alt

সাময়িকী

‘সময়সাগরতীরে জীবনানন্দ’

চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদের জীবনানন্দ ভ্রমণ

রিসতিয়াক আহমেদ

: বৃহস্পতিবার, ১৪ অক্টোবর ২০২১

চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ

জীবনানন্দ দাশ। একটি অপার বিস্ময়ের নাম। যিনি সময়সাগরতীরে বসে অবলোকন করেছেন মহাসময়কে। সংখ্যারেখার মতো শূন্যে বসে তাঁর দু’হাত মেলে ধরেছেন অতীত এবং বর্তমানে। বলতে পেরেছেন-

‘মানুষের মৃত্যু হ’লে তবুও মানব

থেকে যায়; অতীত থেকে উঠে আজকের মানুষের কাছে

প্রথমত চেতনার পরিমাপ নিতে আসে।’

জীবনানন্দের শিল্প নিয়ে এতো রহস্য, এতো বিস্ময় কেন? কারণ যে কোনো উচ্চমার্গীয় ভাষাশিল্পের প্রধান হাতিয়ারই হলো তার রূপক। ভাষার অপর নাম রূপকই। এই যে বলা হলো নাম। এই তো রূপক। মহান স্রষ্টা এই রূপকের ব্যবহার করেন সর্বোচ্চ। এবং সাথে সাথে আপেক্ষিক সময়ের পরিবর্তনের সাথে অভিযোজিত হতে থাকে পাঠক হৃদয়ের মেটাফোরিক অঞ্চলগুলোতে। সৃষ্টি হয় মুখোমুখি বসিবার জীবনের সব লেনদেন।

স্রষ্টা করে যান সৃষ্টি। তাঁর সৃষ্টিতে আমরা হই বিস্মিত। এবং গ্রহণ করি নিজ নিজ দৃষ্টির জায়গা থেকে। আবার কৌতূহল জাগে তার সৃষ্টির মন্ত্রকে জানার। আর তাই তাকে কখনো আখ্যা দেয়া হয় প্রেমের কবি, প্রকৃতির কবি, ইতিহাস চেতনার কবি; কখনোবা নির্জনতম কবি, শুদ্ধতম কবি। তাঁর সৃষ্টিকে প্রবেশ করানো হয় রোমান্টিসিজম, মডার্নিজম, রিয়েলিজম, সুররিয়েলিজম, পোস্টমডার্নিজমের পরীক্ষাগারগুলোতে। কিন্তু কোনোখানেই তার পূর্ণ সত্য মেলে না। কেননা তিনি তো জীবন এঁকেছেন। জীবন তো কোনো সরল ঐকিক অঙ্ক নয়। তবে এসব অংশত সত্যের সমন্বয়েই মেলে পূর্ণ সত্য। আর তাই চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ তাঁর ‘সময়সাগরতীরে জীবনানন্দ’ গ্রন্থে জীবনানন্দের সৃষ্টির সর্বাধিক মেটাফোরিক অঞ্চলগুলোকে আলোচনার চেষ্টা করেছেন।

কবি সর্বদ্রষ্টা। আর তাই তাঁর চোখে কিছুই এড়ায় না। এবং দেখেন আরও অনেক দূর পর্যন্ত। কিংবা দেখেন অন্যকিছু। সমাজের অসামঞ্জস্য থেকেই কবির জন্ম। তাঁর সংবেদনশীল হৃদয় তাঁকে এড়িয়ে যেতে দেয় না। আর তাই জীবনানন্দের জীবদ্দশায় সৃষ্ট দু’টি বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, দুর্ভিক্ষ এবং এর প্রভাবে সমাজের যে আমূল পরিবর্তন- মানুষে মানুষে বিশ্বাসহীনতা, দেশভাগে অস্তিত্বের সংকট, চারিদিকে শবের উৎসব- তা কবির সংবেদনশীল হৃদয় এড়াতে পারেনি। আর তাই ‘ঝরা পালক’ থেকে শুরু করে ‘সাতটি তারার তিমির’ পর্যন্ত প্রতিটি কাব্যগ্রন্থে কখনো সরাসরি কখনোবা রহস্যভারে তিনি সমকালকে প্রকাশ করেছেন। প্রাবন্ধিক-কবি-সমালোচক চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ তাঁর গ্রন্থে জীবনানন্দের ‘কার্ত্তিকের ভোর-১৩৫০’, ‘১৯৪৬-৪৭’, ‘বলিল অশ্বত্থ সেই’, ‘সুচেতনা’, ‘রাত্রির কোরাস’, ‘মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছে’, ‘সময়ের কাছে’ প্রতিটি কবিতায় পঙ্ক্তি থেকে পঙ্ক্তিতে কবির সমকাল চেতনা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন।

