alt

সাময়িকী

নিরন্তর ধুলা ওড়ে

জামাল রেজা

: বৃহস্পতিবার, ১৪ অক্টোবর ২০২১

মেয়েটা ঘরে ঢুকে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মবিন সাহেব চোখের চশমা খুলে হাতে নিলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। এরপর বললেন, নাম কী তোর?

আফিয়া বেগম, মেয়েটা বললো।

এই লাইনে কতদিন?

আফিয়া মাথা নিচু করল।

বিয়েশাদি হয় নাই? আবারও মবিন সাহেব প্রশ্ন করলেন। আফিয়া মাথা তুললো। কী যেনো একটা বললো। মবিন সাহেব বুঝতে পারলেন না। বললেন, ডানদিকে বাথরুম আছে। ভালো করে গোসল করে আয়। সাবান মাখবি শরীরে।

স্যার আমার লগে আলাদা কাপড় নাই।

বললো আফিয়া।

আলাদা কাপড়ের কোনো দরকার নাই, যাইয়া দেখ বাথরুম খুব সুন্দর।

আফিয়া আবার কিছু একটা বলতে গেলে থামিয়ে দিলেন মবিন সাহ্বে। হাত ইশারায় চলে যেতে ইঙ্গিত করলেন তিনি। প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরালেন। বজলুর জন্য তার এখন প্রতীক্ষা। সে ড্রিংকসের আয়োজন করবে। বরফ কুচি না হলে চলে না। আজ দিনেরবেলা ইলেকট্রিসিটি ছিল না মহল্লায়। বরফ জমেনি ফ্রিজে। বজলু সে কথা আগেই জানিয়েছে। এখন তাকে ওপর তলায় মিহিদের ঘরে পাঠানো হয়েছে। তাদের ডিপ ফ্রিজ আছে। কেচে কুচে হলেও কিছু বরফ পাওযা যেতে পারে। কিন্তু বজলু যে গেছে তাও পনের-বিশ মিনিট হয়ে গেল। তাহলে কি বরফ পাওয়া যাবে না? ঐ মেয়ে তুই গোসল করতে গেলি না?

আজ দিনেরবেলা ইলেকট্রিসিটি ছিল না মহল্লায়। বরফ জমেনি ফ্রিজে। বজলু সে কথা আগেই জানিয়েছে

আফিয়া মাথা তুলে অপরাধী ভঙ্গিতে তাকালো মবিন সাহেবের দিকে। মবিন সাহেব রাগলেন না। হেসে দিয়ে বললেন, যা, গোসলটা দিয়ে আয়। জলদি কর। আবারও কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে যায় আফিয়া। শহরের নতুন অতিথি এই মেয়ে। তিন পেরিয়ে আজ চতুর্থ দিন। গতকাল মর্জিনার সঙ্গে রমনা পার্কের লেকে গিয়ে গোসল করে এসেছে। এখন আলাদা কাপড় ছাড়া কীভাবে গোসল করবে তা ঢুকছে না মাথায়। ছতর ঢাকার বিষয়টি মাথার ভেতর ভন-ভন করছে। অসহায় আফিয়া, কর্তার ইচ্ছায় কর্ম বলে কথা। ও বাথরুমে ঢুকলো। বন্ধ করলো দরজা। গায়ের পরিচ্ছদ খুলতে খুলতে হঠাৎ আঁৎকে উঠল। বুকের বাম দিকটায় কালো একটা দাগ হয়ে আছে। ল্যাংড়া মন্টু দাগটা করেছে। গত রাতে জবরদস্তি করে অফিয়াকে পরাস্ত করেছিল কার্জন হলের দেয়ালের আড়ালে। মিনার মা-ই বলেছিল, ল্যাংড়ার কথা না শুনলে না-কি হাইকোর্ট এরিয়াতে থাকা যাবে না। সে কারণে আফিয়াও রাজি হয়েছিল। কিন্তু কে জানতো জানোয়ারটা এইভাবে কামড় বসিয়ে দেবে? সঙ্গে সঙ্গে আহ, উহ, করে উঠলেও পুলিশের ভয়ে কণ্ঠ চড়ায়নি একবারও। আশ্রয় আর মিলবে কোথায়? মিনার মা তো শুরুতেই বলেছিল শরীরের মায়া করলে না-কি ঠাঁই হবে না, তাহলে আবার প্রশ্ন কেন?

