মহসীন হাবিব
বিষণ্ন বিকেল। মিজান সাহেবের মেজাজের পারদ একটু উপরের দিকে। অফিস আদালত বন্ধ। এক সপ্তাহ হয়ে গেল বাসায় বন্দি। আজ দুইজন মক্কেলের দেখা করার কথা ছিল। একজনও আসেনি। শালারা সব করোনা ভাইরাসের দোহাই দেয়! অন্যদিকে পিআইও হারামজাদা, খয়রাতি সাহায্য মেরে খাচ্ছিস! আমার মাসোয়ারা নিয়ে আসতে যত গড়িমসি! অবশ্য পিআইওকে দোষ দিয়ে লাভ কী, এখন তো কারো সঙ্গে কারো দেখা করাও প্রায় নিষেধ। কিন্তু এই সময় সরকারের পয়সা বেশি আসতেছে! চাইল-ডাইল নগদ টাকা। কাবিখা, কাবিটার টাকাও...
স্ত্রী অ্যানি আশেপাশেই হাঁটাহাঁটি করছিল। তারও মন-মেজাজ ভালো না। বাসায় কাজের লোক নাই চার দিন। রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনারও কোনো উপায় নাই। যে কাজ জীবনে করেনি, তাই তাকে করতে হচ্ছে। থালাবাসন মাজা, ঘর ঝাড়ু দেওয়া- এও সম্ভব! শপিংমল বন্ধ তো বন্ধই, এমনকি পার্লারগুলো বন্ধ! মানে জীবনটাই অচল হয়ে গেল! কতক্ষণ ভালো লাগে!
নরমাল সময়ে দুজন যার যার জগতে থাকেন। সমস্যা হয় না। মিজান সাহেব অফিসের দরবার নিয়ে থাকলে অ্যানি ফেসবুক নিয়ে থাকে। আবার অ্যানি যখন বান্ধবীদের নিয়ে থাকে মিজান সাহেব তখন ফেসবুক ঘাঁটাঘাঁটি করেন। এখন বন্দি ঘরের ভেতরে মনে হচ্ছে পাশাপাশি দুটো তাজা বোমা গড়াগড়ি করছে। টক্কর লাগলেই বুম!
মিজান সাহেব বললেন, এক কাপ চা বানাতে পারবে?
অ্যানি ড্রেসিং টেবিলের দিকে যেতে যেতে একটু গরম সুরেই বলল, বানিয়ে খাও।
মিজান সাহেবের পারদ সামান্য আরেক দাগ উপরে উঠল। তিনি বললেন, আমি বানিয়ে খেলে তুমি আছো কী করতে, শুধু সাজগোছ করতে? (বোমায় টক্কর লেগে গেছে)
অ্যানির পারদের দাগ সকাল থেকেই বিপদসীমার কাছাকাছি ছিল।এই ‘শুধু সাজগোছ করতে’ কথাটা তার কানে ঢুকলো রাইফেলের গুলির মতো। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, সারাদিন রান্না, ঘর ঝাড়ু দেওয়া, থালা-বাসন পরিষ্কারের কাজ কে করে দেয়, তোমার মা, না বোন! তারপরও চা বানাতে বলো কোন আক্কেলে!
মিজান সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, আসলে ভুল হইছে। গ্রাম থেকে একজন জোবায়দা বা রাশিদাকে আনলে জীবনটা অন্যরকম হতো।
আনলে না কেন? তখন তো মনে হইছে গইগেরামের একজন বিসিএস পাস করেছি। সুযোগ এসেছে। এবার শহরের বড় ঘরের মেয়ে বিয়ে করে দরিদ্রতার প্রতিশোধ নেব!
মিজান সাহেব কিছুক্ষণ উত্তর দিলেন না। তারপর গল্প করার মতো সুরে বললেন, যে কোনো চাকরিতে ঢোকানোর আগে সরকারের উচিত বিয়ে সম্পর্কে একটা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। সেই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সামনে লেখা থাকবে, চকচক করিলেই সোনা হয় না। প্রশিক্ষকরা প্রথম ক্লাসেই বলবেন, ‘ক্লাবে ড্যান্স করা মেয়েদের সঙ্গে ক্লাবে ড্যান্স করা যায়, জীবনের ড্যান্স করা যায় না!’
