alt

সাময়িকী

বিদ্রোহীর ‘আমি’ এক পৌরাণিক নায়ক

সাদ কামালী

: বুধবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২১

https://sangbad.net.bd/images/2021/December/15Dec21/news/kazi-nazrul-01.jpg

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রতিকৃতি : এম. এ কুদ্দুস

বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির
বিদ্রোহী কবিতার ‘আমি’ আত্মশক্তি উপলব্ধির প্রতিকী অভিব্যক্তি। ‘আমি’র এমন এক পরিচয় তিনি পংক্তি ও পংক্তিতে ঘোষণা করেন যে তিনিই নায়ক পৌরণিক দিব্য শক্তিময়তার, মহাপ্রলয়ে ধ্বংস, সঙ্গে সৃষ্টি বিজয় ও মিলনেরও গান তিনি করেন অর্ফিয়াসের বা শ্যামের বাঁশিতে। আত্মশক্তি উদ্বোধিত বিদ্রোহীর ‘আমি’ এক পৌরণিক নায়ক, দুঃখে অপমানে নীল, ক্ষোভে বিদ্রোহে রুদ্র মহাপ্রলয়, ধ্বংস ও সৃষ্টির নৃত্যপাগল নটরাজ, প্রেম মিলন বিরহে শ্যাম, এ সবই কবি নজরুলের মন চৈতন্যের পরিচয়। বহু কর্মযজ্ঞের বিরোধাত্মক ঘোষণার প্রচণ্ড নায়ক।

‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় ‘বিদ্রোহী’ প্রথম দেখা দিল ১৩২৮ সালের কার্তিক মাসে। ওই বছরই পৌষ মাসে সাপ্তাহিক বিজলীতে আর মাঘ মাসের ‘প্রবাসী’তে। তবে ১৩২৯-এর জ্যৈষ্ঠে ‘প্রলয়োল্লাস’ ব্রাহ্মদের কাগজ নামে পরিচিত প্রবাসী’তে প্রথম প্রকাশ হয়েছিল। আর ১৩২৯-এর বৈশাখে ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশিত হয় ‘সাধনা’ পত্রিকায়; তো ‘প্রবাসী’ ‘সাধনা’ বিজলী অত্যন্ত রবীন্দ্র ঘনিষ্ঠজনদের কাগজ। নজরুলের এই প্রবল আলোড়িত কবিতায় রবীন্দ্রনাথের চোখে পড়তে বেশি সময় লাগেনি। ‘শাত-ইল-আরব’, ‘খেয়া পাড়ের তরণী’, ‘মোর্হরম’, ‘আগমনী’, ‘কোরবাণী’ তিনি আগেই পড়েছেন। তেমন মহাজন মনীষীদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ প্রথম চিনতে পেরেছিলেন নতুন এই কবিকে। শুরু থেকেই তিনি নজরুলকে কবির স্বীকৃতি দিয়ে এসেছেন। এই নবীন ও নতুন কবির প্রতি গুরুদেবের স্নেহ ভালবাসা শুধু নয়, নিজের পংক্তিতে ডেকে নিয়ে বসিয়েছেন বহুবার। ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছেন- ‘শ্রীমান কবি নজরুল ইসলাম স্নেহভাজনেষু’কে। কেন এই উৎসর্গ! রবীন্দ্রনাথ মহাত্মা গান্ধী, জননী সারদা দেবী, দাদা দিদির অনেককেই এমনকি পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুরকেও বই উৎসর্গ করেন নি। যাঁদের তিনি উৎসর্গ করেছেন কখনও কখনও একই ব্যক্তিকে একাধিকবারও, যেমন, নতুন বৈঠান, জ্যোতিরীন্দ্রনাথ প্রমুখকে- তাদের সেই তালিকার ওপর সাধারণভাবে চোখে বুলালেই দেখা যাবে, ব্যক্তিগত সম্পর্কের গভীরতা, যাঁদের কাজে নিজে অনুপ্রাণিত হয়েছেন এবং সমাজ রাষ্ট্রে যাঁরা ভূমিকা রেখেছেন এমন গুণীজনদেরই তিনি উৎসর্গ করেছেন। আবার অনেক বই যেমন শেষের কবিতা, গীতাঞ্জলির মতো গ্রন্থ কাউকে উৎসর্গ করেননি। নির্বাচিত তালিকায় এমন মানুষ আছেন যাঁদের উৎসর্গ করতে পেরে কবি নিজেই ধন্য মনে করেছেন। তাঁদের মধ্যে দুজন যাঁরা ঠাকুর বাড়ির কেউ নন, এমনকি রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অন্যদের সাথে তেমন ঘনিষ্ঠও নন, সে দু’জন হলেন, কবি নজরুল ইসলাম এবং নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। গুরুদেবের অনেক কাজ সিদ্ধান্তই কাছের মানুষ অনেকেই মেনে নিতে পারে নি। তবে প্রায়ই তিনি অপ্রয়োজনীয় কৈফিয়ৎ দিতে যান নি।

শতবর্ষে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা

নজরুলের সাহিত্যে বিশেষভাবে বিদ্রোহী কবিতার শরীর জড়িয়ে যে আমি, তার সার্থক প্রতিকী রূপ পুরাণের রুদ্র। ‘রুদ্র’ ও ‘আমি’ একই সত্তার শুধু প্রথম পুরুষ বা তৃতীয় পুরুষে প্রকাশের কাব্যিক ভঙ্গিমা। বীররসের বহু কবিতায় নজরুল নিজেকে ব্যক্ত করেন রুদ্রের আবরণে ধ্বংস-সংহার-সৃষ্টির নৃত্যপাগল রুদ্রকে তিনি গভীরভাবে আত্মস্থ করেছিলেন; আকাক্সক্ষা ইচ্ছা অভিলাষ প্রকাশের মুখ এই রুদ্র

কবি কাব্য সমালোচক অজিতকুমার চক্রবর্তীর সঙ্গে পুণ্যলতার অসবর্ণ বিয়ে সমর্থন করে কী বিব্রত হতে হয়েছিল সে কথা ইতিহাসে আছে। কিন্তু সম্ভব নীরবে সব সয়েছেন অথবা অগ্রাহ্য করেছেন। নজরুলকে ‘বসন্ত’ উৎসর্গের খবরে তাঁর আশপাশের অনেকেই যখন আপত্তির স্বরে সরব হয়ে ওঠেন তখন রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখাকে সাক্ষ্য মেনে উদ্ধৃতি করছি- ‘জাতির জীবনে বসন্ত এনেছে নজরুল তাই আমার সদ্য প্রকাশিত বসন্ত গীতিনাট্যখানি ওকেই উৎসর্গ করেছি। সেখানা নিজের হাতে দিতে পারলে আমি খুশি হতাম, কিন্তু আমি যখন নিজে গিয়ে দিয়ে আসতে পারছি না, ভেবে দেখলাম তোমার (পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়) হাত দিয়ে পাঠানোই ভাল। আমার হয়েই তুমি বইখানা ওকে দিও।’ উপস্থিত অন্যদের কেউ কেউ যখন নিজেদের অখুশি হওয়াটাকে আড়াল করতে পারলেন না, তখন রবীন্দ্রনাথ তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘জানি তোমাদের মধ্যে কেউ এটা অনুমোদন করতে পার নি। আমার বিশ্বাস, তোমরা নজরুলের কবিতা না পড়েই এই মনোভাব পোষণ করেছ। আর পড়ে থাকলেও তার মধ্যে রূপ ও রসের সন্ধান করোনি, অবজ্ঞা ভরে চোখ বুলিয়েছ মাত্র।’

এই বিদ্বেষীদের ভালো করেই চিনতেন নজরুল। বেশি সময় তিনি এড়িয়ে যেয়ে নিজের কাজ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের স্বীকৃতি স্নেহ এবং ব্রাহ্ম সমাজের প্রমিলা দেবীকে বিয়ে করার পর তাঁর বিদ্বেষীদের নজরুল বিদুষণ আরও বেড়ে যায়। এই প্রসঙ্গটি ভিন্ন প্রবন্ধের অপেক্ষা রাখে। সজনীবাবুর ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকা গোষ্ঠি ও ‘বাঙ্গলার কথা’ পত্রিকাও একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্যারোডি করে সজনীবাবু ভাবকুমার বেনামে লেখেন ‘ব্যাঙ’- আমি ব্যাঙ/লম্বা আমার ঠ্যাং/... বরষা আসিলে ডাকি যে ঘ্যাঙোর ঘ্যাঙ/ আমি ব্যাঙ। টানা দেড় বছর শনিবারের চিঠি নামে বেনামে ব্যক্তিগত চরিত্র থেকে শুরু করে সাহিত্যিক অপবাদে নজরুলকে ধ্বংস করার প্রয়াস চালায়। সকল চেষ্টা যখন নজরুল প্রতিভার ঔজ্জ্বল্যে ম্লান ও ব্যর্থ তখন চেষ্টা হয়েছিল নানা রকম আবেদন নিবেদন করে রবীন্দ্রনাথকেও তাদের পাশে পেতে। সাময়িকভাবে তা কিছু সফল হলেও রবীন্দ্র-নজরুলের স্নেহ শ্রদ্ধার সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত কিন্তু বিন্দুমাত্র বিচলিত হয়নি। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাসহ ‘অগ্নি-বীণা’ প্রকাশ পূর্ব ও উত্তর নজরুলের অবস্থান, রবীন্দ্রনাথের স্বীকৃতিসহ সমকালের নজরুল বিদ্বেষ ইত্যাদির একটি সামান্য ভূমিকা হিসেবেই প্রসঙ্গের উল্লেখ, নজরুল তার ওই নিন্দুকদের সম্পর্কে লিখেছিলেন, ... ‘সবচেয়ে দুঃখ হয়, যখন দেখি কতগুলো জোনাকি পোকা রবিলোকের বহু নিম্ন থেকেও কবিত্বের আস্ফালন করে।’ অল্প সময়ের জন্য হলেও ‘খুন’ শব্দ ব্যবহার নিয়ে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য এবং তাঁর ‘সাহিত্যে ধর্ম’, ‘সাহিত্য নবত্ব’ প্রবন্ধ দু’টির কিছু বক্তব্যে বিচলিত নজরুলের মন ‘বড় পিরীতি বালির বাঁধ’ (১৯২৭) প্রবন্ধ লিখবার মুখ্য কারণ ছিল। নজরুল বিদুষকের এই মাত্রই সাফল্য।

যাই হোক, যৌবনের প্রথম প্রহরে সৈনিক জীবন, তার আগে শিশু শৈশব কৈশরকালে মক্তবে পাঠ, অনিয়মিত স্কুলের পাঠ, অন্য মানুষের বাড়িতে রান্নার কাজ, লেটোর দলের হয়ে গান আখ্যান লেখা-গাওয়া, বেকারিতে কাজকর্ম এই দরিদ্র শিশু শ্রমিকের নুরু থেকে কবি কাজী নজরুল ইসলাম হয়ে ওঠার অত্যন্ত ছোট ও সমস্যা বহুল পথটি মনে রেখেই নজরুলের সংগীত কবিতা নয় তাঁর বিদ্রোহী কবিতাটির পাঠোদ্ধার এই গদ্যের সাধারণ লক্ষ্য।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর পূজনীয় গুরুদেব। কৈশর থেকেই তাঁকে আত্মস্থ করেও নজরুল রবীন্দ্র ভাষা-ভাব প্রবাহে নিজেকে ছেড়ে দেননি। বরং তাঁর জীবন অভিজ্ঞতা, সচেতন মন, এবং প্রতিদিনের ব্যবহারিক জীবনের পরিম-লের ভিতর ভাষা স্বতস্ফূর্তভাবে সৃষ্টি হয়েছে। সময়টা উনিশশ উনিশ, কুড়ি বা একুশ যাই ধরা যাক না কেন গান কবিতা গল্পে তাঁর ভাষা সৃষ্টি হতে থাকে সংস্কারমুক্ত, কণ্ঠস্বর থেকে বিচ্ছিন্ন কোন- দ্বীপ বা অচেনা আকাশ অভিধানের পুরনো গন্ধমাখা নয়।

