লাসলো ক্রাসনাহোরকাই-এর গল্প
অনুবাদ: ফজল হাসান
[অনুবাদকের স্বীকারোক্তি: নোবেল বিজয়ী হাঙ্গেরীয় কল্পলেখক, কথাসাহিত্যিক এবং চিত্রনাট্যকার লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। তিনি বেশির ভাগ সাহিত্য রচনায় দীর্ঘ বাক্য ব্যবহার করেছেন এবং সফলতাও অর্জন করেছেন। তিনি এমন দীর্ঘ বাক্য লিখেছেন যে, একটি মাত্র বাক্যে পুরো উপন্যাসই শেষ হয়েছে, যেমন দ্য মেল্যানক্যালি অব রিজিস্ট্যান্স (দৈর্ঘ্য প্রায়৩০০ পৃষ্ঠা) এবং হার্শট ০৭৭৬৯ (দৈর্ঘ্য প্রায়৪০০ পৃষ্ঠা)। কমা, সেমিকোলন এবং মাঝেমধ্যে কোলন ব্যবহার করে দীর্ঘ বাক্য রচনা করেন তিনি।
যাহোক, দীর্ঘ বাক্য ব্যবহারের কারণ প্রসঙ্গে গুয়ের্নিকা ম্যাগাজিনে (২৬ এপ্রিল, ২০১২) প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে লাসলো ক্রাসনাহোরকাই বলেছেন, ‘আমার তথাকথিত দীর্ঘ বাক্যগুলো কোনো ধারণা কিংবা ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত থেকে আসে না, বরং কথিত বা মুখের ভাষা থেকে আসে। যখন আমরা কথা বলি, তখন কিন্তু অনর্গল, অবিচ্ছিন্ন বাক্য বলি এবং এই ধরনের ভাষায় কোনো সময়যতি চিহ্নের প্রয়োজন হয়না। কেবল ঈশ্বরেরই প্রয়োজন হয় যতি চিহ্নের।’ তিনি মনে করেন, উপন্যাসের ব্যবহৃত ভাষা হওয়া উচিত কথিত ভাষা।
‘বাইরে একটা কিছু জ্বলছে’ মূল গল্পের শুরুর দিকের কয়েকটি দীর্ঘ অনুচ্ছেদ রয়েছে এবং প্রত্যেকটি অনুচ্ছেদে মাত্র একটি করে বাক্যে রচিত। যেহেতু বাংলা ভাষায় বিভিন্ন ধরনের যতিচিহ্নের ব্যবহার থাকলেও দীর্ঘ বাক্য রচনার প্রচলন নেই বললেই চলে, তাই পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে উল্লিখিত অনুচ্ছেদগুলো ভেঙে ছোট ও সহজ-সরল বাক্যে রূপান্তরিত করা হয়েছে।]
সেন্ট আনা হ্রদ একটি মৃত হ্রদ, যা আগ্নেয়গিরির গহ্বরের অভ্যন্তরে সৃষ্টি হয়েছে। হ্রদটি প্রায়৯৫০ মিটার উচ্চতায়অবস্থিত এবং অদ্ভুতভাবে এর আকৃতি প্রায়বৃত্তাকার। হ্রদটি বৃষ্টির পানিতে টইটুম্বর থাকে এবং সেখানে একমাত্র ক্যাটফিশ বাঁচতে পারে। যদি ভালুকরা পানি পান করতে আসে, তবে ওরা মানুষদের চলার পথ এড়িয়ে ভিন্ন পথ ব্যবহার করে এবং পাইন বনের ভেতর থেকে নেমে আসে। দূরে আরও একটি অংশ রয়েছে, যা সমতল জলাভূমি, এবং সেখানে মানুষের খুব একটা যাওয়া-আসা নেই। বর্তমানে জলাভূমির চারপাশ ঘিরে আছে কাঠের তক্তা বিছানো পথ। সেই হ্রদের নাম মস হ্রদ। শোনা যায় যে, মস হ্রদের পানি কখনও জমে না এবং মাঝখানে পানি সবসময় উষ্ণ থাকে। আগ্নেয়গিরিটি হাজার হাজার বছর ধরে মৃত, যা হ্রদের পানির ক্ষেত্রেও একই বিষয় প্রযোজ্য। প্রায়সব জায়গায়এক ধরনের গভীর নীরবতা বিরাজ করে।
একজন আয়োজক প্রথম দিনে আগমনকারীদের দেখিয়েমন্তব্য করে বলেছিলেন যে, এটি একটি আদর্শ হ্রদ, বিশেষ করে নির্জনতা এবং ধ্যানের জন্যে সুনাম রয়েছে। হাঁটাহাঁটি করে মনকে সতেজ করার জন্য এ জায়গা উপযুক্ত, যা কেউ ভোলে না। লোকজন সবচেয়ে উঁচু জায়গায়, যা ‘হাজার-মিটার চূড়া’ নামে পরিচিত, তাঁবু গেড়ে কাছাকাছি থাকার সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। তাই চূড়ার শীর্ষে আরোহণ করা এবং চূড়া থেকে নেমে আসা- উভয়দিকেই চলার পথে পায়ের ছাপ যথেষ্ট ঘন হয়ে ফুটে আছে: ঘন, তবে এর অর্থ এই নয় যে, সমান্তরালভাবে তাঁবুর নিচের অংশে আরও উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনা ঘটে না। সময়তার অভ্যাস মতো চলতে থাকে এবং ক্রমশ যেন আরও দ্রুত গতিতে এগিয়ে যেতে থাকে। মূলত এই বিশেষ জায়গার জন্য উদ্ভাবিত সৃজনশীল চিন্তা-ভাবনা ও ধারণাগুলো আকৃতি ধারণ করে এবং কল্পনায়তারা চূড়ান্ত রূপে পরিণত হয়। সেই সময়ে সবাই তাদের বরাদ্দকৃত স্থানে থিতু হয়এবং পরে তারা নিজেদের হাত দিয়ে ঘরবাড়ি সাজায় এবং মেরামত করে। তবে বেশিরভাগ লোকজন প্রধান ভবনে ব্যক্তিগত কক্ষ পেয়েছে। সেখানে এমন কিছু মানুষ ছিল, যারা কাঠের কুঁড়েঘরে কিংবা অনেক দিন ধরে অব্যবহৃত কাঠের তৈরি ঘরে থাকার ব্যবস্থা করেছে। সেই বিশাল চিলেকোঠার ঘরটি তিনজন তুলে এনে তাঁবুর সঙ্গে জোড়া দিয়েছে, যা ছিল তাঁবুর প্রধান কেন্দ্র। প্রত্যেকেই নিজেদের জন্য আলাদা স্থান তৈরি করে এবং তা ছিল সবার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, বিশেষ করে কাজের ফাঁকে একা থাকার সময়। সবাই চেয়েছিল শান্তি, নিরাপদ এবং ঝামেলামুক্ত পরিবেশ। আর এভাবেই তারা কাজ নির্ধারণ করেছে এবং এভাবেই তারা জীবনযাপন মেনে নিয়েছে। তারা বেশিরভাগ সময়ই কাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকে। তবে তারা হাঁটাচলা, হ্রদের পানিতে সাঁতার কাটা, খাবার এবং তাঁবুর আগুনের চারপাশে সান্ধ্যকালীন সঙ্গীত উপভোগ করা ও তার সঙ্গে স্থানীয়ফলের রস পান করার জন্য অল্প কিছু সময় ব্যয় করে।
