alt

ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেলজয়

মানব সভ্যতার আত্মবিশ্লেষণের আয়না

আরণ্যক শামছ

: বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫

লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখনী এক ধরনের নীরব, ঘনীভূত অনুধাবন- এমন ভাষা যার সঙ্গে পড়লে পাঠকের নড়বড়ে মন মসৃণ তীক্ষ্ণতায় নড়ে ওঠে। তাঁর বাক্যগুলি কখনো কখনো একেবারে দীর্ঘ হয়ে যায়, কিন্তু সেই দীর্ঘতা আসলে সময়কে, নিঃশ্বাসকে, ইতিহাসকে... এক ধারায় মণ্ডিত করে। এই ভাষাতাত্ত্বিক নির্ভরতা এবং নান্দনিক বাধ্যবাধকতা তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত একটি ছোটগল্প ও তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে স্পষ্টভাবেই ধরা পড়ে। তাঁর “An Angel Passed Above Us”- গল্পে যুদ্ধের নদীর ওপর ভাসমান দুই মানুষের কথোপকথন, এবং সাক্ষাৎকারে তিনি বারবার বলেন যে অ্যাপোক্যালিপ্স কোনো এক ভাঙ্গনচিহ্নিত ভবিষ্যৎ ঘটনার নাম নয়; বরং এটি এখনকার জটিল বাস্তবতার ধারাবাহিক অবস্থা-“The apocalypse is now” এই মাত্রাটাই তাঁর সাহিত্যের ন্যায়-তত্ত্বকে নোবেলকমিটির ভাষায় ‘দূরদর্শী অনুসন্ধান’ হিসেবে আখ্যায়িত হয়।

সাক্ষাৎকারে ক্রাসনাহোরকাই ইউক্রেনের যুদ্ধকে ব্যক্তিগত ও ঐতিহাসিক পটভূমি থেকে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, ইউরোপের ইতিহাস পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।? তিনি বলেন, এমন রক্তক্ষয়ী ধারার পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে- যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দেয় এবং তার নিজের দেশের (হাঙ্গেরি) নীরব নীতিকে নৈতিকভাবে ব্যথিত করে। তিনি রাজনৈতিক বিশ্লেষণের চেয়ে বেশি ঐতিহাসিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণ অবলম্বন করেন। তাঁর মতে, “নিরপেক্ষতার ছদ্মবেশে নীরব থাকা একটি নৈতিক প্রলেপ, যা সহিংসতার এক ধরনের অংশ হয়ে পড়ে।” তাঁর Yale Review এর সাক্ষাৎকারের এই কথাগুলো তাঁর সাহিত্যকর্মের প্রতিটি অংশেই গভীরভাবে পরিলক্ষিত হয়।

নোবেলজয় তাঁর সাহিত্যজীবনের এক সুদীর্ঘ প্রতীক্ষার ফসল। তাঁর এই জয়ের নান্দিক ব্যাখ্যাও রয়েছে। নোবেলকমিটি ক্রাসনাহোরকাইকে সম্মানিত করেছেন এই কারণে যে- তিনি ভাষাকে এমন এক নৈতিক ও দার্শনিক সরঞ্জামে পরিণত করেছেন, যা ভেঙে পড়ার সময়েও শিল্পের শক্তিকে প্রতিষ্ঠিত রাখে। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তাঁর কাজ “in the midst of apocalyptic terror, reaffirms the power of art”- অর্থাৎ “ধ্বংসাত্মক সময়েও শিল্পের শক্তি ফেরত আনে।” এইভাবে নোবেল পুরস্কার তাঁর দায়িত্বশীল ভাষা ও ধারাবাহিক থিমকে আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতি দিয়েছে। শুধু ব্যক্তিগত সাহিত্যকর্ম নয়, বরং মানবতার সেই দীর্ঘ-দুর্বল সময়ের ন্যারেটিভটিকেই তারা সম্মান করেছে। বিশ্ব মিডিয়াও দ্রুত এই বিষয়টি ধরতে পেরেছে।রিপোর্টার, সাহিত্যিক সমালোচক, এবং চলচ্চিত্রকার- সবাই ক্রাসনাহোরকাইকে ‘master of the apocalypse’ নামে উল্লেখ করেন। কারণ তার লেখায় ধ্বংস ও সৌন্দর্যের আন্তঃসংলাপ এত গভীর যে, তা আজকের রাজনীতিক এবং সাংস্কৃতিক বন্ধনেও সরাসরি আপাতসংযোগ স্থাপন করে।

ক্রাসনাহোরকাই নিজে নোবেলজয়ের পর যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, তা ছিল গর্ববোধের চেয়ে এক বিমূঢ় শান্তির প্রকাশ। তিনি বলেছেন, “Im very proud and very happy,” তবে সেই খুশির সঙ্গে তিনি সতর্কতাও ব্যক্ত করেছেন।পুরস্কারটি তাকে ভীত করেছে। কারণ এটি অতি সহজে ব্যক্তিগত সাফল্যকে সহজলভ্য বিতরণের উপকরণ করে ফেলতে পারে। অথচ তাঁর দৃষ্টিতে সাহিত্য মূলত “a way of being faithful to words.” তিনি ব্যক্তিগত মর্যাদাকে নিচু করে ভাষার মর্যাদা ও স্থায়িত্বকে সামনে এনেছেন এবং এই অবস্থানটি তাঁর লেখার নৈতিক কোডের সঙ্গে সুসংগত। নোবেলপ্রাপ্তির পর তাঁর এই উপরোক্ত প্রতিক্রিয়া পাঠকের কাছে দেখায়- ক্রাসনাহোরকাই কেবল কাহিনী শোনান না, তিনি ভাষার প্রতি এক ধরনের আধ্যাত্মিক আনুগত্যের ছাত্রও বটে।

তার প্রধান রচনাসমূহ- Satantango, The Melancholy of Resistance, War and War, Seiobo There Below,. এগুলো কোনো একক রাজনৈতিক মিছিলের ইতিহাস নয়; বরঞ্চ প্রতিটি গ্রন্থে তিনি ধীর গতিতে, পরিপূর্ণ বাক্যে মানুষের অপরাপর ক্ষতি, আশা ও নীরব প্রতিরোধকে খুঁজে বের করেছেন। Satantango-তে গ্রামের অভ্যন্তরীণ পতন এবং প্রলোভনে পড়া মানুষের চিত্রকল্প এমনভাবে লেখা হয়েছে যে পাঠক নিজেই মাটির গন্ধ, কলেবরের ‘কন্দ-শীত’ অনুভব করে; The Melancholy of Resistance-এ সাহিত্যে ভয়ের ম্যানিফেস্টো, সাম্প্রতিক ইতিহাস ও আধুনিকতার অস্থিরতার প্রতিফলন, আর Seiobo There Below-এ সৌন্দর্য ও শিল্পের নৈর্ব্যক্তিক, আধ্যাত্মিক উপস্থিতি- সব কিছুর মধ্যেই ক্রাসনাহোরকাইয়ের মৌলিক দায়িত্ব আছে; আর তা হলো মানুষের ক্ষয়ক্ষতি ও নৈতিক টিকে থাকার চেষ্টাকে ভাষায় বন্দি করা। এ কারণেই তাঁকে নোবেলকমিটি কর্তৃক ‘visionary oeuvres’ আখ্যা দেয়া পাঠকসমাজের সামনে একটি নতুন কিন্তু সঠিক প্রেক্ষাপট উপহার দেয়। যেখানে তাঁর কাজ একক কাহিনী নয়, বরং একটি ধারাবাহিকতা- যা পৃথিবীর ভাঙ্গন ও পুনর্গঠন- উভয়কে একই লেন্সে ধারণ করে।