কিন্তু কবি জানেন সমকাল মহাকালের অংশমাত্র। আর তাই তিনি উপলব্ধি করেন- মহাবিশ্বলোকের ইশারার থেকে উৎসারিত সময় চেতনা আমার কাব্যে একটি সঙ্গতিসাধক অপরিহার্য সত্যের মতো; কবিতা লিখবার পথে কিছু দূর অগ্রসর হয়েই এ আমি বুঝেছি, গ্রহণ করেছি। এর থেকে বিচ্যুতির কোনো মানে নেই আমার কাছে। তবে সময় চেতনার নতুন মূল্য আবিষ্কৃত হতে পারে। বলেন- সমস্ত অতীত ও ভবিষ্যৎ আজকের সাথে মিশে গিয়ে বর্তমানকে স্পষ্টতরভাবে গঠন করে। আবার কাল বা সময় বৈনাশিক, কিন্তু সে সেই সমস্ত কুয়াশাগুলোকেই কেটে কেটে চলেছে যা পরিপ্রেক্ষিতের ব্যাপ্তি বাড়াবার পক্ষে অন্তরায়ের মতো। এদিকে শঙ্খ ঘোষ জীবনানন্দের সময় চেতনাকে ব্যক্তিকাল, মানবকাল ও বিশ্বকাল- এই তিনটি স্তরে বিভাজ্য করেন। এই যে জীবনানন্দের সময় চেতনা এটি তিনি কীভাবে উপলব্ধি করলেন? একটি মানুষের যে অভিজ্ঞতা তা কি তার বয়সের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? অবশ্যই নয়। তিনি ইতিহাসের সন্তান। তার পূর্বজ পুরুষদের অর্জিত অভিজ্ঞতা তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। জীবনানন্দের কবিতা আলোচনা করতে অনেক আলোচকই যে পাশ্চাত্যের আশ্রয় নেন তাতে মাইকেলের বাংলায় সনেট প্রবেশের মতো কাঠামোয় চলে কিন্তু দর্শনে নয়। কেননা, জীবনানন্দ বাংলায় জন্মেছেন। এর জল, আলো, বাতাসে বেড়ে উঠেছেন। লিখেছেন একদম খাঁটি বাংলা কবিতা। আর তাই তাঁর সময় চেতনার দর্শনও ভারতীয় প্রাচীন দর্শন অনুযায়ী। সময় অনন্ত, যার শুরুও নেই, শেষও নেই, আছে আবর্তন। এখানে চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ কবির সময় চেতনার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেন- সময় এক শক্তিশালী বিনাশকারী, যে মুছে দেয় সব নক্ষত্র, পুরোনো পথ, কমলা ফুল, বন, বনের পথ। শুধু বেঁচে থাকে সৌন্দর্য, যার জন্ম ও অবস্থান মানুষের মনে। অর্থাৎ বর্তমান কালের নশ্বরতা ও মহাকালের অবিনশ্বরতাই মূলত জীবনানন্দ দাশের সময় চেতনা।

এই যে কবি তাঁর ভাবকে ভাষায় প্রকাশ করেন। ফলত তাঁকে গ্রহণ করতে হয় ভাষার বিভিন্ন অঞ্চলকে। কখনো উপমা, কখনো চিত্রকল্প, কখনো প্রতীকধর্মিতা। তাত্ত্বিকগণ এদেরই একটি ফর্ম দেন পরাবাস্তববাদ। পরাবাস্তববাদকে কবি জীবনানন্দও অস্বীকার করেননি কিন্তু বলেছেন তা সমগ্র ক্ষেত্রে নয়। আবার জীবনানন্দের কবিতার আলোচনা পরাবাস্তববাদেই অধিক চর্চিত হয়েছে। চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদও পরাবাস্তব ফর্মে আলোচনা করতে গিয়ে কবির ‘বেড়াল’ কবিতায় খুঁজে পান মানুষের চিরন্তন সংগ্রামের ছবি, ‘হরিণেরা’ কবিতায় অতীতের হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকাদের, ‘ঘাস’ কবিতায় বিশ্বপ্রকৃতির প্রতিনিধি আর ‘ঘোড়া’ কবিতায় মানুষের চিরন্তন নিয়তিবাদকে।

চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ মনে করেন- জীবনানন্দের কাছে হেমন্ত যেন এক ত্রিপার্শ্ব কাচ, যে বিচ্ছুরিত করেছে বিভিন্ন রঙ, সাথে বিভিন্ন শব্দ, ঘ্রাণ, স্বাদ ও স্পর্শের অনুভূতি। তাঁর কাছে হেমন্ত কখনো পূর্ণতার প্রতীক, কখনো শূন্যতার, কখনো প্রেমের, কখনোবা বিনাশের