এই বৃত্তান্তমূলক কাহিনীর জন্য সাধারণ বিষয় ব্যবহার করাটা খুব বেশি কার্যকর প্রমাণিত হয়নি। যাহোক, ধীরে ধীরে এবং নিশ্চিতভাবে সত্যটি প্রকাশ পেতে শুরু করে, যা প্রথম কাজের দিনে সবচেয়েতীক্ষè চোখে বিষয়টি যেমন দেখা গিয়েছিল, ঠিক তেমনই দেখাচ্ছে। তবে এটি তৃতীয়দিন সকালে মূলত নির্ধারিত বিষয়হিসেবে বিবেচিত হয়েছে- যে আসলে মোট লোকসংখ্যার মধ্যে একজন, অর্থাৎ বারোজনের মধ্যে একজন, এবং সে ছিল সবার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তার আগমন ছিল অত্যন্ত রহস্যময়অথবা অন্তত অন্যদের তুলনায়সম্পূর্ণ পৃথক, কারণ সে ট্রেনে এবং পরে বাসে করে আসেনি। যতই অবিশ্বাস্য মনে হোক না কেন, তার আগমনের দিন বিকেলে, সম্ভবত ছয়টা কিংবা সাড়ে ছয়টা নাগাদ, সে সরাসরি তাঁবুর প্রধান প্রবেশদ্বারের দিকে চলে আসে, ঠিক যেন একজন অচেনা দর্শক নতুন করে পায়ে হেঁটে এসেছে এবং এসেই সে শুধু অল্প সময়ের জন্য মাথা নেড়েছে; আর যখন আয়োজকরা ভদ্রতা এবং বিশেষ সম্মানের সঙ্গে তার নাম তালাশ করেন। পরে তারা রীতিমতো জোরাজুরি করে জিজ্ঞেস করতে শুরু করেন, সে কীভাবে এসেছে। জবাবে সে শুধু বলছে, গাড়িতে করে কেউ তাকে রাস্তার বাঁকে নিয়েএসেছে। চারপাশে গভীর নীরবতা ছিল, অথচ কেউও কোনো গাড়ির শব্দ শোনেনি। তাই তাকে যেকোনো ‘রাস্তার বাঁকে’ নামিয়ে দিতে পারত। যাহোক, তার কথা পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য শোনায়না যে, সে গাড়িতে করে এসেছে। কিন্তু পুরো পথ নয়, শুধুমাত্র নির্দিষ্ট একটি বাঁক পর্যন্ত এবং তাকে সেখানেই নামানো হয়েছে। তাই কেউ তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি, কিংবা আরও সঠিকভাবে বলা যায়, তার কথা কীভাবে ব্যাখ্যা করবে, তা কেউ জানত না। যার ফলে সেই প্রথম দিন থেকেই রয়ে গেল একমাত্র সম্ভাবনা, একমাত্র যুক্তিসঙ্গত বিকল্প কারণ। যদিও বিষয়টি সবচেয়েঅযৌক্তিক যে, সে পুরোপুরি পায়ে হেঁটে হাজির হয়েছে; সে নিজেই বুখারেস্টে যাত্রার প্রস্তুতি নিয়েছে: সেখান থেকে এখানে ট্রেনে আসা এবং পরে বাসে চড়ার পরিবর্তে সে সরাসরি পায়ে হেঁটে এসেছে। কে জানে সেন্ট আনা হ্রদে আসার দীর্ঘ যাত্রা সম্পন্ন করতে তার কত সপ্তাহ লেগেছে এবং অবশেষে সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সাড়ে ছয়টার মধ্যে কোনো একসময়ে সে চত্বরের মূল প্রবেশদ্বারে উপস্থিত হয়েছে। আর যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, আয়োজক দলের কেউ কি ইয়ন গ্রিগরেস্কুকে অভিবাদন জানিয়েছে, হালকাভাবে একবার মাথা নিচু করে জবাব দেয়।
যদি কাহিনীর বিশ্বাসযোগ্যতা তার পায়ের জুতার পরিস্থিতির উপর নির্ভর করত, তবে আদৌ কেউই কোনো সন্দেহ করতে পারত না। সম্ভবত জুতা জোড়া ছিল বাদামি রঙের। সেগুলো কৃত্রিম চামড়ার তৈরি গ্রীষ্মকালীন হালকা লোফার ছিল, পায়ের আঙুলের অংশে ছোট কারুকাজ করা সেলাই ছিল এবং এখন তার পায়ের চারপাশে সম্পূর্ণভাবে ছিঁড়ে গেছে। উভয় জুতার পায়ের তলার অংশ উপরের অংশ থেকে আলাদা হয়ে গেছে, গোড়ালি সম্পূর্ণ ক্ষয়ে গেছে এবং ডান পায়ের আঙুলের কাছে খানিকটা চামড়া তেরছাভাবে ছিঁড়েগেছে, যার জন্য পায়ের নিচের দিকে মোজা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এ শুধু তার জুতা নয়, তাই পুরো ঘটনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিষয়টি রহস্যময় থেকে গেছে। সে কয়েকটি অনুষ্ঠানে যেসব পোশাক পরেছিল, সেগুলো পশ্চিমা দেশের কিংবা পশ্চিমা প্রভাবিত দেশের পোশাক থেকে পৃথক ছিল। কারণ সেসব পোশাক যেন এমন একজন ব্যক্তির ছিল, যে চসেস্কু শাসনামলে আশির দশকের শেষ দিকে কোনো একসময়ে সরাসরি ঠিক সময়মতো এসেছে, যেন সে এসেছে তার গভীর দুঃখ থেকে বর্তমান সময়ে। ঢিলেঢালা প্যান্টগুলো ছিল অবর্ণনীয় রঙের ভারি ফ্ল্যানেলের মতো কাপড়ের তৈরি, যা গোড়ালি পর্যন্ত দীর্ঘ। চেক শার্টের উপরে পরিহিত কার্ডিগানের অবস্থা ছিল আরও করুণ, খাকি-সবুজ এবং ঢিলা বোনা। গ্রীষ্মকালের প্রচ- গরম থাকা সত্ত্বেও চিবুক পর্যন্ত কার্ডিগানে বোতাম আটকানো ছিল।
গ্রিগরেস্কুর দেহের গড়ন ছিল জলজ পাখির মতো হালকা-পাতলা, দু’পাশের কাঁধ ছিল সঙ্কুচিত; টাক পড়া মাথা, তার ভয়ঙ্কর মলিন মুখম-লে এক জোড়া গাঢ় বাদামী চোখ জ্বলজ্বল করছিল- দু’টি জ্বলন্ত বিশুদ্ধ চোখ। তবে চোখ জোড়া অভ্যন্তরীণ আগুন থেকে জ্বলছিল না, বরং দু’টি স্থির আয়নায় বাইরের জ্বলন্ত কিছুর প্রতিফলন ঘটেছে।
তৃতীয়দিনে আয়োজকরা সবাই বুঝতে পারল যে, গ্রিগরেস্কুর কাছে তাঁবুর অর্থ তাবু নয়, কাজের অর্থ শুধু কাজ করা নয়, গ্রীষ্ম মানেই গরম কাল নয়, তার কাছে সাঁতার কিংবা অন্য কোনো অবসর সময়ের আনন্দের কোনো সুখস্মৃতি নেই, যা সাধারণত এ ধরনের সমাবেশে প্রাধান্য পায়। সে আয়োজকদের কাছে নতুন এক জোড়া জুতার কথা বললে তারা তা দিয়েছে (তারা তার জন্য ছাউনি ঘেরা ঘরে আঙটায় ঝোলানো এক জোড়া বুট জুতা খুঁজে পেয়েছে)। সে সারাদিনই বুট জুতা পরেছিল, তাঁবুর চৌহদ্দির মধ্যে হাঁটাচলা করেছে, কিন্তু একবারও তাবুর সীমানা ছেড়ে যায়নি, কখনও উঁচু চূড়ায় ওঠেনি, কখনও উঁচু থেকে নামেননি, কখনও হ্রদের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়নি, এমনকী মস হ্রদের উপরে কাঠের পাটাতনের উপর দিয়েহাঁটতেও যায়নি। সে তাঁবুর সীমানার ভেতরেই ছিল এবং মাঝেমধ্যে এখানে-সেখানে গেলে এদিকে-ওদিকে হেঁটেছে, দেখেছে অন্য লোকজন কী করে। প্রতিবারই সে প্রধান ভবনের কক্ষগুলো পেরিয়েযাওয়ার সময় চিত্রশিল্পী, মুদ্রণ শিল্পী, ভাস্কর শিল্পীদের পেছনে থেমেছে এবং গভীর মনোযোগ দিয়েলক্ষ্য করেছে যে, কীভাবে প্রতিদিন একই কাজ পরিবর্তিত হচ্ছে। সে ছাদে গিয়েছে, ছাউনি ঘরে প্রবেশ করেছে এবং কাঠের তৈরি কুঁড়েঘরে গিয়েছে, কিন্তু কখনও কারও সঙ্গে কথা বলেনি