স্বাস্থ্যোজ্জ্বল নজরুল শুচিবায়ুগ্রস্ততা, কলাকৈবল্যবাদীর উন্নাসিকতা বা কবিতা শিল্পকে মানুষের থেকে দূরে অধরা রেখে অভিধানিক ভাষায় শুধু আকাশচারী করে রাখার অসুখ থেকে মুক্ত ছিলেন। প্রধানত মধুসূদন থেকে বাঙালি কবি সাহিত্যিক নতুন ভাব, আঙ্গিক বা ভাষা বিষয়ে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মান, ইটালি এমনকি উত্তর আমেরিকা থেকে গ্রহণ করে বাংলায় তারা নতুন অভিজাত এবং আধুনিক হয়ে ওঠেন। আর বাংলার শাশ্বত সৃষ্টি প্রবাহ দিনে দিনে ফিকে, অবহেলিত, গ্রাম্য অরুচিকর হয়ে উঠতে থাকে। নজরুল আবির্ভাব প্রথম এই নব্য অভিজাত ও আধুনিকদের বিব্রত কখনও বিরক্ত করে তোলে। হয় রবীন্দ্রনাথ, না হলে প্রকাশ্যে পশ্চিমা প্রকরণ এই দুই প্রচল প্রবাহের ভিতর নজরুল উজ্জ্বল তীব্র সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। বাংলা সাহিত্যে তাঁর পূর্বসূরি খুঁজতে হলে মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদ বধ’ (১৮৬১) এর আঙ্গিক, অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রথম প্রয়োগে শুধু নয়, নতুন চিন্তার ক্ষেত্রটিই ভাবতে হবে। ঐতিহ্য ও চিরকালীন বিশ্বাসের ইতিহাসের রাম লক্ষণের অবস্থান পাল্টে নতুন কবিতায় রাবণের নেতিবাচক শ্রেণি ও চরিত্রকে নায়ক করে তুলবার প্রয়াসের মধ্যে প্রচলিত বিশ্বাস ধারণার গড্ডলিকা থেকে বেরিয়ে মাইকেল নতুন আলো ফেলতে চাইলেন কাব্যসৃষ্টির স্বাধীন চিন্তায়, মাইকেলের মনে সংষ্কার কোনো মান্যতা পেল না। ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ (১৮৬০) প্রহসনে রক্ষণশীল, চরিত্রবানের মুখোশ উন্মোচন অন্যদিকে বিশেষ একটি স্থানীয় ভাষার ভঙ্গিমা নিয়েছেন প্রহসনের শরীর গড়তে। যদিও মাইকেল মনে করতেন বাংলায় অনেক বেশি সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করেই মর্যাদা বৃদ্ধি করতে হবে। অস্থির, ব্যস্ত, দ্রুতই তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ভরিয়ে দিতে চাইলেন নতুন নতুন সৃষ্টি দিয়ে। কিন্তু সময় তিনি পাননি। নজরুল ইসলাম ৪৩ বৎসর বয়সে মূক নির্জীব জীবন্মৃত হয়ে পড়লেন। মাইকেল ৪৯ বৎসর বয়সে দেহান্তরিত হলেন। কিন্তু বাংলা সাহিত্যচর্চার বয়স পাঁচ বছরও নয়। এই অল্প সময়েই আধুনিক বা নতুন চিন্তা, নতুন ছন্দ, সনেট, প্রহসন, নাটক মিলিয়ে বিশাল কর্মযজ্ঞ সৃষ্টি করে গেলেন মাইকেল মাইকেল। এই সৃষ্টির পিছনে যেমন বাঙলায় তাঁর পূর্বসূরি নেই, তেমন সেকালের কবিতা আখ্যান সাহিত্যে প্রচলিত কোনো কিছুরই অনুসরণ করলেন না ইংরেজি ও ফরাসি ভাষা পণ্ডিত মাইকেল। নজরুল পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল, বঙ্কিমকে, কিন্তু তিনি হলেন সম্পূর্ণ নিজের মতো। সাহিত্য বা কাব্যচিন্তা, ভাষাবোধ সংষ্কারমুক্ত নতুন পথ তৈরির প্রয়াস।

https://sangbad.net.bd/images/2021/December/15Dec21/news/kazi-nazrul-02.jpg

কাজী নজরুল ইসলামের ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত সাড়া জাগানো ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি রচিত হয় ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে

নজরুলের অনেক পরে পঞ্চাশের দশক থেকে সুবিমল মিশ্র, বীরেন্দ্র চট্টোচাধ্যায় প্রমুখ ওই অ্যান্টি সাহিত্যের পরিচিতি গড়ে তোলেন, তারপর ষাট সত্তর দশকের হাংরি কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যেও এ্যান্টি উপন্যাস, এ্যান্টি গল্প, এ্যান্টি কবিতা ইত্যাদির আদর্শিক সাহিত্য আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। অ্যান্টি পোয়েট্রি যা কবিতার বিরুদ্ধতা নয়, প্রথাবিরোধী নতুন কবিতার নতুন ধারণার কাব্য-রূপন্ধ। সময় কালের প্রেক্ষাপটে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ ও অগ্নি-বীণা কাব্যগ্রন্থ এই আদর্শের আদি গুরু।

সমস্যা হলো গত শতাব্দির ৩০ দশকের নব্য আধুনিকদের কাছে দেশি নজরুল ‘অরুচিকর’ ‘শ্রুতি পীড়াদায়ক’, ‘উচ্ছ্বাসবহুল’ অধরা মদির আড়ালহীন; বিমূর্ত রূপ ও বোধের বড় অভাব নজরুলের কবিতায়! কিন্তু মায়াকোভস্তি বা পশ্চিমা বিদ্রোহী কবিদের প্রাচীন, সুর ললিত, মন্দ্র গম্ভীর কবিতার বিরুদ্ধে ‘চপেটাঘাত’কে স্বাগতম জানিয়েই শুধু নয়, তাদের নাম আউড়ে নিজেদের পা-িত্য ও আধুনিকতার পরিচয় জাহির করতে কোনো অসুবিধা হয় না। নজরুলের সমকালে যেসব কবি কাব্য রসিক সমালোচক নজরুলকে কবি হিসেবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নন, অসির ঝনঝনানি, তীব্রতা, বিদ্রোহ ছাড়া নজরুলের কবিতায় কিছু পান না তাদেরকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, তোমরা নজরুলের কবিতা হয় পড়নি, আর পড়ে থাকলেও রূপ রসের সন্ধান না করে অবজ্ঞা ভরে চোখ বুলিয়েছে মাত্র। রবীন্দ্রনাথের এই মন্তব্যের সত্যতা গোটা নজরুলের সৃষ্টি সম্পর্কেই বাস্তব হয়ে উঠেছে। তার বহুবিধ কারণের মধ্যে শ্রেণি ও সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি অন্যতম। প্রথানুগত সাহিত্যে ভাষা চিন্তার দায়কে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। যে আধুনিক রুচিবানদের কাছে নজরুল শ্রুতিপীড়ক, স্থুল, অমার্জনীয় রুচির দোষে দুষ্ট তাদের কাছে কিন্তু ওই ভেদবুদ্ধির কারণে মধুসূদনের ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যও একটি ‘শোচনীয় বস্তু’, ‘কৃত্রিম’, ‘বাংলা সাহিত্যে মাইকেলের মহিমা দুর্মরতম কুসংস্কার’; তাদের কাছে মধুসূদন দত্তের ‘নাটকাবলী অপাঠ্য এবং যে কোন শ্রেণীর রঙ্গালয়ে অভিনয়ের অযোগ্য।’ তাঁর সনেট ‘বাগড়াম্বর মাত্র’, মাইকেল হল ‘জলি ক্রিস্টিয়ান ইয়থ’, ‘হিন্দু সংস্কৃতির প্রতি সুচাগ্র অনুকম্পা তার নেই।’ বড় আফসোস এইসব মন্তব্যগুলো বুদ্ধদেব বসুর।

আর বিষয়বস্তু বা ভাবের জন্য যতটা তার চেয়ে অনেক বেশি নজরুলের কবিতা আলোড়িত, চমকিত, বিস্মিত, বিব্রত করেছিল তাঁর কবিতার ভাষা। তাঁর ভাষা এমনকি নতুন! আরবি-ফার্সি দেশি শব্দের প্রয়োগ নজরুলের আগে বহু সফল কবি করেছেন। আরবি ফার্সি দেশজ ও ইংরেজি প্রচুর ব্যবহার করেছেন ছন্দের যাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। দত্তকবির প্রয়াণে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে যে সভা হয়েছিল ১৯২২ সালের ১১ জুলাই রামমোহন লাইব্রেরিতে সেখানে নজরুল সদ্যরচিত ‘সত্যকবি’ কবিতাটি পাঠ করেন এবং রবীন্দ্র আহবানে তাঁর পাশেই বসেন। যাইহোক, সত্যকবি নজরুলের বহু আগে গত শতাব্দীর ২০ দশকের আগে থেকেই কবিতা চর্চা করছিলেন, মোহিতলাল মজুমদার, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তও আরবি ফার্সি শব্দ ব্যবহার ছাড়াও দেশজ শব্দ ইংরেজি শব্দ, অ-কুলীনতদ্ভব শব্দ প্রয়োগে কুণ্ঠিত ছিলেন না। প্রমথ চৌধুরী, তাঁর পূর্বে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথও সাহিত্যে আরবি ফার্সি শব্দ ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত সাবলীলভাবেই। তবে নজরুলের বিশিষ্টতা লক্ষনীয়। এক, আরবি-ফার্সি ভাষা প্রতিদিনের জীবনযাপন ও মক্তবের লেখা পড়ার সুবাদে ব্যবহার ও প্রয়োগ সহজ হয়েছিল। দুই, অন্যদের মতো তিনি শুধু বাংলায় আত্তীকৃত বিদেশী শব্দ হিসেবে এবং বিশেষ একটি ঝোঁক থেকে আরবি ফার্সি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন নি। অনুভূতির মাত্রা ও তীব্রতা প্রকাশের জন্য যেমন তেমনি শব্দের যথার্থ প্রয়োগের মাধ্যমে আবেগ ও ভাবের প্রকাশকে জোরালো করে তোলাও তাঁর লক্ষ্য। আরবি, ফার্সি, তৎভব, আধা তৎভব বা দেশী শব্দ, ইংরেজি শব্দ একই মাত্রা মূল্যে ব্যবহার করেছেন। ভারতবর্ষের একজন হয়ে যেমন তিনি ভারতীয় পুরাণ শাস্ত্রের উত্তরাধিকার বহন করেন গৌরবের সঙ্গে, তেমনি মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়ার সুবাদে মুসলিম পুরাণ কাহিনী কিচ্ছার অনুষঙ্গ শব্দ অনায়াসে তাঁর কবিতায় ধ্বনিময় হয়ে ওঠে। মোসলেম ভারতে প্রকাশিত শাতিল্ আরব! শাতিল্ আরব! পূত যুগে যুগে তোমার তীর।/ শহীদের লোহু, দিলীরের খুন ঢেলেছে যেখানে আরব-বীর’ প্রকাশের সমসাময়িক কালেই ‘উপাসনা’ পত্রিকায় প্রকাশ করেন ‘আগমনী’র আগমন ধ্বনি, আজ রণ-রঙ্গিণী জগতমাতার দেখ্ মহারণ,/ দশদিকে তাঁর দশ হাতে বাজে দশ প্রহরণ,/ পদতলে লুটে মহিষাসুর,/ মহামাতা ঐ সিংহ-বাহিনী জানায় আজিকে বিশ্বাসীকে-/ শ্বাশত নহে দানব শক্তি, পায়ে পিষে যায় শিশু পশুর! ঐতিহাসিক কারণেই নজরুল এই বিশিষ্টতা অর্জন করেছেন। দুটি সংস্কৃতির ভিতর সংস্কারহীন অবাধ অবগাহনই নজরুলের স্বতন্ত্রতার একটি বিশেষ দিক। তাঁর বিশ্বাস ছিল শব্দের জাত নেই। সে কারণে তাঁর কবিতায় আরবি ফার্সি শব্দের পাশে অনায়াসে কুলীন অকুলীন তদ্ভব শব্দের প্রয়োগের সাবলীলতা ছন্দের ও ধ্বনির মর্যাদা ক্ষুণ্ন না করেই অনুভূতি ও অর্থের ব্যাপ্তিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। নজরুলের সব উল্লেখযোগ্য কবিতাতেই মাত্রা বিন্যাস ও যতির বৈচিত্র্য পংক্তির ভাবনুযায়ী সুর-ধ্বনি সৃষ্টি করে। ছন্দকে রক্ষা করেও ওই ভাষা বৈচিত্র্যের পংক্তিতে একটি অবলীলা, স্বাধীন স্ফূর্তি, অবাধ আবেগ ভাবের ভর কেন্দ্রকে হারিয়ে ফেলে না। মজার ব্যাপার হলো, নজরুল বহু মন্দ্র, সুরেলা, প্রথাগত আবেগ ও শব্দ বিন্যাসে অনেক কবিতা লিখেছেন, যেমন, ‘অলকার পানে বলাকা ছুটিছে মেঘ-দূত-মন মোহিয়া/ চঞ্চুতে রাঙা কলমীর কুড়ি মরতের ভেট বহিয়া ॥’- (রাখিবন্ধন) বা ‘কার তরে? ছাই এ পোড়ামুখ আয়নাতে আর দেখব না;/ সুর্মা-রেখার কাজল-হরফ নয়নাতে আর লেখব না (বিরহ-বিধুর) এমন শত শত কবিতা রয়েছে। কিন্তু অগ্নি-বীণার অধিকাংশ কবিতা, সাম্যবাদী, সর্বহারা, জিঞ্জীর, দোলন চাপার- ‘আজ সৃষ্টি’- সুখের উল্লাসে- কবিতাগোত্রের জন্য মুখ্যত কবি নজরুলকে আলোচিত ও সমাচিত হতে দেখা যায়। অবশ্যই অগ্নিবীণা গোত্রের কবিতাই নজরুলের সাম্যক ব্যক্তিত্ব, অভীষ্ট, চারিত্রিক লক্ষণ ও রাজনৈতিক সামাজিক চৈতন্যের স্বরূপ মূর্ত যথার্থরূপেই।

‘বিদ্রোহী’ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশের আগেই ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘শাত-ইল-আরব’, ‘কামাল পাশা’, ‘রণভেরী’, ‘আগমনী’, ‘কোরবানী’, ‘রক্তাম্বরধারিণী মা’ বিভিন্ন সাময়িকী বিশেষ করে মোসলেম ভারত, প্রবাসী, সাধনা, ধূমকেতু, উপাসনা পত্রিকায় প্রকাশ হয়ে যায়। সুতরাং কবি, সম্পাদক, পাঠক আলোচকদের মধ্যে নজরুলের বিশেষ আবির্ভাব অজানা আর ছিল না। কবি মোহিতলাল মজুমদার রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী নজরুল পূর্ব অন্যতম কবি ‘খেয়াপারের তরণী’র ছন্দ, ধ্বনি, ভাষা নিয়ে মোসলেম ভারতেই লেখেন, ‘কোরবাণী’ প্রকাশের পরও লেখেন। খেয়াপারের তরণী পড়ে লেখেন...