এখন কবি তাঁর ভাব প্রকাশের জন্য উপকরণ কোথায় পান? অবশ্যই যেখানে তিনি বাস করেন। এই বাস তার ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক এবং আধ্যাত্মিক বসবাস। যা তিনি হাজার বছর ধরে জিনিওলজির মাধ্যমে বাস করে চলেছেন। কবিতা সম্পর্কে জীবনানন্দের উপলব্ধি- কবিতার অস্থির ভেতরে থাকবে ইতিহাস চেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান। শঙ্খ ঘোষের যে মানবকাল সেখানে জীবনানন্দ সম্পর্কে চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদের উপলব্ধি- মানব অস্তিত্বের আবহমানকালের ইতিহাসকে জীবনানন্দ দেখতে চেয়েছেন এক অবিচ্ছিন্ন ও অখ- সত্তারূপে। তাঁর কাছে যেন এক ক্যানভাসে উপস্থিত বিভিন্ন কাল, বিভিন্ন ভূগোল- এসব তিনি তাঁর কবিতায় যুক্ত-বিযুক্ত করেছেন, পুনর্নির্মাণ করেছেন কখনো ইতিহাসের চিত্রপট, কখনো তার ভেতরের ভাবসত্যটুকু, আবার কখনো দু’টির সমন্বয়, কবি ও ঐতিহাসিকের দ্বৈত ভূমিকায়। যে যুগে জীবনানন্দ বসবাস করেছেন তা ছিল মৃত্যুর শব্দে বেদনার্ত ও যুদ্ধধ্বস্ত, যা কবির কাছে মনে হয়েছে ‘অদ্ভুত আধার এক’। সে থেকে মুক্তি পেতে কবি বারবার ফিরেছেন বিভিন্ন ভূগোল ও সভ্যতার হারানো অতীতে; সেখানেও ছিল ‘রণ রক্ত’, তবু তার মাঝেও ছিল সৌন্দর্য ও মানবিকতা। রূপকথা ও পরাবাস্তবের মাধুরি মিশিয়ে কবি ইতিহাসের শূন্যস্থানগুলি পূরণ করেছেন, তৈরি করেছেন যেন তাঁর কাক্সিক্ষত বিশ্ব: ‘আরো আলো: মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়’। অর্থাৎ এটিই হলো ব্যক্তিকাল, মানবকাল ও বিশ্বকালের পারস্পরিক সম্পর্ক। আবার চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ প্রদ্যুম্ন মিত্রের উপলব্ধি তুলে ধরছেন- জীবনানন্দের কাছে ইতিহাস চেতনার অর্থ নিছক অতীত ইতিহাসের আবহ ও পরিমণ্ডল রচনা নয়, মানবেতিহাসের অন্তর্লীন প্রেরণা ও প্রয়াণের সুরটি চিনে নেওয়া ও চিনিয়ে দেওয়া। তাঁর সৃষ্টিতে ইতিহাসের এই ভাবসত্যের উপস্থাপনার পর্যালোচনাতেই আমাদের আগ্রহ। ‘নগ্ন নির্জন হাত’ কবিতায় চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ খুঁজে পান কবির অতীত ঐশ্বর্য উপলব্ধির সাথে বর্তমানের গম্বুজের বেদনাময় রেখা, নাশপাতির গন্ধ, হরিণ ও সিংহের ছালের ধূসর পাণ্ডুলিপি। আর ‘অস্ত চাঁদ’, ‘পিরামিড’, ‘মিশর’, ‘মনোবীজ’, ‘হাওয়ার রাত’ কবিতায় মিশরীয় সভ্যতায় কবিকে ভ্রমণ করতে দেখেছেন বারবার। সাথে নিজের এশিরিয়া সভ্যতা।

চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ দার্শনিক ও ইতিহাসবিদ ভিকোর ইতিহাসের দর্শনের মূল কথাটি আলোচনা করেন। যেখানে বলা হচ্ছে- প্রচলিত ইতিহাস আলোচনায় বিজেতাদের কথাই শুধু আলোচিত হয়। সেখানে ধর্মবিরোধী ব্যক্তি, বিপ্লবী আন্দোলন, বিদ্রোহী নেতা বা প্রথাবিরোধী ঘটনাসমূহ মূল ধারার প্রতিষ্ঠিত ও লিপিবদ্ধ ইতিহাসে সচরাচর জায়গা করে নিতে পারে না। এখন প্রশ্ন হলো তাহলে তাদের জায়গা কোথায়? তাদের গ্রহণ করে লোকজ সংস্কৃতি। জীবনানন্দ দাশ মূলত ইতিহাস বলতে নিজের দেশের সাথে সাথে বিশ্বের অন্যান্য সভ্যতার ঐতিহ্য ও লোকজ উপাদানকেই গ্রহণ করেছেন। লোকজ উপাদানের খুব বড় জায়গা হলো রূপকথা। জীবনানন্দ লোকায়ত ও আবহমান বাংলার রূপকথাকে গ্রহণ করেছেন। আবার সেখানে তৈরি করেছেন বিনির্মাণ। সৃষ্টি করেছেন আর একটি মায়ারাজ্য। আর তাই ‘রূপসী বাংলা’ হয়ে ওঠে আমাদের কাছে চিরচেনার মাঝেও একটি নতুন বাংলা।

পৃথিবীর বা মহাবিশ্বের প্রতিটি উপাদানই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। যাকে আমরা ধর্ম বা বিজ্ঞান বা আধ্যাত্মিকতা যে দিক থেকেই আলোচনা করার চেষ্টা করি না কেন; সকল ক্ষেত্রে তার নাম প্রকৃতি। আর এই সম্পর্ককে উপলব্ধি করেই জীবনের অন্য মানে কবিতায় স্থান পায়। যা আমরা আমাদের আপাত বাস্তব জীবনে পাই না। আর ভৌগোলিক বসবাস তো প্রকৃতিরই নামান্তর। কিন্তু বুদ্ধদেব বসু কেন বলতে বাধ্য হচ্ছেন- সমগ্র জীবনকে প্রকৃতির ভিতর দিয়েই গ্রহণ এবং প্রকাশ করেন এমন কবির সংখ্যা কম। কারণ জীবনানন্দ প্রকৃতিকে উপর থেকে তার বাহ্যিকরূপ দেখে নয়, প্রকৃতির অংশ হয়ে তার ভেতর প্রবেশ করে মিশে গিয়ে উপলব্ধি করেছেন। চৌধুরী সালাহউদ্দীন জীবনানন্দের প্রকৃতির চিত্রকল্পের আলোচনা করতে গিয়ে প্রসঙ্গত কারণেই চিত্রশিল্পী ক্লদ মনেকে অবতারণ করেন। যিনি তাঁর গৃহের পুকুরে জন্মানো জলপদ্মের বিভিন্ন পরিবেশের বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন রূপ উপলব্ধি করে ২৫০টির বেশি ছবি এঁকেছেন। আর জীবনানন্দ ছবি এঁকেছেন কবিতার শব্দমালায়। আর এখানে প্রকৃতি মূলত স্বদেশ প্রেম। জীবনানন্দ প্রকৃতির ছবি আঁকতে গিয়ে তার সাথে যুক্ত করেছেন পুরাণ। জলের দেবী বারুণী বিরাজ করে গঙ্গাসাগরে, আর জলের দেবতা বরুণ অবিরল জল দান করে যায় কর্ণফুলী-ধলেশ্বরী-পদ্মা-জলাঙ্গীরে। কবির বিশ্বাস, দেবী বিশালাক্ষীর আশীর্বাদেই শঙ্খমালা জন্ম নিয়েছে নীল বাংলার ঘাস আর ধানের ভিতর।