আফিয়া শরীরে মগ দিয়ে পানি ঢাললো। সাবান মাখলো। নিজের শরীর এই প্রথম আয়নায় দেখলো সে। টাটটি ঘরে (বাথরুমে) এমন বড় আয়না ক্যান? প্রশ্নটা নিজেকেই করলো আফিয়া। এরপর নিজের শরীরটা ভালো করে দেখল। সত্যি চমৎকার গড়ন। না চিকন, না মোটা। স্বামীর কথা মনে পড়লো ওর। ছোট ছোট করে বলতো, তোর মতন এমন সুন্দরী বউয়ের খোয়াবই সারাজীবন দেখছি। কিন্তু সেই মানুষটা পাল্টালো অল্প দিনেই। বাচ্চা কোলে নিয়ে সে কারণেই আট মাসের মাথায় ঢাকা শহরে পাড়ি জমালো আফিয়া। বাধ্য হলো। কী করবে আর? নিজেই যেখানে খেতে পায় না, সেখানে বাচ্চার দুধ যোগাবে কোত্থেকে?

এদিকে মবিন সাহেবের মেজাজ গরম হয়ে গেছে। একে তো বরফকুচি পাওয়া যায় নি, তার উপরে ফ্ল্যাটে যে মেয়ে ঢুকেছে, সে কথা বজলু নাকি স্বীকার করেছে মিহির মায়ের কাছে। বাপের অফিসের পিয়নের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করতে পারে যে মেয়ে, তার এতো প্রশ্ন কিসের? স্যার আমার কী দোষ? কম্পিত কণ্ঠে কুর্নিশের ভঙ্গিতে বললো বজলু।

তোর কী দোষ মানে? তুই-ই তো বলেছিস আমি মেয়ে ঢুকিয়েছি ফ্ল্যাটে। বললেন মবিন সাহেব।

জ্বে না স্যার উনি বললেন, ‘তোমাদের ম্যাডাম তো বিদেশে গেছে তাইলে প্রায় দিন-ই সাহেবের সঙ্গে মেয়ে মানুষ গাড়ি থেকে নামে যে?’

তুই কী বললি?

বললাম, কই? না তো। স্যারের সঙ্গে মহিলা দেখলেন কই?

তারপর?

তারপর আর কী, চলে আসলাম।

আজ যে মেয়ে এনেছি সেটা দেখেছে?

জ্বে না স্যার। টেরই পায় নাই। বজলু দাঁত বের করে হাসতে হাসতে চলে গেল।

মবিন সাহেবেরও ইচ্ছে হয়েছিল হাসতে, কিন্তু হাসলেন না। বরফকুচি পাওয়া যায় নি।

বরফ ছাড়া হুইস্কি এক ঢোকও গিলতে পারেন না তিনি। আর হুইস্কি না খেলে তো চলে না তার।

আমু স্যার? ভেজানো দরজা ঠেলে প্রশ্ন করলো আফিয়া।

আয়। বললেন মবিন সাহেব। এরপর তাকালেন আফিয়ার দিকে। খুবই রূপসী। হাতের জ্বলন্ত সিগারেট ফেলে দিলেন মবিন সাহেব। হতবাক হয়ে চেয়ে থাকলেন আফিয়ার দিকে।

ভেজা মুখের মেয়েটার চুল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। ও ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আলাদা ঘ্রাণও যেনো পেলেন তিনি। মনে হচ্ছে আজ আর হুইস্কির প্রয়োজন হবে না। এমনিতেই শরীর মন দুটোই চাঙ্গা। এমনটি কবে হয়েছিল মনে নেই। যৌবনে পা দেবার পর পর হয়ে থাকতে পারে।

কী যেন নাম তোর? আবারও জিজ্ঞেস করলেন মবিন সাহেব।

আফিয়া। কিছুটা লাজুক জবাব দিল মেয়ে। পুরুষের চোখের মধ্যে নিজেকে দেখতে পেয়েছে আফিয়া।

কাছে আয়, আরও কাছে, আরও নিকটে। হাত ধরে আফিয়াকে কাছে টেনে নিলেন মবিন সাহেব।

মুখে চুমু দিতে উদ্যত হলেন; কিন্তু বাঁ-হাত তুলে বাধা দিল আফিয়া। মাফ করবেন স্যার।

কেন?

আমার ঠোঁটে চুমা দিবেন না।

কারণটা কী?

বলতে পারব না স্যার। আফিয়ার মনে পড়ল মিনার মায়ের কাছে রেখে আসা বাদশার কথা। নয় মাসের বাদশা ওর ঠোঁটে চুমু খায়।

সেই ঠোঁটে অন্য কারও অধিকার নেই। মা-পোলার ঠোঁটে ঠোঁট ঘষলে ওখানে গোলাপ ফোটে।

এর চাইতে সুন্দর দৃশ্য এই জগৎ সংসারে আর আছে কি?