বিশ্বসাহিত্যের পরিচিত লেখকগণ এই জয়ের প্রতিক্রিয়ায় নানা রকম মন্তব্য করেছেন; তাঁরা ক্রাসনাহোরকাইকে ভাষার সীমা ঠেলে দেওয়ার নকশাকারী হিসেবে অভিহিত করেছেন- কেউ কেউ বলেছেন, তার দীর্ঘ, অনবরত বাক্যগুলো এমন এক অবস্থা সৃষ্টি করে যেখানে পাঠক “সময়ের প্রবাহকে শ্বাসপ্রশ্বাসের ভেতরে বেঁধে ফেলে” গল্পের ভেতরে ডুবে যায়। অনুরূপভাবে চলচ্চিত্রকার ‘বেলা তার’-এর সাথে তাঁর কাজের সংযোগও অনেক সমালোচক ও পাঠকের চোখে ক্রাসনাহোরকাইকে নতুনভাবে খুলে দিয়েছে। কারণ তার-ভিত্তিক টানা সিনেমাটোগ্রাফি ও দার্শনিক থিমগুলো একে অপরকে বহুগুণে উত্থাপন করে। কিছু বিশ্লেষক বলেছেন, তার সাহিত্য আজকের বিশ্বরাজনীতির অনিশ্চয়তার জন্য এক অপ্রত্যাশিত প্রতিবেদন। যখন রাষ্ট্র ব্যবস্থা ভাঙছে বা নিরপেক্ষতার নামে নীরবতা বাড়ছে, তখন তার কল্পিত গ্রাম, তার যুদ্ধের বর্ণনা, আমাদের সামাজিক সম্পর্কের অপব্যবহারক চিত্রকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

তাঁর ভাষা ও কাহিনী রচনার কৌশল সাম্প্রতিক সময়ের পাঠকের জন্য চ্যালেঞ্জিং হলেও তা সাড়া দিতে বাধ্য করে। কারণ তিনি সরল নাটকীয়তার বদলে গভীরতর অনুধাবনের কাজ অনায়াসে করে ফেলেন। পাঠককে প্রতিটি দীর্ঘ বাক্যে ঢুকতে হয়, ধীরে ধীরে দেহে-মনের ঐক্য টিকিয়ে রাখতে হয়; আর সেই প্রক্রিয়াই আসলে সাহিত্যিক সমাধান। এই কারণে নোবেলজয় কেবল পুরস্কার নয়- এটি পাঠ্য-অনুশীলনের স্বীকৃতি, এমন এক অনুশীলন যেখানে ধৈর্যই মূল মাপকাঠি। খোলাখুলি বলা যায়, আজকের দ্রুত ভোগ্য তথ্যজগতে ক্রাসনাহোরকাই পাঠককে ‘ধীরে পড়া’ শেখায়। এটি নোবেল কমিটির বিবৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যেখানে তারা বলেন তিনি এমন সময়ে শিল্পের শক্তিকে পুনঃনিশ্চিত করেছেন যখন বিশ্ব অপোক্যালিপ্টিক ছায়ায় কুয়াশাচ্ছন্ন।

এখানে একটি প্রাসঙ্গিক দিক হলো- তার লেখায় রাজনৈতিক আলোকপাত থাকলেও তা সরাসরি রাজনৈতিক সারথি নয়; তিনি রাজনৈতিক অনুষঙ্গকে মানবিক সেন্সরে রূপান্তর করেন। উদাহরণস্বরূপ, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক আগ্রাসনকে তিনি শুধু আন্তর্জাতিক কূটনীতির প্রেক্ষিতে দেখেন না; তিনি সেটিকে মানুষের দৈনন্দিন ক্ষয়, আশার ও কল্পনার সঙ্গে বেঁধে দেন। একই কৌশল তার উপন্যাসগুলোতেও প্রযোজ্য। ফলে তাঁর সাহিত্য এখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে: যেখানে অনৈতিক নিরপেক্ষতা মানুষকে নীরব অংশগ্রহণের ভাষা হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর লেখায় ভাষা একটি নৈতিক প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে কাজ করে।

লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের সাহিত্যকর্মের ভেতর দিয়ে আমরা ধীরে ধীরে এমন এক ভূখণ্ডে প্রবেশ করি, যেখানে ভাষা শুধু কাহিনী বলার মাধ্যম নয়, বরং এক ধরনের অস্তিত্বের নিঃশ্বাস। তাঁর প্রথম উপন্যাস Satantango (১৯৮৫) যেন এক অনন্ত বৃষ্টির ভেতর ঘূর্ণায়মান গ্রামীণ মহাকাব্য। হাঙ্গেরির একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রামে মানুষজন তাদের জীবনের ভাঙাচোরা স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে আছে, আর ফিরে আসে এক রহস্যময় চরিত্র- ইরিমিয়াস। সে মুক্তির প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসে, কিন্তু পাঠক বুঝতে পারে এই মুক্তিই ধ্বংসের অন্য নাম। ক্রাসনাহোরকাই এখানে রাজনৈতিক রূপকের মধ্য দিয়ে দেখান- কীভাবে আশা এবং প্রতারণা একে অপরকে প্রতিফলিত করে। তাঁর দীর্ঘ বাক্যগুলো এমনভাবে প্রবাহিত হয় যে, প্রতিটি চরিত্রের নিঃশ্বাস, নীরবতা, হাহাকার একত্রে মিশে যায় এক শব্দতরঙ্গে। এই উপন্যাসের ভাষা একটি নদীর মতো, যা ধীরে ধীরে বিস্তৃত হয়, আবার গহীনে ডুবে যায়; এটি একযোগে বাস্তব ও অতিবাস্তব।

পরবর্তী উপন্যাস The Melancholy of Resistance (১৯৮৯) ক্রাসনাহোরকাইয়ের দার্শনিক ও রাজনৈতিক পরিসরের সম্প্রসারণ। এখানে একটি শহরে হঠাৎ হাজির হয় এক বিশাল মৃত তিমি, যা দেখতে আসে হাজারো মানুষ। এর চারপাশে অজানা আতঙ্ক, গুজব ও ভীতির জন্ম হয়। এই তিমি ক্রাসনাহোরকাইয়ের প্রতীক- সভ্যতার বিকৃত আত্মপ্রতিকৃতি, যেখানে জনগণ নিজেদের ভয়, কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাসে ডুবে যায়। উপন্যাসটি মূলত গণমনস্তত্ত্বের এক সূক্ষ্ম অধ্যয়ন। লেখক এখানে রাজনীতি, ধর্ম, গুজব, ও ক্ষমতার মধ্যকার জৈব সম্পর্ক অন্বেষণ করেন। সেই শহরটি যেন পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি- যেখানে কিছু মানুষ শৃঙ্খলা বজায় রাখতে চায়, আর বাকিরা চায় ধ্বংসের উল্লাস। তাঁর দৃষ্টিতে, এই বিভাজন কোনো জাতীয় নয়, এটি চিরন্তন মানবিক বাস্তবতা।