“খেয়া-পারের তরণী” শীর্ষক কবিতায় ছন্দ সর্বত্র মূলত এক হইলেও মাত্রাবিন্যাস ও যতির বৈচিত্র্য প্রত্যেক শ্লোকে ভাবানুযায়ী সুর সৃষ্টি করিয়াছে; ছন্দকে রক্ষা করিয়া তাহার মধ্যে এই যে একটি অবলীলা, স্বাধীন স্ফূর্তি, অবাধ আবেগ, কবি কোথাও তাহাকে হারাইয়া বসেন নাই; ছন্দ যেন ভাবের দাসত্ব করিতেছে- কোনখানে আপন অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করে নাই- এই প্রকৃত কবি-শক্তিই পাঠককে মুগ্ধ করে। কবিতাটি আবৃত্তি করিলেই বোঝা যায় যে, শব্দ ও অর্থগত ভাবের সুর কোনখানে ছন্দের বাঁধনে ব্যাহত হয় নাই। বিস্ময়, ভয়, ভক্তি, সাহস, অটল বিশ্বাস এবং সর্বোপরি প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত একটা ভীষণ-গম্ভীর অতিপ্রাকৃত কল্পনার সুর, শব্দবিন্যাস ও ছন্দঝঙ্কারে মূর্তি ধরিয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে। আমি কেবল একটি মাত্র শ্লোক উদ্ধৃত করিব,-

আবুবকর উস্মান উমর আলী-হাইদর
দাঁড়ী যে এ তরণীর, নাই ওরে নাই ডর!
কাণ্ডারী এ তরীর পাকা মাঝি মাল্লা,
দাঁড়ী-মুখে সারি-গান- ‘লা-শরীক আল্লাহ্!’

বিশেষ ঐ শেষ ছত্রের শেষ বাক্য ‘লা-শরীক আল্লাহ্’ - যেমন মিল, তেমনি আশ্চর্য প্রয়োগ। ছন্দের অধীন হইয়া এবং চমৎকার মিলের সৃষ্টি করিয়া এই আরবি বাক্য-যোজনা বাংলা কবিতায় কি অভিনব ধ্বনি গাম্ভীর্য লাভ করিয়াছে।”

মোহিতলাল মজুমদারের কথার সূত্র ধরেই ছন্দের অধীন থেকে চমৎকার মিলের সাহায্যে সংস্কৃত ও আরবি শব্দ একই বাক্যে, কখনও ওই দুই মিলিয়ে একটি শব্দবন্ধ তৈরি করে চমকে দেন নজরুল; তাঁর বিদ্রোহী কবিতায় ধর্মনির্বিশেষ বাঙালি পাঠককে তিনি বাধ্য করেছেন সেই শব্দের রস গ্রহণে, ভাষার বা শব্দের সেই স্বাধীনতা ডড়ৎফ Word autonomy তাঁর কবিতায় অবাধ, দ্বিধাহীন অন্যদিকে ছন্দ ও ধ্বনি মাধুর্যে, অভিনব ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় লেখেন, ‘দিব্যি আছিস খোশহালে’ বা পারোয়া করি না বাঁচি বা না-বাঁচি। শব্দের যথার্থতা ধ্বনি সামঞ্জস্য এবং ছন্দ ও মিলের শর্ত পূরণ করেই তাঁর এই অভিনব প্রয়োগ। শব্দের একই মাত্রামূল্যে দেশজ শব্দের সঙ্গে সংস্কৃত বা আরবি, ফরাসি, ইংরেজি শব্দের প্রয়োগের সাফল্যে তিনি শুধু পথিকৃৎ নন একমাত্র সফল কবি। বিদ্রোহী কবিতায়,

তাজি বোরাক্ আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার
হিম্মত-হ্রেষা হেঁকে চলে।

মুসলিম কিংবদন্তির স্বর্গীয় ঘোড়া বা দিব্য অশ্ব চেপে মোহাম্মদ প্রয়োজনকালে আল্লাহর কাছে গিয়েছিলেন। ‘উচ্চৈঃশ্রবা’ ভারতীয় পুরাণের স্বর্গীয় তুরঙ্গম দেবাসুরের সমুদ্রমন্থন থেকে উঠে এসেছিল, এই দুই আলৌকিক ঘোড়া আমাদের বিস্মিত বিহ্বল দৃষ্টির সামনে দিয়ে তীব্র গতিতে ছুটে যায় হিম্মতহ্রেষা। আরবি-সংস্কৃত এই সমাসবদ্ধ পদ সৃষ্টিই নজরুলের। একই পংক্তিতে তিনি নরক ও দোজখের ভয়কে কাঁপিয়ে দেন না শুধু, একই সঙ্গে বাংলা কবিতায় এমন অনবদ্য পংক্তি যার মধ্যে সাম্প্রায়ের ভেদবুদ্ধি মিলিয়ে দিয়ে একই ঐক্যসূত্রে গেঁথে নেন।

‘ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া’। রবীন্দ্রনাথ নজরুলের কবিতায় এই ‘ভাবের সংস্কৃতির সমন্বয়ই’ দেখেছিলেন। শুধু নজরুলই পেরেছেন... জাহান্নামের আগুনে বসিয়া/ হাসি পুষ্পের হাসি হাসতে!

নজরুল প্রথম থেকেই জন্মসূত্রে পাওয়া মুসলিম ইতিহাস ঐতিহ্য কিংবদন্তির সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতি বিশেষ করে পূরাণ বর্ণিত কাহিনীর ইঙ্গিত, দেব-দেবী চরিত্র কবিতার ভাব প্রকাশের প্রয়োজনে অবলীলায় গেঁথে দিয়েছেন। বিশেষ করে ভারতীয় পুরাণ থেকে গ্রহণ করেছিলেন দুই হাতে- আবার আরবি ও সংস্কৃত ভাষায় বর্ণিত শক্তি ও তেজের আধার নানা চরিত্রকে কবিতায় প্রকাশ করেন আত্মচেতন ও আত্মশিত্তির প্রতীক রূপে। বিদ্রোহী কবিতাই সেরা উদাহরণ- ‘ধরি বাসুকীর ফনা জাপটি / ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের / আগুনের পাখা সাফটি।’ বা ‘আমি ব্রজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার, / আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার,’

লিখছেন, ‘আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরি / ...আমি শ্যামের হাতে বাশরি’

অথবা,

‘মহা প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন আমি ধ্বংস / অথবা, আমি ভরা-তরী করি ভরা ডুবি, আমি টর্পেডো / আমি ভীম ভাসমান মাইন...’

মূল সংস্কৃত শব্দের সঙ্গে দেশজ শব্দ আরবি ফারসি শব্দ, ইংরেজি শব্দ একই মূল্যে একই মাত্রায় প্রয়োগ করে বাংলা কবিতায় অভিনবত্বের সূচনা করেন। শব্দই নয় ভারতীয়, আরব্য, ইংরেজি সাহিত্যে ব্যবহৃত গ্রিক ল্যাটিন পুরাণ জুড়ে দেন অনায়াসে।

নজরুলের সাহিত্যে বিশেষভাবে বিদ্রোহী কবিতার শরীর জড়িয়ে যে আমি, তার সার্থক প্রতিকী রূপ পুরাণের রুদ্র। ‘রুদ্র’ ও ‘আমি’ একই সত্তার শুধু প্রথম পুরুষ বা তৃতীয় পুরুষে প্রকাশের কাব্যিক ভঙ্গিমা। বীররসের বহু কবিতায় নজরুল নিজেকে ব্যক্ত করেন রুদ্রের আবরণে ধ্বংস-সংহার-সৃষ্টির নৃত্যপাগল রুদ্রকে তিনি গভীরভাবে আত্মস্থ করেছিলেন; আকাক্সক্ষা ইচ্ছা অভিলাষ প্রকাশের মুখ এই রুদ্র।

শুধু রুদ্র নয়, বিদ্রোহী কবিতার পংক্তিতে পংক্তিতে উদ্ধৃত্ত করেন পুরাণের বহু নায়ক, পুরাণের বহু সূত্র। ভারতীয় পুরাণের সঙ্গে আরব ও পশ্চিম-দেশীয় পুরাণের বহু সূত্র; লক্ষণীয় এই সব সূত্রই কোনো না কোনোভাবে রুদ্রের কোনো রূপেরই পরিচায়ক। ‘রুদ্র’র মূল ধাতু ‘রুদ’ রোদন বা শব্দ করা। রুদ্র বজ্র বা বজ্রধারী মেঘরূপ দেবতা। ঋগ্বেদে অগ্নিই রুদ্র। বিভিন্ন বেদে রুদ্রের নানারূপ এবং সেই রূপ ও বহুগুণের আধার রুদ্রের মধ্যে বৈপরীত্যেরও সমাহার। একই সঙ্গে তিনি ¯্রষ্টা এবং ধ্বংসকারী। তিনি সুর সুন্দর এবং গর্জনকারী মহা ধ্বংস। ঋক যজুর্বেদসহ বিভিন্ন বেদে ও পুরাণে বহু বিচিত্র গুণের উল্লেখ থাকলেও এবং তার গুণের বৈপরীত্যের পরিচয় দিলেও মূলত তার মাত্রাগত বিভেদ নাই। তবে সব বেদ পুরাণেই তিনি নীল ও মেঘবর্ণ, জটাকেশধারী তাঁর হাতে থাকে ধণুর্বাণ, যদিও তিনি নিজ হাতে আকাশ থেকে বজ্র নিক্ষেপ করেন। তিনি ভয়ানক ও মঙ্গলময় ত্রাতা। তিনিই শিব এবং পৌরাণিক তিন দেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু সঙ্গে একজন শিব। বিদ্রোহী কবিতার প্রতি পংক্তিতে পংক্তিতে এই রুদ্র নানা রূপে কখনও ভৃগু, ভীম, পরশরাম, ধুর্ঝটি, সুত, অগ্নি, হোম শিখা, সূর্য, জমদগ্নি, তিনি বিষ্ণু, ব্রহ্মা, চক্র ও মহাশঙ্খ, পিনাক পাণির ডম্রু, ত্রিশুল, ক্ষ্যাপা দুর্বাসা, বিশ্বামিত্র, ধর্মরাজের দণ্ড, রাহু, রৌদ্র, বাড়ব-বহ্নি, কালানল, হুতাশীর। এই তিনিই আবার কৃষ্ণ-কণ্ঠ, অর্ফিয়াসের বাঁশরী আবার শ্যামের হাতের বাঁশরি, তিনি পল্লীবালার আঁচর কাঁচলি নিচোর, মলয় অনিল, উদাস পুরবী হাওয়া, পথিক কবির গভীর রাগিণী, হাম্বির ছাঢ়ানট, হিন্দোল, চপলা চপল হিন্দোল। প্রচণ্ড বিপরীত দুই রূপ ও গুণের আধার। বিদ্রোহী রুদ্রেরই সমন্বিত অমানিবাস।