তুই কাঁপতেছিস ক্যান? প্রশ্ন করলেন মবিন সাহেব। কিন্তু জবাব দিল না আফিয়া। পেতে রাখলো শরীর। জীবনকে লাথি মারতে ইচ্ছা হলো ওর। টাকার কাছে আজ বিক্রি হলো আফিয়া। এক রাতে পাঁচশ টাকা রফায় এসেছে। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালে বাদশাকে বাঁচাবে কী করে? নিজেইবা যাবে কোথায়, খাবে কী? আফিয়া মনে মনে অভিশাপ দিল স্বামীকে। এই যদি ছিল মনে তাহলে বাচ্চা দিছিল ক্যান পেটে? পেটের বাচ্চার লাইগা আজ নিজেকে শেষ করতে হইলো ক্যান? ক্যান মানুষটা একবারের লাইগাও খবর নিল না বউ-পোলার?

আফিয়ার প্রশ্নগুলোর কোনো জবাব নেই। জগৎ-সংসার খুবই নিষ্ঠুর। এখানে অনেকেরই প্রশ্নের জবাব মিলে না। মবিন সাহেবও প্রশ্নের ঘোরেই তো ঘুরপাক খাচ্ছেন। স্ত্রী আমেরিকা চলে গেছে অফিসের নাম করে। স্বামীকে সঙ্গে নেয়া যাবে না। অফিসের পারমিশন নেই। অথচ স্বামীর পারমিশন ছাড়াই স্ত্রী চলে গেছে।

তোর নাম যেন কী? প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে আবারও বললেন মবিন সাহেব। এবার আফিয়া খিলখিল করে হেসে উঠল।

কী হলো হাসছিস কেন? আবারও প্রশ্ন করলেন মবিন সাহেব।

আগে কয়েকবার নাম বলছি, আবারও নাম জানতে চান ক্যান?

ভুইলা গেছি। এক কাজ কর, কিচেনে গিয়ে চা বানিয়ে নিয়ে আয়। পারবি না? হ্যাঁসূচক মাথা নেড়ে অফিয়া চলে গেল কিচেনের দিকে। রান্নাঘরেই মেয়েদের সংসারী হবার স্বপ্ন। ওরও তাই। ছোটখাটো হলেও একটা সংসার গুছিয়েছিল মেয়ে। নরসিংদীর ভেলানগরে আড়াইশ টাকায় ঘর ভাড়া নিয়েছিল তারা। স্বামী রিকশা চালাতো। ভালোই চলছিল সংসার। ইনকাম বড়লে হাতে জমতোও কিছু টাকা। কিন্তু মানুষটা হইলো নিরুদ্দেশ। ক্যান এমুন কইরা কপাল ভাঙলো ওর?

আফিয়া মনে মনে ভাবলো। স্বামীর কথা ভাবলো। মনে পড়লো, স্বামীকে মনে করল। স্বামীর আদুরে মুখটাকে মনে মনে আদর করল আফিয়া।

আপনে আর কোনোদিন আমারে ছাইড়া যাইবেন না। রিকশা চালাইতে মুন না চাইলে খেমা দেইন। আমি গারমেনছের কামে লাইগা যামু। আপনে বাদশারে নিয়া ঘরে থাকবেন- আফিয়া মনে মনে স্বামীর সঙ্গে অনেক কথা বললো।

চুলায় ততোক্ষণে চায়ের পানি শুকিয়ে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।

সাহেবের ডাকে ওর টনক নড়লো।

এদিকে মবিন সাহেব বেল টিপে বজলুকে ডাকলেন। বজলু এলো। মেয়েটা ভালো।

ওর ঠায়-ঠিকানা রেখে দিবি।

বললেন মবিন সাহেব।

বজলু মাথা কাত করে সায় জানিয়ে বললো, কিছু কি লাগবো স্যার?

না কিছু লাগবে না। সবকিছুই আছে। আর শোন, রাত ভোর হবার আগেই ওকে বিদায় করবি।

কখন স্যার?