এবার অ্যানি কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে চোখে তীব্র একটা ভাষা এনে বলল, তার পাশেই আরেকটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থাকবে ভবিষ্যতের ঘুষখোরদের বিয়ে করার বিষয়ে। সেখানে লেখা থাকবে, গ্রাম্য ফকির অফিসার বিয়ে করার ব্যাপারে সাবধান! প্রথম ক্লাসেই প্রশিক্ষক বলবে, ফকিরের চেয়ার যত বড় মন পড়ে থাকে পাটিতে!
মিজান সাহেব ইউটিউব দেখতে দেখতে বললেন, ‘দেখি ইন্টারনেটে মাকাল ফলের ছবি পাওয়া যায় কি না। ফলটা দেখতে খুবই চমৎকার, কিন্তু মুখে দেওয়া যায় না!’
অ্যানি খোঁচাটা ধরে ফেলল। বলল, না, তারচেয়ে দেখ তোমার মায়ের মতো রান্না করা, স্বামীকে পূজা করা মেয়ে পাওয়া যায় কি না! কাজে লাগতে পারে।
এবার মিজান সাহেব আর টেকনিক্যাল ঝগড়ায় থাকতে পারলেন না। তিরিং করে উঠলেন, খবরদার! কথায় কথায় আমার মরা মায়ের উদাহরণ তুলবে না, একদম খুন করে ফেলব!
অ্যানি চাপা স্বরে বলল, ওই তো, আছে এক গ্রাম্য সেন্টিমেন্ট, মা! এত দামী মা, তাহলে মাকে ধানের মিলে কাজ করতে দিয়ে লেখাপড়ার বিলাসিতা করেছ কেন! নিজে কাজে নামতে পারলে না!
কী বলতে চাচ্ছ!
তুমি যা খুশি বুঝে নাও!
অ্যানি দ্রুত হেঁটে ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে নিজের মোবাইল তুলে নিয়ে ফোন করলো, ‘মাম্মি, এক্ষণ গাড়ি পাঠিয়ে দাও, আমি বাড়ি আসব।’
ওপাশ থেকে কী বললো শোনা গেল না। অ্যানি বলল, ড্রাইভারকে ছুটি দিয়েছ! সমস্যা নাই, রাস্তাঘাট একেবারে ফাঁকা। ড্যাডিকে বলো চালিয়ে আসতে। তা না হলে আমি এক্ষণ রাস্তায় বের হয়ে যাবো!
নিস্তব্ধ চারিদিক। কিছুক্ষণ পরই বাড়ির সামনে গাড়ি থামার শব্দ। অ্যানি হাতব্যাগটি নিয়ে দরোজা খুলে চলে যাচ্ছে। মিজান সাহেবের মাথা বিগড়ে আছে। তিনি বাধা দিলেন না। মোবাইল টিপতে টিপতেই বিড়বিড় করে বললেন, যাও! মায়ের কাছ থেকে ক্লাবে ক্লাবে ঘোরার ট্রেনিং নিয়ে আসো!
নিবই তো, কিন্তু তোমার কাছে ফিরে আসবো না!
ঘরের ভেতর থেকে গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দ পাওয়া গেল।
মনে হচ্ছে এবার আর অ্যানি ফিরবে না। একটা ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেবে। আবার আসতেও পারে। কারণ এমন ঝগড়ার পর বাড়ি গিয়ে আবার কয়েক দিন পর ফিরেও এসেছে। দরোজার কাছে দাঁড়িয়ে মিষ্টি করে হেসে বলেছে, হাই!
অ্যানিকে দেখে মিজান সাহেবেরও শুকিয়ে যাওয়া বুকে জোয়ারের পানি এসে ভাসিয়ে দিয়েছে, তার পৃথিবী সতেজ হয়ে উঠেছে। ২.
চায়ে চুমুক দিয়ে লায়লা বলল, ‘রিমোট টিপাটিপি করতেছ কেন? এক চ্যানেলে থাকো।’
আমি বললাম, ‘এক চ্যানেলে বসে কি বিজ্ঞাপন দেখব?’