এরপরের সৃষ্টি War and War (১৯৯৯) তাঁর সবচেয়ে আত্মসন্ধানী ও আধ্যাত্মিক কাজ। এটি একজন হাঙ্গেরীয় আর্কাইভ কর্মচারী গিয়ার্গি কোরিনের গল্প, যে একটি প্রাচীন পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার করে এবং বিশ্বাস করে এটি মানবজাতির বাঁচার শেষ সূত্র। সে পাণ্ডুলিপিটি অনলাইনে প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে আসে, যেন পৃথিবীর ধ্বংসের আগেই এই বার্তা টিকে থাকে। এই উপন্যাসে প্রযুক্তি, ইতিহাস এবং আধ্যাত্মিকতা এক অনবদ্য ঘূর্ণিপাকে মিশে যায়। ক্রাসনাহোরকাই এখানে মানব সভ্যতার মূলে প্রশ্ন তোলেন: “যদি মানবতা ধ্বংসের দিকে যায়, তাহলে শিল্প কি তাকে রক্ষা করতে পারে?” তাঁর লেখায় উত্তর নেই, আছে কেবল অনুসন্ধান, এক অবিরাম নৈতিক যাত্রা।

War and War-এর ভাষা অন্য যে কোনো উপন্যাসের তুলনায় আরও ধীর, আরও গভীর; প্রতিটি অনুচ্ছেদ যেন কোনো সাধুর প্রার্থনা, যেখানে ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ মিলেমিশে যায় এক জটিল আলোয়।

তাঁর সাহিত্যিক আধ্যাত্মিকতার শীর্ষপ্রকাশ ঘটে Seiobo There Below (২০০৮) উপন্যাসে। এটি নানা স্থানে, নানা সময়ে ঘটে যাওয়া আধ্যাত্মিক সৌন্দর্যের খণ্ডচিত্র- কিয়োটো, ভেনিস, গ্রিস, হাঙ্গেরি- সব জায়গায় একটাই অনুসন্ধান: সৌন্দর্য আসলে কী? এখানে তিনি শিল্প ও ঈশ্বরের সম্পর্ককে অন্বেষণ করেছেন এমনভাবে, যেন প্রতিটি চিত্রকর্ম, প্রতিটি ভাস্কর্য, প্রতিটি মন্দির এক জীবন্ত প্রার্থনা। এই উপন্যাসের একটি লাইন বিশেষভাবে আলোচিত- “Beauty demands precision” অর্থাৎ “সৌন্দর্য ধরে রাখতে নির্ভুলতার প্রয়োজন।” আবার অন্য জায়গায় তিনি ভিন্ন সুরে কথা বলেন কিন্তু সেটাও প্রাসঙ্গিক মনে হয়। তাঁর মতে সৌন্দর্য এক ধরনের শৃঙ্খলা, যা বিশৃঙ্খলার ভেতর থেকে জন্ম নেয়। ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভাষা এখানে যেন বৌদ্ধ মন্ত্রের মতো শান্ত ও গভীর, যেখানে পাঠক একসাথে অনুভব করে মানুষ ও ঈশ্বরের দূরত্ব ও নৈকট্য।

এই চারটি উপন্যাসের ভেতর দিয়ে ক্রাসনাহোরকাই এক অদ্ভুত সেতুবন্ধন তৈরি করেছেন- রাজনীতি, ইতিহাস, ধর্ম, দর্শন, ও মানুষের অন্তর্লোকের মধ্যে। তাঁর লেখায় চরিত্ররা কখনোই একক ব্যক্তি নয়; তারা এক জাতি, এক সময়, এক সভ্যতার প্রতীক। তাঁর বাক্যের ভেতর শব্দ যেমন নীরবতাকে ভাঙে, তেমনি নীরবতাও শব্দকে অর্থ দেয়। এই দ্বন্দ্বই তাঁর সাহিত্যকে বিশ্বজনীন করে তোলে।

বিশ্বের সমালোচকরা ক্রাসনাহোরকাইকে “slow reading’s prophet” বলে আখ্যা দিয়েছেন, কারণ তিনি এমন সময়ে লিখছেন যখন মানুষ দ্রুত তথ্য খুঁজে পেতে চায়; অথচ তাঁর লেখায় পাঠককে থামতে হয়, চিন্তা করতে হয়, বাক্যের গতি মাপতে হয়। এই ধৈর্যই পাঠককে তার সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়। সাহিত্য সমালোচক সুসান বার্নোস্কি (Susan Bernofsky), যিনি তাঁর অনুবাদকও, একবার বলেছিলেন- “Reading Krasznahorkai is like watching someone build a cathedral, stone by stone, word by word.”

নোবেল পুরস্কারের জন্য এই ধৈর্য, এই নৈতিকতা, এই মানবিক অন্তর্দৃষ্টি-ই তাঁকে সবচেয়ে উপযুক্ত প্রার্থী করে তুলেছে। কমিটি বুঝেছে, পৃথিবী এখন দ্রুততা, ভয় ও বিভ্রান্তির মধ্যে দৌড়াচ্ছে; আর এমন সময়ে ক্রাসনাহোরকাই আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে ধীরগতি আবার নৈতিকতার রূপ নিতে পারে। তাঁর প্রতিটি উপন্যাস একেকটি ধ্যানমগ্নতার বই- যেখানে ভাষা প্রার্থনা, মানুষ এক ভ্রমণকারী, আর বিশ্ব এক অনন্ত প্রশ্নচিহ্ন।

লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল প্রাপ্তি ২০২৫ সালের সাহিত্যের ইতিহাসে এক মাইলফলক, কারণ এটি শুধু একজন লেখকের সাফল্যের স্বীকৃতি নয়- এটি এক ধরনের প্রতিবাদ, এক ধরনের দার্শনিক ঘোষণা। তাঁর নাম ঘোষণার মুহূর্তে সারা বিশ্বের সমালোচকরা একে “an award for slowness and spiritual courage” বলে অভিহিত করেছেন। যে সময়ে সাহিত্যের মানদ- প্রায়শই বিক্রির সংখ্যা, অনলাইন জনপ্রিয়তা বা রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতার ওপর নির্ভর করে, সে সময়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের মতো একান্ত, ধ্যানমগ্ন, গূঢ় লেখকের পুরস্কার প্রাপ্তি যেন মানব আত্মার প্রতি এক বিশ্বাস পুনঃপ্রতিষ্ঠা।

নোবেল কমিটি ঘোষণায় বলেছিল, এই পুরস্কার “For his visionary prose that transforms despair into a form of beauty, and his uncompromising portrayal of humanityÕs longing for meaning amidst chaos.” অর্থাৎ “এই পুরস্কার তার দূরদর্শী গদ্যের জন্য যা হতাশাকে সৌন্দযের্র রূপে রূপান্তরিত করে, এবং বিশৃঙ্খলার মধ্যে মানবতার অর্থের আকাক্সক্ষার আপোসহীন চিত্রায়নের জন্য।”

এই একটিমাত্র বাক্যের মধ্যে ক্রাসনাহোরকাইয়ের সাহিত্যচিন্তার সারাংশ ধরা পড়েছে। তিনি হতাশাকে অস্বীকার করেন না- বরং তাকে শিল্পে পরিণত করেন, কারণ তাঁর বিশ্বাস, হতাশাই মানুষের সত্যিকারের আর্তি, এবং সেই আর্তিতেই জন্ম নেয় সৌন্দর্য।

পুরস্কার ঘোষণার পর ইউরোপের প্রধান পত্রিকাগুলোতে তাঁর লেখাকে একুশ শতাব্দীর “moral map of humanityÓ e‡j eY©bv Kiv nq| The Guardian wj‡LwQj:ÒKrasznahorkai writes as if time itself were collapsing, yet through that collapse, we rediscover our conscience.”