বেদ পুরাণের রুদ্রের ভিতর নজরুলের এই আত্ম প্রকাশ ও আত্যালোদ্ধির সত্যোচ্চারণ নজরুল মনীষাকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করে দেয়। তবে নজরুলের রুদ্র ও বিদ্রোহীর বিশেষ ঐক্য রয়েছে উপনিষদের রুদ্রের পরিচয়ে- উপনিষদের রুদ্র ঘোষণা দিচ্ছেন- আমিই প্রথম আমার পূর্বে বা উপরে কেউ নেই, আমি চিরন্তন ও চিরন্তন নই। আমি ব্রহ্মা, আমি ব্রাহ্ম নই। এই রুদ্রই শাসনকর্তা, সমস্ত জীব এঁর কথায় চলে। প্রলয়কালে তিনি বিশ্ব ব্রহ্মা-কে ধ্বংস এবং গড়েন। এঁর আদি অন্ত মধ্যম নেই, ইনিই ব্রহ্মা, ইনিই বিষ্ণু, ইনিই ইন্দ্র, ইনিই শিব। রুদ্রের আরও একটি পরিচয় তিনি গণদেবতা বিশেষ। বিষ্ণু পুরাণে রুদ্রের জন্ম সম্বন্ধে যে উল্লেখ আছে তার সঙ্গে পদ্ম পুরাণে গল্পটির কোনো বিশেষ ভেদ নেই। ক্রদ্ধ ব্রহ্মার শরীর হতে অথবা দুই ভ্রুর মাঝ থেকে কাঁদতে কাঁদতে একটি পুত্র উৎপন্ন হলো, সেই পুত্র তখন ব্রহ্মার কাছে নিজের নাম প্রার্থনা করেন। ব্রহ্মা বলেন, তুমি জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই কাঁদছ, তাই তোমার নাম রুদ্র, তারপরও রুদ্র কেঁদে কেঁদে আরও সাতবার চোখের জল ফেলল। তখন ব্রহ্মা তাঁকে আরও সাতটি নাম দেন, ভব, সর্ব, ঈশান, পশুপতি, ভীম, উগ্র কপালী ও মহাদেব বা রুদ্র বা শিব। এ ছাড়াও ব্রহ্মার বরে তিনি ইন্দ্রিয় সকল, অনুহৃদ, ব্যোম, বায়ু, অগ্নি, জল, মহী, তপসা, চন্দ্র ও সূর্য এই সকল স্থানে বাস করবেন।

যাইহোক, মাত্র ২২/২৩ বছর বয়সী মাদ্রাসা মক্তব সেনাবাহিনী থেকে সদ্য ফেরৎ নজরুলের বিদ্রোহীকে বুঝতে পৌরাণিক রুদ্রের এই গুণ পরিচয় রূপের সাম্যক ধরণা থাকলে বিদ্রোহীর আত্মা তখন বোধগম্য হয়ে ওঠে। বাংলা কবিতা পাঠক ও কবিদের তিনি বিস্মিত, বিচলিত কখনও বিব্রত করে তোলেন। পাঠাভ্যাস, রুচি, কাব্যতত্ত্বের ধারণা এবং ভাষা প্রয়োগের ভীষণ অভিনবত্ব চমকে দেয়।

রুদ্রকে নজরুল বিদ্রোহীর আত্মপোলব্ধির ও আত্মপ্রকাশের আধার করেন, এবং তাঁর এই কাব্যদ্রোহের প্রচ- ও সুরময় প্রকাশের জন্য নানা গুণের ও নানা নামের রুদ্রকে প্রথম দেখা যায় উন্নত শীর এক বীর রূপে। এই বীর রূপের আধার ‘আমি’। ‘আমি’ প্রতিকী, এবং এই প্রতীক রুদ্রের গুণ ও বিপরীতধর্মী গুণের প্রতীক। ‘আমি’ অহংকে তিনি আত্মপোলব্ধির আধার হিসেবেই জাহির করেন। কারণ, এই আমির ললাটে আছেন- রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ রাজটিকা। বিশ্ব-ধ্বংসের সময়ের নৃত্যই তাণ্ডব নৃত্য, নৃত্যের উদ্ভাবক বলে রুদ্র বা শিব বা মহাদেবের আর এক নাম নটরাজ। গজাসুর ও কালাসুর নামের দুই অসুরকে বধ করে তাণ্ডব নৃত্যে রত হয়েছিলেন মহাদেব।

আমি অভিশাপ পৃথ্বীর - কে এই পৃথ্বীর! ঘরিবংশে পৃথুর কন্যা বলে পৃথিবীকে স্বীকার করায় বসুন্ধরা পৃথ্বী নামে খ্যাত হন। মহাভারতে আছে, বিরজা নামে এক মানস সন্তান সৃষ্টি করেছিলেন বিষ্ণু। তাঁর অধীন্যস্তদের একজন বেণ, যিনি অত্যাচারী ও প্রজপীড়ক ছিলেন। ঋষিরা মন্ত্রপুত কুশের সাহায্যে বেণকে বধ করেন। তারপর তাঁরা তাঁর দক্ষিণ উরু মন্থন করলে কদাকার এক পুরুষ সৃষ্টি হয়। ঋষিরা তাকে বলেন নিষীদ। এই নিষীদই নিষাদ বংশের আদি পুরুষ এবং ম্লেচ্ছদের উৎপত্তি। তারপর ঋষিরা বেণের ডান হাত মর্দন করলে ইন্দ্রের ন্যায় এক রূপবান পুরুষ উৎপন্ন হয়। ইনিই বেণ পুত্র পৃথু নামে খ্যাত। ইনিই পৃথিবীকে সমতল নানা শস্যা ভা-ারে ভরিয়ে তোলেন। গোবাদি পশু পালনসহ বসুন্ধরা সব প্রয়োজন সাধনে ব্রত।

‘আমি’ বিদ্রোহী যখন ভৃগু রূপে খেয়ালী বিধির বক্ষ ভিন্ন করতে চান তখন এই ভৃগুর অথবা পরশুরামের কঠোর কুঠার এর কতটা শক্তি যে শক্তির ওপর রুদ্রের বা ‘আমি’র এমন নির্ভরতা! ভৃগু সপ্তর্ষিদের একজন এবং অন্যতম প্রজাপতি। ভৃগুই ভার্গব বংশের প্রতিষ্ঠাতা এবং পরশুরাম ভৃগুর প্রপৌত্র এবং ভার্গব নামে খ্যাত। যাইহোক, বিষ্ণুপুরাণের মতে ভৃগু ব্রহ্মার মানসপুত্র। ব্রহ্মা, শিব, বিষ্ণু এঁদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ? মুনি ঋষিরা এই মীমাংসার জন্য ভৃগুকে প্রথম ব্রহ্মার কাছে পাঠান। ভৃগু ইচ্ছা করে তাঁর সম্মান করেন না। এতে ব্রহ্মা বিরক্ত হলে তাঁকে সন্তুষ্ট করে শিবের কাছে যান। সেখানেও শিবকে সম্মান না দেখানোর জন্য শিব ভৃগুকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। তখন ভৃগু শিবকে স্তবে তুষ্ট করে গোলকে যেয়ে দেখেন বিষ্ণু ঘুমাচ্ছেন। ভৃগু তখন বিষ্ণুর বুকে পদাঘাত করেন। জেগে উঠে ভৃগুর পা ওই পদাঘাতে ব্যথা পেয়ে থাকবে ভেবে সঙ্গে সঙ্গে বিষ্ণু ভৃগুর পায়ের সেবা করেন। ক্রোধ না দেখিয়ে বরং নত হয়ে পা সেবা করছে! তখন ভৃগু স্থির করেন বিষ্ণুই দেবতার শ্রেষ্ঠ। সেই থেকে বিষ্ণুর বুকে পদচ্ছাপের চিহ্ন আর বিদ্রোহী নজরুলের ভৃগু-ভগবানের বুকে পদচিহ্নের এই হচ্ছে পৌরাণিক প্রতিশ্রুতি। বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরামের কঠিন কুঠারের পৌরণিক সত্য হলো, পিতা জমদগ্নির পাঁচ সন্তানের কনিষ্ঠ পরশুরাম বাবার আদেশ মেনে কুঠারের আঘাতে নিজ মা রেণুকার মস্তক দেহ থেকে ছিন্ন করে ফেলেন। পরপর চার ভাই মাকে হত্যার আদেশ মান্য করতে না পারায় জনদগ্নি তাদের জড়বৎ পশু পাখি বানিয়ে রাখেন। অন্যপুরুষকে দেখে মা রেণুকার দেহে মনে কামাচ্ছা জেগে উঠলে জমদগ্নি ক্রুদ্ধ হয়ে স্ত্রীকে হত্যা করতে ছেলেদের আদেশ করেন। যাইহোক, পরশুরাম পিতার আজ্ঞা পালন করার পর সন্তুষ্ট পিতা পরশুরামকে বর দিতে চান। পরশুরাম পিতার কাছে বর চান- তাঁর মাকে আবার জীবিত করে সংসার ধর্মে ফিরিয়ে নিতে হবে। প্রাণ ফিরে পাওয়ার পর মায়ের মনে যেন হত্যা হওয়ার স্মৃতি না থাকে, ভাইদের পুনরায় স্বাভাবিক মনুষ্য জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে এবং নিজের জন্য চান দীর্ঘায়ু। পিতা জমদগ্নিকে ক্ষত্রীয়রা হত্যা করেছিল। তার প্রতিশোধে পরশুরাম একাই বিশ্ব থেকে দুরাচারী ক্ষত্রীয়দের একুশবার নিশ্চিহ্ন করেছিলেন। তাই বিদ্রোহী প্রতিজ্ঞা করে ‘নিক্ষত্রীয় করিব বিশ্ব’। তো রুদ্রের সংহার ধ্বংস ও সৃষ্টির প্রতীকী শক্তির রূপে দেখেন পৌরণিক মহাশক্তিধরদের। রুদ্র বা মহাদেব বা শিবের ধনু পিনাক পাণি, প্রয়োজনে যেমন বজ্রতুল্য তীর নিক্ষেপ করতে পারেন ওই পিনাক-পাণি দিয়ে তেমনি অন্য সময় এই পিনাক ধনু হয়ে ওঠে বাদ্যযন্ত্র। মহাদেবের আর এক নাম পিনাকী বা পিনাকপাণি। বিদ্রোহী নিজেকেই দেখেন ওই পিনাক পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দ-। বিদ্রোহী রুদ্রের ধর্ম শুধু ধ্বংস সংহার নয়- তিনি রাতের প্রথম প্রহরের রাগ ‘হাম্বীর’ ২য় প্রহরের রাগ ছায়ানট, ৩য় প্রহরের রাগ হিন্দোল। এই বিদ্রোহী ‘পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি ফিং দিয়া দিই তিন দোল’। তিনি শুধু মহাশক্তির আধার পৌরণিক নায়ক নন, তিনি নৃত্য ছন্দে পাগল, রাগরাগিণীর স্রষ্টা।

নজরুল ইসলামের পৌরাণিক নায়কগণ এবং পৌরাণিক সূত্রের কোনটিই সম্প্রদায় বা গোত্রের পরিচায়ক নয়, তারা মহাজাগতিক এবং সার্বজনীন শক্তির আধার। তাঁদের কোনো ভৌগোলিক পরিচয় নেই। আছে বিশ্বজগতের শক্তির আধার রূপ। ভারতীয় পুরাণের উচ্চৈঃশ্রবা- দেবাসুরের সমুদ্র মন্থনকালে উদ্ভুত শ্বেতবর্ণ তেজস্বী অশ্বই ইন্দ্রের অশ্ব। প্রলয়কালে মোহাম্মদের স্বর্গীয় বাহন বোরারাক। এই দুই অলৌকিক স্বর্গীয় ঘোড়া বাংলা কবিতার দৃষ্টির সামনে দিয়ে তীব্রগতি ও তেজে হিম্মৎ-হ্রেষা ছুটে যায় বিদ্রোহীর বাহন হিসেবে। বোররাকের হিম্মৎ আর উচ্চৈঃশ্রবার হ্রেষা মুছে দেয় সম্প্রদায়ের ভেদরেখা।

নজরুল ছিলেন মনে প্রাণে বাঙালি, তাঁর আস্থা ছিল সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদে। মুক্তির প্রশ্নে তিনি অর্থনৈতিক রাজনৈতিক মুক্তি মানে সমাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক সাম্যনীতিতে তার আস্থা। বিশ্বাস করতেন গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে। সাম্রাজ্যবাদ ও দেশীয় শোষকগোষ্ঠির শৃঙ্খলা থেকে দেশকে মুক্ত করতে তিনি সাম্যবাদীদের দোসর। গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের জন্য অল্প সময়ের জন্য হলেও কংগ্রেসের প্রগতিপন্থি নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন। পরাধীনতার শৃঙ্খলা মোচনের স্বপ্নে পাগল নজরুল ছিলেন বিদ্রোহী ও প্রেমিক পুরুষের সম্মিলিত রূপ। তাঁর বিদ্রোহের অবসান ঘটবে যে দিন আর উৎপীড়িতের কান্না আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর অত্যাচর নির্মূল হবে। স্বপ্ন সাধের সাম্য ভারত ভূমিতে প্রতিষ্ঠ হবে।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