‘তুমি তো কোনো চ্যানেলেই স্থির থাকছ না।’
‘তোমার মতো স্টারপ্লাস ধরে বসে থাকব?’ বলেই আমি জিহ্বায় কামড় দিলাম। সকালবেলাই ঝামেলা করার কোনো ইচ্ছা ছিল না। হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। করোনাকালীন সময়, বেশি বেশি চটলে টুক করে দরোজা খুলে জন¯্রােতের সঙ্গে মিশে যাবো সে উপায়ও নেই।
‘আমি স্টারপ্লাস ধরে বসি থাকি! রান্নাবান্না করে কে? খাবার আসে কোত্থেকে! লজ্জা করে না কথা বলতে! অসভ্য লোক কোথাকার! আমার জীবনটা-’
কিন্তু এই যাত্রা বেঁচে গেলাম! দরোজায় কেউ বেল টিপতেই লায়লা এগিয়ে গেল। খুলেই পাশের বাসার খালাম্মাকে দেখে নিজের মুখে একটা মারাত্মক হাসি ফুটিয়ে তুলল। খালাম্মার পেছনে একজন ২০-২২ বছর বয়সের মেয়ে। লায়লাকে দেখে কে বুঝবে যে এইমাত্র কাশ্মীর যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে, লাইন অফ কন্ট্রোল বরাবর দু-চারটা গোলাবারুদ ছুড়ে দিয়েছে!
খালাম্মা বললেন, ‘লায়লা, এই মেয়েটা কাজ খুঁজতেছে। তোমার তো কাজের লোক নাই। রাখবা নাকি?’
লায়লা ইন্টারভিউ শুরু করল, ‘থাকো কোথায়?’
‘এই বাজারের পেছনে।’
‘নাম কী?
‘ময়না।’
‘বাড়ি কোথায়?’
‘ফরিদপুর’
‘ছেলেপেলে কী?’
‘একটা মেয়ে। বাড়িতে মায়ের কাছে থাকে।’
‘জামাই কী করে?’
‘ঘুইরা ঘুইরা চা বিক্রি করে।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাচ্চাটির কী নাম, বয়স কত?’
খালাম্মা এবং মেয়েটি দেখল, লায়লা হাসিমুখে আমার দিকে ফিরে তাকিয়েছে। কিন্তু আমি দেখলাম ওর চোখ বলছে, তুমি এর মধ্যে নাক গলাচ্ছ কেন! বাচ্চার বয়স কত তা দিয়ে তোমার দরকার কী!
ময়না বলল, ‘তার নাম রিতা। মাইয়া ফরিদপুরে নানীর কাছে থাকে। একটা ফটক আছে স্যার।’
আমার আর কিছু জিজ্ঞাসা করার ক্ষমতা নাই। ডিপার্টমেন্ট লায়লার।
পরদিন থেকে মেয়েটি কাজে লেগে গেল।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে লায়লা ওর ব্যক্তিগত খবরও নেয়। আমার কানে আসে। একদিন শুনলাম লায়লা জিজ্ঞেস করছে, ‘ময়না, তোমার জামাই লোকটা কেমন?’
‘ভালো।’
‘যতœ নেয়?’
‘জি আফা।’
একদিন লায়লা বলল, ‘জানো, ভালো কিছু খেতে দিলে ও খায় না, সঙ্গে নিয়ে যায়।’
আমি বললাম, ‘ভালো।’
‘মেয়েটা একটু হাবাগোবা ধরনের, বুঝলা।’
‘কেমন?’
‘মনে হয় একটু বোধ-বুদ্ধি কম।’
‘এই যুগে বোধ-বুদ্ধি কম হওয়াই ভালো।’ আমি বললাম।
বেশ কয়েক দিন পার হয়ে গেল। একদিন মেয়েটি ঘরে ঢুকতেই দেখা গেল মুখের বাঁ পাশে বেশ খানিকটা ফুলে আছে। ডান হাতের কব্জির কাছে ব্যান্ডেজ। লায়লা বেশ উঁচু গলায় বলল, ‘কী হয়েছে ময়না!’
ময়না চুপ করে আছে।
কী হয়েছে বলো!
‘আফা মারছে।’
‘কেন, কী করেছ তুমি?’
‘ট্যাকা চায়।’
লায়লা খানিক চুপ করে থেকে বলল, ‘বেতনের টাকা কী করো?’