সাড়ে চারটা পাঁচটার দিকে।

পাঁচটার পরে বিদায় করি স্যার। সাড়ে চারটায় বিদায় করলে রাস্তায় গিয়া পুলিশের গুতানি খাইলে আবার নামধাম বইলা দিতে পারে।

ঠিক বলেছিস। এইগুলির তো মান-ইজ্জতের ভয় নাই। বজলু চলে যেতে মুভ করলো। মবিন সাহেব গোল্লা গোল্লা করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, আমি কইলাম ভোরবেলা ঘুমাবো। আস্তে ধীরে বের করে নিয়ে যাবি। ঘুম যেনো না ভাঙ্গে আমার। আর তুই প্রথম বাইরে বের হয়ে দেখে নিবি অন্য ফ্লাটের রেলিংয়ে কেউ দাঁড়িয়ে আছে কি-না।

আপনার কিছুই ভাবতে হইবো না স্যার। আমি কি বলদ নাকি? এমনভাবে হেইরে বাইর করুম মানুষ ক্যানো, কাক-পক্ষীও টের পাইবো না। যাই স্যার, ভালো থাকবেন।

ভালো থাকলেন মবিন সাহেব। আফিয়ার শরীরই শুধু নয়। সোহাগও যেনো পেলেন তিনি। বেশ ক’বার চা বানিয়ে খাইয়েছে। নিজের কোলে মাথা রেখে চুল টেনে দিয়েছে।

রাত তখন আড়াইটা। মবিন সাহেব নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন। পাশেই শুয়ে আছে আফিয়া। ওর চোখে ঘুম নেই। চেষ্টা করছে। কিন্তু ঘুম আসছে না। ঘুম আসবে কী করে? বাদশাটা মিনার মায়ের কাছে কী করছে কে জানে? রাতে যদি দুধ খাবার জন্য কান্নাকাটি করে তাহলে উপায় হবে কী?

আফিয়ার মনে ভাসল ছেলে বাদশার মুখ। শিশু একাডেমির সামনে বস্তা টানানো ঘরে ছেলেকে আফিয়া রেখে এসেছে মিনার মায়ের কাছে। মহিলা ওর জন্য অনেক করছে। দুঃসময়ে এতোটা আপন ক’জনই বা হয়? নির্ঘুম রাত কাটে আফিয়ার। কোনোভাবেই চোখের পাতা মেলাতে পারেনি। স্বামী আর সন্তানের মুখ সারাক্ষণই ভাসছিল ওর মনে। তখন সকাল পৌনে পাঁচটা। মসজিদে আজান পড়েছে মাত্র। ঘরের দরজায় টুকটুক করে টোকা পড়ল। আফিয়া উঠে বসল। পেমেন্ট দিতে দিতে স্যার বলেছিলেন, কাজের ছেলে নাকি ভোরে বের করে দিয়ে আসবে মেইন রোডে। সেই লোকই এলো বুঝি? আফিয়া কালো ওড়নায় নিজেকে ঢাকলো ভালো করে। এরপর ছিটকিনি খুললো দরজার। দেখলো কে যেনো একজন সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে যেতে বললো, নিচে গ্যারেজ ঘরে আয়। এখনই বিদায় হবি।

আফিয়ার বুঝতে বাকি থাকলো না কিছুই। এই লোকই যে মবিন সাহেবের কাজের মানুষ তা বুঝে গেল মেয়ে। মানে মানে বিদায় হতে পারলে বাঁচে আফিয়া। বজলু গ্যারেজের দুই গাড়ির চিপায় বস্তা বিছিয়ে অপেক্ষা করছে। স্যার মেয়ে নিয়ে এলে বিদায় কালে একটু সুযোগ নেয় বজলু। এটা তার পুরনো অভ্যাস। মেয়েরাও যারা আসে তারা তাতে কার্পণ্য করে না মোটেও। তারা জানে চাকর-বাকর হাতে না রাখলে চলবে না। কিন্তু এই মেয়েটা দেরি করছে কেন?

কই আপনে?

বজলু শুনলো আফিয়ার কণ্ঠ। চনমন করে উঠলো ভেতরটা। অতি চেনা কণ্ঠ যেন।

আয়, আয়, আমারে একটু আদর দিয়া যা, আরেকদিন স্যারেরে বইলা টিপস লইয়া দিমুনে। কথা শুনে চমকে ঘুরলো আফিয়া। মাথার ওড়নাটা ততক্ষণে সরে গেল অনেকটা। দু’জন মানুষই তখন মুখোমুখি। স্তম্ভিত তারা কিছুক্ষণ। এরপর হঠাৎই বজলু আফিয়াকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দৌড় দিল। আফিয়ার পড়ে যাবার উপক্রম হলো। টাল সামলে উঠে দাঁড়ালো। ছুটে যাওয়া মানুষটাকে ‘শুনেন শুনেন’ বলে পেছন থেকে গলা ছেড়ে ডাকলো আফিয়া। বজলু থামলো না। স্ত্রীর সামনে থামতে সাহস পেলো না। আফিয়ার চোখের সামনে তখন শুধুই ধুলার ওড়াওড়ি। মেয়েটা তখন আর কোনভাবেই মনে করতে পারলো না স্বামীর মুখটা।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

নিরন্তর ধুলা ওড়ে

জামাল রেজা

বৃহস্পতিবার, ১৪ অক্টোবর ২০২১

মেয়েটা ঘরে ঢুকে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মবিন সাহেব চোখের চশমা খুলে হাতে নিলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। এরপর বললেন, নাম কী তোর?