এবং কোনো প্রশ্নের জবাবে একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি, যেন সে বধির ও মূক, অথবা যেন সে বোঝে না তাকে কী প্রশ্ন করা হয়েছে বা তার কাছে জানতে চেয়েছে। সে ছিল সম্পূর্ণ নীরব, উদাসীন, অসংবেদনশীল এবং ভূতের মতো ভয়ঙ্কর। আর যখন তারা, বাকি সবাই অর্থাৎ এগারোজন, তাকে লক্ষ্য করা শুরু করেছে, যেমন গ্রিগোরেস্কুও তাদের লক্ষ্য করেছিল- তারা যা উপলব্ধি করতে পেরেছে, তারা তাই সেই রাতে আগুনের চারপাশে বসে আলোচনা করেছে (যেখানে গ্রিগোরেস্কুকে কখনও তার সঙ্গীদের অনুসরণ করতে দেখা যায়নি, কারণ সে সবসময়তাড়াতাড়িঘুমিয়ে পড়ে)। তাদের সেই উপলব্ধি এমন ছিল যে, সম্ভবত তার আগমন অদ্ভুত ছিল, তার জুতা জোড়া বেঢপ ছিল এবং তার কার্ডিগান, তার ক্লান্ত-অবসন্ন মুখ, কুঁচকানো দেহ, চোখ- সব কিছুই সম্পূর্ণভাবে এমন ছিল। কিন্তু সবচেয়েঅদ্ভুত যে জিনিস তারা স্থির করেছে, তা ছিল তারা এখনও পর্যন্ত যা লক্ষ্য করেনি এবং তাই ছিল সবকিছুর মধ্যে সবচেয়েঅদ্ভুত জিনিস। বর্তমানে এই অত্যাশ্চর্য সৃজনশীল ব্যক্তিটি সবসময় সক্রিয়আছে। যেখানে সবাই কাজ করছিল, সেখানে সে নিঁখুতভাবে এবং পুরোপুরি অলস ছিল।
গ্রিগোরেস্কু কিছুই করছিল না: তারা নিজেদের উপলব্ধির জন্য বিস্মিত হয়েছিল, কিন্তু আরও বেশি বিস্মিত হয়েছিল এ কারণে যে, তারা তাঁবু ফেলার ঠিক শুরুতে বিষয়টি লক্ষ্য করেনি। ইতোমধ্যে, যদি আপনি গুনে দেখতে আগ্রহী হন, ঘটনাটি ঘটেছিল ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম দিনে; প্রকৃতপক্ষে কেউ কেউ তাদের শিল্পকর্মের চূড়ান্ত কাজ সম্পন্ন করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তবুও কেবল এখনই সমস্ত কিছু তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল।
গ্রিগোরেস্কু আসলে কী করছিল?
কিছুই না, আদৌ কিছুই করছিল না।
সেই মুহূর্ত থেকে তারা অজান্তেই গিগোরেস্কুকে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করে এবং একবার, সম্ভবত দশম দিনে, তারা বুঝতে পারে যে, ভোরের আলো ওঠার সময়এবং সমস্ত সকালবেলা, যখন অনেকেই গভীর ঘুমে নিমজ্জিত ছিল, তখন মোটামুটি একটা দীর্ঘ সময়ের জন্য গ্রিগোরেস্কুকে কোথাও দেখা যাচ্ছিল না।। অথচ সবারই জানা ছিল যে, সে সাধারণত সকালে ওঠে। সে কাঠের গুঁড়ির তৈরি কুটিরের কাছে ছিল না, খামারের কাছে ছিল না, ভেতরে ছিল না, বাইরেও ছিল না। তাকে কোথাও দেখা যাচ্ছিল না, যেন সে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কোথাও হারিয়ে গেছে।
ঘটনা জানার আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ার কারণে দ্বাদশ দিনের সন্ধ্যায়কয়েকজন অংশগ্রহণকারী মনস্থির করে যে, পরের দিন তারা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠবে এবং বিষয়টি তদন্ত করার চেষ্টা করবে। একজন চিত্রশিল্পী, যে ছিল হাঙ্গেরিয়ান, বাকি সবাইকে জাগানোর দায়িত্ব নিয়েছিল।
তখনও অন্ধকার ছিল, যখন সবাই নিশ্চিত হয়েছে যে, গিগোরেস্কু নিজের ঘরে নেই। তারা মূল ভবনটি ঘুরে দেখে, তারপর মূল প্রবেশদ্বার দিয়েবেরিয়ে যায়, আবার ফিরে আসে। তারপর তারা কাঠের কুটির এবং ছাউনি ঘরে যায়, কিন্তু তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। বিভ্রান্ত হয়েতারা বিস্মিত দৃষ্টি মেলে পরস্পরের দিকে তাকায়। হ্রদ থেকে শান্ত শীতল হাওয়া ভেসে আসে। ভোরের আলো ক্রমশ ছড়াতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে তারা একে অপরকে দেখতে পারে। চারপাশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে সুনসান নীরবতা।
তারপর একসময় তারা আওয়াজ শুনতে পেল, কিন্তু সেটা ছিল অস্ফুট এবং তারা যে জায়গায় দাঁড়িয়েছিল, সেখানে থেকে সঠিকভাবে শনাক্ত করা সম্ভব ছিল না। আওয়াজটা দূর থেকে এসেছে, হয়তো খামারের সবচেয়েশেষ প্রান্ত থেকে, কিংবা আরও সঠিকভাবে বললে বলতে হয় যে, সেই অদৃশ্য সীমানার অন্য পাশ থেকে, যেখানে দু’টি পৃথক শৌচাগার রয়েছে, এবং যা খামারের সীমানা চিহ্নিত করেছে। কারণ সেখান থেকে, যদিও চিহ্নিত করা ছিল না, জায়গাটি আর খোলা আঙিনার মতো ছিল না। প্রকৃতি, যার কাছ থেকে ছিনিয়েনেওয়া হয়েছিল, এখনও তা ফিরিয়েনিতে পারেনি। তবুও এ সম্পর্কে কেউ কোনো আগ্রহ প্রকাশ করল না: এক ধরনের অসভ্য, কিছুটা ভয়ানক নির্জন ভূমি, যেখানে তাঁবুর মালিকরা জায়গাটি ব্যবহার করা ছাড়া অন্য কোনো কিছু দাবি করেনি। তারা অকেজো ফ্রিজ থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জঞ্জাল ও রান্নাঘরের ময়লা-আবর্জনা, এমনকি যা কিছু কল্পনা করা যায়, ফেলার জন্য ভাগাড় হিসেবে ব্যবহার করেছে। যার কারণে পুরো জায়গাটি ক্রমশ শক্ত, প্রায়অপ্রতিরোধ্য আগাছার জঙ্গলে ঢেকে যায়। সেই জঙ্গল ব্যবহার উপযোগী ছিল না এবং ধ্বংস করাও সম্ভব ছিল না।
কোথাও দূর থেকে, এই জঙ্গলের কোনো এক জায়গা থেকে, আওয়াজটা ক্রমশ তাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।
তারা তাদের অসমাপ্ত কাজ নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে দীর্ঘ সময় কাটায়নি: একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি, তারা শুধু একে অপরের দিকে তাকিয়ে দেখছিল, নীরবে মাথা নাড়ছিল, ঘন জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করল এবং একটা কিছুর খোঁজে এগিয়েযেতে লাগল।
