হাঙ্গেরীয় লেখকের সাথে সুরাপানকালে দুঃখের সাথে সবাই যখন একমত হচ্ছিল যে, প্রত্যক হাঙ্গেরীয় প্রতিভাই একজন উন্মাদ মাতাল- এটাই নিয়তির অনিবার্য পরিণতি-, আমি তা অস্বীকার করে ওদের সাথে বারো বোতল শ্যাম্পেনের বাজি ধরলাম যে- আমি আর কখনোই মদ্যপান করব না। এবং আমি আর মদ্যপান করিনি, মাতাল হইনি। এই ছিল আমার বেশ রোমাঞ্চকর জীবন। এ সময়ে কাজের কারণে প্রতিদিনই শহর থেকে শহরে ছুটতে হতো, সেই সুবাদে রাতে রেলস্টেশন আর বারে রাত্রিযাপন, জনতার সাথে সামাজিক যোগাযোগ, সংক্ষিপ্ত কথোপকথন, মানুষকে পর্যবেক্ষণ, এসব থেকেই ধীরে ধীরে, আমার মাথায় প্রথম উপন্যাস লেখারচিন্তা এলো। এভাবে কাজ করাটা তেমন কোন ভালো পদক্ষেপ ছিল না, কারণ আমার একটা দৃঢ় অনুভূতি ছিল যে- সাহিত্য একটি আধ্যাত্মিক ক্ষেত্র- সমসাময়িক বিশ্বসাহিত্যে তখন হাইনোচি, ইয়ানোস পিলিনস্কি (János Pilinszky), সান্দর ভেওরেস (Sándor Weöres), এবং আরও প্রতিভাবান কবি কবিতা লিখছেন, তাঁদের কবিতা খুবই ভাল লাগতো, এবং তাঁদেরকে ভালোবাসতাম, কারণ কবিতা সর্বদাই আকর্ষণীয়, আর গোপনীয়। কিন্তু গদ্যকে বাস্তবতার বেশ কাছাকাছি মনে হতো। ধারণা হতো- গদ্যপ্রতিভারা বাস্তব জীবনের খুব কাছাকাছি বাস করেন। এই কারণেই, ঐতিহ্যগতভাবে, হাঙ্গেরীয় গদ্য লেখকরা, যেমন জিগ্মোন্ড মোরিচ (Zsigmond Móricz), ছোট বাক্যে সাহিত্য রচনা করতেন। কিন্তু হাঙ্গেরীয় গদ্য সাহিত্যের ইতিহাসে আমার একমাত্র প্রিয় লেখক- গিউলা ক্রুডি (Gyula Krúdi)। তিনি প্রতিভাবান লেখক, অবশ্য তাঁর রচনা অনুবাদ করা ছিল প্রায় অসম্ভব।
এ. থ্রি.: আর গিউলা ক্রুডি’র বাক্যরচনার শৈলী কেমন ছিলো?
লা. ক্রা.:তিনি অন্য যে কোনো গদ্য লেখকের থেকে ভিন্ন বাক্যশৈলী ব্যবহার করতেন। তাঁর গদ্য সবসময় ম্রিয়মাণ মাতাল মানুষের মতো শোনাত, যেন খুব বিষণ্ণ, জীবনের প্রতি কোনো প্রকারের মোহ নেই, খুব শক্তিশালী কিন্তু যাঁর শক্তি একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু ক্রুডি আমার সাহিত্যিক আদর্শ ছিলেন না। ক্রুডি আমার কাছে একজন কিংবদন্তি, তিনি আমাকে উপন্যাস লেখার সিদ্ধান্ত নিতে শক্তি জুগিয়েছিলেন। ইয়ানোস পিলিনস্কি আমার আরেক কিংবদন্তি। সাহিত্যের বিবেচনায়, পিলিনস্কি তাঁর ভাষা, তাঁর কথা বলার শিল্পিত শৈলীর কারণে আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন।
এ. থ্রি.: সে সময়ে অনুবাদ সাহিত্য কি সহজলভ্য ছিল?