আফিয়া বেগম, মেয়েটা বললো।

এই লাইনে কতদিন?

আফিয়া মাথা নিচু করল।

বিয়েশাদি হয় নাই? আবারও মবিন সাহেব প্রশ্ন করলেন। আফিয়া মাথা তুললো। কী যেনো একটা বললো। মবিন সাহেব বুঝতে পারলেন না। বললেন, ডানদিকে বাথরুম আছে। ভালো করে গোসল করে আয়। সাবান মাখবি শরীরে।

স্যার আমার লগে আলাদা কাপড় নাই।

বললো আফিয়া।

আলাদা কাপড়ের কোনো দরকার নাই, যাইয়া দেখ বাথরুম খুব সুন্দর।

আফিয়া আবার কিছু একটা বলতে গেলে থামিয়ে দিলেন মবিন সাহ্বে। হাত ইশারায় চলে যেতে ইঙ্গিত করলেন তিনি। প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরালেন। বজলুর জন্য তার এখন প্রতীক্ষা। সে ড্রিংকসের আয়োজন করবে। বরফ কুচি না হলে চলে না। আজ দিনেরবেলা ইলেকট্রিসিটি ছিল না মহল্লায়। বরফ জমেনি ফ্রিজে। বজলু সে কথা আগেই জানিয়েছে। এখন তাকে ওপর তলায় মিহিদের ঘরে পাঠানো হয়েছে। তাদের ডিপ ফ্রিজ আছে। কেচে কুচে হলেও কিছু বরফ পাওযা যেতে পারে। কিন্তু বজলু যে গেছে তাও পনের-বিশ মিনিট হয়ে গেল। তাহলে কি বরফ পাওয়া যাবে না? ঐ মেয়ে তুই গোসল করতে গেলি না?

আজ দিনেরবেলা ইলেকট্রিসিটি ছিল না মহল্লায়। বরফ জমেনি ফ্রিজে। বজলু সে কথা আগেই জানিয়েছে

আফিয়া মাথা তুলে অপরাধী ভঙ্গিতে তাকালো মবিন সাহেবের দিকে। মবিন সাহেব রাগলেন না। হেসে দিয়ে বললেন, যা, গোসলটা দিয়ে আয়। জলদি কর। আবারও কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে যায় আফিয়া। শহরের নতুন অতিথি এই মেয়ে। তিন পেরিয়ে আজ চতুর্থ দিন। গতকাল মর্জিনার সঙ্গে রমনা পার্কের লেকে গিয়ে গোসল করে এসেছে। এখন আলাদা কাপড় ছাড়া কীভাবে গোসল করবে তা ঢুকছে না মাথায়। ছতর ঢাকার বিষয়টি মাথার ভেতর ভন-ভন করছে। অসহায় আফিয়া, কর্তার ইচ্ছায় কর্ম বলে কথা। ও বাথরুমে ঢুকলো। বন্ধ করলো দরজা। গায়ের পরিচ্ছদ খুলতে খুলতে হঠাৎ আঁৎকে উঠল। বুকের বাম দিকটায় কালো একটা দাগ হয়ে আছে। ল্যাংড়া মন্টু দাগটা করেছে। গত রাতে জবরদস্তি করে অফিয়াকে পরাস্ত করেছিল কার্জন হলের দেয়ালের আড়ালে। মিনার মা-ই বলেছিল, ল্যাংড়ার কথা না শুনলে না-কি হাইকোর্ট এরিয়াতে থাকা যাবে না। সে কারণে আফিয়াও রাজি হয়েছিল। কিন্তু কে জানতো জানোয়ারটা এইভাবে কামড় বসিয়ে দেবে? সঙ্গে সঙ্গে আহ, উহ, করে উঠলেও পুলিশের ভয়ে কণ্ঠ চড়ায়নি একবারও। আশ্রয় আর মিলবে কোথায়? মিনার মা তো শুরুতেই বলেছিল শরীরের মায়া করলে না-কি ঠাঁই হবে না, তাহলে আবার প্রশ্ন কেন?