ময়না মাথা নিচু করে বলল, ‘তারে দিয়া দেই।’
‘তাহলে আর টাকা তুমি কোত্থেকে দেবে?’
‘আপনি যে টাকা দেন, সেইখান থিকা দুইশ টাকা রাখছিলাম রিতার জন্য জামা কিনব।’
লায়লা রাগে ফুঁসতে থাকল, ‘আমার ধারণা ছিল দরিদ্র মানুষরা অত্যাচারী হয় না। এ তো দেখছি অমানুষ!’
আমি ছোট করে বললাম, ‘অত্যাচারীর কোনো শ্রেণি নাই লায়লা।’
কয়েকদিন পরের কথা। কম্পিউটারে কাজ করছি। লায়লার উচ্চ কণ্ঠ শুনলাম, ‘কী ব্যাপার ময়না, কী হয়েছে! এমন দেখাচ্ছে কেন!’
আমি কান সজাগ করলাম। কয়েক হাত দূরে দরজা দিয়ে রান্নাঘরের কাছে দাঁড়ানো ময়নাকে দেখা যাচ্ছে। ময়না বলল, ‘আফা, আজ ছয়দিন ধরে রিতার বাপে বাড়ি আসে না।’
‘কেন, বাড়ি আসে না কেন, কোথায় আছে?’
‘শুনছি বিয়া করছে।’
আমার মনটা কেমন যেন হয়ে গেল। আমি সাউন্ড সিস্টেমে গান শুনছিলাম, ‘বন্ধুহারা পোড়া দেশে, যায় না বসত করা... যা গো সখী চলে যা মথুরা...’
লায়লা এসে আমার পাশের চেয়ারে বসল। দেখলাম ওর চোখ দুটো টলমল করছে। আমার ভেতরটাও ময়নার জন্য কেঁদে উঠল। মুখে বললাম, জগতের সব কষ্ট নিজের ভেতর নিতে পারবে না লায়লা। লকডাউন খুলে দিয়েছে, চলো আমরা রিক্সা করে কোথাও ঘুরে আসি।
মহসীন হাবিব
বুধবার, ০৬ অক্টোবর ২০২১
বিষণ্ন বিকেল। মিজান সাহেবের মেজাজের পারদ একটু উপরের দিকে। অফিস আদালত বন্ধ। এক সপ্তাহ হয়ে গেল বাসায় বন্দি। আজ দুইজন মক্কেলের দেখা করার কথা ছিল। একজনও আসেনি। শালারা সব করোনা ভাইরাসের দোহাই দেয়! অন্যদিকে পিআইও হারামজাদা, খয়রাতি সাহায্য মেরে খাচ্ছিস! আমার মাসোয়ারা নিয়ে আসতে যত গড়িমসি! অবশ্য পিআইওকে দোষ দিয়ে লাভ কী, এখন তো কারো সঙ্গে কারো দেখা করাও প্রায় নিষেধ। কিন্তু এই সময় সরকারের পয়সা বেশি আসতেছে! চাইল-ডাইল নগদ টাকা। কাবিখা, কাবিটার টাকাও...
স্ত্রী অ্যানি আশেপাশেই হাঁটাহাঁটি করছিল। তারও মন-মেজাজ ভালো না। বাসায় কাজের লোক নাই চার দিন। রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনারও কোনো উপায় নাই। যে কাজ জীবনে করেনি, তাই তাকে করতে হচ্ছে। থালাবাসন মাজা, ঘর ঝাড়ু দেওয়া- এও সম্ভব! শপিংমল বন্ধ তো বন্ধই, এমনকি পার্লারগুলো বন্ধ! মানে জীবনটাই অচল হয়ে গেল! কতক্ষণ ভালো লাগে!
নরমাল সময়ে দুজন যার যার জগতে থাকেন। সমস্যা হয় না। মিজান সাহেব অফিসের দরবার নিয়ে থাকলে অ্যানি ফেসবুক নিয়ে থাকে। আবার অ্যানি যখন বান্ধবীদের নিয়ে থাকে মিজান সাহেব তখন ফেসবুক ঘাঁটাঘাঁটি করেন। এখন বন্দি ঘরের ভেতরে মনে হচ্ছে পাশাপাশি দুটো তাজা বোমা গড়াগড়ি করছে। টক্কর লাগলেই বুম!