লা. ক্রা.:সত্তরের দশক এমন একটা সময় ছিল, যখন আমরা প্রচুর পশ্চিমা সাহিত্যের অনুবাদ পেতাম। উইলিয়াম ফকনার, ফ্রাঞ্জ কাফকা, রিলকে, আর্থার মিলার, জোসেফ হেলর, মার্সেল প্রুস্ত, স্যামুয়েল বেকেট- প্রায় প্রতি সপ্তাহে একটা নতুন মাস্টারওয়ার্ক প্রকাশিত হতো। কারণ, কমিউনিস্ট শাসনের অধীনে শিল্পী-সাহিত্যিকরা নিজেদের কাজ প্রকাশ করতে পারতেন না, তাই শ্রেষ্ঠ লেখক ও কবিরা অনুবাদক হয়ে উঠেছিলেন। সেই কারণেই আমাদের শেক্সপিয়ার, দান্তে, হোমার এবং ফকনার থেকে শুরু করে প্রতিটি মহান আমেরিকান লেখকদের চমৎকার অনুবাদ সহজলভ্য ছিল।
এ. থ্রি.: আর দস্তয়েভস্কি?
লা. ক্রা.: হ্যাঁ। দস্তয়েভস্কি আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন- তাঁর শৈলী বা কাহিনি বিন্যাসের জন্য নয়, বরং তাঁর চরিত্রগুলোর কারণে। দস্তয়েভস্কির ‘শ্বেত রজনী’র (White Nights) সেই কাহিনি বর্ণনাকারীর কথা ভাবুন, উপন্যাসটির প্রধান চরিত্রটি কিছুটা (আমার উপন্যাস) ‘দি ইডিয়ট’ (The Idiot)-এর মাইশকিনের মতো, একজন প্রাক-মাইশকিন চরিত্র। আমি এই বর্ণনাকারীর এবং মাইশকিনের জীবনের অসহায়ত্বের একজন অন্ধ ভক্ত ছিলাম, এক প্রতিরক্ষাহীন, দেবদূত-সুলভ চরিত্র। আমার উপন্যাসগুলোতে আপনি দস্তয়েভস্কির উপন্যাসের সমতুল্য চরিত্রদের খুঁজে পাবেন- যেমন ‘স্যাটানটাঙ্গো’-র এস্টিকি (Estike) বা ‘মেলানকোলি’র ভ্যালুস্কা (Valuska), যারা জাগতিক অসঙ্গতির পরম্পরায় ক্ষতবিক্ষত, এইসব ভাগ?্যবিড়ম্বনার আঘাতগুলো ওদের প্রাপ্য ছিল না। আমি আমার সৃষ্ট ঐসব চরিত্রদের অন্তর দিয়ে ভালোবাসি, কারণ ওরা এমন এক বিশ্বআত্মমানবিকতায় বিশ্বাসী- যেখানে মানুষের অস্তিত্ব স্বর্গীয় এবং মহৎ, আমি তাদের বিশ্বআত্মমানবিকতায় বিশ্বাসী হবার সত্যকে সম্মান করি। কিন্তু মহাবিশ্ব, জগৎ সম্পর্কে তাদের চিন্তাভাবনা, এই সরল বিশ্বাস, আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার মতে, আমরা বিশ্বমানবিকতা নয়, বরং বন?্যপ্রাণিজগতের অন্তর্ভুক্ত। আমরা একটি অত্যন্ত জটিল নৃতাত্ত্বিক (anthropomorphic) জগতে বাস করি- আমরা বিশ্বাস করি আমরা একটি মানব জগতে বাস করি যেখানে প্রাণি, উদ্ভিদ, পাথরের জন্য নির্ধারিত স্থান রয়েছে, কিন্তু আমার বাস্তবিক বিবেচনায় এটা সত্য নয়।
এ. থ্রি.: তাহলে আপনি বলতে চাইছেন, খাঁটি বস্তুবাদ (materialism) আপনার নিজস্ব দর্শন?