প্রকৃতি নিয়ে কবিতা লিখতে গেলে চলে আসে প্রকৃতির ঋতু। বাংলার চিরায়ত কাব্যে দেখা যায় বসন্ত, বর্ষা, শরতের বর্ণনা এবং বন্দনা। কিন্তু জীবনানন্দ হেমন্তকে বেছে নিলেন কেন? বা হেমন্তের কোন উপাদানগুলো জীবনানন্দকে আকৃষ্ট করল। চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ মনে করেন- জীবনানন্দের কাছে হেমন্ত যেন এক ত্রিপার্শ্ব কাচ, যে বিচ্ছুরিত করেছে বিভিন্ন রঙ, সাথে বিভিন্ন শব্দ, ঘ্রাণ, স্বাদ ও স্পর্শের অনুভূতি। তাঁর কাছে হেমন্ত কখনো পূর্ণতার প্রতীক, কখনো শূন্যতার, কখনো প্রেমের, কখনোবা বিনাশের। জীবনানন্দের হেমন্তের এই বহুমাত্রিক দিক যেন, তাঁর নিজের ভাব-বিশ্বাসের বহুমাত্রিকতারই প্রকাশ। ‘অবসরের গান’ কবিতায় খুঁজে পান হেমন্তের বৈপরীত্য। ‘গোধূলি সন্ধির নৃত্য’ কবিতাতেও তাই চাঁদ ও সূর্যের সহাবস্থান।

এই যে প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের মধ্যকার সম্পর্ক তার মন্ত্র কী? মন্ত্র প্রেম। কবিতার সর্বাধিক ব্যবহৃত বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে প্রেম এবং মৃত্যু। এবং রয়েছে প্রেমের বহুমাত্রিকতা। জীবনানন্দের ‘প্রেম’ কবিতায় চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ খুঁজে পান একই সাথে জীবনের জয়গান আবার প্রেমের ক্ষণিকতা। আর ‘নির্জন স্বাক্ষর’ কবিতায় নিঃস্বার্থ প্রেম। কিন্তু জীবনানন্দের প্রেম চেতনার মূল হলো বিষণ্নতা ও ক্ষণিকতার বোধ। কবি মনে করেন প্রেম উজ্জ্বল আলো আর আনন্দ নিয়ে আসে, কিন্তু পরিশেষে প্রেমের ক্ষণিকতাই বাস্তব হয়ে ওঠে, আর তা ছড়িয়ে দেয় এক বিষণ্নতা। আর জীবনানন্দের প্রেমের কবিতায় যে নারী তা কোনো অপ্সরী নয়, এই মাটির পৃথিবীর এবং প্রকৃতির নামান্তর।

মৃত্যু চেতনা জীবনানন্দের কবিতায় যেভাবে প্রকৃতির আশ্রয়ে আমাদের মাঝে প্রতিফলিত হয় তা আর কোনো কবির কবিতার ক্ষেত্রে নয়। চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ জীবনানন্দের ‘জীবন’ কবিতায় বহুজন্মের বহু মৃত্যুর কথা খুঁজে পান। মৃত্যু এখানে এসেছে কখনো মানবিক চরিত্রের প্রিয়া রূপে, কখনোবা বন্ধু রূপে। ‘ক্ষেতে প্রান্তরে’ ও ‘বিভিন্ন কোরাস’ কবিতায় জীবনানন্দ জীবন-মৃত্যুকে খুঁজে পান দৈনন্দিন জীবনচক্রের মধ্য দিয়ে। আর ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় আকাক্সক্ষা রূপে। মৃত্যুকে তিনি খুঁজে পেয়েছেন প্রকৃতির আত্তীকরণের মধ্য দিয়ে। যেমন কয়েকটি লাইন

১. শ্মশানের দেশে তুমি আসিয়াছ

২. আমাদের রক্তের ভেতর

বরফের মতো শীত

৩. শরীরে মমির ঘ্রাণ আমাদের

৪. বেতের ফলের মতো ম্লান চোখে

৫. নিয়ত শিয়রে মৃত্যুর হাত জাগে

জীবনান্দের কবিতায় এতো এতো দিক উন্মোচনের জায়গা রয়েছে যে তার শেষ কথা বলে কিছু নেই। একে ক্রমাগত উন্মোচন করে যেতে হয়। এর স্বাদ গ্রহণ করতে হয় বোধ দিয়ে যুক্তি বা ব্যাখ্যা দিয়ে নয়। চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ তার ‘সময়সাগরতীরে জীবনানন্দ’ গ্রন্থে সেই বোধের মধ্য দিয়েই জীবনানন্দ শিল্পের সর্বাধিক দিক উন্মোচন করার চেষ্টা করেছেন। নিঃসন্দেহে যা জীবনানন্দ পাঠে সহায়ক হিসাবে কাজ করবে।

সময়সাগরতীরে জীবনানন্দ ॥ চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ ॥ প্রকাশক: জনান্তিক, ঢাকা ॥ প্রকাশকাল: অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২১ ॥ প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকা জীবনানন্দ দাশের প্রতিকৃতি অবলম্বনে কবির হোসেন ॥ পৃষ্ঠা সংখ্যা ১২০ ॥ মূল্য : ২৮০ টাকা।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

