গাইবান্ধা : চরাঞ্চলে পরিবারভিত্তিক উদ্যোগ পশুর খামার -সংবাদ
গাইবান্ধার তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদী ও চরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চর গ্রাম মানুষের জীবনজীবিকা, পুষ্টি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে পরিবারভিত্তিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গবাদিপশুর খামার। বন্যা, নদীভাঙন সাথে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা শতকরা ৮০ ভাগ পরিবারের অন্যতম সম্পদ এখন ছাগল, ভেড়া, গরু, মহিষ অথবা ঘোড়া। প্রকৃতির থেকে বেড়ে ওঠা গাছপালা নির্ভর চরাঞ্চলের গবাদিপশু পালনকারী পরিবারের সংখ্যা বেড়ে দ্রুতই শতভাগে পৌঁছাবে এমন প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।
গাইবান্ধা জেলার মোট ভৌগোলিক আয়তনের ৩০ শতাংশ চরাঞ্চলে। বন্যা, নদীভাঙন, শৈত্যপ্রবাহ, খরা, তাপপ্রবাহের সাথে সংগ্রাম করে বসবাস করছে ১৩৪ চরের ২ লাখ ১০ হাজার পরিবারের প্রায় ৪ লাখ মানুষ। তবে, জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবের কারণে জীবনযাত্রা উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হলেও এখন সেই প্রেক্ষাপট অনেকটাই সহনশীল করে নিয়েছে চরের মানুষজন। পরিকল্পিতভাবে ও উন্নত পদ্ধতিতে গবাদি পশু লালনপালন করে হাজারো পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে। দরিদ্র্যতার বৃত্ত থেকে মুক্তও হয়েছেন।
এদিকে, চরাঞ্চলের কৃষি ক্ষেত্রেও দৃশ্যত উন্নয়ন হলেও সারা বছর আয়-উপার্জনে কৃষি তেমন ভূমিকা রাখতে না পারলেও গবাদিপশু প্রাণি এখন অন্যতম অবলম্বন হয়ে উঠছে। যার ফলে ছাগল, ভেড়া, গরু, ঘোড়া, মহিষ পালনকারী পরিবারের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে।
গাইবান্ধা ফুলছড়ি উপজেলার বৃহ্মপুত্র নদে জেগে ওঠা গুপ্তমণি চরে গিয়ে দেখা যায় মর্জিনা বেগম ২০টি ছাগল নিয়ে নিজ বাড়িতে ঘাস খাওয়াচ্ছেন। দেখে মনে হয় তার বাড়িটি যেন ক্ষুদ্র ছাগলের খামার। আগামী মাসের মধ্যে আরো ৫টি ছাগল বাচ্চা দিবে। খোলা চরের প্রকৃতির ঘাসপালা খেয়ে লাফালাফি করে বড় হয়ে উঠছে ছাগলগুলো। ইতোমধ্যে ৫টি বিক্রিও করেছেন নিজেরে প্রয়োজনে। সারাদিন অন্যান্য কাজের পাশাপাশি ছাগল পালন করছেন এবং এইমহুর্তে বিক্রি করলে মূল্য হবে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। এই সম্পদ হয়েছে মাত্র দু’বছরেই। তিনি তার সাফল্যের নেপথ্যে কথা জানিয়ে বলেন, প্রতিবছর নদীভাঙন আর বন্যায় সংসারের অভাব-অনটন কেটে উঠছিলনা। কী করে অভাব অনটন থেকে মুক্ত হবেন এর পরিকল্পনা না থাকায় হত্যাশার জীবন থেকে স্বপ্নের পথ খুঁজে পান বেসরকারি সংস্থা গণউন্নয়ন কেন্দ্রে একটি প্রকল্পর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে।
ফুলছড়ি টেংরাকান্দি চরের হালিমা বেগম। তার বাড়িতে ১৮টি ভেড়া। তিনি বলেন, আমি এখন অনেকটাই চিন্তামুক্ত। আমার বাড়িতে ভেড়ার খামার। ৪টি ছাগল থেকে আমার ১৮টি ভেড়া হয়েছে। ৬টি বিক্রি করে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে জমি ক্রয় করেছি। এবছর আরো ৬টি বাচ্চা দিবে, এভাবেই আমার শতাধিক ভেড়ার খামার গড়ে তোলার ইচ্ছে আছে। আপদ বিপদ হলে ভেড়া বিক্রি তা মোকাবেলা করি। কামারজানি চরের ছলিম ব্যাপারি জানান, আমার বাড়িতে ৪টি ঘোড়া। এগুলো দিয়ে বালুর চরে পরিবহন ব্যবসা করি। ঘোড়াও লাভজনক ও বাজারে ব্যাপক চাহিদা বলে তিনি জানান।