লা. ক্রা.: না, না, মাইশকিনও বাস্তব।
এ. থ্রি.: আরেকটু বিস্তারিত বুঝিয়ে বলুন প্লিজ!
লা. ক্রা.: ফ্রাঞ্জ কাফকাকেই ধরুন, তিনি ফ্রাঞ্জ কাফকা, তাঁর জীবনকাহিনী, তাঁর সাহিত?্যকর্মের কারণে। কিন্তু কে. (ক.) মহাবিশ্বের একটি স্বর্গীয় স্থানে আছেন, এবং সম্ভবত আমার উপন্যাসের কিছু চরিত্রও সেখানে বাস করে। উদাহরণস্বরূপ, ‘স্যাটানটাঙ্গো’-র ইরিমিয়াজ (Irimiás) এবং ডাক্তার অথবা ‘মেলানকোলি’র মিস্টার এস্টার (Mr. Eszter) এবং ভ্যালুস্কা বা আমার নতুন উপন্যাসের ব্যারন (Baron)। তারা চূড়ান্তভাবেই বেঁচে আছেন, তারা তাদের চিরন্তনী অবস্থানে বিদ্যমান! এখন আপনি বিতর্ক করতেই পারেন যে- মাইশকিন কি কেবলই কাল্পনিক? আমি বলব- অবশ্যই কাল্পনিক, কিন্তু এটা সত্য নয়। মাইশকিন হয়তো অন্য কারো মাধ্যমে, দস্তয়েভস্কির মাধ্যমে বাস্তবে প্রবেশ করেছেন, এবং এখন, আমাদের জন্য, তিনি একজন বাস্তব ব্যক্তিত্ব। তথাকথিত চিরন্তনী কল্পনার প্রতিটি চরিত্র কোনো সাধারণ মানুষের মাধ্যমেই এসেছেন। এটা একটা গোপন প্রক্রিয়া, কিন্তু আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে- এটা সত্যি।
এ. থ্রি.: আপনি কীভাবে আপনার বিশাল, বিস্তৃত বাক্যবিন্যাসের স্বতন্ত্র শৈলী সৃষ্টি করেছেন?
লা. ক্রা.: শৈলী সৃষ্টি আমার জন্য কখনোই কঠিন কাজ ছিল না। আমার একাকী জীবনযাপনে আমার কেবল একজন বন্ধু ছিল এবং প্রতিটি বন্ধুর সাথে আমরা একক সংলাপে কথা বলতাম। যদি একদিন আমি কথা বলতাম, পরের দিন সে কথা বলত। কিন্তু কথোপকথন প্রতিবারই ভিন্ন প্রসঙ্গে হতো কারণ আমরা একে অন্যরে কাছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলতে চাইতাম, এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলার জন্য পূর্ণচ্ছেদ বা দাড়ি-কমার প্রয়োজন হতো না, প্রয়োজন হতো শ্বাস এবং ছন্দের- ছন্দ, গতি ও সুরের। বাক্যবিন?্যাসের স্বতন্ত্র শৈলী সৃষ্টির ক্ষেত্রে আমার তেমন কোনো সচেতন প্রচেষ্টার প্রয়োজন ছিল না। এই ধরনের ছন্দ, সুর এবং বাক্য গঠন বরং অন্য ব্যক্তিকে বোঝানোর ইচ্ছা থেকে সৃষ্টি হতো।
এ. থ্রি.: এই শৈল সৃষ্টির প্রয়াসে মিশেল প্রস্ত কিম্বা ব্রেকেটের শৈলীর সাথে কখনো সম্পর্কিত ছিল?