অর্থাৎ “ক্রাজনাহোরকাই এমনভাবে লেখেন যেন সময় নিজেই ভেঙে পড়ছে, তবুও সেই পতনের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের বিবেককে পুনরায় আবিষ্কার করি।”

অন্যদিকে The New Yorker মন্তব্য করে:“He is the Dostoevsky of our age—less judgmental, more meditative.” অর্থাৎ “তিনি আমাদের সময়ের দস্তয়েভস্কি- কম বিচারপ্রবণ, বেশি ধ্যানময়।”

এই তুলনা যথার্থ, কারণ ক্রাসনাহোরকাইও দস্তয়েভস্কির মতো মানব আত্মার গভীর অন্ধকারে আলো খুঁজে বেড়ান। তাঁর চরিত্ররা নৈতিকতা বা ধর্মীয় আদর্শে বিশ্বাস করে না- তারা শুধু বাঁচার অর্থ খুঁজে বেড়ায়, এবং এই অনুসন্ধানই তাঁর সাহিত্যের আধ্যাত্মিক শক্তি।

আজকের পৃথিবী একটি অনন্ত গতির দুঃস্বপ্নে বন্দি- খবরের ঝড়, যুদ্ধের উন্মাদনা, বাজারের হাহাকার, প্রযুক্তির তাড়না। এই সময়ের পাঠক এক পৃষ্ঠায় কয়েক সেকেন্ড ব্যয় করতেও দ্বিধা করে। সেই বিশ্বেক্রাসনাহোরকাই এক মূক দ্রোহী- তিনি বলেন, ধীর হও, ভাবো, শব্দের মধ্য দিয়ে আত্মাকে ছুঁয়ে দেখো।

তাঁর সাহিত্য আসলে “resistance through contemplation”- নীরবতার মাধ্যমে প্রতিবাদ।

তিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, সভ্যতার প্রকৃত সংকট রাজনৈতিক নয়, প্রযুক্তিগতও নয়- এটি নৈতিক। মানুষ আজ তথ্য জানে, কিন্তু সত্য জানে না; কথা বলে, কিন্তু শোনে না; বাঁচে, কিন্তু অনুভব করে না। এই অচেতন অস্তিত্বই ক্রাসনাহোরকাইয়ের উপন্যাসে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রতিপক্ষ। Satantango-এর গ্রামীণ মানুষ হোক, বা War and War-এর একাকী কোরিন- সবাই সেই হারিয়ে যাওয়া মানবতার প্রতীক।

এই কারণেই ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল প্রাপ্তি কেবল সাহিত্যিক স্বীকৃতি নয়; এটি এক ধরনের দার্শনিক আহ্বান:“যদি সভ্যতা সত্যিই এগিয়ে যেতে চায়, তবে তাকে প্রথমে থামতে হবে।”

ক্রাসনাহোরকাইয়ের শেকড় গভীরভাবে পূর্ব ইউরোপের ইতিহাসে প্রোথিত। হাঙ্গেরির রাজনৈতিক দমন, সোভিয়েত প্রভাব, এবং পরবর্তী রূপান্তর- সবই তাঁর চরিত্রে প্রতিফলিত। কিন্তু তিনি কখনো কেবল “Post-Communist writer” নন। তাঁর দৃষ্টি সার্বজনীন। তিনি বলেছেন, “My country is not Hungary, my country is despair.” অর্থাৎ “আমার দেশ হাঙ্গেরি নয়, আমার দেশের নাম হতাশা।” এই এক বাক্যে তিনি সীমান্ত পেরিয়ে যান; তাঁর সাহিত্য হয়ে ওঠে সমগ্র মানবজাতির ভাষা।? তিনি দেখান, ভয় ও নৈরাশ্য কোনো জাতীয় অনুভূতি নয়- এটি মানব অভিজ্ঞতার অভিন্ন অংশ।

বাংলাদেশ ও তৃতীয় বিশ্বের প্রেক্ষাপটে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা

যদি আমরা তাঁর সাহিত্যকে বাংলাদেশের কিংবা তৃতীয় বিশ্বের রাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকে দেখি, আমরা আশ্চর্য মিল খুঁজে পাই। ক্রাসনাহোরকাইয়ের মানুষ যেমন বারবার প্রতিশ্রুতির ফাঁদে পড়ে, মুক্তির নামে নতুন শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়- তেমনি আমাদের সমাজও রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রতারণার চক্রে বন্দি। তাঁর The Melancholy of Resistance-এর শহর যেমন গুজব, ভয় ও অন্ধবিশ্বাসে দগ্ধ, আমাদের সমাজও তেমনি বিভক্ত বিভ্রান্তির আগুনে পুড়ছে।

তাঁর লেখায় যে প্রশ্নটি বারবার ফিরে আসে-

“Who will resist the decay?”

এই প্রশ্ন আজ বাংলাদেশের বাস্তবতাতেও প্রযোজ্য- শিক্ষা, নৈতিকতা ও মানবিক চেতনার পতনের যুগে আমরা কারা প্রতিরোধ করবো, কেমন করে?লাসলো ক্রাসনাহোরকাই আমাদের শেখান, সাহিত্য শুধু শব্দ নয়- এটি নৈতিক চেতনার পুনর্জন্ম। তাঁর প্রতিটি বাক্যে এক ধরনের প্রার্থনা আছে, যেন তিনি মানবতার জন্য লিখছেন, ক্ষমতার বিরুদ্ধে নয়, বরং ভেতরের অন্ধকারের বিরুদ্ধে। তিনি দস্তয়েভস্কির উত্তরসূরি, কাফকার সহযাত্রী, এবং বোর্হেসের নীরব উত্তরাধিকারী। কিন্তু তাঁর নিজের জগৎ একান্ত- যেখানে ধ্বংস মানেই সৌন্দর্যের সূচনা।

এই কারণেই ২০২৫ সালের নোবেল পুরস্কার এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়- সত্যিকারের সাহিত্য কখনো বাজারমুখী নয়, বরং সময়ের বিপরীতে দাঁড়িয়ে নীরবে মানুষের আত্মাকে বাঁচিয়ে রাখে।

ক্রাসনাহোরকাই নিজেই বলেছেন: “Writing is a slow act of resistance against oblivion.” এই ‘ংষড়ি ধপঃ’-এর মধ্যেই নিহিত আছে মানব সভ্যতার পরিত্রাণ। যে যুগে মানুষ দ্রুত ভুলে যায়, ক্রাসনাহোরকাই আমাদের শেখান কীভাবে মনে রাখা যায়- কীভাবে শব্দকে বিশ্বাসে, আর বিশ্বাসকে নৈতিকতায় রূপান্তর করা যায়।

কার্তিকের স্নান

আমি- শেষ

ছবি

মহিবুল আলমের কবিতায় নদী ও নারী

ছবি

কবি মাহমুদ কামাল ও নিমগ্ন আত্মার সাধক

ছবি

স্পর্শ

ছবি

নুরুন্নাহার মুন্নির গল্প

ছবি

মাটির মমতায় হেমন্ত বিকেল

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

জীবনানন্দ দাশ দূর-সময়ের সার্বভৌম কবি

ছবি

পথ ভিন্ন : প্রসঙ্গ লালন

ছবি

মার্গারেট অ্যাটউড ‘রানিং দ্য ব্যাট’

ছবি

এলোমেলো স্মৃতির সমরেশ মজুমদার

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বিমল গুহের কবিতার অন্তর্জগৎ ও শিল্পৈশ্বর্য

ছবি

কবিতার সুনীল সুনীলের কবিতা

ছবি

রূপান্তরের অকথিত গল্পটা

ছবি

বাইরে একটা কিছু জ্বলছে

ছবি

‘কাফকার মতো হবো বলে আইন পড়েছিলাম’