আফিয়া শরীরে মগ দিয়ে পানি ঢাললো। সাবান মাখলো। নিজের শরীর এই প্রথম আয়নায় দেখলো সে। টাটটি ঘরে (বাথরুমে) এমন বড় আয়না ক্যান? প্রশ্নটা নিজেকেই করলো আফিয়া। এরপর নিজের শরীরটা ভালো করে দেখল। সত্যি চমৎকার গড়ন। না চিকন, না মোটা। স্বামীর কথা মনে পড়লো ওর। ছোট ছোট করে বলতো, তোর মতন এমন সুন্দরী বউয়ের খোয়াবই সারাজীবন দেখছি। কিন্তু সেই মানুষটা পাল্টালো অল্প দিনেই। বাচ্চা কোলে নিয়ে সে কারণেই আট মাসের মাথায় ঢাকা শহরে পাড়ি জমালো আফিয়া। বাধ্য হলো। কী করবে আর? নিজেই যেখানে খেতে পায় না, সেখানে বাচ্চার দুধ যোগাবে কোত্থেকে?

এদিকে মবিন সাহেবের মেজাজ গরম হয়ে গেছে। একে তো বরফকুচি পাওয়া যায় নি, তার উপরে ফ্ল্যাটে যে মেয়ে ঢুকেছে, সে কথা বজলু নাকি স্বীকার করেছে মিহির মায়ের কাছে। বাপের অফিসের পিয়নের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করতে পারে যে মেয়ে, তার এতো প্রশ্ন কিসের? স্যার আমার কী দোষ? কম্পিত কণ্ঠে কুর্নিশের ভঙ্গিতে বললো বজলু।

তোর কী দোষ মানে? তুই-ই তো বলেছিস আমি মেয়ে ঢুকিয়েছি ফ্ল্যাটে। বললেন মবিন সাহেব।

জ্বে না স্যার উনি বললেন, ‘তোমাদের ম্যাডাম তো বিদেশে গেছে তাইলে প্রায় দিন-ই সাহেবের সঙ্গে মেয়ে মানুষ গাড়ি থেকে নামে যে?’

তুই কী বললি?

বললাম, কই? না তো। স্যারের সঙ্গে মহিলা দেখলেন কই?

তারপর?

তারপর আর কী, চলে আসলাম।

আজ যে মেয়ে এনেছি সেটা দেখেছে?

জ্বে না স্যার। টেরই পায় নাই। বজলু দাঁত বের করে হাসতে হাসতে চলে গেল।

মবিন সাহেবেরও ইচ্ছে হয়েছিল হাসতে, কিন্তু হাসলেন না। বরফকুচি পাওয়া যায় নি।

বরফ ছাড়া হুইস্কি এক ঢোকও গিলতে পারেন না তিনি। আর হুইস্কি না খেলে তো চলে না তার।

আমু স্যার? ভেজানো দরজা ঠেলে প্রশ্ন করলো আফিয়া।

আয়। বললেন মবিন সাহেব। এরপর তাকালেন আফিয়ার দিকে। খুবই রূপসী। হাতের জ্বলন্ত সিগারেট ফেলে দিলেন মবিন সাহেব। হতবাক হয়ে চেয়ে থাকলেন আফিয়ার দিকে।

ভেজা মুখের মেয়েটার চুল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। ও ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আলাদা ঘ্রাণও যেনো পেলেন তিনি। মনে হচ্ছে আজ আর হুইস্কির প্রয়োজন হবে না। এমনিতেই শরীর মন দুটোই চাঙ্গা। এমনটি কবে হয়েছিল মনে নেই। যৌবনে পা দেবার পর পর হয়ে থাকতে পারে।

কী যেন নাম তোর? আবারও জিজ্ঞেস করলেন মবিন সাহেব।

আফিয়া। কিছুটা লাজুক জবাব দিল মেয়ে। পুরুষের চোখের মধ্যে নিজেকে দেখতে পেয়েছে আফিয়া।

কাছে আয়, আরও কাছে, আরও নিকটে। হাত ধরে আফিয়াকে কাছে টেনে নিলেন মবিন সাহেব।

মুখে চুমু দিতে উদ্যত হলেন; কিন্তু বাঁ-হাত তুলে বাধা দিল আফিয়া। মাফ করবেন স্যার।

কেন?

আমার ঠোঁটে চুমা দিবেন না।

কারণটা কী?

বলতে পারব না স্যার। আফিয়ার মনে পড়ল মিনার মায়ের কাছে রেখে আসা বাদশার কথা। নয় মাসের বাদশা ওর ঠোঁটে চুমু খায়।

সেই ঠোঁটে অন্য কারও অধিকার নেই। মা-পোলার ঠোঁটে ঠোঁট ঘষলে ওখানে গোলাপ ফোটে।

এর চাইতে সুন্দর দৃশ্য এই জগৎ সংসারে আর আছে কি?