লা. ক্রা.:আমার কিশোর বয়সে- তাদের ভাষার অনুকরণ নয়, তাদের শৈলীর অনুকরণ নয়, বরং তাদের জীবন অনুকরণে সচেষ্ট ছিলাম। কাফকার সাথে আমার এক ধরনের নস্টালজিক সম্পর্ক ছিল, কারণ আমি তাঁকে কিশোর বয়সে পড়া শুরু করেছিলাম। কাফকা ছিলেন আমার প্রথম আবিষ্কৃত লেখক, শিল্প¯্রষ্টা, -তখন তাঁকে, তাঁর শিল্পকর্মকে তেমন একটা বুঝতে পারতাম না, কিন্তু একজন ব্যক্তি হিসাবে কাফকাকে নিয়ে অপার বিস্ময় অনুভব করতাম। যখন আমার বয়স বারো বা তেরো ছিল, তখন আমার প্রিয় বইগুলোর মধ্যে একটি ছিল গুস্তাভ ইয়ানৌচের ‘কনভারসেশনস উইথ কাফকা’ (Conversations with Kafka), বইটি আমি আমার বড়ভাইয়ের সংগ্রহ থেকে পেয়েছিলাম। এই বইটির মাধ্যমে কাফকার সাথে আমার পারস্পরিক আত্মিক সম্পর্কের জন্ম হয়েছিল। আর হয়তো সেই কারণেই আমি আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছিলাম- কাফকার মতো হবো বলে। আমার বাবা কিছুটা অবাক হয়েছিলেন, কারণ আমার ‘আইন’ ছাড়াসাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকর্ম, দর্শন, সব কিছুতেই আগ্রহ ছিল। অবশ্য তিন সপ্তাহ পর সেখানকার পরিবেশ আমার অসহ্য হতে শুরু করে, তাই শুধু আইন অনুষদ নয়, সে শহরটিও আমি স্বজ্ঞানে পরিত?্যাগ করি। এরপর কিছুদিন বুদাপেস্টে ধর্ম এবং ফিলোসফি অধ্যয়ন শুরু করি, সেইসাথে আমার পুরোনো গ্রিক এবং ল্যাটিন অধ্যয়ন চালিয়ে যাই, কিন্তু পরীক্ষাগুলো কঠিন ছিল- কারণ আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতাম না। অবশেষে, চার বছর পর, আমার সন্তানের জন্ম হলো, আর সন্তান হলে, আইনত সামরিক পরিষেবার ভয়ানক বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত থাকা যেত।
আমার জন্য সামরিক পরিষেবা ছিল প্রায় মৃত্যুসমতুল্য। সামরিক পরিষেবাকালে আমাকে একটি বন্দুক নিয়ে প্রহরী পোস্টে পাহারায় থাকতে হতো, আর উর্ধতন অফিসার পর্যবেক্ষণে এসে কাফকা পড়া অবস্থায় ধরা পড়লে শাস্তি হিসাবে ক্যাম্পের কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হলো। তাতে আমি খুব একটা হতাশ হইনি, কারণ কাফকা আমার কাছে একজন নির্বোধ সামরিক অফিসারের চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় ছিলেন। আমি নিশ্চিত যে, ফ্রাঞ্জ কাফকা এমন একটি সা¤্রাজ্যের অপরিমেয় বাস্তবতা- যা আমি কেবল দূর থেকে বিস্মিত অনুভব করতে পারি। সেই একই রকমের আনন্দ আমি অনুভব করি দান্তে এবং গ্যোয়েটে এবং বেকেট এবং হোমারের মতো ব্যক্তিত্বদের ক্ষেত্রে, যারা এমন এক সা¤্রাজ্যের অনন?্য অধিশ্বর এবং আমাদের জন্য তাঁদের স্বর্গীয় সহমর্মিতা বিদ্যমান। আমি নিশ্চিত যে, এইসকল পবিত্র ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের শৈল্পিক চিন্তাভাবনার কিছু সামঞ্জস্য রয়েছে। কাফকা সম্পর্কে আমার চিন্তাভাবনা- আপনার কাফকা চিন্তাভাবনার থেকে খুব বেশি আলাদা হবে না।