ছবি

সত্যেন সেনের উপন্যাস: মিথ ও ইতিহাসলগ্ন মানুষ

ছবি

বিস্ময়ের সীমা নাই

ছবি

নগর বাউল ও ত্রিকালদর্শী সন্ত কবি শামসুর রাহমান

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ও বন্ধু আমার

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

শামসুর রাহমানের কবিতায় ‘মিথ’

ছবি

বহুমাত্রিক শামসুর রাহমান

ছবি

দূর-সময়ের সার্বভৌম কবি

ছবি

মাহফুজ আল-হোসেন-এর দশটি কবিতা

ছবি

মনোজগতের অন্বেষায়

সাময়িকী কবিতা

ছবি

এক ঘর রোদ

ছবি

দ্রোহের রম্য পঙ্ক্তিমালা

ছবি

সংবেদী রঙে ও রেখায় প্রাণের উন্মোচন

ছবি

অলস দিনের হাওয়া

ছবি

লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের মর্মস্পর্শী ও দূরদর্শী সাহিত্যকর্ম

tab

ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেলজয়

মানব সভ্যতার আত্মবিশ্লেষণের আয়না

আরণ্যক শামছ

বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫

লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখনী এক ধরনের নীরব, ঘনীভূত অনুধাবন- এমন ভাষা যার সঙ্গে পড়লে পাঠকের নড়বড়ে মন মসৃণ তীক্ষ্ণতায় নড়ে ওঠে। তাঁর বাক্যগুলি কখনো কখনো একেবারে দীর্ঘ হয়ে যায়, কিন্তু সেই দীর্ঘতা আসলে সময়কে, নিঃশ্বাসকে, ইতিহাসকে... এক ধারায় মণ্ডিত করে। এই ভাষাতাত্ত্বিক নির্ভরতা এবং নান্দনিক বাধ্যবাধকতা তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত একটি ছোটগল্প ও তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে স্পষ্টভাবেই ধরা পড়ে। তাঁর “An Angel Passed Above Us”- গল্পে যুদ্ধের নদীর ওপর ভাসমান দুই মানুষের কথোপকথন, এবং সাক্ষাৎকারে তিনি বারবার বলেন যে অ্যাপোক্যালিপ্স কোনো এক ভাঙ্গনচিহ্নিত ভবিষ্যৎ ঘটনার নাম নয়; বরং এটি এখনকার জটিল বাস্তবতার ধারাবাহিক অবস্থা-“The apocalypse is now” এই মাত্রাটাই তাঁর সাহিত্যের ন্যায়-তত্ত্বকে নোবেলকমিটির ভাষায় ‘দূরদর্শী অনুসন্ধান’ হিসেবে আখ্যায়িত হয়।

সাক্ষাৎকারে ক্রাসনাহোরকাই ইউক্রেনের যুদ্ধকে ব্যক্তিগত ও ঐতিহাসিক পটভূমি থেকে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, ইউরোপের ইতিহাস পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।? তিনি বলেন, এমন রক্তক্ষয়ী ধারার পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে- যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দেয় এবং তার নিজের দেশের (হাঙ্গেরি) নীরব নীতিকে নৈতিকভাবে ব্যথিত করে। তিনি রাজনৈতিক বিশ্লেষণের চেয়ে বেশি ঐতিহাসিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণ অবলম্বন করেন। তাঁর মতে, “নিরপেক্ষতার ছদ্মবেশে নীরব থাকা একটি নৈতিক প্রলেপ, যা সহিংসতার এক ধরনের অংশ হয়ে পড়ে।” তাঁর Yale Review এর সাক্ষাৎকারের এই কথাগুলো তাঁর সাহিত্যকর্মের প্রতিটি অংশেই গভীরভাবে পরিলক্ষিত হয়।

নোবেলজয় তাঁর সাহিত্যজীবনের এক সুদীর্ঘ প্রতীক্ষার ফসল। তাঁর এই জয়ের নান্দিক ব্যাখ্যাও রয়েছে। নোবেলকমিটি ক্রাসনাহোরকাইকে সম্মানিত করেছেন এই কারণে যে- তিনি ভাষাকে এমন এক নৈতিক ও দার্শনিক সরঞ্জামে পরিণত করেছেন, যা ভেঙে পড়ার সময়েও শিল্পের শক্তিকে প্রতিষ্ঠিত রাখে। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তাঁর কাজ “in the midst of apocalyptic terror, reaffirms the power of art”- অর্থাৎ “ধ্বংসাত্মক সময়েও শিল্পের শক্তি ফেরত আনে।” এইভাবে নোবেল পুরস্কার তাঁর দায়িত্বশীল ভাষা ও ধারাবাহিক থিমকে আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতি দিয়েছে। শুধু ব্যক্তিগত সাহিত্যকর্ম নয়, বরং মানবতার সেই দীর্ঘ-দুর্বল সময়ের ন্যারেটিভটিকেই তারা সম্মান করেছে। বিশ্ব মিডিয়াও দ্রুত এই বিষয়টি ধরতে পেরেছে।রিপোর্টার, সাহিত্যিক সমালোচক, এবং চলচ্চিত্রকার- সবাই ক্রাসনাহোরকাইকে ‘master of the apocalypse’ নামে উল্লেখ করেন। কারণ তার লেখায় ধ্বংস ও সৌন্দর্যের আন্তঃসংলাপ এত গভীর যে, তা আজকের রাজনীতিক এবং সাংস্কৃতিক বন্ধনেও সরাসরি আপাতসংযোগ স্থাপন করে।

ক্রাসনাহোরকাই নিজে নোবেলজয়ের পর যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, তা ছিল গর্ববোধের চেয়ে এক বিমূঢ় শান্তির প্রকাশ। তিনি বলেছেন, “Im very proud and very happy,” তবে সেই খুশির সঙ্গে তিনি সতর্কতাও ব্যক্ত করেছেন।পুরস্কারটি তাকে ভীত করেছে। কারণ এটি অতি সহজে ব্যক্তিগত সাফল্যকে সহজলভ্য বিতরণের উপকরণ করে ফেলতে পারে। অথচ তাঁর দৃষ্টিতে সাহিত্য মূলত “a way of being faithful to words.” তিনি ব্যক্তিগত মর্যাদাকে নিচু করে ভাষার মর্যাদা ও স্থায়িত্বকে সামনে এনেছেন এবং এই অবস্থানটি তাঁর লেখার নৈতিক কোডের সঙ্গে সুসংগত। নোবেলপ্রাপ্তির পর তাঁর এই উপরোক্ত প্রতিক্রিয়া পাঠকের কাছে দেখায়- ক্রাসনাহোরকাই কেবল কাহিনী শোনান না, তিনি ভাষার প্রতি এক ধরনের আধ্যাত্মিক আনুগত্যের ছাত্রও বটে।