তুই কাঁপতেছিস ক্যান? প্রশ্ন করলেন মবিন সাহেব। কিন্তু জবাব দিল না আফিয়া। পেতে রাখলো শরীর। জীবনকে লাথি মারতে ইচ্ছা হলো ওর। টাকার কাছে আজ বিক্রি হলো আফিয়া। এক রাতে পাঁচশ টাকা রফায় এসেছে। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালে বাদশাকে বাঁচাবে কী করে? নিজেইবা যাবে কোথায়, খাবে কী? আফিয়া মনে মনে অভিশাপ দিল স্বামীকে। এই যদি ছিল মনে তাহলে বাচ্চা দিছিল ক্যান পেটে? পেটের বাচ্চার লাইগা আজ নিজেকে শেষ করতে হইলো ক্যান? ক্যান মানুষটা একবারের লাইগাও খবর নিল না বউ-পোলার?

আফিয়ার প্রশ্নগুলোর কোনো জবাব নেই। জগৎ-সংসার খুবই নিষ্ঠুর। এখানে অনেকেরই প্রশ্নের জবাব মিলে না। মবিন সাহেবও প্রশ্নের ঘোরেই তো ঘুরপাক খাচ্ছেন। স্ত্রী আমেরিকা চলে গেছে অফিসের নাম করে। স্বামীকে সঙ্গে নেয়া যাবে না। অফিসের পারমিশন নেই। অথচ স্বামীর পারমিশন ছাড়াই স্ত্রী চলে গেছে।

তোর নাম যেন কী? প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে আবারও বললেন মবিন সাহেব। এবার আফিয়া খিলখিল করে হেসে উঠল।

কী হলো হাসছিস কেন? আবারও প্রশ্ন করলেন মবিন সাহেব।

আগে কয়েকবার নাম বলছি, আবারও নাম জানতে চান ক্যান?

ভুইলা গেছি। এক কাজ কর, কিচেনে গিয়ে চা বানিয়ে নিয়ে আয়। পারবি না? হ্যাঁসূচক মাথা নেড়ে অফিয়া চলে গেল কিচেনের দিকে। রান্নাঘরেই মেয়েদের সংসারী হবার স্বপ্ন। ওরও তাই। ছোটখাটো হলেও একটা সংসার গুছিয়েছিল মেয়ে। নরসিংদীর ভেলানগরে আড়াইশ টাকায় ঘর ভাড়া নিয়েছিল তারা। স্বামী রিকশা চালাতো। ভালোই চলছিল সংসার। ইনকাম বড়লে হাতে জমতোও কিছু টাকা। কিন্তু মানুষটা হইলো নিরুদ্দেশ। ক্যান এমুন কইরা কপাল ভাঙলো ওর?

আফিয়া মনে মনে ভাবলো। স্বামীর কথা ভাবলো। মনে পড়লো, স্বামীকে মনে করল। স্বামীর আদুরে মুখটাকে মনে মনে আদর করল আফিয়া।

আপনে আর কোনোদিন আমারে ছাইড়া যাইবেন না। রিকশা চালাইতে মুন না চাইলে খেমা দেইন। আমি গারমেনছের কামে লাইগা যামু। আপনে বাদশারে নিয়া ঘরে থাকবেন- আফিয়া মনে মনে স্বামীর সঙ্গে অনেক কথা বললো।

চুলায় ততোক্ষণে চায়ের পানি শুকিয়ে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।

সাহেবের ডাকে ওর টনক নড়লো।

এদিকে মবিন সাহেব বেল টিপে বজলুকে ডাকলেন। বজলু এলো। মেয়েটা ভালো।

ওর ঠায়-ঠিকানা রেখে দিবি।

বললেন মবিন সাহেব।

বজলু মাথা কাত করে সায় জানিয়ে বললো, কিছু কি লাগবো স্যার?

না কিছু লাগবে না। সবকিছুই আছে। আর শোন, রাত ভোর হবার আগেই ওকে বিদায় করবি।

কখন স্যার?