এ. থ্রি.: আমি আপনাকে নিয়ে একটি কালানুক্রমিক ধারা সাজানোর চেষ্টা করছি। আপনি গিউলাতে (Gyula) জন্মেছেন, তারপর আপনার সামরিক পরিষেবা, সেগেদে আপনার পড়াশোনা, অতঃপর ভবঘুরে বছরগুলো এবং ‘স্যাটানটাঙ্গো’-র প্রকাশনা। আপনি ১৯৮৭ সালে বার্লিনে এসেছিলেন এবং ১৯৮৯ সালে হাঙ্গেরিতে ফিরে গিয়েছিলেন।
লা. ক্রা.: হ?্যাঁ, এরপর জার্মানিতে নিয়মিত যাওয়া-আসার মধ্যেই ছিলাম। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে আমি ‘যুদ্ধ ও যুদ্ধ’ (War and War) লেখার প্রস্তুতি শুরু করি। মূলত, আমি জানতে চেয়েছিলাম রোমান সা¤্রাজ্যের সীমান্ত বলতে কি বোঝানো হতো? আমি ডেনমার্ক, গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, ক্রিট ঘুরে এসেছি- সেখানে সামরিক প্রতিরক্ষার ধ্বংসাবশেষ, চিহ্ন খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি। ‘যুদ্ধ ও যুদ্ধ’ লেখার রসদ যোগাতে আমি সেসময় ঘোরাঘুরির মধ্যেই থাকতাম। আমার মনে হয়, ১৯৯৬ সালে যখন আমি নিউ ইয়র্কে অ্যালেন গিন্সবার্গের ফ্ল্যাটে দিন কাটাচ্ছিলাম, তখন ‘যুদ্ধ ও যুদ্ধ’ লেখা শুরু করি।
এ. থ্রি.: গিন্সবার্গের সাথে আপনার দেখা হলো কীভাবে?
লা. ক্রা.:আমাদের একজন অভিন্ন বন্ধুর মাধ?্যমে। আর অ্যালেন খুব বন্ধুত্বপরায়ণ মানুষ ছিলেন। তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে লোকজন আসত এবং যেত, দরজার তালাচাবি ছিলো একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। সেখানে থাকার অভিজ্ঞতা ছিল অসাধারণ, তবে গিন্সবার্গের বৃত্তের অংশ হওয়া ছিল খুব বিরক্তিকর। দিনের বেলায় আমি লেখালেখির কাজ করতে পারতাম, এবং রাতে, যখন অ্যালেন সত্যিই প্রাণবন্ত হয়ে উঠতেন, তখন আমি পার্টি, কথোপকথন এবং সঙ্গীত যোগানের কাজে অংশ নিতাম। অ্যালেনের পাশে রান্নাঘরে বসে বসে তাঁর বাড়িতে আসা সঙ্গীতজ্ঞ, কবি, চিত্রশিল্পী- অমর সব ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে ধন্য এবং বিস্মিত হতাম।
এ. থ্রি.: আমার মনে আছে, আপনি একবার সময়ের অসীমত্বের (timelessness) অনুভূতি নিয়ে আপনার আভিজ্ঞতার বর্ণনা করেছিলেন, বলেছিলেন আপনি সবসময় সেই অভিজ্ঞতা অনুভব করেন। আপনি সময়ের অসীমত্বকে সোভিয়েত সা¤্রাজ্যের তাত্ত্বিকতার সাথে সম্পর্কিত করেছিলেন, বলেছিলেন তারা ইতিহাসকে অদৃষ্ট দূরত্বে সরিয়ে দিয়েছিল।
লা. ক্রা.: তখন একটা কালহীন সমাজের অস্তিত্ব ছিল, সোভিয়েত তাত্ত্বিকেরা এটাই প্রমাণ করে দেখাতে চেয়েছিল যে, কমিউনিস্ট তত্ত্ব বা মার্কসবাদ অবনিশ্বর, এর কখনোই পরিবর্তন হবে না। সর্বদা একই ধূসর আকাশ এবং বর্ণহীন গাছপালা, পার্ক এবং রাস্তা, দালান এবং শহর এবং মফস্বল, বারের ভয়ানক পানীয় এবং দারিদ্র্য এবং যে জিনিসগুলো আপনাকে জোরে বলতে নিষেধ করা হয়েছিল, সেসব বুকে করে আপনি অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন। এটা খুবই হতাশাজনক। আমার প্রজন্মই প্রথম, যারা কেবল