গুপ্তমণি চরের আকলিমা বেগম, রহিতন, মালেকা খাতুনের মতো আরো প্রায় ৫০টি পরিবারের সাথে কথা হলে তারাও গরু-ছাগল পালনে সাফল্যের গল্প বলেন। প্রত্যের বাড়িতে ২ থেকে ১২টি পর্যন্ত গরু। এগুলো নিয়েই তাদের ব্যস্ততা। সারাদিন চরের লালনপালন করেই তাদের বিক্রি উপযোগী করা হচ্ছে। মালেকা খাতুন জানান, কোরবানী ঈদে ২টি গরু বিক্রি করে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা হয়। এই টাকা দিয়ে সারা বছর চলে, আর দুটি গাভি আছে দুধ দেয়, নিজেরাও খাই এবং প্রতিদিনের চাহিদা পুরণ হয়।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণউন্নয়ন কেন্দ্রের নির্বাহী প্রধান জানান, চরাঞ্চলের মানুষের অন্যতম সম্পদ ও অবলম্বন গবাদি পশু। দুর্যোগের সাথে লড়াই করে গরু,ছাগল, ভেড়া, মহিষ, ঘোড়া লালন পালন করে অর্থনৈতিকভাবে অনেকটাই স্বাবলম্বী চরের মানুষজন। প্রায় দেড় দশক আগে চরাঞ্চলে সিএলপি নামে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে কয়েক হাজার গরু প্রদান করা হয়েছিল দরিদ্র পরিবারগুলোকে। এখনও চাহিদা অনুযায়ী ছাগল, গরু দেয়া হচ্ছে। তবে, সরকারি সেবা, সুযোগ-সুবিধা ও নায্যমূল্য না পাওয়ায় তারা কাক্সিক্ষত মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন। তিনি জানান, বন্যাকালীন গবাদি পশুর খাদ্য ও বাসস্থান সংকট দেখা দেয় এবং এসময় তারা বেশ চিন্তিত থাকেন। বন্যা ও দুর্যোগকালীন গবাদিপশুর আশ্রয় ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে তিনি জানান।
ফুলছড়ি উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ডা. জহিরুল ইসলাম জানান, চরাঞ্চলের মানুষের জীবনজীবিকার উন্নয়নে গবাদিপশু যথেষ্ট অবদান রাখছে। এই জেলার পশু চাহিদা মিটিয়ে অন্য জেলায় যাচ্ছে। চরাঞ্চলে গবাদি পশুপালনকারীদের সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে, যাতে রোগ প্রতিরোধ করে গৃহস্থরা লাভবান হতে পারেন।
গাইবান্ধা : চরাঞ্চলে পরিবারভিত্তিক উদ্যোগ পশুর খামার -সংবাদ
শনিবার, ১৯ জুলাই ২০২৫
গাইবান্ধার তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদী ও চরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চর গ্রাম মানুষের জীবনজীবিকা, পুষ্টি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে পরিবারভিত্তিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গবাদিপশুর খামার। বন্যা, নদীভাঙন সাথে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা শতকরা ৮০ ভাগ পরিবারের অন্যতম সম্পদ এখন ছাগল, ভেড়া, গরু, মহিষ অথবা ঘোড়া। প্রকৃতির থেকে বেড়ে ওঠা গাছপালা নির্ভর চরাঞ্চলের গবাদিপশু পালনকারী পরিবারের সংখ্যা বেড়ে দ্রুতই শতভাগে পৌঁছাবে এমন প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।
গাইবান্ধা জেলার মোট ভৌগোলিক আয়তনের ৩০ শতাংশ চরাঞ্চলে। বন্যা, নদীভাঙন, শৈত্যপ্রবাহ, খরা, তাপপ্রবাহের সাথে সংগ্রাম করে বসবাস করছে ১৩৪ চরের ২ লাখ ১০ হাজার পরিবারের প্রায় ৪ লাখ মানুষ। তবে, জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবের কারণে জীবনযাত্রা উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হলেও এখন সেই প্রেক্ষাপট অনেকটাই সহনশীল করে নিয়েছে চরের মানুষজন। পরিকল্পিতভাবে ও উন্নত পদ্ধতিতে গবাদি পশু লালনপালন করে হাজারো পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে। দরিদ্র্যতার বৃত্ত থেকে মুক্তও হয়েছেন।
এদিকে, চরাঞ্চলের কৃষি ক্ষেত্রেও দৃশ্যত উন্নয়ন হলেও সারা বছর আয়-উপার্জনে কৃষি তেমন ভূমিকা রাখতে না পারলেও গবাদিপশু প্রাণি এখন অন্যতম অবলম্বন হয়ে উঠছে। যার ফলে ছাগল, ভেড়া, গরু, ঘোড়া, মহিষ পালনকারী পরিবারের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে।