বিদ্রোহীর ‘আমি’ এক পৌরাণিক নায়ক

সাদ কামালী

বুধবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২১

https://sangbad.net.bd/images/2021/December/15Dec21/news/kazi-nazrul-01.jpg

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রতিকৃতি : এম. এ কুদ্দুস

বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির
বিদ্রোহী কবিতার ‘আমি’ আত্মশক্তি উপলব্ধির প্রতিকী অভিব্যক্তি। ‘আমি’র এমন এক পরিচয় তিনি পংক্তি ও পংক্তিতে ঘোষণা করেন যে তিনিই নায়ক পৌরণিক দিব্য শক্তিময়তার, মহাপ্রলয়ে ধ্বংস, সঙ্গে সৃষ্টি বিজয় ও মিলনেরও গান তিনি করেন অর্ফিয়াসের বা শ্যামের বাঁশিতে। আত্মশক্তি উদ্বোধিত বিদ্রোহীর ‘আমি’ এক পৌরণিক নায়ক, দুঃখে অপমানে নীল, ক্ষোভে বিদ্রোহে রুদ্র মহাপ্রলয়, ধ্বংস ও সৃষ্টির নৃত্যপাগল নটরাজ, প্রেম মিলন বিরহে শ্যাম, এ সবই কবি নজরুলের মন চৈতন্যের পরিচয়। বহু কর্মযজ্ঞের বিরোধাত্মক ঘোষণার প্রচণ্ড নায়ক।

‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় ‘বিদ্রোহী’ প্রথম দেখা দিল ১৩২৮ সালের কার্তিক মাসে। ওই বছরই পৌষ মাসে সাপ্তাহিক বিজলীতে আর মাঘ মাসের ‘প্রবাসী’তে। তবে ১৩২৯-এর জ্যৈষ্ঠে ‘প্রলয়োল্লাস’ ব্রাহ্মদের কাগজ নামে পরিচিত প্রবাসী’তে প্রথম প্রকাশ হয়েছিল। আর ১৩২৯-এর বৈশাখে ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশিত হয় ‘সাধনা’ পত্রিকায়; তো ‘প্রবাসী’ ‘সাধনা’ বিজলী অত্যন্ত রবীন্দ্র ঘনিষ্ঠজনদের কাগজ। নজরুলের এই প্রবল আলোড়িত কবিতায় রবীন্দ্রনাথের চোখে পড়তে বেশি সময় লাগেনি। ‘শাত-ইল-আরব’, ‘খেয়া পাড়ের তরণী’, ‘মোর্হরম’, ‘আগমনী’, ‘কোরবাণী’ তিনি আগেই পড়েছেন। তেমন মহাজন মনীষীদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ প্রথম চিনতে পেরেছিলেন নতুন এই কবিকে। শুরু থেকেই তিনি নজরুলকে কবির স্বীকৃতি দিয়ে এসেছেন। এই নবীন ও নতুন কবির প্রতি গুরুদেবের স্নেহ ভালবাসা শুধু নয়, নিজের পংক্তিতে ডেকে নিয়ে বসিয়েছেন বহুবার। ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছেন- ‘শ্রীমান কবি নজরুল ইসলাম স্নেহভাজনেষু’কে। কেন এই উৎসর্গ! রবীন্দ্রনাথ মহাত্মা গান্ধী, জননী সারদা দেবী, দাদা দিদির অনেককেই এমনকি পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুরকেও বই উৎসর্গ করেন নি। যাঁদের তিনি উৎসর্গ করেছেন কখনও কখনও একই ব্যক্তিকে একাধিকবারও, যেমন, নতুন বৈঠান, জ্যোতিরীন্দ্রনাথ প্রমুখকে- তাদের সেই তালিকার ওপর সাধারণভাবে চোখে বুলালেই দেখা যাবে, ব্যক্তিগত সম্পর্কের গভীরতা, যাঁদের কাজে নিজে অনুপ্রাণিত হয়েছেন এবং সমাজ রাষ্ট্রে যাঁরা ভূমিকা রেখেছেন এমন গুণীজনদেরই তিনি উৎসর্গ করেছেন। আবার অনেক বই যেমন শেষের কবিতা, গীতাঞ্জলির মতো গ্রন্থ কাউকে উৎসর্গ করেননি। নির্বাচিত তালিকায় এমন মানুষ আছেন যাঁদের উৎসর্গ করতে পেরে কবি নিজেই ধন্য মনে করেছেন। তাঁদের মধ্যে দুজন যাঁরা ঠাকুর বাড়ির কেউ নন, এমনকি রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অন্যদের সাথে তেমন ঘনিষ্ঠও নন, সে দু’জন হলেন, কবি নজরুল ইসলাম এবং নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। গুরুদেবের অনেক কাজ সিদ্ধান্তই কাছের মানুষ অনেকেই মেনে নিতে পারে নি। তবে প্রায়ই তিনি অপ্রয়োজনীয় কৈফিয়ৎ দিতে যান নি।

শতবর্ষে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা

নজরুলের সাহিত্যে বিশেষভাবে বিদ্রোহী কবিতার শরীর জড়িয়ে যে আমি, তার সার্থক প্রতিকী রূপ পুরাণের রুদ্র। ‘রুদ্র’ ও ‘আমি’ একই সত্তার শুধু প্রথম পুরুষ বা তৃতীয় পুরুষে প্রকাশের কাব্যিক ভঙ্গিমা। বীররসের বহু কবিতায় নজরুল নিজেকে ব্যক্ত করেন রুদ্রের আবরণে ধ্বংস-সংহার-সৃষ্টির নৃত্যপাগল রুদ্রকে তিনি গভীরভাবে আত্মস্থ করেছিলেন; আকাক্সক্ষা ইচ্ছা অভিলাষ প্রকাশের মুখ এই রুদ্র

কবি কাব্য সমালোচক অজিতকুমার চক্রবর্তীর সঙ্গে পুণ্যলতার অসবর্ণ বিয়ে সমর্থন করে কী বিব্রত হতে হয়েছিল সে কথা ইতিহাসে আছে। কিন্তু সম্ভব নীরবে সব সয়েছেন অথবা অগ্রাহ্য করেছেন। নজরুলকে ‘বসন্ত’ উৎসর্গের খবরে তাঁর আশপাশের অনেকেই যখন আপত্তির স্বরে সরব হয়ে ওঠেন তখন রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখাকে সাক্ষ্য মেনে উদ্ধৃতি করছি- ‘জাতির জীবনে বসন্ত এনেছে নজরুল তাই আমার সদ্য প্রকাশিত বসন্ত গীতিনাট্যখানি ওকেই উৎসর্গ করেছি। সেখানা নিজের হাতে দিতে পারলে আমি খুশি হতাম, কিন্তু আমি যখন নিজে গিয়ে দিয়ে আসতে পারছি না, ভেবে দেখলাম তোমার (পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়) হাত দিয়ে পাঠানোই ভাল। আমার হয়েই তুমি বইখানা ওকে দিও।’ উপস্থিত অন্যদের কেউ কেউ যখন নিজেদের অখুশি হওয়াটাকে আড়াল করতে পারলেন না, তখন রবীন্দ্রনাথ তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘জানি তোমাদের মধ্যে কেউ এটা অনুমোদন করতে পার নি। আমার বিশ্বাস, তোমরা নজরুলের কবিতা না পড়েই এই মনোভাব পোষণ করেছ। আর পড়ে থাকলেও তার মধ্যে রূপ ও রসের সন্ধান করোনি, অবজ্ঞা ভরে চোখ বুলিয়েছ মাত্র।’

এই বিদ্বেষীদের ভালো করেই চিনতেন নজরুল। বেশি সময় তিনি এড়িয়ে যেয়ে নিজের কাজ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের স্বীকৃতি স্নেহ এবং ব্রাহ্ম সমাজের প্রমিলা দেবীকে বিয়ে করার পর তাঁর বিদ্বেষীদের নজরুল বিদুষণ আরও বেড়ে যায়। এই প্রসঙ্গটি ভিন্ন প্রবন্ধের অপেক্ষা রাখে। সজনীবাবুর ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকা গোষ্ঠি ও ‘বাঙ্গলার কথা’ পত্রিকাও একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্যারোডি করে সজনীবাবু ভাবকুমার বেনামে লেখেন ‘ব্যাঙ’- আমি ব্যাঙ/লম্বা আমার ঠ্যাং/... বরষা আসিলে ডাকি যে ঘ্যাঙোর ঘ্যাঙ/ আমি ব্যাঙ। টানা দেড় বছর শনিবারের চিঠি নামে বেনামে ব্যক্তিগত চরিত্র থেকে শুরু করে সাহিত্যিক অপবাদে নজরুলকে ধ্বংস করার প্রয়াস চালায়। সকল চেষ্টা যখন নজরুল প্রতিভার ঔজ্জ্বল্যে ম্লান ও ব্যর্থ তখন চেষ্টা হয়েছিল নানা রকম আবেদন নিবেদন করে রবীন্দ্রনাথকেও তাদের পাশে পেতে। সাময়িকভাবে তা কিছু সফল হলেও রবীন্দ্র-নজরুলের স্নেহ শ্রদ্ধার সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত কিন্তু বিন্দুমাত্র বিচলিত হয়নি। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাসহ ‘অগ্নি-বীণা’ প্রকাশ পূর্ব ও উত্তর নজরুলের অবস্থান, রবীন্দ্রনাথের স্বীকৃতিসহ সমকালের নজরুল বিদ্বেষ ইত্যাদির একটি সামান্য ভূমিকা হিসেবেই প্রসঙ্গের উল্লেখ, নজরুল তার ওই নিন্দুকদের সম্পর্কে লিখেছিলেন, ... ‘সবচেয়ে দুঃখ হয়, যখন দেখি কতগুলো জোনাকি পোকা রবিলোকের বহু নিম্ন থেকেও কবিত্বের আস্ফালন করে।’ অল্প সময়ের জন্য হলেও ‘খুন’ শব্দ ব্যবহার নিয়ে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য এবং তাঁর ‘সাহিত্যে ধর্ম’, ‘সাহিত্য নবত্ব’ প্রবন্ধ দু’টির কিছু বক্তব্যে বিচলিত নজরুলের মন ‘বড় পিরীতি বালির বাঁধ’ (১৯২৭) প্রবন্ধ লিখবার মুখ্য কারণ ছিল। নজরুল বিদুষকের এই মাত্রই সাফল্য।

যাই হোক, যৌবনের প্রথম প্রহরে সৈনিক জীবন, তার আগে শিশু শৈশব কৈশরকালে মক্তবে পাঠ, অনিয়মিত স্কুলের পাঠ, অন্য মানুষের বাড়িতে রান্নার কাজ, লেটোর দলের হয়ে গান আখ্যান লেখা-গাওয়া, বেকারিতে কাজকর্ম এই দরিদ্র শিশু শ্রমিকের নুরু থেকে কবি কাজী নজরুল ইসলাম হয়ে ওঠার অত্যন্ত ছোট ও সমস্যা বহুল পথটি মনে রেখেই নজরুলের সংগীত কবিতা নয় তাঁর বিদ্রোহী কবিতাটির পাঠোদ্ধার এই গদ্যের সাধারণ লক্ষ্য।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর পূজনীয় গুরুদেব। কৈশর থেকেই তাঁকে আত্মস্থ করেও নজরুল রবীন্দ্র ভাষা-ভাব প্রবাহে নিজেকে ছেড়ে দেননি। বরং তাঁর জীবন অভিজ্ঞতা, সচেতন মন, এবং প্রতিদিনের ব্যবহারিক জীবনের পরিম-লের ভিতর ভাষা স্বতস্ফূর্তভাবে সৃষ্টি হয়েছে। সময়টা উনিশশ উনিশ, কুড়ি বা একুশ যাই ধরা যাক না কেন গান কবিতা গল্পে তাঁর ভাষা সৃষ্টি হতে থাকে সংস্কারমুক্ত, কণ্ঠস্বর থেকে বিচ্ছিন্ন কোন- দ্বীপ বা অচেনা আকাশ অভিধানের পুরনো গন্ধমাখা নয়।