কমিউনিস্ট তত্ত্ব বা মার্কসবাদে অবিশ্বাস করতো, শুধু তাই নয়, বরং এটিকে মূর্খতা, বিব্রতকর বাস্তবতা বলে মনে করত। যখন আমরা এই রাজনৈতিক ব্যবস্থার শেষ দেখতে পেলাম, আমাদের জন্য তা ছিল এক অপার বিস্ময়। রাজনৈতিক স্বাধীনতার স্বাদ কখনোই ভুলব না আমি। এখন আমার জার্মান নাগরিকত্ব আছে, কারণ আমার কাছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন মানে, সবার উপরে, সেই আক্রমণাত্মক মূর্খতার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক স্বাধীনতা।
আমি একটি বুর্জোয়া জগৎ থেকে এসেছি, যেখানে কমিউনিস্ট তত্ত্ব কখনোই কোনো প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করেনি। আমরা ছিলাম সামাজিক গণতন্ত্রী, আমার বাবা ছিলেন আইনজীবী, এবং দরিদ্র মানুষকে সাহায্য করতেন। সেটাই আমার জীবনের বাস্তবতা- সপ্তাহে দুই বা তিন সন্ধ্যা দরিদ্র মানুষেরা আমাদের কাছে আসত, আমার বাবা বিনা পারিশ্রমিকে তাদের সাহায্য করতেন। এবং পরের দিন, খুব ভোরে, তারা এসে আমাদের দরজার বাইরে কিছু রেখে যেত- দুটো মুরগি, অথবা কিছু সবজি।
এ. থ্রি.: আসুন, আপনার সাহিত?্যচর্চা নিয়ে আরও বিশদ আলোচনা বলা যাক। একটি বিষয় আমাকে খুব কৌতূহলী করে তোলে- তা হলো, আপনি খুব স্পষ্টতই বলতে ভালোবাসেন যে- আপনার সাহিত?্যচর্চার বিশাল পরিসরে আপনি মাত্র চারটি উপন্যাস লিখেছেন!
লা. ক্রা.: সত্যি, এবং সেগুলো হলো- ‘স্যাটানটাঙ্গো’ (Satantango), ‘প্রতিরোধের বিষাদ’ (The Melancholy of Resistance), ‘যুদ্ধ ও যুদ্ধ’ (War and War), ‘ব্যারন ভেঙ্কেইম-এর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ (Baron WenckheimÕs Homecoming)।
এ. থ্রি.: আপনি ‘অ্যানিমালইনসাইড’ (Animalinside)-এর মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাসকে কোথায় স্থান দেবেন?
লা. ক্রা.:আমার বিবেচনায় ‘অ্যানিমালইনসাইড’ সার্বিক অর্থে একটি উপন্যাস নয়। কিন্তু কোনো উপন্যাস কিংবা ছোটগল্প- তা পৃষ্ঠার সংখ্যার ওপর নির্ভর করে না। আমি আমার কর্মজীবনের শুরুতে কিছু গল্প লিখেছিলাম যেগুলো পরে ‘রিলেশনস অফ গ্রেস’ (Relations of Grace, 1986) গল্পগ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। এই গল্পগুলো ছোট পরিসরে এবং খুব সীমিত সময়ে কাজ করে, যার কেন্দ্রে থাকে একেকটি একক চরিত্র। কিন্তু একটি উপন্যাসে হলো- শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি সেতুর মতো, একটি খিলানের মতো, তাতে বিশাল নির্মাণ থাকে। একটি গল্পের ক্ষেত্রে খিলানের প্রয়োজন হয় না। পরিবর্তে, গল্প হলো একটি ‘ব্ল্যাক বক্স’, একটি যাদুর বাক্স, যার মধ্যে কী ঘটেছে তা কেউ জানে না।
এ. থ্রি.: তাহলে নতুন উপন্যাস, ‘ব্যারন ভেঙ্কেইম-এর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ (Baron WenckheimÕs Homecoming), কী নিয়ে? এটি কি ওডিসি (odysse)-এর মতো কোনো কিছু?