ইতোমধ্যে তারা খুব গভীরে প্রবেশ করেছে এবং জায়গাটি তাঁবু থেকে অনেক দূরে। যখন তারা সেই আওয়াজ চিহ্নিত করতে পারল, তখন বুঝতে তাদের কোনো অসুবিধা হলো না যে, কেউ মাটি খুঁড়ছে।
তারা সবাই ঘুরে অন্য দিকে যায়, কারণ শব্দটি তাদের কানে পরিষ্কারভাবে শোনা যাচ্ছিল। যখন যন্ত্রটি মাটিতে চাপ দিচ্ছিল, পরমুহূর্তে মাটি ছড়িয়েপড়ছিল, ঘোড়ার লেজের মতো গুচ্ছ ঘাসে আঘাত করছিল এবং চতুর্দিকে কাটা ঘাস ছড়িয়েপড়ছিল।
সবাইকে ডানদিকে ঘুরতে হয়েছিল এবং তারপর দশ বা পনেরো পদক্ষেপ এগিয়ে যেতে হয়েছিল। কিন্তু তারা এত দ্রুত সেখানে পৌঁছায় যে, ভারসাম্য হারিয়ে প্রায় নিচে পড়ে যাচ্ছিল। তারা একটি বিশাল গর্তের পাশে এসে দাঁড়ায়। গর্তটি প্রায় তিন মিটার চওড়া এবং পাঁচ মিটার দীর্ঘ, যার তলায় তারা গ্রিগোরেস্কুকে আপনমনে কাজ করতে দেখে। পুরো গর্তটি এতই গভীর ছিল যে, তার মাথা দেখা যাচ্ছিল না। নিজের কাজে গভীর মনোযোগের জন্য গ্রিগোরেস্কু তাদের আগমন মোটেও টের পায়নি। যখন তারা বিশাল গর্তের পাশে দাঁড়িয়েনিচের দিকে তাকিয়েছে, তখনই সে খেয়াল করে।
সেখানে নিচে, গর্তের মাঝে, তারা একটি ঘোড়া দেখতে পেল- পূর্ণ বয়সী, তবে মাটির তৈরি। প্রথমে তারা শুধু মাটির তৈরি ঘোড়াটি দেখল; তারপর দেখল যে, সেই ঘোড়াটি মাথা উঁচু করে আছে, দাঁত বের করে দেখাচ্ছে এবং মুখে ফেনা তুলছে। ঘোড়াটি ভয়ঙ্কর শক্তিতে দৌড়াচ্ছে, যেন কোথাও পালাচ্ছে। তাই শেষের দিকে একসময় তারা লক্ষ্য করল যে, গ্রিগোরেস্কু বড়এক জায়গার আগাছা পরিষ্কার করেছে এবং এই বিশাল গর্ত খনন করেছে। তবে সে গর্তের মধ্যিখানে ঘোড়ার কাছ থেকে এমনভাবে মাটি সরিয়ে দেয়, যা দেখে মনে হয় যে, ঘোড়াটি ভয় পেয়ে ফেনা ভরা মুখে প্রাণপণ দৌড়াচ্ছে; সে ঘোড়াটি খুঁড়েবের করে মুক্ত করেছে এবং পূর্ণ বয়স্ক প্রাণিকে দৃশ্যমান করেছে। প্রাণিটি ভয়ানক আতঙ্কে ছুটছে, যেন মাটির নিচের কোনো কিছুর কবল থেকে পালাচ্ছে।
তারা সবাই হতবাক হয়েদাঁড়িয়েথাকে এবং গ্রিগোরেস্কুকে দেখে। গ্রিগোরেস্কু তাদের উপস্থিতি টের না পেয়ে একাগ্রতার সঙ্গে কাজ করতে থাকে।
সে দশ দিন ধরে খুঁড়ছে- তারা গর্তের পাশে দাঁড়িয়ে নিজেদের মনে ভাবছিল।
সে ভোরে এবং সকালে খুঁড়ছে, এমনকী দিনের সবটুকু সময়ও।
কারও একজনের পায়ের তলায় মাটি সরে যায় এবং গ্রিগোরেস্কু উপরে তাকায়। সে এক মুহূর্তের জন্য থামে, মাথা আনত করে সম্ভাষণ করে এবং পুনরায় কাজে মনোনিবেশ করে।
শিল্পীরা এক ধরনের অস্বস্তি অনুভব করে। কারোর কিছু বলতে হবে, তারা ভাবল।
এটা অসাধারণ, আইয়ন, ফরাসি চিত্রশিল্পী নিচু স্বরে বলল।
গ্রিগোরেস্কু আবার কাজ থামায় এবং গর্ত থেকে বের হওয়ার জন্য একটি মই বেয়েউপরে ওঠে। তারপর কোদাল থেকে মাটি ঝেড়ে ফেলার জন্য পাশে রাখা নিড়ানি দিয়েপরিষ্কার করে এবং রুমাল দিয়েকপালের ঘাম মোছে। অবশেষে সে তাদের দিকে এগিয়েআসে এবং ধীর গতিতে হাত তুলে পুরো দৃশ্যভূমি দেখায়।
এখনও অনেকগুলো বাকি আছে, সে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল।
তারপর সে তার কোদাল উঁচু করে, মই বেয়েগর্তের নিচে নামল এবং পুনরায় খনন কাজ শুরু করে।
বাকি শিল্পীরা কিছুক্ষণ মাথা নাড়ছিল। অবশেষে তারা নীরবে প্রধান ভবনের দিকে ফিরে যায়।
এখন কেবল বিদায়পর্ব বাকি রয়েছে। পরিচালকরা খানাপিনার বিশাল আয়োজন করেছিলেন এবং তা ছিল গত সন্ধ্যায়। পরদিন সকালে তাঁবুর প্রবেশপথ বন্ধ ছিল এবং সেখানে একটি ভাড়া করা বাস থেমে ছিল। যারা বুখারেস্ট থেকে অথবা হাঙ্গেরি থেকে গাড়িতে এসেছিল, তাদের কয়েকজন তাবু ছেড়েচলে গেছে।
গ্রিগোরেস্কু বুটজুতা আয়োজকদের কাছে ফিরিয়েদিয়ে পুনরায় নিজের জুতা পায়ে দেয়। সে তাদের সঙ্গে কিছু সময় ব্যয় করে। তারপর তাঁবু থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে, গ্রামের কাছে রাস্তার এক বাঁকে, তিনি হঠাৎ চালককে বাস থামাতে বললেন। সে কিছু একটা বলল, হয়তো এখান থেকে একা যাওয়াই তার জন্য ভালো হবে। কিন্তু কেউ পরিষ্কারভাবে তার কথা বুঝতে পারল না। সে আসলে কী বলল, তা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল না। কেননা তার কণ্ঠস্বর অস্ফুট ছিল।
বাসটি বাঁক পেরিয়ে যাওয়ার পরই দৃশ্যের অন্তরালে চলে যায়, গ্রিগোরেস্কু রাস্তা অতিক্রম করার জন্য ঘুরল এবং হঠাৎ করে নিচের যাওয়ার সর্পিল পথের শেষে অদৃশ্য হয়েগেল। পেছনে শুধু ভূসম্পত্তি রয়েগেল, পাহাড়ের নীরব নিয়ম-কানুন, বিশাল জায়গাজুড়েপড়েথাকা মৃত পাতায় ঢেকে থাকা জমিন, সীমাহীন প্রান্তর- যা নিচের সব কিছুকে আড়াল করে রেখেছে, গোপন করেছে এবং আচ্ছাদিত করে রেখেছে।
গল্পসূত্র:
‘বাইরে একটা কিছু জ্বলছে’ গল্পটি লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের ইংরেজিতে ‘সামথিং ইজ বার্নিং আউটসাইড’ গল্পের অনুবাদ। গল্পটি হাঙ্গেরীয় ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ওট্টিলিয়ে মুজেট, যা বৃটেনের দ্য গার্ডিয়ান ম্যাগাজিনে ১৭ জুন ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখ্য, জাদুবাস্তববাদধর্মী এই গল্পটি পরে ২০১৩ সালে ইংরেজিতে অনূদিত লেখকের সিওবো দেয়ার বিলৌ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই-এর গল্প
অনুবাদ: ফজল হাসান
বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫
[অনুবাদকের স্বীকারোক্তি: নোবেল বিজয়ী হাঙ্গেরীয় কল্পলেখক, কথাসাহিত্যিক এবং চিত্রনাট্যকার লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। তিনি বেশির ভাগ সাহিত্য রচনায় দীর্ঘ বাক্য ব্যবহার করেছেন এবং সফলতাও অর্জন করেছেন। তিনি এমন দীর্ঘ বাক্য লিখেছেন যে, একটি মাত্র বাক্যে পুরো উপন্যাসই শেষ হয়েছে, যেমন দ্য মেল্যানক্যালি অব রিজিস্ট্যান্স (দৈর্ঘ্য প্রায়৩০০ পৃষ্ঠা) এবং হার্শট ০৭৭৬৯ (দৈর্ঘ্য প্রায়৪০০ পৃষ্ঠা)। কমা, সেমিকোলন এবং মাঝেমধ্যে কোলন ব্যবহার করে দীর্ঘ বাক্য রচনা করেন তিনি।
যাহোক, দীর্ঘ বাক্য ব্যবহারের কারণ প্রসঙ্গে গুয়ের্নিকা ম্যাগাজিনে (২৬ এপ্রিল, ২০১২) প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে লাসলো ক্রাসনাহোরকাই বলেছেন, ‘আমার তথাকথিত দীর্ঘ বাক্যগুলো কোনো ধারণা কিংবা ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত থেকে আসে না, বরং কথিত বা মুখের ভাষা থেকে আসে। যখন আমরা কথা বলি, তখন কিন্তু অনর্গল, অবিচ্ছিন্ন বাক্য বলি এবং এই ধরনের ভাষায় কোনো সময়যতি চিহ্নের প্রয়োজন হয়না। কেবল ঈশ্বরেরই প্রয়োজন হয় যতি চিহ্নের।’ তিনি মনে করেন, উপন্যাসের ব্যবহৃত ভাষা হওয়া উচিত কথিত ভাষা।
‘বাইরে একটা কিছু জ্বলছে’ মূল গল্পের শুরুর দিকের কয়েকটি দীর্ঘ অনুচ্ছেদ রয়েছে এবং প্রত্যেকটি অনুচ্ছেদে মাত্র একটি করে বাক্যে রচিত। যেহেতু বাংলা ভাষায় বিভিন্ন ধরনের যতিচিহ্নের ব্যবহার থাকলেও দীর্ঘ বাক্য রচনার প্রচলন নেই বললেই চলে, তাই পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে উল্লিখিত অনুচ্ছেদগুলো ভেঙে ছোট ও সহজ-সরল বাক্যে রূপান্তরিত করা হয়েছে।]
সেন্ট আনা হ্রদ একটি মৃত হ্রদ, যা আগ্নেয়গিরির গহ্বরের অভ্যন্তরে সৃষ্টি হয়েছে। হ্রদটি প্রায়৯৫০ মিটার উচ্চতায়অবস্থিত এবং অদ্ভুতভাবে এর আকৃতি প্রায়বৃত্তাকার। হ্রদটি বৃষ্টির পানিতে টইটুম্বর থাকে এবং সেখানে একমাত্র ক্যাটফিশ বাঁচতে পারে। যদি ভালুকরা পানি পান করতে আসে, তবে ওরা মানুষদের চলার পথ এড়িয়ে ভিন্ন পথ ব্যবহার করে এবং পাইন বনের ভেতর থেকে নেমে আসে। দূরে আরও একটি অংশ রয়েছে, যা সমতল জলাভূমি, এবং সেখানে মানুষের খুব একটা যাওয়া-আসা নেই। বর্তমানে জলাভূমির চারপাশ ঘিরে আছে কাঠের তক্তা বিছানো পথ। সেই হ্রদের নাম মস হ্রদ। শোনা যায় যে, মস হ্রদের পানি কখনও জমে না এবং মাঝখানে পানি সবসময় উষ্ণ থাকে। আগ্নেয়গিরিটি হাজার হাজার বছর ধরে মৃত, যা হ্রদের পানির ক্ষেত্রেও একই বিষয় প্রযোজ্য। প্রায়সব জায়গায়এক ধরনের গভীর নীরবতা বিরাজ করে।
একজন আয়োজক প্রথম দিনে আগমনকারীদের দেখিয়েমন্তব্য করে বলেছিলেন যে, এটি একটি আদর্শ হ্রদ, বিশেষ করে নির্জনতা এবং ধ্যানের জন্যে সুনাম রয়েছে। হাঁটাহাঁটি করে মনকে সতেজ করার জন্য এ জায়গা উপযুক্ত, যা কেউ ভোলে না। লোকজন সবচেয়ে উঁচু জায়গায়, যা ‘হাজার-মিটার চূড়া’ নামে পরিচিত, তাঁবু গেড়ে কাছাকাছি থাকার সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। তাই চূড়ার শীর্ষে আরোহণ করা এবং চূড়া থেকে নেমে আসা- উভয়দিকেই চলার পথে পায়ের ছাপ যথেষ্ট ঘন হয়ে ফুটে আছে: ঘন, তবে এর অর্থ এই নয় যে, সমান্তরালভাবে তাঁবুর নিচের অংশে আরও উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনা ঘটে না। সময়তার অভ্যাস মতো চলতে থাকে এবং ক্রমশ যেন আরও দ্রুত গতিতে এগিয়ে যেতে থাকে। মূলত এই বিশেষ জায়গার জন্য উদ্ভাবিত সৃজনশীল চিন্তা-ভাবনা ও ধারণাগুলো আকৃতি ধারণ করে এবং কল্পনায়তারা চূড়ান্ত রূপে পরিণত হয়। সেই সময়ে সবাই তাদের বরাদ্দকৃত স্থানে থিতু হয়এবং পরে তারা নিজেদের হাত দিয়ে ঘরবাড়ি সাজায় এবং মেরামত করে। তবে বেশিরভাগ লোকজন প্রধান ভবনে ব্যক্তিগত কক্ষ পেয়েছে। সেখানে এমন কিছু মানুষ ছিল, যারা কাঠের কুঁড়েঘরে কিংবা অনেক দিন ধরে অব্যবহৃত কাঠের তৈরি ঘরে থাকার ব্যবস্থা করেছে। সেই বিশাল চিলেকোঠার ঘরটি তিনজন তুলে এনে তাঁবুর সঙ্গে জোড়া দিয়েছে, যা ছিল তাঁবুর প্রধান কেন্দ্র। প্রত্যেকেই নিজেদের জন্য আলাদা স্থান তৈরি করে এবং তা ছিল সবার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, বিশেষ করে কাজের ফাঁকে একা থাকার সময়। সবাই চেয়েছিল শান্তি, নিরাপদ এবং ঝামেলামুক্ত পরিবেশ। আর এভাবেই তারা কাজ নির্ধারণ করেছে এবং এভাবেই তারা জীবনযাপন মেনে নিয়েছে। তারা বেশিরভাগ সময়ই কাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকে। তবে তারা হাঁটাচলা, হ্রদের পানিতে সাঁতার কাটা, খাবার এবং তাঁবুর আগুনের চারপাশে সান্ধ্যকালীন সঙ্গীত উপভোগ করা ও তার সঙ্গে স্থানীয়ফলের রস পান করার জন্য অল্প কিছু সময় ব্যয় করে।