স্বাস্থ্যোজ্জ্বল নজরুল শুচিবায়ুগ্রস্ততা, কলাকৈবল্যবাদীর উন্নাসিকতা বা কবিতা শিল্পকে মানুষের থেকে দূরে অধরা রেখে অভিধানিক ভাষায় শুধু আকাশচারী করে রাখার অসুখ থেকে মুক্ত ছিলেন। প্রধানত মধুসূদন থেকে বাঙালি কবি সাহিত্যিক নতুন ভাব, আঙ্গিক বা ভাষা বিষয়ে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মান, ইটালি এমনকি উত্তর আমেরিকা থেকে গ্রহণ করে বাংলায় তারা নতুন অভিজাত এবং আধুনিক হয়ে ওঠেন। আর বাংলার শাশ্বত সৃষ্টি প্রবাহ দিনে দিনে ফিকে, অবহেলিত, গ্রাম্য অরুচিকর হয়ে উঠতে থাকে। নজরুল আবির্ভাব প্রথম এই নব্য অভিজাত ও আধুনিকদের বিব্রত কখনও বিরক্ত করে তোলে। হয় রবীন্দ্রনাথ, না হলে প্রকাশ্যে পশ্চিমা প্রকরণ এই দুই প্রচল প্রবাহের ভিতর নজরুল উজ্জ্বল তীব্র সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। বাংলা সাহিত্যে তাঁর পূর্বসূরি খুঁজতে হলে মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদ বধ’ (১৮৬১) এর আঙ্গিক, অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রথম প্রয়োগে শুধু নয়, নতুন চিন্তার ক্ষেত্রটিই ভাবতে হবে। ঐতিহ্য ও চিরকালীন বিশ্বাসের ইতিহাসের রাম লক্ষণের অবস্থান পাল্টে নতুন কবিতায় রাবণের নেতিবাচক শ্রেণি ও চরিত্রকে নায়ক করে তুলবার প্রয়াসের মধ্যে প্রচলিত বিশ্বাস ধারণার গড্ডলিকা থেকে বেরিয়ে মাইকেল নতুন আলো ফেলতে চাইলেন কাব্যসৃষ্টির স্বাধীন চিন্তায়, মাইকেলের মনে সংষ্কার কোনো মান্যতা পেল না। ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ (১৮৬০) প্রহসনে রক্ষণশীল, চরিত্রবানের মুখোশ উন্মোচন অন্যদিকে বিশেষ একটি স্থানীয় ভাষার ভঙ্গিমা নিয়েছেন প্রহসনের শরীর গড়তে। যদিও মাইকেল মনে করতেন বাংলায় অনেক বেশি সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করেই মর্যাদা বৃদ্ধি করতে হবে। অস্থির, ব্যস্ত, দ্রুতই তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ভরিয়ে দিতে চাইলেন নতুন নতুন সৃষ্টি দিয়ে। কিন্তু সময় তিনি পাননি। নজরুল ইসলাম ৪৩ বৎসর বয়সে মূক নির্জীব জীবন্মৃত হয়ে পড়লেন। মাইকেল ৪৯ বৎসর বয়সে দেহান্তরিত হলেন। কিন্তু বাংলা সাহিত্যচর্চার বয়স পাঁচ বছরও নয়। এই অল্প সময়েই আধুনিক বা নতুন চিন্তা, নতুন ছন্দ, সনেট, প্রহসন, নাটক মিলিয়ে বিশাল কর্মযজ্ঞ সৃষ্টি করে গেলেন মাইকেল মাইকেল। এই সৃষ্টির পিছনে যেমন বাঙলায় তাঁর পূর্বসূরি নেই, তেমন সেকালের কবিতা আখ্যান সাহিত্যে প্রচলিত কোনো কিছুরই অনুসরণ করলেন না ইংরেজি ও ফরাসি ভাষা পণ্ডিত মাইকেল। নজরুল পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল, বঙ্কিমকে, কিন্তু তিনি হলেন সম্পূর্ণ নিজের মতো। সাহিত্য বা কাব্যচিন্তা, ভাষাবোধ সংষ্কারমুক্ত নতুন পথ তৈরির প্রয়াস।

https://sangbad.net.bd/images/2021/December/15Dec21/news/kazi-nazrul-02.jpg

কাজী নজরুল ইসলামের ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত সাড়া জাগানো ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি রচিত হয় ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে

নজরুলের অনেক পরে পঞ্চাশের দশক থেকে সুবিমল মিশ্র, বীরেন্দ্র চট্টোচাধ্যায় প্রমুখ ওই অ্যান্টি সাহিত্যের পরিচিতি গড়ে তোলেন, তারপর ষাট সত্তর দশকের হাংরি কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যেও এ্যান্টি উপন্যাস, এ্যান্টি গল্প, এ্যান্টি কবিতা ইত্যাদির আদর্শিক সাহিত্য আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। অ্যান্টি পোয়েট্রি যা কবিতার বিরুদ্ধতা নয়, প্রথাবিরোধী নতুন কবিতার নতুন ধারণার কাব্য-রূপন্ধ। সময় কালের প্রেক্ষাপটে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ ও অগ্নি-বীণা কাব্যগ্রন্থ এই আদর্শের আদি গুরু।

সমস্যা হলো গত শতাব্দির ৩০ দশকের নব্য আধুনিকদের কাছে দেশি নজরুল ‘অরুচিকর’ ‘শ্রুতি পীড়াদায়ক’, ‘উচ্ছ্বাসবহুল’ অধরা মদির আড়ালহীন; বিমূর্ত রূপ ও বোধের বড় অভাব নজরুলের কবিতায়! কিন্তু মায়াকোভস্তি বা পশ্চিমা বিদ্রোহী কবিদের প্রাচীন, সুর ললিত, মন্দ্র গম্ভীর কবিতার বিরুদ্ধে ‘চপেটাঘাত’কে স্বাগতম জানিয়েই শুধু নয়, তাদের নাম আউড়ে নিজেদের পা-িত্য ও আধুনিকতার পরিচয় জাহির করতে কোনো অসুবিধা হয় না। নজরুলের সমকালে যেসব কবি কাব্য রসিক সমালোচক নজরুলকে কবি হিসেবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নন, অসির ঝনঝনানি, তীব্রতা, বিদ্রোহ ছাড়া নজরুলের কবিতায় কিছু পান না তাদেরকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, তোমরা নজরুলের কবিতা হয় পড়নি, আর পড়ে থাকলেও রূপ রসের সন্ধান না করে অবজ্ঞা ভরে চোখ বুলিয়েছে মাত্র। রবীন্দ্রনাথের এই মন্তব্যের সত্যতা গোটা নজরুলের সৃষ্টি সম্পর্কেই বাস্তব হয়ে উঠেছে। তার বহুবিধ কারণের মধ্যে শ্রেণি ও সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি অন্যতম। প্রথানুগত সাহিত্যে ভাষা চিন্তার দায়কে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। যে আধুনিক রুচিবানদের কাছে নজরুল শ্রুতিপীড়ক, স্থুল, অমার্জনীয় রুচির দোষে দুষ্ট তাদের কাছে কিন্তু ওই ভেদবুদ্ধির কারণে মধুসূদনের ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যও একটি ‘শোচনীয় বস্তু’, ‘কৃত্রিম’, ‘বাংলা সাহিত্যে মাইকেলের মহিমা দুর্মরতম কুসংস্কার’; তাদের কাছে মধুসূদন দত্তের ‘নাটকাবলী অপাঠ্য এবং যে কোন শ্রেণীর রঙ্গালয়ে অভিনয়ের অযোগ্য।’ তাঁর সনেট ‘বাগড়াম্বর মাত্র’, মাইকেল হল ‘জলি ক্রিস্টিয়ান ইয়থ’, ‘হিন্দু সংস্কৃতির প্রতি সুচাগ্র অনুকম্পা তার নেই।’ বড় আফসোস এইসব মন্তব্যগুলো বুদ্ধদেব বসুর।

আর বিষয়বস্তু বা ভাবের জন্য যতটা তার চেয়ে অনেক বেশি নজরুলের কবিতা আলোড়িত, চমকিত, বিস্মিত, বিব্রত করেছিল তাঁর কবিতার ভাষা। তাঁর ভাষা এমনকি নতুন! আরবি-ফার্সি দেশি শব্দের প্রয়োগ নজরুলের আগে বহু সফল কবি করেছেন। আরবি ফার্সি দেশজ ও ইংরেজি প্রচুর ব্যবহার করেছেন ছন্দের যাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। দত্তকবির প্রয়াণে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে যে সভা হয়েছিল ১৯২২ সালের ১১ জুলাই রামমোহন লাইব্রেরিতে সেখানে নজরুল সদ্যরচিত ‘সত্যকবি’ কবিতাটি পাঠ করেন এবং রবীন্দ্র আহবানে তাঁর পাশেই বসেন। যাইহোক, সত্যকবি নজরুলের বহু আগে গত শতাব্দীর ২০ দশকের আগে থেকেই কবিতা চর্চা করছিলেন, মোহিতলাল মজুমদার, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তও আরবি ফার্সি শব্দ ব্যবহার ছাড়াও দেশজ শব্দ ইংরেজি শব্দ, অ-কুলীনতদ্ভব শব্দ প্রয়োগে কুণ্ঠিত ছিলেন না। প্রমথ চৌধুরী, তাঁর পূর্বে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথও সাহিত্যে আরবি ফার্সি শব্দ ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত সাবলীলভাবেই। তবে নজরুলের বিশিষ্টতা লক্ষনীয়। এক, আরবি-ফার্সি ভাষা প্রতিদিনের জীবনযাপন ও মক্তবের লেখা পড়ার সুবাদে ব্যবহার ও প্রয়োগ সহজ হয়েছিল। দুই, অন্যদের মতো তিনি শুধু বাংলায় আত্তীকৃত বিদেশী শব্দ হিসেবে এবং বিশেষ একটি ঝোঁক থেকে আরবি ফার্সি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন নি। অনুভূতির মাত্রা ও তীব্রতা প্রকাশের জন্য যেমন তেমনি শব্দের যথার্থ প্রয়োগের মাধ্যমে আবেগ ও ভাবের প্রকাশকে জোরালো করে তোলাও তাঁর লক্ষ্য। আরবি, ফার্সি, তৎভব, আধা তৎভব বা দেশী শব্দ, ইংরেজি শব্দ একই মাত্রা মূল্যে ব্যবহার করেছেন। ভারতবর্ষের একজন হয়ে যেমন তিনি ভারতীয় পুরাণ শাস্ত্রের উত্তরাধিকার বহন করেন গৌরবের সঙ্গে, তেমনি মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়ার সুবাদে মুসলিম পুরাণ কাহিনী কিচ্ছার অনুষঙ্গ শব্দ অনায়াসে তাঁর কবিতায় ধ্বনিময় হয়ে ওঠে। মোসলেম ভারতে প্রকাশিত শাতিল্ আরব! শাতিল্ আরব! পূত যুগে যুগে তোমার তীর।/ শহীদের লোহু, দিলীরের খুন ঢেলেছে যেখানে আরব-বীর’ প্রকাশের সমসাময়িক কালেই ‘উপাসনা’ পত্রিকায় প্রকাশ করেন ‘আগমনী’র আগমন ধ্বনি, আজ রণ-রঙ্গিণী জগতমাতার দেখ্ মহারণ,/ দশদিকে তাঁর দশ হাতে বাজে দশ প্রহরণ,/ পদতলে লুটে মহিষাসুর,/ মহামাতা ঐ সিংহ-বাহিনী জানায় আজিকে বিশ্বাসীকে-/ শ্বাশত নহে দানব শক্তি, পায়ে পিষে যায় শিশু পশুর! ঐতিহাসিক কারণেই নজরুল এই বিশিষ্টতা অর্জন করেছেন। দুটি সংস্কৃতির ভিতর সংস্কারহীন অবাধ অবগাহনই নজরুলের স্বতন্ত্রতার একটি বিশেষ দিক। তাঁর বিশ্বাস ছিল শব্দের জাত নেই। সে কারণে তাঁর কবিতায় আরবি ফার্সি শব্দের পাশে অনায়াসে কুলীন অকুলীন তদ্ভব শব্দের প্রয়োগের সাবলীলতা ছন্দের ও ধ্বনির মর্যাদা ক্ষুণ্ন না করেই অনুভূতি ও অর্থের ব্যাপ্তিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। নজরুলের সব উল্লেখযোগ্য কবিতাতেই মাত্রা বিন্যাস ও যতির বৈচিত্র্য পংক্তির ভাবনুযায়ী সুর-ধ্বনি সৃষ্টি করে। ছন্দকে রক্ষা করেও ওই ভাষা বৈচিত্র্যের পংক্তিতে একটি অবলীলা, স্বাধীন স্ফূর্তি, অবাধ আবেগ ভাবের ভর কেন্দ্রকে হারিয়ে ফেলে না। মজার ব্যাপার হলো, নজরুল বহু মন্দ্র, সুরেলা, প্রথাগত আবেগ ও শব্দ বিন্যাসে অনেক কবিতা লিখেছেন, যেমন, ‘অলকার পানে বলাকা ছুটিছে মেঘ-দূত-মন মোহিয়া/ চঞ্চুতে রাঙা কলমীর কুড়ি মরতের ভেট বহিয়া ॥’- (রাখিবন্ধন) বা ‘কার তরে? ছাই এ পোড়ামুখ আয়নাতে আর দেখব না;/ সুর্মা-রেখার কাজল-হরফ নয়নাতে আর লেখব না (বিরহ-বিধুর) এমন শত শত কবিতা রয়েছে। কিন্তু অগ্নি-বীণার অধিকাংশ কবিতা, সাম্যবাদী, সর্বহারা, জিঞ্জীর, দোলন চাপার- ‘আজ সৃষ্টি’- সুখের উল্লাসে- কবিতাগোত্রের জন্য মুখ্যত কবি নজরুলকে আলোচিত ও সমাচিত হতে দেখা যায়। অবশ্যই অগ্নিবীণা গোত্রের কবিতাই নজরুলের সাম্যক ব্যক্তিত্ব, অভীষ্ট, চারিত্রিক লক্ষণ ও রাজনৈতিক সামাজিক চৈতন্যের স্বরূপ মূর্ত যথার্থরূপেই।

‘বিদ্রোহী’ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশের আগেই ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘শাত-ইল-আরব’, ‘কামাল পাশা’, ‘রণভেরী’, ‘আগমনী’, ‘কোরবানী’, ‘রক্তাম্বরধারিণী মা’ বিভিন্ন সাময়িকী বিশেষ করে মোসলেম ভারত, প্রবাসী, সাধনা, ধূমকেতু, উপাসনা পত্রিকায় প্রকাশ হয়ে যায়। সুতরাং কবি, সম্পাদক, পাঠক আলোচকদের মধ্যে নজরুলের বিশেষ আবির্ভাব অজানা আর ছিল না। কবি মোহিতলাল মজুমদার রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী নজরুল পূর্ব অন্যতম কবি ‘খেয়াপারের তরণী’র ছন্দ, ধ্বনি, ভাষা নিয়ে মোসলেম ভারতেই লেখেন, ‘কোরবাণী’ প্রকাশের পরও লেখেন। খেয়াপারের তরণী পড়ে লেখেন...