তার প্রধান রচনাসমূহ- Satantango, The Melancholy of Resistance, War and War, Seiobo There Below,. এগুলো কোনো একক রাজনৈতিক মিছিলের ইতিহাস নয়; বরঞ্চ প্রতিটি গ্রন্থে তিনি ধীর গতিতে, পরিপূর্ণ বাক্যে মানুষের অপরাপর ক্ষতি, আশা ও নীরব প্রতিরোধকে খুঁজে বের করেছেন। Satantango-তে গ্রামের অভ্যন্তরীণ পতন এবং প্রলোভনে পড়া মানুষের চিত্রকল্প এমনভাবে লেখা হয়েছে যে পাঠক নিজেই মাটির গন্ধ, কলেবরের ‘কন্দ-শীত’ অনুভব করে; The Melancholy of Resistance-এ সাহিত্যে ভয়ের ম্যানিফেস্টো, সাম্প্রতিক ইতিহাস ও আধুনিকতার অস্থিরতার প্রতিফলন, আর Seiobo There Below-এ সৌন্দর্য ও শিল্পের নৈর্ব্যক্তিক, আধ্যাত্মিক উপস্থিতি- সব কিছুর মধ্যেই ক্রাসনাহোরকাইয়ের মৌলিক দায়িত্ব আছে; আর তা হলো মানুষের ক্ষয়ক্ষতি ও নৈতিক টিকে থাকার চেষ্টাকে ভাষায় বন্দি করা। এ কারণেই তাঁকে নোবেলকমিটি কর্তৃক ‘visionary oeuvres’ আখ্যা দেয়া পাঠকসমাজের সামনে একটি নতুন কিন্তু সঠিক প্রেক্ষাপট উপহার দেয়। যেখানে তাঁর কাজ একক কাহিনী নয়, বরং একটি ধারাবাহিকতা- যা পৃথিবীর ভাঙ্গন ও পুনর্গঠন- উভয়কে একই লেন্সে ধারণ করে।

বিশ্বসাহিত্যের পরিচিত লেখকগণ এই জয়ের প্রতিক্রিয়ায় নানা রকম মন্তব্য করেছেন; তাঁরা ক্রাসনাহোরকাইকে ভাষার সীমা ঠেলে দেওয়ার নকশাকারী হিসেবে অভিহিত করেছেন- কেউ কেউ বলেছেন, তার দীর্ঘ, অনবরত বাক্যগুলো এমন এক অবস্থা সৃষ্টি করে যেখানে পাঠক “সময়ের প্রবাহকে শ্বাসপ্রশ্বাসের ভেতরে বেঁধে ফেলে” গল্পের ভেতরে ডুবে যায়। অনুরূপভাবে চলচ্চিত্রকার ‘বেলা তার’-এর সাথে তাঁর কাজের সংযোগও অনেক সমালোচক ও পাঠকের চোখে ক্রাসনাহোরকাইকে নতুনভাবে খুলে দিয়েছে। কারণ তার-ভিত্তিক টানা সিনেমাটোগ্রাফি ও দার্শনিক থিমগুলো একে অপরকে বহুগুণে উত্থাপন করে। কিছু বিশ্লেষক বলেছেন, তার সাহিত্য আজকের বিশ্বরাজনীতির অনিশ্চয়তার জন্য এক অপ্রত্যাশিত প্রতিবেদন। যখন রাষ্ট্র ব্যবস্থা ভাঙছে বা নিরপেক্ষতার নামে নীরবতা বাড়ছে, তখন তার কল্পিত গ্রাম, তার যুদ্ধের বর্ণনা, আমাদের সামাজিক সম্পর্কের অপব্যবহারক চিত্রকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

তাঁর ভাষা ও কাহিনী রচনার কৌশল সাম্প্রতিক সময়ের পাঠকের জন্য চ্যালেঞ্জিং হলেও তা সাড়া দিতে বাধ্য করে। কারণ তিনি সরল নাটকীয়তার বদলে গভীরতর অনুধাবনের কাজ অনায়াসে করে ফেলেন। পাঠককে প্রতিটি দীর্ঘ বাক্যে ঢুকতে হয়, ধীরে ধীরে দেহে-মনের ঐক্য টিকিয়ে রাখতে হয়; আর সেই প্রক্রিয়াই আসলে সাহিত্যিক সমাধান। এই কারণে নোবেলজয় কেবল পুরস্কার নয়- এটি পাঠ্য-অনুশীলনের স্বীকৃতি, এমন এক অনুশীলন যেখানে ধৈর্যই মূল মাপকাঠি। খোলাখুলি বলা যায়, আজকের দ্রুত ভোগ্য তথ্যজগতে ক্রাসনাহোরকাই পাঠককে ‘ধীরে পড়া’ শেখায়। এটি নোবেল কমিটির বিবৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যেখানে তারা বলেন তিনি এমন সময়ে শিল্পের শক্তিকে পুনঃনিশ্চিত করেছেন যখন বিশ্ব অপোক্যালিপ্টিক ছায়ায় কুয়াশাচ্ছন্ন।

এখানে একটি প্রাসঙ্গিক দিক হলো- তার লেখায় রাজনৈতিক আলোকপাত থাকলেও তা সরাসরি রাজনৈতিক সারথি নয়; তিনি রাজনৈতিক অনুষঙ্গকে মানবিক সেন্সরে রূপান্তর করেন। উদাহরণস্বরূপ, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক আগ্রাসনকে তিনি শুধু আন্তর্জাতিক কূটনীতির প্রেক্ষিতে দেখেন না; তিনি সেটিকে মানুষের দৈনন্দিন ক্ষয়, আশার ও কল্পনার সঙ্গে বেঁধে দেন। একই কৌশল তার উপন্যাসগুলোতেও প্রযোজ্য। ফলে তাঁর সাহিত্য এখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে: যেখানে অনৈতিক নিরপেক্ষতা মানুষকে নীরব অংশগ্রহণের ভাষা হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর লেখায় ভাষা একটি নৈতিক প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে কাজ করে।

লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের সাহিত্যকর্মের ভেতর দিয়ে আমরা ধীরে ধীরে এমন এক ভূখণ্ডে প্রবেশ করি, যেখানে ভাষা শুধু কাহিনী বলার মাধ্যম নয়, বরং এক ধরনের অস্তিত্বের নিঃশ্বাস। তাঁর প্রথম উপন্যাস Satantango (১৯৮৫) যেন এক অনন্ত বৃষ্টির ভেতর ঘূর্ণায়মান গ্রামীণ মহাকাব্য। হাঙ্গেরির একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রামে মানুষজন তাদের জীবনের ভাঙাচোরা স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে আছে, আর ফিরে আসে এক রহস্যময় চরিত্র- ইরিমিয়াস। সে মুক্তির প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসে, কিন্তু পাঠক বুঝতে পারে এই মুক্তিই ধ্বংসের অন্য নাম। ক্রাসনাহোরকাই এখানে রাজনৈতিক রূপকের মধ্য দিয়ে দেখান- কীভাবে আশা এবং প্রতারণা একে অপরকে প্রতিফলিত করে। তাঁর দীর্ঘ বাক্যগুলো এমনভাবে প্রবাহিত হয় যে, প্রতিটি চরিত্রের নিঃশ্বাস, নীরবতা, হাহাকার একত্রে মিশে যায় এক শব্দতরঙ্গে। এই উপন্যাসের ভাষা একটি নদীর মতো, যা ধীরে ধীরে বিস্তৃত হয়, আবার গহীনে ডুবে যায়; এটি একযোগে বাস্তব ও অতিবাস্তব।

পরবর্তী উপন্যাস The Melancholy of Resistance (১৯৮৯) ক্রাসনাহোরকাইয়ের দার্শনিক ও রাজনৈতিক পরিসরের সম্প্রসারণ। এখানে একটি শহরে হঠাৎ হাজির হয় এক বিশাল মৃত তিমি, যা দেখতে আসে হাজারো মানুষ। এর চারপাশে অজানা আতঙ্ক, গুজব ও ভীতির জন্ম হয়। এই তিমি ক্রাসনাহোরকাইয়ের প্রতীক- সভ্যতার বিকৃত আত্মপ্রতিকৃতি, যেখানে জনগণ নিজেদের ভয়, কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাসে ডুবে যায়। উপন্যাসটি মূলত গণমনস্তত্ত্বের এক সূক্ষ্ম অধ্যয়ন। লেখক এখানে রাজনীতি, ধর্ম, গুজব, ও ক্ষমতার মধ্যকার জৈব সম্পর্ক অন্বেষণ করেন। সেই শহরটি যেন পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি- যেখানে কিছু মানুষ শৃঙ্খলা বজায় রাখতে চায়, আর বাকিরা চায় ধ্বংসের উল্লাস। তাঁর দৃষ্টিতে, এই বিভাজন কোনো জাতীয় নয়, এটি চিরন্তন মানবিক বাস্তবতা।