এই বৃত্তান্তমূলক কাহিনীর জন্য সাধারণ বিষয় ব্যবহার করাটা খুব বেশি কার্যকর প্রমাণিত হয়নি। যাহোক, ধীরে ধীরে এবং নিশ্চিতভাবে সত্যটি প্রকাশ পেতে শুরু করে, যা প্রথম কাজের দিনে সবচেয়েতীক্ষè চোখে বিষয়টি যেমন দেখা গিয়েছিল, ঠিক তেমনই দেখাচ্ছে। তবে এটি তৃতীয়দিন সকালে মূলত নির্ধারিত বিষয়হিসেবে বিবেচিত হয়েছে- যে আসলে মোট লোকসংখ্যার মধ্যে একজন, অর্থাৎ বারোজনের মধ্যে একজন, এবং সে ছিল সবার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তার আগমন ছিল অত্যন্ত রহস্যময়অথবা অন্তত অন্যদের তুলনায়সম্পূর্ণ পৃথক, কারণ সে ট্রেনে এবং পরে বাসে করে আসেনি। যতই অবিশ্বাস্য মনে হোক না কেন, তার আগমনের দিন বিকেলে, সম্ভবত ছয়টা কিংবা সাড়ে ছয়টা নাগাদ, সে সরাসরি তাঁবুর প্রধান প্রবেশদ্বারের দিকে চলে আসে, ঠিক যেন একজন অচেনা দর্শক নতুন করে পায়ে হেঁটে এসেছে এবং এসেই সে শুধু অল্প সময়ের জন্য মাথা নেড়েছে; আর যখন আয়োজকরা ভদ্রতা এবং বিশেষ সম্মানের সঙ্গে তার নাম তালাশ করেন। পরে তারা রীতিমতো জোরাজুরি করে জিজ্ঞেস করতে শুরু করেন, সে কীভাবে এসেছে। জবাবে সে শুধু বলছে, গাড়িতে করে কেউ তাকে রাস্তার বাঁকে নিয়েএসেছে। চারপাশে গভীর নীরবতা ছিল, অথচ কেউও কোনো গাড়ির শব্দ শোনেনি। তাই তাকে যেকোনো ‘রাস্তার বাঁকে’ নামিয়ে দিতে পারত। যাহোক, তার কথা পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য শোনায়না যে, সে গাড়িতে করে এসেছে। কিন্তু পুরো পথ নয়, শুধুমাত্র নির্দিষ্ট একটি বাঁক পর্যন্ত এবং তাকে সেখানেই নামানো হয়েছে। তাই কেউ তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি, কিংবা আরও সঠিকভাবে বলা যায়, তার কথা কীভাবে ব্যাখ্যা করবে, তা কেউ জানত না। যার ফলে সেই প্রথম দিন থেকেই রয়ে গেল একমাত্র সম্ভাবনা, একমাত্র যুক্তিসঙ্গত বিকল্প কারণ। যদিও বিষয়টি সবচেয়েঅযৌক্তিক যে, সে পুরোপুরি পায়ে হেঁটে হাজির হয়েছে; সে নিজেই বুখারেস্টে যাত্রার প্রস্তুতি নিয়েছে: সেখান থেকে এখানে ট্রেনে আসা এবং পরে বাসে চড়ার পরিবর্তে সে সরাসরি পায়ে হেঁটে এসেছে। কে জানে সেন্ট আনা হ্রদে আসার দীর্ঘ যাত্রা সম্পন্ন করতে তার কত সপ্তাহ লেগেছে এবং অবশেষে সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সাড়ে ছয়টার মধ্যে কোনো একসময়ে সে চত্বরের মূল প্রবেশদ্বারে উপস্থিত হয়েছে। আর যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, আয়োজক দলের কেউ কি ইয়ন গ্রিগরেস্কুকে অভিবাদন জানিয়েছে, হালকাভাবে একবার মাথা নিচু করে জবাব দেয়।
যদি কাহিনীর বিশ্বাসযোগ্যতা তার পায়ের জুতার পরিস্থিতির উপর নির্ভর করত, তবে আদৌ কেউই কোনো সন্দেহ করতে পারত না। সম্ভবত জুতা জোড়া ছিল বাদামি রঙের। সেগুলো কৃত্রিম চামড়ার তৈরি গ্রীষ্মকালীন হালকা লোফার ছিল, পায়ের আঙুলের অংশে ছোট কারুকাজ করা সেলাই ছিল এবং এখন তার পায়ের চারপাশে সম্পূর্ণভাবে ছিঁড়ে গেছে। উভয় জুতার পায়ের তলার অংশ উপরের অংশ থেকে আলাদা হয়ে গেছে, গোড়ালি সম্পূর্ণ ক্ষয়ে গেছে এবং ডান পায়ের আঙুলের কাছে খানিকটা চামড়া তেরছাভাবে ছিঁড়েগেছে, যার জন্য পায়ের নিচের দিকে মোজা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এ শুধু তার জুতা নয়, তাই পুরো ঘটনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিষয়টি রহস্যময় থেকে গেছে। সে কয়েকটি অনুষ্ঠানে যেসব পোশাক পরেছিল, সেগুলো পশ্চিমা দেশের কিংবা পশ্চিমা প্রভাবিত দেশের পোশাক থেকে পৃথক ছিল। কারণ সেসব পোশাক যেন এমন একজন ব্যক্তির ছিল, যে চসেস্কু শাসনামলে আশির দশকের শেষ দিকে কোনো একসময়ে সরাসরি ঠিক সময়মতো এসেছে, যেন সে এসেছে তার গভীর দুঃখ থেকে বর্তমান সময়ে। ঢিলেঢালা প্যান্টগুলো ছিল অবর্ণনীয় রঙের ভারি ফ্ল্যানেলের মতো কাপড়ের তৈরি, যা গোড়ালি পর্যন্ত দীর্ঘ। চেক শার্টের উপরে পরিহিত কার্ডিগানের অবস্থা ছিল আরও করুণ, খাকি-সবুজ এবং ঢিলা বোনা। গ্রীষ্মকালের প্রচ- গরম থাকা সত্ত্বেও চিবুক পর্যন্ত কার্ডিগানে বোতাম আটকানো ছিল।
গ্রিগরেস্কুর দেহের গড়ন ছিল জলজ পাখির মতো হালকা-পাতলা, দু’পাশের কাঁধ ছিল সঙ্কুচিত; টাক পড়া মাথা, তার ভয়ঙ্কর মলিন মুখম-লে এক জোড়া গাঢ় বাদামী চোখ জ্বলজ্বল করছিল- দু’টি জ্বলন্ত বিশুদ্ধ চোখ। তবে চোখ জোড়া অভ্যন্তরীণ আগুন থেকে জ্বলছিল না, বরং দু’টি স্থির আয়নায় বাইরের জ্বলন্ত কিছুর প্রতিফলন ঘটেছে।
তৃতীয়দিনে আয়োজকরা সবাই বুঝতে পারল যে, গ্রিগরেস্কুর কাছে তাঁবুর অর্থ তাবু নয়, কাজের অর্থ শুধু কাজ করা নয়, গ্রীষ্ম মানেই গরম কাল নয়, তার কাছে সাঁতার কিংবা অন্য কোনো অবসর সময়ের আনন্দের কোনো সুখস্মৃতি নেই, যা সাধারণত এ ধরনের সমাবেশে প্রাধান্য পায়। সে আয়োজকদের কাছে নতুন এক জোড়া জুতার কথা বললে তারা তা দিয়েছে (তারা তার জন্য ছাউনি ঘেরা ঘরে আঙটায় ঝোলানো এক জোড়া বুট জুতা খুঁজে পেয়েছে)। সে সারাদিনই বুট জুতা পরেছিল, তাঁবুর চৌহদ্দির মধ্যে হাঁটাচলা করেছে, কিন্তু একবারও তাবুর সীমানা ছেড়ে যায়নি, কখনও উঁচু চূড়ায় ওঠেনি, কখনও উঁচু থেকে নামেননি, কখনও হ্রদের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়নি, এমনকী মস হ্রদের উপরে কাঠের পাটাতনের উপর দিয়েহাঁটতেও যায়নি। সে তাঁবুর সীমানার ভেতরেই ছিল এবং মাঝেমধ্যে এখানে-সেখানে গেলে এদিকে-ওদিকে হেঁটেছে, দেখেছে অন্য লোকজন কী করে। প্রতিবারই সে প্রধান ভবনের কক্ষগুলো পেরিয়েযাওয়ার সময় চিত্রশিল্পী, মুদ্রণ শিল্পী, ভাস্কর শিল্পীদের পেছনে থেমেছে এবং গভীর মনোযোগ দিয়েলক্ষ্য করেছে যে, কীভাবে প্রতিদিন একই কাজ পরিবর্তিত হচ্ছে। সে ছাদে গিয়েছে, ছাউনি ঘরে প্রবেশ করেছে এবং কাঠের তৈরি কুঁড়েঘরে গিয়েছে, কিন্তু কখনও