মিজান সাহেব বললেন, এক কাপ চা বানাতে পারবে?
অ্যানি ড্রেসিং টেবিলের দিকে যেতে যেতে একটু গরম সুরেই বলল, বানিয়ে খাও।
মিজান সাহেবের পারদ সামান্য আরেক দাগ উপরে উঠল। তিনি বললেন, আমি বানিয়ে খেলে তুমি আছো কী করতে, শুধু সাজগোছ করতে? (বোমায় টক্কর লেগে গেছে)
অ্যানির পারদের দাগ সকাল থেকেই বিপদসীমার কাছাকাছি ছিল।এই ‘শুধু সাজগোছ করতে’ কথাটা তার কানে ঢুকলো রাইফেলের গুলির মতো। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, সারাদিন রান্না, ঘর ঝাড়ু দেওয়া, থালা-বাসন পরিষ্কারের কাজ কে করে দেয়, তোমার মা, না বোন! তারপরও চা বানাতে বলো কোন আক্কেলে!
মিজান সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, আসলে ভুল হইছে। গ্রাম থেকে একজন জোবায়দা বা রাশিদাকে আনলে জীবনটা অন্যরকম হতো।
আনলে না কেন? তখন তো মনে হইছে গইগেরামের একজন বিসিএস পাস করেছি। সুযোগ এসেছে। এবার শহরের বড় ঘরের মেয়ে বিয়ে করে দরিদ্রতার প্রতিশোধ নেব!
মিজান সাহেব কিছুক্ষণ উত্তর দিলেন না। তারপর গল্প করার মতো সুরে বললেন, যে কোনো চাকরিতে ঢোকানোর আগে সরকারের উচিত বিয়ে সম্পর্কে একটা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। সেই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সামনে লেখা থাকবে, চকচক করিলেই সোনা হয় না। প্রশিক্ষকরা প্রথম ক্লাসেই বলবেন, ‘ক্লাবে ড্যান্স করা মেয়েদের সঙ্গে ক্লাবে ড্যান্স করা যায়, জীবনের ড্যান্স করা যায় না!’
এবার অ্যানি কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে চোখে তীব্র একটা ভাষা এনে বলল, তার পাশেই আরেকটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থাকবে ভবিষ্যতের ঘুষখোরদের বিয়ে করার বিষয়ে। সেখানে লেখা থাকবে, গ্রাম্য ফকির অফিসার বিয়ে করার ব্যাপারে সাবধান! প্রথম ক্লাসেই প্রশিক্ষক বলবে, ফকিরের চেয়ার যত বড় মন পড়ে থাকে পাটিতে!
মিজান সাহেব ইউটিউব দেখতে দেখতে বললেন, ‘দেখি ইন্টারনেটে মাকাল ফলের ছবি পাওয়া যায় কি না। ফলটা দেখতে খুবই চমৎকার, কিন্তু মুখে দেওয়া যায় না!’
অ্যানি খোঁচাটা ধরে ফেলল। বলল, না, তারচেয়ে দেখ তোমার মায়ের মতো রান্না করা, স্বামীকে পূজা করা মেয়ে পাওয়া যায় কি না! কাজে লাগতে পারে।
এবার মিজান সাহেব আর টেকনিক্যাল ঝগড়ায় থাকতে পারলেন না। তিরিং করে উঠলেন, খবরদার! কথায় কথায় আমার মরা মায়ের উদাহরণ তুলবে না, একদম খুন করে ফেলব!
অ্যানি চাপা স্বরে বলল, ওই তো, আছে এক গ্রাম্য সেন্টিমেন্ট, মা! এত দামী মা, তাহলে মাকে ধানের মিলে কাজ করতে দিয়ে লেখাপড়ার বিলাসিতা করেছ কেন! নিজে কাজে নামতে পারলে না!
কী বলতে চাচ্ছ!
তুমি যা খুশি বুঝে নাও!