লা. ক্রা.: হ্যাঁ। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ‘ব্যারন ভেঙ্কেইম’-এর জন্য, তার জীবনের শেষে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। তিনি বুয়েনোস আইরেসে বসবাসকাি অতি বৃদ্ধ একজন মানুষ। তিনি গিউলা ক্রুডির মতো একজন সংবেদনশীল, খুব লম্বা মানুষ, কিন্তু খুব দুর্ভাগ্যবান- তাঁর জীবনটা কেবলিই ভুলে ভরা।
এ. থ্রি.: তাহলে তিনি আপনার মাইশকিন, মানে আপনার সৃষ্ট প্রতিরক্ষাহীন কোন চরিত্র?
লা. ক্রা.: হ্যাঁ, এরা এস্টিকির মতো। এই উপন্যাসটি আসলে আমার সমস্ত উপন্যাসের সারসংক্ষেপ- আপনি অন্য চরিত্র, অন্যান্য গল্পের সাথে প্রচুর মিল এখানে খুঁজে পেতে পারেন। আমি মনে করি এটি আমার সেরা উপন্যাস।
এ. থ্রি.: আপনার সেরা?
লা. ক্রা.: এটা আমার সচরাচর অন?্যান?্য উপন্যাসের বিষয়বস্তু থেক একটু আলাদা, আমার পছন্দের একটি চিত্তাকার্ষক উপন্যাস। এটা কোনো মহাপ্রলয়ের বার্তায় ভরা নয়, বরং মহাপ্রলয় ইতিমধ্যেই ঘটে গেছে।
এ. থ্রি.: কিন্তু আমার মনে হয়, আপনার সমস্ত বইতেই, মহাপ্রলয় (Apocalypse) গোপনে এসে পড়ে। আমার মনে হয় ঔপন্যাসিকদের দুই রকম প্রকারভেদ আছে: যারা প্রতিটি উপন্যাসকে একটি পৃথক উপাখ্যান হিসাবে বিবেচনা করেন, এবং অন?্যদল মনে করেন যে, তারা একটি উপন্যাস লিখেছেন, যা তাদের লিখিত সমস্ত উপন্যাসের নির্যাস একসাথে ধারণ করে।
লা. ক্রা.:আমি অনেক-অনেকবার বলেছি যে, আমি সবসময় কেবল একটি উপন্যাস লিখতে চেয়েছিলাম। আমি প্রথমটিতে সন্তুষ্ট ছিলাম না, এবং সেই কারণেই আমি দ্বিতীয়টি লিখেছিলাম। আমি দ্বিতীয়টিতেও সন্তুষ্ট হতে পারলাম না, তাই আমি তৃতীয়টি লিখেছিলাম ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন, ‘ব্যারন ভেঙ্কেইম-এর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ (Baron WenckheimÕs Homecoming) দিয়ে আমার উপন্যাস লেখার গল্পটি শেষ করতে পারি। এই উপন্যাসটি দিয়ে আমি প্রমাণ করতে পারি যে, আমি সত্যিই আমার জীবনে মাত্র একটি বই লিখেছি। এটাই সেই বই- ‘স্যাটানটাঙ্গো’, ‘মেলানকোলি’, ‘যুদ্ধ ও যুদ্ধ’, এবং ‘ব্যারন’- এগুলো মিলিয়েই আমার প্রত?্যাশিত সেই সম্পূর্ণ একটি উপন্যাস।
এ. থ্রি.: আপনি কি আপনার লেখা সংশোধন করেন না?