‘সময়সাগরতীরে জীবনানন্দ’

চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদের জীবনানন্দ ভ্রমণ

রিসতিয়াক আহমেদ

চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ

বৃহস্পতিবার, ১৪ অক্টোবর ২০২১

জীবনানন্দ দাশ। একটি অপার বিস্ময়ের নাম। যিনি সময়সাগরতীরে বসে অবলোকন করেছেন মহাসময়কে। সংখ্যারেখার মতো শূন্যে বসে তাঁর দু’হাত মেলে ধরেছেন অতীত এবং বর্তমানে। বলতে পেরেছেন-

‘মানুষের মৃত্যু হ’লে তবুও মানব

থেকে যায়; অতীত থেকে উঠে আজকের মানুষের কাছে

প্রথমত চেতনার পরিমাপ নিতে আসে।’

জীবনানন্দের শিল্প নিয়ে এতো রহস্য, এতো বিস্ময় কেন? কারণ যে কোনো উচ্চমার্গীয় ভাষাশিল্পের প্রধান হাতিয়ারই হলো তার রূপক। ভাষার অপর নাম রূপকই। এই যে বলা হলো নাম। এই তো রূপক। মহান স্রষ্টা এই রূপকের ব্যবহার করেন সর্বোচ্চ। এবং সাথে সাথে আপেক্ষিক সময়ের পরিবর্তনের সাথে অভিযোজিত হতে থাকে পাঠক হৃদয়ের মেটাফোরিক অঞ্চলগুলোতে। সৃষ্টি হয় মুখোমুখি বসিবার জীবনের সব লেনদেন।

স্রষ্টা করে যান সৃষ্টি। তাঁর সৃষ্টিতে আমরা হই বিস্মিত। এবং গ্রহণ করি নিজ নিজ দৃষ্টির জায়গা থেকে। আবার কৌতূহল জাগে তার সৃষ্টির মন্ত্রকে জানার। আর তাই তাকে কখনো আখ্যা দেয়া হয় প্রেমের কবি, প্রকৃতির কবি, ইতিহাস চেতনার কবি; কখনোবা নির্জনতম কবি, শুদ্ধতম কবি। তাঁর সৃষ্টিকে প্রবেশ করানো হয় রোমান্টিসিজম, মডার্নিজম, রিয়েলিজম, সুররিয়েলিজম, পোস্টমডার্নিজমের পরীক্ষাগারগুলোতে। কিন্তু কোনোখানেই তার পূর্ণ সত্য মেলে না। কেননা তিনি তো জীবন এঁকেছেন। জীবন তো কোনো সরল ঐকিক অঙ্ক নয়। তবে এসব অংশত সত্যের সমন্বয়েই মেলে পূর্ণ সত্য। আর তাই চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ তাঁর ‘সময়সাগরতীরে জীবনানন্দ’ গ্রন্থে জীবনানন্দের সৃষ্টির সর্বাধিক মেটাফোরিক অঞ্চলগুলোকে আলোচনার চেষ্টা করেছেন।

কবি সর্বদ্রষ্টা। আর তাই তাঁর চোখে কিছুই এড়ায় না। এবং দেখেন আরও অনেক দূর পর্যন্ত। কিংবা দেখেন অন্যকিছু। সমাজের অসামঞ্জস্য থেকেই কবির জন্ম। তাঁর সংবেদনশীল হৃদয় তাঁকে এড়িয়ে যেতে দেয় না। আর তাই জীবনানন্দের জীবদ্দশায় সৃষ্ট দু’টি বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, দুর্ভিক্ষ এবং এর প্রভাবে সমাজের যে আমূল পরিবর্তন- মানুষে মানুষে বিশ্বাসহীনতা, দেশভাগে অস্তিত্বের সংকট, চারিদিকে শবের উৎসব- তা কবির সংবেদনশীল হৃদয় এড়াতে পারেনি। আর তাই ‘ঝরা পালক’ থেকে শুরু করে ‘সাতটি তারার তিমির’ পর্যন্ত প্রতিটি কাব্যগ্রন্থে কখনো সরাসরি কখনোবা রহস্যভারে তিনি সমকালকে প্রকাশ করেছেন। প্রাবন্ধিক-কবি-সমালোচক চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ তাঁর গ্রন্থে জীবনানন্দের ‘কার্ত্তিকের ভোর-১৩৫০’, ‘১৯৪৬-৪৭’, ‘বলিল অশ্বত্থ সেই’, ‘সুচেতনা’, ‘রাত্রির কোরাস’, ‘মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছে’, ‘সময়ের কাছে’ প্রতিটি কবিতায় পঙ্ক্তি থেকে পঙ্ক্তিতে কবির সমকাল চেতনা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন।