“খেয়া-পারের তরণী” শীর্ষক কবিতায় ছন্দ সর্বত্র মূলত এক হইলেও মাত্রাবিন্যাস ও যতির বৈচিত্র্য প্রত্যেক শ্লোকে ভাবানুযায়ী সুর সৃষ্টি করিয়াছে; ছন্দকে রক্ষা করিয়া তাহার মধ্যে এই যে একটি অবলীলা, স্বাধীন স্ফূর্তি, অবাধ আবেগ, কবি কোথাও তাহাকে হারাইয়া বসেন নাই; ছন্দ যেন ভাবের দাসত্ব করিতেছে- কোনখানে আপন অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করে নাই- এই প্রকৃত কবি-শক্তিই পাঠককে মুগ্ধ করে। কবিতাটি আবৃত্তি করিলেই বোঝা যায় যে, শব্দ ও অর্থগত ভাবের সুর কোনখানে ছন্দের বাঁধনে ব্যাহত হয় নাই। বিস্ময়, ভয়, ভক্তি, সাহস, অটল বিশ্বাস এবং সর্বোপরি প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত একটা ভীষণ-গম্ভীর অতিপ্রাকৃত কল্পনার সুর, শব্দবিন্যাস ও ছন্দঝঙ্কারে মূর্তি ধরিয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে। আমি কেবল একটি মাত্র শ্লোক উদ্ধৃত করিব,-

আবুবকর উস্মান উমর আলী-হাইদর
দাঁড়ী যে এ তরণীর, নাই ওরে নাই ডর!
কাণ্ডারী এ তরীর পাকা মাঝি মাল্লা,
দাঁড়ী-মুখে সারি-গান- ‘লা-শরীক আল্লাহ্!’

বিশেষ ঐ শেষ ছত্রের শেষ বাক্য ‘লা-শরীক আল্লাহ্’ - যেমন মিল, তেমনি আশ্চর্য প্রয়োগ। ছন্দের অধীন হইয়া এবং চমৎকার মিলের সৃষ্টি করিয়া এই আরবি বাক্য-যোজনা বাংলা কবিতায় কি অভিনব ধ্বনি গাম্ভীর্য লাভ করিয়াছে।”

মোহিতলাল মজুমদারের কথার সূত্র ধরেই ছন্দের অধীন থেকে চমৎকার মিলের সাহায্যে সংস্কৃত ও আরবি শব্দ একই বাক্যে, কখনও ওই দুই মিলিয়ে একটি শব্দবন্ধ তৈরি করে চমকে দেন নজরুল; তাঁর বিদ্রোহী কবিতায় ধর্মনির্বিশেষ বাঙালি পাঠককে তিনি বাধ্য করেছেন সেই শব্দের রস গ্রহণে, ভাষার বা শব্দের সেই স্বাধীনতা ডড়ৎফ Word autonomy তাঁর কবিতায় অবাধ, দ্বিধাহীন অন্যদিকে ছন্দ ও ধ্বনি মাধুর্যে, অভিনব ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় লেখেন, ‘দিব্যি আছিস খোশহালে’ বা পারোয়া করি না বাঁচি বা না-বাঁচি। শব্দের যথার্থতা ধ্বনি সামঞ্জস্য এবং ছন্দ ও মিলের শর্ত পূরণ করেই তাঁর এই অভিনব প্রয়োগ। শব্দের একই মাত্রামূল্যে দেশজ শব্দের সঙ্গে সংস্কৃত বা আরবি, ফরাসি, ইংরেজি শব্দের প্রয়োগের সাফল্যে তিনি শুধু পথিকৃৎ নন একমাত্র সফল কবি। বিদ্রোহী কবিতায়,

তাজি বোরাক্ আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার
হিম্মত-হ্রেষা হেঁকে চলে।

মুসলিম কিংবদন্তির স্বর্গীয় ঘোড়া বা দিব্য অশ্ব চেপে মোহাম্মদ প্রয়োজনকালে আল্লাহর কাছে গিয়েছিলেন। ‘উচ্চৈঃশ্রবা’ ভারতীয় পুরাণের স্বর্গীয় তুরঙ্গম দেবাসুরের সমুদ্রমন্থন থেকে উঠে এসেছিল, এই দুই আলৌকিক ঘোড়া আমাদের বিস্মিত বিহ্বল দৃষ্টির সামনে দিয়ে তীব্র গতিতে ছুটে যায় হিম্মতহ্রেষা। আরবি-সংস্কৃত এই সমাসবদ্ধ পদ সৃষ্টিই নজরুলের। একই পংক্তিতে তিনি নরক ও দোজখের ভয়কে কাঁপিয়ে দেন না শুধু, একই সঙ্গে বাংলা কবিতায় এমন অনবদ্য পংক্তি যার মধ্যে সাম্প্রায়ের ভেদবুদ্ধি মিলিয়ে দিয়ে একই ঐক্যসূত্রে গেঁথে নেন।

‘ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া’। রবীন্দ্রনাথ নজরুলের কবিতায় এই ‘ভাবের সংস্কৃতির সমন্বয়ই’ দেখেছিলেন। শুধু নজরুলই পেরেছেন... জাহান্নামের আগুনে বসিয়া/ হাসি পুষ্পের হাসি হাসতে!

নজরুল প্রথম থেকেই জন্মসূত্রে পাওয়া মুসলিম ইতিহাস ঐতিহ্য কিংবদন্তির সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতি বিশেষ করে পূরাণ বর্ণিত কাহিনীর ইঙ্গিত, দেব-দেবী চরিত্র কবিতার ভাব প্রকাশের প্রয়োজনে অবলীলায় গেঁথে দিয়েছেন। বিশেষ করে ভারতীয় পুরাণ থেকে গ্রহণ করেছিলেন দুই হাতে- আবার আরবি ও সংস্কৃত ভাষায় বর্ণিত শক্তি ও তেজের আধার নানা চরিত্রকে কবিতায় প্রকাশ করেন আত্মচেতন ও আত্মশিত্তির প্রতীক রূপে। বিদ্রোহী কবিতাই সেরা উদাহরণ- ‘ধরি বাসুকীর ফনা জাপটি / ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের / আগুনের পাখা সাফটি।’ বা ‘আমি ব্রজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার, / আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার,’

লিখছেন, ‘আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরি / ...আমি শ্যামের হাতে বাশরি’

অথবা,

‘মহা প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন আমি ধ্বংস / অথবা, আমি ভরা-তরী করি ভরা ডুবি, আমি টর্পেডো / আমি ভীম ভাসমান মাইন...’

মূল সংস্কৃত শব্দের সঙ্গে দেশজ শব্দ আরবি ফারসি শব্দ, ইংরেজি শব্দ একই মূল্যে একই মাত্রায় প্রয়োগ করে বাংলা কবিতায় অভিনবত্বের সূচনা করেন। শব্দই নয় ভারতীয়, আরব্য, ইংরেজি সাহিত্যে ব্যবহৃত গ্রিক ল্যাটিন পুরাণ জুড়ে দেন অনায়াসে।

নজরুলের সাহিত্যে বিশেষভাবে বিদ্রোহী কবিতার শরীর জড়িয়ে যে আমি, তার সার্থক প্রতিকী রূপ পুরাণের রুদ্র। ‘রুদ্র’ ও ‘আমি’ একই সত্তার শুধু প্রথম পুরুষ বা তৃতীয় পুরুষে প্রকাশের কাব্যিক ভঙ্গিমা। বীররসের বহু কবিতায় নজরুল নিজেকে ব্যক্ত করেন রুদ্রের আবরণে ধ্বংস-সংহার-সৃষ্টির নৃত্যপাগল রুদ্রকে তিনি গভীরভাবে আত্মস্থ করেছিলেন; আকাক্সক্ষা ইচ্ছা অভিলাষ প্রকাশের মুখ এই রুদ্র।

শুধু রুদ্র নয়, বিদ্রোহী কবিতার পংক্তিতে পংক্তিতে উদ্ধৃত্ত করেন পুরাণের বহু নায়ক, পুরাণের বহু সূত্র। ভারতীয় পুরাণের সঙ্গে আরব ও পশ্চিম-দেশীয় পুরাণের বহু সূত্র; লক্ষণীয় এই সব সূত্রই কোনো না কোনোভাবে রুদ্রের কোনো রূপেরই পরিচায়ক। ‘রুদ্র’র মূল ধাতু ‘রুদ’ রোদন বা শব্দ করা। রুদ্র বজ্র বা বজ্রধারী মেঘরূপ দেবতা। ঋগ্বেদে অগ্নিই রুদ্র। বিভিন্ন বেদে রুদ্রের নানারূপ এবং সেই রূপ ও বহুগুণের আধার রুদ্রের মধ্যে বৈপরীত্যেরও সমাহার। একই সঙ্গে তিনি ¯্রষ্টা এবং ধ্বংসকারী। তিনি সুর সুন্দর এবং গর্জনকারী মহা ধ্বংস। ঋক যজুর্বেদসহ বিভিন্ন বেদে ও পুরাণে বহু বিচিত্র গুণের উল্লেখ থাকলেও এবং তার গুণের বৈপরীত্যের পরিচয় দিলেও মূলত তার মাত্রাগত বিভেদ নাই। তবে সব বেদ পুরাণেই তিনি নীল ও মেঘবর্ণ, জটাকেশধারী তাঁর হাতে থাকে ধণুর্বাণ, যদিও তিনি নিজ হাতে আকাশ থেকে বজ্র নিক্ষেপ করেন। তিনি ভয়ানক ও মঙ্গলময় ত্রাতা। তিনিই শিব এবং পৌরাণিক তিন দেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু সঙ্গে একজন শিব। বিদ্রোহী কবিতার প্রতি পংক্তিতে পংক্তিতে এই রুদ্র নানা রূপে কখনও ভৃগু, ভীম, পরশরাম, ধুর্ঝটি, সুত, অগ্নি, হোম শিখা, সূর্য, জমদগ্নি, তিনি বিষ্ণু, ব্রহ্মা, চক্র ও মহাশঙ্খ, পিনাক পাণির ডম্রু, ত্রিশুল, ক্ষ্যাপা দুর্বাসা, বিশ্বামিত্র, ধর্মরাজের দণ্ড, রাহু, রৌদ্র, বাড়ব-বহ্নি, কালানল, হুতাশীর। এই তিনিই আবার কৃষ্ণ-কণ্ঠ, অর্ফিয়াসের বাঁশরী আবার শ্যামের হাতের বাঁশরি, তিনি পল্লীবালার আঁচর কাঁচলি নিচোর, মলয় অনিল, উদাস পুরবী হাওয়া, পথিক কবির গভীর রাগিণী, হাম্বির ছাঢ়ানট, হিন্দোল, চপলা চপল হিন্দোল। প্রচণ্ড বিপরীত দুই রূপ ও গুণের আধার। বিদ্রোহী রুদ্রেরই সমন্বিত অমানিবাস।