অ্যানি দ্রুত হেঁটে ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে নিজের মোবাইল তুলে নিয়ে ফোন করলো, ‘মাম্মি, এক্ষণ গাড়ি পাঠিয়ে দাও, আমি বাড়ি আসব।’
ওপাশ থেকে কী বললো শোনা গেল না। অ্যানি বলল, ড্রাইভারকে ছুটি দিয়েছ! সমস্যা নাই, রাস্তাঘাট একেবারে ফাঁকা। ড্যাডিকে বলো চালিয়ে আসতে। তা না হলে আমি এক্ষণ রাস্তায় বের হয়ে যাবো!
নিস্তব্ধ চারিদিক। কিছুক্ষণ পরই বাড়ির সামনে গাড়ি থামার শব্দ। অ্যানি হাতব্যাগটি নিয়ে দরোজা খুলে চলে যাচ্ছে। মিজান সাহেবের মাথা বিগড়ে আছে। তিনি বাধা দিলেন না। মোবাইল টিপতে টিপতেই বিড়বিড় করে বললেন, যাও! মায়ের কাছ থেকে ক্লাবে ক্লাবে ঘোরার ট্রেনিং নিয়ে আসো!
নিবই তো, কিন্তু তোমার কাছে ফিরে আসবো না!
ঘরের ভেতর থেকে গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দ পাওয়া গেল।
মনে হচ্ছে এবার আর অ্যানি ফিরবে না। একটা ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেবে। আবার আসতেও পারে। কারণ এমন ঝগড়ার পর বাড়ি গিয়ে আবার কয়েক দিন পর ফিরেও এসেছে। দরোজার কাছে দাঁড়িয়ে মিষ্টি করে হেসে বলেছে, হাই!
অ্যানিকে দেখে মিজান সাহেবেরও শুকিয়ে যাওয়া বুকে জোয়ারের পানি এসে ভাসিয়ে দিয়েছে, তার পৃথিবী সতেজ হয়ে উঠেছে। ২.
চায়ে চুমুক দিয়ে লায়লা বলল, ‘রিমোট টিপাটিপি করতেছ কেন? এক চ্যানেলে থাকো।’
আমি বললাম, ‘এক চ্যানেলে বসে কি বিজ্ঞাপন দেখব?’
‘তুমি তো কোনো চ্যানেলেই স্থির থাকছ না।’
‘তোমার মতো স্টারপ্লাস ধরে বসে থাকব?’ বলেই আমি জিহ্বায় কামড় দিলাম। সকালবেলাই ঝামেলা করার কোনো ইচ্ছা ছিল না। হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। করোনাকালীন সময়, বেশি বেশি চটলে টুক করে দরোজা খুলে জন¯্রােতের সঙ্গে মিশে যাবো সে উপায়ও নেই।
‘আমি স্টারপ্লাস ধরে বসি থাকি! রান্নাবান্না করে কে? খাবার আসে কোত্থেকে! লজ্জা করে না কথা বলতে! অসভ্য লোক কোথাকার! আমার জীবনটা-’
কিন্তু এই যাত্রা বেঁচে গেলাম! দরোজায় কেউ বেল টিপতেই লায়লা এগিয়ে গেল। খুলেই পাশের বাসার খালাম্মাকে দেখে নিজের মুখে একটা মারাত্মক হাসি ফুটিয়ে তুলল। খালাম্মার পেছনে একজন ২০-২২ বছর বয়সের মেয়ে। লায়লাকে দেখে কে বুঝবে যে এইমাত্র কাশ্মীর যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে, লাইন অফ কন্ট্রোল বরাবর দু-চারটা গোলাবারুদ ছুড়ে দিয়েছে!
খালাম্মা বললেন, ‘লায়লা, এই মেয়েটা কাজ খুঁজতেছে। তোমার তো কাজের লোক নাই। রাখবা নাকি?’
লায়লা ইন্টারভিউ শুরু করল, ‘থাকো কোথায়?’
‘এই বাজারের পেছনে।’
‘নাম কী?
‘ময়না।’
‘বাড়ি কোথায়?’
‘ফরিদপুর’
‘ছেলেপেলে কী?’
‘একটা মেয়ে। বাড়িতে মায়ের কাছে থাকে।’
‘জামাই কী করে?’
‘ঘুইরা ঘুইরা চা বিক্রি করে।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাচ্চাটির কী নাম, বয়স কত?’