সাড়ে চারটা পাঁচটার দিকে।

পাঁচটার পরে বিদায় করি স্যার। সাড়ে চারটায় বিদায় করলে রাস্তায় গিয়া পুলিশের গুতানি খাইলে আবার নামধাম বইলা দিতে পারে।

ঠিক বলেছিস। এইগুলির তো মান-ইজ্জতের ভয় নাই। বজলু চলে যেতে মুভ করলো। মবিন সাহেব গোল্লা গোল্লা করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, আমি কইলাম ভোরবেলা ঘুমাবো। আস্তে ধীরে বের করে নিয়ে যাবি। ঘুম যেনো না ভাঙ্গে আমার। আর তুই প্রথম বাইরে বের হয়ে দেখে নিবি অন্য ফ্লাটের রেলিংয়ে কেউ দাঁড়িয়ে আছে কি-না।

আপনার কিছুই ভাবতে হইবো না স্যার। আমি কি বলদ নাকি? এমনভাবে হেইরে বাইর করুম মানুষ ক্যানো, কাক-পক্ষীও টের পাইবো না। যাই স্যার, ভালো থাকবেন।

ভালো থাকলেন মবিন সাহেব। আফিয়ার শরীরই শুধু নয়। সোহাগও যেনো পেলেন তিনি। বেশ ক’বার চা বানিয়ে খাইয়েছে। নিজের কোলে মাথা রেখে চুল টেনে দিয়েছে।

রাত তখন আড়াইটা। মবিন সাহেব নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন। পাশেই শুয়ে আছে আফিয়া। ওর চোখে ঘুম নেই। চেষ্টা করছে। কিন্তু ঘুম আসছে না। ঘুম আসবে কী করে? বাদশাটা মিনার মায়ের কাছে কী করছে কে জানে? রাতে যদি দুধ খাবার জন্য কান্নাকাটি করে তাহলে উপায় হবে কী?

আফিয়ার মনে ভাসল ছেলে বাদশার মুখ। শিশু একাডেমির সামনে বস্তা টানানো ঘরে ছেলেকে আফিয়া রেখে এসেছে মিনার মায়ের কাছে। মহিলা ওর জন্য অনেক করছে। দুঃসময়ে এতোটা আপন ক’জনই বা হয়? নির্ঘুম রাত কাটে আফিয়ার। কোনোভাবেই চোখের পাতা মেলাতে পারেনি। স্বামী আর সন্তানের মুখ সারাক্ষণই ভাসছিল ওর মনে। তখন সকাল পৌনে পাঁচটা। মসজিদে আজান পড়েছে মাত্র। ঘরের দরজায় টুকটুক করে টোকা পড়ল। আফিয়া উঠে বসল। পেমেন্ট দিতে দিতে স্যার বলেছিলেন, কাজের ছেলে নাকি ভোরে বের করে দিয়ে আসবে মেইন রোডে। সেই লোকই এলো বুঝি? আফিয়া কালো ওড়নায় নিজেকে ঢাকলো ভালো করে। এরপর ছিটকিনি খুললো দরজার। দেখলো কে যেনো একজন সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে যেতে বললো, নিচে গ্যারেজ ঘরে আয়। এখনই বিদায় হবি।

আফিয়ার বুঝতে বাকি থাকলো না কিছুই। এই লোকই যে মবিন সাহেবের কাজের মানুষ তা বুঝে গেল মেয়ে। মানে মানে বিদায় হতে পারলে বাঁচে আফিয়া। বজলু গ্যারেজের দুই গাড়ির চিপায় বস্তা বিছিয়ে অপেক্ষা করছে। স্যার মেয়ে নিয়ে এলে বিদায় কালে একটু সুযোগ নেয় বজলু। এটা তার পুরনো অভ্যাস। মেয়েরাও যারা আসে তারা তাতে কার্পণ্য করে না মোটেও। তারা জানে চাকর-বাকর হাতে না রাখলে চলবে না। কিন্তু এই মেয়েটা দেরি করছে কেন?

কই আপনে?

বজলু শুনলো আফিয়ার কণ্ঠ। চনমন করে উঠলো ভেতরটা। অতি চেনা কণ্ঠ যেন।

আয়, আয়, আমারে একটু আদর দিয়া যা, আরেকদিন স্যারেরে বইলা টিপস লইয়া দিমুনে। কথা শুনে চমকে ঘুরলো আফিয়া। মাথার ওড়নাটা ততক্ষণে সরে গেল অনেকটা। দু’জন মানুষই তখন মুখোমুখি। স্তম্ভিত তারা কিছুক্ষণ। এরপর হঠাৎই বজলু আফিয়াকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দৌড় দিল। আফিয়ার পড়ে যাবার উপক্রম হলো। টাল সামলে উঠে দাঁড়ালো। ছুটে যাওয়া মানুষটাকে ‘শুনেন শুনেন’ বলে পেছন থেকে গলা ছেড়ে ডাকলো আফিয়া। বজলু থামলো না। স্ত্রীর সামনে থামতে সাহস পেলো না। আফিয়ার চোখের সামনে তখন শুধুই ধুলার ওড়াওড়ি। মেয়েটা তখন আর কোনভাবেই মনে করতে পারলো না স্বামীর মুখটা।

back to top