বেদ পুরাণের রুদ্রের ভিতর নজরুলের এই আত্ম প্রকাশ ও আত্যালোদ্ধির সত্যোচ্চারণ নজরুল মনীষাকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করে দেয়। তবে নজরুলের রুদ্র ও বিদ্রোহীর বিশেষ ঐক্য রয়েছে উপনিষদের রুদ্রের পরিচয়ে- উপনিষদের রুদ্র ঘোষণা দিচ্ছেন- আমিই প্রথম আমার পূর্বে বা উপরে কেউ নেই, আমি চিরন্তন ও চিরন্তন নই। আমি ব্রহ্মা, আমি ব্রাহ্ম নই। এই রুদ্রই শাসনকর্তা, সমস্ত জীব এঁর কথায় চলে। প্রলয়কালে তিনি বিশ্ব ব্রহ্মা-কে ধ্বংস এবং গড়েন। এঁর আদি অন্ত মধ্যম নেই, ইনিই ব্রহ্মা, ইনিই বিষ্ণু, ইনিই ইন্দ্র, ইনিই শিব। রুদ্রের আরও একটি পরিচয় তিনি গণদেবতা বিশেষ। বিষ্ণু পুরাণে রুদ্রের জন্ম সম্বন্ধে যে উল্লেখ আছে তার সঙ্গে পদ্ম পুরাণে গল্পটির কোনো বিশেষ ভেদ নেই। ক্রদ্ধ ব্রহ্মার শরীর হতে অথবা দুই ভ্রুর মাঝ থেকে কাঁদতে কাঁদতে একটি পুত্র উৎপন্ন হলো, সেই পুত্র তখন ব্রহ্মার কাছে নিজের নাম প্রার্থনা করেন। ব্রহ্মা বলেন, তুমি জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই কাঁদছ, তাই তোমার নাম রুদ্র, তারপরও রুদ্র কেঁদে কেঁদে আরও সাতবার চোখের জল ফেলল। তখন ব্রহ্মা তাঁকে আরও সাতটি নাম দেন, ভব, সর্ব, ঈশান, পশুপতি, ভীম, উগ্র কপালী ও মহাদেব বা রুদ্র বা শিব। এ ছাড়াও ব্রহ্মার বরে তিনি ইন্দ্রিয় সকল, অনুহৃদ, ব্যোম, বায়ু, অগ্নি, জল, মহী, তপসা, চন্দ্র ও সূর্য এই সকল স্থানে বাস করবেন।

যাইহোক, মাত্র ২২/২৩ বছর বয়সী মাদ্রাসা মক্তব সেনাবাহিনী থেকে সদ্য ফেরৎ নজরুলের বিদ্রোহীকে বুঝতে পৌরাণিক রুদ্রের এই গুণ পরিচয় রূপের সাম্যক ধরণা থাকলে বিদ্রোহীর আত্মা তখন বোধগম্য হয়ে ওঠে। বাংলা কবিতা পাঠক ও কবিদের তিনি বিস্মিত, বিচলিত কখনও বিব্রত করে তোলেন। পাঠাভ্যাস, রুচি, কাব্যতত্ত্বের ধারণা এবং ভাষা প্রয়োগের ভীষণ অভিনবত্ব চমকে দেয়।

রুদ্রকে নজরুল বিদ্রোহীর আত্মপোলব্ধির ও আত্মপ্রকাশের আধার করেন, এবং তাঁর এই কাব্যদ্রোহের প্রচ- ও সুরময় প্রকাশের জন্য নানা গুণের ও নানা নামের রুদ্রকে প্রথম দেখা যায় উন্নত শীর এক বীর রূপে। এই বীর রূপের আধার ‘আমি’। ‘আমি’ প্রতিকী, এবং এই প্রতীক রুদ্রের গুণ ও বিপরীতধর্মী গুণের প্রতীক। ‘আমি’ অহংকে তিনি আত্মপোলব্ধির আধার হিসেবেই জাহির করেন। কারণ, এই আমির ললাটে আছেন- রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ রাজটিকা। বিশ্ব-ধ্বংসের সময়ের নৃত্যই তাণ্ডব নৃত্য, নৃত্যের উদ্ভাবক বলে রুদ্র বা শিব বা মহাদেবের আর এক নাম নটরাজ। গজাসুর ও কালাসুর নামের দুই অসুরকে বধ করে তাণ্ডব নৃত্যে রত হয়েছিলেন মহাদেব।

আমি অভিশাপ পৃথ্বীর - কে এই পৃথ্বীর! ঘরিবংশে পৃথুর কন্যা বলে পৃথিবীকে স্বীকার করায় বসুন্ধরা পৃথ্বী নামে খ্যাত হন। মহাভারতে আছে, বিরজা নামে এক মানস সন্তান সৃষ্টি করেছিলেন বিষ্ণু। তাঁর অধীন্যস্তদের একজন বেণ, যিনি অত্যাচারী ও প্রজপীড়ক ছিলেন। ঋষিরা মন্ত্রপুত কুশের সাহায্যে বেণকে বধ করেন। তারপর তাঁরা তাঁর দক্ষিণ উরু মন্থন করলে কদাকার এক পুরুষ সৃষ্টি হয়। ঋষিরা তাকে বলেন নিষীদ। এই নিষীদই নিষাদ বংশের আদি পুরুষ এবং ম্লেচ্ছদের উৎপত্তি। তারপর ঋষিরা বেণের ডান হাত মর্দন করলে ইন্দ্রের ন্যায় এক রূপবান পুরুষ উৎপন্ন হয়। ইনিই বেণ পুত্র পৃথু নামে খ্যাত। ইনিই পৃথিবীকে সমতল নানা শস্যা ভা-ারে ভরিয়ে তোলেন। গোবাদি পশু পালনসহ বসুন্ধরা সব প্রয়োজন সাধনে ব্রত।

‘আমি’ বিদ্রোহী যখন ভৃগু রূপে খেয়ালী বিধির বক্ষ ভিন্ন করতে চান তখন এই ভৃগুর অথবা পরশুরামের কঠোর কুঠার এর কতটা শক্তি যে শক্তির ওপর রুদ্রের বা ‘আমি’র এমন নির্ভরতা! ভৃগু সপ্তর্ষিদের একজন এবং অন্যতম প্রজাপতি। ভৃগুই ভার্গব বংশের প্রতিষ্ঠাতা এবং পরশুরাম ভৃগুর প্রপৌত্র এবং ভার্গব নামে খ্যাত। যাইহোক, বিষ্ণুপুরাণের মতে ভৃগু ব্রহ্মার মানসপুত্র। ব্রহ্মা, শিব, বিষ্ণু এঁদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ? মুনি ঋষিরা এই মীমাংসার জন্য ভৃগুকে প্রথম ব্রহ্মার কাছে পাঠান। ভৃগু ইচ্ছা করে তাঁর সম্মান করেন না। এতে ব্রহ্মা বিরক্ত হলে তাঁকে সন্তুষ্ট করে শিবের কাছে যান। সেখানেও শিবকে সম্মান না দেখানোর জন্য শিব ভৃগুকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। তখন ভৃগু শিবকে স্তবে তুষ্ট করে গোলকে যেয়ে দেখেন বিষ্ণু ঘুমাচ্ছেন। ভৃগু তখন বিষ্ণুর বুকে পদাঘাত করেন। জেগে উঠে ভৃগুর পা ওই পদাঘাতে ব্যথা পেয়ে থাকবে ভেবে সঙ্গে সঙ্গে বিষ্ণু ভৃগুর পায়ের সেবা করেন। ক্রোধ না দেখিয়ে বরং নত হয়ে পা সেবা করছে! তখন ভৃগু স্থির করেন বিষ্ণুই দেবতার শ্রেষ্ঠ। সেই থেকে বিষ্ণুর বুকে পদচ্ছাপের চিহ্ন আর বিদ্রোহী নজরুলের ভৃগু-ভগবানের বুকে পদচিহ্নের এই হচ্ছে পৌরাণিক প্রতিশ্রুতি। বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরামের কঠিন কুঠারের পৌরণিক সত্য হলো, পিতা জমদগ্নির পাঁচ সন্তানের কনিষ্ঠ পরশুরাম বাবার আদেশ মেনে কুঠারের আঘাতে নিজ মা রেণুকার মস্তক দেহ থেকে ছিন্ন করে ফেলেন। পরপর চার ভাই মাকে হত্যার আদেশ মান্য করতে না পারায় জনদগ্নি তাদের জড়বৎ পশু পাখি বানিয়ে রাখেন। অন্যপুরুষকে দেখে মা রেণুকার দেহে মনে কামাচ্ছা জেগে উঠলে জমদগ্নি ক্রুদ্ধ হয়ে স্ত্রীকে হত্যা করতে ছেলেদের আদেশ করেন। যাইহোক, পরশুরাম পিতার আজ্ঞা পালন করার পর সন্তুষ্ট পিতা পরশুরামকে বর দিতে চান। পরশুরাম পিতার কাছে বর চান- তাঁর মাকে আবার জীবিত করে সংসার ধর্মে ফিরিয়ে নিতে হবে। প্রাণ ফিরে পাওয়ার পর মায়ের মনে যেন হত্যা হওয়ার স্মৃতি না থাকে, ভাইদের পুনরায় স্বাভাবিক মনুষ্য জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে এবং নিজের জন্য চান দীর্ঘায়ু। পিতা জমদগ্নিকে ক্ষত্রীয়রা হত্যা করেছিল। তার প্রতিশোধে পরশুরাম একাই বিশ্ব থেকে দুরাচারী ক্ষত্রীয়দের একুশবার নিশ্চিহ্ন করেছিলেন। তাই বিদ্রোহী প্রতিজ্ঞা করে ‘নিক্ষত্রীয় করিব বিশ্ব’। তো রুদ্রের সংহার ধ্বংস ও সৃষ্টির প্রতীকী শক্তির রূপে দেখেন পৌরণিক মহাশক্তিধরদের। রুদ্র বা মহাদেব বা শিবের ধনু পিনাক পাণি, প্রয়োজনে যেমন বজ্রতুল্য তীর নিক্ষেপ করতে পারেন ওই পিনাক-পাণি দিয়ে তেমনি অন্য সময় এই পিনাক ধনু হয়ে ওঠে বাদ্যযন্ত্র। মহাদেবের আর এক নাম পিনাকী বা পিনাকপাণি। বিদ্রোহী নিজেকেই দেখেন ওই পিনাক পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দ-। বিদ্রোহী রুদ্রের ধর্ম শুধু ধ্বংস সংহার নয়- তিনি রাতের প্রথম প্রহরের রাগ ‘হাম্বীর’ ২য় প্রহরের রাগ ছায়ানট, ৩য় প্রহরের রাগ হিন্দোল। এই বিদ্রোহী ‘পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি ফিং দিয়া দিই তিন দোল’। তিনি শুধু মহাশক্তির আধার পৌরণিক নায়ক নন, তিনি নৃত্য ছন্দে পাগল, রাগরাগিণীর স্রষ্টা।

নজরুল ইসলামের পৌরাণিক নায়কগণ এবং পৌরাণিক সূত্রের কোনটিই সম্প্রদায় বা গোত্রের পরিচায়ক নয়, তারা মহাজাগতিক এবং সার্বজনীন শক্তির আধার। তাঁদের কোনো ভৌগোলিক পরিচয় নেই। আছে বিশ্বজগতের শক্তির আধার রূপ। ভারতীয় পুরাণের উচ্চৈঃশ্রবা- দেবাসুরের সমুদ্র মন্থনকালে উদ্ভুত শ্বেতবর্ণ তেজস্বী অশ্বই ইন্দ্রের অশ্ব। প্রলয়কালে মোহাম্মদের স্বর্গীয় বাহন বোরারাক। এই দুই অলৌকিক স্বর্গীয় ঘোড়া বাংলা কবিতার দৃষ্টির সামনে দিয়ে তীব্রগতি ও তেজে হিম্মৎ-হ্রেষা ছুটে যায় বিদ্রোহীর বাহন হিসেবে। বোররাকের হিম্মৎ আর উচ্চৈঃশ্রবার হ্রেষা মুছে দেয় সম্প্রদায়ের ভেদরেখা।

নজরুল ছিলেন মনে প্রাণে বাঙালি, তাঁর আস্থা ছিল সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদে। মুক্তির প্রশ্নে তিনি অর্থনৈতিক রাজনৈতিক মুক্তি মানে সমাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক সাম্যনীতিতে তার আস্থা। বিশ্বাস করতেন গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে। সাম্রাজ্যবাদ ও দেশীয় শোষকগোষ্ঠির শৃঙ্খলা থেকে দেশকে মুক্ত করতে তিনি সাম্যবাদীদের দোসর। গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের জন্য অল্প সময়ের জন্য হলেও কংগ্রেসের প্রগতিপন্থি নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন। পরাধীনতার শৃঙ্খলা মোচনের স্বপ্নে পাগল নজরুল ছিলেন বিদ্রোহী ও প্রেমিক পুরুষের সম্মিলিত রূপ। তাঁর বিদ্রোহের অবসান ঘটবে যে দিন আর উৎপীড়িতের কান্না আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর অত্যাচর নির্মূল হবে। স্বপ্ন সাধের সাম্য ভারত ভূমিতে প্রতিষ্ঠ হবে।

back to top