কিন্তু কবি জানেন সমকাল মহাকালের অংশমাত্র। আর তাই তিনি উপলব্ধি করেন- মহাবিশ্বলোকের ইশারার থেকে উৎসারিত সময় চেতনা আমার কাব্যে একটি সঙ্গতিসাধক অপরিহার্য সত্যের মতো; কবিতা লিখবার পথে কিছু দূর অগ্রসর হয়েই এ আমি বুঝেছি, গ্রহণ করেছি। এর থেকে বিচ্যুতির কোনো মানে নেই আমার কাছে। তবে সময় চেতনার নতুন মূল্য আবিষ্কৃত হতে পারে। বলেন- সমস্ত অতীত ও ভবিষ্যৎ আজকের সাথে মিশে গিয়ে বর্তমানকে স্পষ্টতরভাবে গঠন করে। আবার কাল বা সময় বৈনাশিক, কিন্তু সে সেই সমস্ত কুয়াশাগুলোকেই কেটে কেটে চলেছে যা পরিপ্রেক্ষিতের ব্যাপ্তি বাড়াবার পক্ষে অন্তরায়ের মতো। এদিকে শঙ্খ ঘোষ জীবনানন্দের সময় চেতনাকে ব্যক্তিকাল, মানবকাল ও বিশ্বকাল- এই তিনটি স্তরে বিভাজ্য করেন। এই যে জীবনানন্দের সময় চেতনা এটি তিনি কীভাবে উপলব্ধি করলেন? একটি মানুষের যে অভিজ্ঞতা তা কি তার বয়সের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? অবশ্যই নয়। তিনি ইতিহাসের সন্তান। তার পূর্বজ পুরুষদের অর্জিত অভিজ্ঞতা তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। জীবনানন্দের কবিতা আলোচনা করতে অনেক আলোচকই যে পাশ্চাত্যের আশ্রয় নেন তাতে মাইকেলের বাংলায় সনেট প্রবেশের মতো কাঠামোয় চলে কিন্তু দর্শনে নয়। কেননা, জীবনানন্দ বাংলায় জন্মেছেন। এর জল, আলো, বাতাসে বেড়ে উঠেছেন। লিখেছেন একদম খাঁটি বাংলা কবিতা। আর তাই তাঁর সময় চেতনার দর্শনও ভারতীয় প্রাচীন দর্শন অনুযায়ী। সময় অনন্ত, যার শুরুও নেই, শেষও নেই, আছে আবর্তন। এখানে চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ কবির সময় চেতনার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেন- সময় এক শক্তিশালী বিনাশকারী, যে মুছে দেয় সব নক্ষত্র, পুরোনো পথ, কমলা ফুল, বন, বনের পথ। শুধু বেঁচে থাকে সৌন্দর্য, যার জন্ম ও অবস্থান মানুষের মনে। অর্থাৎ বর্তমান কালের নশ্বরতা ও মহাকালের অবিনশ্বরতাই মূলত জীবনানন্দ দাশের সময় চেতনা।

এই যে কবি তাঁর ভাবকে ভাষায় প্রকাশ করেন। ফলত তাঁকে গ্রহণ করতে হয় ভাষার বিভিন্ন অঞ্চলকে। কখনো উপমা, কখনো চিত্রকল্প, কখনো প্রতীকধর্মিতা। তাত্ত্বিকগণ এদেরই একটি ফর্ম দেন পরাবাস্তববাদ। পরাবাস্তববাদকে কবি জীবনানন্দও অস্বীকার করেননি কিন্তু বলেছেন তা সমগ্র ক্ষেত্রে নয়। আবার জীবনানন্দের কবিতার আলোচনা পরাবাস্তববাদেই অধিক চর্চিত হয়েছে। চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদও পরাবাস্তব ফর্মে আলোচনা করতে গিয়ে কবির ‘বেড়াল’ কবিতায় খুঁজে পান মানুষের চিরন্তন সংগ্রামের ছবি, ‘হরিণেরা’ কবিতায় অতীতের হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকাদের, ‘ঘাস’ কবিতায় বিশ্বপ্রকৃতির প্রতিনিধি আর ‘ঘোড়া’ কবিতায় মানুষের চিরন্তন নিয়তিবাদকে।

চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ মনে করেন- জীবনানন্দের কাছে হেমন্ত যেন এক ত্রিপার্শ্ব কাচ, যে বিচ্ছুরিত করেছে বিভিন্ন রঙ, সাথে বিভিন্ন শব্দ, ঘ্রাণ, স্বাদ ও স্পর্শের অনুভূতি। তাঁর কাছে হেমন্ত কখনো পূর্ণতার প্রতীক, কখনো শূন্যতার, কখনো প্রেমের, কখনোবা বিনাশের