কারও সঙ্গে কথা বলেনি এবং কোনো প্রশ্নের জবাবে একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি, যেন সে বধির ও মূক, অথবা যেন সে বোঝে না তাকে কী প্রশ্ন করা হয়েছে বা তার কাছে জানতে চেয়েছে। সে ছিল সম্পূর্ণ নীরব, উদাসীন, অসংবেদনশীল এবং ভূতের মতো ভয়ঙ্কর। আর যখন তারা, বাকি সবাই অর্থাৎ এগারোজন, তাকে লক্ষ্য করা শুরু করেছে, যেমন গ্রিগোরেস্কুও তাদের লক্ষ্য করেছিল- তারা যা উপলব্ধি করতে পেরেছে, তারা তাই সেই রাতে আগুনের চারপাশে বসে আলোচনা করেছে (যেখানে গ্রিগোরেস্কুকে কখনও তার সঙ্গীদের অনুসরণ করতে দেখা যায়নি, কারণ সে সবসময়তাড়াতাড়িঘুমিয়ে পড়ে)। তাদের সেই উপলব্ধি এমন ছিল যে, সম্ভবত তার আগমন অদ্ভুত ছিল, তার জুতা জোড়া বেঢপ ছিল এবং তার কার্ডিগান, তার ক্লান্ত-অবসন্ন মুখ, কুঁচকানো দেহ, চোখ- সব কিছুই সম্পূর্ণভাবে এমন ছিল। কিন্তু সবচেয়েঅদ্ভুত যে জিনিস তারা স্থির করেছে, তা ছিল তারা এখনও পর্যন্ত যা লক্ষ্য করেনি এবং তাই ছিল সবকিছুর মধ্যে সবচেয়েঅদ্ভুত জিনিস। বর্তমানে এই অত্যাশ্চর্য সৃজনশীল ব্যক্তিটি সবসময় সক্রিয়আছে। যেখানে সবাই কাজ করছিল, সেখানে সে নিঁখুতভাবে এবং পুরোপুরি অলস ছিল।
গ্রিগোরেস্কু কিছুই করছিল না: তারা নিজেদের উপলব্ধির জন্য বিস্মিত হয়েছিল, কিন্তু আরও বেশি বিস্মিত হয়েছিল এ কারণে যে, তারা তাঁবু ফেলার ঠিক শুরুতে বিষয়টি লক্ষ্য করেনি। ইতোমধ্যে, যদি আপনি গুনে দেখতে আগ্রহী হন, ঘটনাটি ঘটেছিল ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম দিনে; প্রকৃতপক্ষে কেউ কেউ তাদের শিল্পকর্মের চূড়ান্ত কাজ সম্পন্ন করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তবুও কেবল এখনই সমস্ত কিছু তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল।
গ্রিগোরেস্কু আসলে কী করছিল?
কিছুই না, আদৌ কিছুই করছিল না।
সেই মুহূর্ত থেকে তারা অজান্তেই গিগোরেস্কুকে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করে এবং একবার, সম্ভবত দশম দিনে, তারা বুঝতে পারে যে, ভোরের আলো ওঠার সময়এবং সমস্ত সকালবেলা, যখন অনেকেই গভীর ঘুমে নিমজ্জিত ছিল, তখন মোটামুটি একটা দীর্ঘ সময়ের জন্য গ্রিগোরেস্কুকে কোথাও দেখা যাচ্ছিল না।। অথচ সবারই জানা ছিল যে, সে সাধারণত সকালে ওঠে। সে কাঠের গুঁড়ির তৈরি কুটিরের কাছে ছিল না, খামারের কাছে ছিল না, ভেতরে ছিল না, বাইরেও ছিল না। তাকে কোথাও দেখা যাচ্ছিল না, যেন সে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কোথাও হারিয়ে গেছে।
ঘটনা জানার আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ার কারণে দ্বাদশ দিনের সন্ধ্যায়কয়েকজন অংশগ্রহণকারী মনস্থির করে যে, পরের দিন তারা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠবে এবং বিষয়টি তদন্ত করার চেষ্টা করবে। একজন চিত্রশিল্পী, যে ছিল হাঙ্গেরিয়ান, বাকি সবাইকে জাগানোর দায়িত্ব নিয়েছিল।
তখনও অন্ধকার ছিল, যখন সবাই নিশ্চিত হয়েছে যে, গিগোরেস্কু নিজের ঘরে নেই। তারা মূল ভবনটি ঘুরে দেখে, তারপর মূল প্রবেশদ্বার দিয়েবেরিয়ে যায়, আবার ফিরে আসে। তারপর তারা কাঠের কুটির এবং ছাউনি ঘরে যায়, কিন্তু তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। বিভ্রান্ত হয়েতারা বিস্মিত দৃষ্টি মেলে পরস্পরের দিকে তাকায়। হ্রদ থেকে শান্ত শীতল হাওয়া ভেসে আসে। ভোরের আলো ক্রমশ ছড়াতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে তারা একে অপরকে দেখতে পারে। চারপাশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে সুনসান নীরবতা।
তারপর একসময় তারা আওয়াজ শুনতে পেল, কিন্তু সেটা ছিল অস্ফুট এবং তারা যে জায়গায় দাঁড়িয়েছিল, সেখানে থেকে সঠিকভাবে শনাক্ত করা সম্ভব ছিল না। আওয়াজটা দূর থেকে এসেছে, হয়তো খামারের সবচেয়েশেষ প্রান্ত থেকে, কিংবা আরও সঠিকভাবে বললে বলতে হয় যে, সেই অদৃশ্য সীমানার অন্য পাশ থেকে, যেখানে দু’টি পৃথক শৌচাগার রয়েছে, এবং যা খামারের সীমানা চিহ্নিত করেছে। কারণ সেখান থেকে, যদিও চিহ্নিত করা ছিল না, জায়গাটি আর খোলা আঙিনার মতো ছিল না। প্রকৃতি, যার কাছ থেকে ছিনিয়েনেওয়া হয়েছিল, এখনও তা ফিরিয়েনিতে পারেনি। তবুও এ সম্পর্কে কেউ কোনো আগ্রহ প্রকাশ করল না: এক ধরনের অসভ্য, কিছুটা ভয়ানক নির্জন ভূমি, যেখানে তাঁবুর মালিকরা জায়গাটি ব্যবহার করা ছাড়া অন্য কোনো কিছু দাবি করেনি। তারা অকেজো ফ্রিজ থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জঞ্জাল ও রান্নাঘরের ময়লা-আবর্জনা, এমনকি যা কিছু কল্পনা করা যায়, ফেলার জন্য ভাগাড় হিসেবে ব্যবহার করেছে। যার কারণে পুরো জায়গাটি ক্রমশ শক্ত, প্রায়অপ্রতিরোধ্য আগাছার জঙ্গলে ঢেকে যায়। সেই জঙ্গল ব্যবহার উপযোগী ছিল না এবং ধ্বংস করাও সম্ভব ছিল না।
কোথাও দূর থেকে, এই জঙ্গলের কোনো এক জায়গা থেকে, আওয়াজটা ক্রমশ তাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।
তারা তাদের অসমাপ্ত কাজ নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে দীর্ঘ সময় কাটায়নি: একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি, তারা শুধু একে অপরের দিকে তাকিয়ে দেখছিল, নীরবে মাথা নাড়ছিল, ঘন জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করল এবং একটা কিছুর খোঁজে এগিয়েযেতে লাগল।