লা. ক্রা.: যখন আমি লিখি, তখন লেখার বিষয়বস্তু আমার মাথায় তৈরি থাকে। ছোটবেলা থেকেই আমি এভাবে কাজ করতে অভ?্যস্ত। আমার শৈশবে, আমার স্মৃতিশক্তি অস্বাভাবিক প্রখর ছিল, আমার ফটোগ্রাফিক মেমোরি ছিল। আমার মাথায় গল্প-উপন?্যাসের প্রয়োজনীয় রসদ সংরক্ষিত থাকতো, সঠিক রূপ, উপযুক্ত বাক্য তাৎক্ষণিক খুঁজে পেতাম, মাথার মধে?্য সবকিছু প্রস্তুত করে লিখে ফেলতাম। আমি ভাগ?্যবান, আমি প্রতিটি মুহূর্তেই কাজ করি। আমার মস্তিষ্ক একটি স্বংয়ক্রিয় যন্ত্রের মতো নিরবচ্ছিন্ন কাজ করে চলে। শুধুমাত্র অসুস্থ থাকলে অথবা যখন আমি মাতাল থাকতাম তখন আমার মস্তিষ্ক ঠিকমতো কাজ করতো না। এই ব্যতিক্রমগুলো ছাড়া, আমি সারাক্ষণই কাজ করি। একটি মাথার ভিতরের একটি বাক্য নিয়ে কাজ শুরু করি, সেই বাক?্যটি ঘিরে মাকড়সার খুব সূক্ষ্ম সুতোর জালের মতো প্রাসঙ্গিক শব্দ কিংবা সূত্র উঁকি দিতে শুরু করে, আমি শুধু সেগুলোর মধ্যে একটি উপযুক্ত, গুরুত্বপূর্ণ, প্রয়োজনিয় জিনিসগুলো সংগ্রহ করে নিই। সে কারণেই আমার বইগুলোর চমৎকার অনুবাদ রয়েছে, আমি চাই আপনি সেগুলো মূল ভাষায় পড়–ন, কারণ যখন আমি কাজ করি, তখন আমি প্রথম যে কাজটি করি তা হলো- ছন্দোময় উপাদানটি ৪
খুঁত করা তৈরি করা। যখন আমি কাজ করি, তখন আমি একই প্রক্রিয়া ব্যবহার করি যা সঙ্গীত এবং সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে বহুল প্রয়োগকৃত এবং প্রমাণিত। সঙ্গীত, সাহিত্য এবং ভিজ্যুয়াল শিল্পের একটি সাধারণ ভিত্তি রয়েছে- ছন্দ এবং গতির কাঠামো- এবং আমি সেই সঙ্গীত মাধ?্যম নিয়েই কাজ করি। সঙ্গীত এবং উপন্যাসের ক্ষেত্রে বিষয়বস্তু একেবারে আলাদা, কিন্তু আমার কাছে সারবস্তুটি সঙ্গীতেরই সমার্থক।
এ. থ্রি.: আপনার উপন্যাসগুলো সম্পর্কে খুব একান্তে কি কিছু বলবেন?
লা. ক্রা.: না, লেখালেখিতে আমি কখনোই আপস করি না। সেজন?্যই আমার উপন্যাসগুলোর মধ্যবর্তী স্তর বলে কিছু নেই। লেখালেখি- আমার কাছে একটি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত শিল্পিত পরিশ্রম। আমি আমার সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে সংকোচ বোধ করি- যেন আপনি আমার সবচেয়ে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিয়ে অযাচিত ঔৎসুক?্য বোধ করছেন। আমি কখনোই আমার সাহিত্যিক জীবনের অংশ ছিলাম না, কারণ আমি সামাজিক অর্থে একজন লেখক হওয়াকে কখনো মেনে নিতে পারিনি। আমার সাথে আপনি এবং আরও কয়েকজন ছাড়া- সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে উৎসাহ বোধ করি না। সবশেষে, আমার সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। সাহিত্য আমার কাছে একান্তই ব্যক্তিগত একটি বিষয়। (সংক্ষেপিত)