এখন কবি তাঁর ভাব প্রকাশের জন্য উপকরণ কোথায় পান? অবশ্যই যেখানে তিনি বাস করেন। এই বাস তার ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক এবং আধ্যাত্মিক বসবাস। যা তিনি হাজার বছর ধরে জিনিওলজির মাধ্যমে বাস করে চলেছেন। কবিতা সম্পর্কে জীবনানন্দের উপলব্ধি- কবিতার অস্থির ভেতরে থাকবে ইতিহাস চেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান। শঙ্খ ঘোষের যে মানবকাল সেখানে জীবনানন্দ সম্পর্কে চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদের উপলব্ধি- মানব অস্তিত্বের আবহমানকালের ইতিহাসকে জীবনানন্দ দেখতে চেয়েছেন এক অবিচ্ছিন্ন ও অখ- সত্তারূপে। তাঁর কাছে যেন এক ক্যানভাসে উপস্থিত বিভিন্ন কাল, বিভিন্ন ভূগোল- এসব তিনি তাঁর কবিতায় যুক্ত-বিযুক্ত করেছেন, পুনর্নির্মাণ করেছেন কখনো ইতিহাসের চিত্রপট, কখনো তার ভেতরের ভাবসত্যটুকু, আবার কখনো দু’টির সমন্বয়, কবি ও ঐতিহাসিকের দ্বৈত ভূমিকায়। যে যুগে জীবনানন্দ বসবাস করেছেন তা ছিল মৃত্যুর শব্দে বেদনার্ত ও যুদ্ধধ্বস্ত, যা কবির কাছে মনে হয়েছে ‘অদ্ভুত আধার এক’। সে থেকে মুক্তি পেতে কবি বারবার ফিরেছেন বিভিন্ন ভূগোল ও সভ্যতার হারানো অতীতে; সেখানেও ছিল ‘রণ রক্ত’, তবু তার মাঝেও ছিল সৌন্দর্য ও মানবিকতা। রূপকথা ও পরাবাস্তবের মাধুরি মিশিয়ে কবি ইতিহাসের শূন্যস্থানগুলি পূরণ করেছেন, তৈরি করেছেন যেন তাঁর কাক্সিক্ষত বিশ্ব: ‘আরো আলো: মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়’। অর্থাৎ এটিই হলো ব্যক্তিকাল, মানবকাল ও বিশ্বকালের পারস্পরিক সম্পর্ক। আবার চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ প্রদ্যুম্ন মিত্রের উপলব্ধি তুলে ধরছেন- জীবনানন্দের কাছে ইতিহাস চেতনার অর্থ নিছক অতীত ইতিহাসের আবহ ও পরিমণ্ডল রচনা নয়, মানবেতিহাসের অন্তর্লীন প্রেরণা ও প্রয়াণের সুরটি চিনে নেওয়া ও চিনিয়ে দেওয়া। তাঁর সৃষ্টিতে ইতিহাসের এই ভাবসত্যের উপস্থাপনার পর্যালোচনাতেই আমাদের আগ্রহ। ‘নগ্ন নির্জন হাত’ কবিতায় চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ খুঁজে পান কবির অতীত ঐশ্বর্য উপলব্ধির সাথে বর্তমানের গম্বুজের বেদনাময় রেখা, নাশপাতির গন্ধ, হরিণ ও সিংহের ছালের ধূসর পাণ্ডুলিপি। আর ‘অস্ত চাঁদ’, ‘পিরামিড’, ‘মিশর’, ‘মনোবীজ’, ‘হাওয়ার রাত’ কবিতায় মিশরীয় সভ্যতায় কবিকে ভ্রমণ করতে দেখেছেন বারবার। সাথে নিজের এশিরিয়া সভ্যতা।

চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ দার্শনিক ও ইতিহাসবিদ ভিকোর ইতিহাসের দর্শনের মূল কথাটি আলোচনা করেন। যেখানে বলা হচ্ছে- প্রচলিত ইতিহাস আলোচনায় বিজেতাদের কথাই শুধু আলোচিত হয়। সেখানে ধর্মবিরোধী ব্যক্তি, বিপ্লবী আন্দোলন, বিদ্রোহী নেতা বা প্রথাবিরোধী ঘটনাসমূহ মূল ধারার প্রতিষ্ঠিত ও লিপিবদ্ধ ইতিহাসে সচরাচর জায়গা করে নিতে পারে না। এখন প্রশ্ন হলো তাহলে তাদের জায়গা কোথায়? তাদের গ্রহণ করে লোকজ সংস্কৃতি। জীবনানন্দ দাশ মূলত ইতিহাস বলতে নিজের দেশের সাথে সাথে বিশ্বের অন্যান্য সভ্যতার ঐতিহ্য ও লোকজ উপাদানকেই গ্রহণ করেছেন। লোকজ উপাদানের খুব বড় জায়গা হলো রূপকথা। জীবনানন্দ লোকায়ত ও আবহমান বাংলার রূপকথাকে গ্রহণ করেছেন। আবার সেখানে তৈরি করেছেন বিনির্মাণ। সৃষ্টি করেছেন আর একটি মায়ারাজ্য। আর তাই ‘রূপসী বাংলা’ হয়ে ওঠে আমাদের কাছে চিরচেনার মাঝেও একটি নতুন বাংলা।

পৃথিবীর বা মহাবিশ্বের প্রতিটি উপাদানই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। যাকে আমরা ধর্ম বা বিজ্ঞান বা আধ্যাত্মিকতা যে দিক থেকেই আলোচনা করার চেষ্টা করি না কেন; সকল ক্ষেত্রে তার নাম প্রকৃতি। আর এই সম্পর্ককে উপলব্ধি করেই জীবনের অন্য মানে কবিতায় স্থান পায়। যা আমরা আমাদের আপাত বাস্তব জীবনে পাই না। আর ভৌগোলিক বসবাস তো প্রকৃতিরই নামান্তর। কিন্তু বুদ্ধদেব বসু কেন বলতে বাধ্য হচ্ছেন- সমগ্র জীবনকে প্রকৃতির ভিতর দিয়েই গ্রহণ এবং প্রকাশ করেন এমন কবির সংখ্যা কম। কারণ জীবনানন্দ প্রকৃতিকে উপর থেকে তার বাহ্যিকরূপ দেখে নয়, প্রকৃতির অংশ হয়ে তার ভেতর প্রবেশ করে মিশে গিয়ে উপলব্ধি করেছেন। চৌধুরী সালাহউদ্দীন জীবনানন্দের প্রকৃতির চিত্রকল্পের আলোচনা করতে গিয়ে প্রসঙ্গত কারণেই চিত্রশিল্পী ক্লদ মনেকে অবতারণ করেন। যিনি তাঁর গৃহের পুকুরে জন্মানো জলপদ্মের বিভিন্ন পরিবেশের বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন রূপ উপলব্ধি করে ২৫০টির বেশি ছবি এঁকেছেন। আর জীবনানন্দ ছবি এঁকেছেন কবিতার শব্দমালায়। আর এখানে প্রকৃতি মূলত স্বদেশ প্রেম। জীবনানন্দ প্রকৃতির ছবি আঁকতে গিয়ে তার সাথে যুক্ত করেছেন পুরাণ। জলের দেবী বারুণী বিরাজ করে গঙ্গাসাগরে, আর জলের দেবতা বরুণ অবিরল জল দান করে যায় কর্ণফুলী-ধলেশ্বরী-পদ্মা-জলাঙ্গীরে। কবির বিশ্বাস, দেবী বিশালাক্ষীর আশীর্বাদেই শঙ্খমালা জন্ম নিয়েছে নীল বাংলার ঘাস আর ধানের ভিতর।