খালাম্মা এবং মেয়েটি দেখল, লায়লা হাসিমুখে আমার দিকে ফিরে তাকিয়েছে। কিন্তু আমি দেখলাম ওর চোখ বলছে, তুমি এর মধ্যে নাক গলাচ্ছ কেন! বাচ্চার বয়স কত তা দিয়ে তোমার দরকার কী!
ময়না বলল, ‘তার নাম রিতা। মাইয়া ফরিদপুরে নানীর কাছে থাকে। একটা ফটক আছে স্যার।’
আমার আর কিছু জিজ্ঞাসা করার ক্ষমতা নাই। ডিপার্টমেন্ট লায়লার।
পরদিন থেকে মেয়েটি কাজে লেগে গেল।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে লায়লা ওর ব্যক্তিগত খবরও নেয়। আমার কানে আসে। একদিন শুনলাম লায়লা জিজ্ঞেস করছে, ‘ময়না, তোমার জামাই লোকটা কেমন?’
‘ভালো।’
‘যতœ নেয়?’
‘জি আফা।’
একদিন লায়লা বলল, ‘জানো, ভালো কিছু খেতে দিলে ও খায় না, সঙ্গে নিয়ে যায়।’
আমি বললাম, ‘ভালো।’
‘মেয়েটা একটু হাবাগোবা ধরনের, বুঝলা।’
‘কেমন?’
‘মনে হয় একটু বোধ-বুদ্ধি কম।’
‘এই যুগে বোধ-বুদ্ধি কম হওয়াই ভালো।’ আমি বললাম।
বেশ কয়েক দিন পার হয়ে গেল। একদিন মেয়েটি ঘরে ঢুকতেই দেখা গেল মুখের বাঁ পাশে বেশ খানিকটা ফুলে আছে। ডান হাতের কব্জির কাছে ব্যান্ডেজ। লায়লা বেশ উঁচু গলায় বলল, ‘কী হয়েছে ময়না!’
ময়না চুপ করে আছে।
কী হয়েছে বলো!
‘আফা মারছে।’
‘কেন, কী করেছ তুমি?’
‘ট্যাকা চায়।’
লায়লা খানিক চুপ করে থেকে বলল, ‘বেতনের টাকা কী করো?’
ময়না মাথা নিচু করে বলল, ‘তারে দিয়া দেই।’
‘তাহলে আর টাকা তুমি কোত্থেকে দেবে?’
‘আপনি যে টাকা দেন, সেইখান থিকা দুইশ টাকা রাখছিলাম রিতার জন্য জামা কিনব।’
লায়লা রাগে ফুঁসতে থাকল, ‘আমার ধারণা ছিল দরিদ্র মানুষরা অত্যাচারী হয় না। এ তো দেখছি অমানুষ!’
আমি ছোট করে বললাম, ‘অত্যাচারীর কোনো শ্রেণি নাই লায়লা।’
কয়েকদিন পরের কথা। কম্পিউটারে কাজ করছি। লায়লার উচ্চ কণ্ঠ শুনলাম, ‘কী ব্যাপার ময়না, কী হয়েছে! এমন দেখাচ্ছে কেন!’
আমি কান সজাগ করলাম। কয়েক হাত দূরে দরজা দিয়ে রান্নাঘরের কাছে দাঁড়ানো ময়নাকে দেখা যাচ্ছে। ময়না বলল, ‘আফা, আজ ছয়দিন ধরে রিতার বাপে বাড়ি আসে না।’
‘কেন, বাড়ি আসে না কেন, কোথায় আছে?’
‘শুনছি বিয়া করছে।’
আমার মনটা কেমন যেন হয়ে গেল। আমি সাউন্ড সিস্টেমে গান শুনছিলাম, ‘বন্ধুহারা পোড়া দেশে, যায় না বসত করা... যা গো সখী চলে যা মথুরা...’
লায়লা এসে আমার পাশের চেয়ারে বসল। দেখলাম ওর চোখ দুটো টলমল করছে। আমার ভেতরটাও ময়নার জন্য কেঁদে উঠল। মুখে বললাম, জগতের সব কষ্ট নিজের ভেতর নিতে পারবে না লায়লা। লকডাউন খুলে দিয়েছে, চলো আমরা রিক্সা করে কোথাও ঘুরে আসি।