এরপরের সৃষ্টি War and War (১৯৯৯) তাঁর সবচেয়ে আত্মসন্ধানী ও আধ্যাত্মিক কাজ। এটি একজন হাঙ্গেরীয় আর্কাইভ কর্মচারী গিয়ার্গি কোরিনের গল্প, যে একটি প্রাচীন পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার করে এবং বিশ্বাস করে এটি মানবজাতির বাঁচার শেষ সূত্র। সে পাণ্ডুলিপিটি অনলাইনে প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে আসে, যেন পৃথিবীর ধ্বংসের আগেই এই বার্তা টিকে থাকে। এই উপন্যাসে প্রযুক্তি, ইতিহাস এবং আধ্যাত্মিকতা এক অনবদ্য ঘূর্ণিপাকে মিশে যায়। ক্রাসনাহোরকাই এখানে মানব সভ্যতার মূলে প্রশ্ন তোলেন: “যদি মানবতা ধ্বংসের দিকে যায়, তাহলে শিল্প কি তাকে রক্ষা করতে পারে?” তাঁর লেখায় উত্তর নেই, আছে কেবল অনুসন্ধান, এক অবিরাম নৈতিক যাত্রা।

War and War-এর ভাষা অন্য যে কোনো উপন্যাসের তুলনায় আরও ধীর, আরও গভীর; প্রতিটি অনুচ্ছেদ যেন কোনো সাধুর প্রার্থনা, যেখানে ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ মিলেমিশে যায় এক জটিল আলোয়।

তাঁর সাহিত্যিক আধ্যাত্মিকতার শীর্ষপ্রকাশ ঘটে Seiobo There Below (২০০৮) উপন্যাসে। এটি নানা স্থানে, নানা সময়ে ঘটে যাওয়া আধ্যাত্মিক সৌন্দর্যের খণ্ডচিত্র- কিয়োটো, ভেনিস, গ্রিস, হাঙ্গেরি- সব জায়গায় একটাই অনুসন্ধান: সৌন্দর্য আসলে কী? এখানে তিনি শিল্প ও ঈশ্বরের সম্পর্ককে অন্বেষণ করেছেন এমনভাবে, যেন প্রতিটি চিত্রকর্ম, প্রতিটি ভাস্কর্য, প্রতিটি মন্দির এক জীবন্ত প্রার্থনা। এই উপন্যাসের একটি লাইন বিশেষভাবে আলোচিত- “Beauty demands precision” অর্থাৎ “সৌন্দর্য ধরে রাখতে নির্ভুলতার প্রয়োজন।” আবার অন্য জায়গায় তিনি ভিন্ন সুরে কথা বলেন কিন্তু সেটাও প্রাসঙ্গিক মনে হয়। তাঁর মতে সৌন্দর্য এক ধরনের শৃঙ্খলা, যা বিশৃঙ্খলার ভেতর থেকে জন্ম নেয়। ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভাষা এখানে যেন বৌদ্ধ মন্ত্রের মতো শান্ত ও গভীর, যেখানে পাঠক একসাথে অনুভব করে মানুষ ও ঈশ্বরের দূরত্ব ও নৈকট্য।

এই চারটি উপন্যাসের ভেতর দিয়ে ক্রাসনাহোরকাই এক অদ্ভুত সেতুবন্ধন তৈরি করেছেন- রাজনীতি, ইতিহাস, ধর্ম, দর্শন, ও মানুষের অন্তর্লোকের মধ্যে। তাঁর লেখায় চরিত্ররা কখনোই একক ব্যক্তি নয়; তারা এক জাতি, এক সময়, এক সভ্যতার প্রতীক। তাঁর বাক্যের ভেতর শব্দ যেমন নীরবতাকে ভাঙে, তেমনি নীরবতাও শব্দকে অর্থ দেয়। এই দ্বন্দ্বই তাঁর সাহিত্যকে বিশ্বজনীন করে তোলে।

বিশ্বের সমালোচকরা ক্রাসনাহোরকাইকে “slow reading’s prophet” বলে আখ্যা দিয়েছেন, কারণ তিনি এমন সময়ে লিখছেন যখন মানুষ দ্রুত তথ্য খুঁজে পেতে চায়; অথচ তাঁর লেখায় পাঠককে থামতে হয়, চিন্তা করতে হয়, বাক্যের গতি মাপতে হয়। এই ধৈর্যই পাঠককে তার সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়। সাহিত্য সমালোচক সুসান বার্নোস্কি (Susan Bernofsky), যিনি তাঁর অনুবাদকও, একবার বলেছিলেন- “Reading Krasznahorkai is like watching someone build a cathedral, stone by stone, word by word.”

নোবেল পুরস্কারের জন্য এই ধৈর্য, এই নৈতিকতা, এই মানবিক অন্তর্দৃষ্টি-ই তাঁকে সবচেয়ে উপযুক্ত প্রার্থী করে তুলেছে। কমিটি বুঝেছে, পৃথিবী এখন দ্রুততা, ভয় ও বিভ্রান্তির মধ্যে দৌড়াচ্ছে; আর এমন সময়ে ক্রাসনাহোরকাই আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে ধীরগতি আবার নৈতিকতার রূপ নিতে পারে। তাঁর প্রতিটি উপন্যাস একেকটি ধ্যানমগ্নতার বই- যেখানে ভাষা প্রার্থনা, মানুষ এক ভ্রমণকারী, আর বিশ্ব এক অনন্ত প্রশ্নচিহ্ন।

লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল প্রাপ্তি ২০২৫ সালের সাহিত্যের ইতিহাসে এক মাইলফলক, কারণ এটি শুধু একজন লেখকের সাফল্যের স্বীকৃতি নয়- এটি এক ধরনের প্রতিবাদ, এক ধরনের দার্শনিক ঘোষণা। তাঁর নাম ঘোষণার মুহূর্তে সারা বিশ্বের সমালোচকরা একে “an award for slowness and spiritual courage” বলে অভিহিত করেছেন। যে সময়ে সাহিত্যের মানদ- প্রায়শই বিক্রির সংখ্যা, অনলাইন জনপ্রিয়তা বা রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতার ওপর নির্ভর করে, সে সময়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের মতো একান্ত, ধ্যানমগ্ন, গূঢ় লেখকের পুরস্কার প্রাপ্তি যেন মানব আত্মার প্রতি এক বিশ্বাস পুনঃপ্রতিষ্ঠা।

নোবেল কমিটি ঘোষণায় বলেছিল, এই পুরস্কার “For his visionary prose that transforms despair into a form of beauty, and his uncompromising portrayal of humanityÕs longing for meaning amidst chaos.” অর্থাৎ “এই পুরস্কার তার দূরদর্শী গদ্যের জন্য যা হতাশাকে সৌন্দযের্র রূপে রূপান্তরিত করে, এবং বিশৃঙ্খলার মধ্যে মানবতার অর্থের আকাক্সক্ষার আপোসহীন চিত্রায়নের জন্য।”

এই একটিমাত্র বাক্যের মধ্যে ক্রাসনাহোরকাইয়ের সাহিত্যচিন্তার সারাংশ ধরা পড়েছে। তিনি হতাশাকে অস্বীকার করেন না- বরং তাকে শিল্পে পরিণত করেন, কারণ তাঁর বিশ্বাস, হতাশাই মানুষের সত্যিকারের আর্তি, এবং সেই আর্তিতেই জন্ম নেয় সৌন্দর্য।

পুরস্কার ঘোষণার পর ইউরোপের প্রধান পত্রিকাগুলোতে তাঁর লেখাকে একুশ শতাব্দীর “moral map of humanityÓ e‡j eY©bv Kiv nq| The Guardian wj‡LwQj:ÒKrasznahorkai writes as if time itself were collapsing, yet through that collapse, we rediscover our conscience.”