প্রকৃতি নিয়ে কবিতা লিখতে গেলে চলে আসে প্রকৃতির ঋতু। বাংলার চিরায়ত কাব্যে দেখা যায় বসন্ত, বর্ষা, শরতের বর্ণনা এবং বন্দনা। কিন্তু জীবনানন্দ হেমন্তকে বেছে নিলেন কেন? বা হেমন্তের কোন উপাদানগুলো জীবনানন্দকে আকৃষ্ট করল। চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ মনে করেন- জীবনানন্দের কাছে হেমন্ত যেন এক ত্রিপার্শ্ব কাচ, যে বিচ্ছুরিত করেছে বিভিন্ন রঙ, সাথে বিভিন্ন শব্দ, ঘ্রাণ, স্বাদ ও স্পর্শের অনুভূতি। তাঁর কাছে হেমন্ত কখনো পূর্ণতার প্রতীক, কখনো শূন্যতার, কখনো প্রেমের, কখনোবা বিনাশের। জীবনানন্দের হেমন্তের এই বহুমাত্রিক দিক যেন, তাঁর নিজের ভাব-বিশ্বাসের বহুমাত্রিকতারই প্রকাশ। ‘অবসরের গান’ কবিতায় খুঁজে পান হেমন্তের বৈপরীত্য। ‘গোধূলি সন্ধির নৃত্য’ কবিতাতেও তাই চাঁদ ও সূর্যের সহাবস্থান।

এই যে প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের মধ্যকার সম্পর্ক তার মন্ত্র কী? মন্ত্র প্রেম। কবিতার সর্বাধিক ব্যবহৃত বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে প্রেম এবং মৃত্যু। এবং রয়েছে প্রেমের বহুমাত্রিকতা। জীবনানন্দের ‘প্রেম’ কবিতায় চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ খুঁজে পান একই সাথে জীবনের জয়গান আবার প্রেমের ক্ষণিকতা। আর ‘নির্জন স্বাক্ষর’ কবিতায় নিঃস্বার্থ প্রেম। কিন্তু জীবনানন্দের প্রেম চেতনার মূল হলো বিষণ্নতা ও ক্ষণিকতার বোধ। কবি মনে করেন প্রেম উজ্জ্বল আলো আর আনন্দ নিয়ে আসে, কিন্তু পরিশেষে প্রেমের ক্ষণিকতাই বাস্তব হয়ে ওঠে, আর তা ছড়িয়ে দেয় এক বিষণ্নতা। আর জীবনানন্দের প্রেমের কবিতায় যে নারী তা কোনো অপ্সরী নয়, এই মাটির পৃথিবীর এবং প্রকৃতির নামান্তর।

মৃত্যু চেতনা জীবনানন্দের কবিতায় যেভাবে প্রকৃতির আশ্রয়ে আমাদের মাঝে প্রতিফলিত হয় তা আর কোনো কবির কবিতার ক্ষেত্রে নয়। চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ জীবনানন্দের ‘জীবন’ কবিতায় বহুজন্মের বহু মৃত্যুর কথা খুঁজে পান। মৃত্যু এখানে এসেছে কখনো মানবিক চরিত্রের প্রিয়া রূপে, কখনোবা বন্ধু রূপে। ‘ক্ষেতে প্রান্তরে’ ও ‘বিভিন্ন কোরাস’ কবিতায় জীবনানন্দ জীবন-মৃত্যুকে খুঁজে পান দৈনন্দিন জীবনচক্রের মধ্য দিয়ে। আর ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় আকাক্সক্ষা রূপে। মৃত্যুকে তিনি খুঁজে পেয়েছেন প্রকৃতির আত্তীকরণের মধ্য দিয়ে। যেমন কয়েকটি লাইন

১. শ্মশানের দেশে তুমি আসিয়াছ

২. আমাদের রক্তের ভেতর

বরফের মতো শীত

৩. শরীরে মমির ঘ্রাণ আমাদের

৪. বেতের ফলের মতো ম্লান চোখে

৫. নিয়ত শিয়রে মৃত্যুর হাত জাগে

জীবনান্দের কবিতায় এতো এতো দিক উন্মোচনের জায়গা রয়েছে যে তার শেষ কথা বলে কিছু নেই। একে ক্রমাগত উন্মোচন করে যেতে হয়। এর স্বাদ গ্রহণ করতে হয় বোধ দিয়ে যুক্তি বা ব্যাখ্যা দিয়ে নয়। চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ তার ‘সময়সাগরতীরে জীবনানন্দ’ গ্রন্থে সেই বোধের মধ্য দিয়েই জীবনানন্দ শিল্পের সর্বাধিক দিক উন্মোচন করার চেষ্টা করেছেন। নিঃসন্দেহে যা জীবনানন্দ পাঠে সহায়ক হিসাবে কাজ করবে।

সময়সাগরতীরে জীবনানন্দ ॥ চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ ॥ প্রকাশক: জনান্তিক, ঢাকা ॥ প্রকাশকাল: অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২১ ॥ প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকা জীবনানন্দ দাশের প্রতিকৃতি অবলম্বনে কবির হোসেন ॥ পৃষ্ঠা সংখ্যা ১২০ ॥ মূল্য : ২৮০ টাকা।

back to top