ইতোমধ্যে তারা খুব গভীরে প্রবেশ করেছে এবং জায়গাটি তাঁবু থেকে অনেক দূরে। যখন তারা সেই আওয়াজ চিহ্নিত করতে পারল, তখন বুঝতে তাদের কোনো অসুবিধা হলো না যে, কেউ মাটি খুঁড়ছে।
তারা সবাই ঘুরে অন্য দিকে যায়, কারণ শব্দটি তাদের কানে পরিষ্কারভাবে শোনা যাচ্ছিল। যখন যন্ত্রটি মাটিতে চাপ দিচ্ছিল, পরমুহূর্তে মাটি ছড়িয়েপড়ছিল, ঘোড়ার লেজের মতো গুচ্ছ ঘাসে আঘাত করছিল এবং চতুর্দিকে কাটা ঘাস ছড়িয়েপড়ছিল।
সবাইকে ডানদিকে ঘুরতে হয়েছিল এবং তারপর দশ বা পনেরো পদক্ষেপ এগিয়ে যেতে হয়েছিল। কিন্তু তারা এত দ্রুত সেখানে পৌঁছায় যে, ভারসাম্য হারিয়ে প্রায় নিচে পড়ে যাচ্ছিল। তারা একটি বিশাল গর্তের পাশে এসে দাঁড়ায়। গর্তটি প্রায় তিন মিটার চওড়া এবং পাঁচ মিটার দীর্ঘ, যার তলায় তারা গ্রিগোরেস্কুকে আপনমনে কাজ করতে দেখে। পুরো গর্তটি এতই গভীর ছিল যে, তার মাথা দেখা যাচ্ছিল না। নিজের কাজে গভীর মনোযোগের জন্য গ্রিগোরেস্কু তাদের আগমন মোটেও টের পায়নি। যখন তারা বিশাল গর্তের পাশে দাঁড়িয়েনিচের দিকে তাকিয়েছে, তখনই সে খেয়াল করে।
সেখানে নিচে, গর্তের মাঝে, তারা একটি ঘোড়া দেখতে পেল- পূর্ণ বয়সী, তবে মাটির তৈরি। প্রথমে তারা শুধু মাটির তৈরি ঘোড়াটি দেখল; তারপর দেখল যে, সেই ঘোড়াটি মাথা উঁচু করে আছে, দাঁত বের করে দেখাচ্ছে এবং মুখে ফেনা তুলছে। ঘোড়াটি ভয়ঙ্কর শক্তিতে দৌড়াচ্ছে, যেন কোথাও পালাচ্ছে। তাই শেষের দিকে একসময় তারা লক্ষ্য করল যে, গ্রিগোরেস্কু বড়এক জায়গার আগাছা পরিষ্কার করেছে এবং এই বিশাল গর্ত খনন করেছে। তবে সে গর্তের মধ্যিখানে ঘোড়ার কাছ থেকে এমনভাবে মাটি সরিয়ে দেয়, যা দেখে মনে হয় যে, ঘোড়াটি ভয় পেয়ে ফেনা ভরা মুখে প্রাণপণ দৌড়াচ্ছে; সে ঘোড়াটি খুঁড়েবের করে মুক্ত করেছে এবং পূর্ণ বয়স্ক প্রাণিকে দৃশ্যমান করেছে। প্রাণিটি ভয়ানক আতঙ্কে ছুটছে, যেন মাটির নিচের কোনো কিছুর কবল থেকে পালাচ্ছে।
তারা সবাই হতবাক হয়েদাঁড়িয়েথাকে এবং গ্রিগোরেস্কুকে দেখে। গ্রিগোরেস্কু তাদের উপস্থিতি টের না পেয়ে একাগ্রতার সঙ্গে কাজ করতে থাকে।
সে দশ দিন ধরে খুঁড়ছে- তারা গর্তের পাশে দাঁড়িয়ে নিজেদের মনে ভাবছিল।
সে ভোরে এবং সকালে খুঁড়ছে, এমনকী দিনের সবটুকু সময়ও।
কারও একজনের পায়ের তলায় মাটি সরে যায় এবং গ্রিগোরেস্কু উপরে তাকায়। সে এক মুহূর্তের জন্য থামে, মাথা আনত করে সম্ভাষণ করে এবং পুনরায় কাজে মনোনিবেশ করে।
শিল্পীরা এক ধরনের অস্বস্তি অনুভব করে। কারোর কিছু বলতে হবে, তারা ভাবল।
এটা অসাধারণ, আইয়ন, ফরাসি চিত্রশিল্পী নিচু স্বরে বলল।
গ্রিগোরেস্কু আবার কাজ থামায় এবং গর্ত থেকে বের হওয়ার জন্য একটি মই বেয়েউপরে ওঠে। তারপর কোদাল থেকে মাটি ঝেড়ে ফেলার জন্য পাশে রাখা নিড়ানি দিয়েপরিষ্কার করে এবং রুমাল দিয়েকপালের ঘাম মোছে। অবশেষে সে তাদের দিকে এগিয়েআসে এবং ধীর গতিতে হাত তুলে পুরো দৃশ্যভূমি দেখায়।
এখনও অনেকগুলো বাকি আছে, সে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল।
তারপর সে তার কোদাল উঁচু করে, মই বেয়েগর্তের নিচে নামল এবং পুনরায় খনন কাজ শুরু করে।
বাকি শিল্পীরা কিছুক্ষণ মাথা নাড়ছিল। অবশেষে তারা নীরবে প্রধান ভবনের দিকে ফিরে যায়।
এখন কেবল বিদায়পর্ব বাকি রয়েছে। পরিচালকরা খানাপিনার বিশাল আয়োজন করেছিলেন এবং তা ছিল গত সন্ধ্যায়। পরদিন সকালে তাঁবুর প্রবেশপথ বন্ধ ছিল এবং সেখানে একটি ভাড়া করা বাস থেমে ছিল। যারা বুখারেস্ট থেকে অথবা হাঙ্গেরি থেকে গাড়িতে এসেছিল, তাদের কয়েকজন তাবু ছেড়েচলে গেছে।
গ্রিগোরেস্কু বুটজুতা আয়োজকদের কাছে ফিরিয়েদিয়ে পুনরায় নিজের জুতা পায়ে দেয়। সে তাদের সঙ্গে কিছু সময় ব্যয় করে। তারপর তাঁবু থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে, গ্রামের কাছে রাস্তার এক বাঁকে, তিনি হঠাৎ চালককে বাস থামাতে বললেন। সে কিছু একটা বলল, হয়তো এখান থেকে একা যাওয়াই তার জন্য ভালো হবে। কিন্তু কেউ পরিষ্কারভাবে তার কথা বুঝতে পারল না। সে আসলে কী বলল, তা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল না। কেননা তার কণ্ঠস্বর অস্ফুট ছিল।
বাসটি বাঁক পেরিয়ে যাওয়ার পরই দৃশ্যের অন্তরালে চলে যায়, গ্রিগোরেস্কু রাস্তা অতিক্রম করার জন্য ঘুরল এবং হঠাৎ করে নিচের যাওয়ার সর্পিল পথের শেষে অদৃশ্য হয়েগেল। পেছনে শুধু ভূসম্পত্তি রয়েগেল, পাহাড়ের নীরব নিয়ম-কানুন, বিশাল জায়গাজুড়েপড়েথাকা মৃত পাতায় ঢেকে থাকা জমিন, সীমাহীন প্রান্তর- যা নিচের সব কিছুকে আড়াল করে রেখেছে, গোপন করেছে এবং আচ্ছাদিত করে রেখেছে।
গল্পসূত্র:
‘বাইরে একটা কিছু জ্বলছে’ গল্পটি লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের ইংরেজিতে ‘সামথিং ইজ বার্নিং আউটসাইড’ গল্পের অনুবাদ। গল্পটি হাঙ্গেরীয় ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ওট্টিলিয়ে মুজেট, যা বৃটেনের দ্য গার্ডিয়ান ম্যাগাজিনে ১৭ জুন ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখ্য, জাদুবাস্তববাদধর্মী এই গল্পটি পরে ২০১৩ সালে ইংরেজিতে অনূদিত লেখকের সিওবো দেয়ার বিলৌ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।