অর্থাৎ “ক্রাজনাহোরকাই এমনভাবে লেখেন যেন সময় নিজেই ভেঙে পড়ছে, তবুও সেই পতনের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের বিবেককে পুনরায় আবিষ্কার করি।”

অন্যদিকে The New Yorker মন্তব্য করে:“He is the Dostoevsky of our age—less judgmental, more meditative.” অর্থাৎ “তিনি আমাদের সময়ের দস্তয়েভস্কি- কম বিচারপ্রবণ, বেশি ধ্যানময়।”

এই তুলনা যথার্থ, কারণ ক্রাসনাহোরকাইও দস্তয়েভস্কির মতো মানব আত্মার গভীর অন্ধকারে আলো খুঁজে বেড়ান। তাঁর চরিত্ররা নৈতিকতা বা ধর্মীয় আদর্শে বিশ্বাস করে না- তারা শুধু বাঁচার অর্থ খুঁজে বেড়ায়, এবং এই অনুসন্ধানই তাঁর সাহিত্যের আধ্যাত্মিক শক্তি।

আজকের পৃথিবী একটি অনন্ত গতির দুঃস্বপ্নে বন্দি- খবরের ঝড়, যুদ্ধের উন্মাদনা, বাজারের হাহাকার, প্রযুক্তির তাড়না। এই সময়ের পাঠক এক পৃষ্ঠায় কয়েক সেকেন্ড ব্যয় করতেও দ্বিধা করে। সেই বিশ্বেক্রাসনাহোরকাই এক মূক দ্রোহী- তিনি বলেন, ধীর হও, ভাবো, শব্দের মধ্য দিয়ে আত্মাকে ছুঁয়ে দেখো।

তাঁর সাহিত্য আসলে “resistance through contemplation”- নীরবতার মাধ্যমে প্রতিবাদ।

তিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, সভ্যতার প্রকৃত সংকট রাজনৈতিক নয়, প্রযুক্তিগতও নয়- এটি নৈতিক। মানুষ আজ তথ্য জানে, কিন্তু সত্য জানে না; কথা বলে, কিন্তু শোনে না; বাঁচে, কিন্তু অনুভব করে না। এই অচেতন অস্তিত্বই ক্রাসনাহোরকাইয়ের উপন্যাসে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রতিপক্ষ। Satantango-এর গ্রামীণ মানুষ হোক, বা War and War-এর একাকী কোরিন- সবাই সেই হারিয়ে যাওয়া মানবতার প্রতীক।

এই কারণেই ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল প্রাপ্তি কেবল সাহিত্যিক স্বীকৃতি নয়; এটি এক ধরনের দার্শনিক আহ্বান:“যদি সভ্যতা সত্যিই এগিয়ে যেতে চায়, তবে তাকে প্রথমে থামতে হবে।”

ক্রাসনাহোরকাইয়ের শেকড় গভীরভাবে পূর্ব ইউরোপের ইতিহাসে প্রোথিত। হাঙ্গেরির রাজনৈতিক দমন, সোভিয়েত প্রভাব, এবং পরবর্তী রূপান্তর- সবই তাঁর চরিত্রে প্রতিফলিত। কিন্তু তিনি কখনো কেবল “Post-Communist writer” নন। তাঁর দৃষ্টি সার্বজনীন। তিনি বলেছেন, “My country is not Hungary, my country is despair.” অর্থাৎ “আমার দেশ হাঙ্গেরি নয়, আমার দেশের নাম হতাশা।” এই এক বাক্যে তিনি সীমান্ত পেরিয়ে যান; তাঁর সাহিত্য হয়ে ওঠে সমগ্র মানবজাতির ভাষা।? তিনি দেখান, ভয় ও নৈরাশ্য কোনো জাতীয় অনুভূতি নয়- এটি মানব অভিজ্ঞতার অভিন্ন অংশ।

বাংলাদেশ ও তৃতীয় বিশ্বের প্রেক্ষাপটে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা

যদি আমরা তাঁর সাহিত্যকে বাংলাদেশের কিংবা তৃতীয় বিশ্বের রাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকে দেখি, আমরা আশ্চর্য মিল খুঁজে পাই। ক্রাসনাহোরকাইয়ের মানুষ যেমন বারবার প্রতিশ্রুতির ফাঁদে পড়ে, মুক্তির নামে নতুন শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়- তেমনি আমাদের সমাজও রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রতারণার চক্রে বন্দি। তাঁর The Melancholy of Resistance-এর শহর যেমন গুজব, ভয় ও অন্ধবিশ্বাসে দগ্ধ, আমাদের সমাজও তেমনি বিভক্ত বিভ্রান্তির আগুনে পুড়ছে।

তাঁর লেখায় যে প্রশ্নটি বারবার ফিরে আসে-

“Who will resist the decay?”

এই প্রশ্ন আজ বাংলাদেশের বাস্তবতাতেও প্রযোজ্য- শিক্ষা, নৈতিকতা ও মানবিক চেতনার পতনের যুগে আমরা কারা প্রতিরোধ করবো, কেমন করে?লাসলো ক্রাসনাহোরকাই আমাদের শেখান, সাহিত্য শুধু শব্দ নয়- এটি নৈতিক চেতনার পুনর্জন্ম। তাঁর প্রতিটি বাক্যে এক ধরনের প্রার্থনা আছে, যেন তিনি মানবতার জন্য লিখছেন, ক্ষমতার বিরুদ্ধে নয়, বরং ভেতরের অন্ধকারের বিরুদ্ধে। তিনি দস্তয়েভস্কির উত্তরসূরি, কাফকার সহযাত্রী, এবং বোর্হেসের নীরব উত্তরাধিকারী। কিন্তু তাঁর নিজের জগৎ একান্ত- যেখানে ধ্বংস মানেই সৌন্দর্যের সূচনা।

এই কারণেই ২০২৫ সালের নোবেল পুরস্কার এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়- সত্যিকারের সাহিত্য কখনো বাজারমুখী নয়, বরং সময়ের বিপরীতে দাঁড়িয়ে নীরবে মানুষের আত্মাকে বাঁচিয়ে রাখে।

ক্রাসনাহোরকাই নিজেই বলেছেন: “Writing is a slow act of resistance against oblivion.” এই ‘ংষড়ি ধপঃ’-এর মধ্যেই নিহিত আছে মানব সভ্যতার পরিত্রাণ। যে যুগে মানুষ দ্রুত ভুলে যায়, ক্রাসনাহোরকাই আমাদের শেখান কীভাবে মনে রাখা যায়- কীভাবে শব্দকে বিশ্বাসে, আর বিশ্বাসকে নৈতিকতায় রূপান্তর করা যায়।

back to top