গাইবান্ধা ফুলছড়ি উপজেলার বৃহ্মপুত্র নদে জেগে ওঠা গুপ্তমণি চরে গিয়ে দেখা যায় মর্জিনা বেগম ২০টি ছাগল নিয়ে নিজ বাড়িতে ঘাস খাওয়াচ্ছেন। দেখে মনে হয় তার বাড়িটি যেন ক্ষুদ্র ছাগলের খামার। আগামী মাসের মধ্যে আরো ৫টি ছাগল বাচ্চা দিবে। খোলা চরের প্রকৃতির ঘাসপালা খেয়ে লাফালাফি করে বড় হয়ে উঠছে ছাগলগুলো। ইতোমধ্যে ৫টি বিক্রিও করেছেন নিজেরে প্রয়োজনে। সারাদিন অন্যান্য কাজের পাশাপাশি ছাগল পালন করছেন এবং এইমহুর্তে বিক্রি করলে মূল্য হবে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। এই সম্পদ হয়েছে মাত্র দু’বছরেই। তিনি তার সাফল্যের নেপথ্যে কথা জানিয়ে বলেন, প্রতিবছর নদীভাঙন আর বন্যায় সংসারের অভাব-অনটন কেটে উঠছিলনা। কী করে অভাব অনটন থেকে মুক্ত হবেন এর পরিকল্পনা না থাকায় হত্যাশার জীবন থেকে স্বপ্নের পথ খুঁজে পান বেসরকারি সংস্থা গণউন্নয়ন কেন্দ্রে একটি প্রকল্পর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে।
ফুলছড়ি টেংরাকান্দি চরের হালিমা বেগম। তার বাড়িতে ১৮টি ভেড়া। তিনি বলেন, আমি এখন অনেকটাই চিন্তামুক্ত। আমার বাড়িতে ভেড়ার খামার। ৪টি ছাগল থেকে আমার ১৮টি ভেড়া হয়েছে। ৬টি বিক্রি করে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে জমি ক্রয় করেছি। এবছর আরো ৬টি বাচ্চা দিবে, এভাবেই আমার শতাধিক ভেড়ার খামার গড়ে তোলার ইচ্ছে আছে। আপদ বিপদ হলে ভেড়া বিক্রি তা মোকাবেলা করি। কামারজানি চরের ছলিম ব্যাপারি জানান, আমার বাড়িতে ৪টি ঘোড়া। এগুলো দিয়ে বালুর চরে পরিবহন ব্যবসা করি। ঘোড়াও লাভজনক ও বাজারে ব্যাপক চাহিদা বলে তিনি জানান।
গুপ্তমণি চরের আকলিমা বেগম, রহিতন, মালেকা খাতুনের মতো আরো প্রায় ৫০টি পরিবারের সাথে কথা হলে তারাও গরু-ছাগল পালনে সাফল্যের গল্প বলেন। প্রত্যের বাড়িতে ২ থেকে ১২টি পর্যন্ত গরু। এগুলো নিয়েই তাদের ব্যস্ততা। সারাদিন চরের লালনপালন করেই তাদের বিক্রি উপযোগী করা হচ্ছে। মালেকা খাতুন জানান, কোরবানী ঈদে ২টি গরু বিক্রি করে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা হয়। এই টাকা দিয়ে সারা বছর চলে, আর দুটি গাভি আছে দুধ দেয়, নিজেরাও খাই এবং প্রতিদিনের চাহিদা পুরণ হয়।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণউন্নয়ন কেন্দ্রের নির্বাহী প্রধান জানান, চরাঞ্চলের মানুষের অন্যতম সম্পদ ও অবলম্বন গবাদি পশু। দুর্যোগের সাথে লড়াই করে গরু,ছাগল, ভেড়া, মহিষ, ঘোড়া লালন পালন করে অর্থনৈতিকভাবে অনেকটাই স্বাবলম্বী চরের মানুষজন। প্রায় দেড় দশক আগে চরাঞ্চলে সিএলপি নামে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে কয়েক হাজার গরু প্রদান করা হয়েছিল দরিদ্র পরিবারগুলোকে। এখনও চাহিদা অনুযায়ী ছাগল, গরু দেয়া হচ্ছে। তবে, সরকারি সেবা, সুযোগ-সুবিধা ও নায্যমূল্য না পাওয়ায় তারা কাক্সিক্ষত মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন। তিনি জানান, বন্যাকালীন গবাদি পশুর খাদ্য ও বাসস্থান সংকট দেখা দেয় এবং এসময় তারা বেশ চিন্তিত থাকেন। বন্যা ও দুর্যোগকালীন গবাদিপশুর আশ্রয় ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে তিনি জানান।
ফুলছড়ি উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ডা. জহিরুল ইসলাম জানান, চরাঞ্চলের মানুষের জীবনজীবিকার উন্নয়নে গবাদিপশু যথেষ্ট অবদান রাখছে। এই জেলার পশু চাহিদা মিটিয়ে অন্য জেলায় যাচ্ছে। চরাঞ্চলে গবাদি পশুপালনকারীদের সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে, যাতে রোগ প্রতিরোধ করে গৃহস্থরা লাভবান হতে পারেন।